#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ১৩
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
পরপর দুইটা মেয়ে বাচ্চা হওয়ার জন্য স্ত্রীকে হসপিটালেই তিরস্কার করছে স্বামী। পার্কিং এড়িয়াতে এরকম দৃশ্য দেখে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলোনা উজান। এমনিতেই তার মনটা আজকে বিষন্ন হয়ে গেছে ইশাকে দেখার পর থেকে তার উপর এরকম একটা অনুচিত বিষয় দেখে তার মন মেজাজ আরও গরম হয়ে গেলো। দুনিয়াতে কত বিচিত্র মানুষের বসবাস। কেউ সন্তান চেয়েও পায়না আবার কেউ পেয়েও তিরস্কার করে। উজানের মন চাইলো খুব কড়া এবং রুদ্ধ গলায় কিছু বলতে কিন্তু স্বামী -স্ত্রীর মধ্য বাহিরের অপরিচিত মানুষ হয়ে কিইবা বলবে। তাই দাতেঁ দাতঁ চেপে সেখান থেকে সরে আসলো। মনে মনে প্রার্থনা করলো লোকটার এই ভ্রম যেন ভাঙে। সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক মাকেতো সেই একই কষ্টের মধ্য দিয়েই তাকে পৃথিবীতে আনতে হয়। হসপিটালের ভেতরে আসতেই আরেক ঘটনার সম্মুখীন হলো সে। একজন স্ট্রোক করা মধ্য বয়সী পুরুষ মানুষ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাকে হসপিটাল থেকে এম্বুলেন্সে নেওয়ার তোড়জোড় চলছে। আত্নীয় স্বজনদের কান্নার আওয়াজ জায়গাটাকে শোকতপ্ত ভারি করে তুললো। প্রাণহীন দেহটাকে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে স্ট্রেচারে করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। স্ট্রেচার ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক ছেলে। কত বয়স হবে আর। কিশোর বয়স ষোল বা সতেরো। মুহুর্তের মধ্য তার বুকের মধ্য ছ্যাত করে উঠলো। ছেলেটার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করলো সে। ঠিক সে সময়ে ফিরে গেলো সে যখন তার বাবা এভাবে তাকে ছেড়ে চলে গেলো। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আর মাত্র সাতদিন বাকি। ছাত্র ভালো হওয়ায় বরাবরই সে পড়াশোনা নিয়ে বেশ গুরুতর চিন্তা ভাবনা করতো। নিয়ম মাফিক সে আদা জল খেয়ে বোর্ড পরীক্ষার জন্য পড়ছিলো। সে রাতেও সে রাত জেগে পড়াশোনা করছিলো। হঠাৎ করে মায়ের চিৎকারের আওয়াজ পায়। কি হয়েছে তা দেখতে মা-বাবার রুমে গিয়ে দেখে মা তার বাবাকে হাতে বুকে মালিশ করে দিচ্ছেন। আর বাবা শুধু বলে যাচ্ছে তার বুক ব্যাথা করছে। উজান তাড়াতাড়ি করে এম্বুলেন্স কল করলো। বাবার মাথার কাছে এসে বললো
” চিন্তা করোনা বাবা। এম্বুলেন্স আসতেছে। আমরা হাসপাতালে যাব। ডাক্তার দেখালেই তুমি ঠিক হয়ে যাবা “।
উজানের বাবা ছেলের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তার মাথায় হাত রাখলেন আর বললেন
” জীবনে অনেক বড় কিছু হও। আর মাকে দেখে রেখো”।
এরপর কালেমা পড়লেন। তারপর আর কোন কথা বলেননি। চোখও বন্ধ করলেন। ঠিক যেমন একজন মানুষ সারাদিন কাজ করার পর বাড়ি ফিরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে। ঠিক তেমন করে। কিন্তু তার এই ঘুম আর ভাঙবেনা। বাবা চলে যাওয়ার পর অনেক কিছু আপনা আপনি বুঝতে শিখেছে সে। আবার ঠকে শিখেছে। দুনিয়ার মানুষের মধ্য অনেক রুপ এর সাথে পরিচিত হয়েছে । বাবার কথা রেখেছে সে। মাকে কোন অসম্মান করেনি আর না তার অবাধ্য হয়েছে। জীবনে তার জন্য কঠিন মূল্য দিয়ে হলেও মার কথার বরখেলাপ করেনি সে। ফোনের রিংটোনের আওয়াজে ধ্যান ভাঙে তার। এতোক্ষণ বেখায়ালে ডুবে ছিলো সে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে সাঁঝের বাবা কল করেছে। তার মনে পরলো দুই ঘন্টা সময় নিয়ে বের হয়েছিলো বাহিরে। সেখানে আরও বেশি সময় লেগেছে। ছুটির দিন রাস্তায় ভীড় থাকে। আর কেনাকাটা করতেও সময় লেগেছে। তাড়াতাড়ি পা চালালো সে। সাঁঝ এর কেবিনের দিকে আসতেই দেখে কয়েকজন অপরিচিত মানুষ। উজান তাদের চেনে না। উজানকে দেখে তারা কথা বন্ধ করে তার দিকে চেয়ে থাকে। রমজান সাহেব বললেন
” উনারা আমার বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোক। সাঁঝ আর বাচ্চাদের দেখতে এসেছে”।
উজান তাদের সালাম দিলো আর কুশল বিনিময় করলো। তারপর হাসি মুখে আরও দুইটা কথা বলে কেবিনের ভেতরে গেলো। গিয়ে দেখে সাঁঝ দুই বাচ্চাকে জাপটে ধরে আছে। একজন মহিলা তাকে বলছে
” এখনতো তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদের বাচ্চা আমাদের দিয়ে দাও। ওরা আমাদের বংশধর। তুমি স্বামীর বাড়িতে যাবা সংসার করবা ওদের দেখার সময় কোথায়? নিজের সংসার বাদ দিয়ে বোনের বাচ্চাদের মানুষ করবা? আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়ে আমরা নিয়ে যাই এবার। তাদের ছাড়া ঘর ফাকা লাগে। আমরা না হয় ছেলেটাকেই নিয়ে যাই। তুমি মেয়েটাকে দেখো। ছেলে আমাদের বংশের বাতি। মেয়েটা ছোট তুমি ওরে মানুষ করো। বড় হলে বিয়ে শাদীর দেওয়ার যে খরচ তা আমরা দেখবোনে “।
উজান এতোক্ষণ আন্দাজ করছিলো মহিলার বয়স এবং আচরণ দেখে যে এইটা তার বড় বোনের শ্বাশুড়ি। কথা শুনে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো এখন। এই মহিলাও ছেলে মেয়ে সন্তানের মধ্য পার্থক্য করছে। তখনকার রাগটা আবার ফিরে এলো। উজান সাঁঝ বলে ডাক দিলো। উজান কখন এসেছে সাঁঝের সেই খেয়ালই নেই। বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে মাথা নিচু করে কাদঁছে। উজান পাশের টেবিল থেকে সাঁঝের ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো
” সাঁঝ পরপর দুইটা ভিডিও কল করবে। প্রথমটা করবে তোমার দুলাভাইকে। দ্বিতীয়টা করবে উকিলকে। বাচ্চাদের নিয়ে উনি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা এখন সামনে আসা দরকার “।
উজানের কথায় মহিলাটি ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো। সে হঠাৎ অস্থিরতা দেখিয়ে বললো
” এর মধ্য আবার বাচ্চাদের বাবাকে কেন আনতে হবে? আর উকিল কোথায় থেকে আসলো? আমাদের বাচ্চা আমরা নিয়ে যাবো এতে কারে কি বলতে হবে? আর তুমিই বা কে যে এর মধ্য ঢুকছো”?
উজান হেসে বললো
” আমি হচ্ছি সাঁঝের স্বামী। আর এই বিষয় এর মধ্য ঢুকছি কারণ এর মধ্য আমার বউ জড়িয়ে আছে তাই। বাচ্চাদের নিয়ে তার বাবা গত কয়েকমাস আগে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেটা এবার মনে হয় আপনাদের জানা উচিত “।
সাঁঝ প্রথমে তার দুলাভাইকে কল দিলো। প্রথমবার কল হয়ে রিসিভ হলো না। কিন্তু পরক্ষনেই সাঁঝের বোন জামাই নিজেই কল ব্যাক করলো। তারপর বললো
” কি অবস্থা সাঁঝ এখন কেমন আছো”?
সাঁঝ কথা বলতে পারলো না। সে বাচ্চাদের জড়িয়ে রইলো। আর কাঁদছে সে। তার দুলাভাই আবার বললো
” কি হয়েছে সাঁঝ? তুমি ঠিক আছো? বাচ্চারা ভালো আছে”?
সাঁঝ কোনরকমে কান্না আটকে বললো
” আপনার মা নিহিনকে নিয়ে যেতে চায় তার কাছে। আমি বাচ্চাকে দিবোনা। বাচ্চা আমার কাছেই থাকবে। ও বাড়িতে আমি বাচ্চা দিবোনা”।
সাঁঝের দুলাভাই বললো
” মা তোমার কাছে বাচ্চা নেওয়ার জন্য গেছে? আমার সাথেতো দুই ঘন্টা আগেই কথা হলো। কিছুতো বললো না”। দাও দেখি মাকে ফোন দাও।
সাঁঝ ফোন এগিয়ে দেয়। ছেলের সাথে মায়ের এবার কথা হবে। আর কোন লুকোচুরি নয়। সাঁঝের বোনের শ্বাশুড়ি মোটেও ভালো মানুষ না। তার বোনকে সংসার জীবনে একটুও শান্তি দেয়নি। সবসময় সংসারকে হাতের মুঠোয় রাখতে চেয়েছে। তাই সবসময় চাইতো ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু তার বোন জামাই ছিলো উল্টো। সে মা আর বউ এর মধ্য সমন্বয় করেই চলতো। তার কাছে যা ঠিক সেটাই সে করতো। এজন্য তার বোনটা সংসার করতে পেরেছে। যেহেতু তার বোনের স্বামী বাহিরে থাকতো এজন্য তার শ্বাশুড়ি আরও বেশি জ্বালাতন করতো। পরের বাচ্চা হওয়ার সময় অনেক অশান্তি করেছে। এই বাচ্চা হওয়ার সময় বাচ্চাদের বাবা দেশে ছিলো। এইবার বাচ্চা হলেই ছয় মাসের মধ্য তাদের নিয়ে যাওয়ার চিন্তাও করেছিলো। কাগজপত্র প্রায় গুছিয়ে এনেছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলোনা। ছেলের দিকে তাকাতেই তার বোনের শ্বাশুড়ির চোখে মুখে অস্থিরতা তৈরি হয়। যেন কিছু ফাকিঁ দিতে গিয়ে ধরা পড়েছে। সাঁঝের বোন জামাই এর নাম রায়হান। সে তার মাকে বললো
” তুমি সাঁঝের কাছে এসেছো সেটাতো আমাকে বলোনি মা?তোমার সাথেতো কিছুক্ষণ আগে আমার কথা হলো”।
রায়হান এর মা কিছুটা ভড়কে গেলেন। তবুও কাউকে বুঝতে না দিয়ে কঠিন গলায় বললেন
” সব কথা তোকে জানানোরতো দরকার নেই। নিজের নাতিনাতনীদের দেখতে আসবো তোকে বলে আসতে হবে নাকি? আমরা নিহিনকে নিয়ে যেতে এসেছি। ও যেহেতু বাচ্চাদের ভালোবেসে কাছে রাখতে চায় তাইলে মেয়েটাকে রাখুক। মেয়ে মানুষ এর এমনিতেই অনেক খরচ। ওরাও এক বাচ্চার দায়িত্ব নিক!।
রায়হান মায়ের কথায় যারপরনাই বিরক্ত হলো। তার মায়ের মন এতো নিচু মনমানসিকতার এই ভেবেই লজ্জায় মাটির নিচে যেতে মন চাচ্ছে তার। তাও সাঁঝের সামনে এমন কথা। দাতেঁ দাতঁ চেপে রাগ সংবরণ করে বললো
” আমি ওদের বাবা। ওরা আমারই অংশ। আমার সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার সামর্থ্য আমার আছে। কাউকে আলাদা করে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে না। আর কোন বাচ্চাই তোমার সাথে যাবে না। বাচ্চার আইনত অভিভাবক সাঁঝ। আমি আসার আগে উকিলের সাথে কথা বলে সবকিছু ঠিক করে এসেছি। বাচ্চাদের আঠারো বছর না হওয়া অবধি তাদের আইনত অভিভাবক সাঁঝ। ততদিন পর্যন্ত বাচ্চারা তার কাছেই থাকবে। আর তোমরা চাইলে মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতে পারো। যদি বিশ্বাস না হয় সাঁঝকে বলো উকিলের সাথে কথা বলায় দিবে। এইটা আমার মর্জিতেই হয়েছে।তাই এই নিয়ে কোনো তামাশা করবে না”।
ছেলের কথায় অবাক হয়ে যায় রায়হান এর মা। ছেলে যাওয়ার আগে এসব করে গেছে তিনি জানতেন না। ছেলেকে যতই নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন ছেলে ততই তার হাত ফসকে গেছে। রাগে জ্বলতে জ্বলতে বললেন তিনি
“কার পরামর্শে এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিস তুই? এগুলো করার আগে আমাদের বলেছিলি? নিজের শ্বশুর বাড়ির উপর এতো ভরসা তোর যে নিজের মা-বাবা কেও জানানোর প্রয়োজন মনে করিসনি। বউতো জাদু করেই রেখেছিলো। সেতো এখন নেই তাই এরা তোর টাকা পয়সা হাতানোর জন্য তোকে জাদু করেছে। মাস ধরে কত টাকা দিস এখানে? সবই দিয়ে দে। এরাই তোর সব। আমরা কেউ না”।
রায়হান এর মেজাজ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো মায়ের কথায়। আর কত নিচে নামবে তার মা। আর কত লজ্জায় ফেলবে তাকে। এতো কিছু করেও তার মধ্য কোন লজ্জাবোধ নেই। যা মুখে আসছে তাই বলছে। রায়হান কোন রকমে মেজাজ ঠিক রেখে উত্তর করলো
” সাঁঝ এখন অসুস্থ মা। হসপিটালে অহেতুক এতো মানুষের ভীড় করা ভালো না। তুমি তোমার উত্তর পেয়ে গেছো। ঠিক এই মুহুর্তে তুমি সেখান থেকে বেড়িয়ে আসবে। দেশতো ছাড়তে বাধ্য করেছোই এখন যদি আর বেশি কিছু করো মা ছেলের সম্পর্কটাও আর ঠিক থাকবে না। তাই চুপচাপ কোন বাড়তি কথা না বলে বের হয়ে আসবে।যথেষ্ট হয়েছে”।
ছেলের কথায় রায়হানের মা ভয় পেয়ে গেলেন। তার ছেলে কখনো এতো কঠিন করে কথা বলে না। আজ বললো। হীতে বিপরীত হতে পারে এইভেবে তিনি তার বিষয়টিকে ঘাটালেন না। রাগে গজগজ করতে ফোনটা সাঁঝকে দিয়ে বের হয়ে গেলেন। সাঁঝ ফোন হাতে নিতেই রায়হান বললো
” বাচ্চারা তোমার কাছেই থাকবে সাঁঝ। ওরা একটু বড় হোক। আমি আমার কাছে নিয়ে আসবো। আর মায়ের কথায় কষ্ট পেও না। তোমার বোন আমাকে অনেক কৃতজ্ঞ করে গেছে এখন আরও বেশি বুঝতে পারি আমি। নিজের নতুন সংসারে মন দাও। নিজের খেয়াল রেখো। রাখছি একটু কাজ আছে। পরে কথা হবে বাচ্চাদের সাথে”।
সাঝঁ মাথা নাড়িয়ে ফোন রেখে দেয়। উজান এতোক্ষন সবটা দেখছিলো। পরিস্থিতি শান্ত হতেই সাঁঝকে জ্বালানোর জন্য বললো
” কচি বউ এতো ছিচঁকাদুনে হয় আগে জানলে এই বুড়ো বয়সে বিয়েই করতাম না। খালি ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে”।
চলবে………
#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ১৪
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান
“শেষ পর্যন্ত তুমিও আমাকে ঠকালে সাঁঝ। আমি কি মানুষ হিসেবে এতো খারাপ যে আমার জীবনে সুখী হওয়ার অধিকার নেই?জীবন কি আমাকে সেই সুযোগটুকুও দিবে না? তুমিতো বলেছিলে তুমি আমাকে ভালোবাসো সারাজীবন আমার সাথে থাকতে চাও সেই তুমি কিভাবে আমাকে ঠকাতে পারলে সাঁঝ? তোমার একটুও বুক কাপঁলো না? তোমার মনে যখন এই সংশয় ছিলো কেন আমাকে আগেই বারণ করলে না?কেন আমার সিদ্ধান্তে তুমি সায় দিলে? তোমার ভালোবাসা কি এতোই ঠুনকো ছিলো”?
অসহায় দৃষ্টিতে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে একদমে কথাগুলো বললো উজান। উজানের গলা কাপঁছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার। মাথা কাজ করছে না। নিজেকে আবার সেই ছয় বছর আগেকার উজান মনে হচ্ছে। জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া নিঃস্ব একজন মানুষ। সে ভেবেছিলো সাঁঝ তার জীবনে নতুন গল্প হয়ে আসবে। তার এই একাকী জীবনকে আবার নতুন রঙে রঙ্গিন করবে। সে ভুল ছিলো। ইতিহাস নতুন কিছু লিখলো না তার জন্য। আবার সেই ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হলো। তার জন্য একটা সুস্থ সংসারের স্বপ্ন দেখা অন্যায়। জীবনে পাশে কাউকে চাওয়া বেমানান। সে একাই ভালো ছিলো। আবার ভুল করলো সে গুরুতর ভুল। সাঁঝকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে সে নতুন করে বাচাঁর আশা পেয়েছিলো সে। প্রতিদিনের মতো রোজকার অফিস শেষ করে বাসায় ফিরেছিলো উজান। বাসায় ফিরে দরজা নক করতেই দেখে ঘরের দরজা খোলা। তার শোবার ঘর থেকে ফিসফিস করে কথার আওয়াজ আসতেছে। হাতের ব্যাগটা সোফায় রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় নিজের ঘরের দিকে। গিয়ে যা দেখলো তাতে তার পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম। সাঁজ অন্য একটা ছেলের সাথে তারই ঘরে অন্তরঙ্গ মুহুর্ত পার করছে। ছেলেটার সাথে কথায় কথায় খিলখিল করে হাসছে। এসব কি দেখছে সে? তার স্ত্রী তার অবর্তমানে তারই বাড়িতে তার শোবার ঘরে এক চাদরের নিচে অন্য একটা ছেলের সাথে দিন কাটাচ্ছে। গা গুলিয়ে উঠলো তার। রাগে অপমানে মাথায় রক্ত উঠে গেলো। চিৎকার করে সাঁঝ বলে ডেকে উঠলো
“সাঁঝ”
সাঁঝ দরজার কাছে উজানকে দেখতে পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে গেলো। প্রেমিকের সাথে সময় পার করতে গিয়ে কখন যে স্বামীর অফিস থেকে আসার সময় হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। এভাবে হাতে নাতে ধরা পরে যাবে স্বামীর কাছে সে কল্পনাও করতে পারেনি। কোন রকমে শাড়ির আচঁল টেনে জড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে একপাশে দাঁড়ালো সে। উজান দ্রুত বেগে সেই ছেলেটার কাছে গিয়ে তাকে কানের নিচ বরাবর একটা চড় দিলো সেই সাথে হাটুঁতে লাথি। ছেলেটা মাটিতে লুটিয়ে পরলো। সাঁঝ অবস্থা বেগতিক দেখে উজানকে থামাতে যায়। কিন্তু উজান থামে না। পায়ের জুতো খুলে মারতে শুরু করে। সাঁঝ কেপেঁ উঠে উজানের এই রুপ দেখে তবুও সে দমে না। সে উজানকে হুমকি দিলো যদি সে সেই ছেলেটাকে না ছেড়ে দেয় তাহলে চিৎকার করে মানুষ জড়ো করবে আর সবাইকে বলবে বাড়ি ফিরে বউকে মারছে। উজানের হাত থেমে যায় এই কথা শুনে। কি নিষ্ঠুর মিথ্যা অপবাদ অনায়াসে দিলো তার স্ত্রী তাকে। উজানের হাতের বাধন আলগা হওয়ার সুযোগ নিয়ে নেয় ছেলেটি। দ্রুত বাসা থেকে পালিয়ে যায়। মাটিতে ধপ করে বসে পরে উজান। তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শরীর তার ভর ছেড়ে দিচ্ছে। বুক জ্বলে যাচ্ছে। দম আটকে আসছে। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে যাচ্ছে। সাঁঝের দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
” সব জেনেইতো জীবনে এসেছিলে কেন আবার ঠকালে”?
সাঁঝের কাছে আত্নসমর্পণ ছাড়া এখন এই মুহুর্তে দ্বিতীয় কোন পথ খোলা নেই। তাই কোন রকম ভনিতা ছাড়াই বললো
” আমি শুধু তোমার টাকা আর আমার স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য তোমার জীবনে এসেছি। আমি তোমাকে ভালোবাসিনা। আমার একটা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার দরকার ছিলো। আর তোমাকেই তার জন্য যথাযথ বলে মনে হয়েছে। তাই নিজের রুপের ভালোবাসার মায়াজাল বিছিয়ে তোমাকে টোপ দিয়েছি। আর তুমি সেই টোপ গিলেছো। তোমার জন্য আমার মনে শুধু দয়া ছাড়া আর কিছু নেই। তুমি হচ্ছো গিয়ে আমার সোনার ডিম পারা হাঁস যাকে শুধু ব্যবহারই করা যায় কিন্তু ভালোবাসা যায় না। তোমার মতো অক্ষম ছেলেকে বিয়ে করার আর কি কারণ থাকতে পারে”?
উজানের স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে নিজের স্ত্রীর দিকে। দুনিয়াতে কি মেয়েরা এমনই ছলনাময়ী হয় নাকি সে এমন জীবন নিয়ে এসেছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। শুধু তার সাথেই কেন এমন হয়। উজান সাঁঝ বলেই একটা চিৎকার দিলো
“সাঁঝ কেন এমন করলে”?
উজানের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় সাঁঝের। আজকেও তার স্বামী এখানে আছে। অনেক বলার পরেও বাসায় যেতে চায়নি। বউকে হসপিটালে রেখে সে বাড়িতে আরাম করে ঘুমাবে না। একেবারে বউকে নিয়েই বাড়ি ফিরবে। এই কথা শোনার পর কারো আপত্তি তোলার কিছু নেই। কিন্তু উজানের কি হলো সে এমন ছটফট করছে কেন? কিছু একটা বিড়বিড় করছে। সাঁঝ দূর্বল শরীর নিয়েই উজানের কাছে যেতেই শুনতে পেলো
” তুমি এমন করতে পারোনা সাঁঝ। আমাকে ঠকাতে পারোনা “।
সাঁঝ অবাক হয়ে যায় উজানের কথা শুনে। সাঁঝ তাকে ঠকাবে কেন?এমন মানুষকে স্বামী হিসেবে পাওয়া কতটা সৌভাগ্যের এইটা শুধু সে নিজেই জানে। সে যে তার ভাগ্যের কাছে কতটা কৃতজ্ঞ এইটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। কিন্তু উজান এমন বলছে কেন? সে কি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে তাকে নিয়ে? সাঁঝ আবারও উজানের মুখের কাছে কান পাতে। উজান আবারও বলে
” আমাকে কেউ ভালোবাসে না। সবাই শুধু ছেড়ে যায়। সবাই শুধু ঠকায়”।
উজানের কথা শুনে সাঁঝের কান্না পেয়ে গেলো। এই মানুষটাকে সে অনেক ভালোবাসে। আর এসব ঘুমের ঘোরে কিসব ভুলভাল বকছে সে। একটু জোরে ধাক্কা দিলো উজানকে। উজান ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে যায়। কেবিনে এসি চলছে। তবুও সে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। বড় বড় শ্বাস ফেলছে সে। খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। আবার সেই এক ঠকে যাওয়ার স্বপ্ন পুনরাবৃত্তি হয়েছে। বুকের মধ্য তীব্র একটা সূচালো ব্যাথা হচ্ছে তার। সেই অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সাঁঝ বললো
” কি হয়েছে আপনার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন আপনি?
উজান ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো সে হসপিটালে তার স্ত্রীর কাছে আছে। আর সে অসুস্থ এখন। কোথাও যায়নি। তার কাছেই আছে। তাহলে সেই স্বপ্ন? উজান কোনরকমে বলে
” আমাকে একটু পানি দাও প্লিজ”।
সাঁঝ দ্রুত বেড এর পাশ থেকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় উজানকে। ঢকঢক করে এক শ্বাসে পুরো গ্লাস শেষ করে ফেলে সে। সাঁঝ তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। তবুও তার অস্থিরতা কমে না। বুকের মধ্য ব্যাথা করছে। সাঁঝ ভাবলো ডাক্তারকে ডাকবে কিনা। তাই ইমারজেন্সি বেল বাজানোর জন্য উঠতে নিলেই উজান সাঁঝের হাত ধরে ফেলে। তার দিকে তাকিয়ে বলে
” আমাকে ছেড়ে যেও না। কোথাও যেও না। এখানেই থাকো আমার পাশে “।
সাঁঝ আর উঠলো না। তার হঠাৎ করে মনে হলো উজানের এই অস্থিরতা এই উদ্বেগ সে কমাতে পারে। তার যন্ত্রনা সে উজানের স্ত্রী হয়ে উপশম করতে পারে। উজানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে। হঠাৎ উজান একটা আবদার করে বসে
” আমার বুকে অনেক ব্যাথা করছে সাঁঝ। তুমি কি আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেবে নিজের সাথে? আমার কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলে মাথা ব্যাথা করে। আমার কাছে থাকো। একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও। আর একটু…….. ”
সাঁজ উজানের আধা আধুরা কথা বুঝলো না। সে কিছুটা লজ্জা মিশিয়ে বললো
“আর একটু কি”?
উজান বললো
” আগে আষ্টেপৃষ্টে জড়াও নিজের সাথে তারপর বলবো”।
সাঁঝ ধীরে ধীরে উজানের কাছে চলে যায়। তারপর স্বামীর অসুখ সারাতে তার কথামতো তাকে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। যতটা তার পক্ষে সম্ভব ততটাই। কিন্তু উজানের মনে হচ্ছে সাঁঝ পারছে না। তাই সে নিজে তার বউকে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে। এখন উজান শান্তি পাচ্ছে। বুকের ব্যাথার তীব্রতা কমছে। অস্থিরতা কমছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না। কিছু মুহুর্ত পার হওয়ার পর উজানের মনে হলো তার শ্বাস প্রশ্বাসের গতি ঠিক হয়ে আসছে। যন্ত্রণা উপশম হচ্ছে বউকে জড়িয়ে ধরে থাকায়। সাঁঝ বলে
“এখন ভালো লাগছে? আর কষ্ট হচ্ছে”?
উজান নরম গলায় বলে
” না এখন কষ্ট মনে হচ্ছে কমে গেছে। তুমি আরও আগে কেন আসলে না সাঁঝ তাইলে কষ্ট আরও কম হতো আমার “।
সাঁঝ বলে উঠে
” তাই”?
উজান বলে
“হ্যাঁ”
সাঁঝ বলে ”
“তখন কথা শেষ করেননি। কি যেন আরেকটু…… ”
উজান শব্দ করে হাসে। নিজের স্ত্রীর কপালে গভীর আদর দিয়ে বলে
“আদরতো মুখে বলে হয়না বউ। করে দেখাতে হবে তাহলে বুঝবে”।
চলবে………..