নোলককন্যা পর্ব-০৮

0
35

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
অষ্টম পর্ব

ড্রয়িংরুমের সোফা টেবিলের উপর কর্কশ শব্দে বেজে চলেছে একটি ফোন। এই এন্ড্রয়েড এর যুগে পুরনো আমলের একটি বাটন ফোন অবহেলায় পরে থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। ফোনটি এতোক্ষণ ধরে মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করার পরেও কেউ তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। এ কেমন আচরণ! নীহার রান্নাঘর হতে খুন্তি হাতে বেরিয়ে এলো। সন্ধ্যা পেরিয়ে সবেমাত্র রাত নেমেছে। রান্নার এখনো ঢের বাকি। কিছুদিন হলো আদ্রতার জ্বর সেরেছে। শারীরিক দুর্বলতার কারনে অনেকটা নেতিয়ে পরায় বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কেটে যায়। পড়াশোনা করে কিছুক্ষণ আগেই সে নিজের রুমে ঘুমিয়ে পরেছে। আদ্রিকার পড়ার চাপ তুলনামূলক বেশি। সবে কলেজে ক্লাস শুরু হয়েছে৷ নতুন বই তাই আগ্রহটাও বেশি। ইদানীং তাকে পড়ার টেবিলে বেশি দেখা যায়। রুমের দরজা খোলা থাকায় নীহার রান্নাঘরের দরজা হতেই আদ্রিকাকে দেখতে পেলো। দরজার দিকে পিঠ করে চেয়ারে বসে পড়ছে৷ রাতে ঘুমানোর সময় বাদে মেয়েরা ঘরের দরজা খোলাই রাখে৷ বাড়িতে মাত্র চারজন সদস্য। এরমধ্যে মোকাররম বেশির ভাগ সময় বাইরে অবস্থান করে৷ বাকি রইলো তিনজন, যারা প্রত্যেকেই নারী। মা-মেয়ের মাঝে আলাদা করে প্রাইভেসির প্রয়োজন কখনো দেখা দেয়নি। তাই খোলা দরজায় অবাধ আসা যাওয়া সবসময় চলে৷ নীহার মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও মেজাজ নিয়ন্ত্রণে আনলেন। তার ছোট মেয়েটা রাজ্যের বোকা, সেটি সে মেনেই নিয়েছে৷ তবুও সময় ও পরিস্থিতিভেদে আপনা থেকেই রাগ চলে আসে৷ তবে এই মুহূর্তে ছোট মেয়েকে বকা দিলে বড় মেয়ের ঘুমে সমস্যা হবে। আদ্রতা হয়তো ছোটবোনকে আগলে রাখার অঘোষিত এক প্রতিজ্ঞা করেছে। সবসময় আদ্রিকার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিপক্ষ মা-বাবা হোক কিংবা অন্যকেউ। আদ্রিকাকে বকা দেওয়া হচ্ছে শোনা মাত্রই ঘুম, ক্লান্তি সব ছেড়ে চলে আসবে। তাই নীহার কন্ঠ যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বললো,

– কখন থেকে ফোনটা বেজে যাচ্ছে। আদ্রিকা, কলটা ধর।

ওপাশ থেকে আদ্রিকা বললো,

– পড়তেছি আমি। তুমি ধরো না।
– রান্নাঘরে এতোসব রান্না একা হাতে সামলাচ্ছি। তুই সামান্য একটা কল ধরে কথা বলতে পারবি না? রান্না বন্ধ করে আমাকে যেতে হবে?
– এসব আমার ভালো লাগে না জেনেও আমাকেই বলবে।

রাগে গজগজ করতে করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তবে তার চলাচলে কোনো প্রকার আগ্রহ দেখা গেলো না। ধীর পায়ে হেলেদুলে টেবিলের কাছাকাছি আসতেই কলটা কেটে গেলো। আদ্রিকা মনে মনে বেশ খুশি হলো। যাক, আর কথা বলতে হলো না। কে কল করেছিলো সেটুকু দেখার প্রয়োজনবোধও করলো না। উল্টোদিকে ঘুরে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। সহপাঠ বইয়ের লালসালু উপন্যাস অর্ধেক পড়া হয়েছে। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলো, এরমাঝে কলটা এসে বিরক্ত করলো। চেয়ারে বসে বই হাতে নিয়ে দেখলো যাওয়ার সময় পেজ মার্ক করে যেতে ভুলে গেছে। কোন পেজ পর্যন্ত পড়েছে সেটাও মনে নেই। মনে মনে কলদাতাকে গালিগালাজ করতে করতে বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকলো। যেইনা পেজ খুঁজে পেলো ওমনি ড্রয়িংরুমের ফোনটা আবার বেজে উঠলো। আদ্রিকা শুনেও না শোনার ভান করে ঘাপটি মেরে রইলো। রান্নাঘর থেকে নীহারের গলা ভেসে আসলে আর বসে থাকা সম্ভব হলো না। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, মোকাররম যে নার্সারি থেকে অর্কিড নিয়ে আসে সেই নার্সারির মালিক কল করেছে। বাড়িতে একটাই ফোন৷ মোকাররম নিজে ফোন ব্যবহার করতে স্বাছন্দ্য বোধ করে না। তাই ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় ফোনকল নীহারকেই ম্যানেজ করতে হয়। ব্যবসা যতোটা না মোকাররম সামলায় ঠিক ততোটাই নীহার এবং এ বাড়ির সদস্যদেরও সামলাতে হয়৷ তবে সেটা অবশ্যই অন্দরমহলে অভ্যন্তরে থেকে। আদ্রিকা ব্যবসায়িক বিষয় থেকে নিজেকে দূরেই রাখে। যতোটুকু গা বাঁচিয়ে চলা যায় আরকি। সে নীহারের উদ্যেশ্য বললো,

– মা, শেকড় নার্সারি থেকে কল দিয়েছ।
– কথা বল।
– আমি কি কথা বললো? আমি ব্যবসার কিছু জানি না।
– কলটা রিসিভড করে শুনবি, কি বলতেছে। এইটুকু পারবি না! পারিস খালি গিলতে। এতো পড়াশোনা করে কি করলি? মানুষ দেখলেই ঘরে লুকায় থাকিস৷ মুখচোরা মেয়ে কোথাকার!

নীহারের সাথে কথা বলে লাভ নেই। সে যে কল রিভিভ করে কথা বলবে না, উল্টো জেদ করে আদ্রিকাকে দিয়েই কথা বলাবে সেটা আদ্রিকা বুঝে গেছে। প্রথমে ফোনটা সাইলেন্ট করে নীহারের চোখ ফাঁকি দিয়ে পা টিপে টিপে ঘরে গেলো। নিচু স্বরে আদ্রতাকে ডাকলো কিন্তু সে গভীর ঘুমে মগ্ন। গা হাত দিয়ে কয়েকবার ঝাকুনি দেওয়ার পর আদ্রতা চোখ মেলে চেয়ে দেখলো, আদ্রিকা চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে৷ হঠাৎ ঘুম ভাঙানোর কারনে আদ্রতার রাগ করার কথা কিন্তু এই মানুষটির প্রতি তার কখনো রাগ আসেনা। সে নির্লিপ্তভাবে বললো,

– কি সমস্যা?

আদ্রিকা ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো,
– শেকড় থেকে কল দিয়েছে।

আদ্রতা হাত বাড়িয়ে ফোনটি নিলো। কল রিসিভ করে কয়েক সেকেন্ড ওপাশের কথা শুনার পর “ঠিক আছে” বলে কল কেটে দিলো। আদ্রিকার মনে হলো, সে কলটা রিসিভড করে কথা বললেই পারতো। ওপাশের মানুষটার কথা শুনা খুব একটা কঠিন কাজ তো নয়। তবুও সে ফোনে কথা বলে না। ফোনে কথা বলতে তার অস্বস্তি হয়। কারো কল আসলেই হার্টবিট বেড়ে যায়, অস্থির লাগে। ফোন রিসিভ করার পর কথা বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। মাথা ফাঁকা হয়ে যায়৷ সামনে থেকে যে প্রশ্নের উত্তর সে খুব সহজেই দিতে পারবে সেটা ফোনকলের মাধ্যমে বলা তার পক্ষে অসম্ভব। আদ্রিকার ফোন ফোবিয়ার ব্যাপারটা তেমন কেউ পাত্তা দেয় না। উল্টো মাঝেমধ্যে নীহার জোর করে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আত্মীয়ের সাথে আদ্রিকার কথা বলিয়ে দেয়। সে সময় আদ্রিকার কান গরম হয়ে যায়, মাথা দপদপ করে। মনে হয় এই তো অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি বলে।

আপাতত ঝামেলা থেকে বেঁচে গিয়ে পড়তে বসলো। আদ্রতা ফোন রাখতে গিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে বেশ কয়েকটা মিসডকল। আদ্রিকাকে দেখিয়ে বললো,

– এটা কে রে? নাম্বারটা চিনিস?
– নাহ।
– কল দিয়েছিলো কয়েকবার। ধরিস নাই কেন?
– কয়েকবার দিছিলো নাকি? আমি তো একবার শুনছি। ফোন ড্রয়িংরুমে ছিলো। আমি যাইতে যাইতে কেটে গেলো।
– পাঁচ বার কল দিয়েছে। জরুরি ছিলো হয়তো।
– কল ব্যাক করে দেখো।
– নাহ থাক। অল্প ব্যালেন্স শেষ আছে। শেষ হয়ে গেলে আব্বু বকবে।
– তাও ঠিক। বিশ টাকা রিচার্জ করে মাস কাটিয়ে দেও। আবার যাবতীয় নার্সারিতে, ক্লায়েন্টকেও কল দেও। কিন্তু ব্যালেন্স যাতে শেষ না হয়।
– বাদ দে। তুই পড়।
– তুমি কই যাও? ঘুম হয়ে গেলো?
– অসময় ডাক দিয়ে এখন আবার জিজ্ঞাসা করতেছিস? মাথা ব্যাথা করতেছে। চা খাবো।
– ওহ! ওভাবে ডাকা ঠিক হয়নি। স্যরি।

‘চুপকথা’-য় কিছু অঘোষিত নিয়ম আছে। এই যেমন, সোফার টেবিলে একটা স্যামসাং এর বাটন ফোন অবহেলায় পরে থাকে। কারো প্রয়োজনে লাগছে না বলে, যে কেউ চাইলেই ফোনটা তুলে গেম খেলতে পারবে না। ফোন হাতে নেওয়া মাত্রই সবার নজর সেই ব্যক্তির দিকে নিবদ্ধ থাকে। সে ফোনে কি করছে, কতোক্ষণ ফোন তার হাতে ছিলো, কাকে কল দিচ্ছে, কি কথা হচ্ছে? সবকিছুর প্রতি সুক্ষ্ম নজরদারি৷ ফোন সারাদিন টেবিলে পরে থাকলে সমস্যা নেই, কিন্তু কেউ ব্যবহার কর‍তে গেলে অনেক সমস্যা।
নীহার রান্নাঘরে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিলো মেয়ের ঘরে। যুবতী মেয়ের মা সে, এইটুকু সচেতন থাকতে তো হবেই। আদ্রতা ফোনে কথা বলেছে, সেটি তার নজর এড়িয়ে যায়নি। মেয়ে রান্নাঘরে আসতেই সে ঘটনা জানার জন্য উশখুশ করতে লাগলো।কিন্তু সরাসরি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করছে না। আদ্রতা যদি ভাবে মা সন্দেহ করছে কিংবা নজরদারি করছে। তা হলে মন খারাপ করবে। অথচ এই নজরদারির ব্যাপারটা সবাই বুঝতে পারে কিন্তু অবুঝের মতো আচরণ করে এড়িয়ে যায়৷ আদ্রতা মায়ের দিকে পাত্তা না দিয়ে পাশের চুলায় চায়ের পানি বসালো। নীহারের রান্না প্রায় শেষ। সে কথা শুরু করার বাহানা খুঁজতেছিলো। অসময়ে চা বানাতে দেখে বললো,

– বিকালবেলা চা খাইলি। এখন আবার কেনো চা বানাচ্ছিস?
– মাথা ধরছে।
– আরেকটু ঘুমাইলে পারতি। উঠলি কেন? রান্না শেষ হইলে ডেকে দিতাম।
– আদ্রিকা ডেকে দিলো। শেকড় থেকে কল দিছিলো।
– কি বললো?
– অর্ডারের অর্কিডগুলা কালকে পাঠায় দিবে৷ ওদের ম্যানেজার আসবে দিতে৷ উনার কাছে পেমেন্ট করে দিতে বলছে।
– এই সামান্য কথাটা গাধী মেয়েটা শুনতে পারে নাই। তোকে ডাকতে গেছে!
– বাদ দেও তো। বাচ্চা মানুষ, ফোন থেকে দূরে থাকাই ভালো।
– বাচ্চা! দুই বছরের বড় ছোট তোরা। সামনে আঠারোতে পরবে। আর কবে বড় হবে ও? ওর বয়সের মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে দিব্যি সংসার করে খাচ্ছে।
– আগে বিয়ে হোক, সেও সংসার করবে।
– শ্বশুরবাড়িতে আমার নাম ডুবাবে। লোকে বলবে মেয়েকে কোনো শিক্ষা দেই নাই। এখন থেকে মাঝেমধ্যে ওর হাতে ফোন ধরায় দিবি। কথা বলা শিখুক। পথে ঘাটে একটু একলা না ছাড়বি। না হলে শিখবে কেমনে?
– আচ্ছা সে না হয় করবো। তুমি চা নেও। রান্না কতোদূর তোমার?
– এই হয়ে গেছে।
– আব্বু আসলো না এখনো!
– দেরীতেই আসুক। বাড়ি আসলেই চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিবে। তোরা আগেই খেয়েদেয়ে ঘরে চলে যা। সে এসে চুপচাপ খেয়ে ঘুমায় পরলে শান্তি।
– অযথা চিল্লাচিল্লি না করে ঘুমাইতে গেছে কখনো? অসম্ভব কল্পনা করো তুমি।

দু হাতে দুটো চায়ের মগ হাতে নিজের ঘরের দিকে গেলো আদ্রতা। আদ্রিকার সাথে চা খেতে খেতে গল্প করছিলো। কিছুক্ষণ পর নীহারও এসে বসলো। মোকাররম না আসা পর্যন্ত এভাবে প্রতিদিন গল্পের আসর চলতে থাকে। মা-মেয়ে মিলে এইটুকু সময় প্রাণভরে বাঁচে৷ নিজেদের কথা বলে, সারাদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলে, পাড়াপড়শির কথা বলে, নীহারের বাল্যকালের গল্প শুনে। তাদের তিনজনের জগতটা ভীষণ সুন্দর এবং স্বস্তিদায়ক, যতোক্ষণ না মোকাররম আসে।

(চলবে)