নোলককন্যা পর্ব-০৬

0
33

#নোলককন্যা
ষষ্ঠ পর্ব
#অক্ষরময়ী

সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। এমন বৃষ্টিতে এক জায়গায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে গাঁ ভিজে যায় কিন্তু অনবরত হাঁটাচলা করলে আবার গায়ে বৃষ্টির পানি তেমন একটা পরে না। ঝড় বৃষ্টি যাই আসুক, ঘরে বসে থাকার ছেলে বিস্ময় নয়। সে তার ইয়ামাহা আর ফিফটিন বাইকে চেপে বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে ফাঁকা রাস্তায় ছুটে বেড়িয়েছে। ঘর ছেড়ে বের হওয়ার সময় পরখ অবশ্য হাতে একটা ছাতা ধরিয়ে দিয়েছে। পরখের মধ্যে একজন মমতাময়ী মা লুকিয়ে আছে। যা দূর থেকে কেউ বুঝতে পারে না। খুব কাছে গিয়ে অনুভব করতে হয়। তিন বছর ধরে একসাথে থাকতে থাকতে এই ছেলেটাকে বিস্ময় পুরোটা চিনে ফেলেছে। এমনিতেও মানুষ চেনায় বিস্ময় বরাবর ফাস্টক্লাস। পরখের কেয়ারিং স্বভাবটা মাঝেমধ্যে বিরক্তও লাগে। কিন্তু মুখে তো আর কিছু বলা যায় না। সে সময় বিস্ময়ও পরখের মতো মনের কথা মনেই দাফন করে ফেলে।
তুরাব বসে আছে ভার্সিটির ক্রিকেট মাঠের শেষপ্রান্তে থাকা বিশাল কদম গাছটার নিচে৷ গাছটার লম্বা, চওড়া কদম পাতায় ছেয়ে থাকায় গাছের তলায় বৃষ্টি পরছে না। বর্ষা-বাদলের দিনে এমন গাছগুলোই হচ্ছে প্রকৃতি প্রদত্ত ছাতা। সেই ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে বিস্ময় অপেক্ষা করছে আদ্রিকার। এখান থেকে কলেজ গেটের ভিশন একদম ক্লিয়ার৷ আদ্রিকা গেটে পা রাখা মাত্রই বিস্ময় তাকে দেখতে পাবে। বোকা, ভীতু চেহারার মেয়েটার মধ্যে কিছু একটা আছে৷ বিস্ময়ের কেমন নেশা লাগে। কলেজে নতুন সেশনের ভর্তি চলছিলো, তখন প্রথমবার দেখা। আজকাল মেয়েরা হয়েছে উড়নচন্ডি, উগ্র। কোমলতা, ধীর-স্থিরতা বলে কিছুই তাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আদ্রিকার মতো মেয়ে যে কারো নজরে পরে যাবে। বোনের পেছনে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে চারদিক ঘুরে দেখছিলো। ভর্তির প্রসিডিওর যা কমপ্লিট করার বড় বোন করছে আর সে শিশুর মতো বোনের পেছন পেছন ঘুরছে। বিস্ময় তখনই ঠিক করে ফেলেছিলো, এই মেয়েটিকে তার চাই। নিজের সোর্স কাজে লাগিয়ে একদিনের মাঝে যাবতীয় খোঁজ খবর সংগ্রহ করে ফেলেছে৷ আদ্রিকার বড়বোন আদ্রতা, এ বছর মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছে। ছোটবোন আদ্রিকা কলেজের মানবিক বিভাগের ‘এ’ সেকশনে ভর্তি হলো। আদ্রিকার কাছাকাছি যাওয়ার একমাত্র সহজ পথ হচ্ছে আদ্রতা- এই সহজ ব্যাপারটি বুঝতে বিস্ময়ের বেশিক্ষণ লাগেনি। একনজরেই সে মানুষের স্বভাব, চিন্তাভাবনাসহ খুঁটিনাটি কিছু বিষয় আন্দাজ করে ফেলতে পারে৷ ছোটবেলা থেকে অনেক ধরনের মানুষের সাথে পরিচিত হতে হতেই এমন আন্দাজ করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এজন্য বিস্ময় তার বাবাকে ধন্যবাদ জানায়৷ অবশ্যই মনে মনে৷ সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কিছু বলার সাহস আদোও তৈরি হয়নি৷ দেশের টপ টুয়েন্টি বিজনেসম্যানদের মধ্যে একজন বিস্ময়ের বাবা। আজ বিজনেস পার্টি, কাল এটা ওটা সেলিব্রেশন, বিজনেসফিল্ডে নানান পার্টনারের বাড়িতে অনুষ্ঠান – সকল ইনভাইটেশনে তিনি সপরিবারে উপস্থিত হন৷ বিজনেসওয়াল্ডে ফ্যামিলিপারসন হিসেবে উনার বেশ খ্যাতি আছে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরাই জানে আসল সত্য। পরিবারকে সময় দেওয়ার মতো অযথা সময় বিস্ময়ের বাবার নেই৷ ছেলের সাথে কখনো হাসিমুখে বসে দুমিনিট কথা বলেছে কিনা তা বিস্ময়ের মনে পরে না। একমাত্র সন্তান তবুও বাবার সাথে নেই সখ্যতা। শুধু সন্তান কেনো, নিজের স্ত্রীর সাথেও মনে কথা বলার সময় তিনি বের করতে পারেন না। বিস্ময়ের মায়ের সময় কাটে বিভিন্ন লেডিস ক্লাব, পার্টি, স্পা, শপিংমল এসব নিয়েই। বিস্ময় অবশ্য মাকে দোষ দেয় না। সময় কাটানোর জন্য তো কিছু একটা করা উচিত৷ এভাবে যদি ভালো থাকা যায়, মনে শান্তি আসে তাহলে ক্ষতি কি? দিনশেষে ভালো থাকাটাই ফ্যাক্ট৷

আটটার কিছুক্ষণ পর কলেজ গেটে আদ্রিকাকে দেখা গেলো৷ আজকেও সে তার বোনের সাথে এসেছে। আদ্রতা ভার্সিটির গেট পেরিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলো। ওর ক্লাস নয়টায়, আদ্রিকার সাড়ে আটটায়। আদ্রিকার জন্য আধাঘন্টা আগে আসা। ক্লাসের আগে এই সময়টুকু বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দিতেই কেটে যায়৷ আদ্রিকার সাথে বিস্ময়ের দেখা করা অন্তত জরুরি। প্রতিদিন একটু কথা না বললে মনে হয় জরুরি কোনো কাজ ছুটে গেছে। অস্থির লাগে৷ আদ্রতা এখন ক্যাম্পাসে ঘুরাঘুরি করবে, আদ্রিকাকে বিস্ময়ের সাথে দেখে না ফেললেই হলো। বিস্ময় মনে মনে হিসাব কষে নিলো। এখন বাজে আটটা পনেরো। ক্লাস শুরু সাড়ে আটটায়। হাতে আছে দশ মিনিট। পাঁচ মিনিট আদ্রিকার ক্লাসে গিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার জন্য।

বিস্ময় লাফ দিয়ে গাছ থেকে কয়েকটা কদম ফুল ছিঁড়লো। ডালে জমে থাকা বৃষ্টির পানি হুড়মুড়িয়ে পরে বিস্ময়কে পুরো ভিজিয়ে দিলো। এতোক্ষণ বৃষ্টির হাত থেকে গা বাচিয়ে কোনো লাভই হলো না। বিস্ময় অবশ্য এতে খুশিই হলো। আদ্রিকা দেখবে বিস্ময় তার জন্য বৃষ্টিতে ভিজে অপেক্ষা করেছে। কোনো ছেলে রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে অপেক্ষা করছে এমন কাজে মেয়েরা খুশি হয়৷ তাদের জন্য ছেলেদের কাঠখড় পোড়ানো দেখলে মেয়েদের মন নরম হয়। ভালোবাসা জন্মানোর প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেয়৷

ভার্সিটিতে ফ্রেশারদের চলতে হয় ফুঁ দিয়ে দিয়ে। একটু ওদিক হলেই সিনিয়রদের প্যারা। সালাম দিতে দিতে মুখে ব্যথা ধরে যায়। ইইচ্ছামতো যেখানে সেখানে বসা যাবে না, বসার জন্য রয়েছে আছে আলাদা জায়গা- যেখানে অল্প জায়গা হওয়ায় সীট পাওয়া যায় না। আবার মাঠে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে মন খুলে আড্ডা দেওয়ার সময়ও তটস্থ থাকতে হয়। উচ্চস্বরের হাসি যদি কোনো সিনিয়রের কানে পৌঁছেছে তো সেদিন কান্নাকাটি করেই বাড়ি ফিরতে হবে। ক্যান্টিনে যেতে হবে একটা নিদিষ্ট সময়ে, সময়ে অসময়ে ক্যান্টিনে যাতায়াত করবে সিনিয়ররা৷ এতো নিয়মকানুন আদ্রতার ভালো লাগে না। ভার্সিটি তো নয়, যেনো যুদ্ধের ময়দান৷ সবসময় মারা পরার ভয়। মাথা নিচু করে রাস্তার এক পাশ দিয়ে ডিপার্টমেন্টের দিকে যেতে সামনে পরলো একজন সিনিয়র ভাই। সে যে শুধু সিনিয়র তা নয়, বরং ভার্সিটিতে তার প্রতাপ পতিপত্তি সুদূর প্রসারী। বাবা ভার্সিটির বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ এর একজন সদস্য, সে নিজেও ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়। ধনী বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে দাপট তো আছেই। সব মিলিয়ে আকাশ ছুঁইছুঁই অবস্থা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদ্রতা মুখে হাসি ফুটিয়ে সালাম দিলো।

– আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আজ এতো সকালে ভার্সিটিতে?
– নয়টায় ক্লাস আছে ভাইয়া৷ ছোটবোনের ক্লাস সাড়ে আটটায়, তাই একটু আগেই আসতে হলো।
– ছোটবোন কি কিন্ডারগার্টেনে পড়ে? এখনো সাথে করে নিয়ে আসতে হয়।
– ও আসলে একা কখনো যাতায়াত করেনি। সবসময় আমি সাথে থাকি। আমার নিজেরও ভালো লাগে। তাছাড়া ও বেশ সরল মনের৷ বিপদ আপদের কথা বলা যায় না।
– আমরা থাকতে একাডেমিতে কীসের বিপদ আপদ? এতো রীতিমতো আমাদের উপর প্রশ্নচিহ্ন।
– স্যরি ভাইয়া। আমি ওভাবে বলিনি। ভার্সিটির বাইরের কথা বলেছি।
– তুমি না থাকলে তখন কি করবে?
– তখন ওর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ওর হাসবেন্ড থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
– নাম কি যেনো তোমার বোনের?
– আদ্রিকা মজুমদার। মানবিক শাখায় পড়ে। আপনার সাথে দেখা হয়েছিলো। আপনার মনে আছে কিনা?
– অবশ্যই মনে আছে। আমার সাথে মাঝেমধ্যে দেখা হয়। কয়েকদিন আগেই তো দেখা হলো। সেদিন তোমার জ্বর ছিলো মেবি। একা যাচ্ছিলো দেখে এগিয়ে দিলাম৷
– অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া৷
– এখন যাচ্ছো কোথায়?
– ডিপার্টমেন্টে যাবো। ক্লাসেই বসেই অপেক্ষা করবো। আধাঘন্টা দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
– আচ্ছা ঠিক আছে যাও। কোনো সমস্যা হলে জানাবে।
– অবশ্যই ভাইয়া। আসি৷ আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।

সিনিয়র ভাইয়ার হাতে একগুচ্ছ ভেজা কদম দেখে আদ্রতার মনটা ভালো হয়ে গেছে। লোকে মুখে যতো কথাই শুনুক, মানুষটা প্রেমিকার জন্য ঠিকই সতেজ এবং রোমান্টিক। বৃষ্টিতে ভিজে প্রেমিকার জন্য কদম ফুল নিয়ে যাওয়ার ছেলেমানুষিও করছে!

কথার ছলে আদ্রতার গন্তব্য জেনে নেওয়াই ছিলো বিস্ময়ের মূল লক্ষ্য৷ ক্লাসরুমে বসে থাকলে তাকে নিয়ে ভয় নেই। ভিজে জবজবে হয়ে ভেজা কদম ফুল হাতে বিস্ময় দ্রুত পা চালিয়ে কলেজ বিল্ডিংয়ের দিকে যাচ্ছে। আশেপাশের সবাই উজ্জ্বল মুখে তার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। প্রেমিকের হাত ধরে হেটে যাওয়া মেয়েগুলোর মুখ বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে একটু বেশি উজ্জ্বল হচ্ছে। পরক্ষণে তারাই আবার প্রেমিকের দিকে কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। মানুষ স্বভাবগত ভাবেই তুলনা করতে পছন্দ করে। তবে সে তুলনা নিজের থেকে বেশি সুখী কারো সাথে করে। দুঃখী মানুষদের নিয়ে ভাবার সময় কারোর নেই।

মানবিক বিভাগের বিল্ডিংটা একটু অদ্ভুতভাবে সাজানো। পুরো বিল্ডিংকে ঘিরে আছে বড় বড় ঝাউগাছ। সামনের দিকের ঝাউগাছগুলোর ডালপালা কেটে বিভিন্ন আকার দিলেও পেছনের দিক গাছগুলো ইচ্ছেমতো হাত-পা ছড়িয়ে বেড়ে যাচ্ছে। মূলত এ বিল্ডিং এর উল্টো দিক থেকেই ভার্সিটির সীমানা শুরু। ঝাউগাছগুলো প্রাচীর হিসেবে কাজ করছে৷ আদ্রিকা বিল্ডিং এর মূল দরজায় পা রাখতেই বিস্ময় তার হাত ধরে বিল্ডিং এর পেছনের দিকে টেনে নিয়ে চললো। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটলো যে আদ্রিকার মুখ থেকে কোনো শব্দই বের হওয়ার সময় পেলো না। এমনকি আশেপাশের সবাই শ্রেণীকক্ষে প্রবেশের তাড়ায় সেদিকে তাকালো না। ঝাউগাছগুলোর আড়ালে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আদ্রিকা ও বিস্ময়। ভয়ে ছমছম করছে আদ্রিকার সারা গা। কেউ দেখে ফেললে এখানেই লজ্জায়, অপমানে মরে যাবে। বিস্ময়কে দু চারটে কটু কথা শুনিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। এগুলো কেমন অসভ্যতা! এমন ছেলের উপর আদ্রিকার রাগ করা উচিত, ঘৃণা আসা উচিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তেমন কোনো কিছুই হচ্ছে না। আদ্রিকার দেহ, মন জুড়ে অদ্ভুত শিহরণ জাগছে। যেনো সে লুকিয়ে মজার কোনো খেলা খেলছে। ধরা পরার ভয়ে তার চেহারায় আতংকের ছাপ স্পষ্ট। ভাগ্যিস মনটা দেখতে পাওয়া যায় না।

বৃষ্টির বেগ অনেকটা কমে এসেছে। শীতের সকালের হালকা কুয়াশার মতো দু এক ফোঁটা গড়িয়ে পরছে। এমন ছুঁই ছুঁই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে বিস্ময় দু হাতে একগুচ্ছ কদম আদ্রিকার সামনে ধরলো। ফুটন্ত কদমের সদ্যস্নাত গা চুঁইয়ে টুপ টুপ করে দু এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে কাঠ কাঠ চেহারার একজন যুবক। যার নিখুঁত মুখটায় রাজ্য জয়ের হাসি। চোখদুটো যেনো রাতের আকাশে উজ্জ্বল তারার মতোন জ্বলজ্বল করছে। ইটরঙা পাঞ্জাবী ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে৷ এই মুহূর্তটি আদ্রিকার কাছে অপার্থিব মনে হচ্ছে। কোনোকিছুর বিনিময়ে সে এই মুহূর্তটিকে নষ্ট করতে চাইছে না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটির হাসি মিলিয়ে যাক এমন কর্ম তার দ্বারা সম্ভব নয়। এ যেনো ঘোর অন্যায় হবে। সে মাটির দিকে তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো ধরলো। কাছে টেনে নিতে চাইছে কিন্তু বিস্ময় ছাড়ছে না। বাধ্য হয়ে আদ্রিকাকে মুখ তুলে চাইতে হলো। বিস্ময়ের চোখের গভীরতায় বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। অতল গহব্বর যেনো। শেষ হওয়ার নাম নেই। আদ্রিকা চোখ সরিয়ে নিলো। বিস্ময়ের কপালে কয়েক গাছি চুল এসে পরেছে। ভেজা চুলগুলোর ডগায় এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি আটকে আছে। ঝরে পরবে পরবে করেও পরছে না। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি ঝরে পরবে। আদ্রিকার সকল মনোযোগ সেখানে। এইতো এক্ষুনি পরবে। ধুর! ছাই। এবারও পরলো না। বিস্ময় গলা পরিষ্কার করে মনোযোগ আকর্ষণ করলো। তারপর বললো,

– ফুলগুলো নিবি না?

কদমফুলের লম্বা কান্ডের নিচের অংশ ধরে আছে বিস্ময়, আর উপরের দিকে আদ্রিকা। নেওয়ার জন্যই তো আদ্রিকা ধরে আছে, তবুও এ কেমন প্রশ্ন! আশ্চর্য মানুষ!

– নেওয়ার জন্যই তো হাত বাড়িয়েছি।
– এই ফুল নেওয়ার মানে জানিস?
– উহু।
– বৃষ্টিভেজা কদম গ্রহণ করা মানে প্রেমিকের নিবেদিত প্রেম গ্রহণ।

চকিতে আদ্রিকা হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে বিস্ময় একহাত আদ্রিকার হাতের উপর রাখলো। আদ্রিকার আর হাত ছাড়িয়ে নেওয়া হলো না।

– এভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছিস কেনো?

নাকে দড়ির কথা শুনে আদ্রিকার মনোযোগ আর এখানে রইলো না। একদল ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে হাসিহাসি করছে। সামনে পেছনে চারদিকে বিশ্রী হাসির শব্দ। তার নাকে একটা নোলক পরা। এ যুগের মেয়েরা কেউ নাকে নোলক পরে না। এমনকি মা চাচীদের কারো নাকেই আর নোলক দেখা যায় না। সবাই নাকফুল পরে, কিছুক্ষেত্রে নথ দেখা যায়। কিন্তু নোলক! এ তো কয়েকযুগ আগের কালচার। সে কথা আদ্রিকা নিজেও জানে। মাকে কয়েকবার বলেও ছিলো। কিন্তু মা তার সিদ্ধান্তে অটল। কোনোভাবেই নোলক খোলা যাবে না। এখানে তো আদ্রিকার কিছু করার নেই। ছেলেমেয়েগুলো শুধু শুধু তাকে নিয়ে মজা নিচ্ছে। অপমানে আদ্রিকার চোখ বেয়ে জল নেমেছে। কোথাও পালিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। ফিরে গিয়ে বাড়িতে কাউকে কিছু জানায়নি। দিনদিন কেমন যেনো আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। আগে যে কথাগুলো আদ্রতাকে বিনাদ্বিধায় বলে ফেলতো, এখন বলতে বড় লজ্জা করে। কলেজে একগাদা ছেলেমেয়ে তাকে হেনস্তা করেছে আর সে মুখ বুজে সয়ে গেছে এতো কোনো বাহাদুরির গল্প নয় যে রসিয়ে বলবে। সারা বিকাল একলা ঘরে কাটিয়ে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নীহারকে বড্ড সাহস করে বলেছিলো,
– মা, সবাই তো এখন নাকফুল পরে। আমি নোলকটা খুলে ফেলি?
– কতোবার বলবো ওটা খোলা যাবে না।
– খুলে নাকফুল পরি? একই তো হলো।
– একই কীভাবে হয়? বারবার এক কথা কেন বলতে হবে তোকে? নোলকটা তোর দাদীর। কতো শখ করে দিয়ে গেছে। এটা খুলে এখন তুই মৃত মানুষটাকে অপমান করবি?

আদ্রিকা উত্তর দেয় না। কি বা উত্তর দিবে? একজন মৃত মানুষের শখের দাম আছে, কিন্তু
তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে কেউ পাত্তা দেয় না৷ তার নাকে সে কি করবে সেটা নির্ধারণ করার অধিকারও নেই। আহা! জীবন। ঘুমানোর সময় আদ্রতা বলেছিলো,
– বিয়ের পর খুলে ফেলিস। স্বামীর ঘরে গেলে তখন আর বাবা-মায়ের দাপট সেখানে চলবে না। তোর জামাইকে বলবি একটা সুন্দর নাকফুল কিনে দিতে৷ তোর এই নোলক তখন আমরা মিউজিয়ামে রেখে দিবো। ঠিক আছে?

অধৈর্য্য বিস্ময় ডাকছে,
– আদ্রি, এই আদ্রি?
আদ্রিকার মাথায় শুধু নাকফুল ঘুরছে, নাকে দড়ির মতো এই নোলকটা ঘুরছে। সে বিস্ময়ের চোখে চোখ রেখে বললো,
– আমার নাকে এই নোলকটা দেখুন?
– দেখলাম।
– সত্যি করে বলুন তো, এটা পরে আমাকে কেমন দেখায়?
– মেয়েদের সাজগোজ নিয়ে আমার তেমন ধারণা নেই। তবে ঠিকঠাকই দেখাচ্ছে। কিন্তু নোলক পরার ব্যাপারটা কেমন ওল্ড ফ্যাশন।

উত্তরটা আদ্রিকার বেশ পছন্দ হলো। মন রাখতে গিয়ে অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তরে বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলে, তোকে দারুণ মানিয়েছে। আদ্রিকা জানে এটা তাদের মনের কথা নয়। মানুষ সময়ের স্রোতে গা ভাসাতে ভালোবাসে। ফ্যাশনের কথা মাথায় রেখে প্রতিনিয়ত নিজেকে বদলে ফেলে। যারা পিছনে পরে যায়, তারা গণ্য হয় ব্যাকডেটেড বলে। বিস্ময় মনের ভাব লুকিয়ে রাখেনি। যা মাথায় এসেছে তাই মুখ ফুটে বলে দিয়েছে। নোলক পরে আদ্রিকাকে খারাপ দেখায় না, সেটা আদ্রিকাও জানে। কিন্তু লোকের সামনে তাকে এই নোলক নিয়ে অস্বস্তিতে পর‍তে হয়। কী দরকার যেচে গিয়ে হাসির পাত্র হওয়ার? তাও আবার সামান্য একটা নোলকের জন্য৷ আদ্রিকার ভীষণ ইচ্ছে করে, নোলক ছাড়া তাকে কেমন দেখায় তা জানতে। কিন্তু বুঝ হওয়ার পর থেকেই নিজেকে নোলক পরা অবস্থায় দেখেছে। মায়ের মুখে শুনেছিলো, মাত্র দু বছর বয়সেই তার দাদী শখ করে ছোট নাতনীর নাক ফুটিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর নিজের নোলকটি নাতনিকে পরিয়ে দিয়েছেন। তার সম্মানার্থে সেই নোলক আদ্রিকার জীবনের সাথে পুরোপুরি ভাবে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
দক্ষ জহুরি যেমন সোনা দেখেই তার ভিতর বাহির সবটা বুঝতে পারে, মানুষ চেনার ক্ষেত্রে বিস্ময় তেমন দক্ষ। নোলক নিয়ে আদ্রিকার হীনমন্যতার খবর সে দ্রুত ধরতে পারলো। আদ্রিকা মনের কথা গুছিয়ে নিলো, সে বলবে-
বিয়ের পর আমি এই নোলক খুলে ফেলতে চাই। আপনি কি অনুমতি দিবেন?
তার আগেই বিস্ময় তাকে অবাক করে দিলো। নিজেদের মাঝে যতোটুকু দূরত্ব ছিলো তা আরেকটু কমিয়ে দিলো। এক পা এগিয়ে আদ্রিকার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বললো,
– বিয়েতে আমি তোমাকে সুন্দর একটা নাকফুল গড়িয়ে দিবো। তখন এটা খুলে ফেলো।

বিস্ময়ের মুখে তুমি সম্মোধন যতোটা না মনের ভিতর রাঙিয়ে দিলো, তার থেকেও বেশি আলোড়ন ঘটালো একটা নাকফুল গড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন।
অশ্রুসিক্ত নয়নে আদ্রিকা ভেজা কদমফুলগুলো নিজের দিকে টেনে নিলো। এবার বিস্ময় হাত ছেড়ে দিয়েছে। কারন সে জানে আদ্রিকা ফুলগুলো গ্রহণ করবে। বিস্ময়ের দীর্ঘ একমাসের কঠোর সাধণার ফলস্বরূপ, তার নিবেদিত প্রণয় গৃহিত হলো। বর্ষার ভেজা সকালে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির চোখ দুটো জলে টইটম্বুর, কিন্তু গড়িয়ে পরছে না। সে দু হাতে একগুচ্ছ কদম নিয়ে লজ্জায় রাঙিয়ে দিচ্ছে চারপাশ। ফুলগুলো নাকের সামনে ধরে বুক ভরে ঘ্রাণ নিচ্ছে।

(চলবে)