নূরজাহানের সংসার পর্ব-৩+৪

0
26

#নূরজাহানের_সংসার
পর্ব- (৩+৪)
#শ্রীমতি_প্রজ্ঞা_মঞ্জরী (লেখিকা)

পর্ব-৩

“আপনি কি নূরের আপন মা?” অর্ণবের প্রশ্নে রাহেলা কেমন কেঁপে ওঠে। মুখটা কেমন পাংশুটে হয়ে গেছে মূহুর্তেই। অর্ণব ফের রাহেলা কে প্রশ্ন করে,
“কাল রাতে নূরজাহান আমায় বলেছে আপনি নাকি আমার প্রথম সংসার এবং সন্তানের কথা বিয়ের আগে তাকে জানান নি। আপনার মেয়ে আমার বলেছে আমি নাকি প্রতারক;প্রতারণা করেছি আপনাদের সাথে।”

রাহেলার শরীর অস্বাভাবিক ভাবে ঘামছে।উচ্চ রক্তচাপের রোগী সে,সামান্য স্ট্রেসেই ধমনীর রক্তচাপের মাত্রা বেড়ে যায়। শাড়ির আঁচলে নিজের কপালের ঘাম টুকু শুষে নিয়ে রাহেলা বলে ওঠে, “আমি-ই নূরের মা। তোমার এমন কেন মনে হলো যে আমি নূরের আপন মা নই; সৎ মা?”

“সৎ মায়ের প্রসঙ্গ আমি তুলিনি মা।আমি শুধু বলেছি আপনি কি নূরের নিজের মা কি-না?”

“আপন মা নয় মানেই তো সৎ মা।এছাড়া আর কি দাঁড়ায়?”

অর্ণব কিছুটা অবাক হয় রাহেলার এমন আচরণে।সৎ মায়ের কথাটাকে সে এভাবে কেন কাটাতে চাইছে? “নিজের মেয়েকে একজন বউ-পরিত্যাক্ত লোকের হাতে তুলে দেওয়া, যার একটা সন্তানও আছে। ওই ভাবে ভাবতে গেলে আমার আপনাকে নূরের সৎ মা-ই মনে হচ্ছে। এছাড়া আপনি বলেছিলেন নূর আমার অতীত সম্পর্কে অবগত, কিন্তু নূরের ভাষ্যমতে আপনি তাকে কিছুই বলেননি।দুই-এ দুই-এ চার মিলাতে পারছি না।”

“নূর মিথ্যে বলেছে।সে সব জেনেই তোমায় বিয়ে করেছে।” অস্থির ভঙ্গিতে বলে ওঠে রাহেলা।

“আমি নূরজাহানের সাথে পাঁচ মাস সংসার করছি,সে এই পাঁচ মাসে একদিনও আমায় মিথ্যে বলেনি।আর আজও আমার মনে হচ্ছে নূরজাহান মিথ্যে বলে… ”

অর্ণবের কথা শেষ হতে না হতেই রাহেলা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, “তুমি কি বলতে চাইছো? আমি মিথ্যে বলছি? নিজের মাতৃতুল্যা শাশুড়িকে মিথ্যেবাদী উপাধি দিচ্ছ?”

“সত্য – মিথ্যের যাচাই তখনি হবে, যখন নূরজাহান এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে আর এই প্রশ্ন গুলো আপনার সামনে আমি তাকে করবো।” কথাটা বলেই অর্ণব বেরিয়ে যায় নূরদের বাড়ি থেকে।

এদিকে রাহেলার মাথাটা ঘুরছে,সে ভাবেছিলো এমন এক সংকটময় সময়ের কথা।নূর অর্ণবকে বলে দিয়েছে যে তাকে রাহেলা মিথ্যের মধ্যে রেখে বিয়ে দিয়েছে? এরপর কি হবে? প্রতারণার মামলায় এই বয়সে এসে কি জেলের ঘানি টানবে? আর সবথেকে ভয়ংকর মিথ্যে যা সে অর্ণবকে বলেছিলো? তার নিজের অতীত? সব জেনে যাবে সবাই?
এতোসব ভেবে সোফায় ধপ করে বসে পড়ে রাহেলা। ছেলে ফাহিমকে বলে এক গ্লাস পানি দিতে। ফাহিম দৌঁড়ে যায় মায়ের জন্য পানি আনতে।
পানির গ্লাসটা হাতে দিতেই ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানি দিয়ে গলা ভেজায় রাহেলা। গ্লাসটা দু’হাতে চেপে ধরে অস্থির ভঙ্গিমায় শ্বাস নিতে থাকে।

“নূরের জামাই অর্ণব?” মধ্যবয়সী এক নারীর কণ্ঠ শোনা যায়। রাহেলা তার প্রশ্নের জবাবে মাথা নাড়ায় শুধু।
উত্তর পেয়ে বাঁকা হাসি ফোঁটে নারীর ঠোঁটে।

অন্যদিকে,
নূরের বাস এসে ফরিদপুর বড় বাসস্টপেজ এ থেমেছে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে নূর কখন যে ঘুমিয়ে গেছে নিজেই জানেনা। স্নেহা নরম কণ্ঠে নূরজাহানকে ডাকে। নূর উঠছে না দেখে নূরের হাত ধরে হালকা ঝাঁকুনি দেয় স্নেহা। ধীরে ধীরে চোখ মেলে নূর।
“উঠে পড়, আমরা চলে এসেছি।”
“ফরিদপুর এসে গেছি?” হালকা আড়মোড়া ভেঙ্গে বলে ওঠে নূর।
“হ্যাঁ, তোমার গন্তব্যে পৌঁছে গেছো নূরজাহান।চলো চলো, বের হই আমরা।” বলেই সিট থেকে ওঠে স্নেহা। নূরও তার পিছন পিছন বাস থেকে নামে।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের প্রখরতা বেড়েছে।ঘড়ির কাঁটায় এখন দশটার একটু বেশি বাজে। নূর নিজের ব্যাগটা উঠিয়ে একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে কিছুটা পানি পান করে। শরীরটা অস্বাভাবিকভাবে দূর্বল লাগছে নূরের। দোকানের বেঞ্চে বসে ঢাকা থেকে কেনা ব্রেড আর কলা বের করে ধীর গতিতে চিবুতে থাকে নূর। স্নেহা নূরের সাথেই ছিলো। সে এখান থেকে অটো ধরে বাসায় যাবে।

“নূরজাহান,তুমি যার বাসায় যাবে তাকে একটা কল করো। ঠিকানা জেনে নাও;আমি তোমায় অটোতে উঠিয়ে দিবো। আর যদি আমার বাসার ওদিকেই হয় তবে আমার সাথেও যেও না হয়।” স্মিত হেসে বলে স্নেহা।
নূর চোখ তুলে তাকায় স্নেহার দিকে। হাতে রাখা ব্রেডের স্লাইস আর কলাটুকু শেষ করে পার্স থেকে সিমকার্ডটা বের করে ফোনে ইনসার্ট করে।কন্টাক্ট অপশনে গিয়ে “মারজানা ফুপ্পি” টাইপ করে নূর;একটা নাম্বার ভেসে উঠতেই কল করে সে। কিন্তু নূরের ফোনের ব্যালেন্স শেষ, হতাশ ভঙ্গিতে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কেটে দেয় নূর।
“কি হলো?ধরলো না?”
নূর একটু ইতস্তত করে জবাব দেয়, “আসলে আমার ফোনের ব্যালেন্স শেষ।এখানে কোথাও থেকে ফ্লেক্সিলোড করিয়ে নিতে হবে। তুমি বরং চলে যাও স্নেহা,আমি না হয় ঠিকানা জেনে একাই চলে যাবো।”

“ইসসস!বোকা মেয়ে। নাম্বারটা বলো,আমি কল দিচ্ছি। আমরা তো এখন বন্ধু, এতো ইতস্তত করছো কেন তুমি?”
বলেই নিজের ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে নূরের কাছে দেয় স্নেহা।
“নাও,ডায়েল প্যাডে নাম্বারটা তুলে দাও।আমি কল দিয়ে দিচ্ছি।”
নূর একটু সংকোচবোধ নিয়েই স্নেহার ফোনের ডায়েল প্যাডে নাম্বারটা তুলে। কিন্তু নাম্বারটা আগে থেকেই স্নেহার ফোনে সেইভ করা দেখে অবাক হয়ে স্নেহার দিকে তাকায় নূর।

অর্ণবদের বাড়ি,

নূরদের বাড়ি থেকে সবেমাত্র ফিরেছে অর্ণব। অর্ণবের মা মুমতাহিনাকে কিচেন,ড্রয়িং,ডাইনিং কোথাও না দেখে একটু স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে অর্ণব। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় সে,এখন শাওয়ার নেওয়া খুবই দরকার। ঘুম না হওয়ায় চোখ দুটো জ্বলছে অর্ণবের,মাথায় হাজারটা চিন্তা।সবকিছু খুবই অসহ্য লাগছে অর্ণবের কাছে।

“পাপা,মাম্মাম কোতায়?(কোথায়) মাম্মাম গরে(ঘরে) নেই পাপা। মাম্মাম আবার চলে গেছে?” কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে এসে অর্ণবের পা ধরে বলতে থাকে অভ্র। মুমতাহিনা চৌধুরীও দৌঁড়ে এসেছেন নাতির পিছনে।

সকালে নাস্তা তৈরি করার মাঝে অভ্র ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করে।মুমতাহিনা চৌধুরী ছুটে যান নাতির কাছে,অর্ণব মূলত তখনই বের হয়েছিলো নূরদের বাসার উদ্দেশ্যে। ছোট্ট অভ্র ঘুম থেকে উঠে নূরকে দেখতে না পেলে কান্না জুড়ে নেয়,মুমতাহিনা তাই নাতিকে নিয়ে অর্ণবের ঘরের দিকে যান। বাইরে থেকে করেকবার নক করেও কারো সাড়া-শব্দ না পেলে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন মুমতাহিনা। ঘর ফাঁকা দেখে অবাক হন তিনি,নূরও ঘরে নেই অর্ণবই বা কোথায় গেল? তিনি নূরের নাম ধরে কয়েকবার ডাক দেন।সাড়া না পেলে তিনি অভ্রকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যান,আর মনে মনে ভাবেন নূর আর অর্ণবের মধ্যে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে? নূর কোথায়? সে কি রাগ করে ভোর হতেই বাপের বাড়ি চলে গেছে? অর্ণব এলেই সব প্রশ্ন করবেন বলে ঠিক করে রাখেন মুমতাহিনা।

“অর্ণব,,, নূর কোথায়? অভ্র তখন থেকে নূরের কাছে।যাওয়ার জন্য কাঁদছে। নূরকে তুমি কি কোনো ভাবে অপমান করেছো? সে কি বাপের বাড়ি চলে গেছে?” অর্ণবের দিকে তাকিয়ে একনাগাড়ে কথা গুলো বলেন মুমতাহিনা।

অর্ণব তখন ছেলের কান্না থামাতে ব্যস্ত। কাঁদতে কাঁদতে ফোলা ফোলা গালটা লাল হয়ে গেছে অভ্রর;বারবার হিচকি তুলছে সে। “থামো বাবা,মাম্মাম চলে আসবে। আমি নিয়ে আসবো মাম্মামকে।তুমি কি খাবে বলো?আমি এনে দিবো তো।আমার সোনা বাবা না তুমি? তুমি তো সুপারম্যান আমার।সুপারম্যানরা কাঁদে না বাবা।” এমন আরো অনেক আদুরে কথা বলে অভ্রকে থামানোর চেষ্টা করছে অর্ণব। এই মূহুর্তে তার নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে।বাচ্চাটা মা-কে ছাড়া কিছুই বুঝেনা,নূর ছাড়া কিভাবে অভ্রর কান্না থামাবে ভেবেই কূল পাচ্ছেনা অর্ণব।

“আমার তিন বছরের বাচ্চাটাকে এভাবে ফেলে গেলে নূর?ও তো তোমায় ছাড়া থাকতে পারেনা।এখন কি করবো আমি?তুমি ওর সৎমা-ই হয়ে উঠলে?” অভ্রর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবতে থাকে অর্ণব।

“তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করেছি অর্ণব।বৌমা কোথায়?তোমাদের মধ্যে যা হয়েছে মিটিয়ে নাও,তাকে ফিরিয়ে আনো যেভাবে পারো।”

“সে কোথায় আছে আমি জানিনা আম্মা। আমায়, আমাদের ফেলে চলে গেছে সে।” মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে অর্ণব। মুমতাহিনা বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় অর্ণবের দিকে। অবাক স্বরে আওড়ায়, “কিহ্?”

“মারজানা খাতুন তোমার কে হন?” স্নেহাকে প্রশ্ন করে নূর।

“আমার মা।তুমি চেনো আমার মা কে?এই নাম তুমি জানলে কিভাবে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে স্নেহা।

“তুমি মারজানা ফুপ্পির মেয়ে? কিন্তু তার নাম তো শিউলি। তোমার নাম তো স্নেহা।”

“আমার নাম স্নেহা রহমান। ডাক নাম শিউলি,বাইরে সবাইকে স্নেহা নামটা-ই বলি। কিন্তু তুমি কে?”

“আমি সারোয়ার ইকবালের মেয়ে;নূরজাহান বিনতে সারোয়ার। মারজানা ফুপ্পি আমার বাবার ফুফাতো বোন। আমার চিনেছো তুমি? আমার দাদি বাড়ি বরিশাল। তোমার সাথে আমার অনেক বছর আগে গ্রামে দেখা হয়েছিলো।”

স্নেহা এবার নিজের মস্তিস্কে একটু চাপ প্রয়োগ করে। অস্পষ্ট হলেও কিছুটা মনে পড়ে তার। অনেক বছর হয়ে যাওয়ায় স্পষ্ট মনে পড়ছেনা তার। কিন্তু ইকবাল আর নূরের নাম সে অনেক শুনেছে। স্নেহার বাবা খালিদ রহমানকে নূরের বাবা টাকা ধার দিয়েছিলেন ব্যবসার জন্য। নিজের যে যৎসামান্য পুঁজি ছিলো তাতে তিনি ব্যবসা দাঁড় করাতে পারতেন না। নূরের বাবার পরামর্শ এবং আর্থিক সহযোগীতায় আজ তার নিজের দুইটা কাপড়ের দোকান। সচ্ছল জীবন-যাপন করছেন তিনি।স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে আছেন। আজও নূরের বাবা ইকবালের কথা কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করে স্নেহার বাবা-মা।

“তুমি ইকবাল আংকেলের মেয়ে নূর?”

“হ্যাঁ।” স্মিত হেসে জবাব দেয় নূর।

“মা-কে ফোন করতে হবেনা। তুমি আমার সাথে চলো,মা-কে সারপ্রাইজ দিবো আমি।চলো চলো।” বলেই নূরের ব্যাগটা নিয়ে অটো স্ট্যান্ড থেকে অটো দাঁড় করায় স্নেহা। অত:পর নূরকে নিয়ে অগ্রসর হয় নিজের বাড়ির দিকে।

“তুমি ভাবতেও পারছো না মা কি পরিমাণ খুশি হবে। তোমার আর আংকেলের কথা মা রোজ আমাদের বলে। আমি ঢাকায় থাকি,একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। মা যখন জানতে পারে তোমরা ঢাকায় আছো, আমায় খোঁজ নিতে বলেছিলো।কিন্তু এতো বড় শহরে কিভাবে কি খুঁজবো বুঝে উঠতে পারিনি।তার উপর সবাই শুধু এটাই বলে তোমরা ঢাকায় থাকো,কোন এরিয়া,কোন সেক্টর কেউ জানেনা।”

“আমরা বাড্ডায় থাকতাম।”

“আমি তেঁজগাও।আমার ইউনিভার্সিটির কাছেই। মা আজকে ডাবল সারপ্রাইজ পাবে বুঝলে?”

“কিভাবে?” স্নেহার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নূর।

“আমি যে আজ বাড়ি আসছি, মা জানেনা।দু’জনকে একসাথে দেখলে একদম ফোর-ফোর্টি ভোল্টের ঝটকা খাবে।” বলেই হেসে উঠলো স্নেহা।

স্নেহার কথায় নূরও হেসে ওঠে।স্নেহা মেয়েটা খুবই মিশুকে,কি সুন্দর করে কথা বলে।তিন-চার ঘন্টার ব্যবধানেই কি সুন্দর বন্ডিং হয়ে গেছে তাদের। নূর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস নেয়।
নূরের বাবা মারা যাওয়ার আগের রাতে নূরকে মারজানার নাম্বার দিয়েছিলেন। যেকোনো সমস্যায় যেন নূর মারজানাকে স্মরণ করে একথাও বলেছিলেন।সাথে একটা চিঠিও দিয়েছিলেন,যদি কখনো মারজানার বাড়ি যায় তাহলে যেন তাকে দিয়ে দেয়।আর তা সম্ভব না হলে তাকে কল করে পুরো ঠিকানা নিয়ে চিঠিটা পাঠিয়ে দেয়।
তার পরেরদিনই নূরের বাবা স্ট্রোক করেন,একদিন আইসিউ তে থাকার পর ইহকালের মায়া ত্যাগ করেন তিনি।
অটোর গতি থেমে গেলে ধ্যান ভাঙ্গে নূরের। চারতলা একটা ভবনের সামনে এসে অটো থেমেছে।স্নেহাকে নামতে দেখে নূরও নেমে যায়। নিজের ব্যাগটা বের করে অটো থেকে,স্নেহা ভাড়া দিতে নিতে নূর আগ বাড়িয়ে ভাড়া মিটিয়ে দেয়।

“এটা কি হলো নূর? তুমি ভাড়া দিলে কেন?” ঘাড় বাকিয়ে জিজ্ঞেস করে স্নেহা।

নূর মুচকি হেসে জবাব দেয়, “ছিলো তাই দিলাম।পরেরবার না হয় তুমি দিও।”

“আচ্ছা,চলো উপরে যাই।” ব্যাগটা গেটের ভিতরে রেখে উপরে উঠতে থাকে স্নেহা।

“ব্যাগ নিবে না?”

“তোমার টাও রাখো। আমার ছোট ভাইটার কোনো কাজ নেই,সারাদিন শুয়ে-বসে থাকে। ওকে দিয়ে ব্যাগ বয়ে উপরে নেওয়াবো।” বলেই নূরের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে গেটের সামনে রেখে দেয় স্নেহা। তারপর নূরের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে যায়।

পর্ব-৪

“অর্ণব নূরকে ফরিয়ে আনো তুমি।তুমি না পারলে আমায় বলো,সে আমার কথা ফেলবে না।আমি বললে সে অবশ্যই আসবে। আমি বুঝাবো।” অর্ণবের দিকে তাকি বলে ওঠেন মুমতাহিনা।

“আম্মা,অভ্রকে নিন।আমি সত্যিই জানিনা আম্মা নূরজাহান কোথায় গেছে।আমি জানলে তাকে নিয়ে আসতাম আম্মা।” বলেই অভ্রকে তার দাদীর কোলে দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় অভ্র। রুমে এসে কাবার্ড খুলে নিজের টিশার্ট আর ট্রাউজার নেয়,ডানপাশে তাকাতেই কেমন খালি-খালি লাগে। এখানে নূরের কাপড় থাকতো, গত পাঁচমাসে এভাবে যায়গাটা ফাঁকা দেখে অভ্যস্ত নয় অর্ণব। আর সাত-পাঁচ না ভেবে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় অর্ণব।

খানিকক্ষণ বাদে ওয়াশরুম থেকে চিল্লিয়ে বলে ওঠে, “নুরজাহান আমার তোয়ালে টা দাও তো,ফেলে এসেছি।” কোনো উত্তর না পেয়ে আবারো একই কথা বলে ওঠে অর্ণব।হঠাৎ মস্তিষ্ক মহাশয় জানান দেন যে নূরজাহান নেই। নূরজাহান চলে গেছে অর্ণবকে রেখে।

অন্যদিকে,

স্নেহা নূরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে।কলিংবেল বাজিয়েছে দুইবার কিন্তু এখনো কেউ দরজা খোলেনি। স্নেহা বিরক্তি হয়ে নিজের মা-কে কল করবে এমন সময় স্নেহার ছোট ভাই সোহেল এসে দরজা খোলে।
“এই বাটুল,কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি? কি করিস ঘরে বসে?” সোহেলের পেটে খোঁচা মেরে বলে ওঠে স্নেহা।

“ধুর আপু,সবসময় খোঁচাতে থাকবেনা তো ভালোলাগেনা। ” বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে সোহেল।

“যাহ,খোঁচালাম না তোকে। নিচে গেটের সামনে দেখ আমাদের দু’জনের ব্যাগ রাখা জলদি করে নিয়ে আয়। তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি। দ্রুত ব্যাগ আনতে দ্রুত পাবি।”

উপহারের কথা শুনে দৌঁড় দেয় সোহেল।স্নেহা নূরকে নিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। মারজানা খাতুন তখন ডাইনিং এ বসে কলমি শাক বাছছিলেন। স্নেহা গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। মারজানা খাতুন চমকে ওঠেন।মেয়েকে দেখে খুশি হন ভীষণ।
“তুই তা দুইদিন পর আসতে চাইলি?”

“আজ ই আসলাম মা। ভাবলাম ছুটি যখন পেয়েছি চলেই আসি। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

“কি সারপ্রাইজ?” স্নেহার কথার উত্তরে বলে ওঠেন মারজানা।

“ওই দেখ, তোমার ইকবাল ভাইয়ের মেয়ে।নূর;নূরজাহান। ” মারজানা তাকালেন নূরের দিকে।খুশিতে চোখজোড়া চকচক করে উঠলো তার।নূরের কাছে গিয়ে সন্তোর্পনে জড়িয়ে ধরলেন নূরকে।
“কতো বড় হয়ে গেছিস মা!সেই তোর ছয় বছর বয়সের সময় ভাইজান বরিশাল ছাড়লেন।আর এসেছিলেন মামি মানে তোর দাদির মৃত্যুর সময়ে। কিন্তু তোর ফুফাজান অসুস্থ থাকায় আমি যেতে পারিনি। কত বছর পরে তোর সাথে দেখা।”

কিছুটা বিরতি নিয়ে মারজানা খাতুন আবার বলে ওঠেন,
“একা এসেছিস? ভাইজান আসেনি?”
বাবার কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল নূরের।
“বাবা নেই ফুপ্পি। ৯মাস আগেই বাবা চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।”

মারজানা যেন ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে আকাশ থেকে পড়লেন।চোখজোড়া জলে টইটুম্বুর হয়ে গেল। নূরের বাবা ছিলেন তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। নূরের দাদা যখন মারা যান তখন নূরের বাবা বয়স দশ কি বারো। এরপর নূরের দাদী মারা যান যখন নূরের বাবা রাহেলাকে দ্বিতীয় বিবাহ করেন তখন।তিনি মারা যাওয়ার পর আর কেউ ছিলোনা গ্রামে,যারা নূরের বাবার খোঁজ নিবে। ফলে দীর্ঘ বারো বছর তিনি আর গ্রামের মাটিতে পা রাখেননি।নূরের বাবা মারা গেলে তাকে ঢাকাতেই কবরস্থ করা হয়।

“ঘরে যা মা।কতো দূর থেকে এসেছিস। ফ্রেশ হ,আমি তোদের খাবার দিচ্ছি। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে একদম।”
নূরের হাত ধরে বলে ওঠেন মারজানা।

সোহেল স্নেহা আর নূরের ব্যাগ নিয়ে উপরে আসলে ;স্নেহা নূরের ব্যাগ নিজের রুমে নিয়ে যায়।নূরও পিছন পিছন যায়। স্নেহার রুমে যেতেই স্নেহা নূরকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দেয়। নূর নিজের ব্যাগ থেকে একসেট কাপড় বের করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।

প্রায় আধা ঘন্টা লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হয় অর্ণব। শরীরটা খুবই ক্লান্ত,কিন্তু ঘুম আসছেনা চোখে। নূরকে খুঁজে বের করা খুবই জরুরী তার জন্য। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট, কোথায় কোথায় ঘুরে বেরাচ্ছে কে জানে! এতো কিছু ভাবনার মাঝে অর্ণব নিজের ল্যাপটপ টা অন করে। সাতদিনের একটা লিভ এপ্লিকেশন লিখে অফিসের হেড অফিসে মেইল করে দেয়। রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং এ বসে মুমতাহিনা চৌধুরীকে ডাকে অর্ণব।

অভ্রকে অনেক কষ্টে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছেন মুমতাহিনা। অর্ণবের ডাকে ডাইনিং এ আসেন তিনি।
“আম্মা খেতে দিন,অনেক ক্ষুধা পেয়েছে।” মাথা নিচু করে বলে অর্ণব।

মুমতাহিনা ফ্রেঞ্চ টোস্ট,অরেঞ্জ জুস,সেদ্ধ ডিম, আর বাটার রাখে অর্ণবের সামনে। অভ্রকে সামলাতে গিয়ে নাস্তা টা বানাতে পারেননি তিনি। এসব খাবার দেখে অভ্র ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়ে। নূর প্রতিদিন সকালে পরোটা,ডিম ভাজি,পাঁচ-মেশালি তরকারি বা অন্য যে কোনো আইটেম বানিয়ে ডাইনিং সাজিয়ে রাখতো।আজ এই শুকনো টোস্ট দিয়েই ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে অর্ণবের।

“অর্ণব?”

মুমতাহিনার ডাকে মাথা তুলে তাকালো অর্ণব। হালকা স্বরে উত্তর করলো, “জ্বী আম্মা?”

“আমায় বলো তোমাদের মাঝে কি হয়েছে? নূর কোথায় গেছে? কি এমন মনমালিন্য হলো?”

“আম্মা,আমি নূরের বাবার বাড়ি গিয়েছিলাম।নূর যায়নি ওখানে।অনেকবার ফোনে ট্রাই করেছি আম্মা,ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে।” ঠাণ্ডা স্বরে বলে ওঠে অর্ণব।

“বেয়ান কি বললেন? নূর তার সাথে যোগাযোগ করেছে?”

“উনিও কিছু জানেন না আম্মা। আপনি চিন্তা করবেন না,আমি নূরকে খুঁজে আনবোই।” বলে কোনো রকম খেয়ে উঠে গেলো অর্ণব। রুমে গিয়ে তার বন্ধু তাসিন কে কল করলো। তাসিন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে আছে। নূরের ফোনের লাস্ট লোকেশন ট্রাক করা গেলে তাকে খুঁজে বের করা যাবে।

কল রিসিভ হতেই অর্ণব বলে ওঠে,
“তাসিন?”

ওপাশ থেকে উত্তর আসে,”হ্যালো অর্ণব? কেমন আছিস?”

“চলছে, তুই ফ্রি আছিস? দেখা করতে পারবি?”

“হ্যাঁ পারবো। কখন দেখা করবি?”

“এখনি,আমি তোর বাসায় আসছি।” বলেই কল কেটে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নেয় অর্ণব। গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

একবারে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয় নূর। শরীরটা আর সায় দিচ্ছেনা।এমন সময়ে এতক্ষণ না খেয়ে থেকে কাহিল হয়ে পড়েছে সে। চুলগুলো গামছা দিয়ে মুছে ভিজে গামছা টা বারান্দায় নেড়ে দেয় নূর। মারজানা খেতে ডাকছিলেন স্নেহা আর নূরকে।

নূর নিজের ব্যাগ থেকে মারজানার জন্য তার বাবার রেখে যাওয়া চিঠিটা বের করে হাতে নেয়। এরপর রুম থেকে বেরিয়ে এসে ডাইনিং এ যায়। মারজানা টেবিলে খাবার গুছিয়ে রেখেছেন ইতমধ্যেই। নূরকে দেখে তিনি চেয়ার এগিয়ে বসতে বললেন।নূর বসতেই প্লেটে খাবার সাজিয়ে দিলেন মারজানা। স্নেহা আসতেই নূরও আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো। খাবার শেষে মারজানাকে চিঠিটা দিলো নূর।
“বাবা আপনাকে দিতে বলেছিলেন চিঠিটা।”

মারজানা হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন। নূরকে স্নেহার সাথে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে চিঠিটা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন।

নূরও বিনাবাক্য স্নেহার রুমে চলে গেল। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো নূর।
…………….
শান্ত নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে অর্ণব। সচরাচর স্মোক করতে দেখা যায়না অর্ণবকে। তব কাজের অনেক স্ট্রেস আর মানসিক চিন্তায় থাকলে সিগারেটে সুখটান দিয়ে সমস্যাগুলো ধোঁয়ার সাথে উঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে সে।

অদূরেই অর্ণবের গাড়ির ডিকির উপর পা তুলে বসে আছে তাসিন। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে দেখছে অর্ণবকে। অর্ণবের এমন এলোমেলো চেহারা দেখে তাসিন প্রথমেই আঁচ করতে পেরেছিলো কোনো না কোনো গণ্ডগোল আছেই;অর্ণবের থেকে সবটা শোনার পর আরো ভালো বিষয়টা নিশ্চিত হয়েছে তাসিন।

“ভাবী প্রেগন্যান্ট? তাও আবার টুইন প্রেগন্যান্সি?

অর্ণব ফিরে তাকায় না।ওভাবেই স্মোক করতে করতে উত্তর করে,
“ইয়াহ! ওয়ান মান্থ প্লাস।”

“তোর সমস্যাটা কি অর্ণব? বাচ্চার কথা শুনে এতো রিয়েক্ট কেন করেছিস?”

অর্ণব সিগারেটের বাকি অংশটুকু ফেলে দেয়; পা দিয়ে পিষে সিগারেটটা নিভিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।

“নূরজাহান এর মা অর্থাৎ আমার শাশুড়ি বিয়ের আগে আমায় বলেছিলেন নূরের কোনোদিন বাচ্চা হবেনা। শারীরিক কোনো জটিলতার কারণে সে বাচ্চা জন্ম দিতে অক্ষম। আর বিয়েতে আমি মূলত সে কারণেই রাজি ছিলাম তাসিন।”

চলবে….