নীল সাঁঝের উজান পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
37

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ৩৪
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

” নিজের জীবনের কোন বিষয়টা আপনাকে সবচেয়ে বেশি এখন বিরক্ত করছে মিলি? নিজের বিবাহ বিচ্ছেদের পর আপনি কি নিজের উপর তিক্ত বিরক্ত হয়ে পড়েছেন নাকি আশেপাশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা মানুষ জনের কথা আপনাকে বেশি বিরক্ত করছে? বিবাহ বিচ্ছেদের কতদিন হলো আপনার”?

এতোক্ষন এতোগুলো প্রশ্ন করে থামলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ তামান্না চৌধুরী। সেদিনের মিলির অসুস্থ হওয়ার ঘটনার পর পার হয়ে গেছে এক সপ্তাহ। মিলির বিধ্বস্ত অবস্থা রায়হানকে ভীষণ ভাবিয়েছে। মিলির সাথে যা হয়েছে সেটা প্রতিদিন কোন না কোন মেয়ের জীবনে অন্তরালে বা প্রকাশ্যে ঘটেই যাচ্ছে। সোমার সাথেও এগুলো হয়েছে। সোমাকে কেউ যদি এতো যত্ন করে বুঝতে পারতো মেয়েটা সংসার জীবনে এতো বেশি কষ্ট পেতো না। নিজের বউকেতো সে কোন সাহায্য করতে পারেনি কিন্তু চোখের সামনে মিলিকে দেখে সেই একই ইতিহাস যেন পুনরাবৃত্তি না হয় এজন্য সে নিজের উদ্যোগে মিলির বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তী কাউন্সিলিং এর জন্য ডাক্তার খুঁজেছে। ডাঃ তামান্না চৌধুরীর সন্ধান দিয়েছে রায়হানের এক ভালো বন্ধু। শহরে যতজন নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন তার মধ্য তরুন প্রজন্মের ডাক্তার হিসেবে বেশ ভালো করছেন তিনি। মিলিকেও সাহায্য করতে পারবেন এই আশা নিয়েই রায়হান আজকে মিলিকে নিয়ে ডাঃ এর চেম্বারে এসেছে। মিলি প্রথমে আসতে চায়নি। সে চায়নি তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এভাবে লোক জানাজানি হোক। সে সাঁঝ এর উপরেও কিছুটা অভিমান করেছিলো যে কেন তার এই বিষয়টা রায়হানকে জানিয়েছে। পরবর্তীতে রায়হান নিজেই স্থির হয়ে মিলিকে বুঝিয়েছে এইটা খারাপ কিছু নয়। মানুষের জীবনে অস্থিরতা অরাজকতা হবেই এবং এটা থেকে বের হওয়ার জন্য কারো সাহায্য নেওয়া দোষের কিছু নয়। অনেক বুঝানোর পর মিলি রায়হানের সাথে ডাক্তারের কাছে আসতে রাজি হয়। মিলি মাথা নিচু করে ডাক্তারের কথা শুনছিলো। ডাক্তারের করা প্রশ্নে মাথাটা তুলে সামনে তাকায়। ডাঃ তামান্না ফের মিলিকে প্রশ্ন করে

” সে এখন কোন বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত এবং বিরক্ত”?

মিলি রায়হানের দিকে চেয়ে থাকে। সে খুব বিচলিত এবং বিব্রতবোধ করছে। রায়হান তাকে স্মিত হেসে অভয় দিয়ে বলে

” মিলি এসব থেকে বের হতে চাইলে তোমার নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে হবে আগে। ডাঃ শুধু একটা মাধ্যম। তাই উনি যা বলছে উত্তর করতে হবে”।

মিলি কাপাঁ কাপাঁ গলায় বলে

“আমি নিজের উপর খুব তিক্ত বিরক্ত আসলে বিষয়টা এমন না। আমি আসলে এটাই ভেবে ভেবে সন্দিহান হয়ে পড়ছি যে আমিতো কারো কোন লোকসান করিনি তাহলে আমার সাথে এতোবড় অন্যায় হলো কেনো? এতো কিছুর পরেও সমস্ত কিছুর দায়ভার আমার উপরেই কেন আসলো?

ডাঃ বললেন

” শুধু কি এই বিষয়গুলোই নাকি আরও কিছু আছে যা আপনি বলতে চাচ্ছেন না? যদি বেশি গভীর কিছু হয়ে বলতে হবে না “।

মিলি বলে

” আমার প্রাক্তন স্বামীর সাথে তার মামাতো বোনের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো বিয়ের আগে। এইটা আমার কাছে গোপন করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। পারিবারিক ভাবে দেখাশোনা করেই বিয়েটা হয়। সে যখন আমাকে ধোঁকা দিলো তখন আমার প্রাক্তন শ্বাশুড়ি আমাকে বলেছিলেন আমি তার ছেলেকে বিছানায় খুশি করতে পারিনি বলেই সে তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে ভুলতে পারেনি। তাই তার এই অধঃপতনের জন্য নাকি আমিও অনেকাংশে দায়ী “।

ডাঃ তামান্না বলে

” আপনাদের মতো শারীরিক সম্পর্ক কেমন ছিলো? প্রথমে কে আগ্রহ প্রকাশ করতেন”?

মিলি ডাক্তারের প্রশ্নে চমকে উঠে। রায়হান পাশে বসা। প্রশ্ন শুনে রায়হানও এদিক ওদিক চেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।মিলি ইতস্তত করে যার অর্থ হচ্ছে সে এই প্রশ্নের উত্তর করতে সহজ হতে পারছে না। বিষয়টি বুঝতে পেরে তামান্না বললেন

” দেখুন মিলি বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি থেকে হওয়া সম্পন্ন একটা ব্যাপার। এখানে দুই পক্ষের আগ্রহ এবং অনুমতি আছে। বিয়ে একটি শারীরিক এবং মানসিক বন্ধন। বিয়ের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জৈবিক চাহিদা। তাই বিষয়টিকে সহজ করে দেখুন। বিয়ে মানেই এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সবাইকেই যেতে হবে। দেখবেন যে দুজন স্বামী -স্ত্রীর মধ্য বনিবনা না হলেও বছরের পর বছর তারা সমঝোতা করে সংসার করছে। এক ছাদের নিচে থাকছে আবার বাচ্চাও হচ্ছে। মতের অমিল এবং সমস্যা হলেই মানুষের বিচ্ছেদ হয়। তাই এটাকে সহজ করে ভাবতে হবে আপনাকে”।

ডাঃ এর কথায় মিলি খানিকটা ধাতস্ত হয়। সে সহজ হয়ে বলে

” আমার মাঝে মাঝেই মনে হতো আমাদের মধ্য মানসিক একটা দূরত্ব আছে। অনেক বিষয়ে তাকে আমি বুঝতাম না। যা বুঝতাম না সেগুলো বুঝার চেষ্টাও করেছি। আবার এমন করে সেও বেখেয়ালি ছিলো অনেক বিষয়ে। শারীরিক ভাবে আমার মনে হয়েছে আমার চাহিদাটা একটু বেশি। আমি স্বামীকে বেশিই চাইতাম। সেই তুলনায় সে এদিকে খেয়াল করতো। সে কখনো এই বিষয়ে এমন কোন আচরণ করেনি যে আমি বুঝতে পারবো সে আমাকে কখনো ঠকাতেও পারে “।

তামান্না বললেন

” বিয়ের কত বছর চলছিলো আপনাদের”?

মিলি উত্তর দেয়

“জি তিন বছর “।

আবার মিলির কাছে প্রশ্ন আসে

” বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন”?

মিলি উত্তর দেয়

“আসলে অনার্স সেকেন্ড ইয়্যারে থাকা অবস্থায় বিয়ে হয়। পড়াশোনা সংসার সব সামলে উঠতে হিমশিম খাচ্ছিলাম বলে বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা ছিলো না। পড়াশোনা শেষ করে বাচ্চা নিতে চেয়েছিলাম। এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে উপরওয়ালা বাচ্চা নেওয়ার আগেই আসল রুপ দেখিয়ে দিয়েছে। তা না হলে আমার বাচ্চা এই দোজখেঁ এসে পড়তো”।

তামান্না বললো

” শ্বশুর শ্বাশুড়ির ব্যবহার আপনার প্রতি এবং আপনার তাদের প্রতি কেমন ছিলো”?

মিলি বলে,

” আমার প্রাক্তন শ্বশুর প্রচন্ড অমায়িক একজন মানুষ। মূলত উনি নিজেই আমাকে পছন্দ করে ওই বাড়ির বউ করে নিয়ে গিয়েছিলেন। শ্বাশুড়ি আমাকে প্রথম দিকে ভালো ভাবে মেনে না নিলেও আমার সাথে খারাপ ব্যবহার সংসার চলাকালীন সময়ে করেননি। তবে ইদানীং কোর্টে মামলা শুনানির সময়ে তার কথাগুলো খুব খারাপভাবে মস্তিষ্কে বিধেঁ যায়। আমার খুব অবাক লাগে উনি নিজে নারী হয়ে আরেকজন নারীকে কিভাবে এতো আঙুল তুলে কথা বলে তাকে কষ্ট দিতে পারেন?

ডাঃ তামান্না প্রশ্ন করা বন্ধ করলেন। উনি উনার উত্তর পেয়ে গেছেন। মিলির সাথে এখন যা হচ্ছে খুব স্বাভাবিক বিষয়। এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। সেই সাথে জীবনের কঠিন সময়গুলোর মধ্য একটা। অনেকেই মনের জোরে এই দিনগুলো অনায়াসে পার করে দেয়। আবার অনেকেই ভেঙে পড়ে। মিলি ভেঙে পড়ে কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়। হঠাৎ করে তামান্নার চোখ যায় মিলির হাতের দিকে। তামান্না বলে

” আপনার হাতে ওগুলো কিসের দাগ? আপনি কি নিজের ক্ষ’তি করার চেষ্টা করেছিলেন”?

মিলি অকপটে জবাব দেয়

” তিনবার চেষ্টা করেছিলাম। এমনকি দুদিন আগেও সিলিং ফ্যান এর সাথে শাড়ি পেচিঁয়ে ঝুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু দরজা লাগাতে ভুলে যাওয়ায় মা এসে যায়”।

রায়হান থ মেরে তাকিয়ে আছে মিলির দিকে। মিলি কত স্বাভাবিক গলায় কথাটা বললো যেন এসবে তার কোন পিছুটান কাজ করছে না। তামান্নাও হাতের কলমটাও থমকে গেলো এই কথা শুনে। তামান্না বলে

” নিজেকে শেষ করা কি কোন সমাধান হতে পারে? এইটা আপনার ইহকাল আর পরকাল শেষ করে দিবে। তার চেয়ে নিজের জন্য বাঁচার কথা ভাবতে হবে “।

মিলি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে তামান্নার দিকে। তামান্না আবার প্রশ্ন করে

” আপনার রাতে ঘুম হয়না বললেই চলে। খারাপ স্বপ্ন দেখেন নাকি”?

মিলি উত্তর দেয়

” জি। প্রচুর খারাপ চিন্তা মাথায় আসে। তার মধ্য নিজের ক্ষতি করার ইচ্ছাটাই বেশি”।

তামান্না বেশ কিছুক্ষণ তার হাতে থাকা নোটপ্যাডের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলে

” আমি আপনাকে কিছু হোমওয়ার্ক দিবো। সেগুলো করে এক সপ্তাহ পর আবার আসবেন। আপনার দ্বিতীয় সেশন এক সপ্তাহ পরে হবে আবার”।

মিলি বলে

” কেমন হোমওয়ার্ক “?

তামান্না বলে

” এখান থেকে বেড়িয়ে আপনি কয়েক ধরনের ফুল গাছ কিনবেন সেই সাথে ক্যাকটাস গাছও কিনবেন। আপনার জন্য কাজ হচ্ছে এক সপ্তাহ গাছের যত্ন নেওয়া। খেয়াল রাখবেন কোন গাছ যেন শুকিয়ে ম’রে না যায়। ক্যাকটাস এর যত্ন কিভাবে নিলে সেই গাছ আরও বড় হয় এইটা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে”।

মিলি কখনো গাছপালা বা বাগান নিয়ে সৌখিন ছিলো না তবে সে এগুলো পছন্দ করে। বাগান করার অভিজ্ঞতা তার নেই। তাই সে কৌতুহল বোধ করলো। মিলি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে তারা নার্সারীতে যায় গাছ কেনার উদ্দেশ্যে। ম্যাপে সার্চ করে দেখে চেম্বার থেকে কিছুটা দুরেই একটা বড় নার্সারী আছে। হাঁটা পথ। দু এক কথা বলতে বলতেই যাওয়া যাবে। হেটেঁ যেতে যেতে রায়হান বলে

“ডাক্তারের সাথে কথা বলে কেমন লাগলো”?

মিলি স্বাভাবিক ভাবে বলে

” ভালো। মনে হচ্ছে উনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন”।

তারা কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে একটা পুরুষের কন্ঠ শুনতে পায়। মিলিকে উদ্দেশ্য করে বলছে

” ডিভোর্স হয়ে তিনমাসই হলো না এখনই প্রেমিক জুটিয়ে ফেলেছো”?

চলবে……

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ৩৫
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

“আদালতে দাঁড়িয়ে খুবতো বড় বড় কথা বলছিলে সেদিন এই জীবনে আর কাউকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে তোমার। কোন পুরুষ মানুষকে আর তুমি জীবনে জায়গা দিতে পারবেনা। মাত্র কয়েকদিনেই দেখি নতুন কাউকে জুটিয়ে ফেলেছো। কাহিনী কি বলোতো? বিয়ের আগে থেকেই চিনতে নাকি একে অপরকে? কোন চক্কর ছিলো নাকি”?

মিলি পেছন ফেরে দেখে এতো সব অশালীন কথাগুলো বলছিলো আর কেউ না তারই প্রাক্তন স্বামী আজাদ। রাগে, ঘৃনায় লজ্জায় মাথা হেটঁ হয়ে গেলো তার। গা গুলিয়ে বমি বমি ভাব হলো তার। ভাবতেই মিলির গা ঘিন ঘিন করে উঠলো এই বাজে লোকের সাথে তিনটা বছর সে সংসার করেছে। নিজের জীবনের তিনটা বছরের সমস্ত ভালোবাসা, সুখ,দুঃখ এবং আহ্লাদ এই মানুষটাকে ঘিরে ছিলো। স্ত্রী হিসেবে যার প্রতি একদিন সে তীব্র মায়া আর টান অনুভব করতো তার জন্য এখন মনে শুধুই ঘৃনা আর ক্ষিপ্ততা জমা হয়েছে। মিলি যথেষ্ট সংযত হয়ে বললো

” তুমি কি ভুলে গেছো তোমার সাথে আমার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। আমার ইদ্দতকালীন সময় শেষ হতেও আর মাত্র কটাদিন হাতে আছে। এতেও যে খুব বেশি কিছু কথা বলা এবং পরিবর্তন আসবে তা কিন্তু না। দরকারও পরবে না। তুমি কিন্তু এখন আমার জীবনে শুধু একজন অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি যার ছায়াতেও আমার অস্বস্তি হয়। তাই আমাদের জন্য এটাই ভালো হবে যে দূরত্ব বজায় রেখে চলা “।

আজাদ তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে। রাগে ক্ষোভে কপালের রগ ফুলে উঠছে তার। মেয়েটাকে সে খুবই হালকা ভাবে নিয়েছিলো। ভেবেছিলো নরম গোছের। দুদিন কান্নাকাটি করবে তারপর সব মেনে নিবে। আজাদ যে পুরোদস্তুর ভুল ছিলো তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মিলি। দমে যাওয়ার পাত্রী সে নয়। আজাদকে সে একদম নাকানি চুবানি খাইয়ে ছেড়েছে। মামলা আপোষে মিটে গেলেও আজাদের জীবন পুরোই যাযাবরের মতো এখন। বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সাফ সাফ বলে দিয়েছে সে বেচেঁ থাকাকালীন যেন এই বাড়িতে ঢুকার সাহস করে না সে। তার যেটুকু পাওনা তাকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হবে কিন্তু বাড়ি আসতে পারবে না। এইদিকে তার উপর একাধিক মামলা থাকায় এবং অফিসে দ্রুত কথা ছড়িয়ে পড়ায় চাকরিটাও চলে গেছে। বন্ধুদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে থাকছে সে। আত্নীয়স্বজনরাও তার সাথে যোগাযোগ রাখা নিরাপদ মনে করছে না আর। আর যেই মেয়ের জন্য নিজের জীবনের এতো বড় অরাজকতা সৃষ্টি হলো সে আরও এক কাঠি উপরে উঠে গেছে। তার নাকি অনেক মানহানি হয়েছে গ্রামে। লোক হাসাহাসি হয়েছে। পরিবারের মান সম্মান ডুবে গেছে। এজন্য সেও আর কোন যোগাযোগ রাখতে চায়না। আসলে এগুলোর জন্য দায়ী সে নিজেই। নিজেই নিজের জীবন বরবাদ করে ফেলেছে। মিলির দিকে গভীরভাবে তাকায় সে। স্ত্রী মিলির সাথে এখনকার মিলির কোন মিলই নেই। মেয়েটা আগের থেকে শুকিয়ে গেছে অনেক। চেহারাটা ফিকে হয়ে গেছে। আগে তার জন্য চেহারায় একটা ভালোবাসা উচ্ছাস ফুটে উঠতো এখন সেটা শুধুই অতীত আর দীর্ঘশ্বাস। আজাদ দমে যায় না। মিলির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে

” সেদিন যদি এতো তেজ না দেখিয়ে আমার কথায় রাজি হয়ে যেতে আজকে নিজের আর এই দুর্দশা হতো না। কি চেহারা করেছো নিজের। আয়নায় দেখেছো আগের মিলির সাথে এখনকার মিলির কোন মিল নেই”।

মিলি কাঠ কাঠ গলায় বললো

” মিল আছে কি নেই সেটা এখন আপনার চিন্তার বিষয় না। এর জন্য দায়ী একমাত্র আপনি নিজেই। আর কি বললেন আপনার কথায় রাজি হয়ে যেতে হতো? লজ্জা শরম চোখের হায়া কোথায় কোন হাটে সস্তায় কেজি দরে বিক্রি করে দিয়ে এসেছেন যে এখনো বুক ফুলিয়ে এরকম কথা বলছেন? আপনার গায়ে মানুষের চামড়া আছে? আমার খুবই সন্দেহ হচ্ছে। যে লোক নিজের স্ত্রী আর তিন বছরের একটা সুখের সংসার এর কথা একবারও ভাবেনি। প্রাক্তন প্রেমিকাকে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে নিয়ে গিয়ে তিন দিন পর ফিরে এসে বউ এর কাছে আরেক বিয়ের কথা বলে তার মধ্য কি বিবেকবোধ আছে? তাকেতো মানুষের কাতারেই স্থান দেওয়া উচিত নয়। আপনাকে আমার মানুষ বলেই মনে হয় না। তাই এসব ফালতু কথা বলে নিজের এবং আমার সময় নষ্ট করবেন না। আপনার সাথে কথা বলতেও আমার গা গুলিয়ে আসছে”।

আজাদ মিলির এহেন কথায় প্রচন্ড রেগে যায়। ক্ষিপ্ত হয়ে বলে

” এখনতো গা গুলাবেই। এখনতো আমাকে মানুষ বলে মনে হবে না। নতুন না’গর জুটেছে যে। তা সেই প্রেমিকের কাছে কি এমনি এমনি যাওয়া হয় নাকি কিছু দেন দরবার করা লাগে”?

আজাদের কথা শেষ হতে দেরি হয়নি কিন্তু তার গালে সপাটে চড় দিয়েছে মিলি। রাগে আর ঘৃনায় রীতিমতো কাঁপছে সে। শুধু এইটুকুতেই সে থামলো না। এতোদিনে নিজের মধ্য জমে থাকা সমস্ত রাগ অভিমান জেদ উগরে দিলো। পায়ের স্যান্ডেল খুলে এলোপাথাড়ি মা’রতে শুরু করলো আজাদকে। ইচ্ছেমতো কিছুক্ষণ এই কান্ড চালিয়ে গেলো সে। রায়হান ভ্রূনাক্ষরেও বুঝেনাই বিষয়টা এতো বাজে ভাবে রুপ নিবে। একটা মানুষ কতটা নিম্ন মন মানসিকতার হলে প্রাক্তন স্ত্রীকে এসব বলে তাও আবার ভরা রাস্তায়। অবস্থা বেগতিক দেখে রায়হান মিলিকে আটকাতে যায়। মিলি তবুও থামেনা। গায়ের আশঁ মিটিয়ে আবারও মা’রতে থাকে। এক পর্যায়ে নিজে থেকেই শান্ত হয়ে যায়। রায়হান মিলিকে বলে

” কেন পচাঁ পাকে পা দিয়ে নিজের গায়ে কাদা লাগাচ্ছেন? উনিতো চাইছেই সেটা। উনি ইচ্ছে করেই এই সব করছে যাতে আপনি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আরও দূর্বল হয়ে পড়েন। আপনাকে শক্ত হতে হবে। এসব কথা গায়ে নেওয়া যাবে না। যার মধ্য মনুষ্যত্ব আর বিবেকবোধ নেই সে কাউকেই সম্মান করতে জানে না। প্রাক্তন স্ত্রী হলেও একটা মেয়েকে যে সম্মান করতে হয় সেই শিক্ষাও সে পায়নি। চলুন এখান থেকে। এসব নির্লজ্জ লোকের কথায় নিজের গায়ের শক্তি আর মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে ফেলার কোন দরকারই নেই”।

আজাদ মিলির হাতে অপমানিত হওয়ার পর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ হারালো। মুখে যা নয় তাই বলতে লাগলো। সে বর্বরের মতো বলতে লাগলো

” বাহ কি প্রেমিক জুটিয়েছিস দুই দিনে। তোরতো কপাল খুলে গেছে। আমাকে নিঃস্ব করে তোকে আমি কিছুতেই সুখে থাকতে দিবো না। আমার সুখ শান্তি কেড়ে নিয়ে তুই আরেকজনের সাথে সুখে ঘর সংসার করবি তা হবে না। তোর শরীরের প্রতিটা ভাজেঁ ভাজেঁ আমার ছোয়াঁ আছে। এই তোর নতুন না”গর জানে তোর বুকে আর কোমড়ে যে তিল আছে। আরও যা যা আছে সেগুলো কি জানে নাকি তাকে বলবো? হাজার হোক তুই আমার এক কালে বউ ছিলি। তোর সাথে এক বিছানায় কত রাত……. ”

আর কিছু বলার আগেই একটা জোরদার থা”প্পড় এসে লাগে আজাদের ডান গালে কানের নিচ বরাবর। ছিটকে চার হাত দূরে গিয়ে পরে মাটিতে। আজাদ প্রথমে ঠাওর করতে পারেনা এইটা কে দিয়েছে। তারপর যখন ব্যাথার তীব্রতা অনুভব করে তখন চোখ মেলে মাথা উঠিয়ে দেখে এইটা মিলির কাজ নয়। রায়হান হাতের মুঠো শক্ত করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দূরে তাকিয়ে দেখে মিলি কোনরকমে চোখ মেলে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। একদম প্রাণশুন্য লাগছে তাকে। মনে হচ্ছে টোকা দিলেই এখনই ধপাস করে পরে যাবে। রায়হান ক্ষিপ্র গতিতে আজাদকে মাটি থেকে টেনে তুলে আবার এলোপাথাড়ি কয়েকটা দেয়। তারপর হিসহিসিয়ে বলে

” সন্তান প্রথম শিক্ষা পায় তার মায়ের কাছে। আমার মনে হয় তোর জন্মের কোথাওতো ত্রুটি আছে যে তোর মধ্য এই শিক্ষা নেই। তোর মায়ের কাছে সময় করে শুনে নিবি তোর জন্মের ঠিক আছে কিনা। আজকের পর মিলির আশেপাশে ওর ত্রিসীমানায় যদি তোকে দেখি ভুলেও যদি আসার চেষ্টা করিস বুঝে নিবি তোর সময়টা আরও খারাপ হতে যাচ্ছে। সেদিন তুই কোনভাবেই ছাড়া পাবিনা”।

আজাদ এর গায়ে বিন্দুমাত্র আর শক্তি নাই। মা’রের চোটে শরীর ব্যথা হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় দাগও হয়ে গেছে। সে আর কিছু বললো না। মিলির দিকে তাকিয়ে ফোস ফোস করে নিশ্বাস নিয়ে দ্রুত সেই জায়গা ছেড়ে চলে গেলো। রায়হান তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস টানে। মিলির দিকে তাকায় সে। মিলি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার। রায়হান মিলিকে ডাক দিলো। কোনো উত্তর করলো না। রায়হান মিলিকে আবারও ডাক দিলো

” মিলি? মিলি ঠিক আছেন”?

না এবারও কোন সাড়া শব্দ নেই। রায়হান মিলির বাহু ধরে ডাকতেই মিলি গা ছেড়ে দেয়। অচেতন হয়ে পড়ে যেতে নিলেই রায়হান তাকে ধরে। মিলি চোখ বন্ধ করে আছে। অনেক ডেকেও মিলির জ্ঞান ফিরলো না। রায়হান অস্থির হয়ে গাড়ি ডেকে দ্রুত হাসপাতালের দিকে ছোটে মিলিকে নিয়ে। গাড়িতে উঠে রায়হান আবারও ডাকে

“মিলি? চোখ খুলুন মিলি?

অন্যদিকে আজকে অফিস থেকে আগেই ফিরে এসেছে উজান। হাতের ফাইল আর ব্যাগটা রেখে বাথরুমে গেছে ফ্রেশ হতে। সাঁঝ ঘরে পানি নিয়ে এসে দেখে উজান বাথরুমে আছে। বিছানার উপর থেকে ব্যাগ আর ফাইল নিয়ে ঠিক জায়গায় রাখতে নেয় সে। হঠাৎ করে ফাইলের উপর থেকে একটা লেখা দেখে তার চোখ আটকে যায়। ফাইলটা খুলে দেখতে নেয় সে। দেখার পর সে আওড়ায়

” উজান তুমি এসব কি করে করলে?

চলবে…………

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ৩৬
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

” বিয়ের দুই মাস হয়ে যাচ্ছে এখনো মধুচন্দ্রিমায় যেতে পারলাম না। এই আফসোস রাখার জায়গা নিজের মনে, বাড়িতে বা অফিসে কোথাও পাচ্ছিলাম না। তার মধ্য আপনিতো আমার কাছে সময়ের সবচেয়ে সুন্দর উপহার চেয়ে বসে আছেন স্বামীর সাথে উমরাহ করবেন। তাই ভাবলাম আপনার জন্মদিনের উপহার এবং বিয়ে পরবর্তী উপহার হিসেবে এটাই দেই আপনাকে। যেই ভাবা সেই কাজ। অবশ্য এর জন্য একটু কষ্ট করতে হয়েছে তবে সামান্য। আপনার কোন কাগজ পত্রই এই বাড়িতে নেই। তাই শ্বাশুড়ি আম্মাকে বলে যাবতীয় সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ট্রাভেল এজেন্সিতে জমা দিয়ে সব কিছু ঠিকঠাক করতে দিলাম। তারা সমস্ত কিছু সুন্দর মতো গুছিয়ে দিলো। আগামী মাসের বিশ তারিখ মানে আপনার পচিঁশ তম জন্মদিনের দিন আমাদের উমরাহ উদ্দেশ্যে ফ্লাইট এর তারিখ”।

সাঁঝ ফাইল হাতে নিয়ে দেখছিলো। ফাইলের মধ্য তাদের উমরাহর জন্য যাবতীয় সকল কাগজপত্র, পাসপোর্ট, প্লেনের টিকেট এবং হোটেল বুকিং এর ইনভয়েস টোকেন সহ সব কিছু আছে। সাঁঝ একে একে দেখছিলো সবগুলো। উজান তাকে এক মুহুর্তের জন্যও বুঝতে দেয়নি সে এসব পরিকল্পনা করছে। সেতো উমরাহ তে যেতে চেয়েছিলো স্বামীর সাথে। সে এটা ভালোভাবেই জানতো উজান তার এই ইচ্ছা পূরন করবে কিন্তু সেটা যে এতো তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে সেটা সে বুঝতে পারেনি। এর মধ্য বাথরুম থেকে বের হয়ে গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে উজান দেখে সাঁঝ ফাইল হাতে নিয়ে সব কিছু দেখছে। তখন সে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে শ্বাস নিলো। সাঁঝ বললো

“এই জন্যই তুমি গত এক সপ্তাহ ধরে ছোটাছুটি করছিলে। এতো কম সময়ে এসব কিভাবে করলে? কিছু বুঝতেই দিলে না। দিনে দশ বার করে আমি উপরতালায় যাই তারাও আসে। কেউ আমাকে কিছুই বললো না। বুঝতেই দেয়নি তুমি এসব নিয়ে দৌড় ঝাপঁ করছো”।

উজান স্মিত হেসে বলে

” তাদের মেয়ে জামাই বলতে বারন করেছিলো তাই বলেনি। বললে কি এমন সারপ্রাইজ পেতে”?

সাঁঝ উচ্ছ্বসিত হয়ে জবাব দেয়

” না পেতাম না”।

উজান স্ত্রীর কাছে যায়। দুই হাত ধরে টেনে বুকের মধ্য জড়িয়ে নেয়। সাঁঝ একদম গিয়ে আছড়ে পড়লো উজানের বুকের উপর। উজানের স্পষ্ট হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে সে। অনেকটা দ্রুত গতিতে উঠানামা করছে। সাঁঝ বললো

” কিছু নিয়ে কি খুব চিন্তা করছো”?

উজান বলে

” হুম করছি। তোমাকে নিয়ে চিন্তা করছি। আমার আধা জীবনতো দেখতে দেখতে চলেই গেলো। বয়সতো আর থেমে নেই। সেদিন চুল চিরুনী করতে গিয়ে কয়েকটা পাকা চুলও দেখলাম। আর কয়েকদিন পরেতো বয়স বেড়ে গিয়ে আরও বুড়ো হয়ে যাবো। তার মধ্য বুড়ো বয়সে বিয়ে করলাম তোমাকে। হঠাৎ করে যদি ম’রে যাই তোমাকে কত ভোগান্তি পোহাতে হবে বলোতো”?

উজানের কথা সাঁঝের একদম পছন্দ হলো না। ঠিক যতটা আদর নিয়ে উজান তাকে বুকের মধ্য জড়িয়ে নিয়েছিলো ঠিক ততটাই রাগ আর বিরক্তি নিয়ে উজানের বুক থেকে সরে আসে সে। ক্ষিপ্ত হয়ে জোরে ধাক্কা দেয় উজানকে। উজানের এসব কথার জন্য থেকে থেকে প্রচন্ড রেগে যায় সাঁঝ। এর আগেও সে দুই তিনবার এগুলো বলেছে। কি বলতে চায় সে? সবসময় এই এক জায়গায় আটঁকে থাকে কেন? এতো হীনমন্যতা নিয়ে সংসার করার চেয়ে তার সংসার না করাই ভালো। সাঁঝ এতোটাই রেগে গেলো যে তার কিছু বলার ইচ্ছাও হলোনা। উজান সাঁঝের দিকে চেয়ে বুঝতে পারে তার বউ এর এই কথাগুলো মোটেও পছন্দ হয় নাই। সে চটে গেছে আর তার কপালে শনি আছে আজকে। আসলেই তার বয়স হচ্ছে। কি বলতে কি বলে ফেলে তার ঠিক নেই। সাঁঝ চলে যেতে নিলেই উজান তার হাত ধরে টেনে আবার বুকের মধ্য জড়িয়ে ধরে। সাঁঝ ফোস ফোস করে শ্বাস টানে আর উজানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। উজান ছাড়ে না বরং আরও আষ্টেপৃষ্টে মিশিয়ে নেয় বউকে। সাঁঝ নিজের আবেগ অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ফুপিঁয়ে কেদেঁ উঠে। উজান এর এবার নিজের উপর কপট রাগ হয়। চেয়েছিলো বউকে খুশি করতে এখন বউকে কাদিঁয়ে ফেলেছে। সাঁঝ কোন কথা না বলে কেঁদেই যাচ্ছে। তার কিছু বলার ইচ্ছাই হচ্ছে না এই মানুষটাকে। আজকে সব বিরক্তির সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে তার স্বামী। উজান কিছুটা সাহস করে বললো

” কেদোঁ না জান। আমিতো এমনি কথায় কথায় বলে ফেলেছি। আসলে বুঝোইতো তুমি আমার কমবয়সী বউ। আমার বয়স বাড়ছে আর তুমি দিন দিন কেমন সুন্দর হয়ে যাচ্ছো। এই জন্যই মজা করে বলেছি”।

সাঁঝ এর নিজের স্বামীর কথা মোটেও পছন্দ হলো না। সে আরও বেশি অসহনশীল হলো। টি শার্টের উপরেই উজানের বুকে দাঁত বসালো সে। উজান ব্যাথা পেলেও কিছু বললো না। উজান আবার বলে

” চুপ করে শুধু দাঁত বসালেই হবে? কথা বলো”।

সাঁঝ তখনো চুপ। সে কিছুই বলবে না। কোনো কথাই সে বলতে চায়না এখন। উজান পরে গেলো বিপাকে। শেষ চেষ্টা হিসেবে বউকে পাজাঁকোলে করে তুলে নিলো। সাঁঝ অবাক হয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে। উজান বিছানায় ফেললো সাঁঝকে। চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর এক গোছা চুল হাতের মুঠোতে নিয়ে সাঁঝের উপর ঝুঁকে গেলো সে। দৃষ্টি স্থির তার সাঁঝের গোলাপী ঠোঁটের উপর। বউয়ের ভেজা ঠোঁট দেখে উজানের কেমন নে”শা ধরে গেলো। উজান বললো

” সোনা পাখি কথা বলবে না আমার সাথে”?

সাঁঝ স্বামীর এই আদূরে স্বরের ডাক শুনে ভড়কে গেলো। এতো মোহনীয় গলায় বউকে ডাকছে যে মনে হচ্ছে কোন জাদু বলে আকৃষ্ট হচ্ছে সে। কেমন যেন সেও খেই হারিয়ে ফেললো। কিসের রাগ আর কিসের কান্না। তার চোখ দুটো এখনো ভেজা। উজান বউয়ের ভেজা চোখের পাতার উপর অনেকগুলো চুমু দিলো। তারপর ফোলা গালে আদর করলো। উজান আর বউয়ের কথার জন্য অপেক্ষা করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না নিজেকে। বউয়ের গোলাপী ঠোঁট তাকে বেহাল করে দিচ্ছে। হাতের আঙুল ছোয়ালো সে সাঁঝের ঠোঁটে। নাকে নাক ঘসলো। তারপর আর উজানের কিছু করতে হয়নি। যা করার সাঁঝ নিজেই করেছে। বউয়ের ভেজা অধরের আদর গভীরভাবে অনুভব করছে সে। সাঁঝ যেন দুনিয়ার সমস্ত অমৃত এই অধরে নিয়ে বসে আছে। সাঁঝ যেন উন্মাদ হলো। অধর এর সুধা উজানের কাছে মধু মনে হলেও পিঠে আর বুকে বউয়ের দেওয়া নখের আচঁড় তার অবস্থা কাহিল করে ফেললো। উজান বুঝলো বউ শোধ তুলছে। উজান বুঝতে না দিয়ে বললো

” সালোয়ার কামিজ পড়বে নাতো। আমি যতক্ষন থাকবো তখনতো আরও পরবে না। দরকার হলে তোমাকে প্রতি মাসে পাচঁটা করে শাড়ি কিনে দিবো। বউয়ের শাড়ির আচঁল টেনে না আদর করতে পারলে শান্তি পাইনা আমি। শাড়িতে তুমি আমাকে বেতাল করে ফেলো জানো তুমি? তুমি দিন দিন আমাকে এতো নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলছো কেনো? আমিতো এরকম ছিলাম না জান”?

সাঁঝ বলে,

” এর জন্য দায়ী তুমি নিজেই। আমিও এর ভুক্তভোগী। তুমি আমাকে এতো কষ্ট দাও কেনো? কি বুঝাতে চাও? আমি কম বয়সী বলে তুমি বুড়ো হয়ে গেলে আমি তোমাকে ছেড়ে চ্যাংড়া খুঁজবো? এই বিশ্বাস করো তুমি আমাকে? তুমি আমাকে ভালোই বাসোনা। বউকে ভালোবাসলে কেউ এই কথা বলে নারবার বউকে কষ্ট দেয় না”।

উজান সাঁঝের গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। আদর করতে করতে বলে

” আর কখনো এই তোমার এই অধম স্বামী এমন কথা বলবে না যাতে তার বউ কষ্ট পায়। তুমি আমার জান প্রাণ কলিজা আমার দুনিয়া সমস্ত কিছুই তুমি আমার। সোনা পাখি খুব বেশি কষ্ট পেয়েছো”?

সাঁঝ শক্ত করে আকড়ে ধরে স্বামীকে। নরম অভিমান নিয়ে বলে

“হুম ”

উজান বলে

” কিভাবে কষ্ট কমাবো তোমার জান”?

সাঁঝ বলে

” যতটা আদর করলে তুমি আমাকে তোমার আত্নার গভীরে মিশিয়ে নিতে পারো ততটা কাছে টেনে নাও আমাকে। তাহলেই কষ্ট কমবে “।

উজান কি বুঝতে পারলো সাঁঝ কি বলছে? উজান এর এতো ভাবতে ইচ্ছে করছে না। তার এখন গুরু দায়িত্ব বউ এর কষ্ট কমানো। সে মনে মনে আওড়ালো বউকে এসব কথা বলে কষ্ট দেওয়া যাবে না। বারবার একই ভুল করলে সেটাকে ভুল বলে না। সেটা হয়ে যায় স্বভাবের দোষ। বউকে কষ্ট দেওয়ার মতো স্বভাবের দোষ সে করতে চায়না। সাঁঝ তলিয়ে যাচ্ছে এক উজান নামক এক অতল সিন্ধুতে। এই সিন্ধুতে সে আজীবন ডুবে থাকতে রাজি কিন্তু এই সিন্ধু থেকে উঠে আসতে রাজি না। সে আরও ডুবতে চায়। আরও বেশি আরও গভীরে। কি আছে এই সিন্ধুতে এতো জানতে ইচ্ছে হয় কেন? এতো আকর্ষন করে কেন? এতো টানে কেনো? অনেক প্রশ্ন কিন্তু সাঁঝ এসব প্রশ্নের উত্তর কি নিজেও চায়?

অন্যদিকে

রায়হান অচেতন মিলিকে নিয়ে এসেছে হাসপাতালে। কাছেই প্রাইভেট হসপিটালের জরুরী বিভাগে নিয়ে এসেছে। জ্ঞান তখনো ফেরেনি মিলির। ডাক্তার দ্রুত তাকে নিয়ে ভেতরে চলে যায় পরীক্ষা করার জন্য। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে যা জানায় রায়হান এর গা কাপিঁয়ে তোলে। ডাক্তার বললো

” পেশেন্ট প্রচন্ড শক পেয়ে মেজর হার্ট এট্যাক করেছে। আগামী চব্বিশ ঘন্টা না যাওয়া অবধি কিছুই বলা যাচ্ছে না। অবস্থা ভালো না। উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করুন বেশি বেশি”।

রায়হান অস্থির হয়ে গেলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো। সে সাথে থেকেও একটা মানুষ এই রকম জীবন সংকটে পড়লো। মিলিকে রক্ষা করতে পারলো না। রায়হানের রাগে কপালের রগ নীল হয়ে গেলো। তার ইচ্ছে করছে আজাদকে এখনই শেষ করে ফেলতে।

চলবে………