#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::১১
অম্বুর মাঝে চড়ের আঘাত অনুভব না হলেও তার গভীরতা ছিল ব্যাপক। শারীরিক ক্ষেত্রে কোনো রুপ প্রভাব না পড়লেও মানসিক ক্ষেত্রে ভেঙে দিয়েছিলো আয়াতকে। নিজেকে তৃষ্ণার কাছে ছোট মনে হচ্ছিল। তৃষ্ণার অনুমতি না নিয়ে তার হয়তো এমন কোনো কাজ করা উচিত হয়নি।
পুলের ভেতরে থেকে মাথা তুলে নত হয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকালো আয়াত। তখনও অনবরত বৃষ্টি হয়ে চলেছে। ওষ্ঠ যুগলের কামড়ে দীর্ঘক্ষণ আঁখি ঢেকে করুন সুরে বলল…
— “দুঃখিত তৃষ্ণা। আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি, তোমার খারাপ লাগবে। আমি আর কখনো পার্মিশন ছাড়া তোমার আশেপাশেও যাবো না। প্লীজ মন খারাপ করো না”।
আয়াতের শীতল কন্ঠে হুশে এলো তৃষ্ণার। নিজের কাজের জন্য কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। সে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিল, তাহলে কেন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। আয়াতকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার আগেই আয়াত শার্টের কলার টেনে ঠিক করতে করতে বললো..
— “তোমার নত হওয়ার দরকার নেই। তোমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে, সেটাই করেছ?
আজও তোমার মনে কোথাও না কোথাও রিজভী রয়ে গেছে। গভীরতম স্পর্শগুলো রিজভীর করার কথা ছিল। হয়তো, আজও তুমি আমার মাঝে তাকে খুঁজে বেড়াও। সত্যিটা কি জানো, আমি আয়াত। সারাজীবন আয়াত-ই থাকবো। রিজভী হতে চাই না, আর হতেও পারবো না”।
— “আসলে আপনি ভুল.
হাতের করতল দেখিয়ে থামিয়ে দিল তৃষ্ণাকে। ধীরে ধীরে পানির মাঝে হেঁটে পুলের কিনারে গিয়ে উঠে বসলো সে। পুলের দিকে মুখ করে পা দুলিয়ে বলল..
— “এখানে কোনো আসলে নকলে নেই, আর না তোমাকে ভুল বুঝছি তৃষ্ণা। বাড়ির ভেতরে যাও, ঠান্ডা লেগে যাবে”!
বাক্য উচ্চারণ করার সাহস হয়ে এলো না তৃষ্ণার ভেতরে। ওরনা দিয়ে শরীর পেঁচিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
তৃষ্ণার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসলো আয়াত। তৃষ্ণার প্রতি করা অভিমান-টাও সে বুঝলো না। এমন একজনকে ভালোবাসলো যাকে দেখার অধিকার নেই, ভালোবাসার অধিকার নেই, ছুঁয়ে দেখার অধিকার নেই। কারণ, সে অন্য আরেকজনের নেশায় নেশাক্ত। হয়তো এমনই হয়, নেশাক্ত শহর-গুলো।
টান টান হয়ে পুলের পাড়ে শুয়ে পড়লো সে। চোখ জোড়া সোজা মেঘলা আকাশের মাঝে বন্দী। বৃষ্টির ঝিরিঝিরি ধারা-গুলো ঠোঁটের সামান্য ফাঁক দিয়ে মুখে প্রবেশ করছে।
.
চোখ মেলতেই সূর্যের তীর্যক রশ্মিতে কুঁচকে এলো আয়াতের চোখ। মাথাটা কেমন ভাড়ভাড় হয়ে এসেছে। দুহাতে মাথা চেপে উঠে বসলো সে। প্রথমে পুল পাড়ে দেখে চমকালেও, পরক্ষণে কালকের কথা মাথায় আসতেই তব্ধ নিঃশ্বাস ছাড়ল। জামা কাপড় শরীরে শুকিয়ে আছে। শক্তিহীন শরীর নিয়ে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে।
রুমে প্রবেশ করতেই সবার প্রথমে তৃষ্ণার ঘুমন্ত মুখটা ভেসে উঠলো। তৃষ্ণা ফ্লোরে বসে, সোফায় মাথা রেখে, দরজার দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে আছে। হয়তো আয়াতের অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে গেছে। কালো রঙের থ্রী পিস-টা বেশ মানিয়েছে তৃষ্ণার গাঁয়ে। চুলের পানি মোছার অভাবে একত্রে ধলা পাকিয়ে আছে। না চাইতেও এগিয়ে গেল আয়াত। নিজের দেওয়া কথা ভেঙ্গে তৃষ্ণাকে অতি সাবধানে কোলে তুলে নিল। বেডের মাঝ বরাবর শুইয়ে দিল। পায়ের কাছে গুটিয়ে রাখা ব্যাঙ্কেট খানা টেনে গলার পর্যন্ত থেকে দিল তৃষ্ণার। কাবার্ড থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মনিকা আর তৃষ্ণার কন্ঠস্বর ভেসে এলো আয়াতের কানে। দু’জনের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে চুল মুছতে লাগলো সে। আয়াতের ধ্যান ভাঙল মনিকার কথায়..
— “আজকে তুই ইউ-কে যাচ্ছিস। কথাটা ভুলে গেছিস? ভালোভাবে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ নয়টা পঁচিশ বাজে। তোর ফ্লাইট বারোটা পঁয়তাল্লিশে। দুইবার তোকে খুঁজে গেছি, কোথায় ছিলিস তুই।”
খক খক করে কেশে উঠলো আয়াত। কালকের শোক দিবস পালন করতে গিয়ে সব ভুলে গেছে। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে দেয়াল ঘড়িটার দিকে দিল। টাওয়াল টা ছুঁয়ে ট্রলিটা বের করলো। চেইন খুলে বেডের উপর তুললো। কাবার্ড থেকে গোছালো জামা কাপড় গুলো ধরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে। তার ফলস্বরূপ গোছালো কাপড়গুলো অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি জিনিস নিখুঁত ভাবে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল..
— “মা খাবার সাজাও। আমি খেয়েই বেরিয়ে পড়লো। নাহলে ফ্লাইট মিস করবো”।
মনিকা শব্দহীন পায়ে দরজা পর্যন্ত গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো। দুজনকে কিছুক্ষন সূক্ষ্মভাবে পরিক্ষা করে আঁচল চেপে মৃদু হাসলে। কিছু একটা ভেবে বললেন..
— “আয়াত তুই চাইলে আরো দিন পরে যেতে পারিস। সবে বউমার সাথে তোর ভাব হলো আর এখনই চলে যাবি। আমি বরং তোর বাবার সাথে কথা বলছি”?
অবিশ্বাসের মলিন কন্ঠে আয়াত বলল..
–” মা, বাবাকে কিছু বলো না। আমি যাবো”।
মনিকা যেতেই পূর্ণরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আয়াত। তৃষ্ণা যেন আকাশ থেকে পড়ল। আয়াত কোথায় যাচ্ছে, সেটাই বুজতে পারছে না। পেছন থেকে শক্ত করে আয়াতকে জড়িয়ে ধরে হতাশাগ্রস্থ কন্ঠে বলল…
— “আপনি আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবেন”?
তৃষ্ণার কথা তীরের মতো এসে লাগল আয়াতের বুকে। মেয়েটার মলিন কন্ঠে ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে তৃষ্ণার দুগালে হাত রেখে বলতে, “তৃষ্ণা আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না”
কিন্তু বলা হলো না আয়াতের। তাকে যেতেই হবে। তৃষ্ণার কন্ঠস্বর মাদকতার মতো কাজ করছে, না জানি মুখের ভঙ্গিমা দেখতে পাগল হয়ে যাবে আয়াত। তৃষ্ণার হাত স্পর্শ করতে গিয়েও করলো না, বলল.
— “অনেকবার চেয়েও বলতে পারিনি”।
আয়াতের উত্তর মোটেও পছন্দ হলো না তৃষ্ণার। আয়াত আগে একবার যাওয়ার কথা বলেছিলো, কিন্তু কবে যাবে সেটা বলেনি।
— “বলতে পারেন নি তাহলে আমাকে ছেড়ে থাকবেন কিভাবে। প্লীজ যাবেন না”।
পেছনে না ফিরেই বলল.
— তৃষ্ণা আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না। আমার বুকের ভেতরে তোমাকে যত্ন করে নিয়ে যাচ্ছি।
________________________
আকাশের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলেছে। ছোট ছোট ছানাগুলো আগে আগে আর বড় বড় পাখিরা পিছু পিছু। তার থেকে অনেক উপর দিয়ে উড়ে চলেছে আয়াত। বাইরের প্রকৃতির পরিবেশ অনুভব করা না গেলেও অদ্ভুত এক অনুভূতির লুকিয়ে থাকে সবার মাঝে। আয়াতের মাঝে তেমন কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার কাছে এমন অনুভূতি নতুন কিছু নয় বরং বেশ পুরোনো। আগেও অনেকবার সে বিমানে চড়ে এদেশ থেকে সে-দেশে পাড়ি জমিয়েছে। তার নিশ্চুপ মনটা তৃষ্ণার কাছে রেখে এসেছে। শুধু দেহটাই বয়ে নিয়ে চলেছে অন্য-দেশে।
তৃষ্ণার সাথে শেষবার কথা হয়েছে দুঘন্টা আগে। একবারের জন্যও মুখটা দেখেনি সে। নিজেকে আর দূর্বল প্রমাণ করে কি লাভ, যদি ছেড়েই যেতে হয়।
জানালার ফাঁক দিয়ে ছোট ছোট ঘরবাড়ি গুলো ম্যাচের মতো লাগে। যেন উপর থেকে এক দৃশ্য আঁকা হয়েছে। ইচ্ছে করছে, সেই দৃশ্যের ভেতরে তৃষ্ণাকে নিয়ে থাকতে। ফোনটা বের করে স্কিনে জুম করে তৃষ্ণার নক কামড়ানো পিকটা দেখলো। পিকটা বেশ পুরনো। তৃষ্ণার সাথে পরিচয় হওয়ার পর তুলেছিল, আর ডিলেট করা হয়নি।
ভাবতে লাগলো সেই দিনগুলো কথা, যখন তৃষ্ণার সাথে তার পরিচয়।
ফ্ল্যাসব্যাক_______
পুরো শহর খুঁজে রক্ত জোগাড় করতে ব্যর্থ হলো আয়াত। বোনের হাসৌজ্জ্বল মুখটা তখন বারবার আয়াতের সামনে এসে হাজির হতো। নিজেকে অক্ষম মনে করে প্রাণমন অস্তিত্বহীন ভারী দেহটা নিয়ে হসপিটালের ফিরে গেল সে। কেবিনের সামনে সিটে বসতেই, ভেতর থেকে পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো। যেন এই কন্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায় রয়েছিল সে। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই বোনের মুখটা দেখে শব্দ করে কেঁদে দিল আয়াত। আয়াতের কান্নার শব্দে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলো সকলে। আরোহী স্যালাইন ক্যানেল একটানে খুলে আয়াতের দিকে ছুটে গেল। দুই ভাই বোনের কষ্টের সাথে কম্পিত হয়েছিল পুরো হসপিটাল।
বোনের অসুস্থতার জন্য রক্তের জোগাড়ের কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তার। দুদিন পর যখন জানতে পারল তৃষ্ণা নামক কোনো মেয়ে রক্ত দিয়েছিলো। তড়িঘড়ি করে হসপিটালের ছুটল মেয়েটার নাম, পরিচয় যোগার করতে। ছোট করে একটা ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য। মেয়েটার নাম পরিচয় জানতে ব্যর্থ হলো সে। বেশ কয়েকদিন পর একজন নার্সের কাছ থেকে জানতে পারল, মেয়েটি তাহসানের ছোট বোন।
সময় নষ্ট না করে ভার্সিটিতে গেল দেখা করতে। রাস্তায় ফ্লোয়ার সপ থেকে বড় সাইজের একটা বু-ফে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে ঘটালো অঘটন।
(চলবে)