নোলককন্যা পর্ব-১২+১৩

0
31

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
দ্বাদশ পর্ব

রোজকার মতো ভূবনভোলা শিক্ষার্থী,শিক্ষক,কর্মচারীদের পদচারণায় পরিপূর্ণ। প্রত্যেকে নিজেদের মতো ব্যস্ত। ক্যান্টিনে চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে, চলছে বন্ধুদের আড্ডা। মুক্তমঞ্চে গিটারিস্টের আঙ্গুলের ছোয়ায় সুর উঠছে, গলা ছেড়ে গাইছে বন্ধুর দল। অফিসরুমে শিক্ষকদের মধ্যে চঞ্চলতা, ক্লাস শুরু হলো বলে। বিস্ময় দাঁড়িয়ে আছে মাঠের এককোণে। তার বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে চতুর্দিকের বাহারী মানুষগুলোকে দেখছে। আজকাল আদ্রিকার সাথে তার সামনাসামনি কথা হয় না। মেয়েটা ক্লাস শুরু হওয়ার আগমুহুর্তে ক্যাম্পাসে আসে। দৌড়ে ক্লাস রুমে চলে যায়। বিস্ময় শুধু দূর হতে এক পলক দেখে। চোখে চোখ মিলে, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে। এতোটুকুতে অদ্ভুত প্রশান্তি। আদ্রিকার চোখে মুখে ফুটে উঠা হাসিটুকু দেখেই বিস্ময়ের মন ভালো হয়ে যায়। রাতে একটা নির্দিষ্ট সময় ফোনকলে কথা হয় দুজনার। সপ্তাহখানেক ধরে এই রুটিনই চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মূলক ফটক দিয়ে প্রবেশ করলো আদ্রিকা ,আদ্রতা। আদ্রিকা মাথা তুলে ঠিক সেই মাঠের কোণে তাকালো। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির চোখজোড়া তারই দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় নুইয়ে পরলো আদ্রিকার চোখজোড়া। বিস্ময়ের চোখের মাদকতায় সে প্রতিবার হারিয়ে যায়। পাশে আদ্রতা কিছু একটা বলছিলো, আদ্রিকা সেসব শুনতে পেলো না। যে পথে কলেজ-ভার্সিটি সেকশন আলাদা হয়ে যায়, সেখানে এসে আদ্রতা আদ্রিকার কাধে হাত রেখে তার একদম সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
– মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করবি। ক্লাস শেষ হলে সোজা এখানে চলে আসবি। একসাথে বাড়ি যাবো।

উত্তরে আদ্রিকা শুধু মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। আদ্রতা তার ব্যাগ থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে আদ্রিকার হাতে দিয়ে বললো,
-টিফিন টাইমে ক্যান্টিনে গিয়ে নাস্তা করে নিস।

এবার সে আর আদ্রিকার উত্তরের অপেক্ষা না করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে ভার্সিটি বিল্ডিংয়ের দিকে পা বাড়ালো। আদ্রতা চলে যেতেই আদ্রিকার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো বিস্ময়ের বাইক। বসন্ত বাতাসের মতো মনে দোলা দিলো কিছু ভালোলাগা। তার রাঙ্গা মুখের পাণে তাকিয়ে কিছু দূর এগিয়ে গেলো বিস্ময়ের বাইক। আদ্রিকা এবার নিজ গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালো। হাতে সময় বেশি নাই। আজকাল বাড়ির পরিবেশ থমথমে। তাই অতি সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে হয়।
আদ্রতা মাত্র কয়েক পা এগিয়েছে, হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালো বিকল্প। সে হকচকিয়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে কঠোর চোখে তাকালো। বিনিময়ে পেলো বিকল্পের হাসিমাখা মুখের দেখা। ছেলেটা কি কোনো কিছুতেই বিরক্ত হয় না? এতো ধৈর্য্য কোথায় পায়? হতাশ আদ্রতা কন্ঠে কিছুটা ক্রোধ নিয়ে বললো,
– কি সমস্যা? এভাবে সামনে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো?
আদ্রতার মরুভূমির মতো ধু ধূয়া কন্ঠ শুনে বিকল্পের মনমাতানো হাসিটা আরেকটু চওড়া হলো। সে হাসি দেখে আদ্রতার মনের মিছে মেঘ পালাই পালাই করতে শুরু করলো। তবুও সে মুখশ্রী গম্ভীর করে উত্তরের আশায় বিকল্পের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু তাকে হতাশ করে বিকল্প ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বললো,
– চা খাবে আদ্রতা?
আদ্রতা কঠিন কিছু কথা শোনাতে চেয়েও নিজেকে সামলে নিলো। এই ছেলেকে যা কিছুই বলা হোক, তা সে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে রোদের মতো ঝলমলিয়ে হেসে উঠবে। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট করে জবাব দিলো,
– না।
পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে বিকল্প তার পিছু নিলো। এভাবে একসাথে ক্লাসরুমে প্রবেশ করলে সবার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। আদ্রতা থেমে গেলো। ক্ষনিকক্ষণ নিজেকে সামলে নিয়ে বিকল্পের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে জানতে চাইলো,
– পিছে পিছে আসছো কেনো? ক্লাসে সবার সামনে বিব্রত করতে চাইছো?
– এক কাপ চা খেতে চাইছি।
– আমি মানা করেছি।
– এতোক্ষণ ধরে অপেক্ষা করলাম, অথচ তুমি এভাবে আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছো! একসাথে বসে চা টুকুই তো খেতে চেয়েছি। বন্ধু হিসেবেই না হয় সাথে চলো।

জবাবে আদ্রতা কিছু বললো না। শুধু রাস্তা বদলে ক্যান্টিনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। সুবোধ বালকের মতো পিছু পিছু চললো বিকল্প।

বাইকের পিছনের সিটে গুটিশুটি মেরে বসে আছে আদ্রিকা। ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে। বাইকের জোরালো শব্দ না থাকলে তার হার্টবিটের শব্দ শোনা যেতো। বাইকের সামনে থাকা মানুষটি তার লাফাতে থাকা হৃদপিন্ডের শব্দ শুনতে না পেলেও কাঁপাকাঁপি করার বিষয়টি টের পেলো। হেলমেটের পেছনে মৃদু হেসে উঠলো। তবে হাসির সে শব্দ আদ্রিকা পর্যন্ত পৌঁছালো না। সে শুধু বাইকের পেছনে শক্ত করে ধরে রাখার কাজে মনোযোগ দিয়েছে। কন্ঠ সামান্য উঁচু করে বিস্ময় জানতে চাইলো,
– আদ্রি, আছিস ?
উত্তরে আদ্রিকা শুকনো গলায় হ্যাঁ বললেও সে কথা বিস্ময় শুনতে পেলো না। সে ফন্ট মিরোরে আদ্রিকার মাথা দুলানো দেখেও আবার প্রশ্ন করলো,
– কীরে? আছিস নাকি রাস্তায় কোথাও টুপ করে পরে গেছিস?
এবার আদ্রিকা হেলমেটের পেছন থেকে একটু জোরেই বললো,
– আছি। পরে যাবো কেনো?
– বলাও তো যায় না। পরে যেতেও পারিস। বসেছিস তো আমার থেকে দূরে এককোণে। তোর আবার যা ওজন! পালকের মতো পাতলা শরীর। বাইকের পেছনে যে কেউ বসে আছে, বুঝতেই পারছি না। বাইকে আমি একা থাকলে যতোটুকু ওজন মনে হয়, এখনও তাই মনে হচ্ছে।
বিব্রত আদ্রিকা খানিক নড়েচড়ে বসে বললো,
– আমার ওজন ছেচল্লিশ কেজি। আমাকে যে পালকের সাথে তুলনা করলেন তা কোন পালকের ওজন এমন হয়?
– ব্যাপার না। আমি একশত চল্লিশ পাউন্ড পর্যন্ত তুলতে পারি।
– কি বললেন? বুঝিনি।
– তোর বুঝতে হবে না। শক্ত করে ধরে বস।

আদ্রিকা যখন বাইক থেকে নেমে হেলমেট খুলে হাতে নিলো, চারপাশে তাকিয়ে জায়গাটি চিনতে পারলো না। শুধু বুঝতে পারলো তারা শহর থেকে কিছুটা দূরে চলে এসেছে। বিস্ময় বাইক পার্ক করে এসে আদ্রিকার প্রশ্নাতুর দৃষ্টি দেখে বললো,
– রুফটপে একটা সুন্দর রেস্টুরেন্ট আছে। এখানের বাটার নানটা অনেক ভালো। চল চল দাঁড়িয়ে রইলি কেনো?

শহরের একদম শেষের দিকে সাততলা ভবনের রুফটপে রেস্টুরেন্টটি অবস্থিত। নতুন প্রজন্ম গতানুগতিকের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করে। বিস্ময়ের বন্ধু সাজ্জাদের যখন গ্রাজুয়েশন শেষ হলো, তখন সে সবাইকে জানালো সে চাকরির পিছনে ছুটবে না। বাবার হোটেলের ব্যবসা নিয়ে কাজ করবে। শহরের একপাশে অবহেলায় একটি খাবার হোটেলে কি কাজ করবে ভেবে বন্ধুরা হেসে গড়িয়ে পরলো। কিন্তু সাজ্জাদ সেসবে পাত্তা না দিয়ে নিজের সবটুকু মনোযোগ নিবেশ করলো বাবার ব্যবসায়। বন্ধুমহল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। বাবার সাথে ব্যবসায় থাকাকালীন ব্যবসায় খুটিনাটি আয়ত্ত্ব করে নিয়ে দ্রুত নিজের একটি রেস্টুরেন্ট খুলে বসলো। মাত্র দু মাসেই এই শহরের পরিচিত হয়ে উঠলো রুফটপ রেস্টুরেন্ট।
ছাদের একদম কোণার চেয়ারে অস্বস্তিতে গাট হয়ে বসে আছে আদ্রিকা। অন্যদিকে ভীষণ আয়েশ করে অপরদিকের চেয়ারে বসে আছে বিস্ময়। কতদিন পর মেয়েটাকে এমন কাছ থেকে এতোক্ষণ ধরে দেখার সুযোগ হলো? সপ্তাহ খানেক তো হবে। তৃষ্ণিত পথিকের মতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিস্ময়। অথচ সামনে বসা মেয়েটিকে দেখো। একবারো বিস্ময়ের দিকে তাকাচ্ছে না। চোখে চোখ রাখছে না। বিস্ময় বাদে অন্য সবকিছুর দিকে তাকাচ্ছে। শুধু বিস্ময়কেই উপেক্ষা করছে। বিস্ময়ের রাগ হওয়া উচিত। তবুও তার মুখে হাসি লেপ্টে আছে। আদ্রিকার অস্বস্তি সে ভীষণ উপভোগ করে। পবিত্র, স্নিগ্ধ, আনকোরা এই মেয়েটার প্রতি ভালোবাসা প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে। নিজে হাতে ধরে ভালোবাসার পাঠ পড়ানোর পুরো জার্নি নিয়ে বিস্ময় ভীষণ এক্সাইটেড। আদ্রিকার সকল অনুভূতির প্রথম অনুভব হবে বিস্ময়। এ যেনো বিস্ময়ের সবচেয়ে বড় পাওয়া। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বিস্ময়ের চোখের তৃষ্ণা মিটে গেলে সে মেনুকার্ড হাতে নিলো। সেটি আদ্রিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– চারপাশে তাকিয়ে পেট ভরিয়ে ফেলবি নাকি কিছু অর্ডার করবি?
আদ্রিকা একবার তার সামনে ধরে রাখা মেনুকার্ডের দিকে তাকালো, আরেকবার বিস্ময়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে। মেনুকার্ড না ছুঁয়েই বললো,
– আমি কি অর্ডার করবো? আমার কোনো ধারণা নেই। আপনি অর্ডার করুন।

মেনুকার্ড রেখে দিয়ে বিস্ময় নিজে থেকে অর্ডার করলো। এখানের সেরা খাবার সম্পর্কে তার ধারণা আছে। বেশ কয়েকবার এসেছিলো। অর্ডার টুকে নিয়ে ওয়েটার চলে গেলে বিস্ময় তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো। সামনের টেবিলে হাত দুটো রেখে সোজা আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে বললো,
– অনেক কাঁপাকাঁপি করেছিস। এখন একটু রিলেক্স হয়ে বস। আর কতোক্ষণ এদিক ওদিক তাকাবি? ঘাড় ব্যথা করছে না তোর?

আদ্রিকা কোলে রাখা স্কুল ব্যাগটি দু হাতের আঙ্গুলে শক্ত করে চিপে ধরে মেরুদন্ড সোজা করে বিস্ময়ের মুখোমুখি বসলো। তবুও তার আচরণে নার্ভাসনেস উপচে পরছে। বিস্ময় পুরো ব্যাপারটা বুঝলো। তাকে স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিলো। কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,
– তোর দিকে তাকিয়ে মানুষ বলবে, আমি তোকে জবরদস্তি করে তুলে এনে এখানে বসিয়ে রেখেছি।
হালকা হেসে আদ্রিকা বললো,
– পরিচিত কেউ দেখে ফেললে?
– ওয়ার্কিং আওয়ারে রেস্টুরেন্ট মূলত ফাঁকা থাকে। কারো সাথে মুখোমুখি হওয়ার চান্স নেই। দেখতেছিস না রেস্টুরেন্ট কেমন ফাঁকা? অন্য সময় তো বসার জায়গা পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়।
– এতোগুলো চেয়ার সব ভরে যায়!
আদ্রিকার বোকা বোকা প্রশ্নে বিস্ময়ের মুখে হাসি ফুটে। সে ভীষণ আদুরে কন্ঠে জানতে চাইলো,
– তুই কখনো আসিস নি এখানে?
– আমি ! এখানে? আরে বাবা! আমাদের তো প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়াই বারণ। এখানে কেনো, আমি অন্য কোনো রেস্টুরেন্টেও কখনো যাইনি। কিছু খেতে ইচ্ছে করলে আব্বু পার্সেল করে নিয়ে আসে।
– সারাদিন বাড়িতে বসে মানুষ কীভাবে দিন কাটায়! বোর লাগে না তোদের?
– উহু। ঘুম থেকে উঠে স্কুল-কলেজ, বাড়ি ফিরে গোসল, খাওয়া-দাওয়া করে ঘুম। ঘুম থেকে উঠে আমি ছাদের বাগানের টুকটাক কাজ করি। তারপর নাস্তা করে বই নিয়ে বসি। হোমওয়ার্ক করে একটু টিভি দেখি, রাতের খাবার করে ঘুমিয়ে পরি। হয়ে গেলো দিনশেষ।
– রোজ রোজ এক রুটিন! বিরক্ত লাগে না? ফ্রি টাইমে কি করিস তোরা?
– বাগানের কাজ করি, টিভি দেখি, লুডু খেলি। আপু অবশ্য উপন্যাস পড়ে। আমাকে ওসব পড়তে দেয় না।
– বাহ ! চমৎকার। ছুটি কাটাস কীভাবে? কোথাও ঘুরতে যাইস না?
– যাই তো। নানু বাড়ি যাই।
– হুম। ঘুরতে যাওয়ার জন্য দারুন জায়গা।

বিস্ময়ের আর বেশি অবাক হওয়া হলো না। এরমাঝে খাবার চলে এলো। বাটার নান, কাবাব এবং গ্রিল চিকেন। এরমাঝে বিস্ময়ের সাথে আদ্রিকা অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। বিস্ময় দুজনের খাবার পরিবেশন করতেই আদ্রিকা বেশ আগ্রহ নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। খেতে খেতে টুকটাক কথাও বলছে।
– আপনি তো চলে যাচ্ছিলেন। এর মাঝে হঠাৎ কি হলো? দুম করে এসে সামনে বাইক থামালেন। কী যে ভয় পেয়ে গেছিলাম!
– ফিরে যেতে যেতেও মনটা তোর কাছে ছুটে যাচ্ছিলো। তাই ভাবলাম, ছোট্ট জীবনে মনটাকে এতো কষ্ট কেনো দেই! ফিরে গেলাম তোর কাছে।
– আমি তো ক্লাসে প্রায়ই পৌঁছেই যাচ্ছিলাম। পৌঁছে গেলে কি করতেন তখন?
– ক্লাস থেকে নিয়ে আসতাম।
– ইশ! বললেই হলো। এই রে! কোনোভাবে আপু টের পেয়ে গেলে ? আপু তো ক্যাম্পাসেই আছে।
– টের পাবে না। তোর আপু নিজের কাজে ব্যস্ত।
– মানে?
– মানে নিজের ক্লাসে ব্যস্ত। তুই এসব রেখে আমার কথা তো একটু ভাবতে পারিস। এতোদিন ধরে তোকে ঠিকঠাক দেখতেও পাচ্ছি না। এক পলক দেখতেই হারিয়ে যাস। আমি একাই তোর শোকে দিনরাত মরে যাচ্ছি। তুই দিব্যি হেসে খেলে দিন কাটাচ্ছিস। কী নিষ্ঠুর রে তুই! আজকে কতো রিস্ক নিয়ে একটু বাইরে নিয়ে এলাম, সে এখন আমাকে কথা শোনাচ্ছে!

আদ্রিকা খাওয়া বাদ দিয়ে বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে ফেললো। ঠোঁটের কোণে ভালোলাগার হাসি লেপ্টে থাকলেও, বিস্ময়ের দৃষ্টি আদ্রিকার চোখ জোড়াতে নিবদ্ধ। চোখ নাকি কখনো মিথ্যা কথা বলে না। তাই বিস্ময় মানুষের চোখ পড়াটা সবার আগেই রপ্ত করে নিয়েছে। সেই বিদ্যা কাজে লাগিয়ে ক্ষনিকেই ধরে ফেললো প্রেয়সীর চোখে এক সমুদ্র বিষাদ গাঁথা।
সেই চোখের দিকে তাকিয়েই দৃঢ় কন্ঠে জানতে চাইলো,
– কি হয়েছে? মন খারাপ কেনো?
আদ্রিকা খানিকটা হকচকিয়ে গেলো। ছোটবেলা থেকে তারা দুবোন বাড়ির অভ্যন্তরীণ ঘটনা মনের মধ্যে লুকিয়ে বাইরে হেসেখেলে বেঁচে থাকতে শিখেছে। রাতভর বাড়িতে মারপিট, ভাঙচুর চলার পরেও সকালে তারা দুবোন হেসেখেলে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরেছে। নীহার গায়ের কালশিটে দাগ লুকিয়ে রান্না ঘরের ভেঙ্গে যাওয়া চুলা, থালা বাসন পরিষ্কার করে নতুন উদ্যোমে রান্নার প্রস্তুতি নিয়েছে। আশেপাশে কেউ কখনো বুঝতেই পারেনি, গতরাতে এই পরিবারটি কতো ভয়ংকর একটি রাত কাটিয়েছে। আজ হঠাৎ করে নিজের ঘরের খবর আরেকজনকে কীভাবে বলে দিবে? অথচ বিস্ময় এমনভাবে জানতে চাইছে, যেনো সে শতভাগ নিশ্চিত আদ্রিকার কিছু নিয়ে মন খারাপ। প্রশ্নে কোনো দ্বিধার আভাস নেই। মন খারাপের কোনো বাহানা খুঁজে না পেয়ে আদ্রিকা বললো,
– বাড়িতে একটু ঝামেলা হয়েছিলো।
– কি হয়েছে?
– এখন সব ঠিক আছে।
বিস্ময় খানিকটা জেদ দেখালো। জবাব তার চাই।
– কি হয়েছে সেটা জানতে চাইছি।
– আব্বু-আম্মুর মধ্যে ঝামেলা। সবার সংসারেই তো হয়। তাই না? কিছুদিন পর আবার ঠিক হয়ে যায়। তেমন বিশাল কিছু না।
– তোকেও মেরেছে?
বুদ্ধিমান বিস্ময়ের ঘটনার শেষ পর্যন্ত বুঝতে বেশি সময় লাগলো না। মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্পগুলো প্রায় একই রকম। তাই দুইয়ে দুই চার মিলাতে খানিকটা বুদ্ধি খাটাতে হয়। যা বিস্ময়ের পক্ষে কঠিন কিছু না। কিন্তু সে কিছুতেই মানতে পারছে না, তার সামনে বসে থাকা সকালের মিষ্টি রোদের মতো আদুরে মেয়েটার গায়ে কেউ হাত তুলেছে, তাকে কষ্ট দিয়েছে। বুকের মাঝে ব্যথা অনুভব হলো না তবে কপালের শিরাগুলো দপদপ করতে লাগলো। বিস্ময়ের দাঁতে দাঁত চিপে ধরা মুখের দিকে তাকিয়ে আদ্রিকা ভড়কে গেলো। ঝটপট করে বললো,
– আরে নাহ।
বিস্ময় কিছুক্ষণ সেভাবেই তাকিয়ে থেকে আদ্রিকার কথা বুঝার চেষ্টা করলো। যেনো সে আদ্রিকার কথা সত্য নাকি মিথ্যে তা যাচাই করছে। বিস্ময়ের কুঁচকে থাকা কপালের ভাঁজ, আগ্রহী চোখ জোড়া, শক্ত চোয়ালের দিকে তাকিয়ে আদ্রিকার ভীষণ ভালো লাগলো। কেউ তার জন্য ভাবছে, তার ভালো থাকা , মন্দ থাকা নিয়ে ভাবছে। বিশাল কিছু প্রাপ্তির মতো গর্ব হতে লাগলো নিজেকে নিয়ে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ কেউ মনে হওয়ার শুরুটা সেখানেই হলো।
বিস্ময় যখন নিশ্চিত হলো, আদ্রিকা সত্য কথা বলছে তার চোয়াল জোড়া শিথিল হলো। সে খাবার মুখে দিতে দিতে কথা গুছিয়ে নিলো। তারপর মুখের খাবার ধীরে সুস্থে চিবাতে চিবাতে বললো,
– আমাদের দেখা করা কিংবা সামনাসামনি কথা বলার সুযোগ একদমই হয় না। কতোদিন হয়ে গেলো বল তো, অথচ আজকে প্রথম অফিশিয়ালি আমরা ডেটে আসলাম। তোর সাথে আমার যোগাযোগ বলতে, ওই কলেজের কয়েক পলকের দেখা আর রাতের কয়েক মিনিটের ফোনকল। যেখানে বেশির ভাগ সময় আমি কথা বলি আর তুই শ্রোতা হয়ে শুনে যাস। কিছু জিজ্ঞাসা করলে শুধু সেটুকুর উত্তর দিস।
এরমাঝে বিস্ময়ের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। সে পানীয় এর গ্লাসে চুমুক দিলো। আদ্রিকা যেনো কথা বলতে ভুলে গেছে। মুখের খাবার মুখে নিয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে বিস্ময়কে দেখে যাচ্ছে। খাবার চিবানো বাদ দিয়ে পুরো মনোযোগ দিয়ে শুধু বিস্ময়ের কথা শুনে যাচ্ছে। বিস্ময় তার হাতের গ্লাস নামিয়ে রেখে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে বললো,
– খাবার বাদ দিয়ে আমার কথা গিলতেছিস নাকি? তাড়াতাড়ি শেষ কর। তোকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আমি আবার কাজে যাবো। কলেজ ছুটি হওয়ার আগে কলেজে না পৌঁছালে ধরা পরে যাবি।
আদ্রিকা নান ছিড়তে ছিড়তে বললো,
– আপনি কথা শেষ করুন।
– আমি অভিযোগ করছি না। আমি জানি তুই একটু শাই। তোকে সময় দিয়েছি। কিন্তু তোকে তো চেষ্টা করতে হবে। নিজেকে গুটিয়ে রাখলে চলবে? এখানে আসা পর্যন্ত ভয়ে কাঁপতেছিলি। এখন কিন্তু অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছিস। একদিনে হবে না, কিছু সময় লাগবে। অপেক্ষা করতে আমার সমস্যা নাই। কিন্তু তোকেও এগিয়ে আসতে হবে। মনের কথা মুখ ফুটে বলতে হবে। আমাকে নিজের ভাবতে হবে। তোর বাড়িতে এতো কিছু ঘটে গেলো,তুই আমাকে কিচ্ছু জানাসনি। আমি কি তোর পর?
আদ্রিকা দু পাশে মাথা দোলালো। তা দেখে বিস্ময় শুধালো,
– তাহলে বলিস নি কেনো?
জবাবে আদ্রিকা চুপ রইলো। সে কি বলবে? নিজের পরিবার নিয়ে বাইরের লোকের সাথে কথা বলতে লজ্জা লাগে? কিন্তু বিস্ময় তার পর কেউ তো নয়। ভীষন আপন একজন মানুষ। যার কথা শুনতে ভালো লাগে, যাকে দেখতে ভালো লাগে, সান্নিধ্য পেতে ভালো লাগে। শুধু সামনাসামনি দাঁড়ালে লজ্জা লাগে। কিন্তু এখন পাশাপাশি বসে থাকতে তো ভালো লাগছে। আদ্রিকার কাছে এসব কিছু ধাঁধার মতো। কাছে যেতে ভয় লাগে, আবার কাছে যাওয়ার তীব্র আকর্ষণ কাজ করে। নিজের ভাবনায় মগ্ন আদ্রিকা হঠাৎ বিস্ময়ের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো। আদ্রিকার ঠোঁটের কোণায় খাবার লেগেছিল। সেটাই বিস্ময় টিস্যুর সাহায্যে মুছে দিলো। এই সময়ে ক্ষণিকের জন্য বিস্ময়ের ডান হাতের অনামিকা আদ্রিকার নিচের ঠোঁট ছুঁয়েছিলো, তাতেই চমকে পিছিয়ে গেলো আদ্রিকা। নির্বিকার বিস্ময় বললো,
– অনেকক্ষণ ধরে ওখানে খাবার লেগেছিলো। চোখে এসে লাগছিলো।
আদ্রিকা আবার মাথা দুলিয়ে টেবিল থেকে টিস্যু তুলে নিয়ে ঠোঁটের কোণা ভালোভাবে মুছে নিলো। সেই সাথে মুছে নিলো নিজের ঠোঁটজোড়া।
বিস্ময় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– তো যা বলছিলাম। আমার একার চেষ্টায় কিছু হবে না। আমরা এখানেই আটকে থাকবো।
– আমাকে কি করতে হবে?
বিস্ময় এবার শব্দ করে হেসে ফেললো। তা দেখে আদ্রিকা যেনো লজ্জায় আরেকটু কুকড়ে গেলো। বিস্ময় হেসেই বললো,
– তোকে তেমন কিছু করতে হবে না। শুধু আমাকে নিয়ে দিনরাত একটু বেশি বেশি করে ভাববি। তাতেই হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, তোর জীবনে ঘটতে থাকা প্রতিটি ঘটনা আমাকে জানাবি। আমার জানার অধিকার আছে। প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় সবকিছু। তাই আমার কাছে কিছু লুকাবি না। মনে থাকবে?

রেস্টুরেন্ট থেকে ফেরার পথে আদ্রিকা স্বাভাবিক ছিলো। বিস্ময়ের সাথে দূরত্ব রেখে বসলেও পূর্বের মতো অস্বস্তি হয়নি। বরং ফুরফুরে বাতাসে নিজেকে আকাশে উড়ন্ত মেঘ মনে হচ্ছিলো। মাঝেমধ্যে সে চোখ বন্ধ করে বাতাস অনুভব করার চেষ্টা করছিলো। আদ্রিকার বন্ধ চোখ, ঠোঁটের কোণে হাসি, মুখমন্ডল জুড়ে ভালো লাগা। ফন্ট মিরোরে এই দৃশ্য বিস্ময়ের মনের কুঠুরিতে বন্দী হয়ে রইলো। বৃহস্পতিবার হওয়ায় কলেজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছে। ওরা যখন কলেজের সামনে পৌঁছালো তখন শিক্ষার্থীরা বের হওয়া শুরু করেছে। বাইক থেমে নেমে আদ্রিকা চিন্তিত মুখে সামনের দিকে তাকালো। বিস্ময় ওর মনের কথা বুঝতে পেরে বললো,
– ভার্সিটি ছুটি হতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি।
আদ্রিকার মুখমন্ডল হতে ঘন মেঘ সরে গিয়ে ঝলমল করা রোদ দেখা দিলো। সে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দ্রুত চলে গেলো নির্ধারিত স্থানে। আদ্রতা যখন এলো, দু বোন হাতে হাত রেখে চললো বাড়ির পথে। গেট পেরিয়ে যেতেই আনমনে পেছনে ফিরে তাকিয়ে চমকে গেলো আদ্রিকা। গেটের এককোণে এখনো দাঁড়িয়ে আছে বিস্ময়। আদ্রিকার সাথে চোখাচোখি হওয়ার পর সে ধীরে সুস্থে বাইকে উঠে উল্টোদিকে চলে গেলো। আদ্রিকাও বোনের সাথে হাসিমুখে বাড়ির দিকে রওনা হলো। দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে এক পলকের একটু দেখা যেনো সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।

চলবে

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
ত্রয়োদশ পর্ব

আজকাল পর্তুলিকাকে রান্নাঘরে খুব একটা দেখা যায় না। কালেভদ্রে সে কখনো এসে রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে যায়। তাঁর বাড়িতে রান্নার কাজ করার জন্য শহরের নামকরা শেফ সদা উপস্থিত রয়েছে। সেখানে তিনি কেনো কষ্ট রান্না করতে যাবেন! কষ্ট করবেনই বা কার জন্য? এ বাড়িতে বিশাল একটি ডাইনিং টেবিল সবসময় অবহেলায় পরে রয়। পর্তুলিকা আজকাল নিজের খাবারটুকু ঘরে বসে খেয়ে নেন। কখনো আবার ছাদের দোলনায় বসে মিঠা রোদ উপভোগ করতে করতে দুপুরের খাবার খান। রান্নাবান্না পছন্দ নয়, এমন কিন্তু নয়। বাগান পরিচর্যার পর কোনো কাজে যদি তাঁর আগ্রহ থাকে, সেটি হচ্ছে রান্না। অথচ সেই রান্না বাদ দিয়েছেন আজ বেশ কয়েক বছর হলো। মেয়েরা রান্না করতে যতোটা না ভালোবাসে , তার থেকে বেশি ভালোবাসে কাউকে রেঁধে খাওয়াতে। পর্তুলিকাও একসময় রেধেবেড়ে স্বামী সন্তানকে খাওয়াতেন। দিনের অর্ধেকটা সময় কেটে যেতো রান্না ঘরে। অথচ এখন ! স্বামী কখন ঘরে ফেরে ,কখন বেড়িয়ে যায় তা পর্তুলিকা জানেনই না। পুরো বাড়ি জুড়ে অদ্ভুড়ে নিশ্চুপতা পর্তুলিকার একমাত্র সঙ্গী। সেই নিশ্চুপতা ভেঙ্গে অনেকদিন পর হলরুম থেকে ডাক ভেসে এলো, “পিউ, পিউ।”

পর্তুলিকা সে ডাক শুনলেন, কিন্তু উত্তর দিলেন না। ইবনূল ইবতেহাজ দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই যাচ্ছিলেন। হঠাৎ রান্নাঘরের দিকে চোখ পরতেই তিনি থমকে দাঁড়ালেন। অবাক চোখে গুটি গুটি পায়ে নিচে নেমে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। কন্ঠের উৎসাহ লুকানোর প্রয়োজন মনে করলেন না। বললেন, “তুমি রান্না করছো!”

পর্তুলিকা উত্তর দিলেন না। শুধু ফিরে তাকালেন। তবে তাঁর নীরব চাহনি অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলো। ইবনূল ইবতেহাজ হালকা হেসে রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কতোদিন পরে নিজের স্ত্রীকে পরিপূর্ণ গৃহিনী রুপে দেখছেন, সে হিসাব কষতে গিয়েও ফিরে এলেন। কী দরকার পুরনো ক্ষত জাগানোর। সামনে দাঁড়ানো সেই রমণী, সময়ের দৌড়ে শুধু শরীর ভারী হয়েছে। বাকিসব ঠিক আগের মতোই। পরণে শাড়ি, আঁচলখানা কোমড়ে গুজে রাখার কারনে ফর্সা পেট উন্মুক্ত। ইবনূল ইবতেহাজ আজও নিজেকে আটকাতে রাখতে পারলেন না। পা দুটো নিজে থেকে সামনে এগিয়ে গেলো। পেছনে দাঁড়িয়ে তিনি যখন তাঁর উন্মুক্ত পেটে হাত রেখে জড়িয়ে ধরলেন, পর্তুলিকা কিছুটা কেঁপে উঠলেন। কড়াইয়ে চামচ নাড়াতে থাকা হাতটি থমকে গেলেও তিনি দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। পর্তুলিকার আলগা খোপা হতে কয়েক গাছি চুল ছুটে গেছে। কিছুক্ষণ ধরে ভীষণ বিরক্ত করলেও দু হাতে কাজ সামলাতে গিয়ে সেগুলো আর সামলানো হয়নি। ইবনূল ইবতেহাজ খুব যত্ন করে সেই চুল করে পর্তুলিকার কানের পেছনে গুজে দিলেন। অনেকক্ষণ চুলোর কাছাকাছি থাকায় পর্তুলিকা খানিকটা ঘেমে গিয়েছেন। কপালে ও নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম মুক্তোর মতোন ঝিকমিক করছে। ইবনূল ইবতেহাজ স্ত্রীর নিরবতার সুযোগ নিয়ে কিছুটা সাহসী হলেন। পেছন থেকে আরেকটু ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পর্তুলিকার ঘাড়ে মুখ গুজে রইলেন। অনেকদিন পর স্বামীর সান্নিধ্য এবং পুরনো দুষ্টুমি উপভোগ করলেও ব্যস্ততার সময় কাজে ব্যঘাত ঘটায় খানিক বিরক্ত হলেন পর্তুলিকা। তবুও নিজের মতো করে কাজ করার চেষ্টা করলেন। কিছুতেই নিজের প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গবে না, কথা বলবে না এই নিষ্ঠুর মানুষটির সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর হলরুম হতে পায়ের শব্দ আসতেই পর্তুলিকা স্বামীর হাতের বাঁধন থেকে দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন। ড্রাইভারকে খামারে পাঠিয়েছিলেন গরুর খাঁটি দুধ আনতে। সে নিশ্চয়ই এসে পরেছে। দ্রুত পায়েস রেঁধে ফেলতে হবে। বাকি খাবার তৈরি হয়ে গেছে। তিনি আরেকবার ঘড়ির দিকে নজর বুলিয়ে নিলেন। হাতে এখনো যথেষ্ট সময় আছে। ইবনূল ইবতেহাজ স্ত্রীর তোড়জোড় দেখে মুখ ভার করে বললেন,
“ছেলেকে পেয়ে আমাকে একদম পাত্তা দিচ্ছো না, এটা কি ঠিক হচ্ছে? তোমার জন্য ছেলেকে মানিয়ে এলাম। কোথায় আমাকে ধন্যবাদ দিবে, একটু আদর করে দিবে। তা না করে এখনো রাগ পুষে রেখেছো।”

পর্তুলিকা কোমড় হতে শাড়ির আঁচল ছাড়িয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে চোখ পাকিয়ে তাকালেন। তবুও কিছু বললেন না। ইবনূল ইবতেহাজ যা বুঝার বুঝে গেলেন। স্ত্রীর নীরবতাকে আজকাল খুব ভালোভাবে পড়ে ফেলতে পারেন। নীরব এই যুদ্ধের কম দিন তো আর হলো না। ছেলে ঘর ছেড়েছে থেকেই কিছুদিন অন্তর অন্তর রাগারাগি, মান অভিমান চলছেই। তিনি ঠোঁট উল্টে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলেন।

ডাইনিং টেবিলে তিনজন ব্যক্তি নীরবে খাদ্য গ্রহণ করছে। কেউ কোনো কথা না বললেও তাদের চোখে মুখে প্রশান্তি লক্ষ্যনীয়। অনেকদিন পর স্বামী সন্তানকে নিজের হাতের রান্না তৃপ্তিসহ খেতে দেখে পর্তুলিকা ভীষণ খুশি। অন্যদিকে প্রিয়তমা পিউকে উচ্ছাসিত দেখে ইবনূল ইবতেহাজ উৎফুল্ল। টেবিলের অপরপ্রান্তে একমনে মায়ের হাতের রান্না তৃপ্তিসহ খাচ্ছে পরখ। পর্তুলিকা ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
– আরেকটু চিকেন দেই?

পরখ নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিকেনকারি রয়েছে। তাই মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– এগুলো শেষ করে নেই। তারপর লাগলে চেয়ে নিবো।

আবারও খাবার মনোযোগ দিতে গিয়ে থেমে গেলো। পর্তুলিকার সামনের রাখা প্লেটে খাবার ওভাবে পরে আছে। তিনি নিজে না খেয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। পরখ মায়ের সামনে থাকা প্লেটটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
– তুমি খাচ্ছো না কেনো? খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

খাবার শেষে ইবনূল ইবতেহাজ সিঁড়ি দিয়ে উপরে যেতে যেতে ছেলেকে বললেন,
– স্টাডি রুমে এসো পরখ। কিছু কথা আছে।

পর্তুলিকা দু কাপ কফি পরখের হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেগুলো নিয়ে স্টাডি রুমে ঢুকে সে দেখলো, ইবনূল ইবতেহাজ তার স্টাডি টেবিলের চেয়ারে বসে আছেন। পরখকে অপরপাশে বসার নির্দেশনা দিতে সে আরাম করে বসে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। ইবনূল ইবতেহাজ এক হাতে কফির কাপ ধরে রেখেছেন, অন্য হাতে সামনে রাখা ফাইলের পাতা উল্টাচ্ছেন। কাপের কফি ফুরিয়ে এলো। সেটি জোরালো শব্দ করে টেবিলে রাখতেই উচ্চ আওয়াজে ইবনূল ইবতেহাজ মাথা তুলে তাকালেন। পরখ বাবার উদ্দেশ্যে বললো,
– আমার পাসপোর্ট?
– পেয়ে যাবে। সবে তো এলে।
– আ’ম ডান হেয়ার। লিভিং নাউ ।
– কিছুক্ষণ তোমার মায়ের পাশে থাকো। পিউ তোমাকে ভীষণ মিস করে। তুমি আসছো শোনা মাত্রই আগের রুপে ফিরে এসেছে। দেখেই ভালো লাগছে।
– তুমি ভীষণ স্বার্থপর, জানো?

ইবনূল ইবতেহাজ শান্ত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্টাডি রুমের বিশাল জানালা হতে পরিষ্কার আকাশ দেখাচ্ছে । সেদিকে তাকিয়ে পরখ বললো,
– একদিন নিজের স্বার্থের জন্য আমাকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করলে। আজ নিজের স্বার্থে আবার জোর করে ঢেকে নিয়ে এলে। তুমি সবসময় নিজের লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেও।
– প্রতিটি মানুষ নিজের কথা বিবেচনা করে জীবনে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলে। এটা অন্যায় কিছু নয়। নিজের ভালোমন্দ নিজেকেই ভাবতে হয়। তুমি নিজেও কি তাই করছো না?
– আমি অন্তত তোমার মতো নই। নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য জ্ঞানত আমি কখনো কারো ক্ষতি করিনি, কাউকে আঘাত করিনি, কারো লক্ষ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াইনি।

কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটি আলতোভাবে টেবিলের উপরে রাখলেন ইবনূল ইবতেহাজ। টেবিলের বামপাশের ড্রয়ার খুলে পাসপোর্টটি বের করে ছেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। তা তুলে নিয়ে পরখ চুপচাপ বেরিয়ে এলো।

মায়ের ঘরে এসে ছিলো বিদায় জানাতে কিন্তু পর্তুলিকার হাসি মুখের দিকে চেয়ে তা আর বলা হলো না। মায়ের কোলে মাথা রেখে সে বিছানায় শুয়ে পরলো। ছেলের কালো কুচকুচে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে পর্তুলিকা বললেন,
– মাকে ছেড়ে একা থাকতে তোর কষ্ট হয় না, বাবু?

চোখ বুজে মায়ের গায়ের ওম অনুভব করছে পরখ। সেভাবে থেকেই উত্তর দিলো,
– প্রথমে কষ্ট হতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। অনেক দিনই তো হলো, মা।
– হুম, অনেক দিনই তো হলো। এখনো রেগে আছিস?

পরখ নড়েচড়ে আরাম করে শুয়ে বললো,
– রাগ নেই। মায়ের উপর রাগ করে থাকা যায়?
– আর বাবার উপর?
– সে তো তুমিও আছো।
– রাগ নয়, অভিমান।
– আমার ক্ষেত্রেও তাই। রাগ নয়, অভিমান।
– কবে যাচ্ছিস, বাবু?
– অফার লেটার হাতে পেলেই।
– তাও কতদিন লাগতে পারে? মিনিমাম।
– দু তিন মাস সর্বোচ্চ।

মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে পরখ ঘুমিয়ে পরেছিলো। যখন ঘুম ভাঙলো চারদিকে অন্ধকার নেমে গেছে। ঘরে হালকা নীলচে আলো, গায়ে কম্ফোটার জড়ানো, মাথার নিচে বালিশ। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসতেই টেবিল ঘড়িতে নজর গেলো। সন্ধ্যা নেমে গেছে। অথচ লাঞ্চের পরেই ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো। ফ্রেশ হয়ে হলরুমে যেতেই রান্নাঘর থেকে পর্তুলিকা বেরিয়ে এলো।
– টেবিলে বস। চা করে দেই।
– লাগবে না মা।

পর্তুলিকা সে কথা এড়িয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে ছেলেকে বসিয়ে দিলেন। দ্রুত পায়ে রান্নাঘর গিয়ে প্লেট হাতে ফিরে এলেন।
– পাকোড়া ভেজেছি। খেয়ে দেখ কেমন হয়েছে।
– আমার ফিরতে হবে মা।
– থেকে যেতে বলছি না। ডিনার করে তারপর যাবি। এখন এটা খেয়ে বলত কেমন হয়েছে।

রাতের খাবার খেয়ে বের হতে রাত অনেকখানি গভীর হয়ে গেলো। ছেলের যাবার পাণে চেয়ে পর্তুলিকা কিছু বললেন না। শুধু হাসিমুখে ছলছল চোখে চেয়ে রইলেন। বাবা-ছেলে দুজনের জেদের মাঝে তিনি ফেঁসে গেছেন।

চলবে..