#নীল_সাঝেঁর_উজান
#পর্বঃ৫
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
নিজের স্ত্রীর পরো’কীয়ার সমস্ত প্রমাণ গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে উজান। কত সুন্দর করে গত এক বছর যাবৎ তার আড়ালে নিখুঁতভাবে অন্য আরেকজনের সাথে সমান্তরালভাবে সম্পর্ক চালিয়ে গেছে সে। তার সামনে সহজ সরল হয়ে থাকার অভিনয় করে গেছে দিনের পর দিন। মা না হওয়ার মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে দিনের পর দিন শ্বাশুড়ির কটু কথা শুনে মহত সেজে স্বামীর কাছে এই সংসারে সাধু হয়ে থাকার নাটক করেছে দিন রাত। স্বামী অফিসে থাকাকালীন অন্য জনের সাথে প্রেমালাপ আর স্বামী অফিস শেষ করে আসার পর বউ হয়ে তার বাহুডোরে থেকে অসহায় নারী হয়ে দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলেছে সে। স্বামী বাবা হতে অক্ষম এই স্পষ্ট বিষয় সামনে এসেছে প্রথম রিপোর্ট এই। তবুও আধুনিক যুগে মানুষ কত কি অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে এই আশায় আশায় আরও গোটা দশেক ডাক্তার আর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে৷ কিন্তু ফলাফল একই। ইশাকে সে অনেক আগেই বলেছিলো এই বিয়ে আর না আগানোই ভালো। সে নতুন করে জীবন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু সেদিন সে শাড়ির আচঁল ফেলে নিজের বুকের মধ্য স্বামীকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিলো যা হয় হয়ে যাক এই সংসার ছাড়বে না। কিন্তু মানুষ এর মন দ্রুত পরিবর্তনশীল। দিনের পর দিন এই সম্পর্কের আন্তরিকতায় যে চিড় ধরেছিলো তাতে হাতুরি দিয়ে ফাটল ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেছে তারই কলেজের এক ছেলে বন্ধু। যে ছেলের সাথে তার স্ত্রীর সম্পর্ক এখন সে ইশার ব্যাচমেট। পড়াশোনা শেষ করে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে এখন। ছেলেটা অবিবাহিত। ইশার বিষন্নতা আর অস্থিরতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে। উজানের একটাই আফসোস হচ্ছে তাকে বললেই অনেক আগেই মুক্তি দিতো সে। এই অনাচারে যাওয়ারতো দরকার ছিলো না। হাতের মধ্য কিছু ছবি নিয়ে একটা লম্বা শ্বাস টেনে সেই দিনের কথা মনে করলো সে। আজ থেকে তিন মাস আগে বন্ধুর সাথে অফিসের এক কলিগের ফেয়ারওয়েল পার্টির জন্য কেক কিনতে গিয়েছিলো তারা। সেখান থেকে বের হয়ে রিক্সা নিতে গিয়ে রাস্তার বিপরীতে খেয়াল করে ইশা তারই দেওয়া একটা রাণী গোলাপী সিল্ক এর শাড়ি পড়ে অন্য আরেকটি ছেলের হাত ধরে রেষ্টুরেন্ট এর ভেতরে যাচ্ছে। এইটা দেখার পর নিজের চোখের ভুল ভেবেছিলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। কিন্তু না ভুল না এইটা তার স্ত্রী ইশাই। তারপর তাকে ফোন দেয় উজান। জিজ্ঞেসে করে
” ইশা কি করছো এখন?
অসময়ে স্বামীর ফোন পেয়ে হকচকিয়ে যায় ইশা। দূর থেকে সেই অস্থিরতা টের পায় উজান। সে শুধু জানতে চায় এখন ইশা কি জবাব দিবে। ইশা জবাব দেয়
” বাসায় ভালো লাগছিলো না। খুব মন খারাপ লাগছিলো তাই বান্ধবীদের সাথে বাহিরে আসছি। মাকে বলেই এসেছি”।
উজান যেন হতবাক হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে এখন। হ্যা সে সত্যি বলেছে সে বাহিরে এসেছে। কিন্তু কোন বান্ধবীদের সাথে না। তৎক্ষনাতভাবে স্ত্রীকে সে আর কোন জেরা করেনি। সে কয়েকটা ছবি তুলে নেয় সাথে সাথে। সন্দেহের উৎপত্তি যখন হয়েছে তখন এটার জন্য আরও গভীরে যেতে হবে। ইশার প্রচুর ফোন আসে। বাবা-মা ছাড়াও বান্ধবীদের সাথে তার কথা বলার প্রচুর অভ্যাস। ঘন্টার পর ঘন্টা গ্রুপ কলে কথা বলে তারা। উজান এগুলো নিয়ে কখনো কথা বলেনি। প্রায়ই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলতো ইশা। ইদানীং সেটা আরও বেড়ে গিয়েছিলো। একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে দেখে পাশে ইশা নেই। বারান্দার দিকে এগোতেই দেখে ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ আসছে। কথাগুলো ছিলো এরকম
” জানিনা আর কতদিন এভাবে এই সংসার করতে হবে। ডাক্তারতো স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছে উজানের বাবা হওয়ার সক্ষমতা নেই। কিন্তু আমারতো মা হওয়ার ক্ষমতা আছে। আমি কেন ওর জন্য এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবো? হ্যাঁ একসময় ওর প্রতি আমার অনেক ভালোবাসা মায়া ছিলো কিন্তু এখন সেগুলো আর কাজ করে না। দিনের পর দিন তার আচরণ রোবট এর মতো হয়ে যাচ্ছে। আর আমার শ্বাশুড়ি দিনের পর দিন আরও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। ব্যবহার প্রচন্ড খারাপ হয়ে যাচ্ছে অথচ ছেলে বাড়িতে থাকলে ভালো মানুষ সেজে থাকে। আমার মাঝে মাঝে সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে”।
অপর পাশের ব্যক্তি বলে
” তাহলে ছেড়ে দিচ্ছো না কেন”?
ইশা কঠিন গলায় বলে
” ছেড়ে দিতে চাইলেইতো ছেড়ে আসা যায়না। বাড়িতে মা-বাবাকে বলেছিলাম আমি এই সংসার করবোনা। তখন মা বলেছে আরও কিছুদিন থেকে মোটা অংকের একটা ভরণপোষণ নিয়ে তার পর আসতে। উজানদের এই বাড়ির দাম এখন অনেক। আর তাছাড়া তাদের আরও একটা ফ্ল্যাট আছে যেটা উজানের নামে কিনেছে শ্বাশুড়ি। আর গ্রামের জায়গা জমিতো আছেই। যদি সে আমাকে ডিভোর্স দেয় এগুলো কিছুই পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমি ডিভোর্স চাইলে একটা ভালো অংকের খোরপোষ দাবি করতে পারবো। তার জন্য কিছুদিন সময় লাগবে আরও”।
অপর পাশের ব্যক্তিটি বলে
” এই শোনো অনেকদিন তোমার সাথে দেখা হয়নি। চলো কাল দেখা করি?
ইশা বলে
” না না এমনিতেই মাঝে বাহানা দিয়ে অনেকদিন বাহিরে দেখা করেছি। শ্বাশুড়ি এই নিয়ে ছেলের কানে বিষ ঢেলেছে। এখন দেখা করলে উজান সন্দেহ করতে শুরু করবে। এমনিতেই তার আচরণ কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড চুপচাপ হয়ে গেছে। ঠিকমতো কথা বলেনা। আর কটা দিন অপেক্ষা করো। তারপরতো তোমার কাছেই একেবারে চলে যাবো। শোনো এখন ফোন রাখছি। অনেকক্ষণ হলো বারান্দায় এসেছি। উজান উঠে না দেখলে আবার কি না কি ভেবে বসবে। আরে হ্যা হ্যা আমিও তোমাকে ভালোবাসি। রাখছি এখন”।
কথা শেষ করে ইশা ঘরের মধ্য আসে। এসে দেখে উজান ঘুমিয়ে আছে। সে একটা জোরে শ্বাস নেয়। তারপর গ্লাস হাতে নিয়ে পুরো পানি শেষ করে শুয়ে পড়ে। উজান এতোক্ষণ চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরেছিলো। সে চোখ খোলে। পাশে চেয়ে দেখে ইশা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কি মিষ্টি লাগছে অথচ একটু আগে এসব কি শুনলো সে। তার বুক কাপঁছে। চোখ ফেটে কান্না আসছে। বুক ভার হয়ে আসছে ব্যাথায়। তাসনিমের কথা খুব মনে পড়ছে তার। কিভাবে মেয়েটাকে ঠকিয়েছে সে।এটাই হয়তো তার কৃতকর্মের ফল। ইশার ফিংগারপ্রিন্ট নিয়ে ফোনের লক খুলে বুকে পাথর চেপে তাদের সমস্ত ফোনালাপ, ছবি তার ফোনে ট্রান্সফার করে নেয় সে। ফোনের অটো কল রেকর্ডিং অপশন চালু করে। তারপর পরবর্তীতে তারা যত কথা বলেছে যতবার দেখা করেছে সব কিছুর প্রমাণ রেখেছে সে তার কাছে একদম ফাইলের মতো সাজিয়ে। সেগুলো নিয়েই ইশার বাবা-মার সাথে দেখা করেছে সে সেদিন। তারাও চাইতেন মেয়ে যেন ডিভোর্স দেয় তাড়াতাড়ি। কিন্তু মেয়ে যে অন্য কারো সাথে জড়িয়ে পড়েছে এটা তারা জানতেন না। উজান তাদের বলেছে
” আমার অক্ষমতার জন্য আমি অনেক আগেই চেয়েছি এই সম্পর্ক শেষ হোক কিন্তু ইশাই চাইছিলো না। আমি ভেবেছিলাম দুনিয়াতে কত মানুষ নিঃসন্তান থাকে তবুও একে অপরের হাত ছাড়ে না। শেষ নিঃশ্বাস অবধি এক সাথে থাকে। ইশার ভালোবাসা দেখে আমিও এরকমই ভেবেছিলাম। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম। আমি আর এই সংসার তার কাছে একটা বোঝা মাত্র এখন। আর তার চেয়েও বড় কথা সে অনেক বড় একটা অনাচারে জড়িয়ে গেছে। এখনো সময় আছে কাদাঁ আরও বেশি ঘোলা হওয়ার আগে তাকে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করতে পারেন। বয়স কম আবেগ বেশী। সে জানেও না কত বড় বিপদ ডেকে নিয়ে আসছে সে। কিন্তু আমার পক্ষে তার সাথে আর সংসার করা সম্ভব হবে না। আমি তাকে নিয়মমাফিক এককালীন একটা ভালো অংকের ভরণপোষণ দিবো। হাজার হোক জীবনের চার বছর সে আমার সাথে থেকেছে। কিন্তু এর বাহিরে বিন্দুমাত্র চালাকি করার চেষ্টা করলে পানি উল্টো দিকে গড়াবে”।
উজানের কথা শুনে ইশার বাবা-মা ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। মেয়ে নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছে অতিরিক্ত লোভের আশায়। নিজের পাতা ফাদেঁ সে নিজেই ফেসেঁ গেছে। তাই মান সম্মান আরও ডুবে যাওয়ার আগে উজানের কথা মানতেই হবে। আর তারপর আজকে ইশার মার হঠাৎ অসুস্থতা বিষয়টা সহজ করে দিয়েছে। এতো কিছু চিন্তা ভাবনা করতে করতে আর মানুষের মুখোশ দেখতে দেখতে সে ক্লান্ত হয়ে গেছে। সে তাসনিমকে যতটা কষ্ট দিয়েছিলো প্রকৃতির বিচার তার চারগুণ হয়ে ফিরে এসেছে। হাতের ফাইল পাশে রেখে কপালে হাত ঠেকিয়ে মাথা নিচুঁ করে বিছানায় বসে আছে সে। গায়ের জামাকাপড় এখনো ছাড়েনি। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। আমেনা বেগম এসেছেন ছেলের কাছে বললেন
” জেগে আছিস উজান”?
উজান মাথা তুলে তাকায়। দেখে দরজায় তার মা দাড়িঁয়ে আছে। একদিনের ধাক্কায় তার মার যেন বয়স বেড়ে গিয়েছে দশ বছর। চিন্তিত বিধ্বস্ত লাগছে তাকে। উজান বললো
” আসো মা। এখনো জেগে আছো? অনেক রাত হয়েছে।
আমেনা বেগম বললেন
” ছেলের সংসার ভেঙে যাচ্ছে। ছেলের জীবনে এতো বড় বিপদ। এইটা জানার পর কোন মায়ের চোখে ঘুম আসে? সত্যিই কি তোর বউ আর এ বাড়িতে ফিরবে না”?
উজান হাসলো। মায়ের হাত ধরে টেনে তার পাশে বসালো। তারপর বললো
” না মা ইশা আর এ বাড়িতে তোমার ছেলের জীবনে ফিরবে না। শুধু শুধু নামমাত্র ছুতোয় এই বিয়ে জিইয়ে রাখার কোন মানে নেই। তার চেয়ে এই বিচ্ছেদ হওয়াই ভালো “।
আমেনা বেগম ফুপিঁয়ে কেদেঁ উঠলেন
” তাহলে তোর কি হবে বাবা? সারাজীবন এইভাবে থাকবি? আমি আজ আছি কাল নেই। তোকে কে দেখবে?
” যার কেউ নেই তার উপরওয়ালা আছে। চিন্তা করোনা মা। এক জীবন দিব্যি চলে যাবে”। উজান বললো।
আমেনা বেগন বললেন
” কোন অন্যায়ের শাস্তি উপরওয়ালা আমাদের দিলো বাপ”?
উজান একটু জোরে হেসে বললো
” তাসনিম কে তোমার মনে আছে মা?
আমেনা বেগম অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে। এতোদিন পর তাসনিম এর কথা উঠলো কেন? ছেলের ভালোবাসাকে নিজের জেদের জন্য দূরে সড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আলাদা করেছিলেন তাদের। এই অন্যায়ের শাস্তি কি তাহলে এসব? ছেলেকে বললো
” কি হয়েছে তাসনিমের “?
উজান বললো
“কিছু না মা। সেদিন অনেক বছর পর ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। না না ও দেখেনি। আমিই শুধু দেখেছি। স্বামী সন্তান নিয়ে শপিং করতে এসেছিলো। কি ফুটফুটে দুইটা পুতুলের মতো বাচ্চা ওদের”।
আমেনা বেগমের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ছেলের কথা শুনে। তার জন্য ছেলের জীবনের আজকে এই অরাজকতা। উজান আবার বললো
“জানো মা ওর বর কে”?
আমেনা বেগম বললেন
” কে”?
উজান এর চোখ ছলছল করে ওঠে। একটা দ্বীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে
” গত মাসে তোমাকে যে চোখের ডাক্তার দেখিয়েছিলাম উনিই তাসনিমের বর”।
চলবে………..