নীল সাঝেঁর উজান পর্ব-০৪

0
18

#নীল_সাঝেঁর_উজান
#পর্বঃ৪
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

“ডিভোর্স নিলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আমাদের মধ্য যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা শেষ হবে? সব কিছুর সমাধান কি পথ আলাদা করে নেওয়াটাই এখন মনে হচ্ছে তোমার কাছে”?

ইশা স্থির গলায় প্রশ্নগুলো করলো উজানকে। ইশাও এখন বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে তার মন বিক্ষিপ্ত বিছিন্ন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সে দোটানায় আছে তার কি করা উচিত। মানিয়ে নেওয়া কিন্তু সেটা কতদিন? মানিয়ে নিয়ে মেনে নেওয়া সেটাও বা কতদিন সবকিছু ঠিকঠাক থাকবে? বাচ্চার জন্য তারও খারাপ লাগে। সন্তানের মা-বাবা কে না হতে চায়। ঠিক তেমনি করে সেও হতে চায়। তারও ইচ্ছা হয় বান্ধবীদের মতো বাচ্চা নিয়ে সময় কাটাতে। বাচ্চার সাথে হাসতে খেলতে। এইটাতো জীবনেরই অংশ। কিন্তু মেনে নিলে তার মা হওয়া হবে না এজীবনে। তার বাবা-মা প্রতিদিন তাকে এই সংসার ছেড়ে যেতে বলে। মিথ্যা অপবাদ নিয়েও শ্বাশুড়ির কথা দিনের পর দিন হজম করে গেছে সে। কিসের আশায় কিসের টানে? উজান কি সেই টান? তার স্বামী তার সংসার এগুলোর মায়া মোহর জন্য এতোদিন সে সবকিছু সয়ে গেছে। কিন্তু সবকিছুতো স্পষ্ট এখন। সত্যিটা সবার সামনে এসেছে। সেও বুঝে দিন দিন এই পরিস্থিতি আরও বিষাক্ত হবে। এমনটাতো না হলেও পারতো। কেন সবকিছু ঠিক হলো না? ইশাকে চুপ করে থাকতে দেখে উজান বললো

” পথ আলাদা হয়ে গেলে আমার জীবনের জটিলতা কমবে কিনা জানিনা কিন্তু আমার জন্য তোমার জীবনের জটিলতা নতুন করে বাড়বে না এটা বলতে পারো। ইশা গতকাল অফিস শেষ করে আমার বাড়ি ফিরতে এতো দেরি হয়েছিলো কেন জানো”?

ইশা বললো

” ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে ছিলে অনেকক্ষন বলেছিলে “।

উজান হালকা হাসলো। তারপর বললো

” উম হু। ট্রাফিক জ্যামে আটকে ছিলাম না। তোমার মা-বাবা এসেছিলো আমার সাথে দেখা করতে। কাল তাদের সাথে কথা বলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে”।

ইশা চমকে উঠে। অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়। তার বাবা-মা উজানের সাথে দেখা করেছে কোথায় এতো কথা হলো এটাতো বলেনি। আর কি এতো গভীর আলাপ করেছে মেয়ে জামাই এর সাথে যে মেয়েকেও বলার প্রয়োজন মনে হয়নি। কি খিচুড়ি পাকাচ্ছে তারা। ইশা জিজ্ঞেস করলো

” কেন দেখা করেছে? কি বলেছে তারা? কোনো অপমান করে কথা বলেছে? আমি জানতাম না এই বিষয় নিয়ে। আমার সাথে কথা হয়েছে তাদের কিন্তু এই ব্যাপারে তারা কিছুই জানায়নি বলেও নি আর বুঝতেও দেয়নি। কি এমন কথা যে অফিস শেষ করেই দেখা করতে হয়েছে তাদের তোমার সাথে? বাড়িতে এসেওতো বলতে পারতো।

উজান সোজাসাপ্টা বললো

” তারা তাদের মেয়েকে এই বিয়ে স্বামী সংসার থেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। শুধু শুধু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে মেয়েকে তারা দেখতে চাইছেন না। তোমার বয়স কম। সারাটাজীবন সামনে আছে। সন্তান একটা সংসারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে স্বামী অক্ষম সেই সংসারে তার মেয়েকে রেখে তারা দুনিয়া ছেড়ে গেলেও শান্তি পাবেন না। তারা তোমাকে ভালো দেখতে চায়। সুখী দেখতে চায়”।

“তারপর তুমি কি বললে তাদের”? ইশা অস্থির হয়ে বলে।

উজান বললো

” ছেড়ে দিবো বলেছি । আমিও চাইনা আমার জন্য তাদের মেয়ের জীবন নষ্ট হোক। পৃথিবীতে সবার ভালো থাকার অধিকার আছে। এমনিতেই এই সংসার ধরে রাখার মতো আমাদের মধ্য কোন সূত্র আর কাজ করছে না। মানসিক এবং শারীরিক কোন বিষয়টাই আর এই পরিস্থিতি উতরে নিতে সাহায্য করছে না। তাই পরিস্থিতি আরও বিষাক্ত হওয়ার আগে দুজনের মধ্য আরও তিক্ততা বেড়ে যাওয়ার আগে সমঝোতা থেকে দুজন দুজনের প্রতি সম্মান রেখে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াটাই ভালো হবে”।

ইশা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উজানের দিকে। সেতো ভেবেছিলো পরিস্থিতি কঠিন হচ্ছে। কিন্তু এতো জটিল আর বিষাক্ত হচ্ছে এই আন্দাজও ছিলো না তার। তার বাবা-মা তাদেরই মেয়ে জামাই এর সাথে দেখা করতে গেছে নিজের মেয়ের ডিভোর্স নিয়ে কথা বলতে। কি অদ্ভুত বিষয়! ইশা আর কিছু ভাবতে পারছে না। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ইশা বললো

” কেন এমন হলো? কেন একটা সুস্থ স্বাভাবিক সংসার আমরা পেলাম না?

উজান বললো

” এর মধ্যও কিছু ভালোতো অবশ্যই আছে। আমাদের নিজেদের কৃতকর্ম আছে। প্রকৃতির বিচার আছে। কাউকে ঠকিয়ে তাকে এক বুক কষ্ট দিয়ে তাকে কাদিঁয়ে বিনা দোষে অপমান করে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে নিজের সুখের কথা চিন্তা করা যে যায়না এইটা আমরা ভুলে যাই। কেউ মুখে বদদোয়া না দিলেও তার চোখের পানি দ্বীর্ঘশ্বাস হয়ে সবকিছু এলোমেলো করতে সক্ষম। আচ্ছা ইশা তোমার বান্ধবীরাও কি আমার অক্ষমতার কথা জানে? সবাইকেই বলেছো কি? না সেদিন তোমার একজন বান্ধবী যে বাড়িতে বেড়াতে এসে তোমাকে বললো স্বামী অক্ষম হলে কি সেই সংসারে বউ সুখ পায় তাই বলছিলাম”।

ইশা খুব লজ্জিত হয় তার এই কাজের জন্য। সে আসলেই বোকার মতো কাজ করেছে। তার বান্ধবীদের সাথে প্রচুর কথা বলার অভ্যাস। সবকিছু তাদের সাথে শেয়ার করে। তারাও করে। বলতে গেলে তাদের বেশিরভাগ সময় এই গল্প হয় কার সংসার কেমন কার স্বামী – শ্বাশুড়ি কেমন। কে কাকে কত বেশি কষ্ট দেয় এগুলোই তাদের আলোচনা। মেয়ে মানুষ এক জায়গায় হলে যা হয় আর কি। সেও তাদের সাথে এগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলো। আর সেদিন তাদের বাড়িতে তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী বাচ্চাকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলো। ছুটির দিন হওয়ায় উজান বাড়িতেই ছিলো। কোনভাবে সব কথা কানে গেছে তার। ইশ!! কি লজ্জাজনক ব্যাপার। ইশাকে চুপ করে থাকতে দেখে উজান বললো

” কি ব্যাপার চুপ করে আছো যে”?

ইশা আমতা আমতা করে বললো

” আসলে মাঝে মাঝে সমস্ত কিছু চিন্তাভাবনা মাথায় নিতে নিতে মন মেজাজ এতো খারাপ থাকতো তখন তাদের সাথে বিষয়টা শেয়ার করে ফেলেছিলাম। সেখান থেকে বান্ধবীরা জানে। আমার বলা উচিত হয়নি তবুও কিভাবে যেন এইটা বলে ফেলেছি। আমি আসলেই লজ্জিত “।

উজান হেসে বলে

” না না লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই। তারাতো ভুল কিছু তোমাকে বলে না। ঠিকই বলে। আসলেইতো সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম স্বামীর সাথে থাকলে সংসারে সুখ আসাটা কঠিন। এই যেমন মা তোমাকে ভুল বুঝে কত কি বলে এতোদিন অপমান করে এসেছে। যদি সত্যিই সমস্যাটা তোমার হতো তাহলে সে যা বলতো তাই করতো। আবার নিজের ছেলেকে বিয়ে করিয়ে আনতো। এতে যার যত কষ্ট হবার হোক। আর এটা নাজায়েজ কিছুও না। আমার যেমন বিয়ে করার এখতিয়ার আছে ঠিক তেমনি তোমারও একই অধিকার আছে স্বামী অক্ষম হলে স্বামীকে ছেড়ে চলে যাবার। তাই কেউই ভুল নয় এখানে। সবার চিন্তাই নিজ নিজ জায়গা থেকে চিন্তা করলে ঠিকই মনে হবে “।

ইশার কাছে সবকিছু কেমন ঘোলাটে লাগছে। সব কিছু বিশৃঙ্খল লাগছে। হঠাৎ কি মনে করে সে উজানকে অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলো। সে বললো

” আচ্ছা তুমি কি এখনো তাসনিম আপুকে ভালোবাসো?

ইশার কথায় হকচকিয়ে উঠে উজান। বুকের ভেতর কেমন শ্বাস টেনে আসে তার। মনের ভেতর কেমন অশান্তি অস্থিরতা তৈরি হয়। তবুও ইশাকে বুঝতে না দিয়ে বলে

” না সে আমার জীবনে ফেলে আসা এমন এক অধ্যায় যেটা খুব সুন্দর ছিলো। কিন্তু এখন সে সবকিছুই স্মৃতি। তাকে ভালোবাসার কোন প্রয়োজন এবং অধিকার কোনটাই এখন আমার আর নাই। তাসনিম তার জীবনে ভালো আছে সুখে আছে। আমি যেমনই জীবন কাটাই না কেন সেটা আমার প্রাপ্য। কিন্ত আমি চাই তাসনিম ভালো থাকুক। ব্যস এই অবধিই”।

তাদের কথার মাঝে হঠাৎ করে ইশার ফোনে ফোন আসে। তার বাবা ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিতেই উনি এমন কিছু বললেন যেটা শুনে ইশা অস্থির হয়ে গেলো। তার চোখ মুখের রং উবে গেলো। ইশা কোনরকমে বললো

” আমি এখনই রওনা দিচ্ছি “।

উজান জিজ্ঞেস করলো

” কি হয়েছে এমন অশান্ত হয়ে গেলে কেনো”?

ইশা বললো

” মা নাকি একটু আগে মাথা ঘুরে পরে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। ডাক্তার নিয়ে এসেছিলো বাসায়। বলেছে অতিরিক্ত চিন্তা থেকে এমন হয়েছে। বিপি হাই হয়ে গেছে। বারবার আমাকে দেখতে চাইছে। আমাকে যেতে বলেছে তাড়াতাড়ি”।

উজান চিন্তিত হয়ে বললো

” চলো তাহলে এখান থেকেই তোমাকে পৌছেঁ দিয়ে আসি। বনশ্রী যেতে সময় লাগবে ভালোই। তোমার চিন্তা করে করেই বোধহয় উনি অসুস্থ হয়ে গেছে”।

ইশা হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ায়। তারপর তারা উবারে করে বনশ্রী পৌছেঁ যায়। উজান ইশাদের বাসার ভেতরে যেতে চায়নি। যদি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি আর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় এজন্য। বিল্ডিং এর নিচ থেকেই চলে যেতে চাইছিলো। কিন্তু ইশা জোর করে তাকে বাসায় নিয়ে যায়। কেমন যেন অদ্ভুত লাগে উজানের। বসার ঘরে সবাই অদ্ভুত চোখে উজানের দিকে চেয়ে থাকে। এইটা দেখে সে আরও বিব্রতবোধ করে। সবাই যদিও তার সাথে শান্ত স্বরে নম্রভাবেই কথা বলেছে। তবুও কোথাও যেন সেই আন্তরিকতাটা আর পেলো না সে । কোনরকমে সবার সাথে ভালো মন্দ দুটো কথা বলে এখান থেকে বের হতে চায় সে। ইশার মা এখন স্থিতিশীল আছেন। মেয়েকে কাছে পেয়ে তিনি বিলাপ গাইছেন। উজান ইশার কাছ থেকে কোন রকমে বিদায় নিয়ে দরজা অবধি এসে পৌছঁলে পেছন থেকে ইশার বাবা উজানকে ডাকেন। উজান পেছনে ফিরে বললো

” জি বাবা বলুন ”

ইশার বাবা বললেন

” মেয়েকে আর তোমাদের বাড়ি পাঠাবো না। যত দ্রুত সম্ভব ডিভোর্স এর কাগজটা পাঠিয়ে দিও। আমরা এই নিয়ে আর কোন অশান্তি চাইনা”।

উজান স্মিত হেসে বললো

” উকিলকে বলেছি যত দ্রুত সম্ভব ডিভোর্স এর কাগজ তৈরী করতে। দুই তিনদিনের মধ্য হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না কোন অশান্তি হবে না”।

এই বলে উজান ইশার বাবাকে সালাম দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। রাস্তায় নেমে কি মনে করে ইশার ঘরের বারান্দার দিকে একবার তাকায়। দেখে ইশা দাড়িঁয়ে আছে। হয়তো এটাই তাদের শেষ দেখা। এখানেই তাদের পথের সমাপ্তি। এতোটুকুই ছিলো তাদের পথ চলা। রাত ১০ টায় বাড়ি ফিরে উজান। দরজা খুলে দিতেই আমেনা বেগম বললেন

” কিরে বউ কোথায়? ইশা নেই কেন সাথে”?

উজান বললো

” হঠাৎ করে ইশার মা অসুস্থ হয়ে গেছে। প্রেসার বেড়ে গেছে। ওর বাবা ফোন করেছিলো তাই তাকে বাবার বাসায় রেখে এসেছি “।

আমেনা বেগমের বুকটা অদ্ভুত চিন্তায় ধক করে উঠে। তিনি বললেন

” কবে ফিরবে কিছু বলেছে?

উজান গ্লাসে পানি ঢালছিলো। মায়ের কথা শুনে চোখে চোখ রেখে বললো

” ইশা আর এ বাড়িতে ফিরবেনা মা “।

চলবে………