নোলককন্যা পর্ব-১৭

0
24

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
১৭

অন্য কোনো কাজে আগ্রহ খুঁজে না পেলেও বাগান পরিচর্যার কাজে আদ্রিকার আগ্রহ ভীষণ। বইপত্র ঘাটাঘাটি করে বাগান পরিচর্যা বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করে। বাড়িতে রোজ পত্রিকা আসে। যেখানে উদ্ভিদ বিষয়ক যেকোনো ফিচার মনোযোগ দিয়ে পড়ে। ছাদ বাগানে আদ্রিকার মূল্যবান অনেক গাছ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে একটি বনসাই। গোলাপি, হলুদ, সাদা এবং মেজেন্ডা মোট চার রঙের ফুলের সংমিশ্রণ একটি বাগানবিলাস গাছে। কলম কাটিং এর মাধ্যমে একটি গাছে চারটি ফুল ফোটাতে সক্ষম হয়েছে আদ্রিকা। তারপর সেই বাহারী বাগানবিলাস গাছটিকে ধীরে ধীরে বনসাইয়ে রুপান্তর করেছে। জীবন্ত এই ভাস্কর্যটি আদ্রিকার ভীষণ দামী এবং প্রিয় সম্পদ। আজ ছাদবাগানে দ্রুত চলে এসেছে সে। পরীক্ষা শেষে কলেজ আপাতত বন্ধ। তাই সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলতে শুরু করলে আদ্রিকা তার যন্ত্রপাতির বক্সটি সাথে নিয়ে ছাদে এসে আসন পেতে বসলো। আজকে বনসাই এর রিপটিং করবে। এ সময়টাতে বাড়ির কেউ ওকে বিরক্ত করে না। সেই বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খুব যত্নসহকারে সাবধানে মাটির চওড়া একটি পটে বাগানবিলাসটি রোপণ করা শেষে আদ্রিকার মুখে হাসি ফুটলো। সে ঠিক যেমনটি চেয়েছিলো, তার থেকে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে বনসাইটি। ছাদের এককোণে বনসাইটিকে রেখে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকাতেই হকচকিয়ে গেলো। সেই বাইকটি দাঁড়িয়ে আছে। বাইকারের দৃষ্টি আদ্রিকার দিকে। আদ্রিকা যে তাকে দেখতে পেয়েছে এবং তার দিকে তাকিয়ে আছে তা বুঝতে পেরেও কোনো ভাবান্তর হলো না বাইকারের৷ সে আগের মতোই তাকিয়ে রইলো। ভীষণ রাগ হলো আদ্রিকার। সরু চোখে চোখ মুখ শক্ত করে সেও তাকিয়ে রইলো। চোখে চোখে অনেকক্ষণ লড়াই চলার পর আদ্রিকা নিজেই হেরে গেলো। কালো কাচের আড়ালে থাকা চোখ দুটোর দিকে এভাবে কতোক্ষণই বা তাকিয়ে থাকা যায়! হেরে যাওয়ার রাগে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু নুড়ি পাথর দেখতে পেয়ে কয়েকটা তুলে নিয়ে ঢিল ছুড়লো। এতোটা পথ অতিক্রম করে সেই পাথর নিশ্চয়ই বাইকার অব্দি পৌছাবে না। তবুও পাথরগুলো দ্বারা বাইকারকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ে ছুড়ে নিজের রাগ কমানোর বৃথা চেষ্টা করলো। আদ্রিকার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে হেলমেটের আড়ালে নিশ্চয়ই হাসছে ছেলেটি। আদ্রিকা স্পষ্ট দেখতে পেলো হাসির দাপটে বাইকারের গা দুলছে। ভীষণ রাগ হলো আদ্রিকার। জিহ্বা বের করে ভেংচি দেখিয়ে ধুপধাপ পায়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।

হলরুমে এসে দেখে মাহিন বসে আছে। আদ্রিকাকে দেখতে পেয়ে আলতো হেসে বললো,
– ভর সন্ধ্যেবেলা কোথা থেকে এলি?
– ছাদ বাগানে গেছিলাম।
– বাগানে পানি দিতে এতোক্ষণ লাগে?
– বনসাইয়ের রিপটিং করলাম।
– ছাদবাগানে বনসাই আছে নাকি?
– হ্যাঁ। বাগানবিলাসের।
– বয়স কতো?
– দশ বছর।
– বিক্রি করবি?
– মোটেও না। ওটা আমার।
– চল দেখে আসি তোর বনসাই।

মাহিনকে বনসাইকে দেখাতে আদ্রিকা অতি উৎসাহে ছাদের দিকে যেতে লাগলো। রান্নাঘর থেকে নীহার ডাক দিলো,
– আবার কোথায় যাচ্ছিস?
– ভাইয়াকে বনসাই দেখাতে ছাদে যাচ্ছি।

নীহার মাছ ভাঁজছিলো। ওগুলো রেখে যেতেও পারছে না। আদ্রতাকে বললো,
– ভ্যাবলাটা এই সন্ধ্যাবেলা মাহিনের সাথে একা ছাদে যাচ্ছে কোন আক্কেলে? এই মেয়েটাক নিয়ে আমি কি যে করবো! তুই সাথে যা তো।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদ্রতাকেও ওদের সাথে ছাদে যেতে হলো। ছাদের লাইট অন করে দিয়ে আদ্রিকা ভীষণ আগ্রহ নিয়ে মাহিনকে ওর সংগ্রহের গাছগুলো দেখাতে লাগলো। বাগানবিলাসটিতে ফুল নেই। আদ্রিকা ডাল ছুয়ে দেখিয়ে দিলো।
– এই বড় ডালটিতে সাদা রঙের ফুল হয়। এই দুটোতে মেজেন্ডা, গোলাপি। এই ছোটোটাতে হলুদ ফুল হয়। যখন ফুল ফুটবে তখন এসে দেখিও। কী যে সুন্দর দেখায়!
– চমৎকার শেপ হয়েছে তোর বনসাইয়ের। আমি একটা ছবি তুলি?

মাহিনের প্রশ্নে আদ্রতা ঝটপট বললো,
– অন্ধকারে ছবি ভালো আসবে না। অন্যদিনে তুলিয়েন।
– আমার ফোনের ক্যামেরা ভালো। রাতেও ভালো ছবি আসে।

আদ্রিকা হাসি মুখে অনায়াসে রাজি হয়ে গেলো।
– আহা! তুলতে দেও না আপু। আমাদের ফোন নেই, বনসাইয়ের ছবিও নেই। মাহিন ভাইয়া, ছবি তুলে আমাকে প্রিন্ট করে এনে দিতে পারবে?
– কেনো পারবো না! বড় করে প্রিন্ট করে এনে দিবো।
– তাহলে তুলো।

মাহিন ভিন্ন এঙ্গেলে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। আদ্রিকা আগ্রহ নিয়ে বাগানের বাকি গাছগুলো দেখাতে শুরু করলো।

– এদিকে এসো। তোমাকে আরও কয়েকটা ফুল দেখাই। এই যে বাগানবিলাসটা দেখছো, এটাতে যে ফুলটা হয় সেটার অর্ধেকটা সাদা, অর্ধেকটা গোলাপি।

আদ্রিকার কথা মাহিন শুনছে না। সে পেছনে দাঁড়িয়ে আদ্রতার হাত চেপে ধরেছে৷ ঘৃণায় জমে গেছে আদ্রতা। আদ্রিকা থাকায় জোর গলায় কিছু বলতে পারছে না। তবুও হাত ছেড়ে নেওয়ার তীব্র চেষ্টা চালাচ্ছে।
– হাত ছাড়ুন মাহিন ভাই।
– ভাই বলা বন্ধ করবে কবে? দুদিন পরে বিয়ে। এখনো ভাই ডাকছো! বাসর ঘরেও ভাই ডাকবে নাকি!
– যখন বিয়ে হবে তখন দেখা যাবে। হাত ছাড়ুন বলছি।

সে কথা মাহিন শুনলো না। হেচকা টানে আদ্রতাকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। অন্য হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে বিশ্রীভাবে হাসলো।
– পালিয়ে আর কতোদিন? একবার বিয়েটা হতে দেও সোনা, তোমার সব অ্যাটিটিউট আমি একটু একটু করে ভীষণ কষ্ট দিয়ে ছাড়াবো।

ব্যথায়, ঘৃণায় আদ্রতার চোখের কোণ ভিজে এসেছে। আদ্রিকা পিছু ফিরতে নিলেই মাহিন ওর হাত ছেড়ে দিলো।

– এখানে একটা অপরাজিতার গাছ আছে৷ দেখবে এসো।

নিজেকে সামলে নিয়ে আদ্রতা বললো,
– আজকে আর কিছু দেখাতে হবে না। রাত নেমে গেছে। অন্যদিন দেখাস৷ চল নিচে যাই।

****

বাড়ির ছোট মেয়ে হিসেবে আদ্রিকা ভীষণ আহ্লাদী। যদিও আহ্লাদ দেখানোর জায়গা তার একটাই। ওর সকল আবদার এসে জমা হয় আদ্রতার কাছে। কয়েকদিন ধরে দিনে কমপক্ষে দশবার আদ্রতার কাছে গিয়ে বলছে,
– আমার জন্মদিন আসতেছে। মনে আছে তো?
– তুই ভুলতে দিলে না ভুলে যাবো।
– যেতেও পারো। এজন্য রোজ মনে করিয়ে দেই। আচ্ছা শোনো না, এবার আমার জন্য ভ্যানিলা কেক আনবে না। চকলেট কেক আনবে। এক পাউন্ড আনলেই চলবে। চকলেট কেকের কালারটা কী সুন্দর! খেতেও ভীষণ মজা।
– তুই কবে চকলেট কেক খেয়েছিস?

আদ্রতার প্রশ্নে থমথমে খেয়ে গেলো আদ্রিকা। পেস্ট্রি শপে নিয়ে গিয়েছিলো বিস্ময়। সেখানেই চকলেট কেক খেয়েছিলো। এতো মজা লেগেছিলো যে কেক খেতে গিয়ে ঠোঁট লেপ্টে ফেলেছিলো। ঠোঁটের উপর লেপ্টে থাকা সেই কেক নিজের আঙ্গুল দিয়ে মুছে নিয়ে নিজের মুখে পুড়েছিলো বিস্ময়। মনে পরতেই লাজে রাঙা হলো আদ্রিকা। ওর মুখের পরিবর্তন সরু চোখে লক্ষ্য করলো আদ্রতা।
– কী করে? কোথায় খেয়েছিস বল? প্রতিবার জন্মদিনে আমি ভ্যানিলা কেক নিয়ে আসি। তুই চকলেট কেক পেলি কোথায়?
– ওই তো গতমাসে ফ্রেন্ডের জন্মদিন ছিলো। কলেজে সবাই মিলে কেক কাটলাম। তখন খেয়েছি। তুমি কিন্তু মনে করে ভ্যানিলা কেক আনবে।
– ঠিক আছে।

নীহারকে গিয়ে বললো,
– মা, ও মা।
– বল।
– পরশু আমার জন্মদিন।
– জানি।
– আমার জন্য কি রান্না করবে?
– রোজ যা রান্না করি।
– আমার জন্মদিন উপলক্ষে স্পেশাল কিছু করবে না?
– কি লাগবে তোর আদ্রিকা?
– এডলিস্ট একটু পায়েশ তো রান্না করতেই পারো।
– আচ্ছা বানিয়ে দিবো।
– কোথায় নিজে রান্না করে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে তা না আমাকেই সব বলে দিতে হয়।

নীহার, আদ্রতাকে জজন্মদিনের কথা বলে বলে বিরক্ত করে ফেললেও বিস্ময়কে কিছু জানায়নি আদ্রিকা। লুকোচুরি এই খেলায় সে ভীষণ মজা পাচ্ছে। উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে, বিস্ময় কিছু একটা করে ওকে সারপ্রাইজ করে দিক। আবার কখনো মনে হচ্ছে বলি দিক জন্মদিনের কথা। প্রেম চলাকালীন এটা ওর প্রথম জন্মদিন। বিস্ময়ের নিশ্চয়ই জানার কথা না। বলি বলি করেও অবশেষে বলতে পারেনি আদ্রিকা।

আজকাল পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমে এসেছে আদ্রতার। বেশিরভাগ সময় নীহারের সাথে রান্নাঘরে কাটায়। সংসারের কাজ শিখে, সুখ দুঃখের গল্প করে। রাতের খাওয়ার পর এটো থালাবাসন পরিষ্কার করে ডাইনিং টেবিলে বসে অনেকক্ষণ গল্প করলো নীহার ও আদ্রতা। আদ্রতা যখন ঘরে ফিরলো তখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। পড়ার টেবিলে বসে আছে আদ্রিকা। আজকে ও দেরীতে ঘুমাবে এটা জানা কথা৷ আদ্রতার থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা আদায় করে নিয়ে তবেই ঘুমাতে যাবে। বিছানায় বসে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে দেখলো বই খাতা খুলে কিছু একটা মনোযোগ দিয়ে লিখছে। তবে কানে গুজে রাখা ইয়ারফোন।

– আজকাল দেখছি সারাক্ষণ ফোন সাথে নিয়ে ঘুরছিস। পড়তে বসেও ফোনটা কেনো তোর কাছে?

আদ্রতার প্রশ্নে কলম থেমে গেলো আদ্রিকার। বোনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
– গান শুনছিলাম।
– পড়তে বসে গান কে শোনে? এভাবে পড়া হয়?
– ম্যাথ করতেছি। গান শুনতে শুনতে ম্যাথ করলে দ্রুত মিলে যায়।
– কী সব অদ্ভুত কথা! মানবিক বিভাগের কীসের ম্যাথ করতেছিস?
– আইসিটি সাবজেক্ট। বাইনারির ম্যাথ। তুমি উকিলের মতো এমন জেরা করতেছো কেনো? কি হয়েছে তোমার?

আদ্রতা জানে না তার কি হয়েছে? আজকাল মেজাজ বড্ড খারাপ থাকে। সবকিছুই বিরক্ত লাগছে। ভার্সিটি যাওয়া হয় না ঠিকমতো। শেষ কবে বই হাতে নিয়েছিলো মনে পরতেছে না। বাম হাতের অনামিকায় আংটিকে নিজের গলার ফাঁ স মনে হয়। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় ওর। গা ঘিনঘিন করে। মনে হয় এখনো মাহিনের ছোঁয়া লেগে আছে। আচ্ছা, বিয়ের পর মাহিন নিশ্চয়ই আরও গভীরভাবে ছুঁবে। তখন কি করবে আদ্রতা? নিজের দেহটা বড্ড নোংরা মনে হবে।

– কিছু না। তুই পড়। আমি শুয়ে পরলাম।
– এখনি ঘুমাবে! বারোটা বাজতে আর একটু বাকি।
– ঠিক বারোটায় উইশ করতে হবে কোথায় লেখা আছে? তুই জন্মেছিলি ঠিক যোহরের আযানের সময়। সেই অনুযায়ী তোর জন্মদিন কালকে দুপুরে শুরু হবে। তখন না হয় উইশ করবো। এখন আমাকে ঘুমাতে দে।

কিছু না বলে আদ্রিকা ঠোঁট ফুলিয়ে খাতায় মনোযোগ দিলো। ফোনের ওপাশে বিস্ময় মুচকি হেসে বললো,
– ঘুমিয়েছে তোর বোন?
– ইয়ারফোনের মাউথপিস মুখের কাছে এনে আদ্রিকা ফিসফিসিয়ে বললো,
– উহু।
– ওকে ঘুমাতে দে। এই ফাঁকে তুই আরেকটা গান শোন।

পড়ার ফাঁকে আদ্রিকা গান শোনে ঠিকই তবে সেটা মেমোরি কার্ডে থাকা কোনো গান নয়৷ ভয়েস কলে বিস্ময়ের কন্ঠে গাওয়া গান শুনে রোজ। গানের মাঝে খানিকটা কথা হয়, গল্প হয়৷ কেউ ঘরে চলে এলে ওপাশে বিস্ময় গুনগুনিয়ে গান গেয়ে যায়। লুকোচুরি এই খেলা ভীষণ ভালো লাগে আদ্রিকার। প্রথমদিকে ভয় পেলো এখন আর ভয় হয় না। রোজকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

তুমি আমার পাশে বন্ধু হে, বসিয়া থাকো
একটু বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো।
আমি মেঘের দলে আছি, আমি ঘাসের দলে আছি।
তুমিও থাকো বন্ধু হে, বসিয়া থাকো
একটু বসিয়া থাকো।
তুমি আমার পাশে বন্ধু হে একটু বসিয়া থাকো।

গানের তালে তালে কখন বারোটা বেজে গেছে আদ্রিকা খেয়াল করেনি। হঠাৎ গান থামিয়ে বিস্ময় বলে উঠলো,
– শুভ জন্মদিন, মেঘমালা। আমার মনের আকাশে সারাজীবন সাদা মেঘ হয়ে ভেসে বেড়ানোর দোয়া রইলো। কখনো রোদের মতো ঝলমলিয়ে উঠো, কখনো বৃষ্টির মতো অভিমানে কেঁদে আমাকে সিক্ত করো।

ভালোলাগায় সত্যি আদ্রিকার চোখ সিক্ত হয়ে এলো। হঠাৎ কারো ছোঁয়া পেয়ে চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো আদ্রতা দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। আদ্রিকাকে জড়িয়ে বললো,
– শুভ জন্মদিন, বাচ্চা। এতো দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছিস কেনো বল তো? বড় হয়ে গেলে দুনিয়াটা ভীষণ নোংরা হয়ে যায়৷ আমার ক্ষমতা থাকলে তোকে কখনো বড় হতে দিতাম না।

আদ্রিকার দিকে তাকাতেই আদ্রতা হেসে ফেললো৷
– সেকি রে! আমি ঘুমিয়ে পরেছি ভেবে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিস নাকি?
– মোটেও না।
– চোখ ছলছল হয়ে আছে।
– তোমার কথাবার্তা শুনে ইমোশনাল হয়ে গেলাম।

আদ্রিকার কপালে আলতো চুমু দিয়ে বললো,
– পড়া শেষ হয়নি?
– আর একটু আছে।
– শেষ করে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে আয়।

খুব দ্রুত ঘুমিয়ে গেলো আদ্রতা। ফোনের ওপাশে বিস্ময় ডাকলো,
– আদ্রি?
– হুম।
– কান্নাকাটি করতেছিস নাকি?
– আমার জন্মদিনের কথা তুমি কীভাবে জানলে?
– সিক্রেট সোর্স।
– এজন্য ফোন রাখছিলে না আজকে?
– প্রথম শুভেচ্ছা আমি জানাতে চেয়েছিলাম।
– প্রতিবার আপু-ই প্রথম উইশ করতো৷ এবার তুমি জিতে গেছো।
– কালকে দেখা করতে পারবি?
– উহু। আপুর সাথে ফিরতে হবে। জন্মদিনের কেক কিনবো একসাথে৷
– এখন কেক কাটবি না?
– নাহ। আব্বু আছে না বাড়িতে!
– তাতে কি হয়েছে?
– কেক কেটে হৈ হুল্লোড় করলে বকা দিবে। এসব আব্বুর পছন্দ না। কালকে বিকালে যখন আব্বু বাড়িতে থাকবে না, চালের আড়তে যাবে তখন আমরা কেক কাটবো৷
– তোর বাপটা পুরাই নিরামিষ একটা মানুষ। বাচ্চারা হৈ হুল্লোড় করবে না তো কি করবে? শোকসভার আয়োজন করবে?
– ওমন কিছু না। আব্বু একটু নিরিবিলিতে থাকতে পছন্দ করে। সাদামাটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করতে চায়।
– উনার সন্নাসীর হওয়া উচিত ছিলো।
– আব্বু আমার আম্মুকে কতো ভালোবাসে জানো? সারাক্ষণ চোখে হারায়। আমরা নানুবাড়িতে যাওয়ার আগে আব্বু বারবার বলে দেয়, একদিন থেকেই চলে আসবে। একা বাড়িতে থাকতে আমার ভালো লাগে না।
– দূরে গেলে ভালো লাগে না, আবার কাছে থাকলে দূর দূর করে।
– আসলে আব্বুর রাগটা একটু বেশি আর ধৈর্য্য একদমই কম।
– সেই সাথে আত্মসম্মানবোধ আকাশচুম্বী কিন্তু ঘটে বুদ্ধির হাঁটুতে।
– তুমি সারাক্ষণ আমার আব্বুর পেছনে লেগে থাকো কেনো?
– কারন তোর বাপের মতো মানুষ দুনিয়াতে একপিচ-ই আছে। ইউনিক শ্বশুর আমার।
– বাদ দেও এসব। কালকে দেখা হচ্ছে না। পরশু দেখা করবো, প্রমিজ।
– আচ্ছা ঠিক আছে। এখন ঘুমাতে যা। অনেক রাত হয়েছে৷
– ঘুম আসছে না। তুমি ঘুম পাড়িয়ে দেও৷
– রোজ দূর থেকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে ভালো লাগে না। আমার কাছে চলে যায়। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি৷
– ইশ! বললেই যেনো চলে যেতে পারবো আমি! এসব আদর যত্ন তুলে রাখো। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে৷ এখন আপাতত রোজ যে গানটা শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেও।
– যা আপনার হুকুম মেঘমালা।

লাইট বন্ধ করে আদ্রতা পাশে শুয়ে পরলো আদ্রিকা। কানে তখনো ইয়ারফোনে লাগানো। গিটারে টুংটাং আওয়াজের ছন্দ তুলে বিস্ময় গাইছে…

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
তোমার দেখা আমার সঙ্গে
মুখোমুখি আমরা দুজন….

চলবে….