নীল সাঝেঁর উজান পর্ব-০১

0
18

#নীল_সাঝেঁর_উজান
#পর্বঃ১
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

” আমি আমার ছেলেকে আবার বিয়ে করাবো। কোন অক্ষম বাজাঁ বউ এর জন্যতো নিজের বংশের বাতি দুনিয়াতে আসা বন্ধ রাখতে পারি না তাই না? বিয়ের চার বছর হতে চললো এখন পর্যন্ত নাতি নাতনির মুখ দেখতে পারলাম না। কমতো আর ডাক্তার দেখালো না আমার ছেলে। কিছু জিজ্ঞেস করলেই প্রতিবার সেই একই উত্তর ধৈর্য নিয়ে চেষ্টা করতে বলছে। বলি আর কত ধৈর্য ধরবো? এজনমে কি নাতি নাতনির মুখ দেখে দুনিয়া ছাড়তে পারবোনা?

কথাগুলো একদমে বলে থামলেন আমেনা বেগম। আজকে শুক্রবার ছুটির দিন বেলা বাজে সকাল আটটা। তার ছেলে আজকে বাসায় আছে। সকালবেলা নাস্তার টেবিলে বসে এইভাবেই রোষ ঝারছেন তিনি তার ছেলের বউ এর উপর। সমস্যা সেই একটাই বিয়ের চার বছরে এখন অবধি কোন সন্তান হয়নি তাদের। বিয়ের প্রথম বছর থেকে আমেনা বেগম ছেলের বউকে জোর করছিলেন সন্তান নেওয়ার জন্য। তার একমাত্র ছেলে উজান এর বিয়ে তিনি নিজে মেয়ে দেখে পছন্দ করে দিয়েছিলেন। ছেলের বউকে তিনি কোন অযত্ন অবহেলা করেননি বিয়ের প্রথম দুই বছর। কিন্তু বিয়ের চার বছরেও যখন খুশির সংবাদ তিনি শুনতে পারলেন না তখন সেই পছন্দের বউমা এখন চোখে বিধঁছে তার। রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছে তার ছেলের বউ ইশা। শান্ত স্থির মেয়ে সে। প্রথম দিকে এগুলো কথা খারাপ লাগলেও এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। গত দুইবছর ধরে শ্বাশুড়ির এই আচরণগুলো হজম করা নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে গেছে। তবুও চোখ উপচে আসা চোখের কান্নাটা আটকে কোনরকমে সেকাঁ রুটিগুলোর ঝুড়ি টেবিলে দিতে দিতে বললো

” আমরাতো প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি মা। ডাক্তার বলেছে কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো সেরে না উঠলে বাচ্চা হবে না। চেষ্টারতো কোন ত্রুটি রাখি নাই মা। আপনি গুরুজন হয়ে যদি সন্তানের দুঃসময় না বুঝেন তাহলে আমরা কিভাবে ধৈর্য রাখার সাহস পাই বলেন”?

ছেলের বউয়ের এই উত্তর শুনে যেন আরও তেতেঁ উঠলেন আমেনা বেগম। সাথে সাথে কণ্ঠে আগুন নিয়ে বললেন

” তা সমস্যা যখন তোমার তুমি রাস্তা ছেড়ে দাওনা মেয়ে। তোমার জন্যতো আমার ছেলের জীবন এমন সন্তান ছাড়া করে রাখতে পারিনা। আমার একটামাত্র ছেলে। তার সন্তান হবে নাতি নাতনিকে কোলে নিয়ে আদর করারতো আমাদেরও শখ আহ্লাদ হয় নাকি? তুমি আমার ছেলেকে আর এই সংসারকে ছেড়ে চলে যাও। তুমি থাকলে জীবনেও আমার ছেলে বাবা হওয়ার সুখ পাবে না। দ্রুত সিদ্ধান্ত নাও। আমি ঘটককে মেয়ে দেখতে বলবো”।

কথাগুলো বিনা দ্বিধায় কোন জড়তা ছাড়াই একনাগাড়ে বলে গেলেন উনি। ইশার বুক ফেটে কান্না আসতেছে। ছেলের মার দাবি থেকে না এক নারী হয়ে আরেক নারীকে তারই সামনে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের জন্য মেয়ে দেখার কথা বলতে একটুও লজ্জা লাগলো না তার। একটুও গলা ধরে আসেনি তার। শুধু নিজের খুশি টাই বড় হয়ে গেলো তার কাছে। সন্তানের মা কি তার হতে ইচ্ছে করে না নাকি সে রোবট যে তার নিজের কোন খারাপ লাগা থাকতে পারেনা। রিমা নিশ্চল পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্য তার স্বামী উজান নিজের ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। স্বামীকে দেখে ডিম ভাজার জন্য আবার রান্নাঘরে চলে গেলো সে। সকালের নাস্তায় রুটির সাথে ডিম ভাজা খুব পছন্দ উজানের। মন সায় না দিলেও স্বামীর জন্য আবার কাজে মন দিলো সে। উজানকে আসতে দেখে আমেনা বেগম আবারও বিলাপের সুরে কথা বলতে লাগলেন

” বাপ উজান এভাবে আর কতকাল কত বছর যাবে? আমার দশটা না পাচঁটা না একমাত্র ছেলে তুই। আর কতদিন নিঃসন্তান থাকবি? এই অপয়া বউরে ছেড়ে দে। আমি তোর জন্য ভালো সুস্থ মেয়ে দেখছি কয়েকজন। তুই রাজি থাকলে আমি কথা বলবো তাদের সাথে। রাজি হয়ে যা বাপ। আমারও তোর ঘরে ছেলে মেয়ে দেখে যেতে ইচ্ছা করে”।

উজান একপলক রান্নাঘরে কাজ করতে থাকা তার বউ এর দিকে তাকালো। ইদানীং বেশ গরম পড়েছে। যাকে বলা ভাপিঁয়ে ওঠা গরম। মাথার উপরে ফ্যান সারাক্ষণ চললেও গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যেতে হয় এমন গরম। মেয়েটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মনটা খারাপ তিক্ত কথার বাণে। শ্বাশুড়ির আচরণে দগ্ধ হয়ে গেছে সে। নিজের মা কে দেখলে মাঝে মাঝে খুব অচেনা লাগে তার। ভাবতেই অবাক লাগে যে ছেলের বউ সে নিজে পছন্দ করেছিলো। ইশা আলুভাজির বাটি আর ডিম ভাজার প্লেটটা উজানের সামনে রাখলো। উজান স্ত্রীকে দেখলো সে ঘেমে একদম চুপচুপে হয়ে গেছে। ইশাকে বললো

” আর কিছু করতে হবে না। বসো এখন। নাস্তা করো। অনেক বেলা হয়ে গেছে। একটু ফ্যানের নিচে বসে ঠান্ডা হও। এখানকার ফ্যানের স্পিড এতো কম এতোদিন বলোনি কেন? ফ্যানটা অনেকদিনের পুরনো। এই গরমে এটা দিয়ে আর কাজ চলবে না। ভালো দেখে নতুন কিনতে হবে। আজকে বিকালে আমার সাথে বের হবে নতুন ফ্যান কিনে নিয়ে আসবো। আমাদের ঘরের টাও দেখলাম কেমন আস্তে ঘোরে। মা তোমার ঘরের ফ্যান এর কি অবস্থা”?

আমেনা বেগম ছেলের এই গা ছাড়া ভাব দেখে বললেন

” আমার ঘরে ফ্যানের কোন প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন নাতি নাতনির মুখ দেখা। তুই আগে আমার কথার উত্তর দে। কি সিদ্ধান্ত নিতে চাস”?

উজান মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে স্মিত হাসলো তারপর বললো

” তোমার ছেলেকে আরেকটা কেন দশটা বিয়ে দিলেও তোমার নাতি নাতনি দেখার শখ পূরন হবে না। এই না মেটা শখ আর আক্ষেপ নিয়েই হয়তো তোমাকে আমাকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে “।

আমেনা বেগম ছেলের কথা কিছুই বুঝতে পারলেন না। সমস্যা যখন তার ছেলের বউ এর তখন কেন আরেক বিয়ে করালে ছেলের সন্তান হবে না। তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন ছেলেকে।

“কি বলতে চাস তুই”? কেন আরেক বিয়ে করলে তোর ঘরে সন্তান হবে না? সমস্যাতো তোর বউয়ের।

উজান কোন ভনিতা ছাড়াই বললো

” ভুল জানো তুমি। ইশা তোমাকে এতোদিন মিথ্যা বলেছে। সমস্যা তোমার ছেলের বউয়ের না। সমস্যা তোমার নিজের পেটের ছেলেরই। তোমার ছেলেই সন্তান জন্মদানে অক্ষম। শুরুতে তাও একটা আশার কথা বলেছিলো ডাক্তার। গত রিপোর্টে সেই আশাটাও আর নেই। তোমার ছেলে কখনোই বাবা হতে পারবে না। কোন মেয়েকে মা হওয়ার সুখ তোমার ছেলেই দিতে পারবে না। তাই পরের বাড়ির মেয়েকে এতোদিন বিনা কারণে যে অভিযোগগুলো করে রোষ দেখিয়েছো তার জন্য তোমার ক্ষমা চাওয়া উচিত ইশার কাছে”।

ছেলের কথা শুনে পুরো হতভম্ব হয়ে গেলেন উনি। কি সব আজেবাজে কথা বলছে তার ছেলে। বংশের প্রথম ছেলে সন্তান সে তার দাদার দিকের। তার দাদার বাড়ির কারোতো এমন কিছু সমস্যা ছিলো না। তার স্বামীর আরও চার ভাই আছে। তাদেরও সন্তান আছে। কারোতো এমন সমস্যার কথা আজ অবধি শোনেনি সে। সেতো জেনে এসেছে মেয়ে মানুষ এর যত সমস্যা হয়। পুরুষ মানুষ যে অক্ষম হয় সে কখনো শোনেওনি দেখেও নি। আমেনা বেগম অবিশ্বাসের গলায় বললেন

” মিথ্যা বলছিস তুই। একদম বিশ্বাস করিনা তোর কথা। আমার ছেলে একদম সুস্থ। হুষ্ট পুষ্ট জোয়ান তরতাজা ছেলে আমার। তার এমন কোন অক্ষমতা থাকতেই পারে না। তুই তোর বউয়ের দোষ ঢাকতে মিথ্যা কথা বলছিস। কি ভেবেছিস মা কিছু বুঝবে না। মা সবই বুঝে। আমার ছেলের কোন সমস্যা নাই। তুই একদম চিন্তা করিস না আমি তোকে আরও ভালো দেখে বয়স কম এমন মেয়ে দেখে বিয়ে দিবো। আমার ছেলে অবশ্যই সন্তানের বাবা হতে পারবে “।

উজান বুঝলো তার মাকে বিনা প্রমাণে বুঝিয়ে লাভ নাই। সেকেলের মানুষের মধ্যে আজকের দিনের আধুনিক যুগের জ্ঞানের কথাগুলো মাথায় ঢুকবে না। তাকে রিপোর্ট দেখিয়েও লাভ নাই। সেটাও বলবে মিথ্যা। অবস্থা বেগতিক দেখে ইশা বললো

” থামো না। সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে বসে খাওয়া বাদ দিয়ে কি শুরু করলে তোমরা”?

আমেনা বেগম রেগে উঠে তড়িৎ গতিতে বললেন

” এই মেয়ে আমার ছেলেকে কি জাদু করেছো যে তোমার দোষ নিজের উপর নিচ্ছে? কি মন্ত্র পড়িয়েছো বলো। কান খুলে শুনে রাখো আমি আমার ছেলের কোন কথা শুনবো না। আমি এক সপ্তাহের মধ্য তোমাকে বিদায় করে আরেক বউ ঘরে আনবো”।

উজানও মায়ের কথায় কি প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝে উঠতে পারলো না। এতো বুঝানোর পরেও সেই একতরফা ইশাকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। উপায়ন্তর না পেয়ে শেষে যে ডাক্তারকে তারা শেষবার কন্সাল্ট করেছিলো তাকে ফোন করলো। কিছুক্ষণ রিং হয়ে ফোন রিসিভ করলেন ডাঃ এহসান রহমান ইনফার্টিলিটি স্পেশালিষ্ট। উজান প্রথমেই সালাম দিয়ে ক্ষমা চাইলো এতো সকালে ফোন করার জন্য। সে বললো

” ডাক্তার আমার মাকে আমি আমার সমস্যার কথা বুঝিয়ে বলতে পারছি না। তিনি মনে করছেন আমি তাকে মিথ্যা কথা বলছি। উনি আমার স্ত্রীকেই দোষারোপ করছেন। আমি ফোন স্পিকার অন করেছি। উনি সামনেই আছে। কষ্ট করে যদি তাকে বুঝিয়ে বলতেন ভালো হতো”।

ডা এহসান বিনয়ের সাথে আমেনা বেগমকে সালাম দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন

” খালাম্মা শুনতে কষ্টকর এবং তিক্ত হলেও সমস্যাটা আসলে আপনার ছেলেরই। আপনার ছেলের স্বাভাবিক পুরুষ মানুষ এর চেয়ে তার পুরুষ প্রজনন ক্ষমতা অনেক কম। এটাকে ডাক্তারি ভাষায় পুরুষ বন্ধ্যাত্ব বলে। উনার স্ত্রী মিসেস ইশার কোন সমস্যা নেই। তিনি একদম সুস্থ আছেন। আসলে এটি কোন রোগ নয়। এটি এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা যা বাচ্চা হতে সাহায্য করছে না। উনার সবগুলো রিপোর্ট ভালো করে ব্যাখা বিশ্লেষণ করেই এই ফলাফল এসেছে যে উনি কখনো বাবা হতে পারবে না। আপনি শান্ত হয়ে বুঝার চেষ্টা করেন আর ধৈর্য রাখেন “।

উজান ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন কেটে দিলো। তারপর মাকে বললো

” এখন বিশ্বাস করেছো? এখনতো ডাক্তার নিজে বুঝিয়ে বললো”।

আমেনা বেগম থ মেরে চেয়ারে বসে আছেন। এতোদিন ছেলের বউয়ের দোষ ভেবে কত তিতা কথা সে মেয়েটাকে বলে এসেছে। কোন প্রতিবাদ সে করেনি। অথচ তার করার কথা ছিলো। সব চুপচাপ হজম করে এসেছে। এক বুক আক্ষেপ নিয়ে তিনি বিরবির করতে করতে নিজের ঘরের দিকে গেলেন

” আমার ছেলে কোনদিন বাবা হতে পারবে না। আমার নাতি নাতনি হবে না। সে বাবা হওয়ার সুখ পাবে না। আল্লাহ কোন দোষে এই শাস্তি দিলে তুমি? আল্লাহ ও আল্লাহ”। আমার ছেলেটা!!

চলবে………