নেশাক্ত তোর শহর পর্ব-১৩

0
772

#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৩

নিজের মন মত সাজতে ব্যস্ত তৃষ্ণা। হালকা লিপস্টিক আর কাজল দিয়ে আয়না সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে। মাঝে মাঝে লজ্জায় কুঁকড়ে উঠছে আবার মিটমিটে হাসছে। মাটি স্পর্শ করা লম্বা আঁচল তুলে মাথায় দিল। আচ্ছা তৃষ্ণার এমন বউ বউ সাজ আয়াতের কেমন লাগত। নিশ্চয়ই বলত, ” আমার মায়াবিনী পিয়াসু পাখি” চোখ বন্ধ করে হাসছে যেন আয়নাটা আয়াত। হঠাৎ-ই তার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে দিল কেউ। ধক করে চোখ খুলে পাশে তাকালো তৃষ্ণা। আয়াত তাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে আছে। খোঁপা করা লম্বা চুলের গোছা খুলে দিলো। চুলের খোঁপা খুলে দিতেই পুরো পিঠে ছড়িয়ে পড়লো চুলোগুলো। কাঁধের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিল আয়াত। গভীর ভাবে মুখ গুঁজে দিল তৃষ্ণার গলায়। কম্পিত হলো তৃষ্ণা। গভীর সেই অনুভূতি। আয়াতের জড়িয়ে ধরা হাতাটার উপর নিজের হাত রাখল। অক্ষিযুগল বন্দি তখন আয়াতে প্রতিচ্ছবি আয়নার মাঝে। এখন পর্যন্ত একবারও আয়াতের মুখশ্রী দর্শক করে নি সে। আয়নাতে তার প্রতিচ্ছবি দেখছে। হুট করে আয়াতের দিকে ফিরিয়ে নিল তৃষ্ণাকে। আচম্বিতে এমন ধাক্কার জন্য প্রস্তত ছিল না তৃষ্ণা। বিধায় হাত গিয়ে ঠেকলো আয়াতের বাহুতে। আয়াত হাত তখনও শাড়ি বেধ করে তৃষ্ণার পেট স্পর্শ করেছে। হাত সরিয়ে কপালের উপর চুলগুলো স্বযত্নে সরিয়ে দিয়ে বলল..

— “পিয়াসু পাখি। তুমি জানো তোমাকে এই রুপে কতোটা সুন্দর লাগছে। তোমার এই মুগ্ধ কর রুপে আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে নিঃশ্ব হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করতে তোমরা এই অপূর্ব সুন্দর সাজটা নষ্ট করতে। কি বলো তুমি করবো”।

লজ্জার্থ তৃষ্ণার মুখটা আমাদের বুকে গুজে নিল। বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে আয়াতের দিকে তাকালো। আয়াত দৃষ্টি তার মুখের মাঝে স্থীর হয়ে আছে। আয়াতের কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে গেল সে। পায়ের পাতার উপর ভর করে সামান্য উচ্চতা বৃদ্ধি করলো। আয়াতের সমান হওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। চোখ বন্ধ করে অধর স্পর্শ করার আগেই ফোন বেজে উঠল। বিরক্তিতে শরীরের পেশি শিথিল হয়ে গেল তার। ইচ্ছে করছে ফোনটা ভেঙ্গে ফেলতে। বাজতে বাজতে কেটে গেল ফোন। পূর্ণরায় ফোন বাজতেই কপালে বিরক্তিকর ভাব ফুটে উঠলো তৃষ্ণার। রিসিভ না করলে বাজতেই থাকবে।
সময় অবিলম্ব না করে দ্রুত ফোনের দিকে এগিয়ে গেল। স্কিনে ভাই লেখা দেখেই কপাল কুঁচকে গেল। ভড় সন্ধ্যায় তাহসান কেন ফোন করেছে। কৌতূহল দমাতে না পেরে তট জলদি ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরলো। হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে তিশার কন্ঠস্বর ভেসে এলো.

— “বোনু! আমি হসপিটালে এডমিট আছি। একবার আসবি। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোকে”।

আর কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেলো। তৃষ্ণা কানে কাছে কিছুক্ষন হ্যালো হ্যালো করে রেখে দিল। হঠাৎ বোনের কি এমন হলো যে, হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। একরাশ অভিমান জমে আছে তার উপর। বোনের জন্য আজ তার জীবনটা ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল।
রিজভীর সাথে তার বিয়ে হয়নি। স্বপ্নটা ভেঙে গেছে, এটাই হয়তো তার বিধান ছিল। আল্লাহ জোড়ায় জোড়ায় মানুষ সৃষ্টি করছে আর তার জোড়া আয়াত। রিজভীর অবহেলা থেকেই আয়াতকে পেরেছে। তবুও সে বেঁচেছে। কারণ কেউ কারো জন্য মরে যায় না। কিন্তু আয়াত যদি তৃষ্ণাকে অস্বীকার করে, তাহলে হয়তো এবার আয়াতের শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে না। রিজভী ছিল তৃষ্ণার জীবন আর আয়াত অক্সিজেন। যাকে ছাড়া তৃষ্ণার অস্তিত্ব নেই। বিগত মাসেই সে বুঝতে পেরেছে।

আশেপাশে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো তৃষ্ণা। আয়াত রুমের কোথাও নেই। বেলকেনি, ওয়াশরুমে দেখে বেডের উপর বসে পড়লো। আবার সে স্বপ্ন দেখেছে। কল্পনা করেছে আয়াতকে। তব্ধ নিঃশ্বাস ছেড়ে পার্স ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো হসপিটালে উদ্দেশ্য।

_______________________
হসপিটালের করিডোরে পায়চারী করছে তাহসান। তার পাশেই বসে আছে শান্তি, রিজভী ও-তার পরিবার। করিডোরে সবাইকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল তৃষ্ণা। ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল..

— “ভাইয়া আপু কোথায়? কি হয়েছে ওর”?

দৃষ্টি সরিয়ে সবাই তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কারো মুখে কথা নেই । কেবিনের ভেতরে ইশারা করে বললেন..

— “তিশা কেবিনের ভেতরে আছে। বিকেলের দিকে পেইন ওঠায় হসপিটালে আনার হয়েছে। রক্তস্বল্পতায় ভূগছে। ডাক্তার সিজারিয়ানের আয়োজন করছে। একটু পর ওকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে। টেনশনে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে”।

তাহসানের কথা শেষ হওয়ার আগেই রিজভী এসে তৃষ্ণার সামনে দাঁড়ালো। দুহাত জোর করে হাঁটু ভাঁজ করে তৃষ্ণার সামনে বসে পড়লো। অপরাধী কন্ঠে বলল.

— “আমি জানি তৃষ্ণা। আমি অন্যায় করেছি, অনেক বড় অন্যায় করেছি। শুধু তোমার সাথেই নয় তিশার সাথেও করেছি। তোমাকে হারানোর শাস্তি আমি তিশাকে দিয়েছে, তার জন্য আমি অনুতপ্ত।
আমি চাইনা, আমার ভুলের জন্য তিশাকে হারাতে। আমি জানি, আমাদের প্রতি তোমার কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ এমন শাস্তি দিয়েছে। তার ফলস্বরূপ আমি তিশাকে হারিয়ে ফেলতে বসেছি। তিশা ছোট থেকে তোমাকে মায়ের মতো ভালোবেসে বড় করেছে! কখনো তোমার উপর আঘাত আসতে দেয়নি। আঙ্কেল আন্টির মৃত্যুর পর তোমার সব দায়িত্ব নিয়েছে। সন্তান ভুল করলে মা যেমন ক্ষমা করে দেয়। মা তেমন ভুল করলে সন্তানের-ও তো ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। আমি দেখছে তিশাকে সারারাত জেগে কাঁদতে। ঘুমের মাঝে তৃষ্ণা তৃষ্ণা বলে কেঁদে উঠতেই।
তুমি প্লীজ তিশাকে ক্ষমা করে দাও। প্লীজ তৃষ্ণা”।

বলতে বলতে তৃষ্ণার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লো রিজভী। অনুসূচনায় স্তব্ধ হয়ে গেল তৃষ্ণা। রিজভী একটিও বাজে কথা বলেনি। তিশা তৃষ্ণার সব ভুল ক্ষমা করে দিয়েছে। আজও সেই সামান্য একটা আঘাত নিয়ে তিশাকে ক্ষমা করতে পারেনি।

ছলছল করে উঠলো তৃষ্ণার নেত্রজোড়া। কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। তিশাকে তখন ড্রেস পড়িয়ে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে তিশার দিকে এগিয়ে গেল। অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নিল। মুখে মিথ্যা হাসির রেখা ফুটিয়ে এগিয়ে গেল। হালকা ঝুঁকে মাথায় চুমু খেল। চোখের কোণে কালি জমে গেছে, চেহারা কেমন হয়েছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। পেটের উপর হাত বুলিয়ে উচ্ছাসের স্বরে বলল..
— “শুনলাম মাম্মাকে না-কি খুব জ্বালাচ্ছিস তুই। মাম্মা বুঝি ব্যাথা পায়না।(তিশার পেটের উপর মাথা রেখে) কি বললি? তোর ভেতরে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। আর একটু সময় সোনা। তারপর তুই আমাদের কাছে চলে আসবি। আমরা একসাথে ইলিশ মাছ চুরি করবো। হা হা হা”।

কারো কন্ঠস্বর শুনে বেষ্টিত নয়নজোড়া খুলে তাকালো তিশা। পেছনে থেকে কালো শাড়ি পরিধিতা একটা মেয়েটাকে পেটের উপর ঝুঁকে থাকতে দেখে চাঁপা হাসলো সে। তিশা খুব ভালো করেই জানে, এটা তার ছোট বোন তৃষ্ণা। তৃষ্ণার মাথায় হাত রেখে উঠে বসতে চাইলে ধমক দিয়ে শুইয়ে দিলো সে। বাচ্চামো করে বলল..

— “আমার চিন্তায় চোখের নিচে কালি জমিয়ে ফেলেছিস দেখছি। এই কাজল বিক্রি করে পুচকু-কে মানুষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস না-কি?
আমি পুচকু-কে চুরি করা শেখাবো। তারপর বিক্রি করে পুচকু মানুষ হবে। বুঝলি”।

নাক টেনে দিল তৃষ্ণা। তৃষ্ণার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মনের তৃষ্ণা দূর করছে তিশা। কতোদিন পরে বোনটাকে হাসতে দেখছে। হাতটা নিজের হাতে বন্দী করে আলতো হেসে বলল..

— “আমি তোর এতোবড় ক্ষতি করলাম; তুই রেগে নেই আমার উপর”।

— “এতো গুলো ধন্যবাদ তোকে আপি; আয়াতকে আমার জীবনের এনে দেওয়ার জন্য। ভাবছিল, তোকে কেন ধন্যবাদ দিচ্ছি। আয়াত আমার জীবনে আসার জন্য একমাত্র কারণ তুই। রিজভী আমার জীবন থেকে গেছে বলেই আয়াত এসেছে। প্রথমে হয়তো রিজভীর শূন্যতা অনুভব করেছি কিন্তু পরে আয়াত অনুভব করতে দেয় নি। আয়াতের পাগলামিতে অতিষ্ঠ করে রেখেছে। এখন আমি আয়াতের নেশায় নেশাক্ত। রিজভীর নয়”।

অজানা হাসি ফুটে উঠল তিশার মুখে। তার বোনটাকে আয়াত নামক ছেলেটা ভালো রেখেছে, এতেই সন্তুষ্ট সে। কখনো আয়াতের সাথে দেখা হলে, অসংখ্য ধন্যবাদ জানাবে তাকে। অন্তত তার বোনটাকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্য।

বাইরে থেকে দুই-বোনের ভালোবাসা দেখে তৃপ্তিকর হাসি হাসলো তাহসান। কতো গুলো দিন পর এক সাথে দুই বোন হাসছে। বুকের মাঝে অজানা স্রোত বয়ে গেল তার।

(চলবে)