নোলককন্যা পর্ব-১০+১১

0
30

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
দশম পর্ব

ড্রয়িংরুমের মেঝেতে উলের কার্পেট বিছানো, তার উপরে পা দিতেই মনে হবে তুলোর মধ্যে পা ডুবে যাচ্ছে। বিদেশে নামীদামী ব্র‍্যান্ডের আরামদায়ক সোফা সেট, দেয়ালজুড়ে বিশালাকার টিভি। সামনে বসলে থিয়েটারের অভাব অনুভব হবে না৷ কর্ণার টেবিলে চিনামাটির ফুলদানিতে তাজা ফুল। গোলাপ, রজনীগন্ধা, বিভিন্ন ধরনের অর্কিড একেকদিন একেক ফুল শোভা পায়। সকাল হতেই বাসী ফুল সরিয়ে নতুন ফুল রাখার কাজটি বাড়ির ভৃত্যদের আয়ত্তে নেই। এই কাজটি গৃহকর্ত্রী নিজেই করেন। ফুলের মার্কেট থেকে বাছাইকৃত তাজা ফুল নিয়ে আসেন বাড়ির পুরনো ভৃত্য। আলো আঁধারের খেলা চলে ড্রয়িংরুম জুড়ে৷ জানালার ভারী পর্দা গুলো বাতাসে দুলতে থাকে। লুকোচুরির মাঝে কখনো মিষ্টিরোদ পর্দার আড়ালে উঁকি দেয়। এমনই পরিবেশে বড় হয়েছে পরখ। সেই ছেলে আজ কোথায় পরে আছে!
ইবনূল ইবতেহাজ আরেকবার ড্রয়িংরুমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। খুবই সাদামাটা বাড়িটির ড্রয়িংরুমের বেশিরভাগ স্থান ফাঁকা। একপাশে কিচেন এবং বাথরুম৷ ইবনূল ইবতেহাজ বসে আছেন ড্রয়িংরুমের একটি সোফার উপর৷ ডাবল সীটের এই সোফাটিকে আসলে চেয়ার বলাই বোধহয় ভালো হবে৷ কাঠের উপর কোনোরকম গদি বসানো। সামনে একটি ছোট্ট কাঠের টেবিল। ড্রয়িংরুমের আরেকপাশের দেয়ালজুড়ে বিশালাকার জানালা। বন্ধ জানালার থাইগ্লাস ভেদ করে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন ধু ধু মাঠ৷ সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলেন। অফিসের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে পরখ বেরিয়ে এলো। হাতের বীন ব্যাগটি সোফা থেকে একটু দূরে রেখে সেখানে বসলো। ইবনূল ইবতেহাজ নিজের পাশের ফাঁকা স্থানটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাবার পাশে বসতেও ছেলের অনীহা। ছেলের উদ্দেশ্যে কড়া কিছু কথা বলা উচিত কিন্তু স্পষ্টবাদী, বদমেজাজি ইবনূল ইবতেহাজ একমাত্র ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাস, মনোবল হারিয়ে ফেলেন। অনেক ভেবেচিন্তে কথা গুছিয়ে তারপর শব্দ উচ্চারিত হয়। অন্যদিকে পরখ মেরুদণ্ড সোজা করে বসে মাথা উঁচু করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে৷ একদম স্বাভাবিক, আত্মবিশ্বাস, আত্ম অহংকারে ভরা। শীতল কন্ঠে বললো,
– কি প্রয়োজন, বলো।

ইবনূল ইবতেহাজ নিজেকে সামলে নিলেন। গলা পরিষ্কার করে বললেন,
– কোনো প্রয়োজন ছাড়া বাবা ছেলের সাথে দেখা করতে আসতে পারে না?
– ওই যে বললে দেখা করতে আসার কথা। বাবা ছেলের মাঝে সম্পর্ক যখন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ছেলেকে দেখার জন্য আয়োজন করে বের হতে হয়, শিডিউল ঘেটে সময় বের করতে হয় তখন কিছুই আর স্বাভাবিক থাকে না।
– ছেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলে তাকে দেখার জন্য বাবাকে আসতেই হয়। কারণ ছেলে ভুলে গেছে তার পরিবার আছে, বাবা মা জীবিত আছে, কিছু দায়িত্ব কর্তব্য আছে।
– দায়িত্ব, কর্তব্য, সম্পর্ক সবকিছু ছেড়েই বেরিয়ে এসেছি। অযথা কিছু প্রত্যাশা না করলে খুশি হবো। কি প্রয়োজনে এসেছো সেটা বলো। আমাকে বের হতে হবে৷

ইবনূল ইবতেহাজ আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আজকাল শ্বাস নেওয়ার পরিবর্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলা তার নিত্যকর্মে পরিণত হয়েছে। ছেলে তাকে তাড়া দেখাচ্ছে যেনো ইবনূল ইবতেহাজ একজন বেকার মানুষ। সারাদিন শুয়ে বসে গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান। নিজের তিরিক্ষি মেজাজ সামলে নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
– আমার ছেলে হয়ে ছোটোখাটো একটা হোটেলে ইন্টার্নশিপ করছো। আমার সাথে কথা বলার প্রয়োজনবোধ করোনি৷ এর থেকেও হাই কোয়ালিটির হোটেলে ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করে দিতাম। কিন্তু সেসব তোমার পছন্দ হবে না।
– জানোই যখন নতুন করে কথা তুলছো কেনো?
– বেয়াদবের মতো কথা বলবে না। আদব কায়দা সব ভুলে গেছো। তোমার এসব হেয়ালি একদম সহ্য করবো না।

ইবনূল ইবতেহাজ এবার বুঝি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না৷ কর্কশ কন্ঠে বজ্রের ন্যায় গর্জিয়ে উঠলেন। কিন্তু পরখ দমে গেলো না। অন্য কেউ হলে হয়তো আনমনেই কেঁপে উঠতো। কিন্তু পরখ বিশালাকার নারকেল গাছের ন্যায় বজ্রপাতের সামনে অটল রইলো। পূর্বের ন্যায় শান্ত কন্ঠেই বললো,
– সহ্য হয় না, তবে সামনে এসো না।
– তোমার সাথে কথা বলা আর দেয়ালে মাথা ঠুকানো একই কথা। যাক গে সেসব। বখে যখন গেছোই এখন আর শুধরানোর সময়-সুযোগ কিছুই নেই। আমি চেষ্টাও ছেড়ে দিয়েছি। নিজের মূল্যবান সময় ব্যয় করে এসেছি। অকারণ কথা না বাড়াই। ইন্টার্নশিপ শেষ হয়ে এসেছে। এরপর কি করবে কিছু ভেবেছো?
– আমাকে নিয়ে এমন অযথা ভাবনা চিন্তা কেনো?
– যুক্তি তর্ক বাদ দিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা বলো। আমি তোমার শত্রু নই। একজন বাবা তার সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত থাকবে, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববে এটাই স্বাভাবিক। এখানে বরং তোমার আচরণ অনুচিত, দৃষ্টিকটু। আমার একমাত্র ছেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, থাকছে বিরানভূমির মাঝে এক ভূতুড়ে বাড়িতে। আমার বিশ্বাস তোমার ভার্সিটি কিংবা কাজের জায়গায় তুমি নিজের সঠিক পরিচয় দেওনি৷ যদি দিতে তাহলে এমন সস্তা হোটেলে ইন্টার্নশিপ করতে হতো না। গোবেচারা টাইপ জীবনযাপনে কী খুঁজে পাও আমি বুঝি না। হেঁটে যাতায়াত করো, লোকাল বাসে ধাক্কাধাক্কি সহ্য করো, সস্তা খাবারের দোকানের নোংরা খাবার খাও, বাড়ি বাড়ি ঘুরে টিউশন করাও- তুমি কি ভেবেছো আমার কাছে খবর পৌঁছায় না? এসব অনাচার করে তুমি কি শান্তি পাও তা তুমি ভালো জানো। গ্যারেজে লাখ টাকার গাড়ি পরে আছে, ব্যাংক জমানো টাকা, প্রতিমাসে তোমার ক্রেডিট কার্ডে ব্যালেন্স আসছে অথচ তুমি সেসব এড়িয়ে যাচ্ছো৷ শুধুমাত্র আমাকে ছোট করা, অপমান করার জন্য এমন করে থাকলে এসব এবার বন্ধ করো। যথেষ্ট হয়েছে৷ সোসাইটিতে আমার যা সম্মান ছিলো তা তোমার কারনে অলরেডি হারিয়ে ফেলেছি। যারা চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেতো না তারা আজ তাচ্ছিল্যের স্বরে মাথা উঁচু করে জানতে চায় আমার ছেলের কি খবর। তোমার কারনে, শুধুমাত্র তোমার কারনে আজ ইবনূল ইবতেহাজকে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে বাঁচতে হয়। তুমি আমাকে কতোটা অপমানিত করেছো, হেয় করেছো তা জানো না৷ কখনো ফিল করতে পারবে না। যতদিন না নিজে বাবা হবে ততোদিন বুঝতে পারবে না। বরাবরই তোমার জেদ, একরোখা স্বভাব এবং গোয়ার্তমির কারনে আমাকে হেনস্তা হতে হয়েছে। আমার একমাত্র সন্তান তুমি, কখনো কোনোকিছুতে বাঁধা দেইনি৷ ঘরে ভালো লাগছে না, একা থাকতে চেয়েছ। আমি কিছু বলিনি৷ অফিসে জয়েন করতে বললাম কিন্তু তুমি আত্মনির্ভরশীল হবে৷ টিউশনি করিয়ে, কোচিং-এ পড়িয়ে নিজের খরচ চালিয়েছো। তাও মেনে নিলাম। পড়াশোনা শেষ, এবার ছেলেমানুষী ছাড়ো। দায়িত্ব নেওয়ার মতো যথেষ্ট বয়স তোমার হয়েছে৷ আমারও বয়স বসে নেই। অনেক হলো এবার বিশ্রাম নিতে চাই। ব্যবসার হাল তোমাকেই ধরতে হবে।

এতোক্ষণ চুপচাপ কথা শুনে গেলেও এবার ছটফট করে উঠলো পরখ। চঞ্চল হলো দৃষ্টি। ইবনূল ইবতেহাজ তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করছেন ছেলেকে। মুহূর্তেই পরখ নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– তোমার ব্যবসায় আমার আগ্রহ নেই। আমার নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা আছে৷ আমি সে অনুযায়ী এগিয়ে যেতে চাই।
– আমার তিলে তিলে গড়া সাম্রাজ্য আমার পরে তোমাকেই সামলাতে হবে৷
– তোমার ভাইয়েরা মুখিয়ে আছে। তাদের দায়িত্ব দেও। আমার আগ্রহ নেই।
– ছেলে হিসেবে তোমার কোনো দায়িত্ব নেই?
– বাবা হিসেবে তুমি যতোটা দায়িত্ববান ছেলে হিসেবে আমিও ঠিক ততোটাই দায়িত্বশীলতা দেখাচ্ছি।
– তাহলে তুমি নিজের সিদ্ধান্ত বদলাবে না?
– নাহ৷

ইবনূল ইবতেহাজ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কিছুক্ষণ চোখ বুঝে সোফায় মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলেন। এরপর টেবিলের উপর রাখা গ্লাস থেকে পানি পান করলেন। উনাকে এখন বেশ ফুরফুরে এবং প্রানবন্ত দেখাচ্ছে। ক্ষণিকের মাঝে বাবার এমন পার্থক্য দেখে পরখ অভ্যস্ত। এতক্ষণ যে মিষ্টি কথায় ছেলেকে ইমোশনালভাবে কাবু করতে চেয়েছিলেন তাও পরখ জানে। এবার মূল অস্ত্র বের করবেন। তাই এমন নিস্তব্ধতা। খানিক বিরতি। পরখ যা জানার অপেক্ষায় ছিলো তার দিকেই এগিয়ে গেলেন ইবনূল ইবতেহাজ। সব রাগ, ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলে কোমল কন্ঠে বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন,
– কবে যাচ্ছো তাহলে?
– সামনের মাসে।
– হাতে সময় বেশি নেই। সব গুছিয়ে নিয়েছো? কোনো হেল্প লাগবে?
– অলমোস্ট কমপ্লিট। আই ক্যান ম্যানেজ মাইসেল্ফ।
– ফাইনান্সিয়াল কোনো হেল্প?
– লাগবে না।
– হুম। সেল্ফ-ডিপেন্টডেন্ট। গুড জব। পাসপোর্ট-ভিসা অল ক্লিয়ার?

পরখ থমকালো, খানিকটা ভড়কালোও বুঝি। তারপর বরফ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিজের জন্মদাতার দিকে৷ বিশ্বাস করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়, তবুও আশ্চর্য হলো, কষ্ট পেলো। মাথার দুপাশে শিরাগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে লাফালাফি করছে। এতোদিনের পরিশ্রম এভাবে বৃথা যেতে পারে না। এই মুহুর্তে রেগে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে পরিস্থিতি বিগড়ে যেতে পারে। শান্ত মস্তিষ্কে ভাবতে হবে৷ পরখ দ্রুত ক্যালকুলেশন করছে। ইবনূল ইবতেহাজ শান্ত। মুখশ্রীতে প্রশান্তির ছাপ। ছেলে তার বোকা নয়। শুধু একটু জেদী, একগুঁয়ে। পথে আনতে গেলে তাই একটু আধটু কঠোর, অমানবিক হতে হয়। পরখ যখন বললো, কী চাই তোমার? তিনি পরিকল্পনা মোতাবেক গুটি ফেললেন।

– হায়ার স্টাডিজ-এর জন্য যেতে চাইছো, যাও। বাবা হয়ে ছেলের স্বপ্নকে খু ন করতে পারি না৷ তবে তুমি যেহেতু বাবাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে জানো না৷ দেন লেটস হ্যান্ডেল ইট লাইক এ্যা বিজনেস ডিল।
– স্লিট ইট।
ইবনূল ইবতেহাজ টেবিলের উপর কনুই ঠেকিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বসলেন। ছেলের চোখে চোখ রেখে বললেন,
– দেশে ফিরে ব্যবসার হাল ধরবে। লাইক এ গুড সান ইউ উইল টেক ওভার মাই এম্পায়ার এন্ড ইউ উইল রান ইট, গিভ ইট ইউর হান্ড্রেড পারসেন্ট এফোর্ট।
– পাসপোর্ট কবে ফেরত পাচ্ছি?
– আমার অফার পছন্দ হলে ফ্রি সময়ে বাড়ি চলে এসো। তোমার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করবে। তোমার মন আবার কখন বদলে যায় বলা মুশকিল। পিউ অনেকদিন ধরে ছেলেকে দেখেনি বলে মন খারাপ করে আছে। বারবার বায়না করছে ছেলেকে এনে দেও। মায়ের সাথে দেখা করে এসো সেই সাথে ঘরে ফেলে আসা পাসপোর্টও নিয়ে আসবে। হাউ ইট সাইন্ডস?
– পারফেক্ট।

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
একাদশ পর্ব

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকল অলসতা ঝেঁকে বসে। যদিও নিয়ম মেনে খুব সকালে ঘুম ভেঙে যায় কিন্তু রুটিন অনুসারে নিত্যকর্মে ভাটা পরায় বিছানা ছেড়ে উঠা হয় না। চোখ বন্ধ করে বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে মন ভরে গেলে নয়টার দিকে হেলেদুলে নাস্তার টেবিলে বসে আদ্রতা এবং আদ্রিকা। রান্না ঘরে কড়াইয়ে খুন্তি চালাতে ব্যস্ত নীহার। সাপ্তাহিক ছুটির সবার জন্য বহাল থাকলেও বাড়ির গৃহিণীর জন্য এমন কোনো ছুটি নেই। তাদের রোজকার জীবন একই নিয়মের মাঝে বন্দী৷ নেই কোনো গ্রীষ্ম-বর্ষা, ঈদ-পার্বণ, ফ্লাইডে-হলিডে। তাদের জন্য প্রতিটি দিন ওয়ার্কিং ডে৷ তাই প্রতিদিনের মতো আজও নীহারকে ভোরবেলা বিছানা ছাড়তে হয়েছে৷ অন্যদিনের তুলনায় বরং আজ কাজ বেশি। সকালের নাস্তা খেয়ে মোকাররম বেড়িয়ে গেছে গ্রামের দিকে কিছু চারা আনতে হবে। নার্সারির যাবতীয় পণ্য পরিবহনের কাজের দায়িত্ব রওশন আলীর ছোট লরি ট্রাকের। কিছুদিন আগে একবার গিয়ে সুপারির চারা দেখে এসেছিলো রওশন আলী। মোকাররম নিজে থেকে আর চেক করার ঝামেলা করতে চায়নি। আজ একেবারে রওশন আলীকে সাথে নিয়ে লরিতে চেপে গেছে চারাগুলো নিয়ে আসতে৷ নীহার তাকে নাস্তা করিয়ে মেয়েদের জন্য রুটি তৈরি করে হটপটে রেখে দিয়েছিলো। এখন দ্রুত হাতে সবজি গরম করে নিচ্ছে। ঠান্ডা তরকারি দু বোনেই খেতে চায় না।

নাস্তা শেষে ঘর পরিষ্কারের টুকটাক কাজে লেগে গেলো দু বোন। শুক্রবার মানেই কাপড় ধোঁয়া, ফার্নিচার পরিষ্কার করা, ফ্লোর মুছা এসব কাজের দিন। কাজ শেষে লাঞ্চের পর ভাত ঘুমের জন্য এক বিছানায় শুয়ে আছে নীহার এবং তার দুই মেয়ে। আদ্রিকার চোখে ঘুম নেই তবুও সে চোখজোড়া বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে এককোণে শুয়ে আছে। আজ সারাদিন একবারও মোবাইল চেক করার সুযোগ পায়নি। বিস্ময় নিশ্চয়ই খোঁজ করেছিলো। শুরুতে মোবাইলে কথা বলায় অস্বস্তি হলেও এখন আদ্রিকা চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষার প্রহর গুনে। যদিও জড়তা এখনো কাটেনি৷ কল রিসিভড করে সে চুপ করে থাকে। কথা যা বলার বিস্ময় নিজেই বলে। টুকটাক প্রশ্নের হ্যাঁ বা না এমন উত্তর দেয় মাঝেমধ্যে। বিস্ময়ের কখনো শেষ না হওয়া গল্পগুলো শুনতেই আদ্রিকার ভালো লাগে। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, বন্ধুমহল এসব নিয়ে তার অনেক গল্প আছে। প্রতিদিন মজার মজার অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে বসে আর আদ্রিকার অধির আগ্রহে শোনে। আজ শুক্রবার, আদ্রতা সারাক্ষণ আশেপাশেই ঘুরছে। বোনের সান্নিধ্যে থাকা মেয়েটির এখন একলা কিছু সময় খুঁজে৷ একটা নিজের ঘর হলে বেশ হতো। ফিসফিসিয়ে বিস্ময়ের সাথে কথা বলতে হতো না। সতর্ক নজর দরজার দিকে রাখতে গিয়ে বিস্ময়ের কন্ঠের মাদকতায় ডুবে যাওয়া হয় না।

বিছানার অপরপ্রান্তে নির্ঘুম আদ্রতা। দোটানায় মন উচাটন হয়ে আছে। বিকল্প আজকাল একটু বেশি বেপরোয়া আচরণ করছে। আদ্রতার সাড়া পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এদিকে মাহিন সেদিনের ঘটনার পর জোর দিচ্ছে বিয়ের আলোচনায়। মোকাররম মজুমদারের কাছে নতুন করে প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। ধারালো ছুরির উপরে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে আদ্রতা। যেকোনো সময় কেঁটে রক্তাক্ত হবে নগ্ন পা। ফলাফল জানা সত্ত্বেও এই পথে হাঁটতে সে বাধ্য৷ এর মাঝে অসম্ভবের স্বপ্ন দেখা এক যুবক বিকল্প৷ আদ্রতা নামক যে মরীচিকার পেছনে সে ছুটছে, সেই মেয়েটি আসলে পায়ে বেড়ী পরানো একজন কয়েদি মাত্র। যার জেল হাজতের পরোনা জারি হয়েছে অনেক আগেই, এখন শুধু হাজতবাসের সূচনা বাকি।

বিছানায় শেষের দিকে প্রস্থ বরাবর শুয়ে আছে নীহার। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর দু চোখে ভেঙেচূড়ে আসছে ঘুম। তবুও সে সচেতন রেখেছে শ্রবণ ইন্দ্রীয়। কিছু ক্যাকটাস নেওয়ার জন্য একজনের আসার কথা। মোকাররম জানিয়ে গিয়েছে বিকালবেলা একজন মহিলা আসবে কিছু ক্যাকটাস নিতে৷ নীহার যেনো বাড়ির ভেতরে থাকা ক্যাকটাসগুলো দেখায়। বাইরে নার্সারির দিকে যাওয়ার দরকার নেই। সেই থেকে নীহার সারাদিন সদর দরজার দিকে নজর রেখেছে। এখন তীব্র ঘুমের সাথে লড়াই করে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন সে। এর মাঝে সদর দরজায় কারের হর্ণ শোনা গেলো। ঘুম ঘোরে নীহার সেই শব্দ শুনলেও চোখজোড়া খুলছে না। মস্তিষ্ক নিজেও খানিক বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত। একবার, দুবার শব্দ শোনার পর আদ্রিকা উঠে পরলো। গায়ে ঝাকুনি দিয়ে ডেকে তুললো নীহারকে। আদ্রিকার কন্ঠ শুনে আদ্রতার হালকা তন্দ্রাভাব কেটে গেছে। সেও উঠে বসলো। নীহার বাইরে গিয়ে দেখলো কার হতে একজন মহিলা নেমে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাহ্যিক দর্শনে যেকেউ বলে দিতে পারবে তিনি একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের গৃহকর্ত্রী। নীহার তাকে বাড়ির পূর্বদিকের বাগানে নিয়ে গেলো। যেখানে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ক্যাকটাস। ভদ্র মহিলা ঘুরে ঘুরে পুরো বাগান দেখলেন। যদিও উনার শুধু কয়েকটি ক্যাকটাস নেওয়ার কথা ছিলো কিন্তু এখন তিনি নতুন ছাদবাগানের জন্য কিছু ফুল গাছ নিতে চাচ্ছেন। রঙ্গন, হাসনাহেনা, শিউলি, অলকানন্দা, স্পাইডার লিলিসহ কয়েকটি গাছের একটি করে চারা নিলেন। ব্যবসায় টুকটাক হেল্প করতে হয় জন্য নীহার মাঝেমধ্যে মোকাররমের সাথে কথার ছলে গাছের চারার দাম জেনে নেয়। এছাড়াও ব্যবসার যাবতীয় আলোচনা মোকাররম নিজেই নীহারের সাথে করে। তাই মোকাররম যতোটা নার্সারি সম্পর্কে অবহিত নীহারও ততোটাই। তবুও যাওয়ার সময় মোকাররম ক্যাকটাসের সাইজ অনুযায়ী বিক্রিত মূল্য নীহারকে জানিয়ে গেছে। ভদ্রমহিলার নেওয়ার কথা ছিলো কয়েকটি ক্যাকটাস, এখন তিনি ক্যাকটাসের সাথে নিচ্ছেন প্রায় দশটি ভিন্ন গাছের চারা। সে অনুযায়ী বিবেচনা করে নীহার বিক্রিত মূল্যে কিছু ছাড় দিলো। এতে অবশ্য যথেষ্ট লাভ অবশিষ্ট রয়েছে। ভদ্রমহিলা খুশি হয়ে চলে গেলেন। কার ড্রাইভার একটি ভ্যান ডেকে চারা গাছগুলো ভ্যানে তুলে দিলো।

রাতে মোকাররম বাড়ি ফিরলো তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে৷ বাবার গোমড়া চেহারা দেখে আদ্রতা, আদ্রিকা দুজনেই নিজের ঘরে ঘাপটি মেরে আছে। তাদের নিঃশ্বাসের শব্দও বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে না। নীহার দ্রুত হাতে চুলায় চায়ের পানি বসালো। কড়া লিকার দিয়ে এক কাপ রঙ চা চেয়েছে মোকাররম। গোসল থেকে বেরিয়েই চায়ের কাপ তার সামনে চাই। নীহার গ্যাসের চুলার আগুন বাড়িয়ে দিলো। চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে এক কাপ চা নিয়ে গেলো ঘরে। মোকাররম তখনো বাথরুম থেকে বের হয়নি। সে আবার ফিরে এসে মেয়েদের ঘরে প্রবেশ করে আদ্রতাকে বললো,
– রান্নাঘরে চা আর মুড়ি মাখা রাখা আছে। নিয়ে এসে দুবোনে খেয়ে নে।
আদ্রতা পা টিপে টিপে রান্নাঘরে থেকে চা, মুড়ি মাখা নিয়ে এসে আবার দরজা চাপিয়ে দিলো।
মোকাররম গরম তিতকুটে চায়ে চুমুক দিয়ে গ্রামে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বর্ণনা করলো।
গ্রামের এক বাড়িতে গিয়েছিলো সুপারি গাছের চারা আনতে৷ রওশন আলীর কাছে শুনেছিলো চারাগুলোর উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট। সেই অনুযায়ী সে চারার দাম নির্ধারণ করে ডিল ফাইনাল করেছিলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলো চারাগুলো বড়জোর তিন ফুট উচ্চতার। সেই অনুযায়ী সে দ্বিগুণ দাম দিয়ে ফেলেছে। বাগান মালিকের সাথে কথা বলে কোনো লাভ হয়নি। তিনি কোনোভাবেই দর-কষাকষি করবেন না। চারা নিতে হলে নির্ধারিত মূল্যেই নিতে হবে। লরি নিয়ে গ্রামে যেতে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। যাতায়াতের খরচ পরেছে অনেক। এখন খালি হাতে ফিরে আসা মানে বিশাল অঙ্কের টাকা গচ্চা যাওয়া। তাই সে বাধ্য হয়ে নির্ধারিত মূল্যেই চারাগুলো নিয়ে এসেছে। মোকাররম আবারও আফসোস করে বললো,
– এখন এই একশত চারা কোনো লাভ ছাড়াই কেনা দামে বিক্রি করতে হবে। সারাদিন নার্সারি, দোকান দুটোই বন্ধ রাখতে হলো। জার্নিতে শারীরিক ধকলের কথা না হয় বাদ দিলাম৷ চর্তুরদিকে শুধু লস আর লস।

কথা মাঝে বিরক্ত করা মোকাররম পছন্দ করে না। সে যখন কথা বলে তখন সবাই চুপ থাকে। এমনকি বাড়িতে কোনো প্রকার শোরগোল তার পছন্দ না। তাই পুরোটা সময় নীহার মনোযোগ দিয়ে কথা শুনে গেলো। কথা শেষ হওয়ার পর বললো,
– বাদ দেও। যা হবার তা হয়ে গেছে। এরপর থেকে নিজে দেখে যাচাই করে তারপর অর্ডার দিও।
– আমার এতো সময় আছে? একদিকে নার্সারি সামলাও অন্যদিকে সারের দোকান। একা মানুষ কয়দিকে যাবো! তোমরা বাড়িতে বসে বসে খাওয়া পাচ্ছো। টাকা ইনকাম করতে গেলে বুঝতা। মানুষের কথার আজকাল কোনো দাম নাই। পাঁচ ফুটের চারা তিন ফুট হয়ে গেলো। আগে কতোবার এভাবে চারা কিনছি তখন তো এমন হয় নাই।
– কখনো হয়নি জন্য কখনো হবে না, এমন তো নয়। ব্যবসায় সাবধান থাকা জরুরি। এরপর থেকে নিজে উপস্থিত থেকে চারা কিনিও।
– ব্যবসা বন্ধ রেখে এখন আমি গ্রামে গ্রামে গিয়ে চারা কিনবো! বেশি বুঝো তুমি। এজন্য লোকে বলে মেয়ে মানুষের কথা শুনে চললে ব্যবসা বানিজ্য ভেসে যাবে। অযথা কথা বলে।

নিজের ভুল বুঝতে পেরেও তর্ক করে, ধমক দিয়ে পার পেয়ে যাওয়া মোকাররমের স্বভাব। এখন যুক্তি তর্ক করতে গেলে তার মেজাজ আরও খারাপ হবে। গালাগালি, মারামারি পর্যন্ত গড়াবে। তাই নীহার চুপ হয়ে গেলো। জেদি পুরুষ মানুষকে ভালো মন্দ বুঝাবে কে! তার ব্যবসা সেই ভালো জানে। লাভ হোক, লস হোক তবুও সে নিজের মতো করে চালাবে। নীহারের শুধু চোখে মেলে তামাশা দেখে আফসোস করা ছাড়া কিছু করার নেই৷
কিছুক্ষণ পর মোকাররম নিজেই বললো,
– ক্যাকটাসের চারা নেওয়ার জন্য আসার কথা ছিলো। আসছে?
– হ্যাঁ। বিকালের দিকে আসছিলো।
– কয়টা ক্যাকটাস নিছে?
– পাঁচটা।
– যাও টাকা নিয়ে আসো।

নীহার আলমারি থেকে টাকা এনে মোকাররমের হাতে দিলো। তার মুখে চাপা হাসি লুকোচুরি খেলছে৷ পাঁচটি ক্যাকটাসের জায়গায় সে আজকে দুই হাজার টাকার চারা বিক্রি করে ফেলেছে। অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য কাজ। যেখানে সারাদিন নার্সারি বন্ধ ছিলো, এর মাঝে নীহারের জন্য কিছু আয় তো হয়েছে৷ মোকাররম মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে খুশি হবে এইটুকু নীহার জানে। স্বামীর অভিব্যক্তি জানার জন্য উৎসুক হয়ে সে চেয়ে আছে। মোকাররম চায়ের কাপ রেখে টাকা গুণে দেখলো দুই হাজার টাকা। সে মুখ নীহারকে প্রশ্ন করলো,
– এখানে তো দুই হাজার টাকা৷ আর কি বিক্রি করেছ?
– মহিলাটি বাগান ঘুরে দেখে বললেন আরও কিছু ফুলের চারা নিবেন৷ মোট দশটি গাছের চারা আর পাঁচটি ক্যাকটাস নিয়েছেন।

মোকাররম সবকিছু শুনলো। কোন কোন গাছের চারা নিয়েছে তা জেনে মনে মনে দ্রুত হিসাব কষে দেখলো একুশশত পঞ্চাশ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু তার হাতে দুই হাজার টাকা৷ সে নীহারকে বললো,
– বাকি টাকা কোথায়?
– আর কীসের টাকা?

মুহূর্তেই নীহারের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। মোকাররম টাকাগুলো টেবিলে রেখে বললো,
– দশটা ফুলের চারা চৌদ্দ’শ টাকা৷ পাঁচটা ক্যাকটাস সাড়ে সাত’শ। মোট কতো হয়?
– একুশ শত পঞ্চাশ।
– এখানে কত আছে?
– দুই হাজার।
– বাকি দেড়’শ কই?
– ক্যাকটাসগুলো দেড়শ টাকা দেয়নি। দাম কম রাখার জন্য বারবার বলতেছিলো দেখে একশত বিশ টাকা করে নিয়েছি৷ আরও তো কিছু চারা নিলো। এইটুকু কম তো রাখাই যায়।

মহিলা মানুষের হাতে ব্যবসা ছেড়ে দিলে এমনই হাল করে ছাড়ে। যেখানে সে নিজে সকালবেলা দেড়শ টাকা পিস বলে গেছে সেখানে এই মহিলা কোন সাহসে দাম কমালো? দাম কমানো মূল কথা নয়। এইখানে ব্যাপার হলো নীহার তার কথা অমান্য করার সাহস দেখিয়েছে৷ ক্রোধে মোকাররম টেবিলের উপরের রাখা মুড়ির বাটিটি নীহারের দিকে ছুড়ে মারলো। নীহারের মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে স্টিলের বাটিটি ফ্লোরে তীব্র শব্দ করে পরে গেলো। ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পরলো মুড়ি, চানাচুর৷ স্টিলের বাটিটি তখনও ঝনঝন শব্দে ফ্লোরে ঘুরছে। হতম্বভ নীহার মাথায় প্রাপ্ত আঘাত অনুভবের অবস্থায় নেই। সে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরেছে। মোকাররম ঘরের চারদিকে চেয়ে দরজার পেছনে ফ্লোর পরিষ্কার করার ঝাড়ুটি দেখতে পেলো। ঝাড়ুটি নিয়ে এসে উল্টোদিকে ধরে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে নীহারকে পরপর কয়েকটি আঘাত করলো। দুটি আঘাতের পরেই নীহার ফ্লোরে লুটিয়ে পরেছে৷ মোকাররম তখনো থেমে থাকেনি। সে এবার পায়ের সাহায্যে তীব্র লাথি দিতে থাকলো ফ্লোরে লুটিয়ে পরা নীহারের গায়ে৷

পাশের ঘরে নিঃশব্দে বই পড়ছিলো আদ্রতা এবং আদ্রিকা। একটু একটু করে মুড়ি নিয়ে মুখে পুরছিলো তারপর এক চুমুক চা পান করছে। হঠাৎ তীব্র শব্দ ভেসে এলো পাশের রুম থেকে। ফ্লোরে বাসন পরার আওয়াজ চিনতে ভুল হয়নি আদ্রতার। সাথে সাথেই সে সচেতন হয়ে গেলো। একটু পরেই ভেসে এলো মোকাররমের বিশ্রী গালির শব্দ। সে একবার আদ্রিকার দিকে চেয়ে দেখলো। বিছানায় বসে থরথর করে কাঁপছে। সে আদ্রিকাকে বললো,
– ঘর থেকে বের হবি না। এখানেই থাক।

এরপর দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আদ্রতা না বললেও আদ্রিকা ঘর ছেড়ে বের হতো না। বিছানা থেকে নড়ার শক্তি তার মধ্যে নেই৷ সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বিছানার কোণে বসে বিছানার চাদর আকড়ে ধরলো। নীহারের গোঙ্গানির আওয়াজে তার চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। মোকাররমের মুখ হতে নির্গত প্রতিটি অকথ্য ভাষা কানের পর্দায় ভারী আঘাত হানছে। সে দু হাতে কান চিপে ধরলো।

আদ্রতা যখন দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো তখন নীহার একেরপর এক আঘাতে কুপোকাত। ফ্লোরে লুটিয়ে পরে গোঙ্গাচ্ছে আর কাঁদছে। মোকাররম তার পিঠের উপর ঝাড়ুর অগ্রভাগ দিয়ে প্রহার করছে।
– মা*গী নাং দেখলে তোর হুশ থাকে না। আমি কি বলে গেছি সেই কথা তোর মনে ছিলো না? কোন সাহসে তুই দাম কমাইলি? তোর নাং লাগে? বসে বসে খাবার পাচ্ছিস, শরীরে চর্বি জমছে। শুয়োরের বাচ্চা, তোর বাপের বাড়ি থেকে আনছিস চারা? আধা আধুরা দামে গিয়ে দিলি। শালী পাড়ায় পাড়ায় ঘুরিস আর নাগর জুটাইস। তোর এতো বন্ধু আসে কই থেকে?….

আদ্রতার গা রি রি করে উঠলো। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে মোকাররমকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।
– থামো। কি শুরু করছো তোমরা! আশেপাশে মানুষজন কিছুই দেখো না৷ পাড়ার লোকে কি বলবে!
নীহারকে দাঁড় করিয়ে আড়াল করে দাঁড়ালো আদ্রতা। মোকাররম নিজেকে সামলে আবার চড়াও হলো নীহারের উপর। সামনে আদ্রতাকে পেয়ে বললো,
– সামনে থেকে সর জানোয়ারের বাচ্চা।
আদ্রতা সরলো না। সেও কন্ঠে ঝাঁঝ মিশিয়ে বললো,
– নিজের ব্যাবসা নিজে সামলাও। আমাদের কাজ পছন্দ না তো আমাদের দায়িত্ব দিয়ে গেছো কেন?
মুখে মুখে তর্ক মোকাররমের কোনাকালেই পছন্দ না। এই মুহূর্তে মেয়ের মুখের কথা আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো। নীহার সেই অবস্থাতেই আদ্রতাকে চুপ করার জন্য জোরাজুরি করছে। কিন্তু তা পাত্তা না দিয়ে আদ্রতা নিজের মতো বলে গেলো। মোকাররম তার হাতে থাকা ভেঙেচূড়ে যাওয়া ঝাড়ু দিয়ে কয়েক ঘা আদ্রতার পিঠে বসিয়ে দিলো।
– বসে বসে খেয়ে কলিজা বড় হয়ে গেছে। মুখে মুখে তর্ক করতেছিস! আমি কষ্ট করে ইনকাম করবো আর তোরা ঘরে বসে খাবি! এক টাকার বাজার আসবে না আর। শুয়োরের বাচ্চারা, বের হ আমার বাড়ি থেকে।

চোখের সামনে যুবতী মেয়েকে মার খেতে দেখতে কোনো মায়ের সহ্য হবে না। নীহার নিজের শরীরের ব্যথা ভুলে গেলো। মেয়েকে নিয়ে কোনোরকম দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পাশের ঘরে ডুকে দরজায় ছিটকিনি দিলো। ক্ষুব্ধ মোকাররম তার হাতের থাবায় দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে। একের পর এক লাথি, ধাক্কা দিচ্ছে আর দরজা খুলে দিতে বলছে। সে কোনোরকম এই বেয়াদব বউ, বাচ্চাকে নিজের ঘরের ঠাঁই দিবে না। আজই ঘরছাড়া করবে। ঘরের ভিতরে বিছানায় লুটিয়ে পরেছে নীহার৷ ফ্লোরে অস্থির হাঁটাচলা করছে আদ্রতা। তার বাম হাতে ভীষণ জ্বালা করছে। ঝাড়ুর কাঠি ঢুকে গিয়েছিলো। টেনে বের করার পর এখন রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পরছে৷ দরজায় প্রতিটি আঘাতের সাথে চমকে উঠছে বিছানার কোণে গুটিশুটি হয়ে থাকা আদ্রিকা। নীহার এক হাত বাড়িয়ে আদ্রিকার হাত চেপে ধরলো।

(চলবে)..