#নীল_সাঝেঁর_উজান
#পর্বঃ৬
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
নিজের প্রাক্তন প্রেমিকার সামনে মাথা নিচুঁ করে বসে আছে উজান। তাসনিমের সাথে সে যা করেছে এরপর ক্ষমা চাওয়ার মুখ আর তার নেই। কোন মুখে তার সাথে কথা বলবে ভেবে পাচ্ছেনা সে অথচ তার বলার অনেক কিছু আছে। তাসনিম অনেক ভালো মনের মেয়ে। একজন ভালো মানুষ। স্থির এবং শান্ত স্বভাবের। অল্পতেই খুশি হয়ে যায়। রাগ জেদ খুব কম কিন্তু কেউ যদি একবার তার মন থেকে উঠে যায় সেখানে লক্ষবার কড়া নাড়লেও সেই মানুষটির জন্য তার মনের দরজা বন্ধ করে দেয় চিরদিনের মতো। উজান ক্ষমা চাইতে এসেছে তাসনিমের কাছে। সেই কাজের জন্য ক্ষমা যেই কাজ মানুষ এর করার পর্যায়ে পরে না। তাসনিমের চাহনি বলে দিচ্ছে সে কতটা বিরক্ত উজানকে দেখে। উজান জানে সে যতক্ষণ এখানে আছে এই চাহনি সহ্য করতে হবে তাকে। সে এটারই প্রাপ্য। উজান বুক ভরে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নেয়। উজান কিছুটা ইতস্তত করে বলে
” কেমন আছো তাসনিম”?
তাসনিম সহসা কোন জবাব দেয় না। এই দিন সে দেখতে চায়নি। যে বিষাক্ত স্মৃতি সে ফেলে এসেছিলো বহু বছর আগে সেই মানুষটিকে আর জীবনে দেখতে চায়নি সে। তবুও আবার দেখা হলো বলতে গেলে হয়েই গেলো। তাসনিম উজানের দিকে তাকায়। চোখ মুখ ফ্যাকাশে লাগছে ছেলেটার। চোখ লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে দুই তিন রাত ঠিকমতো ঘুমায়নি। এই মানুষটিকে জীবনের পাচঁ বছর সময় দিয়েছিলো সারাজীবন পাশে পাবে বলে কিন্তু এক লহমায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে দিয়ে সে চলে গেছে। তাসনিম কাঠ কাঠ গলায় উত্তর করলো
” বেশ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? তোমার মা আর স্ত্রী কেমন আছে”?
উজান তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো
” ঠক মানুষের কি ভালো থাকা সাজে? যে ভালোর জন্য তোমার বিশ্বাসকে অপমান করেছিলাম সেই ভালোটা আজকে বিষ হয়ে জীবনকে নীল করে দিয়েছে। তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছি এগুলো তারই পুরস্কার। আচ্ছা তাসনিম তুমি আমায় অভিশাপ দিয়েছিলে না “?
তাসনিম শব্দ করে হাসে। এই মানুষটিকে এখন রীতিমতো বিরক্তিকর লাগলেও সে যথেষ্ট শান্ত হয়ে উত্তর করলো
” আমার অভিশাপ পাওয়ারও যোগ্য তুমি নও উজান। তোমার কথা আমি কবেই ভুলে গেছি। কারণ দুঃস্বপ্নকে শুধু বোকারাই মনে রাখে। সেখানে তুমিতো একটা বিষাক্ত দুঃস্বপ্ন। এতোবছর পর এগুলো বলতে ডেকে এনেছো এখানে? লজ্জা করে না তোমার”?
উজান আমতা আমতা করে বললো
” আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না”?
তাসনিম সোজাসাপ্টা বললো
” না তোমাকে ক্ষমা করা যায় না। কারণ তুমি একটা অমানুষ অমানুষ অমানুষ”।
উজান ঘুমের মধ্য হঠাৎ মৃদু চিৎকার দিয়ে জেগে যায়। পুরো গা ঘেমে উঠেছে তার। অথচ এসি চলছে ২৬° সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো সে। তাসনিমের কাছে ক্ষমা চাইতে নিলে সে তাকে অমানুষ বলেছে। আসলেইতো সে অমানুষ। অমানুষকে কেউ ক্ষমা করে কখনো?সে চায়না কখনো তাসনিমের মুখোমুখি হতে। তাসনিমের সামনে যাওয়ার মুখ নেই তার। সে এটাও চায়না তাসনিম তাকে ক্ষমা করুক। কিছু কিছু ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়াটাও একটা অন্যায়। তাই সে কখনো চায়না তাসনিমের ক্ষমা। সে শুধু চায় মেয়েটা যেন স্বামী সন্তান নিয়ে ভালো থাকে সুখে থাকে। উজান বেড সাইড টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে রাত তিনটা। ঘুম যখন ভেঙেই গেছে আবার সহজে ঘুম ধরবে না। মনের অস্থিরতা কমানোর জন্য ওযু করে এসে নামায পড়তে বসে সে। তারপর ভোরের নামাযটাও একসাথে শেষ করে তারপর একটু একটু চোখ লেগে আসে তার। উজান বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসে। সেই ঘুম ভাঙে বেলা দশটায়। উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তার টেবিলে এসে দেখে দুই তিন রকমের নাস্তা। কিন্তু ডিম ভাজি নাই। ইশা বলে ডাকতে নিলেই মনে পড়ে ইশা আর এই বড়িতে ফিরবেনা। ঘরের ভেতর থেকে তার মা বাহিরে এসে বলে
” উঠে পড়েছিস? আসলে অনেকদিন পর রান্নাঘরে গিয়েছি। কোথায় কি রাখা আছে তা মনে করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। রান্নাওতো করলাম অনেকদিন পর। এতোদিনতো ইশা ছিলো ও এসব দেখতো”।
উজান রুটি ছিড়ে সুজির সাথে মিশিয়ে খেতে খেতে বললো
এখন থেকে আবার অভ্যাস করতে হবে। আমি আরও একটা ছুটা বুয়ার ব্যবস্থা করবো খুব তাড়াতাড়ি যাতে তোমার কষ্ট না হয়। তার মা তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমেনা বেগম বললেন
” সংসারটা কি কোনমতেই বাচাঁনো যাবে না”?
উজান এর হাত থেমে যায় এই কথা শুনে। মনের অজান্তেই হাসি আসে তার। মনে মনে ভাবছে কি অদ্ভুত একটা বিষয়। কাল অবধি যে মানুষ মেয়েটাকে সংসারে দেখতে চায়নি বলে তাকে সংসার ছেড়ে যেতে বলছিলো আজকে সেই বলছে সংসারটাকে বাচাঁনো যায় কিনা কোনভাবে। উজান বললো
” মা আমাদের মানুষের মধ্যে একটা বিরাট সমস্যা আছে। আমরা খুব সহজেই জীবনে মানুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। অভ্যস্ত হয়ে যাই তার সাথে। এরপর সেই মানুষটি যদি কোনভাবে আমাদের জীবনে আর না থাকে তখন আমাদের তাকে ছাড়া কোন কাজ ভাবতে এবং করতে অনেকটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আমাদের একা থাকার অভ্যাস করতে হবে মা। এখন থেকে নিজের কাজ নিজেদেরই গুছিয়ে করতে হবে। অন্য কারো জন্য বসে থাকা যাবে না। দাও আমাকে বাজারের ব্যাগ দাও। সপ্তাহের বাজার করে নিয়ে আসি”।
আমেনা বেগম মনোযোগ দিয়ে ছেলের কথা শুনলেন। ছেলে তার মন বানিয়েই ফেলেছে এই সংসার সে আর করবে না। তার ভীষণ খারাপ লাগছে। নিজের চোখের সামনে ছেলের সংসার ভেঙে যাচ্ছে তার ছেলে কষ্ট পাচ্ছে সে কিছুই করতে পারছে না অথচ সব কিছুর মূলে সে নিজেই। তার করা অন্যায়ের হায় তার ছেলের উপর পড়েছে৷ কে জানতো এসব হবে। ছেলে তার মুখে কিছু না বললেও মা হয়ে তিনি আন্দাজ করতে পারছেন ছেলের ভেতরটা পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি ফোস করে দম ছাড়লেন। উপরওয়ালার কাছে এই শোক তাপ হাহাকার এর পথ উত্তরণের জন্য প্রার্থনা করছেন তিনি। উজান এসব নিয়ে আর ভাবছে না। এগুলো তার আর গায়ে লাগছে না। তাকে এখন জীবনের সামনের দিনগুলো একাই কাটাতে হবে এই ভেবেই মনস্থির করেছে সে। দেখতে দেখতে তিন দিন পার হয়ে গেলো। নিয়মমাফিক উজান অফিসে বসে কাজ করছিলো।গতকাল উকিলের সাথে দেখা করে এসেছে। ডিভোর্স পেপারে স্বাক্ষর করে এসেছে এবং সেটা ইশার কাছে পাঠানো হয়েছে। এতোক্ষণে পেয়েও গেছে সেটা। ডিভোর্স এর কাগজে স্বাক্ষর করার সময় বুকটা তার কেপেঁ উঠছিলো। এই বিয়েটার জন্যই তাসনিমকে সে চিরতরে হারিয়েছে। হয়ে গেছে ঠক, বিশ্বাসঘা*তক। অথচ সেই বিয়েই তার টিকলো না। ইশাকে এককালীন ভরণপোষণ হিসেবে দুই লক্ষ টাকা দিয়েছে। আর দেন মোহর আগেই পরিশোধ করা ছিলো। ইশার গয়না এবং কাপড়চোপড় ডিভোর্স এর কাগজের সাথেই পাঠিয়ে দিয়েছে সব। হঠাৎ করে তার ফোনে কল আসে। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে কলটা করেছে ইশা। ইশা এখন তার স্ত্রী আর নেই। প্রাক্তন স্ত্রী বলা যায়। কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে ইশা সালাম দিয়ে বললো
” শেষ অবধি তালাক দিয়ে এই সম্পর্কটা ভেঙেই ফেললে?
উজান হাসে এই বিদ্রুপের ভাষা শুনে। কিন্তু তার কন্ঠ স্থির করে বলে
” কেন তুমিতো এটাই চেয়েছিলে যত দ্রুত সম্ভব যেন এই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়? খুশি হওনি? এখনতো তোমার আর কোন বাধাঁ রইলো না। নিশ্চিন্তে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। তবে এটা বলতে পারো তোমার কিছু দাবি করার আগেই এইসব হয়েছে। ভরণপোষণ এর টাকা কি কম মনে হচ্ছে? বয়ফ্রেন্ড খুশি হয়নি”?
ইশা থতমত খেয়ে বলে
” তুমি সবকিছু টের পেয়ে গিয়েছিলে না? আমি জানিনা এতো বড় একটা অনাচারে কিভাবে জড়িয়ে গেছি। আসলে বাচ্চা না হওয়ার টেনশন আর অস্থিরতায় কবে এসবের মধ্য জড়িয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। আর তোমার সাথে সব রকম দূরত্বটা এটাকে বাড়তে আরও বেশি উস্কে দিয়েছে। আমার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে গিয়েছিলো। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও “।
উজান শব্দ করে হাসে আর বলে
” এখন এসব কিছু বলে আর লাভ নেই ইশা। ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমাকে আমি বিগত দিনে অসংখ্যবার বলেছি আমাদের পথ আলাদা হওয়াই উচিত। আমি তোমাকে মুক্তি তখনও দিতাম। কিন্তু আমার আফসোসের জায়গাটা কোথায় জানো? আমারই স্ত্রী হয়ে থেকে আমারই দেওয়া শাড়ি পড়ে তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যেতে। আমারই পাশে ঘুমের ভান করে পড়ে থেকে ঘুমন্ত স্বামীকে ঘরে রেখে দিনের পর দিন বারান্দায় প্রেমালাপ করে গেছো। আবার তারই সাথে পরিকল্পনা করে গেছো কিভাবে আমার কাছ থেকে ভরণপোষণ এর মোটা অংক দাবি করবে। আচ্ছা তোমরা মেয়েরা এতো বোকা কেন”?
ইশা বললো
” কি বুঝাতে চাইছো”?
উজান কোন ভণিতা ছাড়াই বললো
” যার সাথে তোমার সম্পর্ক এখন রেখেছো তাকে কোন ভিত্তিতে ভরসা করো ইশা? সে একটা অবিবাহিত ছেলে। তোমার মনে প্রশ্ন জাগেনি একজন অবিবাহিত ছেলে বিবাহিত নারীর সাথে সম্পর্ক রাখে সে পরবর্তীতে যে তোমাকে ঠকাবেনা তার কি নিশ্চয়তা আছে? আবেগের বসে এইভাবে বিপথে চলে গেছো। যেকোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাকে একটু বাজিয়ে দেখো সে আদতে ভরসা করার যোগ্য কিনা। আমি বাবা হতে অক্ষম এজন্য আমাদের পথ আজ হোক কাল হোক আলাদা করতে হতোই কিন্তু জীবনের পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে আরেকটু সময় নিও। মানুষকে পরোখ করে দেখো। তোমার খারাপ আমি কখনো চাইবোনা। প্রার্থনা রইলো আগামী দিনের জন্য। তুমি ভালো থেকো সুখে থেকো। মা’র হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। সে না বুঝে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। বয়স্ক মানুষ তাকে ক্ষমা করে দিও। আর কিছু বলবে?
ইশা কাদোঁ কাদোঁ গলায় বললো
” আমাকে ক্ষমা করে দিও উজান। আমি তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারিনি। তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি। আর মা’র জন্য আমার মনে কোন অভিযোগ নেই। তাকে বলো আমাকে যেন পারলে ক্ষমা করে দেয়। তুমিও ভালো থেকো উজান। প্রার্থনা রইলো তোমার জীবনের জটিলতাও যেন দূর হয়ে যায়। ভালো থেকো উজান। ভালো থেকো। আমাকেও এক দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেও”।
উজান স্থির শান্ত হয়ে বললো
“রাখছি তবে “।
চলবে………