নীল সাঝেঁর উজান পর্ব-০৭

0
26

#নীল_সাঝেঁর_উজান
#পর্বঃ৭
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

হসপিটালে রোগী ভর্তি করাতে এসে সেই রোগীকেই যে বিয়ে করতে হবে এমন কথা কল্পনাতেও ভাবেনি উজান। গায়ের সাদা পাঞ্জাবিতে রক্তের দাগ লেগে আছে। মুহুর্তের মধ্য কি থেকে কি হয়ে গেলো উজান এখনো ঘোরের মধ্য আছে। তবে বিয়েটা করতে তাকে কেউ জোর করেনি। বিয়েটা সে করেছে নিজের ইচ্ছায় নিজের জ্ঞানে এবং সবকিছু বুঝেই। তবুও জীবনের সাইঁত্রিশ বছরে এসে এমন কিছুর মুখোমুখি হতে হবে তাকে এমন কিছু সে কখনো আশা করেনি। আজ সকাল অবধিও তার জীবন রুটিন মাফিক চলছিলো। আজকেই সে অফিসের অফিসিয়াল ট্যুর শেষ করে বাসায় পৌছেঁছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির সুবাদে অনেক ট্যুর থাকে তার দেশের ভেতরে এবং বাহিরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডিরেক্টর পদে আছে এখন সে। এক সপ্তাহের জন্য মালেশিয়া গিয়েছিলো সে। আজকে ভোরবেলাই সে একটা লম্বা সফর শেষ করে বাসায় পৌছেঁছে। এসেই কোনরকমে জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে একটা লম্বা ঘুম দিয়েছিলো। সেই ঘুম ভাঙে একদম বেলা বারোটায়। ঘুম ভাঙে কলিং বেল বাজার শব্দে। ঘুম জড়ানো চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে দেয় সে। দরজা খুলে দেখে উপরের তিন তালার ফ্ল্যাটের মালিক রমজান আংকেল দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। তিনি বললেন

” কেমন আছো উজান বাবা”? কেয়ারটেকার এর কাছে শুনলাম তুমি ভোরে বাসায় এসেছো। ক্লান্ত হয়ে এসেছো তাই একটু দেরি করেই আসলাম তোমার কাছে”।

উজান বিনয়ের সাথে সালাম দিয়ে মুখে হাসি নিয়ে বললো

” আলহামদুলিল্লাহ আংকেল ভালো আছি। জি লম্বা জার্নি ছিলোতো তাই ক্লান্ত অনেকটা। এসেই ঘুমিয়ে গেছি”। আংকেল ভেতরে আসুন।

রমজান সাহেব বাড়ির ভেতরে এসে হাতের মিষ্টির প্যাকেটটা টি টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর বললেন

” বাবা আজকে সাঝেঁর বিয়ে। তুমি বাহিরে ছিলে। গত সপ্তাহে এসে ছেলে পক্ষ সাঝঁকে দেখে গেছে। মেয়েকে দেখেই ছেলে এবং ছেলের পরিবারের পছন্দ হয়। ছেলে ইউ এস এ থাকে। সেখানেই চাকরি করে। হাতে মাস খানেকের ছুটি নিয়ে এসেছে তাই বাবা-মা দ্রুত বিয়েটা করিয়ে দিতে চায়। আমাদেরও আপত্তি করার মতো কিছু ছিলো না। সাঝঁ নিজেও মত দিয়েছে এই বিয়েতে। মেয়েকেতো আজ হোক কাল হোক বিয়ে দিতেই হতো তাই দেরি করে লাভ কি। তাই আজকে আকদের অনুষ্ঠান করে রাখছি। ছেলে পরের বার ছুটিতে এসে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে নিয়ে যাবে সাথে সাঝঁকেও নিজের সাথে ইউ এস এ নিয়ে যাবে। তুমিতো জানো আমার তিন সন্তান। বড় মেয়েতো আর এই দুনিয়াতে নেই। বড় ছেলে আর সাঝঁ। তুমি বিয়েতে থাকলে অনেক খুশি হবো বাবা”।

উজান মনোযোগ দিয়ে এতোক্ষণ রমজান সাহেবের কথা শুনছিলেন। খুব বেশিদিন হয়নি তারা এখানে এসেছেন। মাত্র ছয়মাস আগেই তারা তিন তালার ফ্ল্যাটে উঠেছেন। আগে তারা মিরপুর দশ নাম্বারে ভাড়া থাকতো। আগের ফ্ল্যাটের মালিক পরিবার সহ সুইজারল্যান্ডে সেটেল হওয়ায় অল্প দামে কম সময়ের মধ্যে ফ্ল্যাটটি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তখন রমজান সাহেব এই ফ্ল্যাটটি কিনেন। পরিবার সহ থাকেন। এখানে আসার কিছুদিন পড়েই ডেলিভারি হতে গিয়ে উনার বড় মেয়েটা আর ফেরেনি। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হওয়ায় বাচ্চাকে বাচাঁনো সম্ভব হলেও মাকে বাচাঁনো যায়নি। এইটা তার দ্বিতীয় সন্তান ছিলো। আগের সাত বছরের একটা ছেলে আছে। বাচ্চা দুটো এখানেই থাকে নানা নানীর কাছে। বাচ্চার বাবা অনেক চেয়েছিলেন সাথে করে নিয়ে যেতে কিন্তু সাঝঁ নাকি যেতে দেয়নি। ভদ্রলোকের মা মানে বাচ্চাদের দাদী নাকি খুব বেশি সুবিধার না। তাদের বড় মেয়েকে কষ্ট দিতেন সংসারে। শুধু জামাই ভালো দেখে সংসার করে গেছে। বাচ্চাদের মা দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার চল্লিশ দিন না যেতেই নিজের বোনের মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে ছেলের। এসব দেখে সাঝঁ তিক্ত বিরক্ত হয়ে বাচ্চা দুটোকে আরও যেতে দেয়নি। তবে বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়নি ভদ্রলোকের। স্ত্রীকে ভালোবাসতেন তাই কাউকে না জানিয়ে বিদেশে চলে গেছেন তিনি। তবে তফাত শুধু এটুকুই এবার তার যাওয়ার কথা ছিলো পরিবারসহ। সেখানে তিনি একাই গেলেন। নিয়তি কখন কি যে পরীক্ষা নেয়। সাঝঁকে উজান খুব বেশি না হলেও মোটামুটি চেনে। প্রায়ই বাচ্চাদের নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে যায়। খুবই বিদঘুটে পরিস্থিতিতে উজানের সাথে সাঝেঁর দেখা হয়েছিলো। একদিন সাঝঁ ছেলে বাচ্চাকে সাথে নিয়ে আইসক্রিম কিনতে গলির মাথায় দোকানে গিয়েছিল। সেখানে দেখে উজান সিগারেট খাচ্ছে। সাঝেঁর সিগারেট এবং সিগারেট খাওয়া লোক একদম পছন্দ না। সে ধোয়াঁ আর গন্ধটাই সহ্য করতে পারেনা। বমি পায় তার। কোনরকমে নাক চেপে আইসক্রিম নিয়ে বাসায় এসেছিলো। সাঝঁ তখনো চেনেনা উজানকে। একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হতে নিলে লিফটে উজানের সাথে দেখা। তখন তাদের পরিচয় হয়। সেই থেকে এক কথা দু কথা হতে প্রতিবেশী হিসেবে সাঝেঁর সাথে পরিচয় বাড়ে। ছুটির দিনে উজান ছাদে যায় গাছগুলোকে দেখতে। ছাদে তার কিছু গাছ আছে। সময়ের অভাবে প্রতিদিন আসা হয় না। কিন্তু ছুটির দিনে এসে অনেকক্ষন থাকে সে। গাছের আগাছা পরিষ্কার করে পানি দেয়। তখন সাঝঁ বাচ্চা দুটোকে নিয়ে আসে। ছোট্ট বাচ্চাটার বয়স ছয় মাস এখন। দাড়াঁনো শিখছে। উজানকে দেখলেই হাস। উজান কোলে করে ছাদে নিয়ে বেড়ায়। একদিন সাঝঁ উজানকে জিজ্ঞেস করেছিলো

” একা এতো বড় বাড়িতে আপনি একাই থাকেন? আপনার বাবা-মা কোথায়? বিয়ে করেননি”?

উজান এক পলক সাঝেঁর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকায়। তারপর সোজা সাপ্টা বলে

” বাবা উচ্চ মাধ্যমিক পড়াকালীন অবস্থায় দুনিয়া ছেড়ে গেছেন। আর মা বছর দুই হচ্ছে তিনিও বাবার কাছে গেছেন। ডায়বেটিকস এর রোগী ছিলেন। সেইটা একদম কমে নীল হয়ে যাওয়ায় আর বাচাঁনো সম্ভব হয়নি “। আর বউ সে….

সাঝঁ বললো

” বউ সে কোথায়”?

উজান ভনিতা না করে বললো

” ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে ছয় বছর আগে। বাবা হতে পারবো না তাই আর সংসারে বেধেঁ না রেখে নতুন জীবনে যাতে আগায় এজন্য বিচ্ছেদ হয়ে গেছে আমাদের”।

সাঝঁ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে উজানের দিকে। কি সোজাসাপ্টা ভাবে অবলীলায় নিজের জীবনের কঠিন সত্য একদমে বলে গেলো কোনরকম দ্বিধা জড়তা ছাড়াই। একটা মানুষ দুনিয়াতে পুরো একা অথচ তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে কত কি সহ্য করে দুনিয়াতে বেচেঁ আছে। এতো সুদর্শন ছেলে এতো ভালো চাকরি তবুও দিনশেষে বাড়ি ফিরে কাউকে ডেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে অপেক্ষা করার মতো কেউ নেই। সাঝেঁর খুব মায়া হয় উজানের জন্য। সেদিন সে আর কোন কথা উজানকে বলার সাহস যোগাতে পারেনি। তবে বিপত্তি বাধেঁ কয়দিন পর থেকে। উজান লক্ষ করে সাঝঁ নানা ছুতোয় তার সাথে কথা বলে। এটা ওটা দেওয়ার বাহানায় তার বাসায় আসে। কখনো রান্না করা খাবার নিয়ে কখনো বাচ্চাদের নিয়ে। উজান বয়সের অভিজ্ঞতা থেকে এই আবেগ অনুভূতি ধরতে পারে। তাই সাঝঁকে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে

” তুমি কি বুঝতে পারছো নিজেকে কোন বিপথে নিয়ে যাচ্ছো তুমি”?

সাঝঁ না বুঝার ভান করে বলে

” কি বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না”।

উজান বলে

” না বুঝার মতো মেয়ে তুমি নও সাঝঁ। তুমি খুব ভালো করেই জানো এসব আবেগ অনুভূতির ফল কখনো ভালো কিছু বয়ে আনেনা। নিজেকে সামলাও। বয়স কম। পড়াশোনা করে জীবনে আগাও। বাবা-মা ভালো ছেলে খোঁজ করছেন। ভালো ছেলে পেয়ে গেলে বিয়ে করে নাও। অযথা মরিচীকার পেছনে নিজের জীবনের ভালো অনুভূতিগুলো খারাপ করার মতো বোকামি করোনা”।

ব্যস সাঝঁকে কিছুই আর বলতে হয়নি। সেদিনের পর সাঝঁকে আর দেখেনি উজান। কখনো সামনেও আসেনি এক প্রকার জেদ করে। উজানও আর এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি বরং ভালো হয়েছে সময় থাকতে বুঝতে পেরেছে। নিজেকে সামলে নিয়েছে। এই যে তারপর আজকে সাঝেঁর বিয়ের খবর জানতে পারলো উজান। উজান রমজান সাহেবকে ছোট্ট করে বললো

” আমি থাকবো আংকেল সাঝেঁর বিয়েতে। বিয়েটা কখন”?

রমজান সাহেব বললেন

” এইতো বাবা জুম্মার নামায এর পর। ছেলে পক্ষ রওনা দিয়েছে। কুমিল্লা থেকে আসতে তিন ঘন্টার মতো লাগবে”।

উজান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে জানায় সে থাকবে। তারপর রমজান সাহেব খুশি মনে বিয়ের অন্যান্য কাজের জন্য উজানের বিদায় নিয়ে চলে গেলো। উজান দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে সোফায় এসে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর মিষ্টির প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস নিলো। তারপর বললো

” সুখী হও সাঝঁ। স্বামী, সন্তান এবং একটা সুস্থ সংসার তোমার জীবন রঙিন করুক”।

জুম্মার নামায শেষে মায়ের কব’র জিয়ারত করে বাড়ি ফিরতেই দেখে পুরো বিল্ডিং মানুষ দিয়ে ভরে গেছে। নিচ তালা সিড়ি থেকে শুরু করে তিন তালা অবধি অনেক মানুষ। সাঝঁদের ফ্ল্যাটের সামনে আরও বেশি মানুষ। উজান ভেবেছে বিয়ে বাড়ি তাই হয়তো। কিন্তু ঘরের কাছে আসতেই তীব্র কান্নার আওয়াজ শোনা গেলো। ভীড় ঠেলে ঘরে ঢুকতেই দেখে সবাই একে অপরকে জড়িয়ে মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বিলাপ করে কাদঁছে। উজান কাছে এসে সাঝেঁর বড় ভাইকে দেখে জিজ্ঞেস করে

” কি হয়েছে সবাই কাদঁছে কেন বিলাপ করে? বরপক্ষ আসেনি এখন? এতোক্ষনেতো পৌছেঁ যাওয়ার কথা”।

সাঝেঁর বাবা মেঝে থেকে উঠে উজানকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে কেদেঁ উঠলেন। তারপির বললেন

” আমাদের সুস্থ হাসি খুশি পরিবারের উপর কোন অদৃশ্য নজর লাগছে বাপ। আমার বড় মেয়েটা এভাবে চলে গেলো। ছোটটার বিয়ের বরযাত্রী বিয়ে ভেঙে মাঝ রাস্তা থেকে ফেরত চলে গেছে। আমার মেয়েটার কি হবে “?

উজান সাঝেঁর ভাইয়ের দিকে তাকাতেই সে বুঝিয়ে বললো

” বর‍যাত্রী ঢাকা হাইওয়েতে উঠতে নিলেই একটা ট্রাক এসে গাড়িকে ধাক্কা দেয়।গাড়িতে থাকা ছেলে সহ সবাই কম বেশি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। আর ছেলের বাবা ড্রাইভারের পাশে থাকায় অবস্থা বেশ খারাপ। তাই ছেলের দাদী বলেছে আমাদের মেয়ে নাকি অশুভ অপয়া। সে তাদের ঘরে না যেতেই তাদের এতো বড় দূর্ঘটনা ঘটেছে বউ হয়ে গেলে আরও বেশি বিপদ ডেকে আনবে। তাই বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে তারা। আমার বোনের কপালটা এতো খারাপ কেন হলো?এতো বড় ধাক্কাটা সইবে কেমনে”?

উজান বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। এর মধ্য পাড়া প্রতিবেশী আত্নীয় স্বজন বলাবলি করছে মেয়ে এরকম অপয়া।বিয়ের দিনই এতো বড় এক্সিডেন্ট হলো। ছেলে পক্ষ ঠিকই করেছে বিয়ে ভেঙেছে। এমন অশুভ মেয়েকে কে ঘরের বউ বানাবে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আসলো উজানের। এরই মধ্য ঘরের মধ্য থেকে সাঝেঁর মায়ার চিৎকার ভেসে আসলো। সাঝঁ দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকক্ষণ ডাকছে কিন্তু খুলছে না। উজান অজানা এক আশংকায় ধড়ফড়িয়ে উঠে। সাঝেঁর বাবা ভাই সাথে সাথে উঠে যায়। দরজায় নক করতে করতে থাকে কিন্তু কোন সারা শব্দ নেই। উজান জোরে ধাক্কা দেয় দরজায়। হাতে বেশ ব্যাথা পেয়ে রক্তও বের হয়। কিন্তু অনেক চেষ্টার পর দরজা খুলে যা দেখে তাতে চিৎকার দিয়ে উঠে

“সাঝঁ”

চলবে……..