নোলককন্যা পর্ব-১৯+২০

0
23

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
ঊনবিংশ পর্ব

শব্দ এমন একটা অস্ত্র যা দিয়ে মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা যায়। আবার টুকরো টুকরো হওয়া মানুষকে জুড়েও দিতে পারে অল্প কয়েকটি শব্দ। ঔষধ একই, পার্থক্য শুধু ব্যবহারবিধি-তে।
আদ্রিকার মন আকাশের মেঘ এতোদিন হাজার চেষ্টা করেও সরাতে পারেনি আদ্রতা এবং নীহার। অথচ আজ বিস্ময়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলাতেই মন খারাপ সরে গিয়ে সেখানে এখন সূর্য হাসছে। সামান্য কয়েকটা কথা, একটুখানি আশা ভরসা। তাতেই আদ্রিকার সমস্ত আত্মগ্লানি ধুয়ে মুছে গেলো। বিস্ময় যেহেতু বলেছে, এখন থেকে নিশ্চয়ই সবকিছু ঠিকঠাক চলবে। একদম আগের মতো।
অনেকদিন বাদে আদ্রিকাকে হাসতে দেখে, ওর চঞ্চলতা দেখে ভীষণ ভালো লাগছে আদ্রতার। রাস্তার পাশের আইসক্রিম পার্লার থেকে একটা আইসক্রিম কিনে দিলো ওকে।

অনেকদিন বাদে বিস্ময়ের সাথে ফোনে কথা বলার সুযোগ মিলেছে। কলেজ থেকে ফিরেই বন্ধ ফোনটি চার্জে দিয়েছে আদ্রিকা। এতোদিন চার্জবিহীন পরে ছিলো। কেউ খোঁজও করেনি। তেমন দরকার পরে না। ছাদের রেলিং এ বসে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে গিটারে সুর তুলেছে বিস্ময়। এক কাপ কফি এনে রেলিঙের উপর রাখলো পরখ। বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
– মন ভালো?
– অনেক ভালো।
– ঝামেলা মিটেছে?
– হ্যাঁ। তোর বুদ্ধি শুনে আজকে সরাসরি দেখা করেছি। অল্পতেই বুঝে গেলো। তুই ভাবতে পারবি না, কি হয়েছে।
– ভাবার দরকার নেই। তোর মুখেই শুনি।
– কিস করেছি সেই নিয়ে কান্নাকাটি করছিলো পাগলটা। এই যুগে কে এমন সতীসাবিত্রী হয় কেউ!
– সবাইকে এক পাল্লায় মেপে বিচার করছিস কেনো? অনেকের মোরাল এথিকস এখনো অনেক স্ট্রং। ভালোবাসাকে এখনো অনেকে পবিত্র অনুভূতি হিসেবে মানে। কাছে গিয়ে কলুষিত করতে চায় না। ভালোবাসার শারীরিক ভাষা শুধুমাত্র হালাল সম্পর্কেই সুন্দর, প্রশান্তিময়। তোর গার্লফ্রেন্ড যেহেতু চাইছে না, কী দরকার জোর করার!
– চাওয়ার কথা দূরে রাখ। ও মানতেই পারছে না। যা ভুল হয়েছে শুধু একবারই। আরেকবার চেষ্টা করতে গেলে আমার উপরে না হামলা করে বসে। যা পাগল মেয়ে!

দুজনের কথা মাঝে আদ্রিকার কল এলো। কলার আইডি দেখে বিস্ময়ের মুখে যে আনন্দময় হাসি দেখা গেলো, তা দেখে পরখ বুঝে গেছে ব্যক্তিটি কে। চওড়া হেসে নিজের কফি নিয়ে চলে গেলো ছাদ থেকে।

– রাগ কমেছে?
– রেগে ছিলাম কোনদিন?
– যে কয়েকদিন ফোন বন্ধ করে রেখেছিলি, আমার সাথে দেখা করতি না, তাকাইতি না আমার দিকে।
– রেগে ছিলাম না। মন খারাপ ছিলো শুধু।
– এখন মন ভালো হয়েছে?
– হ্যাঁ।
– আজকে এতো তাড়াতাড়ি কল দিয়েছিস, আবার পটরপটর করে কথা বলতেছিস! বডিগার্ড কই তোর?
– আপুকে একদম বডিগার্ড বলবে না।
– একশবার বলবো। ওর জন্য ঠিকঠাক প্রেম করতে পারি না। তা কোথায় আমার একমাত্র শ্যালিকা?
– মাহিন ভাইয়ার মা এসেছে। আপুর বিয়ের শাড়ি কেনাকাটা নিয়ে কথা বলছে।
– কীসের কথা?
– কালকে বিয়ের শাড়ি কিনতে যাবে। আপুকে সাথে যাইতে বলতেছে কিন্তু আপু যাবে না। ওর নাকি নিজের কোনো পছন্দ নেই৷ বড় চাচীকে পছন্দমতো একটা নিয়ে আসতে বলেছে। এটা কোনো কথা, বলো? নিজের বিয়ের শাড়ি নিজে পছন্দ করে কিনবে না? আরে বিয়ে তো একদিনই হবে। সেদিনটা অন্তত নিজের পছন্দ অনুযায়ী সাজা উচিত।
– তোর বিয়ের শপিং তুই নিজে করতে চাচ্ছিস?
– অবশ্যই। আমাদের বিয়েতে সবকিছু আমাকে সাথে নিয়ে কেনাকাটা করবা।
– মোটেও না। তুই আমার পছন্দ মতো সাজবি।
– অসম্ভব। আমার পছন্দের রঙের সাথে যদি তোমার পছন্দ না মিলে তখন?
– কোন রঙের শাড়ি নিতে চাস তুই?
– লাল রঙের।
– আমিও চাই, আমার বউ লাল টুকটুকে বউ সেজে আমার বাড়ি আসুক।
– আমাদের পছন্দের মিল আছে। দুজনে মিলেমিশে বিয়ের কেনাকাটা করে নিবো।
– তোর আপুর আগেই তোর বিয়ের কেনাকাটা করে দেই চল।
– এহ! না বিয়ে, না শাদি। বিয়ের শপিং করে আমি কি করবো?
– বিয়েশাদি হলে কেনাকাটা করতে আপত্তি নেই?
– কেনাকাটা ছাড়া আবার বিয়ে হয় নাকি!
– তোদের মেয়েদের কতো নিয়মকানুন রে!

ওসব নিয়মের ধার ধারলো না আদ্রতা। সব দায়িত্ব মাহিনের মায়ের হাতে দিয়ে নিজেকে ঝামেলা মুক্ত করে রাখলো। মাহিনের মা বলেছে, মাহিনের সাথে গিয়ে অন্তত বিয়ের শাড়িটা কিনে নিয়ে এসো। ওই অসভ্য ছেলেটার সাথে একলা বাইরে যাওয়ার কথা ভেবেই আদ্রতার গা গুলিয়ে আসছিলো।

***

আদ্রিকা আজকে একাই কলেজে এসেছে। গতকাল আদ্রতার জন্য বিয়ের শাড়ি কেনা হয়েছে। গাঢ় বেগুনি রঙের একটা জামদানী শাড়ি। যদিওবা শাড়িটা আদ্রিকার পছন্দ হয়নি। তবুও বোনের মুখের দিকে চেয়ে কিছু বলেনি। আজকে সকালে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় মাহিনের ভাবি এসে জানালো, ব্লাউজ সেলাই করতে দিতে হবে। আদ্রতা যেনো তার সাথে টেইলার্সের দোকানে যায়।
বাধ্য হয়ে বাড়িতে রয়ে গেলো আদ্রতা।

ভূবনভোলা একাডেমির গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই বিস্ময়ের বাইকটি নজরে এলো। বাইকের উপর বসে আদ্রিকার অপেক্ষা করছিলো। দেখতে পেয়ে বাইক নিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
– বাইরে আয়।

কলেজের ভেতর না গিয়ে আদ্রিকা বেরিয়ে এলো। আজকে ওরা আবার সেই রুফটপ রেস্টুরেন্টে এসেছে। বিস্ময় নাস্তা করলো। আদ্রিকা শুধু এককাপ চা নিলো। খাওয়া শেষে একটা প্যাকেট আদ্রিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এটা পরে আয়।
– কি আছে?
– বোরকা।
– কেনো?
– আমরা এখন শপিংমলে যাবো। বোরকা না পরলে যদি পরিচিত কেউ দেখে ফেলে তখন তুই আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিবি৷ এখন বেশি কথা না বলে ঝটপট পরে আয়৷

বোরকা পরে আদ্রিকা নিজেই নিজেকে চিনতে পারছে না। নেকাব দিয়ে মুখ ঢাকার কারনে শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে৷ ওকে দেখে চওড়া হাসলো বিস্ময়৷
শহরের সবচেয়ে বিলাসবহুল শপিংমল, যার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আদ্রিকা মাথা উচু করে শপিংমলের ছাদের দিকে তাকাতো, সেখানে ওকে নিয়ে এলো বিস্ময়। একটা জামদানীর দোকানে প্রবেশ করতেই আদ্রিকার চোখ দুটো মার্বেলের মতো হয়ে গেলো। চারদিকে চোখ ধাধানো সৌন্দর্য। বিস্ময়ের হাত ধরে ফিসফিসিয়ে বললো,
– আমরা এখানে কেনো এসেছি?
– শপিং করতে৷
– তাই বলে জামদানী!
– হ্যাঁ। শাড়ি নিবি নাকি সালোয়ার কামিজ?
– কীসের জন্য?
– বিয়ের।
– কার বিয়ে? আপুর? ওর বিয়ে উপলক্ষে আমার শপিং করা শেষ।
– তোর বিয়ে উপলক্ষে নিবি।

বিস্ময়ের উত্তরে আদ্রিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো৷ ওর বিয়ে মানে? নিশ্চয়ই মজা করছে বিস্ময়। আদ্রিকার উত্তরের অপেক্ষা না করে ওকে টেনে টুলের উপর বসিয়ে সেলসম্যানকে বললো,
– লাল রঙের রেডিমেড সালোয়ার কামিজ দেখান।

আদ্রিকা তখনো বিস্ময়ের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। নিজের নামের মতোই কর্মকান্ড এই মানুষটির। আদ্রিকা কখনোই বুঝে উঠতে পারেনি। এখনো পারছে না।
– তোর যা সাইজ, শাড়ি পরলে ডুবে যাবি। তার থেকে সালোয়ার কামিজ পর। বিয়েতে শাড়ি পরতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

বেশ কয়েকটা থ্রি পিজের মধ্যে থেকে একটা চুজ করা হলো। সেটা আদ্রিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিস্ময় ওকে নিয়ে গেলো চেঞ্জিং রুমের সামনে।

– ভেতরে গিয়ে প্রথমে এই থ্রি পিজটা পড়বি। তার উপর আবার বোরকা পরে নিবি।

চারদিকে মানুষজন গিজগিজ করছে। ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে আদ্রিকার মাথা। কাপড়গুলো হাতে নিয়ে অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো বিস্ময়ের দিকে।
– কীরে! তুই ভেতরে গিয়ে নিজে চেঞ্জ করে আসবি নাকি আমাকে চেঞ্জ করিয়ে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি যা। সময় বয়ে যাচ্ছে।

জোর করে ঠেলেঠুলে চেঞ্জিং রুমে পাঠিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তাড়া দিতে লাগলো বিস্ময়। নতুন কাপড়ের উপর বোরকা পরার কারনে বেশ অসুবিধা হচ্ছে আদ্রিকার। তবুও চুপচাপ বসে রইলো বিস্ময়ের বাইকের পেছনে। ওরা এখন কোথায় যাচ্ছে, ও জানে না।
কোলের উপর রাখা কলেজের ব্যাগটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে শুধু। কিছুক্ষণ পর শহর থেকে দূরে গ্রামের দিকে এসে বিস্ময়ের বাইকটা থামলো। দূর থেকে মেঘাকে দেখতে পেয়ে খানিকটা সাহস ফিরে পেলো আদ্রিকা। বাইক থেকে নামতেই বিস্ময় মেঘার উদ্দেশ্যে বললো,
– ওকে ভিতরে নিয়ে যাও মেঘা। বোরকা পরার অভ্যাস নেই তো গরমে ঘেমে গেছে একদম। ফ্যানের নিচে নিয়ে বসাও।

কলের পুতুলের মতো মেঘার পেছন পেছন চলে গেলো আদ্রিকা। বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্মিত এল (L) আকৃতির একটি বাড়ি। মোট তিনটি ঘরের মাঝখানের ঘরে ওকে নিয়ে এলো মেঘা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোনো গৃহস্থ বাড়ি। এই ঘরটি কোনো দম্পতির শোয়ার ঘর। বিছানার উপর বসে আস্তে ধীরে বোরকা খুলতে খুলতে মেঘার কাছে জানতে চাইলো,
– কী হচ্ছে এসব? কার বাড়ি এটা? তুমি এখানে কি করছো?
– তুই কিছু জানিস না? না জেনে চলে এলি?
– কি জানবো?
– আজকে তোর বিয়ে। এটা কাজির বাড়ি৷

আদ্রিকার হাত থেমে গেছে। অবাক চোখে চেয়ে রইলো মেঘার দিকে। ওর গা থেকে বোরকাটা খুলতে সাহায্য করলো মেঘা। কালো বোরকা সরাতেই বেরিয়ে এলো লাল রঙের জামদানী সালোয়ার কামিজ।
– কিছু না জেনেই বিয়ের সাজে কাজির বাড়িতে চলে এসেছিস! ইশ! নাটক দেখো!
– মেঘা, আমি সত্যিই কিছু জানতাম না৷ বিস্ময়কে একটু ডেকে নিয়ে এসো প্লিজ।
– আরে ভাইয়া এখন কাজির সাথে কথা বলছে। কাবিননামায় লেখালেখির কিসব কাজ আছে।
– গিয়ে বলো আমি কথা বলতে চাই। এক্ষুনি।

অগত্যা মেঘা বেরিয়ে গেলো। আদ্রিকা নিজেই যেতে পারতো। কিন্তু পাশের ঘর থেকে কয়েকটি ছোট বাচ্চা উঁকি দিয়ে আদ্রিকাকে দেখছে। লাল রঙের জামদানী পরিহিতা বধূকে দেখে ফিসফিস করছে, সেই সাথে একজন আরেকজনের গায়ের উপর ঢলে পরে হাসছে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে আদ্রিকার। ভয়ে কান্না করতেও যেনো ভুলে গেছে।
কিছুক্ষণ পর ঘরে এলো বিস্ময়। ওর গায়ে সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবি। এতোক্ষণে ভালো করে খেয়াল করলো আদ্রিকা।

– কি হয়েছে? কিছু লাগবে তোর? ওদিকে অনেক কাজ বাকি।

বিস্ময়ের ব্যস্ততা দেখে ওকে সত্যিই বর মনে হচ্ছে৷ অবশ্য আজকে ওদের বিয়ে হলে বিস্ময় সত্যিকারের বর-ই তো। কাছাকাছি এসে আদ্রিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে জানতে চাইলো,
– এসব কি হচ্ছে বিস্ময়?
– আমাদের বিয়ে।
– আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?
– হঠাৎ করে মনে হলো বিয়েটা করে রাখি।
– কেনো? এখনি কেনো?

আদ্রিকার ওড়নাটা গলা দিয়ে নিচের দিকে ঝুলানো ছিলো। সেটা খুলে নিয়ে মাথা ঢেকে দিয়ে নতুন বউয়ের মতো করে গায়ে জড়িয়ে দিলো বিস্ময়। গা কেঁপে উঠলো আদ্রিকার। জড়সড় হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। ওর দু গালে হাত রেখে প্রেমময় কন্ঠে বিস্ময় জানালো নিজের অপারগতার কথা,
– তোকে এখন কতোটা আদুরে লাগছে জানিস? ইচ্ছে করছে আদরে আদরে ভরিয়ে দেই। কপালে এঁকে দেই ভালোবাসার পরশ। তীব্র ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তোকে ছোঁয়া বারণ। এজন্যই বিয়েটা করছি। এতো তাড়াতাড়ি করছি। বিয়ে হয়ে গেলে আমাদের সম্পর্কটা স্বীকৃতি পাবে৷ হালাল সম্পর্ক হবে। কখনো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তোকে ছুয়ে ফেললেও তখন আর তোর ঘৃণা জন্মাবে না নিজের প্রতি। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে অপরাধবোধে দৃষ্টি নিচু করে নিতে হবে না। বরং নিজের প্রতিবিম্বের চোখে চোখ রেখে লাজে রাঙা হতে পারবি।
– কিন্তু এভাবে বিয়ে করতে পারবো না আমি।
– কেনো পারবি না?
– বাড়িতে কি বলবো?
– এখনি বাড়িতে জানাতে হবে না। বিয়ে হবে, কবুল বলবি তারপর বাড়ি ফিরে যাবি।
– যখন জানতে পারবে?
– সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আমার উপর ভরসা আছে না?

মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো আদ্রিকা।

– সুযোগ অনুযায়ী বিয়ের কথা জানাবো৷ সবটা সামলে নিবো আমি।
– তাই বলে এখনি বিয়ে করতে হবে কেনো?
– তোর বোনের বিয়ের পর তোকে ঘরে বসিয়ে রাখবে না তোর বাপ। ধরে বেধে তোরও বিয়ে দিয়ে দিবে। তখন কীভাবে আটকাবো আমি? এজন্যই বিয়ে করে রাখছি।
– আমাকে আগেই একবার জানাতে।
– পরশু রাতে পরখের কথায় হঠাৎ করে মাথায় এলো। দেরী করতে চাচ্ছিলাম না।
– আমার ভীষণ ভয় করছে বিস্ময়।
– সারাজীবন ভীতু থেকে যাবি? এখন অন্তত একটু সাহস দেখা৷ এখানে চুপটি করে বসে থাক। ওদিকে আমার অনেক কাজ বাকি। সাক্ষী একজন আসেনি এখনো৷ আমি যাই।

ভীতু মানুষ যখন প্রেমে পরে তখন অত্যাধিক সাহসী হয়ে উঠে। আদ্রিকাও নিজেকে ভীষণ সাহসী প্রমাণ করতে উঠে পরে লেগে গেলো। আজ হোক কাল হোক, বিয়ে তো একসময় করতেই হতো। সেটা আজকে হয়ে গেলে ক্ষতি কি? বাড়িতে কেউ জানছে না, অতএব ঝামেলা হওয়ার কোনো চান্সও নেই। প্রেম করার থেকে বিয়ে করা বেশি ভালো। একটা হারাম সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে হালাল সম্পর্কের দিকে যাচ্ছে ওরা।

আদ্রিকাকে যখন পাশের ঘর ডাকা হলো তখন কাজী সাহেব গোমড়া মুখ করে বসে আছেন। আদ্রিকাকে দেখে বললেন,
– মা জননী, আপনি এদিকে আসেন। আপনাকে বুঝায় বলি।

উনার সামনের চেয়ারে আড়ষ্টভাবে বসলো আদ্রিকা। পেছনে বিস্ময় দাঁড়িয়ে।
– শুনেন, দেনমোহর হইলো একটা মেয়ের আর্থিক নিরাপত্তা। ভবিষ্যতের কথা আমরা কেউ জানি না৷ আপনার বয়স কম, পরবর্তীতে যদি এই বিয়ে না টিকে…

পেছন থেকে বিস্ময়ের দরাজ গলার স্বর ভেসে এলো,
– কাজী সাহেব, এমন শুভ দিনে এসব কী ধরনের কথা?
– আহা বাবাজী, আমি শুধু উদাহরণ দিচ্ছি। বিয়েটা যদি না টিকে কিংবা তোমার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তখন মেয়েটার আর্থিক নিরাপত্তা দিবে এই দেনমোহর।

আদ্রিকা বললো,
– সেভাবে ভাবতে গেলে আমারও কিছু একটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ফেলে দেওয়া যায় না। ধরুন আমার কিছু একটা হয়ে গেলো, তখন এই টাকার কি হবে? কাজী সাহেব, আমার মূল্যবান সম্পদ হবে আমার স্বামী। সামান্য কয়েকটা টাকা আমাকে কি নিরাপত্তা দিবে যদি মানুষটাই আমার না থাকে?
– এই যুগের ছেলেমেয়েরা আধুনিকতার নামে নিয়মকানুন মানতে চায় না। যুবক বয়সে এসব কথার তাৎপর্য বুঝতে পারবেন না। আমার পুরো জীবনে মাত্র দশ হাজার টাকা দেনমোহরের বিয়ে কখনো পরাই নাই। আপনি আরেক ভেবে দেখেন, মা জননী৷
– ওর পকেটে যদি দশ টাকা থাকে এবং ওর সামর্থ্য যদি এতোটুকুই হয় তাহলে আমি দশ টাকা দেনমোহরেও বিয়ে করতে রাজি আছি।
– তাহলে আমার আর কি বলার আছে! আপনাদের বিয়ে, আপনাদের ইচ্ছে মতোই হবে। তবে মা জননী আরেকটা সমস্যার কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি। আপনার সার্টিফিকেটের বয়স অনুযায়ী এখনো বিয়ের বয়স হয় নাই। আঠারো বছর হতে এখনো দু মাস বাকি। আমার রেজিস্ট্রার খাতায় আপনাদের সই নিয়ে রাখবো, কিন্তু এখনি কোর্টে জমা দিতে পারবো না। দু মাস পরে কোর্টে জমা দেওয়ার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে আপনাদের বিয়ে কার্যকর হবে৷ তাই দুই মাস পর এসে কাবিননামা তুলে নিয়ে যাবেন৷ এখন শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে পরিয়ে দিচ্ছি।
– আচ্ছা ঠিক আছে। আমার সমস্যা নেই৷

বিস্ময় ও আদ্রিকার বিয়ে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হলো চারজন। আদ্রিকার পক্ষ থেকে মেঘা, বাকি তিনজন বিস্ময়ের বন্ধু। বিছানার মাঝখানে আদ্রিকা ও বিস্ময়কে বসানো হয়েছে। মেঘা বসেছে আদ্রিকার পাশে৷ লম্বা ঘোমটা দিয়ে আদ্রিকা বসে আছে মাথা নিচু করে। শক্ত করে ধরে রেখেছে মেঘার হাত। ওদিকে মেঘা হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে। কাজী সাহেবের কথাগুলো রিপিট করছে বিস্ময়ের একজন বন্ধু, জামিল। জামিলকে কাজী সাহেব একবার বলছেন,
– শুধু মুখে বললে হবে না। আঙ্গুল দিয়ে বরের দিকে নির্দেশ করো।

বেচারা তর্জনী উচু করে বিস্ময়ের দিকে নির্দেশ করে দেখালো। পরেরবার কাজী সাহেব আবার বললেন,
– আঙ্গুল ঝাঁকিয়ে দেখাও।

বেচারা এদিকে নিজেই বিয়ে করেনি। বন্ধুর বিয়েতে উকিল দেওয়ার দায়িত্ব কিনা তারই কাঁধে পরেছে। এসব নিয়মকানুন অদ্ভুত ঠেকছে জামিলের নিকট। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওর পেটে গন্ডগোল দেখা দিয়েছে৷ টয়লেট যেতে না দিয়ে জামিলকে কেউ এখানে জোর করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে৷ ঘরে উপস্থিত বর কনেসহ সকলে জামিলের অবস্থা দেখে হাসছে৷ এসব হাসি মজার মাঝখানে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করা হয়ে গেলো। বিস্ময় তো এক নিঃশ্বাসে কবুল বলে বসে আছে। হাসিখুশিতে মেতে থাকলেও কবুল বলার সময় আদ্রিকার শরীর কাঁপছিলো। মেঘা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভরসা দিতে চাইলো মেয়েটিকে৷ বিস্ময়ের দিকে একপলক চেয়ে কবুল বলে দিলো আদ্রিকা। সবাই যখন আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানালো তখন আদ্রিকার চোখ বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পরেছে। যা সবার অলক্ষ্যে দ্রুত মুছে ফেললো আদ্রিকা।

চলবে….

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
বিংশপর্ব

শপিং করার পর বিয়ে হলো, তারপর মিষ্টি বিতরণ। সব মিলিয়ে মাত্র দুই ঘন্টায় পাল্টে গেলো আদ্রিকার অনুভূতি। নেকাবের আড়ালে বসে মিটি মিটি হাসছে৷ বুকের ভেতর থেকে অনেক বড় একটা ভার নেমে গেছে৷ ভীষণ হালকা লাগছে। বিস্ময়ের দিকে তাকালেই এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ছেয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। এই মানুষটা তার স্বামী, ভাবতেই ভীষণ ভীষণ ভালো লাগছে। কাজীর বাড়ির থেকে বেরিয়ে ছোট একটা রেস্টুরেন্টে ওরা ছয়জন খাওয়া দাওয়া করলো। খাওয়া শেষে যে যার মতো ফিরে গেলো আদ্রিকা ও বিস্ময়কে রেখে৷ পার্কিং থেকে নিজের বাইকটা নিয়ে এসে আদ্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময় তার মানিব্যাগ থেকে দশ হাজার টাকা আদ্রিকার হাতে তুলে নিলো।
– নেও ধরো। তোমার প্রাপ্য।

আদ্রিকার মুখ জুড়ে প্রাপ্তির হাসি, সুখের আনাগোনা। টাকাগুলো নিয়ে ব্যাগে রেখে দিলো।
– তুই থেকে তুমি হয়ে গেলাম?
– বউকে তুই বললে কেমন জানি শোনায়। এখন থেকে তুমি করে বলবো। গাড়িতে উঠো। তোমাকে দিয়ে আসি।
– এখন কোথায় যাবো?
– কলেজে।
– এই সময়?
– টিফিন পিরিয়ড চলছে। এই ফাঁকে ক্লাসে ঢুকে যাবে।
– তারপর স্কুল শেষে বাড়ি চলে যেতে হবে।
– হ্যাঁ। যাবে। স্বামীর বাড়ি যেতে চাইছো নাকি? তুমি যেতে পারলে আমার নিয়ে যেতে আপত্তি নেই। তারপর তোমার বাপ আবার ছুটতে ছুটতে আমার বাড়িতে চলে আসবে। এটাই সমস্যা আরকি।
– এখন নিয়ে চলো তোমার বাড়িতে।
– পাগল হয়েছো?
– সিরিয়াসলি বলছি। আজকে বিয়ে হলো আমাদের৷ এখনি ফিরে গেলে আজকে আর তোমার সাথে দেখা হবে না। আমাদের বিয়ের প্রথম রাতটা একসাথে কাটাতে না পারি, অন্তত দিনের বেলা দুজনে একান্তে একটু বসতে নিশ্চয়ই পারি৷ নিয়ে চলো না প্লিজ। কলেজ ছুটির সময় হলে চলে আসবো৷
– ভেবে বলছো?
– হুম।
– ঠিক আছে। বউয়ের আবদার ফেলি কি করে! উঠে পরো বাইকে৷

বাইকের পেছনে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো আদ্রিকা। আজকে আর অপরাধবোধ হচ্ছে না। নেই কোনো আড়ষ্টতা, ভয় ভীতি। বিস্ময়ের কথা মেনে বিয়ে করে ফেলাটা মন্দ মনে হচ্ছে না আর। বিয়ের আগে যেখানে হাত ধরতেই ভয় করতো এখন কাধে হাত রেখে গায়ের সাথে ঘেঁষে বসতে ভালো লাগছে৷
শহর ছেড়ে নিরিবিলিতে বিস্ময়ের বাড়ি। দোতলা ছোট বাড়িটির সামনে মাঝারি একটি আম গাছ। আম গাছের নিচেই প্রবেশ দরজা। নিচতলার গ্যারেজের সামনে বাইক পার্ক করে রেখে ওরা দুজনে নামলো। সিমেন্টের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বিস্ময় বললো,
– এই বাড়িতে ভাড়া থাকি আমি। আমি বলতে আমরা আরকি। আরেকজন ছেলে থাকে আমার সাথে। এখন ডিউটিতে আছে মনে হয়।

দোতলার অর্ধেকটা জুড়ে ফাঁকা ছাদ। কেমন সুনসান, নীরব। স্লাইডিং ডোর সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই স্বল্প জায়গায় ছোট একটি টেবিল, দুটো চেয়ার দেখা গেলো। টেবিলের উপর থালা বাসন দেখে বুঝা যাচ্ছে এটা ডাইনিং টেবিল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখনো এঁটো প্লেট পরে আছে। টেবিলের ডানদিকের দেয়ালে বিশাল জানালা। বামদিকে ছোট কিচেন এরিয়া। যেখানে কোনোরকমে একজন দাঁড়িয়ে রান্না করতে পারবে। কিচেন লাগোয়া দেয়ালের সাথে ওয়াশরুম। সামনের দিকে পরপর তিনটি ছোট কামরা। আদ্রিকা অবাক চোখে চেয়ে দেখলো সেসব। কলেজ হোস্টেলের রুম গুলো এর থেকে অনেক বড়। ওদের এক রুমের সমান বিস্ময়ের বাড়ির তিনটি রুম। আদ্রিকার প্রতিক্রিয়া দেখে বিস্ময় মাথার পেছনে হাত রেখে ভ্যাবলা হেসে বললো,
– ব্যাচেলর এর বাড়ি এমনই হয়। বউ নেই, কে গুছিয়ে রাখবে বলো। এসো তোমাকে আমার রুম দেখাই। তিনটি রুমের ডানপাশের রুমটি বিস্ময়ের। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই ভ্যাপসা একটা গন্ধ এসে নাকে লাগলো। পুরো ঘর জুড়ে স্যাতসেতে ভাব। বিস্ময় দ্রুত ভেতরে ঢুকে দ্রুত হাতে বিছানার উপরে জড়ো করে রাখা কাপড়গুলো একসাথে মুড়িয়ে পোটলা করে র‍্যাকের উপর রেখে দিয়ে আদ্রিকার দিকে কাঠের চেয়ারটি এগিয়ে দিয়ে বললো,
– সকালে ঘুম থেকে উঠে রুম গুছানোর সুযোগ পাইনি। তুমি এখানে চেয়ারে বসো।

আলতো হেসে চেয়ারে বসে আদ্রিকা বললো,
– কখন গুছাও বলে মনে হচ্ছে না।
– রোজ এটা ওটার দরকার পরেই৷ এতো গুছিয়ে কি হবে?
– তাই বলে মশারি, কাথা সব এভাবেই রেখে দিবে?
– প্রতি রাতে মশারি ফেলতে হয়, কাথা গায়ে নিতে হয়। তাহলে গুছিয়ে কি লাভ? কাথা বিছানো থাকে, মশারি টাঙ্গানো থাকে। আমি এসে চুপচাপ ওর ভেতরে ঢুকে ঘুমিয়ে পরি।
– ছিঃ কী নোংরা! বিছানাও ঝাড়ু দেও না।
– ব্যাচেলর লাইফ এমনি। তুমি কি খাবে বলো?
– কিছু না৷ খেয়েই তো এলাম।
– প্রথমবার এসেছো। খালি মুখে যাওয়া যাবে না।
– চা বানিয়ে খাওয়াও।
– আচ্ছা। তুমি বোরকা পরে বসে আছো কেনো? বোরকা খুলে রেখে ফ্যানের নিচে বসো। আমি চা বানিয়ে আনছি৷

বিস্ময় চলে গেলে বোরকাটা খুলে চেয়ারের উপর রাখলো আদ্রিকা। একদম পেছনের দেয়ালে একটা জানালা আছে। সেটা খুলে দেওয়ার সাথেই আলো এসে ভরিয়ে দিলো অন্ধকার ঘর৷ অনেকদিন পর রুমটা মনে হয় স্বস্তিতে শ্বাস নিলো। চারদিক কেমন ঝলমল করছে! ঘরে একটা সিংগেল খাট, পড়ার জন্য চেয়ার-টেবিল, কাপড় রাখার র‍্যাক, একটা আরএফএল এর আলমারি আছে। তাতেই যেনো চারদিক ভরে গেছে৷ নিজের বাড়িতে একটা কাজ না করা আদ্রিকার কেনো যেনো এই ঘরটা গুছিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করলো। ওড়নাটা কোমড়ে গুজে নিয়ে প্রথমে পড়ার টেবিলের অগোছালো বইগুলো গুছিয়ে রাখলো। খাটের মশারি খুলে একপাশে গুছিয়ে রেখে দিলো। এরপর খাট গুছালো, কাপড় ভাঁজ করে রাখলো। আলমারি লক করা থাকায় ওটাতে হাত দিলো না। কাপড়ের র‍্যাকটা গুছাতে বেশ সময় লাগলো। এরপর ঘরের মেঝে ঝাড়ু দিয়ে ময়লা তুলে নিলো বেলচায়। বাইরে খাবার টেবিলের পাশে একটা ময়লা ফেলার ঝুড়ি দেখেছিলো ওটাতে ময়লা ফেলতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। তখনি ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একটি যুবক। হঠাৎ নিজের সামনে অপরিচিত যুবকের আগমনে ভীষণ চমকেছে আদ্রিকা৷
জোরসে ‘ইন্না-লিল্লাহ’ বলে দু কদম পিছিয়ে গেলো। রান্না ঘর থেকে ছুটে এলো বিস্ময়। আদ্রিকার সামনে পরখকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে নিজেও বিস্মিত। অবাক কন্ঠে শুধালো,
– তুই ডিউটিতে যাসনি?

আদ্রিকার দিকে তখনো তাকিয়ে আছে পরখ৷ ওর মাথা কাজ করছ না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে নিজের ভ্রম বলে মনে হচ্ছে। নিজেদের বাড়িতে হঠাৎ মেয়ে এলো কীভাবে? বিস্ময় আবার ডাক দিলো,
– পরখ?

ধ্যান ভাঙ্গলো পরখের। তবে দৃষ্টি সরালো না। তীরের মতো তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফালাফালা করে দিতে চাইছে আদ্রিকাকে।
– তোর না আজকে ডিউটি ছিলো?
– ক্যান্সেল হয়েছে।

আদ্রিকা তখন পরখের অদ্ভুত দৃষ্টি থেকে বাঁচতে ওখান থেকে সরে এসে ময়লাগুলো ঝুড়িতে ফেলে দিলো। তারপর বিস্ময়ের পাশে এসে দাড়ালো। ওর হাত ধরে বিস্ময় পরখের সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিতে বললো,
– ওর নাম পরখ। আমার ফ্ল্যাটমেট। ওর কথাই তখন তোমাকে বলছিলাম। আর পরখ, এ হচ্ছে আদ্রিকা। যার কথা তোকে বলেছিলাম।
– হুম, তোর সোলমেট৷

পরখের রুক্ষ জবারের বিপরীতে আদ্রিকা বিনয়ী ভঙ্গিমায় সালাম দিলো। পরখ জবাব নিলো কিনা বুঝা গেলো না। কঠোর দৃষ্টি মেলে ওভাবেই তাকিয়ে রইলো। অপ্রস্তুত আদ্রিকা বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে খানিক হাসার চেষ্টা করে বললো,
– আমি রুমে যাচ্ছি। তুমি চা নিয়ে এসো।
– আচ্ছা যাও।

দ্রুত পায়ে ফিরে গেলো আদ্রিকা। ও চলে যেতেই পরখ যেনো রাগে ফেটে পরলো। চাপা কন্ঠে ধমকিয়ে উঠলো।
– এসব কি? তুই এখন বাড়িতে মেয়ে নিয়ে আসা শুরু করছিস? এতোটা অধঃপতন। এই বাড়িতে এসব চলবে না বিস্ময়। আমি আগেই বলে দিচ্ছি৷
– হেই, রিলেক্স। যাস্ট বাড়ি দেখাতে নিয়ে এসেছি। আজকের মতোন ম্যানেজ করে নে প্লিজ। আর আনবো না। প্রমিজ। কিছুক্ষণ পরেই চলে যাবে৷ তুই একটু বাইরে থেকে ঘুরে আয়। ও নার্ভাস ফিল করতেছে৷

জবারে পরখ কিছু বললো না। ধুপধাপ শব্দ করে নিজের ঘরে চলে গেলো।
এতোক্ষণ নার্ভাস ফিল না হলেও এই মুহুর্তে ঘরের ভেতর অস্থিরভাবে পায়েচারি করছে আদ্রিকা। বাড়িতে যে অন্য কেউ আছে সেটা ও জানতো না। একটা মগে চা নিয়ে বিস্ময় ঘরে প্রবেশ করলো। মুখে তার লেপ্টে থাকা হাসি। আদ্রিকার দিকে চায়ের মগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এই নেও তোমার চা।
– শুধু একটা মগ নিয়ে এসেছো কেনো? তুমি খাবে না?
– তুমি শেয়ার করলে খাবো৷

লাজুক হাসলো আদ্রিকা। তবে মুখ থেকে চিন্তার রেখা গেলো না৷ ওকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে থুতনি রেখে গভীর কন্ঠে জানালো,
– ভালোবাসি মেঘমালা।

পেছনে ফিরে বিস্ময়ের বুকে মাথা রাখলো আদ্রিকা। বুকে মাঝে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিস্ময় জানতে চাইলো,
– কি হয়েছে?
– উনি কোথায়? মানে তোমার রুমমেট।
– পাশের ঘরে।
– মানে? তোমার ঘরের পাশের ঘরটায়?
– হ্যাঁ।
শুকনো মুখে দরজার দিকে তাকালো আদ্রিকা। ওর চিন্তিত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ওর হাত ধরে বিছানার কাছে নিয়ে এলো বিস্ময়। নিজে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আদ্রিকাকে কোলের উপর বসিয়ে নিলো।

– আমি আছি না? শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তুমি চা খাও।

নীরবে চায়ের মগে চুমুক দিয়ে মগটি বিস্ময়ের দিকে এগিয়ে দিলো। তা দেখে মুচকি হেসে বিস্ময় বললো,
– আমার দু হাত ভর্তি। বউকে কোলে নিয়ে বসে আছি দেখতে পাচ্ছো না?

লাজুক হেসে নিজের হাতে চায়ের মগ বিস্ময়ের মুখের কাছে নিয়ে গেলো। চা খাওয়া শেষে বিস্ময়ের দিকে ঘুরে আদ্রিকা আলতোভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো বিস্ময়ের ঠোঁটে। চোখে চোখ রেখে বললো,
– থ্যাঙ্কিউ।
– থ্যাঙ্কিউ কেনো?
– এতোদিন আমাদের সম্পর্কটা আমার মনে একটা ভারী পাথরের মতো চেপে ছিলো। আজকে ভীষণ হালকা লাগছে৷ প্রেম, ভালোবাসা, রিলেশন এসবের প্রতি কোনোকালেই আমার আগ্রহ ছিলো না৷ বলতে দ্বিধা নেই, তোমার জোরাজোরির কারনে প্রেমের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলতে হয়েছিলো। তুমি স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বললেও আমি বলতে পারতাম না৷ তোমার সাথে সহজভাবে ঘুরাফেরা করতে পারতাম না৷ সবসময় মনে হতো ভুল করছি, মন্দ কাজ করছি।
– এখন মনে হচ্ছে না?
– উহু। এখন তুমি আমার স্বামী। আর কোনো জড়তা নেই। আমি পুরোটাই তোমার।
– এখন যদি তোমাকে চুমু দেই, তুমি কাঁদবে না?
– উহু।

মাথা দু দিকে দুলিয়ে হাসতে হাসতে জবাব দিলো আদ্রিকা। ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে আরেকটু ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে নিয়ে বিস্ময় জানতে চাইলো,
– যদি গভীরভাবে ছুঁয়ে দেই তুমি রাগ করবে না?
– উহু।

একহাত ঘাড়ে রেখে আদ্রিকার মুখটি নিজের কাছাকাছি নিয়ে এলো। ঠোঁট ছোয়ালো আদ্রিকার ঠোঁটে। আদ্রিকার হাত দুটোও নেমে এসেছে বিস্ময়ের মাথায়। যা ধীরে ধীরে বিস্ময়ের পিঠের দিকে নেমে যেতে থাকলো। সম্মতি পেয়ে ওকে খাটে শুইয়ে দিলো বিস্ময়। সরিয়ে দিলো গায়ে জড়িয়ে থাকা ওড়নাটা। ঠোঁট ছোঁয়ালো কানের লতিতে, উন্মুক্ত গ্রীবাদেশে। আবেশে চোখ বুঁজেছিলো আদ্রিকা। উদরে বিস্ময়ের হাতের ছোঁয়া পেতেই চোখ খুলে ওকে থামিয়ে দিলো। ঠোঁট উল্টিয়ে বিস্ময় জানতে চাইলো,
– কি হলো?
– দরজা লাগিয়েছো?
– হ্যাঁ।

কাঠের দরজাটিতে দুটো ছোট ছিদ্র রয়েছ। যা দিয়ে অনায়াসে ঘরের ভেতরের দৃশ্য আবছাভাবে দেখা সম্ভব। ঘরে প্রবেশ করার সময় আদ্রিকার নজরে পরেছিলো। বাড়িতে আরেকজন পুরুষ মানুষ আছে। মন খচখচ করছিলো আদ্রিকার। গায়ের উপর থেকে বিস্ময়কে সরিয়ে দিয়ে বললো,
– জানালা, দরজার পর্দা টেনে দিয়ে এসো।

বিরক্তবোধ করলেও বিনাবাক্য বিছানা ছেড়ে নেমে এলো বিস্ময়৷ জানালা দরজায় ভালোভাবে পর্দা টেনে দিতেই দিনের মাঝেই ঘরে নেমে এলো সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার৷ একটানে নিজের গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলে বিছানায় ফিরে এলো।
– জানালা দরজা সব বন্ধ৷ আর বিরক্ত করবে না৷

মুচকি হেসে বিস্ময়ের আদর উপভোগ করতে লাগলো আদ্রিকা। বিস্ময়ের ঠোঁট অস্থিরভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে পুরো শরীর। গায়ের কামিজটা যখন খুলে ফেলছিলো আদ্রিকার মনে হলো, পাশের ঘরে একজন অপরিচিত মানুষ আছে৷ যার সাথে মাত্র এক দেয়াল দুরত্ব। যদি কোনো শব্দ শুনতে পায়? স্বাভাবিক হতে পারছিলো না আদ্রিকা। ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো,
– উনি এখনো পাশের ঘরেই আছেন?

বিস্ময় ঘরের প্রবেশ করার পরেই পরখ বেড়িয়ে গেছে। ওর বাইকের শব্দ পেয়েছিলো বিস্ময়। আদ্রিকার বক্ষবন্ধনী খুলে ফ্লোরে ছুড়ে মেরে জবাব দিলো,
– অনেক আগেই বাইরে চলে গেছে। এখন চুপ করে থাকো। বিরক্ত না করে আমাকে আদর করতে দেও৷

***

ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে আদ্রিকার। কয়েক মিনিট ঘুমিয়েছে কিনা তাতেই বিস্ময় আবার বিরক্ত করতে শুরু করে দিয়েছে। বন্ধ চোখ জোড়ায় অনবরত চুমু খেয়ে বলছে,
– বাড়ি ফিরবে না, মেঘমালা? উঠে পরো৷

দু হাতে বিস্ময়কে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আদ্রিকা বললো,
– উহু। যাবো না। তোমার কাছে থেকে যাবো।
– থেকে যাও। আমার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।

চোখ খুলে বিস্ময়ের ঠোঁটে দীর্ঘ চুমু দিয়ে আদ্রিকা বললো,
– ইশ! শখ কতো! আপুর বিয়েটা হোক তারপর একেবারে চলে আসবো।

বিছানা ছেড়ে কাপড়চোপড় পরে নিচ্ছিলো। বিস্ময় বললো,
– ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে৷
– আরেকজনের ইউজ করা ওয়াশরুমে যেতে ইচ্ছে করছে না৷ বাড়ি ফিরে সোজা ওয়াশরুমে চলে যাবো।

বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বাইরে বের হয়ে খোলা ছাদে কিছুক্ষণ পায়েচারি করলো আদ্রিকা। সামনে বিস্তৃত খোলা মাঠ। সবুজ ঘাসের বিছানা মনে হচ্ছে৷ আশেপাশে কোনো মানুষজন নেই। প্রধান সড়ক থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে তবেই এই বাড়িটা নজরে পরে। শহুরে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে যতোদিন রবে, ততোদিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আদ্রিকা বললো,
– তোমাদের ছাদটা ভীষণ সুন্দর। নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ। এমন ফাঁকা করে রেখেছো কেনো ছাদটাকে? কয়েকটা ফুলের গাছ এনে লাগাবে।
– পরিচর্যা করবে কে?
– তোমরা করবে।
– আমার দ্বারা এসব হবে না। পরখ অনেক ব্যস্ত৷ ও মনে হয় এমাসেই বাড়িটা ছেড়ে দিবে।
– কেনো?
– বিদেশ যাচ্ছে পড়তে।
– ওহ। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আমার সাথে রাতে কথা বলো?
– হুম। রেলিং এর উপর বসে।
– এখানে বসে? ভয় করে না?
– কীসের ভয়?
– এতোটুকু প্রশস্ত! বসতে গেলেই মনে হচ্ছে পরে যাবো।
– বসে দেখো, পরবে না।
– উহু। আমি বসবো না।

সে কথা বিস্ময় শুনলো না। নিজে রেলিঙের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আদ্রিকাকে কোলের উপর বসিয়ে নিলো। ভয়ে কিছুক্ষণ না, না বলে চিৎকার করলেও পরে শান্ত হয়ে গেলো আদ্রিকা। পেছন থেকে দু হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বিস্ময় বললো,
– এখানে বসে আমি প্রায় একটা দিবাস্বপ্ন দেখতাম।
– আমাকে নিয়ে?
– হ্যাঁ। চাঁদনী রাতে খোলা ছাদে এভাবে তোমাকে নিয়ে বসে আছি। তোমার কোলের উপর আমার পছন্দের গিটার। এভাবেই তোমাকে জড়িয়ে ধরে আমি গিটার বাজাচ্ছি। সেই সাথে গাইছি ভীষণ প্রিয় একটা গান।
– এখন গাও।
– এই দিনের বেলা?
– হ্যাঁ।

বিস্ময় গুনগুন করে গান গেয়ে উঠলো,

তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা
তুমি আমার সাধের সাধনা।
মম শুণ্যগগনবিহারী
আমি আপন মনে মাধুরি মিশায়ে
তোমারে করেছি রচনা।
তুমি আমারি, তুমি আমারি
মম অসীম গগনবিহারী
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা
তুমি আমার সাধের সাধনা।

চলবে…