নোলককন্যা পর্ব-০৩

0
46

তৃতীয় পর্ব
#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী

সকালের ঝলমলে আলোয় চারদিক চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে বেলা অনেকখানি গড়িয়ে গেছে, অথচ ঘড়ির কাটা তখনো আট এর ঘর ছুঁইছুঁই। চুপকথার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা। মেইনরোড দিয়ে ব্যস্ত যানবাহন সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে। আদ্রিকা কাঁচুমাচু করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও একটা রিক্সা থামাতে পারেনি। মূলত সে চাচ্ছিলো কোনো রিক্সাচালক তাকে দেখে নিজেই জিজ্ঞাসা করুক, আদ্রিকা কোথাও যাবে কিনা? তাহলে আদ্রিকা শুধু স্কুলের নামটা বললেই স্কুলের গেটে নামিয়ে দিয়ে আসবে। বাড়ি থেকে স্কুল পায়ে হেঁটে দশ মিনিটের পথ। বাজার পেরিয়ে স্কুলে যেতে হয়। আদ্রতা সারারাত জ্বরে কাতরিয়েছে। সকালের দিকে জ্বর কমলেও শরীর ভীষণ দুর্বল। নীহার তাকে ভার্সিটি যেতে বারণ করেছে। কিন্তু আদ্রিকার ক্লাস সবে শুরু হওয়ায় তার, কলেজ মিস দেওয়া সম্ভব নয়৷ তবুও আদ্রিকা একবার বলেছিলো, সেও আজকে যাবে না। তাই নিয়ে নীহার বেশ বকাঝকা করে কলেজের জন্য বের হতে বলেছে। অথচ আদ্রিকা বাড়ির গেটের সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। মন চাইছে একছুটে আদ্রতার কাছে চলে যেতে।

বাজারের দিক হতে মোকাররম নার্সারির দিকে আসছিলো, বাড়ির গেটের সামনে আদ্রিকাকে দেখে এগিয়ে এলো। বাজারের পাশে মেইনরোডের সাথেই বাড়ি হওয়ায় বাড়ি থেকেই নার্সারির ব্যবসা সামলায়। রাস্তার সাথে বাড়ির বাইরের দেয়াল ঘেষে সারি করে নার্সারির গাছগুলো রাখা আছে। তাই মোকাররম বেশিরভাগ সময় বাজার এবং বাড়ির আশেপাশেই থাকে। বাবাকে দেখে আদ্রিকার সকল ভয় কেটে গেলো। যদিও বাবার সাথে সখ্যতা নেই বললেই চলে। তবুও বাবা আশেপাশে থাকলেই নির্ভরতা খুঁজে পায়। মোকাররম মজুমদার মেয়েকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিকটা ক্ষিপ্ত হলো। মেয়ে দুটোকে নিয়ে তার কোনো চিন্তাভাবনা না থাকলেও তাদের জন্য নিজের সম্মানে তিল পরিমাণ আঁচ যাতে না লাগে সে ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকে। এমনিতেই উঠতি বয়সের দুটো মেয়ে, সবসময় চোখে চোখে রাখতেও পারে না। বাজারের উপরেই বাড়ি, চারিদিকে কতো লোকজন! কে কখন ক্ষতি করার জন্য ওত পেতে থাকে, বলা তো যায় না। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– সকালবেলা রাস্তার মধ্যে এমন দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

– কলেজ যাবো, আব্বু।

– কলেজ যাবি তো যা। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লোকজনকে চেহারা না দেখালে হচ্ছে না।

ভীতু মনটা তিক্ত কথায় আরও বিষাদে ভরে গেলো। আদ্রিকার মনের অবস্থা কেউ বুঝার চেষ্টাই করছে না। আদ্রিকা কখনো একা চলাচল করে নি, আজকে হঠাৎ এভাবে রাস্তায় একা ছেড়ে দিলে সে কীভাবে চলবে? এই সামান্য কথাটি মা নিজেও বুঝতে চাইছে না। এদিকে বাবার থেকে কিছু আশা করাই বোকামি। তবুও উপায় না পেয়ে আদ্রিকা আমতা আমতা করে বললো,

– রিক্সার অপেক্ষা করছি।

– দুই কদম হাঁটলেই কলেজ! এইটুকু রাস্তা রিক্সায় যাইতে হবে? নবাবের বংশধর নাকি তোদের? হেঁটে হেঁটে চলে যা। রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটবি। মাথা নিচু করে কলেজ যাবি, মাথা নিচু করেই আসবি।

– প্রতিদিন তো হেঁটে যাই। আজকে একা যাবো তো। দেও না একটা রিক্সা ডেকে।

– একা যাবি কেন? আদ্রতা কই?

– আপুর তো জ্বর।

– কমে নাই এখনো?

– নাহ।

– নবাবি শরীর তোদের। ঔষধ ছাড়া সামান্য জ্বরও সাড়ে না। আমার টাকা খরচ না করা পর্যন্ত তোদের শান্তি নাই।

মোকাররম মজুমদার রাস্তার ওপরপাশ হতে একটি রিক্সা নিয়ে এলো। আদ্রিকা রিক্সায় উঠে বসতেই রিক্সার হুক তুলে দিলো, যা রোদ পরেছে। রিক্সাচালক প্যাটেল ঘুরাতেই মোকাররম কি মনে করে যেনো আবার রিক্সা থামিয়ে ভাড়াটাও দিয়ে দিলো। তারপর হনহন করে নার্সারিতে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পরলো।

বাবার হাজার খারাপ আচরণের মাঝেও ছোট্ট একটি কাজ সন্তানের মন ভালো করে দেয়। মুহুর্তেই সব অভিযোগ ভুলে মনে হয় আমার বাবা-ই সেরা বাবা। আদ্রিকার ক্ষেত্রেও তা একইরকম। হুক তুলে দেওয়া, ভাড়া মিটিয়ে দেওয়া- মোকাররম এর সামান্য কেয়ার আদ্রিকার মন ফুরফুরে করে দিয়েছে। অকারণ মুখে হাসি লেপ্টে আছে। এতোক্ষণের অস্বস্তি, ভয় একনিমিশেই উড়ে গেছে। তবে সেই মনের ফুরফুরে ভাব স্থায়িত্বকাল খুব বেশি হলো না। একা রিকশায় বসে পুরনো একটা ভয় জেগে উঠলো। মাসখানিক ধরেই আদ্রিকার মনে হচ্ছিলো কেউ তাকে ফলো করছে। রাস্তাঘাটে কিংবা কলেজে নয়, বরং তার বাড়ির সামনেই ঘটে এমন ঘটনা। মূলত একতলার ছাদের বাগানটিতে সকাল-সন্ধ্যা পানি দেওয়া, গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দেওয়া কিংবা গাছের ডালপালা ছেঁটে দেওয়া- বাগান পরিচর্যার কাজটি আদ্রিকা নিজেই করে। এই কাজটি কেউ তার উপর চাপিয়ে দেয়নি, বরং সে নিজ উৎসাহে কাজটি করে। তার আগ্রহ দেখে বাড়ির অন্য সদস্যরা তাকে বাঁধা দেয়নি। তবে ছাদে উঠা-নামা নিয়ে নীহার কিছু নিয়ম পালনের আদেশ জারি করেছেন। আদ্রিকা ফজরের নামাজের পর একবার ছাদে আসে, আরেকবার আসে বিকালবেলা। মাগরীবের আযান দেওয়ার পরপরই ছাদ থেকে নেমে যায়। প্রথম যেদিন আদ্রিকা তার উপর নজরদারীর বিষয়টি খেয়াল করেছিলো, সেদিন মাগরীবের কিছুক্ষণ আগেই আদ্রিকা ছাদে এলো। এসএসসির পর বাড়িতে অলস সময় কাটাতে হচ্ছিলো। আত্মীয়ের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া বাবার পছন্দ নয়। জোর করে নানুবাড়ি গেলে আবার বাড়িতে ফেরার পর বিশাল ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। তাই বছরের দু একবার যাওয়া হয় আরকি। আদ্রিকার সময় কাটতো টিভি দেখে, বই পড়ে কিংবা ঘুমিয়ে। অলস দুপুরের ভাত খাওয়ার পর উপন্যাস পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পরেছিলো। ঘুম ভাঙ্গতেই দৌড়ে ছাদে উঠে গাছগুলোতে পানি দেওয়ার একসময় বাড়ির সামনের রাস্তায় চোখ পরতেই দেখলো, একটি পালসার ওয়ান ফিফটি বাইক। বাইক চালকের মাথায় কুচকুচে কালো হেলমেট থাকায় চেহারা দেখা যাচ্ছিলো না, তবে তার দৃষ্টি যে আদ্রিকার দিকেই নিবদ্ধ ছিলো তা একনজর তাকালেই বুঝা যায়। বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে , বাইক চালক অনেকক্ষণ যাবৎ এখানেই অবস্থান করছেন। বেশ শান্ত এবং আরামদায়কভাবেই বাইকের উপর বসে আছে, যেনো ফেরার কোনো তাড়া নেই। তবুও আদ্রিকা নিজের মনকে বুঝালো, এটি তার সন্দেহবাতিক মনের ভুল ধারণা। দ্রুত হাত চালিয়ে সবগুলো গাছে পানি দেওয়া শেষ করার আগেই চারদিক মাগরীবের আজানের ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। ভাগ্য ভালো ছিলো তাই ঘর ছাড়ার সময় বুদ্ধি করে আদ্রতার বড় ওড়নাটা সাথে নিয়ে এসেছিলো। সে ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা থাকায় আরও কিছুক্ষণ ছাদে অবস্থান করার সম্ভব হলো। সন্ধ্যায় ছাদে আসার জন্য নীহারের দেওয়া নির্দেশের একটি হচ্ছে মাথায় কাপড় থাকতে হবে। সন্ধ্যাবেলা অশরীরীদের আনাগোণা বেড়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্ক নারী এবং তাদের চুলের দিকে তাদের নজর থাকে প্রখর। নীহার আধুনিকা হলেও মেয়েদের ব্যাপারে কোনো রিস্ক নিতে চায় না। তাই সকল নিয়মকানুন মেনে চলার চেষ্টা করে। আজানের পর থেকেই নীহার অনবরত ডাকে আদ্রিকা দ্রুত কাজ শেষ করে ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার মুহুর্তে আরেকবার রাস্তার দিকে তাকাতেই শিহরে উঠলো। পালসার ওয়ান ফিফটি বাইকটি তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে। বাইকচালকের দৃষ্টি আদ্রিকার দিকেই, আদ্রিকার মনে হচ্ছিলো সময় থমকে গেছে। তা না হলে বাইকচালককে এখনো সেই আগের মতোই সেখানেই কেনো দেখতে পাচ্ছে? ভীতু আদ্রিকা সেদিন ছাদ থেকে প্রাণপণে ছুটে পালিয়েছিলো। ছাদে তার আসা যাওয়া বন্ধ হওয়ার ভয়ে সেদিনের ঘটনা কাউকে জানায়নি৷ প্রাণপ্রিয় বড়বোন আদ্রতাকেও নয়। আদ্রতা ছোটবোনকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তিত থাকে৷ আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করে আগাম সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে৷ দেখা যাবে, ছাদ পরিচর্যার কাজটিও সে নিজের ঘাড়ে তুলে নিবে। কিন্তু আদ্রিকা তো এই কাজটি হারাতে চায় না। গাছগুলোর সাথে তার সখ্যতা অনেকদিনের। বন্ধুবিহীন জীবনে তারাই যেনো আদ্রিকার বন্ধু। সেদিনের পর প্রায়ই বাইকচালককে আদ্রিকার বাড়ির সামনের রাস্তায় দেখা যায়। কখনো ভোরের দিকে, আবার কখনো সন্ধ্যা নামার পূর্বমুহুর্তে। আদ্রিকা ভেবে পায় না, এই মানুষটি তার ছাদে আসার শিডিউল কীভাবে পেলো? ওই দূর সড়ক হতেই কেনো তাকিয়ে থাকতে হবে? স্কুলে বান্ধবীদের মুখে রাস্তায় কিংবা স্কুলের সামনে ছেলে বন্ধুদের আনাগোনার গল্প শুনেছিলো। অনেকে এসব গল্প বেশ অহংকারের সাথে বলতো আবার অনেকে ভয় কিংবা লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে। তখন কলেজের যাত্রা শুরু না হওয়ায় বাড়ির বাইরে তেমন যাতায়াত হতো না। কিন্তু সপ্তাহ খানিক ধরে আদ্রিকার কলেজ শুরু হয়েছে। সেইসাথে শুরু হয়েছে ভয়ের রাজ্যে বসবাস। বাইকচালক যদি আদ্রিকার পিছু নেই, সেই খবর যদি বাবার কানে যায় তাহলে বাড়িতে প্রলয় শুরু হয়ে যাবে। পুরোটা রাস্তা আতংকে কাটিয়ে অবশেষে ভূবনভোলা একাডেমির গেটে নেমে পরলো।

ভূবনভোলা একাডেমির ইতিহাস আরেকটু বিস্তৃত। সে গল্প আরেকদিন বলা যাবে। আপাতত আদ্রিকার চক্ষু চড়কগাছ বিস্ময়কে দেখে। ভূবনভোলা একাডেমির কলেজ সেকশনের জন্য বরাদ্দ গেটের সামনেই সে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিকাকে দেখে বেশ স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে এলো, যেনো তার এখানে অপেক্ষা করার কথা ছিলো। আদ্রিকার সামনে এসেই জিজ্ঞাসা বললো,

– তোর ক্লাস না আটটায়? ঘড়ি দেখেছিস কটা বাজে?

আদ্রিকার হাতে ঘড়ি নেই। তাড়াহুড়ায় না জানি আর কি কি ফেলে এসেছে! আদ্রতা সবকিছু গুছিয়ে না দিলে এভাবেই হেনস্তার স্বীকার হতে হয়। নিজের বাম হাত দেখিয়ে আদ্রিকা বললো, তার কাছে ঘড়ি নেই। বিস্ময় নিজের হাত ঘড়ি দেখিয়ে বললো,

– আটটা দশ বাজে। কলেজ সবে শুরু হলো, এখনি এমন ফাঁকিবাজি। নিকট ভবিষ্যতে তুই তো ক্লাস বাঙ্ক দেওয়ায় সেরা ছাত্রী নির্বাচিত হবি।

– আপু অসুস্থ তাই একা আসতে একটু দেরী হলো।

– গতকাল যে বললি আদ্রতার জ্বর, তা এখনো আছে! ঔষধপত্র কিছু খাচ্ছে তো নাকি? চল, চল তোকে ক্লাসে দিয়ে আসি। এখন একা গেলে ক্লাসটিচারের বকা খাবি নিশ্চিত।

গতকালের প্রসঙ্গ আসতেই আদ্রিকা কেমন অস্বস্তিতে গাট হয়ে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস বিস্ময় নিজেই ক্লাসে যাওয়ার তাড়া দিলো। কলেজের গেটে বিস্ময়কে দেখেই গতকাল মনতরীর চরে কাটানো সময়ের কথা মনে পরেছিলো। বিস্ময়ের পাগলামির কথা ভাবতেই একদফা আতঙ্ক এসে জুড়ে বসা স্বাভাবিক। কিন্তু সেসব প্রসঙ্গ না তুলে বিস্ময় খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে, যেনো গতকাল কিছুই ঘটেনি। বিস্ময়ের প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতাবোধ এবং কিছুটা স্বস্তি নিয়ে তার থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে পিছু পিছু চললো ক্লাসের দিকে। বিস্ময় না থাকলে প্রথমদিনই সহপাঠীদের সামনে বিশ্রীভাবে অপমানিত হতে হতো! ভাগ্যিস বিস্ময় ভাই কলেজ গেটে অপেক্ষা করেছিলো।

(চলবে..)