#নুন_ঝালের_সংসার
(৬ষ্ঠ পর্ব)
ছবিগুলো পাওয়ার পরে তাপসীর কিছুক্ষণ মাথায় কাজ করছিলো না। ওর মনে হলো, আর এই বাসায় থাকবেই না। বাচ্চাদের নিয়ে এখুনি এই মুহূর্তেই বের হয়ে যাবে। কিন্তু একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে৷ এখন বের হয়ে কোথাও যাওয়াও তো কঠিন। এদিকে বাইরে যাওয়ার জন্য মেয়েটা আঁচল ধরে কান্নাকাটি করছে। ছেলেটা ফ্লোরে গড়াগড়ি দিচ্ছে।
তাপসী এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো। নাহ, আগে বাচ্চাদের সামলাতে হবে। হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।
পার্কে বাচ্চাদের ছেড়ে দিলো, ওরা খেলতে শুরু করলে পাশেই একটা বেঞ্চে বসে তাপসী ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলো। এই ছবির মহিলা যদি শীলা ম্যাডামই হয় তাহলে তো সুমন ওকে তেমন পছন্দই করে না। সুমন এমনিতেই অফিসের কথা বাসায় আনে না তবুও মাঝেমধ্যে যাদের ব্যাপারে টুকটাক বলে তাদের মধ্যে রাজন আর শীলা – এই নাম দুইটা শোনা যায়। শীলা ম্যাডামের গায়ে পড়া স্বভাব নিয়ে সুমন বেশ বিরক্ত ছিলো। পছন্দের কেউ হলে তো মুখ ফুটে দুই একবার প্রশংসা করতো। সুমনের নানান রকম দোষ ত্রুটি থাকলেও ওর মধ্যে নারীদের প্রতি তাকানো বা এই বিষয়ে কখনো কোনো দূর্বলতা দেখে নি। কাজ ছাড়া এই লোকের মাথায় আর কিছু নেই!
নাহ, তাপসী আবার ছবিগুলো বের করে। বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। বেশ কায়দা করে অ্যাঙ্গেল করে তোলা। সরাসরি তুললে বেশ স্বাভাবিক ছবিই বিশেষ করে খাওয়ার টেবিলের ছবি তো অনেক লোকের মাঝে স্বাভাবিক বসে খাচ্ছে। তাপসী জুম করে। সুমনকে যতোটুকু দেখা যায় তাতে ওর মুখ গম্ভীর আর সেখানে কিছুটা বিরক্তির ছাপ। তাপসী স্ত্রী হিসেবে স্বামীকে যতটুকু চেনে তাতে সুমন রাগ হলে এমন গম্ভীর হয়ে থাকে। সুমন চিৎকার চেঁচামেচি পছন্দ করে না। মেজাজ খারাপ হলে জাস্ট মুড অফ করে থাকে৷
তাপসী সুমনের কাছ থেকে এই বিষয়ে কোন কিছু না শুনে অচেনা নাম্বারের ছবি দেখে কোন সিদ্ধান্ত নেবে না। ঐ নাম্বারে কল দিয়ে দেখেছে, বন্ধ। তার মানে ওর সংসারে আগুন লাগানোই উদ্দেশ্য। তাপসী কিছুটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে। চোখে যা দেখা যায়, তা সব সময় সত্য হয় না।
সুমন আজ অত্যন্ত ত্যাক্ত বিরক্ত। শীলার বকবকানিতে ওর কান পঁচে গেছে। দামী রেস্তোরাঁয় খাবার অর্ডার দিয়ে টেবিলে আসতে সময় লেগে গেলো, মানুষের ভীড়ও ছিলো ভালোই। এরপর বের হতেই এমন জ্যাম লাগলো যে নয়টার আগে বাসায় পৌঁছানোই কঠিন হয়ে যাবে। সবাইকে নিয়ে বের হওয়া তো দূরের কথা। তাপসীকে ম্যাসেজ পাঠালো রাতে রান্নার দরকার নেই, খাবার আনবে।
একদম ঘেমে টেমে একাকার হয়ে বাসায় পৌঁছালো। আগে গোসল করে নিলো। ততক্ষণে বাচ্চারা শোরগোল শুরু করেছে। তাপসী খাবার গরম করে প্লেটে বেড়ে দিচ্ছে।
– আজ দেরি হলো যে। অন্যদিন তো দেরি হলে জানাও।
কিছুটা চিন্তিত মুখে জিজ্ঞাসা করলো তাপসী৷ ওর বুকের মধ্যে ধুকপুক ধুকপুক করছে। সুমন যদি মিথ্যা বলে!
– আর বইলো না। শীলা ম্যাডামের যন্ত্রণায় আজ আমার দিন শেষ। সে তো কাজ করিয়ে নেয়ার জন্যই আমার পেছনে আজ লেগেছে। বললাম ম্যাডাম করে দিচ্ছি। কিন্তু না, তার সাথে আবার খাবার খেতে হবে। না করলে তার আবার ভীষণ ইগোতে লাগে। উনি ভাবে তার মতো সুন্দরী মহিলাকে এভাবে না বলবে কোন সাহসে! এই মহিলার আবার নানান জায়গায় যোগাযোগ আছে, বেশি কিছু বলাও যায় না। আজ আগে আসতে চাইলাম আর পড়লাম দুনিয়ার প্যাঁচে৷
ভীষণ বিরক্তি আর রাগ নিয়ে সুমন বলতে থাকে। তাপসীর মনের মেঘ কেটে যায়। যেন এতোক্ষণে ভালো করে শ্বাস নিতে পারলো। প্লেট নিয়ে তাপসীও বসে পড়ে।
খাওয়া শেষে বাচ্চাদের নিয়ে তাপসী শুয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবে – থাক সুমন অ্যানিভার্সারি, জন্মদিন সব কিছু ভুলে যাক তবুও ওদের সংসার ভালো থাকুক। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে ওদের ঘুমন্ত শরীরে হাত বুলিয়ে দেয়।
সুমন দরজার সামনে এসে তাপসীকে মৃদু স্বরে ডাকে। তাপসী উঠে যায়। ভাবে সুমন হয়তো নিজের প্রয়োজনেই ডাকছে। কিন্তু সুমন ওর ঘরে না যেয়ে তাপসীর হাত ধরে ড্রইংরুমে সোফায় নিয়ে বসে।
সুমন আসলে এতোটা ভালো আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। আবেগের জায়গায় খুব দূর্বল। ঠিক কি বলবে বুঝতে পারে না।
– আ আ আমার গতকালকের দিনের কথা মনে ছিলো কিন্তু অফিসে প্রেজেন্টেশন ভালো না হওয়ায় বস খুব বকা দিলো। আমি সব ভুলে গেলাম। এই দেখো এই আংটির রিসিট, আগের দিনেই কেনা।
তাপসী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সুমন ওর জন্য ডায়মন্ডের রিং কিনেছে! ও আঙুলে পরিয়ে দেখে একদম ঠিকঠাক। ডায়মন্ডটা কেমন ঝকমক করছে কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ঝকমক করছে তাপসীর মুখ। অনেক অনেক দিন পরে অভিমানের মেঘ ভেঙে সুমনের সামনে তাপসী কাঁদে। সুমন কিচ্ছু বলে না। আলতো করে জড়িয়ে ধরে। কান্নার দমকে তপসীর শরীর ফুলে ফুলে উঠছে। সুমন তাপসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মেয়েটার উপরে বেশ ধকল যায়, সুমন নিজেও এখন সাহায্য করতে পারে না।
খুব সুন্দর একটা রাত পার করে সকালে উঠেই তাপসীর মন তেতো হয়ে যায়। শাশুড়ি এসেছেন, ডাক্তার দেখাবেন। এবার বেশ কয়েকটা দিন থাকবেন!
(চলবে)