নোলককন্যা পর্ব-০৫

0
42

#নোলককন্যা
পঞ্চম পর্ব
#অক্ষরময়ী

কাঁচা কলা, কাঁচা পেঁপে, টমেটো, শসা হামানদিস্তায় থেতলে ধনিয়াপাতা, পুদিনাপাতার সাথে তেঁতুল দিয়ে মেখে তাতে সামান্য মরিচ, লবণ, চিনি, সরিষার তেল দিয়ে মাখানো হচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলে ছাদে বসে সেই মাখানো খাবে আদ্রিকা এবং আদ্রতা। জ্বরের কারনে আদ্রতার মুখের স্বাদ চলে গিয়েছে। যাই খাচ্ছে তাই তিতা লাগছে। মুখের স্বাদ ফিরিয়ে আনতে এই আয়োজন। সারাদিন ঘুরে ঘুরে সবকিছু যোগাড় করে আদ্রিকার ফেরার অপেক্ষা করছিলো। বিকাল নামতেই দু’বোন ছাদে এসে গল্পের ডালা নিয়ে বসেছে। বোনের নির্দেশনা অনুযায়ী আদ্রিকা হামানদিস্তায় একের পর এক উপকরণ দিয়ে যাচ্ছে সেইসাথে একা কলেজে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে৷

– কতোক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার পরও একটা রিক্সা পাচ্ছিলাম না। পরে আব্বু একটা রিক্সায় তুলে দিলো। আমার যে কী ভালো লাগতেছিলো!
– একা তাহলে কলেজে যেতে পারলি! এখন থেকে রোজ একাই তো যাওয়া আসা করতে পারবি।
– অসম্ভব। একদিনেই আমার যে কতো খারাপ অবস্থা হয়েছে।
– অভ্যাস করতে হবে। আমি যখন থাকবো না তখন কি করবি?
– থাকবে না মানে? আমাকে রেখে কোথায় যাবে তুমি?
– বাহ রে! বিয়েশাদি করতে হবে তো। দেখবি কোনদিন যেনো হুট করে বিয়ে দিয়ে বিদায় করে দেয়।
– মাহিন ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে কথা চলছে। আমি লুকিয়ে শুনেছি। ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে হলে দারুণ মজা হবে। বাড়ির পাশেই তোমার শ্বশুরবাড়ি হবে।

মাহিনের কথা উঠতেই আদ্রতা আতংকে নীল হতে হতেও নিজেকে সামলে নিলো। মাহিনকে বিয়ে করার থেকে জলন্ত আগুনে ঝাপিয়ে পরা বেশি ভালো। অত্যন্ত সাময়িকভাবে জ্বলেপুড়ে একসময় মৃত্যুর স্বস্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু মাহিনকে বিয়ে করলে প্রতি মুহূর্তে আগুনে দগ্ধ হতে হবে। আদ্রতার সাথে চাচাতো ভাই মাহিনের বিয়ের অঘোষিত একটা আলাপ অনেকদিন ধরেই চলছে। নীহার এটা ওটা বলে এতোদিন বিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে। কিন্তু আদ্রতা কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে পা রাখতেই মাহিনের পক্ষ থেকে বিয়ের তোড়জোড় চলছে। ইদানীং মাহিন নিজেও আদ্রতার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। ছোটবেলা থেকে এ বাড়িতে তার নির্বিঘ্নে যাতায়াত থাকলেও কিশোর বয়স হতে আসা যাওয়া একপ্রকার বন্ধই ছিলো। কিন্তু ইদানীং সময় অসময়ে এ বাড়িতে এসে হাজির। আদ্রতার দিকে তাকানোর ভঙ্গিমায় এসেছে পরিবর্তন। আদ্রতা প্রায়ই তাকে এড়িয়ে চলে। সে বাড়িতে এলে নীহার একটু বেশি সতর্ক থাকে। আদ্রতাকে একমুহূর্ত কাছ ছাড়া করে না। আদ্রতার দিকে তাকানো, কথা বলার চেষ্টা সবকিছুতেই কেমন একটা কামুকতা উপচে পরে। যা অনুভব করা যায় কিন্তু মুখ ফুটে অভিযোগ করার উপায় নেই। তাই সতর্ক থাকাই শ্রেয়। এমন ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতেই নীহারের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে। কিন্তু সিদ্ধান্ত স্বয়ং মোকাররম মজুমদার এবং তার ভাইদের। সেখানে নীহারের মতামতের বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। স্ত্রী, সন্তান, পরিবারের প্রতি মোকাররম মজুমদারের উদাসিনতা থাকলেও নিজের ক্ষমতা জাহির করার সুযোগ সে কখনো হাতছাড়া করে না। সংসারের প্রতিটি কাজে তার মতামতই হবে সর্বশেষ কথা। তাই আদ্রতা কোনো রুপকথার গল্পের মতো চমৎকারের আশা করে না। শুধু চায় আর কিছুদিন যেনো বিয়েটা আটকে রাখা যায়। জীবনের স্বাদ আর কিছুদিন উপভোগ করতে চায়। বোনটি তার বড়ই নির্বোধ। জীবনের কঠিন পথের সন্ধান সে এখনো পায়নি। নীহার, আদ্রতা দুজনে মিলে তাকে এসব থেকে দূরে রাখে। অন্তত তার জীবনটা সুন্দর হোক। দু আঙ্গুলে আদ্রিকার নাক চিপে ধরে বললো,
– আমি না হয় বিয়ে করে বাড়ির পাশেই থাকবো, কিন্তু তোর যখন বিয়ে হবে তখন কি করবি?
– উম! আমি বিয়েই করবো না। তোমার সাথেই থেকে যাবো।

ভর্তা মাখানো শেষ হয়েছে, এবার সার্ভ করার পালা। বাড়ির পেছন দিকে সবজি বাগানে মিষ্টি কুমড়ার গাছটি মনখুলে ডালপালা ছড়িয়েছে৷ ছাদ থেকে নেমে আদ্রিকা সেদিকে ছুটে গেলো মিষ্টিকুমড়ার পাতা আনতে। কচি সবুজ পাতা ধুয়ে তাতে ভর্তা রেখে খেলে ভর্তার স্বাদ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ছাদে বসে আদ্রতা অপেক্ষা করছে, তখন মোকাররম ছাদে এলো।
গতকাল সকালে নীহার জ্বরের ঔষধ আনার কথা বলেছিলো। হাতে দু’পয়সা এলেই বাড়ির মানুষেরা কীভাবে যেনো টের পেয়ে যায়। তখন কেউ অসুখে পরে মরোমরো দশা, কিন্তু আজরাইল নিয়ে যায় না। কীভাবে যেনো বেঁচে যায়। কৈ মাছের প্রাণ বলে কথা। এতো সহজে এদের হাত থেকে মোকাররমের নিস্তার নেই। রক্ত জল করে পরিশ্রম করা উপার্জন এরা দু হাতে উড়িয়ে তবেই না শান্তি পাবে। আজ স্কুলের ফি, কাল বই কেনা, জুতা কেনা, বছরে দুইবার জামা-কাপড়, প্রতিদিন ব্যাগ ভর্তি বাজার-সদাই তো আছেই। একটা দিন বাদ নেই যে ঘরে খরচ আসে না। এক সংসারের পেছনে টাকা ঢালতে ঢালতে মোকাররমের ক্যাশ ফাঁকা হতে চললো। সকালবেলা সবে বাজারের উদ্দেশ্যে কদম ফেলেছে কি ফেলেনি তখনি আবার ঔষধ কেনার কথা শুনে মেজাজটাই বিগড়ে গিয়েছে। আচ্ছামতো দুটো কথা শুনিয়ে দিয়েছিলো নীহারকে৷
একটা স্কুলের বাগানের জন্য ফুল গাছের বেশ বড় অঙ্কের অর্ডার পেয়েছিলো। সেখানে গাছ পাঠিয়ে অর্ডার কমপ্লিট করতেই দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিলো। ঔষধ কেনার কথা মনেই ছিলো না। রাতে যখন ঘরে ফিরলো তখন পাশের রুমে মেয়েকে জ্বরে কাহিল হয়ে পরে থাকতে দেখে খারাপই লেগেছিলো। ঔষধ কেনার কথা মনে থাকলে কিনে আনতো। আহারে! মেয়েটা জ্বরে কতোই না কষ্ট পাচ্ছে। পাশের ঘরে গিয়ে একবার মেয়েটাকে দেখে আসতে মন চাইছিলো, কিন্তু কোনো এক দ্বিধার বশে আর যাওয়া হলো না। মেয়ে দুটো রাতে ঠিকঠাক খায়নি বলে মোকাররম স্বল্প কিছু মুখে দিয়ে শুয়ে পরেছিলো। সকালবেলা বাজারে গিয়ে ঔষধ আনবে ভেবেই ঘুমিয়ে ছিলো কিন্তু সকাল হতে আবার ভুলে গেছে।

দিন গড়াতেই সেই মেয়ে একগাদা তেতুল নিয়ে ছাদে বসে আছে৷ ছোটবেলায় দাদী বলতো, “জ্বর নিয়া টক খাইলে হাড় জ্বর আইবো। হাড়ে হাড়ে জ্বর ছড়ায় যাইবো।”
সেই কথা মনে পরতেই রেগেমেগে আদ্রতার সামনে থাকা হামানদিস্তা লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন।
– জানোয়ার বাচ্চারা, তোদের রঙ দেখে বাঁচি না। সারাদিন খালি খাই খাই৷ খেয়ে আমার সংসার শেষ কইরা ফেললি। রাক্ষসের দল। কাজকর্ম কিছু নাই। হাত পা ছড়ায় ছাদে বসে আছে। ভরা বিকালে মানুষজন বাজারঘাট যাইতেছে, উদাম মাথা নিয়ে ছাদে বসে কি চেহারা দেখাইতেছিস? যা ঘরে যা।

ছাদের মেঝেতে ছড়িয়ে পরা তেতুল ভর্তার দিকে তাকিয়ে আদ্রতা খুব দ্রুত নিজের জায়গা ছাড়লো। লোহার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই আদ্রিকার সাথে দেখা। সে খুব উৎসাহ নিয়ে দুটো মিষ্টিকুমড়া পাতা ধুয়ে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে আসছে। আদ্রতাকে নিচে দেখে বললো,
– কি হলো? নেমে এলে কেনো? এই দেখো পাতা নিয়ে এসেছি। নিচের ট্যাপ থেকে ভালো করে ধুয়ে নিয়েছি। দেখো, একটুও ময়লা নেই।
– আমার হাত লেগে সব নিচে পরে নষ্ট হয়ে গেছে৷ এখন আর খাওয়া হবে না। পাতাগুলো ফেলে দে।

আদ্রিকা স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। ওর হাত থেকে পাতা দুটো নিয়ে আদ্রতা নিজেই বাইরে ফেলে দিলো। আদ্রিকার চোখ দুটো ছলছলে। এই ভর্তাটা তার খুব পছন্দ। এতোদিন মা অথবা আদ্রতা বানিয়ে দিতো। আজ সে কতো শখ করে নিজের হাতে বানিয়েছে! একটু টেস্ট করে দেখতেও পারলো না। মেঝেতে পরে কি সবটুকু ময়লা হয়ে গিয়েছে? একটুখানিও খাওয়ার যোগ্য নেই?

আদ্রতার হাত ধরে মনভার করে বললো,
– স্যরি রে। কীভাবে যেনো হাত লেগে পরে গেলো। আমি কালকে আবার বানিয়ে দিবো। প্রমিজ।

বোনের মুখে মেঘের ছায়া দেখে আদ্রিকার নিজের মন খারাপ জলীয়বাষ্পের মতোন উড়ে গেলো। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– বাদ দেও তো। রিজিকে ছিলো না তাই পরে গেছে।

ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখা গেলো মাহিন এসেছে। তার গায়ে কটকটে লাল রঙের একটা শার্ট, জিন্স প্যান্ট, চুলে স্পাইক কাটিং। আদ্রতার চোখ জ্বালা করতে শুরু করলো। জ্বরটা বুঝি আবার আসছে। আদ্রিকা তো ফিক করে হেসে বললো। তা দেখে মাহিন ধমকে উঠলো।
– বেয়াদবের মতো হাসতেছিস কেন?
– আপনাকে একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে ভাইয়া। লাল টুকটুকে রাঙা বউ।
– ছেলেদের বউ এর মতো লাগবে কেনো? নতুন বরের মতো লাগছে, এটা বলতে পারিস৷
আদ্র‍তাকে বললো,
– শুনলাম তোমার নাকি জ্বর আসছে। তাই দেখতে আসলাম। বাজার থেকে অনেক খুঁজে রাঙামাটির আনারস নিয়ে আসলাম। ওদিকের আনারস অত্যাধিক মিষ্টি। খাইলেই জ্বর দৌড় মেরে পালাবে।
– আমার জ্বর এমনিতেই পালিয়ে গেছে। আনারসের প্রয়োজন নেই৷ আপনি এগুলো নিয়ে যান।
– এমন জেদ দেখাও কেন? খাইতে কইছি খাবা। জেদি মেয়ে মানুষ দুই চোক্ষের বিষ।
– না দেখলেই হয়৷

আদ্রতা গটগট করে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিলো। আদ্রিকা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। আপুটা কেনো যেনো মাহিন ভাইয়ার সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। কতো সুন্দর হলুদ রঙের পাকা আনারস নিয়ে এসেছে। আপু খেতে চাইলে মা এখনি কেটে দিতে, এতে আদ্রিকারও খাওয়া হতো। এখন আর আনারস খাওয়ার কথা বলা যাবে না। আপুর মেজাজ ভীষণ খারাপ। মা নিজেও আজ মুখ ভার করে কাজ করবে৷ টিভির রিমোট হাতে নিয়ে সোফায় বসে টিভি অন করলো। সামান্য সাউন্ড দিয়ে টিভি দেখতে হবে। মোকাররমকে বাড়ি ফিরতে দেখলেই দ্রুত টিভি অফ করে নিজের ঘরে দৌড়াতে হয়৷ তাই সম্পূর্ণ মনোযোগ টিভির দিকে দেওয়া যায় না, একটা চোখ থাকে সদর দরজার দিকে।
টেবিল হতে আনারস দুটো তুলে নিয়ে মাহিন বেরিয়ে গেলো। মেয়ের বড্ড তেজ। একবার বিয়েটা হয়ে যাক, সব ঠান্ডা করে দিবে। আজকেই বাড়িতে বিয়ের কথা তুলতে হবে। আর কোনো দেরী নয়। নীহার দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। আজকের ঘটনা মশলা মেখে মোকাররমের কানে পৌঁছাবে। সে নিয়ে বাড়িতে আরেক অশান্তি শুরু। নীহারের ইচ্ছে করে ঘর সংসার ছেড়ে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু মেয়ে দুটো যেনো পায়ে শিকল হয়ে বেঁধে আছে। মা ছাড়া অকূল সাগরে ভেসে যাবে। ভালো কোনো ছেলের হাতে মেয়ে দুটোকে তুলে দিলে আর চিন্তা থাকতো না। কিন্তু এবার মনে হয় আদ্রতার বিয়েটা আর আটকানো সম্ভব হবে না। মেয়েটাকে জলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করার সাক্ষী নীহার কীভাবে হবে!

(চলবে)