#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ২৮
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
” প্রাক্তন প্রেমিকার জন্য অনেক খারাপ লাগছে নাকি উজান? এতোবছর পর তার সাথে সেদিন কথা হলো। পুরনো দিনের কথা মনে পড়েই কি এমন মন খারাপ থাকে তোমার”?
এই মাঝ রাতে সাঁঝের মুখে এই কথাগুলো শুনে পায়ের তলার মাটি দুলে উঠলো উজানের। সেতো তাসনিম সম্পর্কে কোন কিছু জানায়নি সাঁঝকে। তাহলে সে কি করে জানলো? সেদিন তাদের দুজনের কথা আড়াল থেকে শুনে ফেলেছে? যদি শুনেও থাকে তারপরেও এতো নিরুত্তাপ ভাব কেন ছিলো তার? কিছুইতো প্রশ্ন করেনি। ব্যাখাও জানতে চায়নি। ঢাকায় ফিরে এসেছে আজকে পাচঁদিন হলো। উজানের মন মেজাজ আসলেই ভালো নেই। সবকিছু বিস্বাদ ঠেকে তার। জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসাব করতে বসেছিলো সে। পাওয়ার হিসেবের খাতায় কিছুই নেই। সবকিছু ধূসর লাগে তার কাছে। বুকের মধ্য ইদানীং খুব চাপা যন্ত্রনাটা বেড়ে গেছে। কেমন যেন একটা দম বন্ধকর অবস্থা হয়ে যায়। কাজে মন বসছে না। অফিসে গিয়েও অন্যমনস্ক থাকছে। এক কাজ দু তিনবার করে করতে হচ্ছে। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। খেতেও অনীহা জমেছে। সাঁঝ এর সাথেও ভালো করে কথা বলা হচ্ছে না। এই কয়েকদিনে তার সাথে মেলামেশাও হয়নি। সব কিছু মিলিয়ে কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে সে নিজে। সাঁঝের ডাকে আবারও হুশ ফেরে তার। অনুশোচনা নিয়ে সাঁঝ এর দিকে তাকায়। সাঁঝ আবার বলে
” কি হয়েছে উজান? তোমার এরককম বিধ্বস্ত লাগছে কেন? পুরনো প্রেমিকাকে দেখে পুরনো প্রেম জেগে উঠছে নাকি”?
উজান স্থির হয়ে বলে
” তুমি আড়াল থেকে আমাদের কথা শুনেছিলে? আড়াল থেকে কথা শোনা একদম পছন্দ না আমার। কথা যখন শুনছিলে কাছে এসেই শুনতে”?
সাঁঝ কিছুটা চমকে উঠে। উজানের আসতে দেরি হচ্ছিলো বলে সে কেবিনের বাহিরে গিয়ে তাদের একসাথে কথা বলতে শোনে। তার উদ্দেশ্য আড়াল থেকে কথা শোনা ছিলো না কিন্তু উজানকে এক নারীর সঙ্গে এতোক্ষণ কথা বলতে দেখে কৌতুহল আটকাতে পারেনি সে। তাই তাদের কি কথা হচ্ছিলো সব শুনে ফেলে সাঁঝ। উজানের প্রাক্তন প্রেমিকার জন্য সাঁঝের মনে কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া নেই। তার অভিযোগ বা হাহাকার অন্য জায়গায়। সেটা হচ্ছে সাঁঝ উজানের জীবনে আসার আগে তার স্বামীর জীবনে দুজন নারীর উপস্থিতি ছিলো। প্রথম নারীকে উজান ভালোবেসেছিলো। তার সাথেই জীবনের জন্য সব ভেবে রেখেছিলো। উজানের মায়ের জন্য উজান সেটা থেকে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। মায়ের পছন্দে বিয়ে হলেও সেখানেও মন কষাকষি চলেছে। উজানের বাবা না হওয়ার সমস্যা সাথে স্ত্রীর অন্য কারো প্রতি ঝুঁকে যাওয়া যার ফলস্বরুপ সেই বিয়েও স্থায়িত্ব হয়নি। একে একে জীবনের হিসাবে এতো গড়মিল নিয়ে মানুষটা আগে থেকেই বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিলো। উজানের জীবনে সে তৃতীয় স্থানে এসে পৌছেঁছে কিন্তু তার জীবনে উজান প্রথম পুরুষ। এইটা অবাক করার মতো হলেও সত্য যে দুজনের বয়সের তফাত বেশি তার উপর উজান তালাকপ্রাপ্ত একজন পুরুষ মানুষ তার উপর সাঁঝ আর্কষিত হয়েছিলো। উজান মানুষটাই এমন। তার ব্যক্তিত্ব এমনই ছোয়াঁচে ধরনের। সাঁঝ উজানের চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট করে বলে
” আড়াল থেকে কথা শোনার ইচ্ছা আমার ছিলো না। আমি তোমাকে খুঁজতেই বের হয়েছিলাম। তোমরা কথা বলছিলে তাই আর সামনে যাইনি বিব্রত হতে পারো দেখে। তুমিওতো আমাকে সেদিন পুরো সত্য বলোনি”?
উজান তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বলে
” কি বলতাম আমি? নিজের প্রেমকাহিনী শোনাতাম তাও আবার এক যুগ পুরনো যেটার কোন ভিত্তি নাই এখন “।
সাঁঝ উজানের কাছে এসে বলে
” তাহলে যেসব কথা বা আলোচনার ভিত্তি নেই তার জন্য বর্তমান সময়কে কেন নয় ছয় করছো? কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছো? তুমি কি এখনো তাসনিমকে ভালোবাসো উজান”?
উজান এতোক্ষন ল্যাপটপে বসে কাজ করছিলো। সাঁঝের কথায় সেটা বন্ধ করে তার কথা শুনছে। নিজের স্ত্রীর মুখে এরকম অহেতুক কথাবার্তা শুনতে ভালোলাগছে না তার। এমনিতেই এই বিষয়টা তাকে শান্তি দিচ্ছে না আবার সাঁঝকে জবাবদিহি করতে মন চাইছে না। সাঁঝ ফের বলে
” কি ব্যাপার এমন চুপ করে আছো কেন”?
উজান বলে
“কি বলা উচিত আমার এখন তোমার মনে হয়? আমি কি উত্তর দিলে তোমার মনঃপুত উত্তর হবে?
সাঁঝ এরকম হেয়ালি কথায় রেগে যায়। সে শুনতে চাচ্ছে তার স্বামী তাকে কাছে টেনে নিক। কাছে টেনে নিয়ে আদরে আহ্লাদে তাকে স্পর্শ করে বলুক অতীতে যা হয়েছে তা নিয়ে আর কোন কথা নয়। তুমি আমার বর্তমান। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে নিয়েই বাচঁতে চাই। সাঁঝ বলে
” আমাকে কেন বিয়ে করেছো? আমাকে শুধুই নিজের শরীরের খোরাক মেটাতে বিয়ে করেছ? আমাকেতো তুমি ভালোইবাসোনা। বিয়ে কি শুধু নিজের চাহিদা পূরন করতে করেছো? কিন্তু আমিতো তোমাকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসা শখ আদর আহ্লাদ এবং চাহিদা সবইতো তুমি। আমাকে পোড়াচ্ছো কেন”?
উজান সাঁঝের হাত ধরে বলে
” এসব কি বলছো তুমি? তুমি বুঝে বললে ঠিক কি বললে এখন?আমিতো বলেছি তোমাকে ভালোবাসার জন্য আমার সময়ের প্রয়োজন। আমি যে তোমার মায়ায় জড়িয়ে গেছি তার মধ্য তুমি কিছু উপলব্ধি করতে পারোনা? আমার আদর যত্ন অন্তরঙ্গতায় তুমি কোন ত্রুটি পেয়েছো?আমিতো চেষ্টা করছি তোমাকে ভালো রাখার। কি সমস্যা হচ্ছে বলোতো”?
সাঁঝ এর ধৈর্যের বাধঁ যেন ভেঙে যায় এরকম হেয়ালী কথাবার্তায়।মুহুর্তের মধ্য সে একটা অবুঝের মতো কাজ করে বসে। উজানের শার্টের কলার ধরে টেনে একদম নিজের কাছে নিয়ে আসে। দুজনের মধ্য কোন দুরত্ব নেই। সাঁঝের ঘন নিশ্বাস এর শব্দ উজান পাচ্ছে। সাঁঝ এতো জোরে কলার ধরেছে যে শার্টের দুইটা বোতাম খুলে গেলো। আঙুলে ব্যাথাও পেলো। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই তার। সাঁঝ ক্ষিপ্ত হয়ে উজানের ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে দিলো। এখানেই সে ক্ষান্ত হয়নি বুকে আচঁড়ও দিলো। নখের দাগ বসে গেছে একদম। উজান বিন্দুমাত্র আওয়াজ করেনি। ব্যাথায় চোখে পানি এসে গেছে তার। দাতেঁ দাতঁ চেপে সহ্য করলো সাঁঝের এই নিদারুন পাগলামো। সাঁঝ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। নিজেকে শান্ত করতে হিস হিসিয়ে বললো
” পুরাতন প্রেমিকার জন্য মন একদম বেতাল হয়ে আছে। দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন উনি। চোখের সামনে জ্বলজ্যান্ত সুন্দরী বউ থাকতে উনি বৈরাগী রুপ ধারন করেছেন। সন্যাস জীবন নিয়ে হিমালয়ে যাবে এমন ভাব। আমিও দেখবো কবে এই বউ এর দরকার হয়”?
এতোগুলো কথা বলে রাগে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সাঁঝ। শ্বাশুড়ির ঘরে গিয়ে চুপ করে শুয়ে পরলো। অতিরিক্ত রাগে কান্না আসছে তার। এক না দুই না তিন নাম্বার সে তার স্বামীর জীবনে। তার আগে আরও দুজন নারী তাকে ভালোবেসেছে। প্রেমিকা ছিলো কিন্তু সে কি ছুয়েঁছে তার স্বামীকে? প্রেম করলেতো মানুষ কম বেশি ছোয়াঁছুয়ি করে। এক যুগ আগে উজান কি তাকে ? আর সেই মেয়েটাও? আগের বউ নাকি উজানকে অনেক আদর করতো সুন্দরীও ছিলো। সে এতো দেরিতে কেন আসলো উজানের জীবনে। এগুলো ভাবতে ভাবতে ডুকরে কেঁদে উঠে সে। সে ভুলেই গেলো একটু আগে রাগের মাথায় কি করে এসেছে সে। কাদঁতে কাদঁতে ঠায় পরে রইলো বিছানায়। এইদিকে উজান এর এসব কিছু বুঝে উঠতে সময় লাগলো। ঘাড় আর বুকের ক্ষতে জ্বলছে তার। মাথাও ধরেছে ভীষণ। শরীরটাও ভালো লাগছে না। বুঝতে পারছে বয়স হচ্ছে। এখন শরীরে নানা রকম উঠানামা ঠেসে ধরবে। ড্রয়ার থেকে ওষুধ বের করে পানি খেতে নিয়ে দেখে গ্লাসে পানি নেই। সাঁঝ রাখেনি তারও খেয়াল নেই। বিয়ে হওয়ার পর থেকে এই কাজ সেই করে আসছে। শরীরটাকে টেনে নিয়ে আর পানি নিয়ে আসতে মন চাইলো না। ওষুধ না খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। চোখ বন্ধ করে রইলো। সাঁঝ কান্না করা থামিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ করে তার মনে হয়েছে সে উজানের সাথে ভালো ব্যবহার করেনি। এরকম করাটা তার ঠিক হয়নি। উজানের এমনিতেই মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তারউপর সে এরকম কষ্ট দিয়েছে। স্বামীকে দেখার জন্য মন ছটফট করে উঠে তার। বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ঘরের দিকে। ঘরে গিয়ে দেখে উজান শুয়ে আছে। বেড সাইডে ওষুধ আর খালি পানির গ্লাস রাখা। সাঁঝ মনে করার চেষ্টা করলো গ্লাসে পানি ছিলো না। তারমানে উজান পানি না পেয়ে ওষুধও খায়নি। সাঁঝ দ্রুত গিয়ে জগ ভর্তি পানি নিয়ে আসে। গ্লাসে পানি নিয়ে উজানকে ডাকে। উজান চোখ মেলে দেখে বউ তার এক হাতে গ্লাস আর ওষুধ নিয়ে দাড়িঁয়ে আছে। মাথা যন্ত্রনায় ছিড়ে যাচ্ছে। ওষুধটা আগে খাওয়া প্রয়োজন। উঠে বসে ওষুধটা খায় সে। তারপর সাঁঝের দিকে তাকিয়ে তাকে সে আবার চলে যাবে নাকি এমন কিছু। সাঁঝ যায়না বরং উজানের দিকে এগিয়ে আসে। গলার কাছে শার্ট সরিয়ে দেখে দাঁতের দাগ বসে গেছে। বুকের কাছে শার্ট সরাতেই দেখে নখ গেথেঁ বসে গেছে। এগুলো কি করেছে সে ভেবেই নিজেকে চড়াতে ইচ্ছে হলো তার। সাঁঝ উজানের খুব কাছে যায়। যতটা কাছে গেলে শরীরের সাথে শরীর মিশে যায় ততটাই কাছে। ক্ষতের জায়গাগুলোতে আদর করে দেয়। উজান বুঝতে পারে সাঁঝ কি করছে। প্রথমে নিরুত্তেজ থাকলেও আদরের স্পর্শ যখন গভীর হতে শুরু করে, ভেজা আদরে উজানের চোখ মুখ গলা বুকের কাছে অন্যরকম শীতলতা জাগে তখন উজান স্ত্রীর উষ্ণ আদরে সারা দেয়। সাঁঝ উজানের বুকে মুখ গুজেই ফুপিয়ে কেঁদে বলে
” কেন আমি এতো দেরিতে তোমার জীবনে আসলাম? কেন আমি তোমার জীবনে প্রথম নারী হয়ে তোমার ভালোবাসা পেলাম না উজান”?
চলবে…….
#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ২৯
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
” আমার জীবনে প্রাক্তন আছে বলেই যে তোমার অবস্থান নড়বড়ে বা তাদের থেকে কম গুরুত্ব তোমাকে দিচ্ছি বা ভবিষ্যতে সম্ভাবনা আছে এমন মনে হলে তুমি আমাকে এখনো তাইলে পুরোটা চিনতে পারোনি সাঁঝ। অবশ্য এটা তোমার দোষ না। অল্প কয়েকদিনের পরিচয়ে আর বোঝাপড়ায় একটা মানুষকে কি চেনা যায়? বছরের পর বছর এক সাথে থাকার পরেও চেনা যায়না। আর তুমি আসলেই আমার জীবনে মাত্র কদিন আগে। একটু সময় লাগবে। তোমার স্বামী জীবনে হয়তো অনেক ভুল করেছে কিন্তু তার জন্য তাকে অনেক বেশি কিছু হারাতেও হয়েছে। তুমি যদি অবুঝের মতো এমন কিছু ভেবে নিজে কষ্ট পাও আর আমাকেও দাও ব্যাপারটা কেমন দেখায় জান”?
সাঁঝ নিজের স্বামীর বুকে মুঝ গুজে এখনো কেদেঁই যাচ্ছে। থামার নাম নেই। তার এতোকিছু মাথায় আসছে না। তাকে শুধু একটা চিন্তাই কষ্ট দিচ্ছে তার স্বামীর জীবনে যে অনেক পরে এসেছে। তার স্বামী উজান শুধু তার একার ভালোবাসা ছিলো না। এই ভালোবাসা আরও কয়েক দফাতে ভাগ হয়েছে। ভাগাভাগি করে তার জন্য অবশিষ্ট যা আছে সেটাতে সে খুশি নয়। তার উজানের পুরো ভালোবাসাটাই চাই। পুরো উজানকেই চাই। সাঁঝ ধরা গলায় বললো
” তোমার ভালোবাসা আমার আগে অনেক অংশে ভাগ হয়ে গেছে। আমার জন্য অবশিষ্ট যা আছে সেটা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার যে তোমার পুরো ভালোবাসাটাই লাগবে। আমি কোনো অংশীদার চাই না”।
এতো দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যেও উজানের হাসি পেলো। হঠাৎ করে সাঁঝের এই অবুঝ আচরণ সে মেলাতে পারছে না। সাঁঝের পিঠে আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে বললো
” ওরা তোমার স্বামীর ভালোবাসার অংশীদার নয়। ওদের আলাদা জীবন আছে। যে যার জীবনে স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তাদের ভালোবাসার গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। সেখানে তোমার স্বামী তাদের জীবনে একটা ভুলে ভরা ফেলে আসা অধ্যায়। যেটার পাতা উল্টে দেখতে লাগলে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু আসবে না বুঝেছো পাগলি মেয়ে”?
সাঁঝ এতো বড় বড় কথা বুঝে না। দার্শনিক উক্তি বা কথা দুটোই তার মাথার উপর দিয়ে যায়। সে স্বামীকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। উজানের বুকের মধ্য পোষা বিড়ালের মতো গুটিয়ে যায়। স্বামীর বুকে নাক ঘষে। সাঁঝ নরম গলায় বলে
“আমার দিকে তাকাও “।
উজান সাঁঝের দিকে তাকায়। ঢাকায় ফেরার পরে সে এতোটাই অমনোযোগী হয়ে গেছে যে বউ এর দিকে ঠিকমতো খেয়ালও করেনি। ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছে তার। মোমের মতো নরম তার বউ। পুতুলের মতো গড়ন তার। সেদিন ট্রেনের ভেতর তাসনিমকে দেখে দিন দুনিয়া ভুলে বেখেয়ালি হয়ে গিয়েছিলো সে। সে ফিরে গিয়েছিলো এগারোটা বছর আগের দিনগুলোতে। তাসনিমের সাথে তার ভালো ভালো স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেছে। তার সাথে করা অমানবিক আচরণ এর ফলস্বরুপ তার জীবনের এই যে টালমাটাল অবস্থা এটাই সে মাঝে মাঝে মেনে নিতে পারে না।যার জন্য কিছু নির্দিষ্ট সময়ে এসে তার জীবনে সে ভেঙে পরে। সবকিছু বিস্বাদ লাগে তার। জীবনটাই তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। এতোবছর এই কঠিন সময়গুলো সে একাই সামলে এসেছে। একাই এরকম টালমাটাল হয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পরেছে আবার একা একাই নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার আর সেটা হয়নি। এবার এই সময়গুলোতে সাঁঝ আছে। স্ত্রীর কাছে তার এই আচরণ ভালো লাগেনি এই জন্যই আজকে এই সমস্যাটা হয়েছে। উজান স্থির হয়ে সাঁঝের দিকে তাকায়। সাঁজ উজানের ডাল গালে হাত রেখে আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। উজান বলে
” এই সময় আমার জীবনে বহুবার এসেছে। আমি একাই সামলে নিয়েছি এতো বছর। এবার তুমি আসাতে সব কেমন গুলিয়ে গেলো। ধরা পরে গেলাম। তবে বিশ্বাস করো ওরা শুধু আমার প্রাক্তন এর জায়গাটাতেই আছে। ওদের জন্য আমার জীবনে এর বেশি কোথাও কিছু নেই। মাঝে মাঝে নিজের জীবনের হিসেব মেলাতে গিয়ে আমি খেই হারিয়ে ফেলি তাই এই অবস্থা হয় আমার। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তোমার প্রতি আমার আরও বেশি দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিলো”।
সাঁঝ বলে
” তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো তুমি আমার প্রতি ঠিকমতো দায়িত্ববান ছিলে না? আমার প্রতি অবিচার করেছো? প্রশ্ন কেন করছি? উত্তরতো আমি জানি। করেছোতো। আমাকে নিজের থেকে দূরে রেখেছো। আমার কাছে আসোনি, ভালোবাসোনি। মন খুলে নিজের কষ্টের কথা বলোনি। আমিও যে অনেক কষ্ট পেয়েছি। নিজের মধ্য দহনে শেষ হয়ে গেছি। ভেবেছি আমার স্বামী আমার সামনে তার প্রাক্তন প্রেমিকার কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। এটা একজন স্ত্রী হয়ে নিজের কাছে কত লজ্জার বিষয় যদি বুঝাতে পারতাম তোমায়। উজান আমাকে কি ভালোবাসো নাকি আমাদের সম্পর্ক শুধু চাহিদার মধ্যেই”?
আর কিছু বলতে পারে না সাঁঝ। তার আগেই নিজের অধরের সাথে তার অধর দুটো আকঁড়ে ধরে উজান। এতো কথা শুনতে ভালো লাগছে না এখন। অনেক হয়েছে প্রাক্তন নিয়ে কথা। এসবের আর কোন দাম নেই তার কাছে। জীবনের যথেষ্ট সময় এই নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে করতে গেছে তার। অনেক ভুল ভ্রান্তি হয়েছে। যা হয়েছে সেগুলোকে আর ফেরানো যাবে না। অতীতকে ভেবে বর্তমানকে নিয়ে ছেলেখেলা করা যাবে না। সাঁঝ ছাড়া তার আর আপন বলতে দুনিয়ায় কেউ নাই। সেতো একাই ছিলো। কাউকেতো চায়ওনি। জীবন তাকে সুযোগ দিলে সে কেন সুযোগ হাতছাড়া করবে। আর কখনো অতীত কে বর্তমানের সাথে মেলাবে না সে। উজান সাঁঝকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। সে ব্যস্ত স্পর্শ মেলাতে। সাঁঝ আজকে বদ্ধ উন্মাদ এর মতো আচরণ করছে। উজানকে সে দম ফেলার মতো সুযোগ দিচ্ছে না। অনেক রাত অবধি এসব ঝড় চললো দুজনের মধ্য। দুজন দুজনকে একে অপরের যতটা গভীরে গেলে আবিষ্কার করতে পারে তারা তৃপ্ত ততটাই সীমা ছাড়িয়েছে তারা। সাঁঝের অবদান ছিলো আজকে উজানের কাছে অবাক করার মতো। আদরের ঝড় শেষে সাঁঝ উজানের হাতটা নিজের উদরে রেখে বললো
” আমার মন বলছে এখানে কেউ আসবে। ঠিক এখানটায় তোমার মতো কেউ। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি আসবে দেখো। আমার প্রার্থনা তোমার অপেক্ষা শেষ হবে। উপরওয়ালা নিরাশ করবেন না”।
উজান স্তব্ধ হয়ে যায় স্ত্রীর মুখে এসব কথা শুনে। নিজের স্ত্রীর উপর আজকে সে তৃপ্ত। একটা সুন্দর সময় তারা পার করেছে এতোক্ষন। হঠাৎ করে বুকের মধ্য মোচড় দিয়ে উঠে সাঁঝের কথাগুলো শুনে । স্ত্রীর উদরে হাত রেখে আলতো করে বুলিয়ে দেয় সে। চোখ দিয়ে কান্নারা ঠেসে বেরিয়ে আসে। সেটার স্পর্শ পায় সাঁঝ। স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অজস্র চুমু খায় উজান স্ত্রীর পুরো উদর জুড়ে। সাঁঝ কেপেঁ উঠে থেকে থেকে। উজান ক্ষীন আর দূর্বল গলায় উদরে মুখ গুজে বলে
” শুনছো আমি উজান বলছি। কেউ আছো এখানে? আমি তোমার বাবা হবো জানো । এখানে আছো কেউ? আমাকে শুনতে পাচ্ছো? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।
সাঁঝের বুকের ভেতরটা হাহাকারে ভরে যায় উজানের এই মরিয়া হয়ে কথা বলাতে। সেওতো উজানের মতোই অধীর আগ্রহে আছে তাদের ঘর আলো করে কেউ আসবে। উজানের এই আক্ষেপ হাহাকার গুলো মিলিয়ে যেন যায় সেওতো চায়। এই চাওয়া পাওয়ার আক্ষেপ আর প্রার্থনা নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেলো বুঝতে পারলো না তারা। ভাগ্য ভালো দিনটা সাপ্তাহিক ছুটির দিন। অফিসের দিন হলে আজকে উজানের আর অফিসে যাওয়া হতো না। ঘুমিয়েছেই তারা প্রায় শেষ রাতের দিকে। উজানের যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়িতে বাজে বেলা দশটারও বেশি। জেগে উঠে শুয়ে থেকেই আড়মোড়া ভেঙে পাশে তাকিয়ে দেখে তার বউ পুরো এলোমেলো হয়ে তাকে এক হাতে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। গতরাতের সাঁঝের করা পাগলামির কথা মনে হতেই প্রচন্ড হাসি পেলো তার। বউ এর কপালে আসা অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে দিলো। টুপ করে বউয়ের কপালে, চোখে, মুখে আর ঠোটেঁ চুমু দিলো সে। সাঁঝ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। উজানের মনে হলো বউয়ের আরও কিছুক্ষণ ঘুম দরকার। তাই সে একাই গেলো হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে। লম্বা একটা গোসল সেরে বের হয়ে দেখে বউ এখনো গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। উজান ভাবলো অনেকদিন নাস্তা বানানো হয় না তার। অনেকদিন পর সে অনেকটা আয়েশ করে নাস্তা বানালো। সুজি, আলু ভাজি আর গরম গরম পরোটা সাথে কড়া লিকারের আদা চা। ঘন্টাখানেক সময় লাগলো। নাস্তা যখন প্রায় হয়েই এসেছে তখন রান্নাঘরে আগমন ঘটলো সাঁঝের। একটা নীল শাড়ি পরেছে সে। চুল ঠিকমতো মুছতে পারেনি। ভেজা চুল থেকে পানি টপ টপ করে পরছে। বউ এর এই রুপ দেখে পরোটা উল্টাতে গিয়ে হাতে ছ্যাকাঁ খেয়ে হুশে আসলো। উজান দুষ্টুমি করে বললো
” তুমি যখন তখন বিধ্বংসী রুপে আমার সামনে আসো কেনো? চোখ মন সব বিক্ষিপ্ত করে দাও। এরকম করলে আমার আর কাজ করতে হবে না”।
সাঁঝ এক পা করে আগাতে আগাতে উজানের একদম কাছে যায়।উজানের চোখের দিকে তাকিয়ে চুলাটা বন্ধ করে। তারপর হাত দিয়ে ভেজা চুল ঝেরে উজানের মুখে পানি ছিটায় আর বলে
” উপরওয়ালা তোমার জন্যই এরকম বিধ্বংসী রুপ দিয়ে তৈরী করে পাঠাইছে যাতে তোমাকে রুপের মায়াজালে আটকে রাখতে পারি বুঝেছো?
উজানের আর বলার কিছু থাকে না। আজকাল সে অনেক কিছুতেই কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। সে নিজেও ভেবে হয়রান হয়ে যায় হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেলো। এসব খুনসুটির মধ্যেই সাঁঝের ফোনে কল আসে। অচেনা নাম্বার থেকে কল পেয়ে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বললো
” আমি কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার বাসায় আসছি। কোথাও যেও না যেনো”।
চলবে……
#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ৩০
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
” সোমাকে ছাড়া আমার নিজেকে নিঃস্ব মনে হয় সাঁঝ। মনে হয় এতো বড় দুনিয়াতে তোমার বোন আমাকে সর্বস্বান্ত করে রেখে চলে গেছে। সেতো যাওয়ার সময় কিছুই নিয়ে পরপারে যায়নি অথচ দেখো সে ছাড়া আমি আমার জীবনের সব কিছু খুইয়ে বসে আছি। বেচেঁ থাকা কষ্টদায়ক হয়ে গেছে। দিনশেষে আমার নিজেকে খুব ছোট লাগে জানো? মনে হয় তোমার বোন উপর থেকে আমাকে উপহাস করে বলছে সারাজীবন আমাকে যতটা অসহায়ত্ব আর একাকীত্ব উপহার দিয়েছো তা সুদে আসলে ফেরত পাওয়ার সময় এখন। তার ফোন নাম্বারে এখনো ভুলে আমি ফোন করে ফেলি মাঝে মাঝে। ফোনটা তোমার মায়ের কাছে। উনি ধরেন। উনার গলা পেলে আমার মনে পড়ে এই ফোনের মালিক পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই সাতটা মাসের মধ্যে এমন কোন দিন নাই যে তোমার বোনকে ভেবে আমার চোখে পানি আসে নাই। কাজ বাড়িয়ে দিয়েছিলাম যদি একটু বের হতে পারি এসব থেকে। বেরতো হতে পারিনি উল্টো সব ছেড়ে চলে এসেছি। মনে হলো বাচ্চারা মা হারিয়েছে এখন যদি বাবাকেও নিজেদের কাছে না পায় তাহলে তাদের মায়ের সাথে যে অবিচার করেছি তার সাথে বাচ্চাদের প্রতি অবিচারও যোগ হবে। বিদেশে আর থাকতে পারছিলাম না চলে এসেছি। এখানেই কিছু করে একটা রোজগারের ব্যবস্থা করবো। বউ হারিয়েছি বাচ্চাদের বাবা থেকেও তাদের বাবার আদর স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করলে পরপারে সোমার কাছে কি জবাব দিবো। তোমার বোনের আমি ঠিকঠাক খেয়াল রাখতে পারিনি অথচ সে আমাকে দুটো ফুটফুটে বাচ্চা উপহার দিয়ে গেছে”।
এতোক্ষন এসব কথা বলছিলো সাঁঝের বোন সোমার স্বামী। কিছুক্ষণ আগে অচেনা নাম্বার থেকে রায়হান ফোন করেছিলো তাকে। কাউকে না জানিয়েই বিদেশ থেকে একেবারে চলে এসেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর ফিরবে না বাচ্চাদের নিয়ে বাংলাদেশেই রয়ে যাবে। তাকে চেনাই যাচ্ছে না। শরীর শুকিয়ে স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। চোখ মুখ কাহিল হয়ে আছে। বেচেঁ থাকতে কাছের মানুষের মূল্য বুঝা না গেলেও তার চলে যাওয়ার পর বুঝা যায় সে জীবনে কোথায় অবস্থান করছিলো। রায়হানকে দেখে উজান এবং সাঁঝের প্রতিক্রিয়া এখন তেমন। সাঁঝ একটা লম্বা শ্বাস নেয়। সাঁঝ বলে
” আপনি যে চলে এসেছেন আপনার মা জানলে অনেক রাগ করবে। এর আগেও আসতে চেয়েছেন কতবার। কতবার আপু আপনাকে আসতে বলতো। আপনাকে পাশে না পেয়ে কত কেদেঁছে। আপনার মার জন্য সে অনেক কষ্ট পেতো। সেই আসলেন ভাইয়া শুধু আমার বোনটা স্বামীকে নিজের যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো তখন পাশে পায়নি।
সাঁঝের অভিযোগ শুনে রায়হানের মাথাটা লজ্জায় নত হয়ে যায়। আসলেই কথাটা শতভাগ সত্যি। সোমা তাকে অনেক বার আসতে বলেছে। সে বলতো দরকার হলে নুন মেখে ডাল ভাত খেয়ে থাকবো তাও তুমি আসো। তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না। ছেলেটা বাবার আদর ছাড়া বড় হচ্ছে। যখনই দেশে ফেরার কথা বাড়িতে জানাতো তখনই পরিবার থেকে বলতো দেশে এসে কি করে খাবি। তার মা বলতো এতো কষ্ট করে টাকা পয়সা খরচ করে পড়িয়েছি বিদেশে পাঠিয়েছি দেশে এসে দোকানদারি করার জন্য? ছোট ভাই বোনগুলো আছে তাদের এখনো গতি হয়নি। ওদের হকের টাকাও তোর পেছনে ঢেলেছি আর তুই এখনই চলে আসতে চাচ্ছিস? এসব তোর বউ শিখিয়ে দিয়েছে। এই মেয়ে আমার সংসারের বরকত নষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কান পড়া দিয়ে ছেলের মন নষ্ট করে দিচ্ছে। ব্যস তারপরে আর বাড়ি ফেরার সকল ইচ্ছাই দমে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিলো তার। সে বাড়াবাড়ি করলে এর সমস্ত দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হতো তার বউয়ের উপর। এজন্য একটা সময় সে সোমাকে আশ্বাস দিয়ে দিয়ে শান্ত করেছিলো আমি তোমাদের নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করেই দেশে ফিরবো। এখন সবই আছে। সেও দেশে ফিরেছে একেবারে কিন্তু যার জন্য অনেক আগে ফেরা উচিত ছিলো সে এক বুক হাহাকার নিয়ে চলে গেছে। আরেকটু সাহস করে যদি তখন সিদ্ধান্ত নিতো মেয়েটা হয়তো একটু শান্তি পেতো। এখন সবই দীর্ঘশ্বাস। রায়হানকে চুপ থাকতে দেখে উজান বললো
“ভাইয়া এখনি কিভাবে সব সামলাবেন ভাবছেন? আপনার পরিবার জানলেতো আবার অশান্তি করবে। উনাকে শেষবার আমি হসপিটালে দেখে যতদূর বুঝেছি উনি মানুষ হিসেবে বিপজ্জনক। সন্তানদের মধ্য বৈষম্য করেন উনি। আপনার ছেলে নিহিন কে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু নিহাকে না। তার মতে নিহিন আপনাদের বংশের বাতি আর মেয়ে হচ্ছে বোঝার মতো। আমার জানা মতে আপনার নিজেরও দুইটা বোন আছে। উনি কি তাদের সাথেও এমন ব্যবহার করেন?
নিজের মাকে নিয়ে একের পর এক অভিযোগ শুনতে শুনতে রায়হান খুব ক্লান্ত, তিক্ত এবং বিরক্ত। হ্যাঁ তার মা সন্তানদের মধ্য ভেদাভেদ করেন কিন্তু সেটা নিজের সন্তানদের নিয়ে না। অন্যদের সন্তানের সাথে। নিজের বেলায় তিনি ষোলআনাই বুঝে নিতে জানেন। বোনদের বিয়ের সময় রায়হান এর কাছে কত কি আবদার করেছিলেন। বোনেরাও রায়হানের কাছে লিষ্ট পাঠিয়েছিলো তাদের শখ পূরন করার জন্য। অবশ্য সেটা এখনো করে। রায়হান মায়ের, বোনের এবং ভাইয়ের আবদার মেটাতে দিন রাত পরিশ্রম করেছে। দিনশেষে বউ বাচ্চার জন্য কিছু করতে গেলেই মায়ের সেই তিতা কথাগুলো আজও তার মন মেজাজ খারাপ করে দেয়। বিগত এক মাস সে তার মায়ের সাথে ঠিকমতো কথা বলে না। ভাই চাকরি করবে না ব্যবসা করবে তাই টাকার দরকার। টাকা দিতে বলেছে। রায়হান এক বাক্যে নিষেধ করে দিয়েছে তার জমানো কোন টাকা নেই। সে দিতে পারবে না। তারপর থেকে তার মা বা ভাই কেউ তার সাথে ঠিকমতো কথা বলে না। রায়হানও ফোন দেয় না। স্বার্থপর নাকি সে এমনিতেও তাদের চোখে এখন সত্যিকার অর্থে সেটা হলে দোষের কিছু না। রায়হান মাথা তুলে তাকায়। সাঁঝকে বলে
” বাচ্চারা কোথায় “?
সাঁঝ বলে
” বাচ্চারা মার কাছে আছে। সারাদিন আমার কাছেই থাকে নিহিনের স্কুলের সময়টুকু ছাড়া। রাতের সময়টা মা বাচ্চাদের নিয়ে থাকে। মা ওদের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ওরাও মার কাছে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর আমার বিয়ের পর মা একটু বেশি তাদের কাছে রাখে”।
বলতে গিয়ে সাঁঝের গলা লজ্জায় ধরে আসে। আসলেই তাই। বিয়ের পর সাঁঝ যাতে নিজের সংসারে মন দিতে পারে এজন্য বাচ্চাদের তার মা বাবাই বেশি সময় দেয়। আগে বাচ্চারা রাতের বেলাতেও সাঁঝের কাছে থাকতো কিন্তু এখন সেটা হয়ে উঠে না। মাঝে মাঝে সাঁঝ নিজেও দ্বিধায় থাকে তবুও তাকেওতো নিজের সংসারে আবার উজানকে সময় দিতে হবে এটাও মাথায় রাখতে হবে। এজন্য তারা মিলেমিশেই বাচ্চাদের দেখাশোনা করছে। ছুটির দিনগুলোতে উজান বাচ্চাদের সময় দেয় অনেকক্ষন। এর মাঝে কয়েকবার বাইরে ঘুরতে গেছে তারা। বাচ্চাদের জন্য খেলনা নিয়ে আসে। সবই করার চেষ্টা করছে কিন্তু তারপরেও মা-বাবার অভাব কি কেউ পূরন করতে পারে? ওরাও এইটুকু বয়সে বুঝে গিয়েছে এভাবেই তাদের জীবনে মানিয়ে নিতে হবে”।
রায়হান বলে
” বাচ্চাদের জন্যই আমার ফেরা। আমিও বাচ্চাদের আর নিজের কাছ থেকে দূরে রাখতে চাইনা। ওদের নিয়েই বাকি জীবন পাড়ি দিবো। মায়ের অভাবতো পূরন করতে পারবো না কিন্তু মা এবং বাবার দুই দায়িত্বই পালন করার চেষ্টা করবো। তুমি বলো কেমন লাগছে জীবনে আসা নতুন মানুষ নতুন সংসার? আমারতো মনে হচ্ছে তুমি দারুন আছো”।
সাঁঝ লজ্জা পায় এই কথা শুনে। কি জবাব দিবে সে এই কথার। তবুও ইতস্তত করে বলে
” ভালো আছি ভাইয়া। নতুন মানুষ নতুন সংসার সব মিলিয়ে ভালো আছি। আপনাদের জামাই ভীষণ ভালো মানুষ না হলে কি ঐরকম একটা মুহুর্তে এতো বড় সিদ্ধান্ত নেয়? সবাই যখন আমাকে বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছিলো সেইতো আমাকে বাঁচিয়েছে”।
উজান সেখানে উপস্থিত আছেই এখনো। নিজের বউয়ের মুখে প্রশংসা শুনে তার চোখে মুখে রাজ্যের লজ্জা এসে ভর করলো। উজান বললো
” ওসব পুরনো কথা থাক। যেসব কথা ভাবলে মন খারাপ হয় সেগুলো যতটা সম্ভব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সব কিছু ঘটারই একটা উদ্দেশ্য থাকে। যা হওয়ার তাতো হবেই। ভাইয়া আপনি অনেক লম্বা সফর করে এসেছেন আপনার বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। আপনি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করেন তারপর বিশ্রাম নিয়ে না হয় আমরা গল্প করবো”।
রায়হান স্মিত হেসে বললো
“এখন বুঝতে পারছি সাঁঝ প্রথম দেখায় তোমার উপর ক্রাশ কেন খেয়ে বসেছিলো।আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি নতুন জামাই এর এতো প্রশংসা কেন করে এটাও বুঝতে পারছি এখন। আসলেই তুমি প্রশংসা পাওয়ার মতোই মানুষ “।
উজান সাঁঝের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। এর অর্থ হচ্ছে তুমি এই কথা ভাইয়াকেও বলেছিলে? সাঁঝ চোখের ভাষা বুঝে বললো
” হ্যাঁ ভাইয়া সব জানে। কিভাবে তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে এটাও জানে। ভাইয়াও আমাকে তোমার পক্ষ নিয়েই বুঝিয়েছিলো যাতে এই বিষয় নিয়ে তোমার সাথে জিদ না করি। তুমি ঠিক আর আমি হয়তো ভুল। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমার কাছ থেকে যত দ্রুত সম্ভব দূরে চলে যাওয়ার কিন্তু…….”।
উজান ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সাঁঝের দিকে। এই মেয়েটা এতো কিছু ভেবে বসেছিলো। আর সে এটাকে তার বয়সের আবেগ বলে চালিয়ে দিয়েছে। রায়হান নতুন দম্পতির এই ঠান্ডা যুদ্ধের মধ্য থাকতে চাইলো না। সে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর বললো
” আমি ঐ বাসায় যাই। আব্বা আম্মা আর বাচ্চাদের সাথে দেখা করি। আবার পরে আসবো”।
রায়হান এই বলে চলে যায়। তারপর উজান সাঁঝের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যায়। সে বলে
” কে যেনো ভেবেছিলো আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে?
সাঁঝ উজানের গালে টুকুস করে ভেজা হামি দিয়ে বলে
” আমিগো আমি ভেবেছিলাম। তুমি যে ফিরিয়ে দিয়েছিলে তাই”।
চলবে………….