নীল সাঁঝের উজান পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
57

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ২৫
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

” আমি এইরকম ব্যভিচারী পুরুষ মানুষ এর সাথে সংসার করবো না। দরকার পড়লে গলায় কলসি বেধেঁ পুকুরে ডুব ডিবো তবুও এমন চরিত্রহীন পুরুষের ঘর করবোনা। আমাকে ঘুমের মধ্য রেখে রাতের অন্ধকারে যে স্বামী চাচাতো বোনের ঘরে যায় শরীর নিয়ে উল্লাস করতে কোন লজ্জায় কোন সম্মানে আমি এমন বাড়িতে সংসার করবো? এইটা কোন ন্যায় সংগত বিচার হতে পারে আপনারাই বলেন। মেয়ে মানুষ বলে কি আমার কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা চাওয়া পাওয়ার দাম নাই? বিয়ের পর থেকে সেই সংসারে আমারে দাসীর মতো খাটায়। আমার গায়ের রং কালো বলে আমার স্বামীর নাকি আমার সাথে থাকতে গা ঘিন ঘিন করে। আমার সাথে তার বংশ পরিবার মেলে না। তার মা আর বোন মিলে দিনরাত আমাকে অমানুষের মতো খাটায় নেয়। তারপরেও তাদের কাছে কথা শুনতে হয় কি কালা মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসছিস খালি খায় আর ঘুমায় অথচ ভোর পাচঁটায় ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে বের হই আর তারপর ঘরে আসি রাত এগারোটা বারোটায়। আমার স্বামীর আমারে দিকে ফিরে তাকাতে মন চায়না তাই তার চাচাতো বোন এসে তাকে গল্প করার জন্য ডেকে নিয়ে যায় তার ঘরে। আমার সাথে থাকার সময় সে হাসে না অথচ রাত বিরাতে চাচাতো বোনের সাথে আমি তাকে খিলখিল করে হাসতে দেখি। আমারেতো দেখতে এসে তারাই বিয়ে করে নিয়ে গেছে। আমিতো বিয়ে করতে চাইনি। বাবারে বলছিলাম পড়ালেখা করবো। সেইটাও করতে দেয়নি এই অমানুষগুলো। অথচ আমার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিলো। বিয়ের সময় বলছিলো স্বামীর ঘরে গিয়ে যত মন চায় পড়বো কিন্তু অমানুষ আমারে রেখে চাচাতো বোনের সাথে রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকে বউ বাচঁলো না ম*রলো এই খবরটাও কোনদিন নেয় নাই। আমি এই সংসার করতে চাইনা। আমি মুক্তি চাই। কেউ যদি বলে মেনে নিয়ে সংসার করতে আমি নিজেকে শেষ করে দিবো বলে দিলাম”।

অষ্টাদশী এক মেয়ের প্রতিবাদী স্বরে সবাই কেপেঁ উঠলো। গ্রামের এক বাড়ির খোলা আঙিনায় বিচার সভা বসেছে। গ্রামের বয়স্ক মুরুব্বি সহ চেয়ারম্যান সবাই আছে। সাথে মেয়ের পরিবার এবং যাকে নিয়ে অভিযোগ করা হচ্ছে তার পরিবারও আছে। সেই সাথে আরও মানুষ জমা হয়েছে এই বিচার দেখার জন্য। মেয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কান্না করতে করতে অভিযোগ জানালো উপস্থিত সবাইকে। উজান আর সাঁঝ বাড়ি ফিরছিলো। ফেরার পথেই গ্রামের মানুষকে এক জায়গায় এইভাবে জমায়েত হতে দেখে কৌতুহলবশত তারাও সেখানে দেখতে যায় বিষয়টা কি। সেলিম একজনের কাছ থেকে বিষয়বস্তু শুনে এসে তাদের জানালো। মেয়েটার বয়স সবে আঠারো। গ্রামের স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ার সময় পাশের গ্রামের এক প্রবাসী ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়। দেখতে এসেই বিয়ে করে নিয়ে যায় ছেলের পরিবার। ছেলের পরিবার ভালো না। চোখের নজর বড় কিসিমের। মেয়েরে অনেক জ্বালায়। সারাদিন ধরে কাজ করায় তার উপর গায়ের রং চাপা দেখে কথা শোনায়। ছেলের নাকি নজর ভালো না। ঘরে বউ রেখে চাচাতো বোনের সাথে এক ঘরে থাকার সময় ধরা খাইছে বউ এর কাছে।বউটা অনেক বুদ্ধিমান। কাউরে কিছুই বলে নাই। চুপচাপ বাপের বাড়ি এসে চেয়ারম্যান এর কাছে বিচার দিছে। অনেক কথা হওয়ার পর আজ বিচার বসছে। মেয়ে সেই ঘরে ফিরতে চায়না। ছেলে নাকি মাফ চাইছে তাও সে এই স্বামীর ঘর করবে না। উজান আর সাঁঝ লম্বা শ্বাস টেনে মাথা দোলায়। তাদের কথার মাঝেই চেয়ারম্যান সাহেবের গলা পাওয়া যায়। উনি উপস্থিত সবাইকে শান্ত হতে বললেন। মেয়েকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন

” মা তুমি যে তোমার স্বামীর বিরুদ্ধে এতো বড় অভিযোগ তুলছো তোমার কাছে কোন প্রমাণ আছে? প্রমাণ ছাড়া কাউকে এতো বড় অভিযোগে অভিযুক্ত করাটাও কিন্তু আরেকটা দোষণীয় কাজ”।

অষ্টাদশী তরুণী মাথা নোয়ায় না। ভয় পায় না। দমকে উঠে পিছপা হয় না। সে যেন জানতো এমন প্রশ্ন আসবেই। সে সব প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে এবার। অনেক হয়েছে সহ্য করা। মেয়ে মানুষ বলে তার কি কোন নিজস্ব মান অভিমান নেই? যারা মনে করে মেয়ে মানুষ ভলেই তাকে সমস্ত কিছু মানিয়ে নিতে হবে তাদের জন্য জবাব সে প্রস্তুত করেই রেখেছে। হাতের ফোনটা চেয়ারম্যানকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো

” আমি মিথ্যা অভিযোগ আনি নাই। আমার কি লাভ নিজের সংসার নষ্ট করে? আমি সব বুঝেই এই অভিযোগ আনছি। এইখানে এই ভিডিও দেখলেই আপনি বুঝবেন আমি ভুল না ঠিক”।

চেয়ারম্যান ফোন হাতে নেয়। ভিডিওটা প্লে করে। সেখানে দেখা যাচ্ছে মেয়েটির স্বামী অন্য একটা মেয়ের সাথে অনৈতিক কাজে ব্যস্ত। গা গুলিয়ে উঠে চেয়ারম্যান সাহেবের। এই এলাকায় তার অনেক নাম ডাক। তিনবার হজ্ব করে এসেছেন তিনি। খুবই ন্যায় পরায়ণ মানুষ। এগুলো অনৈতিক কাজ তিনি কখনো কোন কিছুর সাথে তুলনা করে প্রশ্রয় দেননি। তার ঘরেও চারটা মেয়ে আছে। রাগে ক্ষোভে চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে তার। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েটির স্বামী আর তার পরিবারকে দেখছেন। এতোক্ষণ হৈচৈ করলেও ভিডিও রেকর্ড আছে শুনে মুখে কুলুপ এটেঁছে। তিনি গলার স্বর উচুঁ করে বললেন

” এসব কি দেখতেছি আমি? ছেলে বিয়ে করাইছেন এগুলো করার জন্য? ছেলে যদি ঘরের মধ্যই এগুলো করে তাহলে আরেক গাঁয়ে অন্য মেয়েরে দিয়ে বিয়ে করাইছেন কেন? পরের বাড়ির মেয়েকে নিয়ে গিয়ে দাসীবৃত্তি করানোর জন্য? বিয়ের সময় দেখেন নাই মেয়ের চামড়া সাদা না কালো? ছেলের চরিত্র সম্পর্কে জানতেন না? কি ব্যাপার মুখে কুলুপ এঁটেছেন কেন এখন? এই মেয়েটার এখন কি করা উচিত আপনাদের সাথে”?

ছেলের মা বললো

” বিয়ের আগে ছেলের সম্পর্কের কথা তিনি জানতেন। এক পরিবারে ছেলেকে বিয়ে দিবেন না দেখে অন্য গ্রামে বিয়ে দিছেন ছেলের বাবা। ছেলে বিয়ের পর বউ নিয়ে ভালোই ছিলো। বিদেশ গিয়ে ছয় মাস থেকেও আসছে। গ্রামে গেরস্থ মানুষ আমরা। ধান চালের সময় অনেক কাজ থাকে। আমাদের শ্বাশুড়িও আমাদের দিয়ে অনেক কাজ করাইছে। তাই বউরেও কাজ করতে হবে এটাই স্বাভাবিক। আর গায়ের রং চাপা এইজন্য আমি অসন্তুষ্ট এইটা ঠিক কথা। আমি আরও সুন্দর মেয়ে চাইছিলাম আমার ছেলের জন্য কিন্তু আমি ছেলের এই খারাপ কাজ সম্পর্কে জানতাম না। সেই চাচাতো বোনেরও বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। সামনের মাসে বিয়ের তারিখ”।

এই কথা শুনে উপস্থিত সবাই ছিঃ ছিঃ করতে লাগলো। মেয়ের মা মুখে আচঁল চাপা দিয়ে ফুপিয়ে কাদঁতে লাগলেন। এই কোন নরকে মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন। ছেলে প্রবাসী দেখে ভেবেছিলেন অবস্থা ভালো পরিবার ভালো জমি জমা আছে মেয়ে অসুখী হবে না। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন মেয়ের সুখ লিখা থাকে তার ভাগ্য সহায় হলে। তিনি ডুকরে কেদেঁ উঠলেন। বিলাপ করে বললেন

“এখন আমার মেয়েটার কি হবে চেয়ারম্যান সাহেবে? আমার মেয়ের যে কপাল পুড়লো”।

চেয়ারম্যান সাহেব নিজেও স্তব্ধ হয়ে গেছেন। নৈতিকতার কতখানি বিপর্যয় হলে মানুষ এতো নিচে নামতে পারে। ছেলের বাবা বললেন

” আমি আমার ছেলে এবং পরিবারের হয়ে বউ এর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। চাইলে তার পাও ধরতে রাজি আছি। ভুলতো মানুষই করে। মাফ করে দিয়ে সংসারে ফিরে চলো বউ। আমি কথা দিচ্ছি আমার ছেলে আর এমন কাজ করবে না। তোমার সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করবে না”।

মেয়েটির বাবা এই কথায় যেন আরও ফুঁসে উঠলো। তিনি ধৈর্য নিয়ে এতোক্ষন চুপ থাকলেও এখন মুখ খুললেন

” আমি আমার মেয়েকে ঐ বাড়িতে আর দিবোনা। আমি চাইনা আমার মেয়ে আবার সেই সংসারে অমানুষগুলোর মধ্য যাক। আমার মেয়েরে আমি পড়াতে চাইছিলাম। আমার মেয়ে পড়ালেখায় খুবই ভালো ছিলো। ওর মায়ের জেদে এই বিয়ে দিছিলাম আমি। মেয়েটার আমার ডাক্তার হওয়ার শখ ছিলো খুব। আমি ঐ নরকে মেয়ে দিবোনা আর”।

চেয়ারম্যান সাহেব নিজেও চান না মেয়েটি ফিরে যাক আবার। য়িনি মেয়েটির দিকে তাকালেন। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিনি মেয়েটিকে বললেন

” তুমি শেষ অবধি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো মা জানিয়ে দাও সবাইকে”।

মেয়েটি মাথা উচুঁ করে বললো

” আমি এই সংসার করবোনা। আমি মুক্তি চাই এই বিয়ে থেকে”।

চেয়ারম্যান সাহেব সিদ্ধান্ত দিলেন

” এই ভরা মজলিসে ছেলেটি মেয়েকে তালাক দিবে সেই সাথে তার দেনমোহর পরিশোধ করবে। বিয়ের সময় যা যা গয়নাপাতি দেওয়া হয়েছিলো এবং ছেলের পরিবারকে যা যা উপহার সামগ্রী দেওয়া হয়েছিলো সব ফেরত দিতে বলা হলো এবং এটাও বলা হলো মেয়ের পরিবার চাইলে আইনের দ্বারস্থ হতে পারে। সেই সাথে তিনি স্কুল কমিটিকে অনুরোধ করবেন মেয়েটিকে যেন আবার স্কুলে ফেরার ব্যবস্থা করা হয় এবং এই ব্যাচের সাথে পরবর্তী বোর্ড এক্সাম দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় “।

সবাই চেয়ারম্যান এর এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালো। কেউ কেউ মেয়েকে অনেক সাহসী বললো আবার কেউ কেউ বলতেছিলো মেয়েটির আরও ধৈর্য ধরা উচিত ছিলো। পুরুষ মানুষ এর এরকম স্বভাব হয়ই একটু আধটু। উজান আর সাঁঝের এসব কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে আসলেও তারা খেয়াল করলো মেয়েটির চেহারায় একটা চাপা উচ্ছাস। মুক্তির আভা যেন মেয়েটাকে নতুন জীবন দিলো। এই মেয়েটির সাহস আর তেজ তাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। সে অবশ্যই ডাক্তার হবে এমন আশা করতেই পারে তারা। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ অনেক দেরি হয়ে গেলো। বাড়ি ফিরে গোসল সেড়ে তারা দুপুরের খাবার খেতে বসলো। সবাইকে বললো তারা বিচারে কি দেখে এসেছে। হঠাৎ করেই তার মামাতো ভাই সেলিম বললো

” মেয়েটার অনেক সাহস আছে। অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে। চেহারায় কি তেজ তার। গায়ের রং সাদা হয়নিতো কি হইছে ওরকম মেয়ে এই আশে পাশের তল্লাটে নাই। মেয়ে অনেক দূর যাবে। শ্যামা হোক মেয়েটা অনেক মায়াবী”।

উজান এক পলক তাকালো সেলিমের দিকে। এই চোখের ভাষা ভিন্ন কিছু বলছে। উজান আন্দাজ করতে পারলো কিছুটা বাকিটাতো তাকে জিজ্ঞেস করলে সেলিম নিজেই বলবে।

চলবে……….

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ২৬
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

“মামা আমি আমার অংশের জমি বিক্রি করতে চাচ্ছি। চাকরি সামলে আমার পক্ষে জায়গা জমি দেখাশোনা করা বা খোঁজ নেওয়া সম্ভব না। এজন্য চাচ্ছিলাম শুধুমাত্র কিছু শতাংশ জমি হাতের পাচঁ রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দিতে। ভবিষ্যতে যদি গ্রামে ফার্ম হাউজ করতে মন চায় এজন্য ভালো কিছু জমি রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দিতে। অগ্রাধিকার সূত্রে আপনি আর ছোট মামা এই জমি কেনার আগে অধিকার রাখেন। বাহিরের মানুষের কাছে আমি বিক্রি করতে চাচ্ছিও না। তাই আপনারা দুজনে মিলে জমি নিলে আমার জন্য আরও ভালো। আমার পক্ষে এসব দৌড়াদৌড়ি করা সম্ভব না। আপনারা যেটা ভালো বুঝেন সেটাই করেন”।

উজানের কথা এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো সবাই। উজানের জমি বিক্রির কথা শুনে তারাও নড়েচড়ে উঠলো। উজানের পক্ষে আসলেই সম্ভব নয় জমি জায়গা দেখাশোনা করা। সে শহরে থাকে এইদিকে আসেও না তাই সে এসব ঝামেলা নিতেও চাচ্ছে না। উজানের ছোট মামা বললো

” জমি বিক্রি করা কোন ব্যাপার না। আমাদের কাছেই যে জমি বিক্রি করতে হবে এমন কোন কথা নেই। বাজার দর অনুযায়ী জমির ক্রেতা অনেকেই আছে। তুমি আরেকটু সময় নাও। এখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসতে হবে তার কোন মানে নেই। একান্তই যদি অপারগতা হয়ে যায় তোমার তাহলে জমি বিক্রির ব্যবস্থা যে কোন সময় করা যাবে”।

উজান তার ছোট মামার কথায় সন্তুষ্ট হলো। জমি বাইরে বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যাবে এটা সে জানে কিন্তু টাকার চেয়ে সম্পর্কের দাম আর মান তার কাছে অনেক। তার মা বেচেঁ নেই এখন। কয়েক টাকা বেশির জন্য সে বাহিরের মানুষের কাছে জমি বিক্রি করতে চায়না। নিজেদের মধ্য বিক্রি করলে এগুলো তারাই ভালো করে দেখে শুনে চাষবাষ করতে পারবে। জমি বিক্রি বা টাকা এখানে মুখ্য বিষয় না। এখানে সম্পর্ক আর তার মাঝে আন্তরিকতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উজান স্মিত হেসে বললো

” মামা পরিশ্রম আর বুদ্ধি দিয়ে কাজ করলে টাকা কোন না কোন উপায়ে আসবেই। আমার কাছে সম্পর্কের গভীরতা আর আন্তরিকতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আম্মা নাই কিন্তু মাথার উপরে আপনারা আছেন। বাহিরে বেশি দাম পেলেও আমি বাহিরে জমি বিক্রি করবো না। আপনারা দুজনেই নিতে পারেন বা কেউ একজন একা নিতে চাইলে সেটাও করতে পারেন। বিষয় পুরোপুরি আপনারাই সিদ্ধান্ত নেন। আপনারা ভেবে চিনতে যা সিদ্ধান্ত নিবেন সেটাই আমি উচিত হবে বলে মনে করবো”।

উজানের বড় মামা বললেন

” তোমার কথাবার্তা একদম তোমার বাবার মতো। দুলাভাইও এমন করেই কথা বলতেন। সম্পর্কের মধ্য কোন ঝামেলা চাইতেন না। একইতো রক্ত শরীরে বইছে। বাবার মতো ছেলে হবেই। আপা দুলাভাইকে উপরওয়ালা জান্নাত নসিব করুন। তারা এতোটুকুই আয়ু নিয়ে এসেছিলেন দুনিয়াতে। কখনো মন খারাপ করবে না বাবা। সবাইকেই দুনিয়া ছাড়তে হবে। যতদিন মাটির উপরে আছি আমরা আছি তোমার পাশে । তুমি কতদিনের ছুটি নিয়ে এসেছো উজান? তুমিতো আসতেই পারোনা। নতুন বউকে নিয়ে আসছো ।আমরা সময় পাবোতো নাকি তাকে আপ্যায়ন করার”?

উজান হেসে বলে

” এখন অফিসে অনেক কাজের চাপ মামা। এই সময় সাধারণত ছুটি নেওয়া উচিত না কিন্তু আমার বকেয়া ছুটি ছিলো অনেক। সেখান থেকে ছুটি বের করে নিয়ে এসেছি। সমস্যা নেই আমরা আরও দুদিন আছি। আপনারা আপনাদের বউমাকে আপ্যায়ন করেন। যেভাবে আপনাদের ভালো লাগে”।

উজানের ছোট মামা বললেন

” মাত্র দুদিন? আমরাতো ভেবেছিলাম সপ্তাহ খানেক ছুটি নিয়ে আসছো। দুদিনে নতুন মানুষের কতটুকু আপ্যায়ন হয়? নতুন বউকে দেখতে দেখতেইতো দুদিন পার হয়ে যাবে। আর কয়েকটা দিন ছুটি বাড়িয়ে নিতে”।

উজান বলে,

” আবার পরে কখনো আসবো মামা। আপনারাতো আছেন। আসা যাওয়া হবেই। এবার ছুটি এমনই নিয়েছি। আপনারাওতো আমাদের বাড়ি আসেন না। আপনারাও ঢাকায় আসবেন সবাইকে নিয়ে। গ্রামের মতো এতো খোলামেলাতো সেখানে না তবুও সবাইকে নিয়ে আসবেন”।

উজানের বড় মামী বললো

“রাতে তোমরা কি খাবে? পিঠা বানাতে চাচ্ছি। দুধু পুলি, নারিকেল পুলি, পাটি সাপটা, পাকোন পিঠা আরও ঝালের কিছু পিঠা। উজানের মা পিঠা খেতে পছন্দ করতো। নারিকেল দিয়ে ঘন করে পায়েশ অনেক আয়েশ করে খেতো সে। সাঁঝ তুমি মিষ্টি পছন্দ করো নাকি ঝাল খেতে পছন্দ করো বেশি”?

সাঁঝ লজ্জা মুখে মাথা তুলে তাকায় উজানের বড় মামীর দিকে। সে মিষ্টি খুব একটা খেতে পারে না। ঝাল খাবার তার পছন্দ। তাই সে নরম গলায় বললো

” ঝাল জাতীয় খাবার ভালো লাগে তার। মিষ্টি খেলে মুখ একটু জড়িয়ে আসে তার। এজন্য মিষ্টি একটু কম খায় সে”।

উজান এই কথা শুনে ভ্রু কুচঁকে তার দিকে তাকায়। তার বউয়ের মিষ্টি কম পছন্দ এইটা সে এই কয়েকদিনে বুঝেছে। উজানের মাথায় আসে না যে মেয়ে স্বামী বলতে পাগল সারাক্ষণ তার কাছ থেকে ছুতো ধরে আদর নিয়ে ফেরে তার মিষ্টি কেমনে কম পছন্দ হয়। ঝাল পছন্দ করে এটা তাকে দেখলেই বুঝা যায়। যে জেদ আর রাগ অভিমান করে থাকে। উজান সাঁঝকে চোখ টিপ দেয় এর অর্থ তুমি ঘরে চলো তোমার আজ হচ্ছে। সাঁঝ তা দেখেই দ্রুত চোখের পলক নামিয়ে নেয়। দুপুরে খাবার পর এখন একটু বিশ্রামের সময় সবার। যদিও গ্রামে মানুষ বিশ্রাম কম নেয়। তারা সারাদিন কিছু না কিছু করতেই থাকে। উজান আর সাঁঝ নিজেদের বরাদ্দকৃত ঘরে চলে আসলো বিশ্রাম এর জন্য। আজকে তারা অনেক হেঁটেছে। একদিনে এতো হাটাঁর অভ্যাস অনেকদিন যাবত নেই তাদের। শখ করে করে হেটেঁছে অনেকক্ষন কিন্তু এখন পা ব্যাথা করছে। সাঁঝকে পা ধরে বসে থাকতে দেখে উজান বউয়ের পা দুটো নিজের কোলের উপর নেয়। সাঁঝ চমকে উঠে। সাথে সাথেই পা সরিয়ে নিতে চাইলেই উজান আরও টেনে নেয় পা দুটো। সাঁঝ হকচকিয়ে উঠে বলে

” কি করছো? পা ধরে রেখেছো কেনো? ছেড়ে দাও। কেউ দেখলে কি বলবে? স্বামী দিন দুপুরে বউ এর পা ধরে বসে আছে। এমনিতেই গ্রামের মানুষ দুপুরেও ঘুমায় না। কিছু না কিছু খুটখাট করতেই থাকে। কেউ কোনদিক থেকে দেখে ফেললে হাসি তামাশা শুরু করে দিবে। ছেড়ে দাও প্লিজ “।

উজান ছাড়ে না বরং টেনে ধরে বসে থাকে। সাঁঝের এতো হাটাঁর অভ্যাস নেই। তার মধ্য কিছুদিন আগেই একটা বড় ধকল গেছে সেটার রেশ এখনো আছে। সাঁঝের শরীরটা এখনো দূর্বল হয়ে যায় মাঝে মাঝে। উজান সাঁঝের পা হালকা হাতে একটু একটু করতে শুরু করে। সাঁঝ আরও এক দফা চমকে উঠে। মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছে এমন কিছু। অস্বাভাবিক কিছু দেখছে চোখের সামনে। উজান সাঁঝের দিকে চেয়ে বলে

” তোমার এতো হাটাহাটির অভ্যাস নেই। আসলে আমাদের শহুরে জীবনটা এতো যান্ত্রিক যে আমরা এতো ছোটাছুটি করি কিন্তু এভাবে হাটাঁর সুযোগ হয়ে উঠে না। পা ব্যাথা করছে এজন্য। সরিষার তেল গরম করে মালিশ করে দিতে পারলে আরাম লাগতো আরও। তুমি থাকো আমি বাহিরে গিয়ে দেখি তেল গরম করে নিয়ে আসতে পারি কিনা”।

সাঁঝ ধড়ফড়িয়ে উঠে। এখনই সবাই খেয়ে দেয়ে উঠলো। এই সামান্য পা ব্যাথার জন্য আবার তাদের কষ্ট দেওয়া কেন। আর সবাই কি ভাববে একটু হেটেঁছে কি না হেটেঁছে পা ব্যথায় কাহিল হয়ে গেছে। সাঁঝ তাড়াতাড়ি করে উজানের হাত ধরে টেনে তাকে আবার বসায়। সাঁঝ বলে

” না না তুমি অযথা বেশি চিন্তা করছো। এতোটাও বেশি ব্যাথা না। একটু বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তার চেয়ে আমার কাছে এসে বসো। তখন দেখলাম হাত দিয়ে মাথা ধরে রেখেছো। জার্নি করলে তোমার মাইগ্রেনের ব্যাথা বেড়ে যায়। আসো আমি তোমার মাথাটা টিপে দেই”।

সাঁঝ উজানের কাছে এসে উজানের মাথাটাটিপে দিতে শুরু করে। আরামে উজানের চোখ বুজে আসে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে তার চোখ ভারি হয়ে আসছে। উজান সাঁঝের কোলে মাথা রাখে। উজান কি ভেবে সাঁঝের উদরে মুখ গুজে দেয়। অতর্কিত বার্তা ছাড়াই আদর করতে থাকে। সাঁঝ শিউরে উঠে। উজান বলে

“তুমি তখন কি যেন বললে তোমার মিষ্টি পছন্দ না? মিষ্টি খেলে মুখ জড়িয়ে আসে”?

সাঁঝ চুপ করে আছে। উজান এর স্পর্শ আরও গাঢ় হতে শুরু করে। সাঁঝকে চুপ করে থাকতে দেখে উজান স্ত্রীর উদরে হামি দিয়ে বললো

” সাঁঝ আমাদের জীবনে কি একটা মিরাকল ঘটতে পারেনা? তোমার এই নরম উদরে আমাদের দুজনের অংশ কি উপরওয়ালা চাইলে দিবেন না?

সাঁঝের ভেতরটা হু হু করে উঠে। বিশেষ করে তখন সেই বুড়িমার কথা শোনার পর থেকেই উজানের মন আরও বেশি নরম হয়ে গেছে। সেতো নিজেও চায় তাদের দুজনের অংশ যেন তাদের কোল জুড়ে আসে। পিতামাতা হওয়ার শখ আহ্লাদ কার না হয়। তারা চাইবে খুব করে উপরওয়ালার কাছে চাইবে খুব করে আকুতি মিনতি করে চাইবে যেন তাদের একটা সুযোগ দেন সন্তানের বাবা-মা হওয়ার।

চলবে…………..

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ২৭
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

প্রায় এগারো বছর পর ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে প্রাক্তন প্রেমিকার ডাকে পুরো গা কেপেঁ উঠলো উজানের। কি হচ্ছে কি তার সাথে এটা সে ঠাওর করতে পারে না। এই বছরটা তাকে চমকের উপর চমক দিয়ে যাচ্ছে। জীবনে এতোগুলো ফেলে আসা অধ্যায় আবার সামনে চলে আসছে একের পর এক। এতোগুলো বছর পর তাসনিম তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একদম তার মুখোমুখি। একটা সময় তাদের মধ্য সম্পর্ক ছিলো। সেই সম্পর্কের একটা উদ্দেশ্য ছিলো। একটা প্রত্যাশা ছিলো দুজন মানুষের মধ্যে। সারাজীবন একসাথে থাকার ইচ্ছে স্বপ্ন আর আবেগ ছিলো। একটা সময় কথা হতো সারারাত ঘুম জেগে। দুজনের একসাথে ভোরের সূর্যোদয় দেখার ইচ্ছা ছিলো। সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে একসাথে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যাস্ত দেখার আহ্লাদ ছিলো। একে অপরের কাধেঁ মাথা রেখে কত শত কবিতার বই পড়ে শেষ করার কথা ছিলো তাদের। দুজনের একটা বাড়ি হবে সেই বাড়ির বারান্দায় একটা শিউলি ফুলের গাছ লাগানোর কথা ছিলো। সাদা সাদা ফুল ঝরে বারান্দা তুষারের আস্তরণের মধ্য দেখতে লাগবে। সেই কথাগুলো সব কবেই শেষ হয়ে গেছে। কত প্রতিশ্রুতি কবেই মিলিয়ে গেছে ঝড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বালির বাধঁ এর মতো। আজ সেসব শুধুই দ্বীর্ঘশ্বাস। এক জনমের দূরত্ব তাদের মধ্য। দুজন দুজনের জন্য নিষিদ্ধ মানুষ। শেষটাতো উজান নিজেই করেছে। নিজেই নিজের ভালোবাসাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। এতে উজানের লাভ ক্ষতি কতটুকু হয়েছে তা হিসাব না করলেও হবে কিন্তু তাসনিমের কোন ক্ষতি হয়নি। সে ভালো আছে সুখে আছে। সে একজন সুখী বিবাহিত নারী যার স্বামী সন্তান নিয়ে ভরা ঘর সংসার। ইশার সাথে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার আগে একবার দেখেছিলো সে তাসনিমকে।সেটাও বছর ছয় আগে। সেদিন তাসনিম তাকে দেখেনি। আজ এতোগুলো বছর পর আবার দেখছে তাকে। তার প্রাক্তন প্রেমিকা প্রথম ভালোবাসা। তার জীবনে আসা প্রথম নারী যাকে সে অবলীলায় ঠকিয়েছে। ঠকিয়ে পেয়েছে এক টালমাটাল জীবন। উজানের সামনে থাকা নারীটি তাকে আবার ডাকলো। ঘোর ছুটে যায় উজানের। তাসনিম ডাকছে

” উজান তুমি এখানে? কত বছর পর তোমাকে দেখলাম আবার”?

উজান যেন পাথরের ন্যায় জমে গেছে। সে কি বলবে এই মুহুর্তে কি বলা উচিত হবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে তো তাসনীমের কাছে একজন দাগী অপরাধী। উজান অনেক কষ্টে স্মিত হাসার চেষ্টা করে। সে বললো

” ঠিক এগারো বছর পর তুমি আমাকে আবার দেখছো। অনেকগুলো দিন তাই না? শুধু দিন কেন অনেকগুলো মাস বছর পরে। কেমন আছো তাসনিম”?

তাসনিম মুখে হাসির রেখা টেনে বললো

” আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। এইতো বর আর বাচ্চাদের সাথে ওদের দাদাবাড়ি এসেছিলাম গরমের ছুটিতে। এখন আবার ঢাকায় ফিরছি। বাচ্চারা তাদের বাবার সাথেই আছে ভেতরে। তুমি এখানে কোন কাজে এসেছিলে”?

উজান এর বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধড়ফড় করছে। তাসনিম এতো সহজ করে কথা বলছে অথচ সে পারছে না। কেন? তাসনিমকে ঠকিয়েছে বলে? কষ্ট দিয়েছে বলে? উজান যথাসম্ভব সংযত হয়ে বললো

” নওগাঁতে মামার বাড়ি এসেছিলাম প্রয়োজনীয় কাছে। এখন আবার ঢাকাতে ফিরে যাচ্ছি “।

তাসনিম বললো

” একা এসেছো নাকি পরিবার সহ? তোমার মা, বউ আর বাচ্চারা সহ এসেছো?

উজান বিড়বিড় করে বললো

মা! বাচ্চা!

উজানকে চুপ করে থাকতে দেখে তাসনিম আবার বললো

“তারা কেমন আছে? কোথায় আছে ভেতরে”?

উজান স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাসনিমকে বললো

” মা দুনিয়ায় নেই দুইবছর হচ্ছে। আর বাচ্চা নেই। হওয়ার সম্ভাবনাও নেই হয়তো। আমি নিঃসন্তান তাসনিম। তোমাকে নিষ্ঠুরভাবে ছেড়ে চলে যাওয়ার শাস্তি হিসেবে এটা পেয়েছি”।

তাসনিম অবাক স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছে উজানের দিকে। এক বুক হাহাকার নিয়ে কত অবলীলায় কথাগুলো বলে গেলো উজান। তাসনিম ক্ষীন গলায় বললো

” নিঃসন্তান কেন? বিয়েতো করেছো বউ এর বাচ্চা হয়নি? কার সমস্যা কি সমস্যা”?

উজান হেসে বললো

” শুধু বিয়ে করলেই বাচ্চা হয়? সমস্যাটা আমার। ডাক্তারের স্পষ্ট জবাব ছিলো বাবা হওয়ার সক্ষমতা নেই আমার”।

তাসনিম একটা ধাক্কা খেলো মনে হয়। উজানের বাচ্চা কত পছন্দ ছিলো। সে সবসময় বলতো আমার তিন চারটা বাচ্চা হবে। ঘর জুড়ে তাদের ছোটাছুটি থাকবে। তাদের কথা ঝগড়ার আওয়াজে সারা ঘর গম গম করবে। সেতো উজানকে কখনো অভিশাপ দেয়নি আর না তা কখনো খারাপ চেয়েছে। হ্যাঁ সে খুব কষ্ট পেয়েছিলো উজানের ব্যবহারে। উজানের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সে খুব ভেঙে পড়েছিলো। কিন্তু সেটা স্থায়িত্ব হয়নি। সে জীবনে এগিয়ে গেছে। সে তার স্বামীর সাথে ভালো আছে। তিনটা ফুটফুটে পুতুলের মতো বাচ্চার মা সে। অথচ উজান সেতো ভালো থাকার জন্য মায়ের কথায় বিয়ে করেছিলো। তাসনিমের কৌতুহল হয়। সে বলে

” মায়ের পছন্দে যাকে বিয়ে করেছো সে খুব ভালো তাইনা”?

উজান তাসনিমের মুখের দিকে তাকায়। যেন সে একটা বিদ্রুপ শুনলো। জীবনের সবচেয়ে বড় বিদ্রুপ তার জন্য এটা। উজান বললো

” সেই বিয়ে টিকেনি। তালাক হয়ে গেছে কিছু পরিস্থিতির কারণে “।

তাসনিম আরও বেশি অবাক হয়। একজন মানুষের সাথে এক জীবনে এতো কিছু কেন ঘটেছে? এতো কষ্ট কেন সে পেয়েছে। কি বলবে বুঝতে পারে না সে। তবুও মুখে হাসি মিয়ে বললো

” এখন কি একা আছো? আর বিয়ে থা কিছু করোনি”?

উজান নত স্বরে বলে

” করেছি কিছুদিন আগে। জীবন কেন জানি আবারও সুযোগ দিলো। প্রথম বিয়ের বিচ্ছেদের পর ছয়বছর সময় লেগেছে এই সুযোগ পেতে। একজন মানুষ এসেছে জীবনে আমার”।

তাসনিম খুশি হয়। সে বলে

” সে খুব ভালো তাইনা? তুমি ভালো আছো তার সাথে?

উজান বললো

” হ্যা ভালো আছি। ভীষণ ভালো আছি। সে খুবই ভালো মেয়ে। মিষ্টি মেয়ে।সব জেনেই এসেছে। আমিও চেষ্টা করছি ভালো থাকার”।

তাসনিম লম্বা একটা শ্বাস টানে। তারপর নরম গলায় বলে

” সেদিন তোমার ছেড়ে চলে যাওয়ার পর খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। রাগ অভিমান হয়েছিলো খুব। তোমার উপর নিজের উপর। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমাকে কখনো অভিশাপ দেয়নি। কখনো খারাপ চাইনি। আমাদের একসাথে পথ চলা ঐটুকুই ছিলো এই বাস্তবতা আমি মেনে নিয়েছিলাম। তারপর নিজের জীবনে এগিয়ে গিয়েছি”।

উজান বলে

” বাদ দাও এসব। ভাগ্যে যা ছিলো তাই হয়েছে। তাসনিম আমাকে কি তুমি ক্ষমা করতে পারো?

তাসনিম অবাক হয়ে যায় তারপর বলে

” কি বলছো তুমি উজান? আমার তোমার উপর কোন অভিযোগ নেই । আমি কিছুই মনে রাখিনি। ক্ষমাতো কবেই করে দিয়েছি। এসব পুষে রেখে কি করবো বলো?

উজান স্মিত হাসে তারপর বলে

” তবুও তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে যে অমানবিকভাবে কষ্ট দিয়েছি তার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি”।

তাসনিম কিছু বলতেই যাবে এরমধ্য মামনি বলে ডেকে উঠে এক বাচ্চা। একটা বাচ্চা ছেলে। সাত বা আট এরকম বয়স হবে। তাসনিম বলে

“আমার ছেলে। আমার তিনটা বাচ্চা। দুইটা জমজ ছেলে-মেয়ে তারপর আরেকটা ছেলে বাচ্চা হয়েছে। ছোটটার বয়স পাচঁ বছর”।

বাচ্চা ছেলেটা উজানকে সালাম দেয়। ওর মা কে বলে অনেকক্ষন ধরে মাকে দেখছিলোনা তাই বের হয়ে এসেছে। ছেলে তার এমনই মা ন্যাওটা। তাসনিম বললো

” আমি তোমার এই আংকেল এর সাথে কথা বলছিলাম। আমরা এক সাথে ভার্সিটিতে পড়ালেখা করতাম “।

বাচ্চা ছেলেটা উজানের সাথে হ্যান্ডশেক করে। তারপর তার মাকে বলে ছোট ভাই কাদঁছে। ক্ষুধা লাগছে মনে হয়। তাসনিম এর বিদায় নেওয়ার সময় হয়ে গেছে। উজানকেও কেবিনে যেতে হবে। অনেকক্ষন হচ্ছে সেও বাহিরে বের হিয়েছে। সাঁঝ একা ভেতরে। তাসনিম হেসে নরম গলায় বলে

” আসছি ভালো থেকো। তোমরা সুখী হও। উপরওয়ালা তোমাদের কোল আলো করুন “।

উজান অনুগ্রহের নজরে তাসনিমের দিকে তাকায়। সেও মাথা দুলিয়ে বলে

” তুমিও ভালো থেকো”।

উজান তাদের কেবিনে ফেরে। কিছু শুকনো খাবার নিয়ে। মনটা তার বির্মষ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। সাঁঝকে এসব বুঝতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না। এমনিতেই স্পর্শকাতর সে। কি ভাবতে কি ভেবে বসবে। এতোগুলো বছর পর তাসনিমকে দেখে আবারও সব কিছু এলোমেলো লাগছে তার। সাঁঝ তাকে দেখে বললো

” বেশ দেরি করলে যে?

উজান ইতস্তত করে বললো

” হঠাৎ করে ভার্সিটি লাইফের পরিচিত একজন ব্যাচমেট এর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিলো। তারাও ঢাকা ফিরছে। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেলো”।

সাঁঝ উজানকে লক্ষ্য করলো কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেতো ঠিকই ছিলো। বাহির থেকে আসার পরেই কেমন লাগছে তাকে। মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে মনে হচ্ছে। সাঁজ উজানের চোখের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেনের এই পুরো কেবিন তারা রিজার্ভ নিয়েছে। তারা ছাড়া আর কোন যাত্রী আসবে না। সাঁজ বললো

” তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? কেমন ছাড়া ছাড়া অন্য মনস্ক দেখাচ্ছে তোমাকে”?

উজান কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তাসনিমের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে তার কিছুই ভালো লাগছে না। বুকের ভেতর কেমন একটা চাপা যন্ত্রনা হচ্ছে। কেমন চিনচিন করে ব্যাথা হচ্ছে। এইটা যে অমূলক সেটা মনকে কি করে বুঝাবে সে। তাসনিম তার জীবন থেকে চলে গেছে। যোজন যোজন দূরে। সে ভালো আছে। উজান নিজের স্ত্রীর দিকে তাকায়। মনোযোগ দিয়ে সাঁঝকে দেখে। কি সুন্দর মায়া ভরা চেহারা। এই মেয়ের কাছে সে শান্তি পায়। মন মেজাজ স্থির শান্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। সেখানে অতীতের কথা ভেবে কেন বুকের মধ্য কষ্ট নিয়ে বেড়াতে হবে। উজান হঠাৎ করে বলে উঠে

“সাঁঝ আমাকে তোমার বুকের মধ্য জড়িয়ে নিয়ে থাকবা? আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমার কেমন অশান্তি লাগছে সবকিছু।

সাঁঝ কিছু বললো না। বাধ্য স্ত্রীর মতো দুহাত বাড়িয়ে স্বামীকে বুকের মধ্য জড়িয়ে নিলো। মনের মধ্য তার খচখচ করছে খুব। উজানের এই মন খারাপ হওয়া সে মেনে নিতে পারছে না। সে এই মানুষটাকে এতো ভালোবেসে ফেলেছে। উজানকে বেশি ভালোবেসে বলেই কি তার সারাক্ষণ এরকম ভয় হয়? কিসের ভয়? মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সাঁঝ উজানের চুলের ভাজেঁ চুমু খায়। উজান তার শুধু তার।

চলবে……………