নীল সাঝেঁর উজান পর্ব-০২

0
23

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ২
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

“কি দরকার ছিলো মাকে এমুহূর্তে এসবকিছু বলার? তাকেতো পরেও ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলতে পারতে? নাস্তা না করেই উঠে চলে গেলো। এখন এর জের ধরে সারাদিন কিছু মুখে তুলবেন কিনা কে জানে”?

ইশা চোখে মুখে চিন্তা এবং হতাশার ছাপ স্পষ্ট করে কথাগুলো বললো। গত দুবছর ধরে তার শ্বাশুড়ি তাকে কথা দিয়ে অনেকভাবেই হেয় করেছে দোষী সাব্যস্ত করেছে। কথার খোচাঁ এতোই তীক্ষ্ণ এবং সূচালো যে যা রুহ অবধি গেথেঁ গেছে তার। তবে আজকে কেন জানি অনেকটা হালকা লাগছে। রোজ রোজ এতো অশান্তি এতো কথার অপমান ভালো লাগেনা তার। মনে মনে একটু হলেও শান্তি লাগছে এই ভেবে উজান আজকে কথাগুলো স্পষ্ট করে বলে ভালো করেছে। উজান ইশার দিকে বেশ ভালো করে লক্ষ্য করে বললো

” প্রথম দিন যখন ডাক্তার রিপোর্ট দেখে ফলাফল বলেছিলো সেদিনই তাকে এসে সব বলা উচিত ছিলো। বলতে অনেকটা সময় নিয়েছি আমরা। তোমারও হয়তো স্বামী সম্পর্কে রোজ রোজ নিজের মায়ের কাছে কটু কথা শুনতে ভালো লাগে না। তেমনি আমারও আর ভালো লাগছিলো না। ভেতর থেকে সবকিছু দমবন্ধকর লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো কত বড় পাথর মাথার উপর চেপে আছে”।

ইশা অবাক হয়ে গেলো স্বামীর কথা শুনে। তার মা প্রতিদিন তাকে ফোন করে বলে এই সংসার ছেড়ে চলে যেতে। উজানকে তালাক দিতে বলে। আরও কত কি বলে মুখে যা আসে কিন্তু এসবতো তার স্বামীর জানার কথা না। কারণ সে কখনোই এসব কিছু নিয়ে তার সাথে কিছু বলেনি। উজান তার অবাক হওয়া চোখমুখ দেখে বললো

” অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি এতোটাও অবুঝ নই যে কিছুই বুঝবো না। তোমাকে দুই বছরে কমপক্ষে দুইশতবার বলেছি সবকিছু সামনে নিয়ে আসতে। দুই পরিবারের মধ্য বিষাক্ততা বেড়ে যাওয়ার আগে একটা সমাধানে আসতে। কিন্তু তুমি বলছিলে আরও কয়েকজন ডাক্তার দেখিয়ে যেন কিছু বলি তাদের। এখনতো সেটাও হয়ে গেছে। সবগুলো ডাক্তারের পরামর্শ এবং বিশ্লেষণ একই। তাই আজকে মাকে জানানো ভুল কিছু হয়নি। আরও বিরুপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগে এই ধাক্কাটা নিতেই হতো তাকে। সবসময় নিজে যা ঠিক মনে করে এসেছে সেটাই করেছে। কারো সিদ্ধান্তের পরোয়া করেনি। এটাও ভাবেনি তার করা আচরণ এর জন্য অন্য মানুষের কতটা কষ্ট হতে পারে”।

প্রচন্ড হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস নিলো সে। তার মা নিজের জেদের জন্য বরাবরই এরকম অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার বয়স যখন সতেরো তখন তার বাবা গত হয়। উচ্চমাধ্যমিক এর ছাত্র ছিলো তখন। প্রায়ই দেখেছে বাবাকে তার মার আচরণ নিয়ে কষ্ট পেতে। কিন্তু সংসারে অশান্তি হবে বলে তার নিরীহ বাবা সবসময় এসব এড়িয়ে যেতেন। বাবার রেখে যাওয়া টাকা পয়সা দিয়ে দিব্যি চলে গেছে তাদের। অর্থনৈতিক কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি তাদের। মাথার উপর থাকার মতো ছাদ থাকায় অভাব কি জিনিস তারা সেভাবে উপলব্ধি করেনি। অভাব ছিলো বাবা না থাকারই শুধু। মায়ের এই স্বভাবের কারণে সেও জীবনে অনেক অশান্তি ভোগ করেছে। তার প্রায়শ্চিত্ত তাকে হয়তো নিজের জীবন দিয়ে সারাজীবন করে যেতে হবে। তবুও মা হয় তার জন্ম দিয়েছে তাকে। তার জীবদ্দশায় কোন অবহেলা অযত্ন হেলা করা যাবে না। উজানকে চুপ করে থাকতে দেখে ইশা বললো

” আচ্ছা উজান যদি সত্যিই সমস্যাটা তোমার না হয়ে আমার হতো তাহলে মা যা একটু আগে বললো তুমি কি তাই করতে? আমাকে ছেড়ে দিতে বা আমাকে রেখেই আরেকটা বিয়ে করতে”?

ইশা অনেকদিন এই প্রশ্নটা করতে চেয়েছে স্বামীকে। কিন্তু তার মন খারাপ হতে পারে ভেবে করেনি। কিন্তু আজকে না করে থাকতেও পারছিলো না। উজান বললো

” তোমার কি মনে হয় কি করতাম আমি”? পাল্টা প্রশ্ন করে উজান।

ইশা একটু ভেবেই বলে

” তুমি মন থেকে না চাইলেও মায়ের কথার সাথে না পেরে রাজি হয়েই যেতে। তবে সেটাকে তোমার সায় আছে এমন কিছু বলবো না। পরিস্থিতির চাপেই বিয়েটা হয়তো করতে তুমি “।

উজান একটু ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। এই মেয়েটা শান্ত স্থির সহজ সরল তবে অনেক বুদ্ধিমান। সে বললো

” মা যে তোমাকে বললো এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার বিয়ে করাতো ঠিক সেটাই করতো সে এবং আমি করতামও। তবে এখানে একটা বিষয় হচ্ছে পরিস্থিতির চাপে পরে না। নিজের আগ্রহ এবং ইচ্ছা থেকেই বিয়েটা করতাম। মানুষের মধ্যে একটা কথা খুব প্রচলিত আছে জানো পরিস্থিতির চাপে পরে নাকি তারা বিয়ে করে। এইটা একদম ভুল কথা অন্তত পুরুষ মানুষ এর জন্য। পুরুষ মানুষ নিজে না চাইলে তাকে কখনো কেউ বিয়ে করাতে পারেনা। সে চায় বলেই বিয়েটা তার ইচ্ছেতেই হয় নয়তো কারো সাধ্য নেই তাকে জোর করার”।

উজানের কথা শুনে ইশা আরেকদফা চমকে উঠলো। জীবন সংসার এতো তুচ্ছ এতো নগন্য। যতক্ষণ সে টানতে পারে ততক্ষন সে থাকবে অকেজো হয়ে গেলেই তার প্রয়োজন শেষ। অথচ এই সংসারটাকে আগলে রাখতে কত কিছুর সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। ইশা আহত স্বরে বললো

” আমার প্রয়োজন তাহলে কি দাড়াঁতো তোমার সংসারে শুধু নিজের সবটা দিতে পারাটাই? আর দিতে না পারলে এভাবে ছুড়েঁ ফেলে দিতে”?

উজান বুঝতে পারলো কথার গভীরতা এখন অন্যদিকে যাচ্ছে এবং এটা হওয়ারই ছিলো। পরিস্থিতি সামনে আরও অনেক কিছুই করাবে। এইটাতো মাত্র শুরু। বিচলিত হলো না সে। সেও স্পষ্ট করে জবাব দিলো

” আমার প্রয়োজনটাও তোমার জীবনে তেমন কিছুই। তোমার মা-বাবাও তোমাকে বিগত দুই বছর ধরে এটাই বলে আসছে। কথাগুলোর ধরন একই বলা যায় বুঝে নিলে”।

ইশা চুপ হয়ে যায়। এই কথার বিপরীতে আর কোন কথা মাথায় আসছে না তার। আসলেই তার বাবা-মা এগুলোই বলে।পরিস্থিতিটাই এমন। সামনে তারা আর কোন আশা দেখতে পাচ্ছে না শুধু হতাশা ছাড়া। উজান বললো

” বিকেলে তৈরী হয়ে থেকো। একটু কেনাকাটা করা প্রয়োজন ঘরের জন্য”।

ইশা চুপচাপ হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে রান্না ঘরে চলে যেতে নেয় দুপুরের খাবার আয়োজন করতে। উজান তাকে পিছু ডেকে বলে

“ইশা”?

ইশা থেমে যায়। আবার সামনে ফিরে সে। উজান তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উজান বললো

” মাকে এখন একা থাকতে দাও। তাকে এই পরিস্থিতির সাথে ধাতস্থ হতে দাও। নিজে থেকে কিছু বলার বা বুঝানোর চেষ্টা করবে না। এমনকি দুপুরে খাওয়ার জন্যও তুমি তাকে ডাকবে না। খাবার সময় আমি তাকে ডাকবো দরকার হলে। মানসিকভাবে তাকে প্রস্তুত হতে দাও সবকিছুর জন্য “।

ইশা বললো

” উনি ডায়বেটিকস এর রোগী। না খেয়ে থাকলেতো সমস্যা হবে “।

উজান উত্তর করলো

” মার নিজের সেই চিন্তা আছে। রোগ যার মাথা ব্যাথাটাও তার। মানুষের উপর নজরদাড়ি কিভাবে করতে হয় সে খুব ভালো করেই জানে। এই নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা নিজের কাজে মন দাও “।

ইশা চলে যায় সেখান থেকে। উজানও ঘরে ফিরে এসে ফোন হাতে নিয়ে কাউকে কল দেয়। রিং বাজতেই একটু পর ফোন রিসিভ হয়। উজান বললো

” কাজ শেষ হতে আর কতদিন লাগবে”?

ফোনের অপরপাশের মানুষটি তাকে কিছু বুঝালো। তারপর উজান আবারও বললো

” যত দ্রুত সম্ভব কাজটা করতে। সে আর দেরি করতে চায়না। সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছে পরিবর্তন করার সুযোগ আর নেই।

ফোনের ওপাশের ব্যক্তি আরও কিছু কথা বললো তাকে। দুজনের মধ্য বেশ কিছুক্ষণ কথা হওয়ার পর ফোন রেখে দেয় উজান। ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় যায়। কিছু গাছ আছে তার এখানে টবে লাগানো। গাছগুলো শাখা প্রশাখা বেড়ে বড় হয়ে গেছে। ছেটেঁ দেওয়া প্রয়োজন। সে সরঞ্জাম নিয়ে এসে গাছের আগাছা পরিষ্কার করতে শুরু করে। তারপর হাত ধুয়ে এসে বুকশেলফ থেকে শীর্শেন্দুগুন মুখোপাধ্যায়ের পার্থিব বইটি বের করে। অনেকদিন কোন বই পড়া হয় না। ব্যস্ততার জন্য অনেক বই এভাবে জমে গেছে। সেই সাথে পড়তে নিলেও ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। তবে আজ পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে তার। দেখা যাক কতদূর পড়া যায়। এই ভাবতে ভাবতে বেশ অনেকখানি বই পড়ে ফেলেছে সে। যখন উঠলো দেখলো যোহরের আজান এর সময় হয়ে গেছে প্রায়। সময়মতো তৈরী হয়ে মসজিদে গেলো। নামায পড়ে এসে দেখে ইশা টেবিলে দুপুরের খাবার দিয়ে দিয়েছে। টুপিটা রাখতে যাওয়ার জন্য ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ইশাকে প্রশ্ন করে

” মা দুপুরে গোসল সেরেছে ?পরে আর কিছু বলেছে”?

ইশা বললো

” হ্যাঁ। খাবার ঘরে দিয়ে আসতে বলেছে। নামায পড়ে সেখানেই খাবে বললো”।

উজান হাসলো। সে তার মাকে চেনে। মানুষ অভ্যাসের দাস। মানুষ এর উপর নিয়ন্ত্রণ করা যার অভ্যাস সে কখনো এতো অল্পতে ভেঙ্গে পড়ে না। তবে সে যাতে নিজের ভুল বুঝতে পারে এটার জন্যই সময় হয়ে গেছে কিছু করার। দুপুরে খাবার শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারা বাহিরে চলে যায় যেমনটি উজান আগেই বলেছিলো। ঘরের জিনিসপত্র কেনার কথা ছিলো তাদের। কিন্তু তারা সেদিকে যাচ্ছে না। রিক্সাওয়ালাকে বললো ধানমন্ডি লেক যেতে। মোহাম্মদপুর থেকে ধানমন্ডি লেক যেতে তাদের সময় লাগলো প্রায় চল্লিশ মিনিট এর মতো। শুক্রবার দিন ভীঁড় বেশি রাস্তায়। যদিও ধানমন্ডি লেকেও অনেক ভীঁড় থাকে। তবুও হাটঁতে হাটঁতে নিরিবিলি জায়গা দেখে বসলো তারা। ইশা বললো

” এখানে আসলে যে? ঘরের জন্য কেনাকাটা করতে চাইলে”।

উজান ইশার মুখোমুখি হয়ে বসে আছে। সে ইশাকে এখন এমন কিছু বলবে যেটা তার অনেক আগেই বলা উচিত ছিলো। উজান বললো

” ঘরের জন্য ফেরার পথেও কেনাকাটা করা যাবে। কিন্তু এখন তোমাকে কিছু কথা বলার আছে”।

ইশার মুখে চিন্তার ছাপ। তাদের চার বছরের সংসারে উজান কখনো এভাবে কিছু বলার জন্য বাইরে নিয়ে আসেনি তাকে। ইশা খুবই বিচলিত হয়ে পড়লো। সে বললো

” কি এমন কথা “?

উজান কোন ভনিতা না করেই বললো

” একটা অন্যায় যেটা মা আর আমি মিলে করেছিলাম “।

চলবে…………..