নোলককন্যা পর্ব-০৯

0
28

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
নবম পর্ব

ভূবনভোলা একাডেমিকের ভেতরে প্রবেশ করলে সামনেই একটা বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের দেখা মিলে। বৃহদাকার এই গাছটির বয়স অর্ধশতক পেরিয়েছে৷ এই তো কিছুদিন আগেই ঝলসে দেওয়া রোদকে উপেক্ষা করে সূর্যের থেকেও বেশি তেজ নিয়ে ফুটে থাকতো টকটকে কৃষ্ণচূড়া ফুল৷ গাছের দিকে তাকালে মনে হতো রক্তে ছেয়ে গেছে আকাশের একটি অংশ৷ ভূবনভোলা একাডেমিকের কলেজ এবং ভার্সিটি দুটো এরিয়ার প্রতিটি কোণায় ঘাসের দেখা মিলে। এখানে ঘাসের চাষ হয়৷ ঘাস পরিচর্যার জন্য বেতনভুক্ত কর্মচারী রয়েছে। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে যখন চারদিকের গাছপালা পর্যন্ত পুড়ে যাচ্ছিলো তখনও ভূবনভোলার ভূমিতে লিকলিকিয়ে বেড়ে চলেছে সবুজ ঘাস। কলেজ সেকশনের অধ্যক্ষ মহাদয় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিদিন সকাল বিকাল ঘাসে পানি দেওয়ার কাজটি পর্যবেক্ষণ করেন৷ রোজ দুবেলা পানির সংস্পর্শে এসে ঘাসগুলো কোন লজ্জায় নেতিয়ে পরবে? তারা সূর্যের তাপের সাথে লড়াই করে প্রতিবার জিতে যায়। সবুজ সতেজ ঘাসের উপর যখন রক্ত রাঙানো কৃষ্ণচূড়া ঝরে পরে, সে এক দেখার মতো দৃশ্যই বটে৷ শত শত কৃষ্ণচূড়া ঝরে পরে তৈরি হয় সবুজের উপর লাল ফুলের বিছানা। গ্রীষ্ম বিদায় নিয়েছে, বর্ষা এসেছে। ফুলে ভরা সেই যৌবন পেরিয়ে গেলেও গাছটির রুপে খুব একটা ভাটা পরেনি৷ সবুজ পাতায় ভরা গাছটি ধরনীর বুকে বিশাল ছায়া ফেলেছে। তারই নিচে অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিস্ময়। চঞ্চল চোখজোড়া কখনো হাত ঘড়ির দিকে, আবার কখনো প্রবেশ পথে। অবশেষে যুগ যুগান্তর পেরিয়ে প্রকৃতিতে শীতল বাতাস বইতে শুরু করলো। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে থাকলেও বিস্ময়ের বুক এতোক্ষণ গ্রীষ্মের চনচনে রোদে খাঁ খাঁ করছিলো। আদ্রিকার দেখা মিলতেই সেই বুকে শীতল বাতাসের ঝাপটা এসে লাগলো। এক ছুটে গিয়ে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আদ্রিকার পাশে আদ্রতাকে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। আদ্রতা বলেই নিজের মনের লাগাম টেনে ধরলো। অন্য কেউ হলে বিস্ময় আজ কাউকে পরোয়া করতো না৷ কতোদিন হয়ে গেলো আদ্রিকার সাথে ঠিকঠাক কথা হয় না৷ মেয়েটা কেমন যেনো! সেই যে হ্যাঁ বলে গেলো তারপর থেকে বিস্ময় আদ্রিকার সান্নিধ্য পেতে মরিয়া হয়ে আছে। অথচ আদ্রিকা আগের মতোই শান্ত, স্থির। কাছে আসার অস্থিরতা নেই, দুচোখ ভরে দেখার তৃষ্ণা নেই৷ পথ চলতে ফিরতে সামনাসামনি হয়ে গেলে শুধু মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে৷ এতোটুকুতে বিস্ময় সন্তুষ্ট নয়। এভাবে এমন করে প্রেম হয় নাকি!
আজও বিস্ময়কে দেখে লাজুক হেসে আদ্রিকা ক্লাসের দিকে চলে গেলো। আদ্রতা নিজের ডিপার্টমেন্টের দিকে যাওয়ার পথে সিনিয়রকে দেখে নিয়মমাফিক সালাম দিলো। বিস্ময় সালামের উত্তর দিয়ে পড়াশোনার হালচাল জিজ্ঞাসা করে বিদায় নিলো। দ্রুত পায়ে ডিপার্টমেন্টের দিকে গেলেও আদ্রতার মনের ভেতর কেমন খুঁত খুঁত করছে। কথা বলার সময় বিস্ময়কে দেখে মনে হলো তার ভীষণ তাড়া। অথচ কিছুক্ষণ আগেও তাকে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলো। হঠাৎ কার জন্য এতো মরিয়া হয়ে উঠলো? গেটে প্রবেশের সময় আশেপাশে কেউ ছিলো না। শুধুমাত্র তারা দু’বোনই ভেতরে আসলো। বাড়ি থেকে বের হতে আজ দেরী হয়ে গিয়েছিলো। তাই সবার শেষে তারা এসে পৌঁছেছে। তাহলে কি আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো? নিজের ভাবনার বাহার দেখে নিজেই নিজেকে ধমকে উঠলো। কী সব অদ্ভুত চিন্তা! বিস্ময় আকাশের চাঁদের মতো মূল্যবান। চাঁদের গায়ে কলঙ্কের দাগ যতো বেশি হয়, তার প্রতি আকর্ষণ ততোই বাড়তে থাকে। সদা সতর্ক থাকতে গিয়ে আজকাল সবাইকে সন্দেহ হয়৷ নিজেকে অসুস্থ কোনো মানুষ মনে হয় আদ্রতার। ভালো থাকাতেই তার ভয়।

কলেজের সীমানার ভেতর ঢুকে বিস্ময় তার বড় বড় পা ফেলে খুব দ্রুত আদ্রিকার কাছাকাছি পৌঁছে গেলো। খপ করে বাম হাতটা ধরে মুক্তমঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলো৷ খোলা মাঠের একপাশে বিশাল চারকোণা উঁচু মঞ্চ। চারদিকেই রয়েছে মঞ্চে উঠার সিঁড়ি। আউটডোর প্রোগ্রাম, আনঅফিশিয়াল প্রোগ্রাম, ক্লাবগুলোর মিটিং সহ বড় ছোট প্রোগ্রামগুলো মুক্তমঞ্চেই আয়োজন করা হয়৷ সবসময় শিক্ষার্থীদের পদচারণায় ব্যস্ত থাকে মুক্তমঞ্চ। কপোত-কপোতীরা নিজেদের মধুর সময় উপভোগ করতে ব্যস্ত। একপাশে ক্লিন ফ্রম রুট ক্লাবের সদস্যরা তাদের পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করছে। অন্যদিকে একদল ছেলেমেয়ে গীটারে সুর তুলে গাইছে,

“গাজা খাবো আটি আটি
মদ খাবো বাটি বাটি
ফেন্সি খেলে টাস্কি খেয়ে যাই ও মিরাবাই গাজার নৌকা পাহাড়তলী যায়….”

বন্ধুদের সেই দলটির পাশে বসলো আদ্রিকা ও বিস্ময়। কোলাহলের মাঝে তাদের কেউ আলাদা করে খেয়াল করবে না৷ গানে ব্যস্ত ছেলেমেয়েগুলো এখন নিজেদের মাঝে মত্য। আদ্রিকা বসে ছটফট করতে লাগলো। অশান্ত চোখজোড়া চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ অথচ বিস্ময় শুধু তার দিকে চেয়ে আছে। আদ্রিকার মাথা ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বিস্ময় বললো,

– এদিক ওদিক কাকে দেখছিস? আমার দিকে তাকা। আমাকে তোর দেখতে ইচ্ছে করে না?

বিস্ময়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো আদ্রিকা। এ প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দিবে সে! বিস্ময়ও ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নয়। আবার প্রশ্ন করলো,

– সত্যি আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? কী আজব! এদিকে আমি একাই তোকে একপলক দেখার জন্য চাতক পাখির মতোন ঘুরতে বেড়াচ্ছি। বড্ড নিষ্ঠুর তুই।
– কখন বললাম,দেখতে ইচ্ছে করা না? রোজ তো দেখি। আপনি গেইটের আশেপাশেই দাঁড়িয়ে থাকেন।
– তুই আমাকে খুঁজিস তাহলে?
– হুম।
– কখনো বলিস নি কেনো?
– কি বলবো?
– এই যে আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে, কথা বলতে ইচ্ছে করে।
– কথা বলতে গেলে কেউ দেখে ফেলবে৷ এখানে যে এভাবে কথা বলছি, আপুর কানে গেলে আমি শেষ।
– সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নিজের নিজের কাজ করছে। তোর মতো বয়ফ্রেন্ডকে ফেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে না।
– ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাইরে বসে আছি। টেনশন হচ্ছে।
– একদিন ক্লাস না করলে কিছু হবে না। প্রেম করলে এমন অনেক ফাঁকি দিতে হয়।
– সেকেন্ড ক্লাসটা অনেক জরুরি৷ ওটা করতে হবে৷ প্রথম ক্লাসের পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আপনার কথা শেষ হবে না? এরপরে ক্লাসে চলে যাবো।
– আমার কথা মানে? শুধু আমার ইচ্ছার কারনে তুই এখানে বসে আছিস? তোর নিজের ইচ্ছে নেই। থাক, তোর এখানে বসে সময় নষ্ট করার দরকার নাই৷ তুই ক্লাসে চলে যা।

বিস্ময় অভিমানে মুখ ফিরিয়ে বসলো। আদ্রিকা পরলো বিপাকে। কখন কী বলতে হয় আজও শিখতে পারলো না। প্রেম শুরুর পর আজকেই প্রথম একান্তে বসে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আজই রাগিয়ে দিলো। রাগী মানুষকে প্রচন্ড ভয় পায় আদ্রিকা। কিন্তু তাই বলে চুপ করে বসে থাকলে তো চলবে না। কিছু বলতে গেল যদি বাবার মতো আরও বেশি রেগে যায়? গায়ে হাত উঠালে? ভয়কে একপাশে রেখে বিস্ময়ের দিকে হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নিলো। এভাবে কীভাবে একজন পুরুষ মানুষের গায়ে হাত দিবে! আলতো কন্ঠে ডাকলো,
– শুনুন?

বিস্ময় ফিরেও তাকালো না। হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নেওয়া! মোটেও তাকাবে না। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করলেই ধরা দিবে। যেমন গাঢ় ঘি তার জন্য তেমনই বন্দোবস্তো তো করতেই হবে। রাগ করে এখান থেকে উঠে চলে গেলে কী ব্যাপারটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে? এসব ভাবতে ভাবতেই বাহুতে আঙ্গুলের খোঁচা অনুভব করলো। তাকিয়ে দেখলো আদ্রিকার ডান হাতের তর্জনী তার বাহুতে খোঁচা দিচ্ছে। সে তাকাতেই দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হলো বিস্ময়ের। রাগ যেনো আরও বেড়ে গেলো।

– আমি কি অচ্ছুত? আমাকে ছুঁলে তোর জাত যাবে?
– আবার কি করলাম?

মাথা নিচু করেও জবাব দিলো আদ্রিকা। ওর ভীষণ খারাপ লাগছে। কোথায় ভুল করছে নিজেই বুঝতে পারছে না। চোখে জলের ধারা নামলো বলে। কণ্ঠ স্যাঁতস্যাতে হয়ে গেছে। বিস্ময় সেদিকে পাত্তা দিলো না। সভ্য করে তুলতে একটু আধটু কষ্ট দিতেই হবে।

– ওভাবে আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে একপ্রকার অপমান করলি। এভাবে কেউ কোনো মানুষকে ডাকে! তাও আবার নিজের বয়ফ্রেন্ডকে।
– মুখে ডাকলাম, জবাব দিলেন না।
– হাত নাই তোর?

চাপা কন্ঠে একটা ধমক দিয়ে বলতেই আদ্রিকা কেঁপে উঠলো। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বিস্ময়ের থেকে একটু দূরেই চেপে বসলো। বলা যায় না, রেগে গিয়ে বাবা যেভাবে মাকে থাপ্পড় মা রে, বিস্ময়ও যদি ওমন একটা থাপ্পড় দেয় ও তো এখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। ওর আতংকে চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে বিস্ময় বুঝে গেলো আজকের জন্য অনেক হয়েছে। এখানেই থামতে হবে। চেহারা দেখে মনের অবস্থা বুঝে ফেলার অদ্ভুত ক্ষমতার জন্য নিজেকে নিয়ে সে বেশ গর্ববোধ করে। মেয়েদের মন বুঝে ফেলার মতো অসম্ভব কাজটা সে রপ্ত করতে পেরেছে বলেই মেয়েগুলোকে পুতুলের মতো নাচাতে পারে৷ নিজেকে শান্ত করে চেহারায় ইনোসেন্ট একটা ভাব এনে বললো,

– আজকে একসাথে অনেকগুলো ভুল করে ফেলেছিস। তবুও আমি ক্ষমা করে দিতে রাজি আছি। আমার আবার দয়ার শরীর৷ কিন্তু বিনা শাস্তিতে মাফ পেয়ে গেলে তোর ভুলগুলো শুধরাবে না। তাই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
– কি?
– কম্পেনসেশন বুঝিস?
– হ্যাঁ।
– তোর কম্পেনসেশন হলো, তুই এখন আমার হাত ধরবি এবং হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকবি।

আদ্রিকার মুখটা ক্ষণিকেই চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো হয়ে গেলো। বিস্ময় একটু ছুঁলেই সে লজ্জায় নুইয়ে যায় এখানে তো নিজে থেকে হাত ধরার ব্যাপার। মাথার ভিতর ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ কান দুটোতে অতিরিক্ত গরম লাগছে৷ জ্ঞান হারিয়ে না ফেললেই হলো। আদ্রিকাকে নিশ্চলভাবে বসে থাকতে দেখে বিস্ময় আবার বললো,

– প্রেম করছি অথচ দুজনে বসে আছি শ’ক্রোশ দুরত্ব বজায় রেখে৷ মাসখানেকের বেশি হয়ে গেলো আমাদের সম্পর্কের এখনো হাতটা ধরতে পারলাম না।
– একটু আগেও হাত ধরে এখানে নিয়ে এলেন।
– ওটা প্রয়োজনের খাতিরে ছিলো। বাসের হেলপারও যাত্রী উঠা-নামার সময় হাত ধরে। ওইরকমভাবে হাত ধরাতে কোনো অনুভূতি নেই।
– বললেই হলো। বাসের হেলপারকে হাত ধরবে দেবো কেনো?
– ওরে বোকা! ওটা যাস্ট উদাহরণ। ওসব বাদ দে। তুই এখন মন থেকে অনুভব করে আমার হাতটা একটু ধর না, প্লিজ। তোর তৃষ্ণায় আমি কবে যেনো মরেই যাই।
– কীসব অলক্ষুণে কথা!

কপট রাগ দেখালেও ভেতরে ভেতরে ভেঙেচূড়ে যাচ্ছে মেয়েটা। মন থেকে হাতে হাত রাখার বাসনা জাগলে যেমন ভয়ংকর একটা ভালোলাগা কাজ করে সেটা ওর হচ্ছে না। বরং মাথার ভেতর প্রচন্ড চাপ অনুভব করছে। তবুও প্রেমিকের দাবী তো মানতেই হবে। প্রেমে কি এমনই হয়? জানা নেই আদ্রিকার। বিস্ময় বাম হাতে সিঁড়ির উপর ভর দিয়ে বসে ছিলো। আদ্রিকা তার কাঁপাকাঁপা হাতটি সেই হাতের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো। বিস্ময়ের লম্বা হাতের উপরে রাখলো নিজের ডান হাত। দুজনের হাতের সাইজের মধ্যে পার্থক্য অনেকটা। বিস্ময়ের বৃদ্ধাঙ্গুলী পর্যন্ত এসে ঠেকেছে আদ্রিকার তর্জনী। আদ্রিকা যখন নিজের হাতের সাথে বিস্ময়ের হাতের পরিমাপ করতেন ব্যস্ত বিস্ময় তখন খুব যত্ন করে ডান হাতে আদ্রিকার হাতটা তুলে নিলো। এরপর হাতটি নিজের দুহাতের মধ্যে রেখে বুকের কাছে আকড়ে ধরলো। মুখে হাসি ফুটিয়ে আদ্রিকাকে জিজ্ঞাসা করলো,

– খারাপ লাগছে?

আদ্রিকা লজ্জায় মাথা নুইয়ে শুধু ডানে বামে মাথা ঝাঁকালো। বিস্ময় আবার বললো,
– হাত ছেড়ে দিবো?

আদ্রিকা ওভাবেই আবার মাথা ঝাঁকালো। বিস্ময় ছোট্ট সেই হাতটা টেনে মুখের কাছে নিয়ে এসে আঙ্গুলে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আদ্রিকা হালকা কেঁপে উঠলো। মুখে গোলাপী আভা দেখা দিলো। সত্যি আর খারাপ লাগছে না। মনের ভেতর হাজারো প্রজাপতি নেচে বেড়াচ্ছে। উত্তেজনায় হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেলো। বিস্ময় নিশ্চয়ই ওখান থেকে বসেই ওর বুকের ধুকপুক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। লজ্জায় মুখটা আরও নত হয়ে গেলো।
বিস্ময় ছোট হাতটা একহাতে ধরে রেখে অন্য হাতে আদ্রিকার হাতের আঙ্গুল ছুঁয়ে দিচ্ছিলো।

টুংটাং গীটারের শব্দ, খালি গলায় গানের আওয়াজ, ক্লিন ফ্রম রুট ক্লাবের সভাপতির বজ্রকন্ঠের ভাষণ, সদস্যদের তর্ক বিতর্ক, প্রেমিকের খুনসুটিতে প্রেমিকার হৃদয় উজার করা হাসি – চতুর্দিক হতে ভেসে আসা শব্দের মাঝে বসে আদ্রিকা-বিস্ময়ের মনে হচ্ছে তারা নির্মল বাতাসে শান্ত প্রকৃতির কোলে একান্তে বসে আছে। ইহজগতে কেউ নেই, তারা দুটি প্রাণ বাদে। বাতাসে আদ্রিকার বেণুনী থেকে ছুটে যাওয়া কয়েকটি চুল উড়াউড়ি করছে। অবাধ্য চুলগুলো বাম হাতে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বললো,

– আমি এখন যাই? এই ক্লাসটা মিস করলে খুব সমস্যায় পরে যাবো। প্রথম ক্লাসের পড়াটা কীভাবে কালেক্ট করবো সে চিন্তায় মাথা ধরে গেছে।
– ক্লাসের নোট মেঘা তোকে দিয়ে দিবে। টেনশন নিচ্ছিস কেনো?
– আপনি মেঘাকে চিনেন?
– চিনবো না কেনো। আমার নজর সবদিকে আছে। ভূবনভোলায় কোন ব্যক্তিটিকে আমি চিনি না?
– আপনাকেও তো সবাই চিনে। জনপ্রিয় মানুষ আপনি।
– এই জনপ্রিয় মানু্ষটা একান্ত আপনার ম্যাডাম।

এই প্রথম আদ্রিকার নিজেকে নিয়ে সামান্য অহংকার হলো। রুপকথার রাজকুমারের মতো ছেলেটা সত্যি তার সামনে বসে আছে। বাইক নিয়ে ভূবনভোলার আনাচে-কানাচেতে দাঁপিয়ে বেড়ানো ছেলেটা যখন মেয়েদের পাশ দিয়ে যায় প্রত্যেকের বুকে বসন্তের বাতাস বয়ে যায়। বিস্ময় যখন বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসে গানের আসর বসাতো কলেজ-ভার্সিটি উভয় সেকশনের শিক্ষার্থীরা মুহূর্তেই সেখানে জটলা বাঁধিয়ে ফেলতো। কলেজে আসার পর আদ্রিকাও দূর থেকে একবার দেখেছিলো। কখনো কল্পনাও করেনি সেই মানুষটির সাথে পাশাপাশি বসার সুযোগ হবে। অথচ আজ সেই রুপকথার রাজকুমার একান্ত তার।

– তোদের বাড়িতে ফোনটা এখনো আছে নাকি বেঁচে ঝালমুড়ি কিনে খেয়েছিস?
– হুম?
– কালকে কতোবার কল দিলাম। কেউ রিসিভ পর্যন্ত করলো না। আজব মানুষজন!
– আপনি কল দিয়েছিলেন? কখন? কেনো? এক মিনিটি, আপনি ফোন নাম্বার কোথায় পেলেন? জানলেন কি করে আমাদের বাড়িতে ফোন আছে?
– তোর বুদ্ধির বাহার দেখে আমার হাসতে হাসতে কান্না পাচ্ছে৷
– কেনো?
– আজকাল কোন বাড়িতে ফোন নেই? সবার হাতে হাতে এন্ড্রয়েড।
– আমাদের বাড়িতে ফোন ব্যবহার নিষেধ। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গত বছর স্যামসাং এর একটা বাটন ফোন কেনা হয়েছে। সেটা প্রয়োজনের বাইরে হাত দিয়ে ছোঁয়াও বারণ।
– ওটা কি ঘর সাজানোর জন্য রেখেছে? কাজে যখন লাগছে না, জলে ফেলে দিস না কেনো?
– বাবার ব্যবসায়িক কল আসে।
– তাহলে তোর বাবা পারসোনাল ফোন ইউজ করলেই পারে। ওটাকে বাড়িতে ফেলে রেখে নিজে বাজারে ঘুরে।
– ফোন বাবার পছন্দ না৷ তাই সাথে নেয় না। আমাদের হাতে ফোন দেখলেই বকা দেয়। জরুরি কল ছাড়া ওটা টেবিলেই পরে থাকে।
– আমিও জরুরি প্রয়োজনে কল দিয়েছিলাম।
– কি প্রয়োজন?
– তোকে খুব মনে পরছিলো। তোর কন্ঠস্বর শোনার জন্য অস্থির হয়ে একের পর এক কল করে গিয়েছি কিন্তু তুই পাত্তাই দিলি না।
– সর্বনাশ! অন্য কেউ রিসিভ করলে?
– তুই তো ধরতে পারতি। একটু রিস্ক নিতেই হলো।
– আমি কখনোই ধরতাম না। আম্মু অথবা আপু সবসময় কল রিসিভ করে কথা বলে।
– তোকে ফোন ধরতে দেয় না?
– আমি নিজে থেকেই ধরি না। ফোনে কথা বলতে ভালো লাগে না।
– এখন থেকে বলবি। আমার রোজ কল দিবো।
– অসম্ভব। ফোনের আশেপাশে সবাই থাকে। ধরা পরে যাবো।
– যখন কেউ থাকবে না তুই একটা মিসড কল দিস। আমি কল ব্যাক করবো। তুই শুধু হ্যালো বললেই হবে। ওইটুকু শুনলেই আমার মন শান্ত হয় যাবে।
– কী অদ্ভুত কথা! ফোন নাম্বার কে দিলো আপনাকে?
– আমার সিক্রেট সোর্স আছে। ওসব বলা যাবে না।

আরও কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বিস্ময় ফোনের টুকটাক ফাংশন আদ্রিকাকে শিখিয়ে দিলো। আগে যেহেতু কখনো ফোন ব্যবহার করেনি তাই শুরু থেকেই বুঝাতে হলো। মিসড কল দেওয়া, কললিস্ট থেকে নাম্বার মুছে ফেলা, মেসেজ ডিলিট করা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শেখানোর পর একটা কাগজে নিজের মোবাইল নাম্বার লিখে আদ্রিকার হাতে ধরিয়ে দিলো৷ দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। থার্ড ক্লাসের আগে আদ্রিকা পেছনের দরজা দিয়ে চুপিচুপি ক্লাসে প্রবেশ করে মেঘার পাশে বসে পরলো। মেঘা খুব সুন্দর করে দুটো ক্লাসের নোটস করে রেখেছিলো। যা আদ্রিকার হাতে তুলে দিয়ে টিফিন পিরিয়ডে আবার পড়া বুঝিয়ে দিলো। আদ্রিকার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো। এই বুঝি মেঘা কিছু জানতে চাইবে। কিন্তু ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপারে মেঘা কিছুই জিজ্ঞাসা করলো না। মেঘা আগাগোড়া সবই জানে। বিস্ময়ের সাথে হয়তো যোগাযোগ আছে৷ নীরবতায় উত্তর খুঁজে নিলো আদ্রিকা।