#নীল_সাঝেঁর_উজান
#পর্বঃ৩
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
“একজন পুরুষ মানুষ এর জন্য সবচেয়ে বড় পরাজয়ের দিন কোনটা জানো ইশা”?
উজান প্রশ্ন করে ইশাকে। ইশা এই মুহুর্তে খুবই নড়বড়ে অবস্থায় আছে। মাথায় অনেক কথা অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তার। তার মধ্য উজানের এমন প্রশ্ন শুনে মনের মধ্য আরও বেশি খচখচ করছে। ইশা চিন্তিত হয়ে বলে
” কোনদিন”?
উজান স্মিত হেসে উত্তর করে
” যেদিন সে নিজের বিবেকের কাছে হেরে গিয়ে জেনেশুনে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যায় হচ্ছে জেনেও চুপচাপ মেনে নেয়। অনুশোচনায় পুড়তে পুড়তে ভেতর থেকে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে গেলেও যখন বোবা আর্তনাদ কাউকে শোনাতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে চুপ হয়ে যায় তখন একজন পুরুষ মানুষ নিজের পরাজয় স্বীকার করে। আজ থেকে চার বছর আগে আমিও এমন করে নিজের বিবেক বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে নিজের মায়ের জেদ মেনে নিয়ে একটা অন্যায় করেছিলাম। সেটাকে শুধু অন্যায় বললে ভুল হবে সেটা একটা ঘোর পাপ ছিলো। আমি ঠকিয়েছি, বিশ্বাস ভেঙেছি সাথে সব স্বপ্ন শখ আহ্লাদ সেই সাথে একজন মানুষের নির্ভেজাল ভালোবাসাকে অপমান করেছি। একটা কোমল হৃদয় ভেঙেছি। এতো কৃতকর্মের ফলতো প্রকৃতি আমাকে দিবেই। সেতো যা আমরা করি তার দ্বিগুণ আকারে ফেরত দেয়”।
ইশা এক ধ্যানে উজানের কথা শুনছিলো। তার বুক কাঁপছে হাত পা কেমন অসাড় লাগছে মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। এগুলো কি বলছে উজান সে বুঝতে পারছেনা। কার সাথে অন্যায় করেছে বিশ্বাস ভাঙার মতো পাপ করেছে। সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। বিয়ের এতো বছরে স্বামীর গোপন কথা শুনতে কোনো মেয়েরই ভালো লাগবে না তবুও উজান এর কথা শুনতে হবে। ইশা কোনরকমে স্থির গলায় বললো
” কার সাথে করেছেো এমন কিছু”?
উজান বললো
” তুমি আমার জীবনে আসা প্রথম নারী নও ইশা। তোমাকে কখনো ভালোবাসতে পেরেছি কিনা জানিনা তবে চেষ্টা করেছি স্বামী হিসেবে সব দায় দায়িত্ব পালন করার। চেষ্টাও করেছি পুরনো দিনের করা যত কিছু আছে সব ভুলে তোমাকে ভালোবাসার। কিন্তু আমি বারবার ব্যর্থ হয়েছি। প্রতিদিন সকালে যখন আয়নায় নিজেকে দেখি তখন আমার মনে হয় আমি একজন অমানুষ একজন অপরাধী যার বেচেঁ থাকা জীবনের সমস্ত কাজ প্রশ্নবিদ্ধ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমার একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। আমি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পড়লেও তার বিভাগ ছিলো আলাদা। সে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিল। তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ভার্সিটির পিঠা উৎসবে। তখন শীতকাল যাবে যাবে ভাব বসন্ত আসবে এমন সময়। একটা মেয়ে নীল জামদানি শাড়ি পড়ে খোপায় বেলিফুলের বড় গাজরা দিয়ে এক গাছি নীল চূড়ি পড়ে নিজেদের দেওয়া স্টলে পিঠা বিক্রি করছিলো। বন্ধুদের সাথে আমিও গেলাম। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। কিন্তু তাকে প্রথম দেখেই চোখ আটকে যায়। তারপর আর কিছু দেখতে শুনতে ভালো লাগছিলো না। কিন্তু অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ হওয়াতে বেশি মানুষের মধ্যে থাকতে আমার বরাবরই ভালো লাগে না। তাই সেদিন কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম সে আমাদের সেশনেই আমার ব্যাচমেট। আমরা সমবয়সী ছিলাম। তখন আমরা সবে মাত্র সেকেন্ড ইয়্যারে পড়ি। এরপর তার প্রতি আমার আলাদা একটা আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা। কখনো লাইব্রেরিতে আবার কখনো ক্যান্টিনে। এই আগ্রহ থেকে কবে যে তাকে মন দিয়ে বসেছিলাম বুঝতেই পারিনি। ফোনের যুগ হলেও তার ফোন নাম্বার, ফেসবুক আইডি কিছুই জানতাম না। আমার এক বন্ধুকে বিষয়টা সাহস করে বলেছিলাম। সেই বন্ধুই আমার বলতে দেরি কিন্তু তার এগুলো বের করে আমাকে দিতে দেরি হয়নি”।
“তার নাম কি ছিলো”? ইশা অনেক কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে
উজান বললো
“তাসনিম ছিলো ওর নাম। এক কোমল মনের অধিকারী। যে হাসতে ভালোবাসতো, গুনগুন করে গান গাইতো, রান্না করতে ভালোবাসতো,ভোরের শিউলি ফুল কুড়োতে পছন্দ করতো আর শাড়ি পড়তে ভালোবাসতো। জামদানি শাড়ি ছিলো তার খুব পছন্দের। টাংগাইলের মেয়ে কিনা। ভার্সিটিতে পড়া অবস্থাতেই তার একটা শাড়ির অনলাইন ব্যবসা ছিলো। ভার্সিটিতে যেকোন ছুতো পেলেই মেয়েরা শাড়ি পড়ে। এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে সে জামদানি শাড়ি নিয়ে কাজ করতো। তার সাথে আমার আলাপের ছুতোয় তৈরী হয় মায়ের জন্য শাড়ি কেনার বাহানায়। মায়ের জন্য একটা হালকা মিষ্টি রঙয়ের শাড়ি কিনেছিলাম তার পেইজ থেকে । সেই শাড়ি ও নিজেই আমাকে ডেলিভারি করার জন্য এসেছিলো। যেহেতু ক্যাম্পাসের মধ্যই। যেদিন শাড়ি ডেলিভারি করেছিলো সেদিন টাকার খামের সাথে সাহস করে একটা চিঠিও তাকে দিয়েছিলাম। চিঠিটা ছিলো প্রেম নিবেদন গ্রহণ করার জন্য। তারপর আর কি প্রায় একমাস হয়ে যাওয়ার পরেও যখন নিবেদন গ্রহণ হয়ে কোন ফিরতি চিঠি আসলো না তখন নিজেকে বুঝ দিলাম আমি হয়তো তার প্রেমিক হওয়ার যোগ্য নই। তারপর হঠাৎ একদিন ফোনে মেসেজ আসলো ক্যাম্পাসের প্যারিস রোডে একটা জায়গায় অপেক্ষা করতে হবে। সে আসবে। কিছু কথা আছে। মনে আশা জাগলো এই বুঝি প্রেম নিবেদন গ্রহণ হয় এবার। আমার ধারণা সত্যি করেছিলো সে। তবে শর্ত ছিলো মায়ের জন্য তার কাছ থেকেই শাড়ি কিনতে হবে। পরবর্তী চার বছর খুব সুন্দর প্রণয়ের দিনগুলো চলে যাচ্ছিলো। কত আশা কত স্বপ্ন একটা সুন্দর সংসারের কথা বলেছিলো আমাকে। পাশ করার পরেই আমি এখানে ওখানে চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছিলাম যাতে ওর কথা বাসায় বলতে পারি। তখনও আমার বাংলাদেশ ব্যাংকে এই চাকরিটা হয়নি। একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি হলো। এবার ভাবলাম বাসায় বলবো। আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ইতিমধ্যে তাসনিম বেশ কয়েকটা ভালো পাত্র থেকে আসা বিয়ের কথা বাদ দিয়েছে। আমিও তাকে অপেক্ষা করতে বলেছি। কিন্তু একটা সিদ্ধান্ত সব তছনছ করে শেষ করে দিয়েছে”।
ইশা বলে “কি সিদ্ধান্ত”?
উজান একটা দ্বীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে বলে
” মার তোমাকে বউ করে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত। তার তোমাকে ছোট খালার কোন এক অনুষ্ঠানে দেখে পছন্দ হয়েছিলো। তারপর তোমার বাড়িতে পাকা কথা দিয়েছে। শুধু আমার চাকরি পাওয়ার অপেক্ষা ছিলো। তবুও বিরোধিতা করে তাসনিমের কথা বলতেই বলেছিলো সমবয়সী মেয়েরা স্বামীকে সম্মান করে না, শুধু ঝগড়া করে। শ্বাশুড়িকে মান্য করবে না। এজন্য সে বয়সে ছোট মেয়ে দেখেছে ছেলের জন্য। সমবয়সীরা নাকি বেশি বুঝে। স্বামীহারা বিধবা শ্বাশুড়িকে দেখবেনা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে। ছেলের কান ভাঙিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে। সে পাকা কথা দিয়ে এসেছে। বিয়ে ওখানেই করতে হবে। কথার বরখেলাপ করা যাবে না। স্বামী চলে যাওয়ার পর ছেলেকে একা হাতে কষ্ট করে মানুষ করার দাবি নিয়ে সে আমাকে বলেছিলো সে ঘরকুনো মেয়ে চায় শাড়ির ব্যবসা করে এমন মেয়ে চায় না। আরও কত শত আবেগী কথাবার্তা কত দিব্যি”।
ইশার বুকটা ভার হয়ে আসে। এখন বুঝতে পারে কেন উজান বিয়ের আগে তার সাথে একবারও কথা বলতে চায়নি তাকে দেখেওনি। সরাসরি বিয়ের দিন গিয়ে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে তাকে। উজানের সাথে তার সংসার শুরু হওয়া এবং দাম্পত্য জীবনের শুরুটা একটু অন্যরকমই ছিলো। সহজ হতে পারেনি অনেকদিন উজান। দুজনের বোঝাপড়াতেও সময় লেগেছিলো অনেক। এখনোতো তারা দুজন দুজনকে বুঝতে পারে না। ইশা বললো
” তারপর কি হয়েছিলো”?
উজান বললো
” শুধু একটা ফোনকল করে ভেঙে দিয়েছিলাম পাচঁ বছরের সম্পর্ক। একটা মানুষকে ভেঙে দিয়েছি তার আশা, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাকে অপমান করেছি। বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছি। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করেছি। নিজের মায়ের ভালো মন্দ দোষগুণতো আর তাকে বলে মাকে ছোট করতে পারি না তাই বলেছি তাকে এখন আর আগের মতো ভালো লাগে না বুড়িয়ে গেছে সে। আগের মতো তার প্রতি সেই আবেগ অনুভূতি আর টানে না। বিয়ের জন্য সে আমার যোগ্য না”।
“তাসনিম কিছু বলেনি “? ইশা ধরা গলায় বলে
উজান বললো
” সে শুধু একটা কথায় বলেছিলো আমার মতো অযোগ্য কাউকে জীবনে জড়ানোর চেয়ে তোমার যাকে যোগ্য মনে হয় তাকেই বেছে নিও। শুধু নিজের অযোগ্যতা বুঝতে জীবন থেকে সেরা পাচঁটা বছর অপাত্রে চলে গেলো এটাই তার আফসোস হয়ে থাকবে”। সেদিনের পর তার সাথে সমস্ত রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু সেদিন অফিস শেষ করে ফেরার পথে সুপারশপে বাজার করতে গিয়ে তাকে আমি দেখেছি। স্বামীকে নিয়ে বাজার করতে এসেছে। সাথে দুটো ছোট বাচ্চা। এক ছেলে এক মেয়ে জমজ মনে হলো। দুবছর হবে হয়তো। আমাকে দেখেনি বা দেখলেও না দেখার ভান করেছে। তবে সে ভালো আছে সুখে আছে। বহুদিন পর তার খোজঁ নিতে ইচ্ছে হলো। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরপরই বাবা-মার কথায় বিয়ে করে নিয়েছিলো সে। বর ডাক্তার। আর সে আগের ব্যবসাকে আরও বড় পরিসরে দাড় করিয়েছে। অনালাইন বিজনেস সহ উত্তরা আর মিরপুরে দুইটা শাড়ির আউটলেট আছে তার। ভীষণ ভালো আছে সে এবং সুখে আছে। স্বামী ভালো হয়তো খুব। বড় বাচাঁ বেচেঁ গেছে আমার সাথে তার জীবন জুড়ে যায়নি। তা না হলে সারাজীবন মান্ধাতার আমলের চিন্তাভাবনার সাথে আর সাংসারিক কূটকাচালের মধ্য পিষ্ট হয়ে অক্ষম স্বামীর সাথে সংসার করতে হতো। সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন”।
” এই জন্যই তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসতে পারোনি? মন থেকে মেনে নিতে পারো নাই? ইশা বললো
” মেনে নিতে না পারলে তোমার সাথে সংসার করতে পারতাম না চার বছর ধরে। আর ভালোবাসার চেষ্টা করিনি বললে ভুল হবে ওই যে বললাম আয়নায় নিজেকে দেখলে দাগী অপরাধী মনে হয় এজন্য আর ভালোবাসাটা হয়ে উঠেনি”। উজানের সহজ সরল স্বীকারোক্তি।
ইশা বুঝতে পারলো কেন মাঝে মাঝে উজান না ঘুমিয়ে রাত কাটায়। বিয়ের পর থেকে দেখছে তার স্বামীর ঘুম অনিয়মিত। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্য ছটফট করে। স্বামীর সব দায়িত্ব পালন করলেও মানসিক দিক থেকে তাদের বোঝাপড়ায় একটা দূরত্ব আছে। এমনও দিন গেছে সে হঠাৎ করে রাতে জেগে উঠে দেখে উজান গভীর রাতে জায়নামাযে মোনাজাতে কাদঁছে। সে ভেবেছিলো বাচ্চার জন্য হয়তো। কিন্তু এতো অনুশোচনায় দগ্ধ একজন মানুষ দিনরাত নিজের মধ্য এতো কিছু বয়ে বেড়াচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারেনি। আন্দাজও করতে পারেনি। বুঝবে কি করে সেই গভীরতায় যাওয়ার অনুমতি তার স্বামী উজান তাকে দেয়নি। ইশা একটু দম নিয়ে বললো
” আজ এসব কথা এতোদিন পর বললে যে আমাকে বিশেষ কোন কারণ “?
উজান কাঠকাঠ গলায় চোখে চোখ রেখে বললো
” আমার ডিভোর্স চাই ইশা”।
চলবে………….