#নুন_ঝালের_সংসার
(শেষ পর্ব)
সুমনের কাজের প্রেসার বাড়ার আরেকটা কারণ হলো প্রমোশন হয়েছে। প্রমোশন হলে সম্মান বাড়ে, উপার্জন বাড়ে কিন্তু সেই সাথে বাড়ে দায়িত্ব। আগে তবুও শুক্র শনিবার স্ত্রী সন্তানদের সাথে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতো। একটু রেস্টুরেন্টে বসা, কখনো ফুসকা চটপটি খেয়ে বাসায় ফিরতো। বাচ্চারা এসবে ভীষণ খুশি হয়। কিন্তু সুমনের এখন সময় নেই। ছুটির দিনেও মিটিং, ওয়ার্কশপ, ট্যুর – কিছু না কিছু লেগেই থাকে। এদিকে অফিসের ব্যস্ততার সাথে নানান জনের দ্বন্দ্ব, অফিস গসিপ আর বাজে রাজনীতিও জড়িয়ে আছে। ফলাফল সুমন এখন বাজারটাও নিজে করতে পারে না। মাসের প্রথমে বাজার খরচের টাকা তাপসীর হাতে গুঁজে দিয়ে দায়িত্ব সারে।
তাপসীর এসব আর গায়ে লাগে না। নিজেই বাচ্চাদের নিয়ে বের হয়। শিশুদের খেলার ইনডোর পার্ক আছে, সেখানে যায়। বাচ্চারা মিলে আইসক্রিম খায়। বাচ্চাদের সাথে শপিং করে, গল্প করে – সময় কেটে যায়।
সময় কি আর কারো জন্য অপেক্ষা করে? অপেক্ষা করলে সুমন দেখতে পারতো তাপসীও বদলে যাচ্ছে। এখন আর সুমনের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে না। দু:খ, অভিমানে মন খারাপ করে থাকে না। হয়তো সেই মনটাই মরে গেছে।
সুমনের অফিসের বস বদলেছে। ওদের অফিসের সিলভার জুবিলী উপলক্ষে লোগো চেঞ্জ করবে, ওয়েব সাইট নতুন করে সাজাতে হবে। এই কাজগুলো দেখভাল করছে সুমনের এক জুনিয়র। সুমন আবার এসব প্রযুক্তিগত কাজ খুব একটা ভালো বোঝে না। ও পুরো দৌড় ঝাঁপের উপর আছে এই সিলভার জুবিলীর অনুষ্ঠান নিয়ে। নামী হোটেলে এই সিলভার জুবিলীর অনুষ্ঠান হবে, সেখানে দামী লোকজন থাকবে। চেঞ্জ হবে অফিসিয়াল লোগো আর নতুন ওয়েবসাইটের উদ্বোধন হবে। বুফে খাবারের আয়োজন আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানে সেই পর্যায়ের অনুষ্ঠান।
গত এক মাস ধরে সুমন বাসায় আসে রাত ১১/১২ টায় আবার সকালে উঠেই দৌড়। রাজনকে কোন মতেই অনুষ্ঠানের কোনো কিছুতে ভুল ধরতে দেবে না – এই ব্রত নিয়ে দৌড়াচ্ছে। আবার নতুন বসের মন জয় করার ব্যাপার আছে। সব মিলিয়ে জীবন মরণ না হোক মান সম্মানের বিষয় আছে৷ আর তাপসী এবং সংসার? ওরা তো বের হয়ে যাচ্ছে না। একটু সামলে নিয়েই পরিবারকে সময় দেবো – মাঝেমাঝেই সুমন এটা ভাবে।
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। পরিপাটি হয়ে সুমন অনুষ্ঠানে যায়। বিশাল মঞ্চে ডিজিটাল ব্যানার, প্রোজেক্টর। কিছুক্ষণ বক্তব্য হলো। এরপর লোগো উন্মোচন। নতুন লোগোটা এতোই সুন্দর – হলভর্তি সবাই হাততালি দিয়ে প্রশংসা করলো। প্রধান অতিথি এবং সুমনের বস তো মুগ্ধ। উনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে এই লোগো যারা করেছেন তাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। আর সুমনের সেই জুনিয়রকে জিজ্ঞাসা করলেন – উনারা কি এসেছেন?
সুমনের জুনিয়র শাহেদই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। ভাবলো এই সুযোগে ক্রেডিট নিই। ঐ তো এতো খুঁজে খুঁজে এতো ভালো আইটি প্রতিষ্ঠানকে বের করেছে৷
স্যার, আমাদের সাথে এই জমকালো অনুষ্ঠানে আছে সেই আইটি প্রতিষ্ঠান যারা চমৎকার লোগো ডিজাইন করেছে এবং এই ওয়েস সাইট এমনভাবে তৈরি করেছে যেন সব ধরণের মানুষ এমনকি স্পেশান নিডের ব্যক্তিও অ্যাক্সেস করতে পারে৷ ভয়েজ কমান্ড দিয়েও কাজ করা যাবে। কিছু না বুঝতে পারলে এ আই এ্যাসিস্ট্যান্ট এসে কি খুঁজছে সেটা জানতে চাইবে।
সুমনের বস ভীষণ খুশি হয়ে আইটি প্রতিষ্ঠানকে মঞ্চে ডাকলেন।
মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি আমাদের সহযোগী আইটি ফার্ম Hermit কে।
ছয়জন ঝলমলে মুখ মঞ্চে এগিয়ে গেলো। তার মধ্যে দুইজন মেয়ে। এক জনের পরনে সাদা সোনালীর মিশেল দেয়া জামদানী, গলায় মুক্তার জড়োয়া। চুলগুলো পেছনে খোপা করে একটা সাদা জারবার ফুল দেয়া। ভীষণ স্নিগ্ধ একটা চেহারা, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সেই স্নিগ্ধ চেহারা দেখে সুমন চমকে উঠলো – তাপসী!
Hermit এর পক্ষ থেকে ওদের টিম প্রধান ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলো। আগামীতে একসাথে আরো কাজ করার প্রত্যাশা করলো।
ভাইয়া, এটা তাপসী ভাবী না? হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ ম্যান। তোমার বউ তো ভীষণ গুণী। এতো ভালো একটা আইটি ফার্মে আছে। কি ভাগ্য তোমার।
সুমনের কানে কিছুই ঢুকছে না। সেই ল্যাপটপ কেনার কথা মনে পড়ছে। মাঝেমধ্যে ড্রইংরুমে আলো জ্বালার কথাও স্মরণে আসছে। কিন্তু এতোটা গ্যাপ কবে হলো যে তাপসী এতো কিছু করছে আর সে জানতে পারলো না!
লাঞ্চ টাইমে সুমন তাপসীর মুখোমুখি হলো
– এতো কিছু করেছো আমি কিছুই জানতে পারলাম না!
– তুমি কি জানতে চেয়েছো? নিজে আয় করে খরচের জ্বালা কেমন বুঝতে চেয়েছি শুধু।
সুমন আরো কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারে না। ওর আরো কলিগরা চলে আসে। তাপসীকে যেন সুমন চিনতেই পারছে না। আত্মবিশ্বাসী, স্মার্ট তাপসী। অনেকেই পরিচিত হতে চাচ্ছে। সুমনের কি বুকের মধ্যে একটু ঈর্ষার আগুন জ্বলে উঠে? উঠে হয়তো, বুঝতে দেয় না।
তাপসী আগেই ফিরে যায়। সুমন আসে সব প্রোগ্রাম শেষ করে। নিজের কাছে থাকা বাড়তি চাবি ঘুরিয়ে যখন বাসায় ঢোকে তখন সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। তাপসী বাচ্চাদের নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। খাবার ওভেনপ্রুভ বাটিতে ঢেকে রাখা। ওভেনে দিলেই গরম হয়ে যাবে। তবুও আজ অনেকদিন পরে সুমন একাকিত্ব বোধ করে।
ইচ্ছা করে তাপসীকে ডেকে তোলে। কিন্তু কোন এক অজানা দ্বিধায় সেটা পারে না। পাশাপাশি দুই রুমের দূরত্ব দুই গ্রহের দূরত্বে যেয়ে ঠেকেছে যেন। কেউ কাউকে যেন চেনে না। তবুও পাশাপাশি একে অন্যের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে টিকে আছে!
(সমাপ্ত)