#নুন_ঝালের_সংসার
(২য় পর্ব)
তাপসীর ইদানীং খুব মন খারাপ হয়। জীবনটা কেমন যেন পানসে হয়ে যাচ্ছে। না, ওদের লাভ ম্যারেজ না। পারিবারিকভাবেই বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পরে সুমন ওকে ভীষণ ভালোবাসতো। এমনকি হাতে করে মুখে ভাত তুলে দিতো। এরপর ওদের প্রথম সন্তান শাফিন হলো। প্রথম সন্তান হলে মেয়েদের যা হয় আর কি! ঠিকমতো কোলেই নিতে পারে না এমন।
তাপসীর মা কয়েকদিন ছিলো। কিন্তু ওর বাবা বাড়িতে একা থাকায় খাওয়া দাওয়ার খুব সমস্যা হচ্ছিলো। ভাই আর ভায়ের বউ আলাদা, বেশ দূরেই থাকে। শাশুড়ি বেশ পারতেন কাছে এসে থাকতে। কিন্তু তার নাকি গ্রাম ছেড়ে কোথাও গেলে দমবন্ধ লাগে, দুই দিনের বেশি কিছুতেই থাকতে চান না। আবার জ্বালাও আছে। ফ্রিজ খুলে দেখেন কি আছে, রান্নাঘর, ঘরের সব জায়গায় কেন জানি আঁতিপাঁতি করে দেখেন। কোনটা তাপসীর অগোচরে নষ্ট হলে সেই হৈ চৈ – “এখনকার মেয়েদের সংসারে মন নেই। কষ্ট করে তো আর আনতে হয় না, নষ্ট হলেও বা কী!” এমন সাত রকম কথা শুনাতে ছাড়েন না। তাপসী অবশ্য কোন উত্তর দেয় না। এসব কথার কি যে উত্তর হয়, সেটাই বোঝে না!
শাফিন হওয়ার সেলাই না শুকাতেই রাইছা পেটে আসলো। প্রথমে ভেবেছিলো বাচ্চাটা রাখবে না। কিন্তু সেটা সাময়িক ভাবনা। একজন মা কি আর সন্তান নষ্ট করতে পারে? হ্যাঁ হয়তো অনেকেই করে কিন্তু তাপসীর বিশ্বাস তারা বিপদে পড়েই এই কাজ করে। রাইছা হলে, দুই বাচ্চা আর সংসার নিয়ে তাপসী দুই চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো। নিজের যে কিছু ডিগ্রী ছিলো, রেজাল্টও অনেক ভালো সেটা যেন ভুলেও গেলো। দুধ ডায়াপার বন্দী জীবন যেন! ওর সার্কেলের মেয়েরা কেউই বসে নেই। সবাই যা হোক কিছু না কিছু করছেই৷ সেখানে তাপসী শুধুই গৃহিণী। এগুলো মনে হলে ডিপ্রেশন লাগে। কিন্তু কিছুই করার নেই। একটা ছুটা বুয়া এসে যা হোক কিছুটা হেল্প করে, বাকি সবটা তাপসীকেই করতে হয়। ছুটা বুয়াদের নিয়ে আরেকটা জ্বালা হলো হুটহাট কামাই দেয়। বলা নেই কওয়া নেই, আসে না। পরেরদিন এসে এমন করে বিপদের বর্ণনা দেয় যে মনে হয়, বুয়ার বাসার কাজও নিজে গিয়ে করে আসলে ভালো হতো!
বাচ্চা আর সংসার নিয়ে থাকতে থাকতে তাপসী যেন নিজেকে ভুলেই গিয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ আয়নার সামনে গেলে চমকে উঠে। তাপসী ছিপছিপে লম্বা ফর্সা বেশ সুন্দর একটা মেয়ে ছিলো। আরো ছিলো এক মাথা লম্বা চুল। সুমনের সাথেই ওর প্রথম বিয়ের কথা হয় আর একবারেই বিয়ে। সুমন অনেকবার বলেছে ওর চুল দেখেই নাকি সুমন মুগ্ধ হয়েছিলো। কিন্তু সেই চুল সব পড়ে শেষ। দুইটা বাচ্চা হওয়ার পরে বাকিটা বাচ্চাদের চুল ধরে টানাটানি আর অযত্ন, অবহেলায়। চোখের নিচে স্থায়ী কালি পড়েছে যেন। কপালে বলিরেখা, সিঁথির জায়গা ফাঁকা হয়ে কপাল বড় হয়ে গিয়েছে। অনেকটাই মুটিয়ে গিয়েছে। নিজেকে আসল বয়সের চেয়ে দশ বছরের বেশি বয়সী মনে হয়৷
সুমনের অফিসে প্রমোশন হয়েছে, বেড়েছে কাজের চাপ। এটা তাপসী বুঝতে পারে। কিন্তু তাপসীর কষ্টটা সুমন বোঝে কিনা, এইটা তাপসী অনেক সময় বুঝতেই পারে না। এই যেমন আজকের ঘটনা। বিবাহ বার্ষিকীর কথা সুমনের মনে নেই – এটা নিয়ে তাপসীর ক্ষোভ নেই। ক্ষোভ হলো তাপসীর ম্যাসেজগুলো তো অন্ততঃ চেক করবে! তাপসী প্রথমতঃ বিবাহ বার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়েছে। এরপর উত্তর না দিলেও তাপসী দুপুরের পরে ঠিকই জানিয়েছে আজ বুয়া আসে নাই আর বিবাহ বার্ষিকীতে ওরা প্রতি বছর বাইরে ঘুরতেই যায়, রেডি হবে কিনা?
কিন্তু সুমন উত্তর দেয়া তো দূরের কথা ম্যাসেজ সিনই করে নি! এখানেই তাপসীর খুব কষ্ট লেগেছে। তাপসী এবং বাচ্চারা তো সুমনের ফাস্ট প্রায়োরিটি হওয়া উচিৎ তাই না? বুঝলো যে সুমন অনেক ব্যস্ত, অফিসে অনেক ঝামেলায় থাকে। কিন্তু সেটা কিসের জন্য? কাদের জন্য? নিশ্চয় পরিবারের জন্য। সেই পরিবারই যদি প্রায়োরিটি লিস্টের নিচের দিকে চলে যায়, তাহলে তাপসীর এতো কষ্ট কার জন্য? আর সুমনই বা কার বা কাদের জন্য এভাবে ছুটছে? শুধুই নিজের উন্নতি?
ছেলেরা কেন বোঝে না, একটা মেয়ের বয়স যতই বাড়ুক না কেন ভালোবাসার মানুষের জন্য মনের মধ্যে তার আদর, তার মনোযোগ এবং যত্ন পাওয়ার যে আকাঙ্খা থাকে, সেটা কখনোই কমে না! হয়তো না পেতে পেতে এক সময় বাচ্চাদের প্রয়োজনে, সমাজের প্রয়োজনে, টিকে থাকার প্রয়োজনে মেনে নেয় কিন্তু এই ভালোবাসার অভাববোধ কখনোই যায় না!
সুমন তবুও রুটি কলা খেয়ে ঘুমাতে গেছে। তাপসী কিছুই খায় না। দুপুরেও খায় নি, সময়ই পায় নি। বাচ্চাদের নিয়ে পাশের রুমে ঘুমাতে যায়। না, রাগ করে আলাদা ঘুমায় না। এটা সুমনের ইচ্ছাতেই হয়েছে। রাইছা হওয়ার পরে দুই বাচ্চাই রাতে উঠে চিৎকার করে কাঁদতো। সুমন ঘুমাতে পারতো না। সকালে অফিস থাকায় নিজেই একদিন কাঁথা বালিশ নিয়ে পাশের রুমে চলে গেছে। সেখান থেকে আর এই বেড রুমে ফেরা হয় নি। তাপসীর কেমন যেন পরাজিত লাগে। জীবন যুদ্ধে পরাজিত। বেশ গুমোট গরম। এসি চললেও জানালা খুলে দেয়। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। চাঁদ তো নেই, একটা তারাও নেই। মেঘে আকাশকে আরো অন্ধকার করে রেখেছে। সেদিকে তাকিয়ে তাপসীর চোখ ফেটে পানি বের হয়। আজ বহুদিন বহুকাল পরে তাপসী কাঁদছে। তাপসী হাসি কান্না দুটোই যেন বহু আগেই ভুলে গিয়েছে!
(চলবে)