#নুন_ঝালের_সংসার
(৯ম পর্ব)
তাপসী খুব দ্বিধা নিয়ে এক সন্ধ্যায় সুমনকে ল্যাপটপের কথা বললো।
– আমি কয়েকটা অনলাইনে কোর্স করেছি। এখন আমার একটা ল্যাপটপ খুবই প্রয়োজন।
সুমন তাপসীর এই কথায় কোন উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। চুপচাপ চা খেতে লাগলো।
– আমি তোমাকে কিছু বলছি।
– হুম শুনলাম তো।
– কিছু বলবে না?
– কি বলবো? আমি তো টাকার মেশিন না। মা এখান থেকে যাওয়ার পর থেকে টাকার জন্য মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলো। টাকা দিয়ে নাতিনের জন্য সোনার চেইন কিনবে। সেই টাকা পাঠানোই লাগলো। এদিকে তোমার আংটি তো কিনলাম এই বছরেই। এক হাতে সংসার খরচ আবার এতো টাকা, আমি কোথা থেকে দেবো? দুইটা বাচ্চার খরচও কি কম মনে হয়? আসলে কি জানো তাপসী, টাকা আয় করলে বোঝা যায় খরচের জ্বালা!
তাপসী মাথা নিচু করে শুনলো। শেষের কথায় ওর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। এই কথাটা না বললেও পারতো। তাপসী যে কতোটা কষ্ট পেয়েছে তা ঠিক বোঝাতে পারবে না। কিন্তু বুঝতে দিলো না। চোখের জল গোপন করলো। চুপচাপ ঐ জায়গা থেকে সরে আসলো।
পরেরদিন সকালে তাপসী ফোন করলো ওর ভাইকে। তাপসীর ভাই আরিফ হাসান সরকারী কলেজের টিচার। ভাবীও তাই। পারিবারিক কোন অনুষ্ঠান ছাড়া তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয় না। তাপসী নিজের বাচ্চা সংসার নিয়ে এতোই ব্যস্ত থাকে যে, অন্য কোথাও ফোন দেয়া, কথা বলার এনার্জি বা সুযোগ কোনটাই পায় না। আরিফ ছোট
বোনের ফোন পেয়ে অবাকই হলো। প্রথমে ভাবলো কোনো বিপদ হলো কিনা!
– তাপসী কিছু হয়েছে? তোরা সবাই ভালো আছিস?
– ভালো আছি ভাইয়া। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। সামনাসামনি বলতে চাই কিন্তু তোমার বাসায় যাবো না। বাইরে কোথাও দেখা করতে পারবে?
আরিফ বুঝলো বেশ গুরুতর কিছু। কথা না বাড়িয়ে একটা ঠিকানা দিয়ে পরেরদিন বিকেলে দেখা করতে বললো। তাপসী পাশের ফ্লাটের ভাবীর কাছে বাচ্চা দুটোকে রেখে দেখা করতে গেলো।
এটা মূলতঃ একটা কফিশপ। আরিফ এসে বসলে তাপসী কোনো ভূমিকা না করে ওর অবস্থার কথা বললো। ও যে বাসায় বসেই কিছু করতে চায়, কিছু কোর্স করেছে এবং ল্যাপটপ কেনা প্রয়োজন সব খুলে বললো।
তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে আস্তে খুব নরম স্বরে বললো
– ভাইয়া, আমাকে ল্যাপটপ কেনার টাকা ধার হিসেবে দিতে পারবে? আমি সত্যি শোধ করে দেবো। একবারে হয়তো পারবো না কিন্তু আস্তে আস্তে সব শোধ করে দেবো। প্রথমেই কাজ তেমন পাবো না জানি। কিন্তু ধীরে ধীরে পারবো না ভাইয়া? আর না হয় আমার কিছু গহনা রাখো। বাইরে কোথাও রাখার চেয়ে তোমার কাছেই না হয় থাকলো !
আরিফের খুব কষ্ট লাগলো। ঠিক এই মুহূর্তে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে স্বার্থপরও মনে হচ্ছে। ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। খোঁজ নেয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু নিজেদের জীবন নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত যে খোঁজ নিতেই ভুলে গেছে। তাপসী যখন গহনা রেখে দেয়ার কথা বললো, আরিফের বুক কেঁপে উঠলো। বোনের দুই হাত চেপে ধরলো।
– আমি জানি ভাই হিসেবে আমি ভালো না, স্বার্থপর। কিন্তু জীবনে এই প্রথম কোনো কিছুর কথা বললি তাপসী। চল তোকে সাথে করেই একদিন ল্যাপটপ কিনে দেবো। আর এটা তোর ভায়ের উপহার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সামান্য সহায়তা৷
তারপর একদিন তাপসী ওর ভাই আর বান্ধবী তামান্নার সাথে ভালো ব্রান্ডের একটা ল্যাপটপ কিনে আনলো। খুশি মনে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে ড্রইং রুমে বসে বসে কাজ শুরু করলো। কিন্তু তাপসী এই জগতে নতুন, কেউ ওকে চেনে না। কাজ পেতে লিংক লাগে। তেমন কাজ পায় না তাপসী। তবুও নিজে নিজে কিছু স্যাম্পল কাজ করে। বন্ধু বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। ওদের মাধ্যমে যারা এই কাজ করে তাদের সাথে যোগাযোগ করে। তাপসী ভেঙে পড়তে চায় না। লেগে থাকলে একদিন অবশ্যই কিছু হবে।
আসলে সবকিছুতেই ভাগ্য লাগে। তাপসীর ভাগ্য ফিরলো ঠিক আট মাসের মাথায় যখন ওদের এক বন্ধু সার্কেল ওদের একটা অনলাইন প্লাটফর্মে তাপসীকে যুক্ত করলো।
এটা মূলত একটা অনলাইন আইটি ফার্ম। প্রায় সবাই নতুন। দুই জন পুরাতন যারা বেশ দীর্ঘ সময় ধরে এই অনলাইন কাজের সাথে যুক্ত। তারা আরও কিছু নতুন মুখকে সাথে নিয়ে নতুন একটা আইটি ফার্ম দিয়েছে যার নাম দিয়েছে – Hermit.
এই নামকরণ হয়েছে ওদের ছয়জনের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে। এর মধ্যে তাপসীও আছে। তাপসী মনে মনে ভীষণ উত্তেজিত। নতুন কিছু করার, নতুন কিছু করতে পারার সুযোগ পাওয়ায় আবেগে উদ্বলিত।
এই আট মাস আর এর সাথে বিভিন্ন কোর্স করার চার মাস যোগ করলে এক বছরে তাপসীর সবচেয়ে বড় অর্জন হলো নিজেকে গুছিয়ে নেয়া। বাচ্চা কিভাবে সামলে সময় বের করবে সেটা যেমন শিখে ফেলেছে ঠিক তেমনি শিখে ফেলেছে সংসারের সব কাজ করেও কিভাবে নিজেকে সময় দেয়া যায়। এখন তো ঘুমানোর আগে দুই এক পাতা বইও পড়ে। নিজেকে সমৃদ্ধ করতে না পারলে বেশি দূর এগোতে পারবে না।
তাপসীকে প্রথমদিকে ফার্ম থেকে ছোট ছোট কিছু কাজ দিতো। তাপসীর সবচেয়ে বড় দিক হলো ওর আগ্রহ আর আন্তরিকতা। কাজ না বুঝলে বার বার জিজ্ঞাসা করে বুঝে নেয় কিন্তু যেটুকু কাজ করে তা একদম পারফেক্ট। একদিনে কিছুই হয় না, তাপসীরও হয় নি। কিন্তু তাপসী লেগে থাকে। শিখতে থাকে এসব কাজের খুঁটিনাটি।
সুমন নিজের অফিস আর কাজ নিয়ে এতোই ব্যস্ত যে তাপসী কি করে এসব দিকে নজর দেয়ার সময় নেই। সংসার ঠিকমতো চলছে, বাচ্চারা ঠিক আছে। আবার তাপসী বাইরেও কোথাও যায় না, সুতরাং আর কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করে না। কিন্তু একদিন এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়লো যে তাপসীকে একদম অন্যভাবে আবিস্কার করলো।
(চলবে)