নোলককন্যা পর্ব-০৪

0
42

#নোলককন্যা
চতুর্থ পর্ব
#অক্ষরময়ী

পরপর তিনটে ক্লাসের পর টিফিন পিরিয়ডে স্টুডেন্টরা যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। নিজেদের মতো হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠে। কিন্তু আজ টিফিন পিরিয়ডে ফাস্ট ইয়ারের এ-সেকশন একটু বেশি উৎতপ্ত। হাতেগোণা কয়েকজন ক্যান্টিনে খেতে গিয়েছে, বাকিরা সবাই লাস্টবেঞ্চে বসে থাকা একজন মেয়েকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
আদ্রিকা সহজে কারো সাথে মিশতে পারে না, তার উপর কলেজ শুরু হয়েছে সবে সপ্তাহখানিক। তাই কারো সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। প্রতিদিন ক্লাসে সর্বশেষ বেঞ্চে একাই বসে ক্লাস করে, একাই ক্যান্টিনে গিয়ে হালকা কিছু নাস্তা খেয়ে আসে, ছুটির ঘন্টা পরা মাত্রই দ্রুততার সাথে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে যায়। এই ছিলো আদ্রিকার রুটিন। এতোদিন কেউ তাকে বিরক্ত না করলেও আজ কীভাবে যেনো সবার নজরে পরে গিয়েছে। ক্লাসে শুরু থেকেই কয়েকজন মেয়ে তার দিকে বারবার ফিরে তাকাচ্ছিলো, নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিলো। তাদের কথোপকথন শোনা না গেলেও তারা যে আদ্রিকার বিষয়ে কথা বলছে এবং তাকে নিয়েই হাসাহাসি করছে – তা তাদের আচরণে স্পষ্ট। পুরোটা সময় আদ্রিকা দেখেও না দেখার ভাণ করে গেছে। টিফিন পিরিয়ডে ক্যান্টিনে যাওয়ার উদ্দেশ্য বের হতেই যাচ্ছিলো মেয়েগুলো নিজেই পথ আটকায়। তার বেঞ্চের ওপরপাশের সীটবেঞ্চে তারদিকে মুখ করে বসে। আদ্রিকার পরিচয়, স্কুলের নাম, বাড়ির ঠিকানা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করার মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা শুরু করলেও পরবর্তীতে তা সীমা ছাড়িয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দিকে চলে যায়। মেয়েগুলোর উগ্রতা এবং অসুস্থ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ আদ্রিকাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। সে কোনোদিকে না তাকিয়ে মাথা নিঁচু করে বসে আছে। মনোযোগ অন্যদিকে করার চেষ্টা করছে, যাতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক জনতার কোনো কথাই তার কর্ণগোচর না হয়৷ কিন্তু তার নিস্তব্ধতা সবাইকে আরও উৎসাহী করে তুলেছে। ক্লাসে সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি রিপা। সে আদ্রিকার নত মুখটা এক হাতে উঁচু করে ধরে বললো,
– এটা কী নতুন ফ্যাশন নাকি? কি রে তোরা কেউ ট্রাই করবি নাকি?

পেছনে থেকে ছেলে মেয়ের উচ্চস্বরে হাসি ভেসে এলো। কেউ একজন বললো-
– নতুন ফ্যাশন হতে যাবে কেনো রে! এটা তো সেই আদিকালের মানুষজন পড়তো। এই মেয়ে দেখি এখনো সেই মানধাতা আমলেই পরে আছে।
– এটা মানুষও পরতো! আমি তো জানি গরুর নাকে পরানো হয়। গতবার কুরবানির ঈদে যখন গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন দেখলাম একটা গরুর নাকে পরানো। গ্রামের লোকেরা কী যেনো নাম বলেছিলো? ওহ হ্যাঁ, মনে পরেছে। গ্রাম্যভাষায় ‘নাখোয়ান’ বলে।
– আমাদের দাদুবাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ওখানের মানুষেরা বলে নাথ।
– কোন গরুর নাকে এভাবে দড়ি পরানো হয় জানিস? যে গরুগুলো খুব দুষ্ট হয়, কোনোভাবেই বাগে আনা যায় না তাদের নাক ফুটিয়ে দড়ি পরানো হয়। এতে গরু শান্ত হয়ে যায়। তো আদ্রিকা, তোর নাকে এমন দড়ি পরানো হয়েছে কেনো? এদিক ওদিক তেড়ে বেরিয়েছিস নাকি?

সময়ের সাথে ভীড় আরও বাড়ছে, সেই সাথে সবার হাসিতামাশাও। রিপা মেয়েটা আদ্রিকার নাকের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
– তোর নাকের এই দড়িটা ধরে টানলে তুইও কি গরুর মতো পিছে পিছে চলে আসবি৷ দ্বারা, ট্রাই করে দেখি।

আদ্রিকা একবার ডানে মাথা ঘুরায় আরেকবার বামে। সামনে এগিয়ে আসছে রিপার হাত৷ যেনো রুপকথার কোনো রাক্ষসের বিশাল এক হাত৷ আদ্রিকাকে ছুঁতে যাবেই, তখনই পেছন থেকে কেউ একজন ‘আদ্রিকা’ বলে ডেকে উঠলো। উৎসুক জনতা পেছন ফিরে দেখলো, কোমড়ে দুহাত রেখে মেঘা দাঁড়িয়ে। মেধাবী হওয়ায় শিক্ষকদের সাথে মেঘার খুব দ্রুত ভালো কানেকশন তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাই অন্য স্টুডেন্টরা তাকে সমঝে চলে। আদ্রিকার মতো মেয়েকে মেঘা কীভাবে চেনে সেটা সবার অজানা। তবে তার উপস্থিতিতে খুব মজার একটা খেলায় ব্যাঘাত ঘটায় সবাই খুব ব্যথিত হলো। সেদিকে তোয়াক্কা না করে মেঘা তার লম্বা দুটো বিনুনির নিচের চুলগুলো আঙ্গুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে আদ্রিকার দিকে এগিয়ে গেলো। ওর হাত ধরে টেনে দাঁড় করে বেশ জোরে ধমক দিয়ে বললো,
– সেই কখন থেকে ক্যান্টিনে অপেক্ষা করতেছি৷ টিফিন পিরিয়ড শেষ হলে আমরা লাঞ্চ করবো? দুই মিনিটের কথা বলে দশ মিনিটেও তোর খোঁজ নেই। চল তাড়াতাড়ি।

আদ্রিকা তখনো আতংকে জর্জরিত। মেঘার কথা বুঝতে পারলো না এবং কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোও তার পক্ষে সম্ভব হলো না। ক্লাসের বাকি স্টুডেন্ট তখনও নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে। তা দেখে মেঘা আবার ধমকে বললো,
– তোরা এমন রাস্তার ধারে বেঁধে রাখা ষাঁড়ের মতোন রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সড় সামনে থেকে।

হুর মুড় করে কেউ জায়গা ছেড়ে নিজের সীটে গিয়ে বসে পড়লো, কেউ আবার ক্লাস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। টিফিন পিরিয়ড শেষ হতে তখনো আরও মিনিট দশেক বাকি৷ মেঘা মেয়েটা গলার স্বর উঁচু করে ছাড়া কথাই বলতে পারে না। সবসময় হুমকি ধমকির মধ্যেই থাকে৷ তার স্বাভাবিক কথা শুনলেও মনে হয়, যেনো ধমক দিচ্ছে।
ক্যান্টিনে গিয়ে দেখা গেলো সেখানে প্রচুর ভীড়। মেঘা কোনোরকম একটা চেয়ার খুঁজে এনে আদ্রিকাকে বসতে বলে নিজে চলে গেলো খাবারের সন্ধানে। চারদিক অচেনা ছেলেমেয়ের পদচারণায় গিজগিজ করছে। কলকল করে কথার স্রোত বয়ে যাচ্ছে৷ উচ্ছ্বল তরুণ-তরুণীদের দেখে নিরাশ আদ্রিকা এতোক্ষণের চাপিয়ে রাখা কান্নাটা আর আটকাতে পারলো না৷ দু হাতে মুখ ঢেকে চেয়ারে বসেই কাঁদতে শুরু করলো। আদ্রতাকে ছাড়া কলেজ আসাটাই আজকে ভুল হয়েছে। মায়ের আর দুটো বকা খেয়ে তবুও বাড়িতে রয়ে যেতো, তাহলে একটা বাজে দিনের সম্মুখীন হতে হতো না৷

মেঘার একহাতে প্লেট, প্লেটে দুটো সিঙ্গার, দুটো ডালপুরি, সাথে বেশ খানিকটা পাতলা টমেটো সস। অন্য হাতে একটা পানির বোতল, দুটো টিস্যু। একটা টিস্যু আদ্রিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এই টিস্যুটা দিয়ে আপাতত চোখ মুছে ফেল। টিস্যু দুটো এনেছিলাম খাবার পর হাত মুছবো বলে। তুই আগেই কান্নাকাটি করা শুরু করলে আরেকটা নিয়ে আসতাম। কী রে, নে ধর।

আদ্রিকা টিস্যু হাতে নিতে তার কোলে প্লেট রেখে পাশের একটা ছেলের দিকে চলে গেলো। ছেলেটির খাওয়া প্রায় শেষের দিকে।
‘ অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে খেয়েছিস। এখন চেয়ারটা আমাকে দে। বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে। আর অপেক্ষা করতে পারবো না৷ তাড়াতাড়ি উঠ।’
অচেনা ছেলেটাকে ধমকে তার চেয়ারটি নিয়ে এসে আদ্রিকার পাশে বসে গোগ্রাসে সিঙ্গারা খেতে শুরু করলো। আদ্রিকাকে তখনো টিস্যু হাতে বসে থাকতে দেখে বললো,
‘টিফিন পিরিয়ড শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছিস? ঘন্টা পরলে খাওয়া শুরু করবি নাকি?’
মেঘার কার্যকলাপ দেখে আদ্রিকা চোখ মুছতে ভুলে গিয়েছিলো। ছলছল চোখ, জলে ভেজা কপল – আদ্রিকাকে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। একটু করে সিঙ্গারা ভেঙ্গে সসে চুবিয়ে খুব সাবধানে মুখে দিচ্ছে। এমন শান্ত মেয়ে এখনো ভূবনভোলায় আছে তাহলে! সেই শান্ত মেয়েটিকেই কীভাবে খুঁজে পেলো কে জানে! ছেলের পছন্দ আছে বলতে হয়। মুচকি হেসে মেঘা নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। ক্লাসে ফিরে গিয়ে সামনের বেঞ্চ থেকে ব্যাগ নিয়ে এসে আদ্রিকার সাথেই পেছনের বেঞ্চে বসলো।
আদ্রিকা জানে না, ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী মেয়েটি কেনো নিজে এসে তাকে সাহায্য করলো। আজকে প্রথমবার এসে এমন ভাবে কথা বলছিলো যেনো কতোদিনের চেনা! খুবই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তারা। অথচ আজই প্রথম তাদের আলাপ হলো৷ সবাই যখন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলো তখন মেঘা এসে আদ্রিকা বলে ডাকতেই কয়েকজন মেয়ে একে অপরকে বলছিলো, এই মেঘা এসেছে। তখনই আদ্রিকা শুনেছিলো, এই মেয়েটির নাম মেঘা৷

– ওরা আমার নাকের নোলক নিয়ে হাসাহাসি করছিলো। আমাকে কি নোলক পরে সত্যি বাজে দেখায়?

ওর থুতনি ধরে পুরো মুখটা ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করার পর মেঘা বললো,
– নাহ তো। তোকে তো এটা পরে বেশ সুন্দর লাগছে। একদম ইউনিক স্টাইল। এটার নাম নোলক নাকি? জানতাম না তো। সবাই তো এখন নাকফুল অথবা নথ পরে। নোলক পরে কাউকে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে, এজন্য অন্যদের হিংসা হচ্ছে৷
– আমার বোনও বলে আমাকে নোলক পরে ভালো মানায়। এই তুমি আবার আমার মন রাখার জন্য বলছো না তো? সত্যি করে বলো।
– সত্যি, সত্যি, সত্যি। তিন সত্যি বলছি। তোকে দারুণ দেখাচ্ছে।

ছুটির সময় মেঘাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। সে কোন ফাঁকে যেনো বেরিয়ে গেছে। কলেজ গেটে আবার বিস্ময়কে দেখতে পাওয়া গেলো। ভার্সিটির ক্লাস আগেই শেষ হয়ে যায়৷ বিস্ময় এতোক্ষণ আদ্রিকার অপেক্ষায় ছিলো। ওকে দেখে আদ্রিকার কেনো যেনো খুব ভালো লাগলো। আদ্রতার পর এই প্রথম কেউ তার অপেক্ষায় ছিলো। বিস্ময়কে তো আর এটা বলা যায় না৷ মনের সকল অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কিছু কথা মনকুঠুরীতেই সুন্দর। সেগুলো মুখে বলে ফেললে কেমন বোকা বোকা শোনায়। তাই আদ্রিকা বললো,
– আপনি অপেক্ষা করছিলেন কেনো? আমি কিন্তু আপনার সাথে কোথাও যাবো না।
– গার্লফ্রেন্ড হ আগে তারপর নিয়ে যাবো। যার তার সাথে আমি কোথাও যাই না।
– ঠিক আছে। আপনার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে যাইয়েন। আমার পিছু পিছু আসছেন কেনো?
– চল, তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
– কেনো?
– ভার্সিটির জুনিয়রের ছোটবোন বলে কথা। ঠিকমতো বাড়ি পৌঁছালো কিনা, একটা দায়িত্ব আছে না আমার। নিকট ভবিষ্যতের গার্লফ্রেন্ডও বটে।

শেষের কথাটি ফিসফিসে বলার কারন আদ্রিকা শুনতে পেলো না। সে নিজের মতো বকবক করতে থাকলো৷ যেমনটি আদ্রতার সাথে বাড়ি ফেরার সময় করে। নিশ্চুপ, শান্ত আদ্রিকা বোনের সামনে চঞ্চল হয়ে উঠতো। আজ সেই চঞ্চল প্রজাপতির খোঁজ পেয়েছে বিস্ময়। প্রজাপতির রঙ যে চোখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছে, এর থেকে বাঁচার উপায় নেই। বাঁচতে চাইছেও না সে। পেছনে তাকাতেই দেখলো মেঘা দূর থেকে হাতের ইশারায় ‘দারুণ পছন্দ’ বলে চলে গেলো। বিস্ময়ও ইশারায় থ্যাংকস জানিয়ে আদ্রিকার সাথে তালমিলিয়ে হাঁটতে লাগলো।

– আপনার সাথে বাড়ি ফিরতে দেখলে বাবা আমাকে মে-রেই ফেলবে।
– বাজার পর্যন্ত সাথে যাবো।
– বাজারেও বাবার অনেক পরিচিত আছে।
– আমি একটু দুরত্ব বজায় রেখে পেছন পেছন যাবো।
– বাজার পেরিয়ে আর যেতে হবে না৷ বাকিটা আমি যেতে পারবো।
– ঠিক আছে যাবো না।
– তাহলে সমস্যা নেই।
– আমি রোজ এভাবে গেলে সমস্যা নেই?
– কিহ! আপু থাকবে সাথে। আপনি কীভাবে সাথে আসবেন?
– মানে আপু সাথে না থাকলে সমস্যা ছিলো না?

আদ্রিকা উত্তর দিলো না। বিস্ময় সেখানি দাঁড়িয়ে বললো,
– আমি তোর সাথে আরও অনেকটা পথ পারি দিতে চাই, আদ্রি। তুই অনুমতি দিবি?

অজান্তেই আদ্রিকা পা দুটো থমকালো৷ ব্যস্ত রাস্তায় দুজন পথিক নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। পথচারীরা দু একজন চলতি পথে উৎসুক নয়নে চেয়ে বিদায় নিচ্ছে৷ পাশ দিয়ে যাওয়া কোনো এক সাইকেল আরোহীর সাইকেলের বেলের শব্দে আদ্রিকার ঘোর কাটলো। পেছন ফিরে বিস্ময়কে বললো,
– দ্রুত চলুন, দেরী হয়ে যাচ্ছে। মা আবার বকবে।

বিস্ময়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে সে দ্রুত পা চালালো। মনে মনে দোয়া করছে, গতদিনের মতো পাগলামি না করলেই হয়। বিস্ময় অসামাজিক কোনো কিছুই করলো না। কিছু হয়নি এমন ভাব নিয়ে আদ্রিকার পিছু পিছু চললো।

(চলবে…)