নীল বুনোলতা পর্ব-১১

0
238

#নীল_বুনোলতা ( ১১)
#লেখনীতে #রেহানা_পুতুল
লতা বলল,
এই নোংরা ধানের গোলাঘরের চাবি কই?

সজীব বলল,
হঠাৎ ধানের গোলাঘরের চাবি দিয়ে কি করবে?

আপনার প্রিয় দাদার কুকীর্তির অমূল্য নির্দশন দেখবেন না?

সজীব উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু লতার যুক্তিসঙ্গত আক্রমণাত্মক জিজ্ঞাসার কোন প্রতিউত্তর দিলনা।

লতা রইসকে ডাক দিল। বলল ,
আপনার কাছে ধানের গোলার চাবি নেই?

রইস দোনোমোনো করতে লাগল।
দিবেন? নাকি বিকল্প ব্যবস্থা অবলম্বন করবো আমি?

রইস মুখকে অসহায়ের মতো করে বলল,আসেন।
রইসকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো সজীব,সুজানা,চুমকি,লতা ও সবুজ।

রইস তার ঘরের ভিতরে গিয়ে লাইট জ্বালালো। সবাই বাইরে দাঁড়ালো। সজীব মাঝে মাঝে লুকানো চোখে লতাকে দেখছে।চরইস চাবি নিয়ে বের হলো। লতার বুক ধুকপুক করছে। সে নিজেও জানেনা এই ঘরের আসল রহস্য।

রইস নারভাস ভঙ্গিতে শব্দহীনভাবে গোলাঘরের দরজা খুলল। ভিতরে একটা হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক লাইট জ্বলছে। তার পিছন দিয়ে নিরবে বাকিরা ঢুকল। পুরো গোলাঘর ভরা ধান। বলা যায় ছোটখাটো ধানের আড়ত কিংবা মজুদখানা। স্তুপাকারে ধান পড়ে আছে পাহাড়ের ন্যায় খাড়া হয়ে। ধানগুলো বড় বড় চাটাই দিয়ে ঢেকে দেওয়া। হয়তো পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই সুব্যবস্থা। তার সামনে দিয়ে সরুপথ আকারে রয়েছে,পেছনের দিকে হেঁটে যাওয়ার জন্য। সবাই একে একে পিঁপড়ার সারির মতো হেঁটে যাচ্ছে। পাশাপাশি হাঁটার অবকাশ নেই। লতা ও সজীবের ভিতরে সীমাহীন উৎকন্ঠা ও উদ্বেগ।

সবাইর আগে রইসকে দেওয়া হয়েছে। তার পিছনেই লতা। গোলাঘরের শেষ মাথায় আসতেই দেখা গেল খুপরিঘরের আকারে একটা ছোট্ট রুম। নিচে তোষক দিয়ে বিছানা করা। পাশে একটা চার্জের টেবিল ফ্যান। যেটা কিনা বিদুৎ না থাকলেও চলে। তার উপরে চারজন কিশোরী মেয়ে রুগ্নভাবে শুয়ে আছে।

রইসকে দেখেই তারা দূর্বল স্বরে জিজ্ঞেস করল,
আইজ দুপুর, সন্ধ্যাকালে আমাগো খানা দেননাই ক্যান রইস ভাই? আমরা মানুষ না?আমাগো পেট নাই? ক্ষিধা নাই।

রইস কিছু বললনা। পিছন দিয়েই বাকিরা তাদের সামনে গেল। সজীবকে দেখেই তারা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। সজীব তাদের দেখে আৎঁকে উঠল। তার সারাশরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। আশ্চর্যমাখা কন্ঠে তাদের বলল,

তোমরা এখানে বন্দী কেন? কিভাবে? তোমরা না আমাদের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছো?

সুজানা কিছুই বলতে পারলনা। কেবল বোবাচোখে তাদের দিকে চেয়ে রইলো। চুমকি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থেকে থেকে শিউরে উঠছে।

মেয়ে চারজন থরথর করে কাঁপছে বৃষ্টিতে ভেজা মুরগীর ছানার মতো। সবার ফ্যাকাসে অধরযুগল তিরতির করে দুলছে গাছের কচি শাখার মতন। একজন ভেউভেউ করে কেঁদে উঠলো। লতা হাঁটু ভেঙ্গে তাদের পাশে বসে পড়ল। দেখল চারজনেরই দুইগাল বেয়ে পড়া অস্রুস্রোতের শুকিয়ে যাওয়ার জ্বলজ্বলে চিহ্ন। লতার কোমল মনটা হুহু করে উঠল। আবেগ নিয়ন্ত্রণ তার সাধ্যের বাইরে চলে গিয়েছে। তাদেরকে বুকে পেঁচিয়ে ধরলো বুনো লতার ন্যায়। কান্নামিশ্রিত স্বরে বলল,
তোমরা ভয় পেওনা। আমি তোমাদের উদ্বার করতে এসেছি। আজ থেকে তোমরা মুক্তি। উঠে আসো আমাদের সাথে। পেট পুরে খাবে এখন। পরে সব শুনব।

চুমকি ওদের দাঁড়াতে সাহায্য করল। ধরে ধরে গোলাঘরের বাইরে আনলো।

সজীব মাথা হেঁট করে রইলো লজ্জায়। ক্রোধে, অপমানে,ঘৃণায় তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মাত্র কয়দিন হলো লতা এ সংসারে বউ হয়ে এসেছে। এর মধ্যেই তার দাদার বর্বরতার সমস্ত আলামত তার কাছে ধরা পড়ে গেল। যা সে নিজেও জানতোনা এতটা বছর।
সবাই গোলাঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। রইস তালা লাগিয়ে দিল। চাবিটা সজীবের দিকে বাড়িয়ে ধরল। অপরাধী মুখে বলল,
ভাই নেন চাবি।

সজীব পাথর চোখে রইসের দিকে চাইল। যেন পারলে গিলে খায়। রইস কিছু বুঝে উঠার আগেই,তার গায়ে ধুম ধাড়াক্কা লাথি উষ্ঠা পড়তে লাগল।

ওমাগো! বলে রইস দাঁড়ানো থেকে কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সজীবের শক্ত ক্যাডসের আঘাতে রইস প্রায় অর্ধমৃত হয়ে গেল। চুমকি,লতা,সবুজ,ও সুজানা এই চারজনের হাতে চারটি মেয়ে ধরা। তাই তারা চাইলেই কোনভাবে সজীবের থেকে রইসকে রক্ষা করতে পারেনি। সজীব লম্বা লম্বা পা ফেলে পুকুর পাড় অতিক্রম করে বাড়িতে চলে এলো।

বাকিরা পিছন দিয়ে মেয়েদের নিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি পৌঁছে গেল। গিয়ে দেখে আলতাফ শিকদারের মৃতদেহ। গলায় শক্ত নাইলনের রশি পেঁচানো।
চারজন মেয়ে মৃত আলতাফের গায়ে থু থু ছিটালো। নিস্তেজ পা দিয়ে লাথি মারলো। লতা হতবাক হয়ে গেল সজীবের উম্মক্ততা দেখেই। খুঁজে দেখল সজীব ওয়াশরুমে গোসল করছে শাওয়ার ছেড়ে।

লতা চুমকিকে আদেশ দিল মেয়েদেরকে ভাত দেওয়ার জন্য। সেই চারজন মেয়ে সময় নিয়ে ভাত খেল। তারা একজন আরেকজনের হাতে চিমটি কেটে স্বপ্ন না বাস্তব নিশ্চিত হলো। আচম্বিতে কি থেকে কি ঘটে গেল ভাবতেই তারা প্রত্যেকে বিমূঢ় হয়ে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে তারা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে আজ দুটো বছর ধরে। সুজানা চুমকিকে বলল,ওদের জন্য শোয়ার ব্যবস্থা করতে কাঁথা বালিশ দিয়ে।

লতা অপেক্ষায় আছে সজীব বের হওয়ার। বেশকিছু সময় পরে সজীব বের হলো। লতা আস্তে করে বলল,

মেরে ফেললেন?

তাহলে কি তুমি মারতে? আমার মায়ের খুনীকে আমিই মেরে স্বস্তি পেয়েছি।

লতা নিচু গলায় বলল,
আমি মেরে খুনী হতামনা। যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে সে নিজেই মরে যেতো।

তার যে বয়স এখন। এই বয়সে আজ সারাদিনের শাস্তি এক যুগের সমান হয়ে গিয়েছে।

লাশ কি করবেন এখন?

লাশ রইসকে নিয়ে পুঁতে ফেলব।

যেই কথা সেই কাজ। সজীব রইসকে নিয়ে সেদিন গভীর রাতে তাদের পারিবারিক গোরস্থানে আলতাফ শিকদারের শবদেহ পুঁতে দিল।

রাতের ঘন আঁধার নেমে এলো
ধরনীর কোলে। প্রকৃতি নিঃশ্চুপ। নৈঃশব্দ্যে নেই কোন কলরব। চারদিকে সুনসান নিরবতা। থেকে থেকে বাগানের ভিতর হতে নির্জনতার আওয়াজ ভেসে আসছে। করুণ শোনাচ্ছে সেই অশরীরী ভৌতিক আওয়াজ।
সবুজ গেস্টরুমে শুয়ে পড়ল। সুজানার ভয় লাগছে। সে চুমকিকে সাথে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সেই চারজন মেয়ে এক রুমে শুয়ে পড়ল। কিন্তু কারো আঁখিকোণে নেই তন্দ্রাভাব। নিদ্রারা নিয়েছে আজ ছুটি। ভিন্ন ভিন্ন রুমে ঘুমালেও তাদের প্রত্যেকের চিন্তার ও কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু একজন মানুষ। আলতাফ শিকদার এবং তাকে ঘিরে আবর্তিত ঘটনা ও জীবন।

লতা ও সজীব পাশাপাশি শুয়ে আছে। তাদের চোখেও ঘুম নেই। সজীব লতাকে শুনিয়ে বলছে,
কি বিচিত্র এই পৃথিবী। তার চেয়েও কতই না বিচিত্র এই পৃথিবীর মানুষগুলোর জীবনধারা। তাদের রুচিবোধ, চাওয়া পাওয়া, কত অদ্ভুত! তাইনা লতা?

লতা চাপা নিঃস্বাস ছাড়ল। বলল হুম। কেন জানি আমার মন কু গাইছে। অজানা আশংকায় বুকটা ভার হয়ে আছে। রুমকির জন্য খারাপ লাগছে অনেক।

সজীব লতার চুলের ভিতর পাঁচ আঙ্গুল গলিয়ে দিল। চুলে বিলি কাটতে কাটতে মায়াভরা কন্ঠে বলল,
ঘুমানোর চেষ্টা করো একটু।

কাক ডাকা ভোরেই সবাই উঠে গেল। সব মেয়ে মানুষগুলো অজু করে নামাজ পড়ে নিল। কোরান তেলওয়াত করল। সকাল দশটার দিকে হালকা নাস্তা করে সজীব ঝটপট রেডি হলো চলে যাওয়ার জন্য।

লতাকে ডেকে বলল,
সবুজকে রেখে দাও আমাদের বাড়িতে। ও কলেজে এখান থেকেই যাওয়া আসা করুক আপাতত। বাড়িতে গিয়ে ওর সবকিছু নিয়ে আসুক। তোমার ফোন পেয়েই আমি জরুরি কাজ ফেলে চলে আসছি। সেগুলো গুছিয়ে আবার আসব। সাবধানে থেকো তোমরা সবাই। আর মেয়েগুলো আপাতত এখানেই থাক। আমি এসে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিব।

সজীব যাওয়ার সময় তার পিছু পুছু দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল সুজানা, নিজ থেকেই মায়ের আশীর্বাদ দিতে। তার চোখ দুটো জলে টলমল। সজীব নরম চোখে সুজানার দিকে চাইল। শুধু বলল,
আসি। দোয়া করবেন।

বাড়ির গেইটের কাছাকাছি যেতেই বাইরে থেকে গেইটে আওয়াজ হলো। সজীব গেইট খুলতেই হুড়মুড় করে চার পাঁচজন পুলিশ ঢুকে পড়ল।

কি সমস্যা? কি চাই? বলল সজীব।

বাড়ির ভিতর হতে লতাসহ বাকি সবাই এসে গেইটে জড়ো হলো।

আলতাফ শিকদার খুন হয়েছে নাকি গুম হয়েছে। সেই তদন্তে আসছি আমরা।

ঠিকাছে আপনারা দেখেন। আমার তাড়া আছে। আমি যাই।

ঝট করেই একজন পুলিশ সজীবের হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিল।
পাশ থেকে আরেকজন বলল,

এত দ্রুত পালাতে চাচ্ছেন? নাকি আপনিই হত্যাকারী ও গুমকারী?

লতা সুজানা হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠলো। লতা বলল,
উনাকে যেতে দিন। আপনাদের প্রশ্নের জবাব আমার কাছে। প্লিজ উনাকে ছেড়ে দিন।

উনি কে হয় আপনার?

আমার হাজব্যান্ড উনি।

ওহ আচ্ছা! এ দেখি বাংলা সিনেমার পুরোনো ডায়লগ। নাহ? স্বামীকে বাঁচাতে নিজের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নেয়া?

এই নিয়ে চল একে। সুজানা কেঁদে ফেলল। দুইহাত জোড়করে অনুনয় বিনয় শুরু করলো পুলিশের কাছে। দয়া করে আমার ছেলেকে ছেড়ে দিন। আমার ছেলে কিছুই করেনি। ওতো বাড়িতেই ছিলনা।

আরেকজন পুলিশ ঠোঁট কাত করে তীর্যক হাসি হাসলো। বলল,
এ দেখি আরেক বাংলা সিনেমার মা জননী। পুত্রকে বাঁচাতে চাচ্ছে৷

সজীব লতার দিকে পলক তুলে চাইল মায়াভরা দৃষ্টিতে। শুধু বলল,
ভালো থেকো। আমার জন্য চিন্তা করোনা। আমি ফিরে আসবো।

সবাই মাটিতে আছড়ে পড়ল। গগন বিদারী বিলাপে ভারী হয়ে উঠলো নীল বুনোলতা কুঞ্জের রক্তিম আকাশ।

চলবে — ১১
জনরা #থ্রিলার