নীল সাঝেঁর উজান পর্ব-১৭+১৮

0
32

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ১৭
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

সবচেয়ে কাছের বান্ধবীর সংসার ভেঙে যাওয়ার খবর শুনে থ মেরে বিছানায় হতবিহ্বল হয়ে বসে আছে সাঁঝ। শরীরটা তার এখন অনেকটাই ভালো। হসপিটাল থেকে বাড়িতে আসার সাতদিন পার হয়ে গেছে। যদিও উজানের সাথে বিয়ের খবর এখনো তেমন কাউকে ঘটা করে বলা হয়নি আর না সে বলতেও চায়। ধীরে ধীরে দিন গেলে এমনিতেই বুঝে যাবে সবাই। জানার মধ্য কতিপয় কিছু আত্নীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী আর দু একজন বান্ধবী জানে। তাদের মধ্যেই একজন কাছের বান্ধবী আজকে দেখা করতে এসেছে তার সাথে। খুব বেশি বন্ধু বান্ধব নেই সাঁঝের। এই বান্ধবীকে সে তার ভার্সিটি জীবনে পেয়েছে। অনার্স সেকেন্ড ইয়্যারে থাকাকালীন হঠাৎ করেই বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। তারপর সংসার পড়াশোনা সামলাতে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে তাকে। সাঁঝ যথেষ্ট সাহায্য করেছে তাকে। মিলি নাম এই বান্ধবীর। সাঁঝের বিয়েতে আসতে পারেনি। কেন আসতে পারেনি এখন কারন জানলো সে। তার স্বামীর মামাতো বোনের সাথে বিয়ের আগে থেকেই সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু বিষয়টা গোপন করে মিলির সাথে বিয়ে দেওয়া হয় কারণ মিলির শ্বশুরের নিজেদের মধ্য আত্নীয়তা পছন্দ ছিলোনা তাই। বিয়ের পর সবকিছু ভালোই চলছিলো। কখনো স্বামীর তরফ থেকে এমন কোন আচরণ পায়নি সে যাতে তার সন্দেহ হয়। তবে গত ছয় মাস থেকে সেই মামাতো বোনের বিয়ে নিয়ে তোড়জোড় শুরু হলে মিলির স্বামীর মধ্য পরিবর্তন আসতে শুরু করে। গত মাসে সেই মামাতো বোনের বিয়ে ছিলো। সবচেয়ে তাজ্জবের কথা হচ্ছে বরকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বরণ করে নিয়ে এসেছিলো সে। তার দশ মিনিট পরেই সেই মামাতো বোনকে মানে এতোদিন পর প্রেম জেগে ওঠা পুরাতন প্রেমিকা নিয়ে পালিয়ে গেছে তার স্বামী। কতবড় অপমান কত তীক্ষ্ণ অসম্মান। মুহুর্তের মধ্য হৈচৈ পড়ে গেছে পুরো গ্রামে। এতো বড় অসম্মানের পর সেদিনই এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়েছে মিলি। এতো বড় একটা ধাক্কা কত বড় যন্ত্রণা বুকের মধ্য নিয়ে এই একটা মাস সে বেচেঁ আছে। ঘটনার তিন দিন পর ফিরে আসে তার স্বামী। মিলির কাছে ক্ষমা চায়। সে নাকি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলো না সেই মেয়েটার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মিলির কাছে এসেছে অনুমতি নিতে। তারা বিয়ে করবে। মিলি অনুমতির জায়গায় সেদিন ডিভোর্স পেপার তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছে

” আদালতে এই নিয়ে ফয়সালা হবে। আমার সম্মান এতো ঠুনকো নয়। মানহানির সাথে মানসিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং দেন মোহরানা পরিশোধ চেয়ে মামলা করা হয়েছে থানায়। এসব কিছুর ফয়সালা হলেই বিয়ে করতে যাবেন। না হলে দেখা যাচ্ছে বিয়ের আসর থেকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাচ্ছে “।

সত্যিই সেদিন ছেলেটাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। সে এখনো জেলেই আছে। এই মাসের শেষের দিকে শুনানির তারিখ আছে। সাঁঝ প্রশ্ন করে

” সেই মামাতো বোনের কি অবস্থা এখন”?

মিলি বললো

” ওই বাড়ির সাথে নাকি সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সবার। তবে মেয়েটা তাকে ফোন দিয়েছিলো। ঘৃনায় রাগে লজ্জায় গা ঘিন ঘিন করে উঠেছিলো তার। মেয়েটা বলেছে কেস তুলে নিতে। সে নাকি তাকে ছাড়া বাচঁবেনা। আমি নাকি তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে তাদের মধ্য ঢুকে গেছি। আমাকে নাকি আমার স্বামী কোনদিন ভালোই বাসেনি। পরিবারের চাপে বিয়ে করেছে। আমি ফোন রেখে দিয়েছি। থানায় গিয়ে জানিয়ে এসেছি আমাকে ফোন করে এসব কথা শোনায়। তারপর থানা থেকে ওই মেয়ের বাড়ি গিয়ে পুলিশ বুঝিয়ে এসেছে এরপর যদি আবারও ফোন করে এমন মানসিকভাবে হেনস্থা করে তাহলে তার বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নেওয়া হবে”।

সাঁঝ জিজ্ঞাসু চোখে মিলিকে প্রশ্ন করে

” তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কি বলে? ছেলের পক্ষ নিয়ে সাফাই গাইতে আসেনি? আর দশ জন বাপ মায়ের মতো বলেনি পুরুষ মানুষ এর এমন একটু আধটু স্বভাব থাকেই। তুমি মামলা তুলে নাও “।

মিলি মলিন হেসে বলে

” এইটা আমিও ভেবেছিলাম। কিন্তু এমনটা যে হয়নি এটাই আমার কাছে অবাক লাগে। আমার শ্বশুর ভীষণ ভালো মানুষ। উনি সাদাকে সাদা আর কালোকে কালোই বলেন। উনি আমাকে আরও ভালো উকিলের কাছে নিয়ে গেছেন যাতে বিষয়টা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। তবে শ্বাশুড়ি বলেছিলেন তালাক যখন দিচ্ছি তাহলে এতো পাচঁ কান করা কেন? কিন্তু শ্বশুরের এক ধমকে উনার কথা আর ধোপে টিকে নাই। এখন যা ফয়সালা হবে সব আদালতের রায় অনুযায়ী হবে”।

সাঁঝ বলে

” তোর বাবা-মা কি বলে? তারা তোর সাথে আছে”?

মিলি বললো

” এখন অবধিতো আছে। জানিনা কি হবে। এই সমাজে ডিভোর্স হওয়া মেয়েদের নিয়ে কত কি কথা শুনতে হয় সহ্য করতে হয় এগুলো শুধু একসময় শুনতাম আর এখন নিজের চোখে দেখছি। বাড়িতে ভালো লাগে না বলে কয়েকটা প্রাইভেট ফার্মে সিভি দিয়ে রেখেছি। ভাবছি আই ই এল টি এস দিবো। বাহিরে স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স করতে যাবো।এখানে থাকলে এই বিষয়টা আমাকে খুব ভোগাবে। ইতিমধ্যে মানসিকভাবে অনেকটাই অস্থির হয়ে আছি। তোর কাছে আসবো আসবো করে আসাই হচ্ছিলো না এই সব ঝামেলায়। তোর ফোন বন্ধ পেয়ে মাঝে আন্টিকে কল করেছিলাম। আন্টি বললো সব। মাঝে মাঝে এতো অবাক লাগে নারী জীবন এতো কঠিন কেন এই ভেবে। তারপর বল নিজের বরকে কেমন বুঝতে পারছিস?

সাঁঝ এবার নড়েচড়ে বসলো মিলির কথায়। হসপিটাল থেকে আসার পর সে বুঝতেই পারেনি কোনদিক থেকে সপ্তাহ ঘুরে আজকে বৃ্হস্পতিবারে পরেছে। ডাক্তার এতো কড়া ডোজের ওষুধ দিয়েছিলো যে খাওয়ার সাথেই ঘুম চলে আসে। সকালে ঘুম ভাঙেও দেরিতে। উজান কখন যায় কখন আসে এসব সে বুঝেই উঠতে পারেনি। তবে যতক্ষন চোখ খোলা থাকে ততক্ষন মানুষটার সাথে গা ঘেষেঁ ঘেষেঁ থাকে। সেদিনের সকালের কথা মনে হতেই এখনো লজ্জায় তার মাথা নুইয়ে আসে। সেদিন তারা প্রথম অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলো। সাঁঝ সেই স্পর্শে সেই আদরে সেই অন্তরঙ্গতায় কোন বাধাঁ দেয়নি। সে নিজেও চাচ্ছিলো এই স্পর্শ আরও গভীর হোক যদিও তার শরীর তখনো অনেক অসুস্থ ছিলো। তবুও সাঁঝ স্বামীকে কাছে চেয়েছে। উজান যখন তার পুরো মুখে এলোপাথাড়ি চুমু দিয়ে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছিলো তখন সাঁঝের খুব আফসোস হয়েছিলো এই মানুষটার দেখা আগে কেন পায়নি সে। কিন্তু উজান সেদিন বেশি গভীরে গিয়ে স্ত্রীকে আদর করেনি। গলায় মুখ গুঁজে সাঁঝকে আরও শক্ত করে বুকের মধ্য নিয়ে বলেছিলো

” আগে সুস্থ হও সাঁঝ। আমি আছি তোমার কাছে। এভাবেই আমার সমস্ত আদর, ইচ্ছা এবং অস্তিত্ব দিয়ে তোমার মধ্য ডুবে থাকবো। এবং সেটা যতদিন বেচেঁ থাকবো ততদিন”।

সাঁঝ এর হাত জ্বলছিলো টান লাগায়। কিন্তু সেটা তাকে কষ্ট দিচ্ছিলো না। সেতো বিভোর হয়ে স্বামীর কথা শুনছে। এই কথায় সে অবাক হলো, খুশি হলো কিন্তু তৃপ্ত হলো না। তারপর আর কি সে নিজেই উজানকে আরও বেশি টেনে নিয়েছে নিজের কাছে। উজান যত বুঝায় সে আরও বেশি পাগলামো করে। তবে কিছুক্ষণ পর হাতের ব্যাথা বেড়ে যাওয়ায় নিজে থেকেই ক্ষান্ত দেয়। ব্যাথা এতোটাই বেড়ে যায় যে আবার ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। আবার নতুন করে সেলাই এর জায়গা পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনা হয়। সেদিন এর পর দুজনের মাঝে উজান ভারত পাকিস্তানের বর্ডার হিসেবে কোলবালিশ দিয়ে রেখেছে। সকালে উঠে উজান নিজের জায়গায় ঠিক থাকলেও কোলবালিশ ঠিক থাকে না। প্রতিদিন সে তার স্ত্রীকে হয় নিজের বুকের উপর নয়তো পেটের উপর আবার নয়তো পায়ের কাছে দেখতে পায়। এভাবেই এই সপ্তাহ চলে গেলো। মিলির ডাকে ঘোর ভাঙে সাঁঝের।

“সাঁঝ ”

সাঁঝ বলে

” হুম বল শুনছিতো”।

মিলি প্রশ্ন করে

” বললিনাতো ভাইয়া কেমন মানে বর কেমন তোর”?

সাঁঝ হেসে বলে

” জীবনের একটা কঠিন সময়ে এই মানুষটা ভরসা হয়ে আশ্বাস হয়ে আমার জীবন বাঁচিয়েছে। নয়তো যে অবস্থা আমি নিজের করেছিলাম তাতে আমাকে তুই আজকে জীবিত দেখতে পারতি না”।

মিলি একটা লম্বা শ্বাস টানে। কেন তাদের সাথেই এমন হলো? কখনোতো কারো খারাপ চায়নি আর না কাউকে জেনে বুঝে কষ্ট দিয়েছে। না জেনেও দিয়েছে কিনা সেটা বলতে পারছে না। তবুও এতো কঠিন পরীক্ষা জীবন তাদেরই নিচ্ছে। মিলি বলে

” প্রার্থনা করি দোস্ত ভালো থাক। সুস্থ পরিবেশে সংসার কর। আমার জন্যেও দোয়া করিস। আজকে তাহলে আসি”।

সাঁঝ বলে

” এখনি চলে যাবি? আরেকটু থেকে যা। বাচ্চাদের মা নিয়ে গেছে তাই আমিও এমন অলস হয়ে সময় কাটাই নয়তো দিন বাচ্চাদের সাথেই বয়ে যায়”।

মিলি বলে,

“অন্যদিন এসে আবার থাকবো অনেকক্ষণ। আজকে যাই। অনেকক্ষন বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। দেরি হলে মা চিন্তা করে এখন”।

সাঁঝ বান্ধবীকে স্মিত হেসে বিদায় দেয়। সময় এগিয়ে যেতে যেতে আটটা বাজে। উজান আসে অফিস থেকে। নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে। সাঁঝ এর উঠে আসতে কষ্ট হবে বলে কলিং বেল দেয় না। নিজেই চাবি খুলে ঘরে আসে। আজকেও আসলো তাই। বউকে ডাকে সে। কিন্তু উত্তর আসেনা। ধড়ফড়িয়ে উঠে দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে যায়। ঘরে যেতেই দেখে বউ বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু ঘুমাবে ভালো কথা কিন্তু এই গরমে কালো শাড়ি তাও আবার যেনতেন শাড়ি না জর্জেট এর শাড়ি পরে ঘুমিয়ে আছে। কালো উজানের প্রিয় রং। রেড ওয়াইন শেড এর লাল লিপস্টিক উজানের ভেতর বাহির থেকে ঝড় তুললো। শুকনো ঢোক গিললো সে। আজকেও বউ ফন্দি আঁটছে তার। কাছে গিয়ে হাতটা ধরে ডাক দিতেই উজানকে এক ঝটকায় বিছানায় ফেলে সাঁঝ নিজের উপর নিয়ে আসে। চোখ খুলে সাঁঝ বলে

” আমাকে কেমন লাগছে?

উজান চেয়ে আছে সাঁঝের ঠোঁটের দিকে। কোনরকমে বললো

” সুন্দর লাগছে। লিপস্টিকের শেডটা ভালো আছে “।

সাঁঝ বললো

” যে পেইজ থেকে নিয়েছি তারা বলেছে এইটা ওয়াটার প্রুফ”। তুমি দেখতো ওরা সত্যি বলেছে কিনা”?

উজান কি বলবে আর কি বলা উচিত ভেবে পেলো না। তার আর তখন ফ্রেশ হওয়া হলোনা। পিপাসা পেয়েছিলো পানি খাওয়া হলো না। সে ব্যস্ত এখন মহাব্যস্ত।

চলবে……….

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ১৮
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

“কাঁদছো কেন সাঁঝ? হাতে কি আবার ব্যাথা করতেছে? শরীর খারাপ লাগতেছে? অস্বস্তি হচ্ছে কোথাও? আমি তোমাকে বলেছিলাম পাগলামি করোনা। তুমিতো কথাই শুনতে চাও না। ছোট বাচ্চার মতো জিদ করলে। তুমি যে অসুস্থ মাত্র সেরে উঠতেছো এইটা কেন ভুলে যাও? আমিতো তোমাকে বলেছিলাম আমি তোমার শুধুই তোমার। আচ্ছা একটা কথা বলোতো তুমি কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তায় আছো? কোন দুশ্চিন্তা তোমাকে শান্তি দিচ্ছে না। অস্থির হয়ে আছো মনে হচ্ছে”।

সাঁঝ আরও জোরে কেঁদে উঠে। অনেকক্ষন ধরেই কাঁদছে। কিন্তু কেন সেটা এখনো ঠাওর করতে পারছে না উজান। তার জানা মতে সে এমন কিছু এখন অবধি তার বউকে বলেনি বা আচরণ দ্বারা প্রকাশ করেনি যে বউ এর কষ্ট হবে। উজান সাঁঝের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এতেই যেন তার বউ আরও গলে গেলো। স্বামীকে আরও বেশি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে মনে হচ্ছে বুকের মধ্য ঢুকে যাবে। উজান এতোটুকু বুঝে বউ এর মন মেজাজ অস্থিতিশীল হয়ে আছে। মুড সুইং হচ্ছে। উজান এর কি করা উচিত বুঝতে পারছে না। তবুও শেষ চেষ্টা হিসেবে দুষ্টুমি করে বললো

” তুমি যদি এমন করে কেদেঁই যাও তাহলে আমি কি করে বুঝবো তোমার কি হয়েছে। আমাকে বলতে হবেতো। এখন যদি কান্না না থামিয়ে আমাকে না বলো কি সমস্যা হচ্ছে তোমার তাহলে কিন্তু আমি তোমার বুদ্ধি প্রয়োগ করা শুরু করবো”।

সাঁঝ উজানের বুকের উপর থেকে মাথা তুলে তাকায়। চোখ পানিতে ভরে আছে ঠিক যেন লেবুর রসের মতো। টুপ করে গড়িয়ে পরবে। উজানের ভীষণ মায়া হয় এই চেহারা দেখে। কি অদ্ভুত রকমের আকৃষ্ট করার ক্ষমতা আছে এই মেয়েটার। কত সহজে তাকে আপন করে নিয়েছে। কঠিন সত্য ছাড় দিয়ে জীবনের একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়ে তার সাথে সংসার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে তার আদরের বিপরীতে সাঁঝ নিজেও তাকে কত আদর করলো। প্রতিটা মুহুর্তে উজানের মনে হয়েছে সে স্বপ্ন দেখছে নয়তো এতো ভালো মুহুর্ত তার জীবনে আসার কথা না। অন্তরঙ্গতার পুরোটা সময় সাঁঝ তাকে ক্ষনে ক্ষনে বুঝিয়েছে জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। সময় শুন্যস্থান পূরণ করে দেয়। সাঁঝ উজানের গাল আলতো করে ধরে বলে

” কি বুদ্ধি প্রয়োগ করবে”?

উজান বললো

” আমার আদর করে এখনো মন ভরেনি। তুমি একটা রহস্যময় সিন্ধু। যার অতলে অনেক কিছু আবিষ্কার করা এখনো বাকি। তোমার গভীরে যাওয়া এখনো অনেকটা বাকি। যে চোখে মুখে এতো মায়া সেখানে আমি পুরোটা তোমাকে অনুসন্ধান করার কমতি রেখেছি। আমাকে আরেকটু ভালোবাসবে সাঁঝ? আরেকবার নিজের গভীরে কাছে টেনে নিবে? আরেকটু বেশি আদর করবে? বহু বছর পর আবার জীবনে ভালো মুহুর্ত পেয়েছি আমি। যদি পার‍তাম সময়টাকে এইভাবেই থেমে রাখতাম আমি”।

সাঁঝ মনে হয় লাই পেয়ে গেলো আরও। সেতো চায়ই স্বামীর সাথে লেপ্টে থাকতে কিন্তু কেউ যদি তাকে অতিরিক্ত স্বামী পাগল ভেবে তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে এজন্য সে নিজেকে খুব সহজে কারো কাছে প্রকাশ করেনা। কিন্তু মনে মনে ঠিকই চায় স্বামীর সানিধ্য। লোকটা তার কাছে অনুমতি চাইছে কেন? স্বামী হয় সে। বউকে আদর আহ্লাদ কপ্রবে এতে আবার বলার কি আছে। বউ হয়ে কি সে সব কথা এভাবে খোলাখুলি বলতে পারে। তারতো লজ্জা করে। সাঁঝ কোন কথা বললো না। শুধু উজানের গলায় একটা ভেজা স্পর্শ দিলো। উজান কিছুটা চমকে উঠে। এই মেয়ের ভালোবাসা আর আদর প্রকাশ করার বুদ্ধি, পথ বা কৌশল যেটাই বলা যাক না কেন দারুণ। মেয়েটাকে যত বুঝার চেষ্টা করছে ক্ষনে ক্ষনে অবাক হয়ে যাচ্ছে উজান। এসব ভাবতে ভাবতে সাঁঝ তার মিশনে নেমে পড়েছে ইতিমধ্যে। সাঁঝ উজানকে এতো গভীরভাবে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে যে উজান এর আর কোন কিছু ভাবতে মন চাইলো না। সে শুধু সাঁঝকে চায় এখন। প্রতিটা স্পর্শ উজানকে বাধ্য করছে নিজের বউকে নিয়ে ভাবতে। কি জাদু করলো এই মেয়ে? উজান বেসামাল হলো নিয়ন্ত্রণ হারালো। এই অনিয়ন্ত্রিত মুহুর্ত চললো বেশি কিছুক্ষণ। দুজনেই চুপচাপ শান্ত স্থির হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। উজান ফের প্রশ্ন করে

” কাঁদছিলে কেন তখন”?

সাঁঝ বলে

” ভয় পেয়ে”।

উজান এর চোখে মুখে আশংকার ছাপ

” কিসের ভয় পাচ্ছো তুমি? কেউ কিছু তোমাকে বলেছে? আমাকে নিয়ে কেউ তোমাকে লথা শুনিয়েছে সাঁঝ”?

সাঁঝ দু দিকে মাথা নাড়ায় যার অর্থ না। সাঁঝ বলে

” আজকে আমার ভার্সিটি জীবনের সবচেয়ে কাছের বান্ধবী এসেছিলো। পুরো ব্যাচে সবার আগে তার বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু সে আজকে এসে তার সংসার ভাঙার কাহিনী বলে গেলো। মানুষ চিনতে পারেনি। ঠকে গেছে সে আর সেটা ভীষণ বাজে ভাবে “।

সাঁঝ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে সব কিছু বিস্তারিত বললো উজানকে। মিলির সাথে ঘটে যাওয়া সেই নিন্দনীয় ঘটনা। উজান এতোক্ষনে বুঝতে পারলো বউ এর চিন্তার কারণ। তার বউ এজন্য ভয় পেয়েছে যদি মিলির মতো তারও সংসার নষ্ট হয়ে যায়। উজান বললো

” মানুষের মন সবচেয়ে দ্রুত পরিবর্তনশীল। এখন সময়টা এতো বেশি অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে গিয়ে ঠেকেছে যে কাউকে বিশ্বাস করা, তাকে ভালোবেসে বুঝতে পারা, তাকে ধরে রাখা এগুলো খুব কঠিন হয়ে গেছে। মানুষ ভুলগুলোকে কিছুতেই ভুল বলে মানতে চায়না যতক্ষণ না অবধি সেটা তার গলার কাছে কাঁটার মতো বিধঁতে শুরু করে। নিজের জীবনের সুখ শান্তি মানুষ নিজের হাতেই নষ্ট করে। যে মানুষগুলো ভুক্তভোগী হয় সারাজীবন তাদের মনে মস্তিষ্কে এগুলো ট্রমা হয়ে রয়ে যায়। এগুলো থেকে বের হওয়া কতটা কঠিন সেটা যদি কাউকে কষ্ট দেওয়ার আগে বিবেক বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করতো তাহলে হয়তো এতো কুৎসিত খেলায় মত্ত হতো না। আমি নিজেও এই ছলনার ভুক্তভোগী। তবে দিনশেষে আমি উপরওয়ালার কাছে এতো কৃতজ্ঞ যে তোমাকে আমার জীবনে পাঠিয়েছে। আমি যখন তোমাকে ফিরিয়ে দেই তখন ভেবেছিলাম বাচ্চা মেয়ে আবেগের বসে ভুল অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছে। যদি আমিও সেটার আরও সুযোগ নেই তাহলে আমার আর ওইসব বিবেকহীন লোকের মধ্য তফাত থাকবে না। তার মধ্য জীবনের একটা নষ্ট উপাখ্যান আছেইতো আমার। মোট মিলিয়ে আমি ছয়টা বছর কোনভাবেই সাহস করে উঠতে পারিনি নতুন করে এসব নিয়ে ভাবার। হঠাৎ করে তুমি এলে। জীবনে জড়িয়ে গেলে মনে হচ্ছে যদি আরও কিছু সময় আগে আসতে হয়তো আরও বেশি ভালো হতো। সাঁঝ আমাকে৷ কখনো ছেড়ে যাবেনাতো”?

সাঁঝ অকপটে বলে

” যাবো একদিন “।

উজান কেপেঁ উঠে স্ত্রীর কথায়। কাপুঁনিটা এমন ছিলো যে সেটা সাঁঝকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। নিজের স্বামীর এই অস্থিরতা দেখে বললো

” আমাকে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে তুমিইতো মাটির ঘরে রেখে আসবে। তখনতো যেতেই হবে তাইনা?

উজান এর ভীষণ রাগ হচ্ছে এখন। এই মেয়ে তার ব্লাড প্রেসার বাড়িয়ে দেয় মাঝে মাঝে। কি সব কথা বলে। সেদিন হসপিটালে সেই সময়ের পর থেকে আসলেই সে ভীষণ ভয়ে থাকে। উজান রাগ করে সাঁঝ এর ঘাড়ে একটা আচঁড় কাটলো। সাঁঝ কোন টু শব্দ করলো না। সাঁঝের এরকম নিরুত্তাপ ভাব দেখে আরেকটা চিমটি দেয় হাতের বাহুতে। এবারও সে তেমন ভাব ধরেই থাকলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উজানের দিকে। উজান বললো

” আর একবার এমন কিছু বললে এই কালো জর্জেট শাড়ি পড়িয়েই তোমাকে পার্সেল করে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিবো”।

সাঁঝ হেসে উঠে। বলতে গেলে হেসেই যাচ্ছে। এরই মধ্য উজানের পেটের মধ্য শব্দ করে উঠে। তাদের মাথায় খাবার খাওয়ার চিন্তা ছিলো না এতোক্ষণ অথচ উজান দুপুরের খাবারের পর আর কিছুই খাওয়া হয়নি। বাড়ি ফেরার সময় খিদেও পেয়েছিলো অনেক কিন্তু বউকে দেখে পেটের খুধা গলার পিপাসা সব কবেই উড়ে গেছে। উজানের এখন মনে হচ্ছে তার ক্ষুধা লাগছে। সেটা একটু না বেশ ভালোই লাগছে। সাঁঝ খুবই লজ্জিত হয় নিজের এই কাজে। সারাদিন অফিসে কাজ করে এসে সে স্বামীকে অভুক্ত রেখে দিয়েছে। তাছাড়া তার নিজেরও ক্ষুধা লেগেছে বলতে গেলে। সাঁঝ ইতস্তত করে বলে

” চলেন ফ্রেশ হয়ে নেওয়া উচিত এখন। অনেকক্ষন অফিস থেকে আসছেন। খাওয়া দাওয়া আজকে সব চুলোয় গেছে”।

উজান কি বুঝলো কে জানে নিজেও উঠলো সাথে বউকেও তুলে নিয়ে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। তারপর আবার খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে বেশ অনেকটা রাত হলো। দুজনে গল্প করছে এদিক ওদিক কত কথা। এরই মধ্য ইন্টারকমে কল আসলো। উজান কল রিসিভ করতেই বেশ জোরে একটা কি বলে চিৎকার দিলো। আশেপাশে থেকেও তারা অনেক শোরগোল শুনতে পাচ্ছে। সাঁঝ উজানকে বললো

” কি হয়েছে চিৎকার করলে কেনো”?

উজান বলে

“চারতালার আদিল সাহেবের স্ত্রী দিপা ভাবী নাকি সুই*সাই*ড করেছে। ভাই বাসায় ছিলোনা এতোক্ষণ। ভাই কিছুক্ষণ আগে এসে ভাবীকে বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থায় পান। অনেক ডেকেও সাড়া পাচ্ছিলেন না। পরে হাতের মুঠোয় ঘুমের ওষুধের শিশি পান। পুলিশকে জানানো হয়েছে আসছে”।

চলবে……….