নূরজাহানের সংসার পর্ব-৬+৭

0
27

#নূরজাহানের_সংসার
পর্ব-৬
#শ্রীমতি_প্রজ্ঞা_মঞ্জরী (লেখিকা)

অর্ণবের গাড়িটা নূরদের বাড়ির সামনে এসে থামলো। গাড়ির ভিতর থেকে প্রথমে অর্ণব তারপরে বেড়িয়ে এলো তাসিন। অর্ণব সোজা ঢুকে গেলো নূরদের বাড়িতে তার পিছনে তাসিনও ঢুকলো। সদরদরজার কাছে এসে কলিংবেল বাজানোর কিছু মূহুর্তে পরেই দরজা খুললেন রাহেলা। অর্ণবকে দেখে বলে ওঠেন, “তুমি?”

রাহেলার চেহারার অস্বাভাবিকতা নজরে পড়লো তাসিনের। অপরাধীদের সাথে ডিল করতে করতে সহজেই মানুষের মুখের অভিব্যক্তি ধরে ফেলে তাসিন। রাহেলার চোখে আছে ভয় আর আতংক তবে চেহারায়।বিরক্তিভাব।যেন এই সময়ে অর্ণবের আসায় কিছুটা হলেও বিরক্ত সে। তার উপর উটকো ঝামেলা হিসেবে সাথে তাসিন।

রাহেলা দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে অর্ণব আর তাসিনকে ভিতরে ঢুকতে দিলেন।তাসিন বাড়িতে ঢুকে আশপাশটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলো।
“বাড়িতে কি আপনি একাই আছেন?”

তাসিনের কথায় কেমন যেন চমকে উঠলেন ভদ্রমহিলা।জড়তাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “এই সময়টাই আমি একাই থাকি বাড়িতে। আমার ছেলে স্কুলে থাকে।”

তাসিন রাহেলার উত্তরে সন্তুষ্ট না হলেও হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যাপারটা আপাতত বন্ধ রাখলো।

“ফরিদপুরে কি আপনাদের কোনো আত্মীয় আছেন?”

“আমার জানা মতে নেই। নূরের দাদী মারা যাওয়ার পর আমাদের আর যাওয়া হয়নি গ্রামের বাড়িতে।”

রাহেলার কথায় অর্ণবের মনে যেই সামান্য আশার আলো দেখা গিয়েছিলো তা-ও নিভে গেলো।ফরিদপুর শহরটা মোটেই ছোট নয়। অন্তত নূরের কোনো আত্মীয় আছে কিনা ওই শহরে তা জানতে পারলে নূরকে খোঁজা সহজ হতো।

“অর্ণব, এখানে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমাদের ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে।”

তাসিনের কথা শুনে অর্ণব বলে ওঠে,
“হ্যাঁ, আর উপায় নেই।”

“নূর কি ফরিদপুর আছে?” উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে রাহেলা।

তাসিনের কাছে এই মহিলার আচরণ মোটেই স্বাভাবিক লাগছে না।নিজের মেয়ে প্রায় একদিন হতে চললো নিরুদ্দেশ অথচ এই মহিলার মধ্যে কোনো হেলদোল নেই? উনি কি কোনোভাবে জানেন নূর কোথায় আছে?

অর্ণবের উত্তর দেওয়ার আগেই তাসিন বলে ওঠে, “এখনো জানিনা। প্রাথমিক ধারণা করছি।”
তাসিন নিজের কথা শেষ করে রাহেলাকে আর কিছু।বলার সুযোগ দিলো না।অর্ণবের হাত ধরে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

বাইরে এসে অর্ণবকে উদ্দেশ্য করে তাসিন বলে, “তোর শাশুড়ির হাব-ভাব আমার সুবিধার লাগেনি অর্ণব। উনি মিথ্যে বলেছেন আবারো।”

“তুই আবার কি মিথ্যে পেলি?”

“উনি বলেছেন উনি বাড়িতে একা আছেন।কিন্তু আমি সোফার সামনের সেন্টার টেবিলে দু’টো গ্লাস দেখেছি কোল্ড ড্রিংস এর। সাথে পপকর্ণ আর পাকোড়া ছিলো।সম্ভবত কোনো শো বা সিনেমা দেখা হচ্ছিলো। একা একা অবশ্যই উনি দু’টো গ্লাস নিয়ে বসে থাকবে না।”

অর্ণব চকিতে তাকালো তাসিনের দিকে।নূরের চিন্তায় আশেপাশে খেয়াল করেনি অর্ণব। “নূরজাহান কে খুঁজে পাচ্ছিনা প্রায় বারো ঘন্টা হতে চললো।আমার থেকে ওনার উদ্বিগ্নতা বেশি হওয়া উচিৎ ছিলো অথচ উনি বসে সিনেমা দেখছেন!” চোয়াল শক্ত করে বলে ওঠে অর্ণব।

“রিল্যাক্স অর্ণব।আমি যদি খুব বেশি ভুল না হই তাহলে ফরিদপুরে ওনাদের কোনো না কোনো আত্মীয় আছেই।ভাবী হয়তো সেখানেই গেছেন। নিজের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়েও কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মেয়ে ভাবী নয়।নিরুদ্দেশ হতে চাইলে চট্টগ্রাম বান্দরবন ও যেতে পারতেন;কিন্তু উনি ফরিদপুর গেছেন।পরিচিত কেউ আছে বলেই গেছেন।”

“তাসিন,আমি ফরিদপুর যাবো।”

“আমি না ব্যাটা;বল আমরা।ফরিদপুর সদর থানার ওসির সাথে যোগাযোগ করি দাঁড়া। ভদ্রলোক আমার পরিচিত,এক ট্রেনিং এ দেখা হয়েছিলো।” বলেই পকেট থেকে ফোনটা বের করে ওসির নাম্বার খুঁজতে থাকে তাসিন।
……………..

“ওর হাসবেন্ডের নাম তুই কি করে জানলি?” মারজানার প্রশ্নের জবাবে স্নেহা নূরের রিপোর্ট টা খুলে তার সামনে দিয়ে বলে,

“দেখো এখানে অভিভাবক এর যায়গায় শাফিকুল চৌধুরী অর্ণব এর নাম লিখা আছে।ঢাকার বড় হাসপাতাল গুলোতে রিপোর্ট এ পেশেন্টের নামের সাথে অভিভাবকের নাম ও লেখা থাকে মা।”

মারজানা রিপোর্ট টা হাতে নেন। নূরের নামের যায়গায় ও নূর চৌধুরী লেখা দেখে উনি শিওর হন নূর বিবাহিত।

নূরের সবে জ্ঞান ফিরেছে। পিটপিট করে চোখ খুলে হাসপাতালের সাদা সিলিং নজরে আসে তার। হাত নড়াতে গেলেই হাতে মৃদু টান লেগে অস্ফুট স্বরে “আহ্” বলে ওঠে নূর। আশেপাশে তাকাতেই বুঝে যায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে সে। গলায় একটু জোর সঞ্চয় করে “ফুপ্পি? স্নেহা?” বলে ডাক দেয় নূর।

কেবিনের বাইরে থেকে নূরের আওয়াজ পেয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে মারজানা আর স্নেহা। নূরের পাশে যেয়ে নূরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মারজানা বলে ওঠে, “খারাপ লাগছে মা? পানি খাবি?”

মারজানার কথায় উপর নিচ করে মাথা নাড়ায় নূর। ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে ছিপি খুলে নূরের সামনে ধরেন তিনি;স্নেহা ততক্ষণে নূরকে সাবধানে বিছানা থেকে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। দূর্বল হাতে পানির বোতলটা নিয়ে কয়েক ঢোক পানি পান করে নূর;গলাটা একদম শুকিয়ে গেছিলো তার।

“স্নেহা তুই একটু বাইরে যা তো। নূরের সাথে কথা আছে আমার।”
মায়ের কথায় আর টু-শব্দ না করে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় স্নেহা।

বেডের পাশের ধাতব টুল টা টেনে নিয়ে বসেন মারজানা।

“তোর সাথে কি খারাপ কিছু হয়েছে মা?তোর মা মানে সৎমা রাহেলা কি কিছু করেছে?”

মারজানার কথায় নূরের মুখটা ছোট হয়ে যায়। মাথাটা নিচু করে চোখের পানি ফেলে নূর।

“নূর? কাঁদেনা বাচ্চা। তুই কাঁদলে, তোর মন খারাপ থাকলে বাচ্চাদের কষ্ট হবে সোনা। ফুপ্পিকে বল কি হয়েছে? ”

“বাচ্চাদের” শব্দটা শুনে কান্না থামিকে অবাক চোখে তাকায় নূর।
“বাচ্চাদের? কয়টা বাচ্চা ফুপ্পি?”
নূরের এমন কথায় হেসে ফেলেন মারজানা।
“দু’ট পুচকু আছে নূর। এবার আমায় বল কি হয়েছে?”

নূর যেন খুশিতে বাকহারা হয়ে গেছে। নূরের রিপোর্ট গুলো নূর দেখার সুযোগ পায়নি। গতকাল রাতে অর্ণবদের বাড়ি ফিরেই এতসব ঘটনা ঘটে গেলো যে নূর আর সময়-ই পায়নি রিপোর্ট দেখার।

“নূর? বলবি না ফুপ্পি-কে?”

মারজানার কথায় নূরের মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু মনের উপর এই বোঝা একা একা বয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।মনের ভিতরটা বড্ড পুড়ে,যাদের আপন ভেবে জীবনের এতোগুলো দিন কাটালো তারাই দিনশেষে পিঠে ছুড়ি মারলো!
নূর এবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।নূরের কান্না দেখে মারজানা বসা থেকে উঠে দাঁড়ান;দু’হাতে নূরকে আগলে নিয়ে মাথায় চুমু দিতে থাকেন।
“আমায় সবাই ঠকিয়েছে ফুপ্পি। মামণি…মামণি আমায় ঠকিয়েছে। অর্ণব আমায় মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে ফুপ্পি। আমায় সবাই কষ্ট দিয়েছে ফুপ্পি।” ক্রন্দরত কণ্ঠে মারজানাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো অভিযোগ করতে থাকে নূর।

“বাবা আমায় কেন একা রেখে গেলেন ফুপ্পি?বলো না আমায়,কেন? এতো খারাপ আমি? ছোট বেলায় মা ফেলে চলে গেলেন;যাকে মায়ের আসনে বসালাম সে আমায় না জানিয়েই এমন এক পুরুষের সাথে বিয়ে দিলেন যার আগেও সংসার ছিলো; এক সন্তানের বাবা।”

নূরের কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লেন মারজানা। রাহেলা মেয়েটাকে এমন এক অথৈ সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে? এমন জঘন্য কাজ সে কি করে করলো?

“আমি তাও মেনে নিয়েছিলাম ফুপ্পি। অর্ণবের স্ত্রী, তার সন্তানের মা হয়ে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম আমি যেভাবে মায়ের আদর ছাড়া আমার শৈশবটা কাটিয়েছি এভাবে যেন অভ্রকে না কাটাতে হয়। সব তো ভালোই ছিলো ফুপ্পি,অর্ণব আমায় অনেক কেয়ার করতো।কখনো আমায় অবহেলা করতো না।কিন্তু বাচ্চা হওয়ার কথা শুনে অর্ণব কেমন পালটে গেল। ও বললো আমায় বাচ্চা ন*ষ্ট করতে নাহলে ওর সংসার ছেড়ে দিতে। আমার সন্তান হ*ত্যার থেকে ওর সংসার ছাড়া সহজ মনে হয়েছিলো ফুপ্পি,তাই আমি চলে এসেছি। সব ছেড়ে চলে এসেছি।”

মারজানা আর কিছু বললেন না। সবটা তার কাছে পানির মতো পরিষ্কার। কিন্তু অর্ণবের বাচ্চা নষ্ট করতে বলার বিষয়টা তার বোধগম্য হয়না। নূরকে আস্তে করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেন মারজানা। নূর তখনো ফুঁপিয়ে কান্না করেই যাচ্ছে। মারজানা নূরের মুখটা দু’হাতের আঁজলায় নিয়ে চোখের পানিটুকু মুছিয়ে দিলেন।

“অর্ণবকে জিজ্ঞেস করিসনি? কেন সে বাচ্চা চায়না?কেন তোকে এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করলো?”

নূর ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে জিজ্ঞেস করেনি অর্ণবকে। জিজ্ঞেস করার সুযোগই পায়নি;অর্ণব বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছে আগেই। আর তার ফিরে আসার আগে নূর বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে।
………..

অর্ণব আর তাসিন বেরিয়ে যাওয়ার পর সদরদরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে সোফায় গিয়ে বসেন রাহেলা।

“চলে গেছে?” এক মধ্যবয়স্কা রমণী বের হতে হতে জিজ্ঞেস করে।

“হ্যাঁ, চলে গেছে। তুই না লুকালেও পারতি। অর্ণব তোকে চেনে না।”

“ও না চিনলেও তো আমি চিনি।সকালে এসে একবার আমায় দেখে গেছে, এখন আবার দেখলে সন্দেহ করতে পারতো। আর কি বলে গেলো? নূর ওদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে?”

“হ্যাঁ, সেটাই তো বললো সকালে।এখন এসে জিজ্ঞেস করলো ফরিদপুরে আমাদের কোনো আত্মীয় আছে কিনা। নূর কি ফরিদপুর আছে?” উৎসুক চোখে অপর রমণীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে রাহেলা।

“মেয়েটা তাহলে মায়ের বর পেয়েছে বল? মায়েরও সংসার টিকলো না,মেয়েরও একই দশা।” বলেই কুটিল হাসি হাসলেন সেই রমণী।

“আমি আবার কবে সংসার ছাড়লাম?”

রাহেলার এমন কথার পিঠে রমণীটি বলে ওঠে, “তুই কি নূরের মা? তুই তো ওর সৎ-মা।”

রাহেলা মুখটা ভেঙচি দিয়ে বলে, ” পাকোড়া খা,ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

অত:পর দুই রমণী কোল্ড ড্রিংস এর গ্লাস হাতে নিয়ে পাকোড়া আর পপকর্ণ খেতে খেতে সিনেমা দেখতে থাকে।
……………

“অর্ণব? কথা হয়ে গেছে।উনি বলেছেন আমাদের সর্বোচ্চ সাহায্য করবেন। আমি বাসের টিকিট ও বুক করে নিয়েছি। সন্ধ্যা সাতটায় বাস;তুই বাসায় যা। একটু রেস্ট নে। আর পারলে দুই-তিন সেট কাপড় নিয়ে নিস।”

অর্ণব কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায় তাসিনের দিকে। অত:পর দু’জন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। তাসিনকে তার বাসায় ড্রপ করে নিজেও বাড়িতে যায়। রুমে গিয়ে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নেয় ব্যাগে।হাতমুখ ধুঁয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ফেলে।ফোনে ছয়টা পনেরো তে এলার্ম সেট করে চোখ বন্ধ করে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।

চলবে….

#নূরজাহানের_সংসার
পর্ব-৭
#শ্রীমতি_প্রজ্ঞা_মঞ্জরী (লেখিকা)

দুটো ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে মাঠের মাঝে খেলছে নূর। পড়নে নীল শিফন জর্জেট শাড়ি, হাতে নীল রেশমি।চুড়ি, কপালে ছোট্ট একটা টিপ। খোলা চুলগুলো বাতাসে খেলা করছে। বাচ্চা মেয়ে দু’টোর পড়নেও সাদা ফ্রক। কাঁধ ছুঁই-ছুঁই চুলগুলো দুই ঝুঁটি করে বেঁধে রাখা দু’জনেরই।
বাচ্চা মেয়ে দু’টো সবেই হাঁটতে শিখেছে। একটু হেঁটে আবার ধপাস করে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে।আবার উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে খেলছে।সামনের ছোট ছোট দাঁতগুলো দৃশ্যমান হয় হাসির তালে তালে।কি মিষ্টি দৃশ্য! হুট করেই নূর বলে ওঠে, “নূরানী, আস্তে মা।পড়ে যাচ্ছো বার বার। বোনকে দেখো কি সুন্দর হাঁটছে।”

মেয়েটা মায়ের কথা বুঝলো কিনে কে জানে? খিলখিলয়ে হেসে উঠলো সে। অর্ণব দূর থেকে দাঁড়িয়ে এই সুন্দর দৃশ্য অবলোকন করছিলো।মেয়েদের কোলে নেওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াবে এমন সময় সামনের দৃশ্য দেখে পা জোড়া থেমে যায় অর্ণবের।

কোনো এক অচেনা পুরুষ এসে নূরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে।নূরও আহ্লাদে আটখানা হয়ে লোকটার হাত আঁকড়ে ধরে আছে। লোকটা নূরের গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে মেয়েদের কাছে গেলো। মেয়েরাও আধো আধো বুলিতে “পাপা পাপা” বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকটার কোলে। নূর দাঁড়িয়ে দেখছে বাবা আর মেয়েদের ভালোবাসা। হঠাৎ হাতে টান লাগতেই ফিরে তাকায় নূর। অর্ণবকে দেখে কপাল কুচকে বলে ওঠে, “আরে…কে আপনি? অসভ্যের মতো হাত ধরে টানছেন কেন?”

নূরের এহেন কথায় অর্ণবের হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে যায়।নূর এই সুযোগে হাতটা ছাড়িয়ে নিজের স্বামীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। লোকটা এক হাতে আগলে নেয় নূরকে।

“নূর,আমি অর্ণব;তোমার স্বামী।এই মেয়ে দুটো আমার মেয়ে নূর। আমি ওদের বাবা। তুমি আমায় চিনতে অস্বীকার করছো নূরজাহান?”

“আপনি আমার স্বামী? কোন স্বামী? যে সত্য মিথ্যার যাচাই না করেই আমায় দোষারোপ করেছে সেই স্বামী? যে নিজের সন্তানদের হ*ত্যা করতে বলেছে সেই স্বামী?”

নূরের কথায় অর্ণবের মনটা ভেঙ্গে কয়েক টুকরায় পরিণত হয়। সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, “নূর… আমার নূরজাহান। ”

নূর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। অত:পর পাশের লোকটাকে দেখিয়ে বলে ওঠে,
“উনিই আমার স্বামী,আমার সন্তানদের বাবা।আমার আশ্রয়স্থল,আমার একমাত্র ভরসার স্থান;যাকে আমি অত্যন্ত ভালোবাসি এবং সম্মান করি।”

নূর অন্য কাউকে নিজের স্বামী বলছে,নিজের সন্তানদের পিতা বলছে। নূর নাকি তাকে ভালোবাসে! অর্ণবের পা দু’টো টলে উঠলো। আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে অর্ণব এবার কয়েক পা পিছিয়ে গেলো।

“আশা করি আপনি আপনার উত্তর পেয়ে গেছেন।এবার আমাকে আর বিরক্ত করবেন না মিস্টার অর্ণব।” বলেই একটা মেয়েকে কোলে নিলো নূর। নূরের হাসবেন্ড আরেকটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে উলটো দিকে ফিরে হাঁটা শুরু করলো।

অর্ণব ধপাস করে ঘাসের উপর বসে পড়লো।অশ্রু চোখে অস্পষ্টভাবে দেখছিলো নূরের চলে যাওয়ার দৃশ্য। নূর,নূরের স্বামী,সন্তান,নূরের সংসার যেখানে কোনো যায়গা নেই অর্ণবের। অর্ণব গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো।

এলার্মের শব্দে ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠলো অর্ণব। এটা কি স্বপ্ন ছিলো? এতো বাজে স্বপ্ন ও হয়? তার নূর তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে নিজের করে নিবে? অন্য কারো ঘরে হবে #নূরজাহানের_সংসার? অর্ণবের পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। ঘরে এসি চলছে তাও ঘামছে অর্ণব। নূরকে হারানো যে তার কাছে মৃত্যু-সমতুল্য তা আর অর্ণবের বুঝতে বাকি নেই।

অর্ণব বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ঘরে আসে। নিজেকে পরিপাটি করে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি ঘর থেকে। মুমতাহিনা চৌধুরীর ঘরে গিয়ে তার থেকে বিদায় নেয় অর্ণব। বের হওয়ার আগে বলে আসে,
“নিজের আর অভ্রর খেয়াল রাখবেন আম্মা। আমি নূরজাহানকে নিয়ে ফিরবো শীঘ্রই।”

…………..

নূরকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে।শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ না হলেও মানসিক ভাবে একটু সুস্থ বলে চলে। মারজানার কাছে সব বলার পরে নিজেকে অনেকটাই হালকা লাগছে নূরের। স্নেহার রুমের খাটের উপর পা মেলে আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো নূর। নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ফোনের চার্জ ফুরিয়ে বন্ধ হয়ে আছে। স্নেহার থেকে চার্জার নিয়ে ফোন চার্জে বসায় নূর। এমন সময় মারজানার আগমন ঘরে। নূরের জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছেন তিনি। কয়েক ধরনের ফল।

“নূর এদিকে আয়। নাস্তা করে নে।তারপর রেস্ট করবি।”
মারজানার কথায় আর টু-শব্দ না করে খেতে শুরু করে নূর। অর্ধেকটা খেয়ে বলে ওঠে, “আর পারবোনা ফুপ্পি।অনেকটা খেয়েছি।”

“অর্ধেক খেয়েছিস সবে।পুরোটা শেষ কর।”

“আর খেতে পারবোনা। দেখ, কেমন বমি বমি পাচ্ছে। জোর করে খেলে সব উগড়ে যাবে।”

নূরকে আর জোর করলেন না মারজানা। একটু সময় পর বলে উঠলেন, “অর্ণবের নাম্বার দে নূর।”

নূর চমকে উঠলো।”ওনার নাম্বার দিয়ে কি করবে ফুপ্পি?”

“দিতে বলেছি দিবি। আমার কথা আছ।”

“প্লিজ ফুপ্পি,আমি এখানে আছি ওনাকে জানিও না। উনি আবার আমায় অপমান করবেন।”

মারজানা হাত রাখলেন নূরের মাথায়। বললেন, “চিন্তা করিস না। আমি থাকতে কেউ তোকে কিচ্ছু বলবে না।কিন্তু আমার জানা দরকার কেন অর্ণব এমনটা করলো।”

নূর ভরসা পেলো। সে নিজের ফোনটা অন করে অর্ণবের নাম্বারটা বের করে দিলো মারজানাকে। মারজানা নাম্বারটা নিজের ফোনে সেভ করে নিলেন। নূরকে বিশ্রাম করতে বলে চলে গেলেন তিনি।

ডাইনিং এর উপর নূরের জন্য নিয়ে যাওয়া ফলের প্লেটটা রেখে মারজানা বলে উঠলেন, “এখানে রাহেলা কিছু একটা করেছেই। অর্ণবের সাথে আমায় কথা বলতে হবে। ভাইজান চিঠিতে যা লিখেছিলেন তা অর্ণবকে জানাতে হবে। নূরের সংসারটা নষ্ট হতে দিবোনা আমি।”

………..

ঢাকা থেকে ফরিদপুরগামী বাসে বসে আছে অর্ণব আর তাসিন। একটু তাদের আগেই বাস ছেড়েছে। তাসিন ফোনে কিছু একটা করছিলো, হঠাৎ কন্ট্রোলরুম থেকে তার কলিগ মিরাজের কল আসে। তাসিন ফোন রিসিভ করতেই মিরাজ বলে ওঠে,
“তাসিন? দুপুরে যেই নাম্বারটা দিলি ওটা আবার এক্তিভেট করা হয়েছে। লোকেশন ফরিদপুরের ঝিলটুলিতে দেখাচ্ছে। আরেকটু অপেক্ষা করলেই এক্সাক লোকেশন রোড নাম্বার সহ আমি তোকে দিতে পারবো।”

“থ্যাংকস ম্যান। আমার ওয়াটসএপে ফুল লোকেশন সেন্ট করে দে তাহলে।” বলেই কল কাটে তাসিন।

অর্ণব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাসিনের দিকে।

“ভাবীর লোকেশন ট্র‍্যাক করা গেছে।”

“কোথায় আছে নূর?কিভাবে জানলি?” প্রশ্ন করে অর্ণব।

“ফরিদপুরের ঝিলটুলিতে আছেন। আমার কলিগ ফুল লোকেশন পাঠাবে এখনি। যত সময় লাগবে ভেবেছিলাম; তার অর্ধেক সময়ের মধ্যে ভাবীকে খুঁজে পাবো আমরা।”

তাসিনের কথায় সন্তুষ্ট হয় অর্ণব। স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে মনে মনে বলে, “আমি আসছি নূরজাহান।”
……………

মারজানা নিজের ফোন থেকে কল দেয় অর্ণবের নাম্বারে। রিং হয়ে গেলেও অর্ণব ফোন তুলছেনা দেখে আরো কয়েকবার কল দেন মারজানা। কিন্তু ফলাফল শূণ্য। মারজানা হতাশা ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

সারা রুমে পায়চারি করছে নূর। মনটা অস্থির লাগছে তার কাছে। কিছু কি খারাপ হতে চলেছে? ফুপ্পি অর্ণবের নাম্বার নিয়ে গেলো।যদি অর্ণব এখানে চলে আসে? নূরকে যদি বাচ্চা এবরশন করতে জোর করে? না না সে কিছুতেই নিজের বাচ্চাদের নষ্ট করবেনা।প্রয়োজন হলে বাচ্চা হওয়ার পর সে অর্ণবকে ডিভোর্স দেবে। প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় ডিভোর্স কার্যকর হয়না। নিজের পেটে হাত রেখে নূর বলে ওঠে,
“মা তোদের কিছু হতে দেবেনা।তোদের বাবা যতই যা বলুক, আমি তোদের কষ্ট পেতে দিবো না কিছুতেই।”
…………….

রাত প্রায় দশটা। অর্ণব আর তাসিন ফরিদপুর বড় বাসস্টপেজ এ আছে। এখান থেকে অটো নিয়ে মিরাজের পাঠানো লোকেশনে যাবে তারা। অর্ণব পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করেই দেখে আননোন নাম্বার থেকে চারটা মিসড কল। ফোনটা সাইলেন্ট থাকার কারণে টের পায়নি অর্ণব। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কল হবে ভেবে আননোন নাম্বারটায় কল ব্যাক করে অর্ণব। কয়েকবার রিং হওয়ার পরেই ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ করে মেয়েলি গলায় কেউ বলে ওঠে,
“হ্যালো অর্ণব?”

“জ্বী আমি অর্ণব।আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।”

“আমি সম্পর্কে তোমার ফুফু শাশুড়ি হই। তোমার সাথে নূরের ব্যাপারে একটু কথা বলার ছিলো।”

অর্ণব কিছুটা অবাক হয়। তার জানা মতে নূরের বাবার কোনো ভাই বা বোন নেই। তাহলে ইনি কে?

“আমি এখন একটা কাজে ফরিদপুর এসেছি;বাড়িতে যেয়ে আপনাকে আমি কল ব্যাক করি?”

অর্ণবের কথায় মারজানা যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে গেলেন।
“আমার বাসা ঝিলটুলিতে, তুমি এসো আমার বাসায়। বিষয়টা খুবই আর্জেন্ট।”

ঝিলটুলিতে বাসা শুনে অর্ণব ভাবে, তাসিন বলেছিলো নূরের লাস্ট লোকেশন ঝিলটুলিতে। তার মানে কি নূর ওনার বাসায় আছে?
কয়েকটা শুকনো ঢোক গেলে অর্ণব।অত:পর বলে ওঠে, “নূর আপনার বাসায় আছে?”

অর্ণবের হার্টবিট তুঙ্গে।সে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে প্রার্থনা করছে ফোনের ওপাশ থেকে যেন উত্তর হ্যাঁ আসে।

“হ্যাঁ, নূর আমার বাসায় ই আছে।”

তৎক্ষণাৎ চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয় অর্ণব।তার বুকের ওপর থেকে যেন বড় কোনো পাথর নেমে গেছে। চোখ বন্ধ রেখেই বলে ওঠে, “লোকেশনটা বলুন, আমি আসছি।”

ওপাশ থেকে লোকেশন বলতেই অর্ণব ফোনটা কেটে দেয়।তাসিনকে বলে, “তোর ভাবী যার বাসায় আছে সে কল করেছিলো।নূরের লোকেশন কি *******?

তাসিন তৎক্ষণাৎ উত্তর করে, “হ্যাঁ এই লোকেশনই দিয়েছে মিরাজ।”

অর্ণব আর দেরি করে না।একটা অটো ঠিক করে তাসিনকে নিয়ে রওনা হয় মারজানার বাসার উদ্দেশ্যে।
……..

অর্ণবের সাথে কথা শেষে ফোনটা খাটের পাশে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন মারজানা। স্নেহা আর নূর শুয়ে পড়েছে। জার্নি করে আসায় স্নেহার আজ তাড়াতাড়ি ঘুম এসেছে। মারজানা একবার স্নেহার রুমে উঁকি দিয়ে দেখলেন মেয়েরা কি করে। অত:পর নিজের রুমে যেয়ে খাটের উপর বসে রইলেন। যেকোনো সময় অর্ণব আসবে,নূরকে সামলাতে হবে তার। নূরের সাথে যে অন্যায় হয়েছে তাতে অর্ণব নিজেও ষড়যন্ত্রের শিকার।কোনো না কোনো সমস্যা আছেই;আর সমস্যার মূল হোতা হিসেবে রাহেলার দিকেই প্রথম সন্দেহের তীরটা যায়।

নূর শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলো।হঠাৎ পানি পিপাসা পেলে শোয়া থেকে উঠে বসে নূর।পাশের টেবিলে ওয়াটার বোতলটা ফাঁকা পড়ে আছে দেখে বোতলটা হাতে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে আসে সে।জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে কিছুটা পানি খেয়ে নেয়,ফাঁকা বোতলটা ভরে ঘরের দিকে রওনা হবে এমন সময় বাসার কলিংবেল বেজে ওঠে। আশে-পাশে কেউ নেই দেখে নিজেই দরজা খুলতে এগোয় নূর।

অন্যদিকে মারজানা ও কলিংবেলের শব্দে নিজের রুম থেকে বের হন;বেরিয়ে দেখেন নূর ইতমধ্যেই দরজার কাছে পৌঁছে গেছে।

নূর দরজাটা খুলতেই সামনের লোকটাকে দেখে তার হাতটা আলগা হয়ে যায়। সদ্য পানি ভরে আনা বোতলটা মেঝেতে পড়ে যায় সশব্দে। সময়ের ব্যবধানেই নূর অবচেতন হয়ে পড়ে যেতে নিলে সামনে থাকা মানুষটা দু’হাতে আগলে নেয় নূরকে। নূরের মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রাখে। এরপর তাকে পাঁজাকোলে করে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে।

চলবে….