নোলককন্যা পর্ব-২১+২২

0
34

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
একবিংশ পর্ব

বাজারে সর্বপ্রথম যেদিন মৌসুমি ফল আসে, সেদিন বেশ চড়াদামে বিক্রি হয়। তবুও সেগুলো কিনে ফেলেন মোকাররম। চোখের সামনে অপরিচিত, স্বল্প পরিচিত সুস্বাদু কোনো খাবার পরলে সেটা মেয়েদের জন্য কিনে নিতে ভুলেন না। ভূবনভোলার মার্কেটে ব্লাকবেরি খুবই দূর্লভ ফল। যেই পাশ দিয়ে যাচ্ছে, একনজর ফিরে তাকাচ্ছে। কিন্তু কেনার সাহস করছে খুবই অল্প মানুষ। এইটুকু ফলের সেকি দাম! মোকাররম আধা পোয়া কিনে নিয়ে সেই ভরদুপুরে বাড়ি ফিরলেন। ফলগুলো নীহারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
– মেয়েরা কই?
– ঘরে।
– ফলগুলো ধুয়ে দেও ওদের।
– বিকালে দেই। এখন ভাত খাবে।
– এখনি দেও।

তর্ক করে লাভ হবে না জেনে আদেশ অনুযায়ী ফলগুলো ধুয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন নীহার। পড়ার টেবিলে বসে আছে আদ্রতা। একটু আগেই বাজার থেকে ফিরে গোসল করেছে। ভেজা চুলগুলো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এতো লম্বা, ঘন কালো সোজা চুল! দেখলেই নীহারের মন ভালো হয়ে যায়। টেবিলের উপর ফলের বাটি রেখে আদ্রিকাকে খুঁজলো।

– আদ্রিকা ফিরেনি এখনো?
– নাহ।
– এতোক্ষণে ফিরে আসার কথা!
– রাস্তাঘাটে একটু আধটু দেরী হতেই পারে।
– ফলগুলো খেয়ে নিস।
– আদ্রি আসুক তারপর খাচ্ছি।

কয়েকটা ফল বাটিতে নিয়ে মোকাররম দিতেই সে বিরক্তি নিয়ে বললো,
– নিয়ে যাও। খাবো না।
– কিনে আনলে এখন খাবে না কেনো?
– এতো কথা বলার তোর দরকার নাই। বাচ্চাদের জন্য আনছি, ওদের খাইতে দে।

কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে এলো নীহার। আদ্রতার বিয়ে উপলক্ষে স্রোতের মতো টাকা খরচ হচ্ছে। কোথায় কিসের খরচ করছে জানে না নীহার। মোকাররম নিজেও সেসবের খোঁজ রাখে না। কেনাকাটার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে মাহিন। আজকে বাবুর্চিকে টাকা দেওয়া লাগবে, কালকে চেয়ার টেবিলের দোকানে, আরেকদিন ফুলের অর্ডার এমন কতো কতো খাদের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সেসবের খোঁজ কেউ রাখছে না।

হেলেদুলে বাড়ি ফিরলো আদ্রিকা। বিস্ময়ের ওখানে থ্রি পিজ বদলে কলেজ ড্রেস পরে নিয়েছিলো। বিছানার উপর ব্যাগ রেখে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। পেছন থেকে আদ্রতা জানতে চাইলো,
– দেরী হইলো কেনো?
– আইসিটি ল্যাব ছিলো।

আজকাল কারনে অকারণে আদ্রিকা আনমনে হাসে। পড়তে বসে মিটিমিটি হাসে, কলেজ যাওয়ার পথে এদিক ওদিক তাকায়। সারাক্ষণ সেজেগুজে আয়নার সামনে ঘুরেফিরে নিজেকে দেখে। চঞ্চলা, রূপবতী মেয়েটিকে একপলক দেখার জন্য অনেক অনেকক্ষণ কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে থাকে বিস্ময়। ইচ্ছে করে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ছোট্ট বউটাকে নিয়ে ব্যস্ত নগরী থেকে ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। বাতাসের গতিতে বাইক চালিয়ে গন্তব্যহীন ছুটতে থাকবে৷ কোমড় জড়িয়ে ধরে পেছনে বসে থাকবে আদ্রিকা৷ আহা! এমন সুখ স্বপ্ন দেখতে মন্দ লাগে না। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মুক্তমঞ্চে বসে এমন অনেক অনেক সুখের গল্প বলে বিস্ময়। আদ্রিকা মনোযোগ দিয়ে শুনে। ওরা যখন টোনাটুনির বাসা বাঁধবে তখন এভাবে হুটহাট বাইকে চেপে বেড়িয়ে যাবে অজানার উদ্দেশ্যে।

বিয়ের আগে এটাই হয়তো শেষবার ক্লাসে আসা। সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে৷ আশানুরূপ ফলাফল দেখে মনটা ভালো হয়ে গেলো আদ্রতার। বিষন্ন জীবনে কিছু একটা তো মনমতো হলো। কি ভেবে যেনো চারপাশে খুঁজে দেখলো বিকল্পকে। কোথাও দেখতে পেলো না। কাউকে জিজ্ঞাসা করাটা ভালো দেখাবে না। তাই ডিপার্টমেন্টের এককোনায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। শেষ মুহুর্তে ধীর পায়ে এলো বিকল্প। একপলক রেজাল্ট দেখে নিয়ে রেজাল্ট কার্ডটি দুমড়েমুচড়ে পকেটে রাখলো।

– রেজাল্ট কেমন হয়েছে?

আদ্রতার কথায় চমকে ওরদিকে তাকিয়ে তৎক্ষনাৎ মাথা নিচু করে পায়ের জুতোর দিকে তাকিয়ে মলিন স্বরে বললো,
– মোটামুটি।
– রেজাল্ট কার্ড দেখি।

সে কথা এড়িয়ে গিয়ে বিকল্প বললো,
– তোমার রেজাল্ট নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে?
– আলহামদুলিল্লাহ। 3.88 একটুর জন্য ফাস্ট পজিশন মিস হয়ে গেছে।

এতোক্ষণে হাসি দেখা গেলো বিকল্পের মুখে। তা দেখে আদ্রতা বললো,
– কই, রেজাল্ট কার্ড দেখাও।
– আরে বাদ দেও। আমার রেজাল্ট ওতোটাও ভালো হয়নি।

আদ্রতার হঠাৎ কি যেনো হলো! কোথা থেকে এমন অধিকার জন্মালো সে জানে না। বিকল্পের প্যান্টের পকেটে নিজের হাত ঢুকিয়ে রেজাল্টকার্ডটি বের করে আনলো। হকচকিয়ে গিয়ে কিছু বলতেও ভুলে গেলো বিকল্প। আদ্রতা নির্বিকার। রেজাল্ট কার্ডে চোখ বুলিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে উচ্চস্বরে জানতে চাইলো,
– একি অবস্থা! মাত্র টু পয়েন্ট! এতো খারাপ করলে কি করে? তুমি অনেক ভালো স্টুডেন্ট ছিলে।

ওর চিন্তিত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বিকল্প মলিন হাসলো। অনুরোধের সুরে বললো,
– পড়াশোনা ছেড়ো না আদ্রতা। তুমি অনেক ভালো করবে।

ওর হাত থেকে রেজাল্টকার্ডটি নিয়ে ডিপার্টমেন্ট ত্যাগ করলো। মূর্তিমান আদ্রতা সেখানে নিশ্চুপ ছিলো অনেকক্ষণ। তারপর ছুট লাগালো বিকল্পের পেছনে। ওর সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,
– তুমি আমার জন্য এমনটা করছো? প্লিজ এমন করো না। দেখো, ভালোবাসা জীবনের সবকিছু নয়। এটা একটা অনুভূতি মাত্র। এর বাইরে জীবনে অনেককিছু রয়েছে, যা আঁকড়ে ধরে অনায়াসে একটা জীবন পার করে দেওয়া যায়। বাড়িতে তোমার অসুস্থ মা রয়েছেন। তুমি তার একমাত্র ছেলে। তোমাকে নিয়ে উনার কতো স্বপ্ন! পড়াশোনা করে ভালো জব করবে, উনার চিকিৎসা করাবে। একটা মেয়ের মোহে পরে নিজের মাকে অবহেলা করতে পারোনা। উনি অনেক কষ্ট করে একলা তোমার লালনপালন করেছেন, লেখাপড়া করিয়েছেন। উনার কষ্টের এই প্রতিদান দিবে?

আদ্রতা তাকে নিয়ে ভাবছে! অনেক ভালো লাগলো বিকল্পের। মলিন মুখে হাসি ফুটেছে। ছলছল চোখে চেয়ে অনেকখানি সাহস করে আদ্রতা এক হাতের আঙ্গুল আলতো করে ধরলো। হাত ছাড়িয়ে নিলে নিক, অপমান করলে করুক। এসবের তোয়াক্কা বিকল্প করে না। মলিন মুখে হাসিটা খুবই করুণ দেখাচ্ছে। আদ্রতার বুকের ভেতর কেনো যেনো ভীষণ ব্যথা শুরু হলো। নির্মিশেষ তাকিয়ে রইলো বিকল্পের দিকে। ওর চোখে চোখ রেখে বিকল্প বললো,
– মা নেই আদ্রতা। দুদিন আগে মারা গিয়েছেন।

আর অপেক্ষা না করে হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো।

***

বাড়িতে আদ্রতার বিয়ে নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মেহমান যা আসছে সব মাহিনদের বাড়িতে। আদ্রতার নানা বাড়ির সাথে তেমন কোনো আত্মীয়তা অবশিষ্ট নেই। ও বাড়ি থেকে মেহমান আসা মোকাররমের পছন্দ নয়। এজন্য আদ্রতার মামারা ধীরে ধীরে বোনের খোঁজ খবর নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে৷ তবুও নীহার ফোন করে দাওয়াত দিয়েছিলো। বিয়ের দিন আসবে বলেছে। কিন্তু মাহিনদের বাড়ি ভরে গেছে মেহমান দিয়ে। মাহিনের নানাবাড়ির সকল সদস্য এসে বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে। সেমিস্টার ব্রেকের কারনে আদ্রতার ভার্সিটি আপাতত বন্ধ। তাই বাড়িতে বসে রাজ্যের মানুষের আদর যত্নে ব্যস্ত দিন কাটছে৷ পাশাপাশি দুটো বাড়ি হওয়ায় মাহিনের আত্মীয়রা সময়ে অসময়ে চলে আসছে আদ্রতার বাড়িতে। এতো সমাগমের মধ্যে বিস্ময়ের সাথে আজকাল খুব একটা কথা হচ্ছে না আদ্রিকার। সে নিয়ে মন ভার করে বিস্ময় বললো,
– তুমি আজকাল আমাকে সময় দিচ্ছো না, মেঘমালা।
– বাড়ি ভরা লোকজন। সুযোগ পাচ্ছি না। রাতে ফোনে কথা না হলেও এতোদিন কলেজে দেখা হতো। কালকে থেকে সেটাও মনে হয় বন্ধ হয়ে যাবে।
– কেনো?
– আগামী সপ্তাহে আপুর বিয়ে৷ বাড়িতে অনেক কাজ। মা বলেছে, এই কয়েকদিন কলেজে না যেতে৷
– কিহ! এতোদিন তোমাকে না দেখে কীভাবে থাকবো?

খিলখিল করে হেসে উঠলো আদ্রিকা।

– ইশ! ঢং দেখো!
– সত্যি বলছি৷ তোমাকে একদিন না দেখলে আমার ভালো লাগে না।
– কালকে নয়ন ভরে দেখে নিও। তারপর কয়েকদিন এই স্মৃতি দিয়ে কাজ চালিয়ে নিবে।
– কতোদিন দেখা হবে না?
– সবমিলিয়ে প্রায় দশ দিন।
– তাহলে একটা কাজ করো। কালকে কলেজ যেতে হবে না। সোজা বাড়িতে চলে এসো।
– তোমার বাড়িতে?
– হ্যাঁ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমার সাথে থাকবে। অনেক অনেক স্মৃতি তৈরি করে নিবো।
– আচ্ছা।
– একটু দেরী করে বের হয়ে নয়টার দিকে এসো। সকালের দিকে আমাকে একবার অফিসে যেতে হবে৷ নয়টার মধ্যে ফিরে আসবো৷

পরেরদিন সকালে কলেজ ড্রেস না পরে গোলাপি একটা সালোয়ার কামিজ গায়ে দিলো। তা দেখে আদ্রতা বলল,
– ড্রেস পরিস নি কেনো? কলেজে বকা দিবে না?
– বান্ধবিরা মিলে প্ল্যান করেছি আজকে ইউনিফর্ম পরবো না। তাছাড়া আজকে বৃহস্পতিবার। ক্লাস টিচার কিছু বলবে না। এক ড্রেস পরতে পরতে বোর হয়ে গেছি। একটু সাজিয়ে দেও।

চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে চুলগুলো আধাখোলা রেখে পাঞ্চক্লিপ লাগিয়ে দিলো৷ মুখে একটু ময়েশ্চারাইজার দিতেই ফর্সা ত্বকে গোলাপি আভা দেখা দিয়েছে৷ এক্সট্রা মেকাপ কিংবা ব্ল্যাশ দিতে হলো না।

মাস্ক পরে কলেজের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে করতে সময়ের আগেই বিস্ময়ের বাড়ির সামনে পৌছে গিয়েছে আদ্রিকা। মেইনরোডেই রিক্সা থেকে নেমে বাকিটা পথ ধীর পায়ে হেঁটে এলো। হাতে ঘড়ি নেই, তাই সময় অনুমান করা যাচ্ছে না। তবে যে ধীর গতিতে হেঁটে এসেছে তাতে এতোক্ষণে নয়টা পেরিয়ে যাওয়ার কথা৷ ভেতরে যাবে না, যাবে না করেও সিমেন্টের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো৷ তখনি হুড়মুড় করে নিচে নামতে দেখা গেলো পরখকে। দুজন দুজনার দিকে বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো আদ্রিকা। সালাম দিয়ে দ্রুত এড়িয়ে চলে গেলো। স্লাইডিং ডোরটি হালকাভাবে টান দিতেই বুঝা গেলো দরজা লক করা।

– বিস্ময় বাড়িতে নেই।

পেছন থেকে আসা আওয়াজে চমকে ফিরে তাকালো। পরখ দাঁড়িয়ে আছে ছাদে। আদ্রিকা ভেবেছিলো পরখ চলে গেছে৷ সেজেগুজে বাইরেই তো যাচ্ছিলো৷ ফিরে এলো কেনো? পরখের সামনে দাঁড়ালে কেনো যেনো ভীষণ অস্বস্তি হয়। পায়ের দিকে তাকিয়ে নখ খুটতে খুটতে জবাব দিলো,
– আমি অপেক্ষা করি।
– কেনো এসেছো এখানে?

পরখের সাথে এটা দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। প্রথমদিন শুধু সামনাসামনি দেখা হলো। সাধারণ কোনো কথাবার্তাও হয়নি। এমন দূরদূরান্তের সম্পর্ক একজন মানুষের সাথে। তার মুখে এমন ব্যক্তিগত প্রশ্ন শুনে অবাক হলো আদ্রিকা। বিরক্তবোধ করলো খানিকটা। হতে পারে সে বিস্ময়ের ফ্ল্যাটমেট। তাই বলে ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে? পরখ যদি এই প্রশ্নটি বিস্ময়কে করতো, তাও মেনে নেওয়া যেতো৷ কিন্তু আদ্রিকাকে সরাসরি প্রশ্ন করাটা একটু বেশি অনধিকারচর্চা হয়ে গেলো না? বিরক্তবোধটা মুখে ফুটে উঠলেও জবাব দিলো,
– বিস্ময়ের সাথে দেখা করতে।

উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হলো না বোধহয়। পরখকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে দেখে ভড়কে গেলো আদ্রিকা। পিছিয়ে গিয়ে স্লাইড ডোরের সাথে আরোও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো। তবুও থামলো না পরখ। আদ্রিকার একদম কাছে দাঁড়িয়ে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। গায়ের সাথে গা ছুঁই ছুঁই। পরখের বলিষ্ঠ দেহের পেছনে আদ্রিকার ছোট দেহটি হারিয়ে গেছে। ভয়ে, অস্বস্তিতে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। আদ্রিকার নিচের ঠোঁটের হালকা গোলাপি লিপস্টিক বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ঘষে মুছে দিলো পরখ। অনাকাঙ্ক্ষিত ছোয়ায় গা ঘিনঘিনে অনুভূতি ছড়িয়ে পরলো দেহ জুড়ে৷ আসন্ন বিপদের কথা ভেবে হাটু কাঁপছে থরথর। মুখটা আদ্রিকার মুখের কাছে এনে গাঢ় স্বরে বললো,
– দেখা করতে এমন এক ফ্ল্যাটে এসেছো, যেখানে আরেকজন ব্যাচেলর ছেলে থাকে। তোমার ভয় করছে না?

এতোক্ষণ চোখের জল গড়িয়ে পরছিলো নীরবে। পরখের কথায় অজান্তেই হেঁচকি তুলে কেঁদে ফেললো। বাঁকা হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ালো পরখ৷ শান্ত কন্ঠে বললো,
– এর থেকেও ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে তোমার সাথে৷ আর কখনো এখানে আসবে না।

সরে যেতে দেরী নেই, আদ্রিকা নিজের কাঁধের ব্যাগের ফিতা দু হাতে চেপে ধরে এক ছুটে নেমে এলো বিস্ময়ের ফ্ল্যাট থেকে। মেইনরোড থেকে রিক্সা নিয়ে কীভাবে বাড়ি পৌঁছেছে সে জানে না৷ বাড়িতে ঢুকে হলরুমেই কাঁধের ব্যাগটা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে হড়বড়িয়ে বমি করতে লাগলো। নীহার, আদ্রতা ছুটে এলো সাথেই। নিস্তেজ হয়ে পরেছে আদ্রিকা। গায়ে ভীষণ জ্বর। কোনোরকমে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো ঘরে। আধো জাগরণেও পরখের ভীতি আদ্রিকার পিছু ছাড়লো না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, আর কখনো বিস্ময়ে সাথে অপরিচিত পরিবেশে দেখা করতে যাবে না৷

কাজের চাপে আদ্রিকার দিকে খুব একটা খেয়াল রাখা সম্ভব হলো না। তবুও তিনবেলা ভাত খাইয়ে দেওয়া, ঔষধ খাওয়ানোর কাজটি আদ্রতা ঠিকমতো করেছে। যার কারনে রাতের দিকে জ্বর কমে গেলেও দূর্বলতা রয়ে গেলো। টেবিলের উপর রাখা ফোনটি বেজে উঠতেই দূর্বল হাতে রিসিভ করলো আদ্রিকা। ওপাশে বিস্ময়ের অভিমানী কন্ঠস্বর,
– কেনো এলে না, মেঘমালা?

আদ্রিকা গিয়েছিলো সেই খবর তাহলে জানায়নি পরখ। ভদ্রতার মুখোশ পরে অমানুষ একজন। এতোদিনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে ইচ্ছে হলো না আদ্রিকার। দূর্বল গলায় বললো,
– সকাল থেকে ভীষণ জ্বর। স্যরি, তোমাকে খবর দিতে পারিনি।

অসুস্থতার খবরে উতলা হয়ে উঠলো বিস্ময়৷ পারলে এখনি ছুটে চলে আসে। ফোনের এপাশে মুচকি হাসলো আদ্রিকা। এইটুকু ভালোবাসা-ই তো চাই জীবনে। অসুস্থতার খবরে কেউ একজন উতলা হবে, ভালোবেসে মাথায় হাত রাখবে৷

– ঔষধ খেয়েছি৷ জ্বর কমে গেছে। একটু দূর্বল লাগছে শুধু।
– এই শরীর নিয়ে বিয়ে বাড়িতে হৈ হুল্লোড় করতে যেয়ো না আবার। রেস্ট নেও। আর শোনো, বেশি সাজগোছ করবে না। তোমার দিকে অন্য ছেলেরা মুগ্ধ চোখে তাকাবে, আমার সহ্য হবে না। মানছি বোনের বিয়ে, ইনজয় করতে ইচ্ছে করছে৷ কিন্তু আমার কথা ভেবে অন্তত ভীড় এড়িয়ে চলো। যতোটুকু সম্ভব ঘরের ভেতর থাকার চেষ্টা করবে।
– আচ্ছা ঠিক আছে।

এরপর দুজনে চুপ করে রইলো। আদ্রিকা ডাকলো,
– বিস্ময়?
– হুম।
– অনেকদিন তোমার সাথে ঠিকমতো কথা হবে না। একটা গান শোনাবে?
– কোন গান শুনবে? যেটা শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেই সেটা শোনাবো?
– উহু। এখন ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না৷ সারাদিন ঘুমিয়েছি।
– তাহলে কোনটা শুনতে চাও?
– এই মুহুর্তে তোমার মাথায় যেটা আসে।

গতকাল রাতের ওই বৃষ্টির ফোঁটাতে
তোমাকেই খুঁজেছি কেনো আসোনি তুমি?
বিষাদের রঙেতে আঁকা কতো যে আঘাত
তুমি নেই, তুমি নেই করে কাটছে প্রতিরাত।
তুমি ওমন করে আমায় আর ডাকো না
কেনো হঠাৎ এসে হাতে হাত রাখো না?

তুমি আড় চোখে আর আমাকে খুন করো না
তোমাকে কাজল টিপে বহুদিন দেখিনা।
তুমি হায় দিন যায় চলে যায় রজনী
নদী শুকিয়ে গেছে আসোনি তুমি…

চলবে…

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
দ্বাবিংশ পর্ব

লোকসমাগম একদম পছন্দ নয় মোকাররমের। কিন্তু মাহিনের মায়ের ইচ্ছায় বিয়ের জমকালো আয়োজন করা হয়েছে। উনার ছোটপুত্রের বিয়েতে কোনোরকম কমতি রাখতে চান না। গতকাল মেহেদির অনুষ্ঠান হলো ঢাক ঢোল পিটিয়ে৷ মাহিনের বাড়ির সকল নারী অতিথিরা আদ্রতার বাড়িতে ভীড় জমিয়েছে। এ বাড়িতে নারী সদস্য মাত্র তিনজন। নীহারের সময় কোথায় হাত ভর্তি করে মেহেদি দিয়ে পটের বিবি হয়ে বসে থাকার! বিয়ের কনে আদ্রতা, সে নিজেও খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তবুও জোরাজুরি করে দু হাত ভর্তি করে মেহেদি পরানো হয়েছে৷ এরপর অতিথিরা সবাই আসন পেতে বসেছে মেহেদির ডালা নিয়ে৷ সারারাত গান নাচে মেতেছিলো সবাই। এদিকে দুহাতে মেহেদি দিয়ে এককোনায় মনমরা হয়ে বসেছিলো আদ্রিকা। এতো সুন্দর করে মেহেদি দিয়ে কি লাভ হলো! বিস্ময় দেখতে পারলো না তার মেহেদি রাঙা হাত। দু মিনিট ফোনে কথা বলবে সেই সুযোগও নেই।
নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সবাই ক্লান্ত হয়ে আদ্রতার ঘরে, হলরুমে, বাইরের বারান্দায় গাদাগাদি করে শুয়ে পরেছিলো। সকাল আটটা বাজতেই বিছানা থেকে গুটিগুটি পায়ে নেমে এলো আদ্রিকা। মেঝে ভরা মানুষজন। কে কোনদিকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে তার ঠিক নেই। একজনের ঘাড়ের উপর আরেকজনের পা। সেসব পেরিয়ে সাবধানে বেড়িয়ে এলো। বাইরের সোফার টেবিলে রাখা ফোন। এই সুযোগে বিস্ময়ের সাথে কথা বলে নেওয়া যায়। ঘুমকাতুরে চোখ দুটো হাতের পিঠে ঢলে বিস্ময়ের নাম্বার ডায়াল করতে যাবেই পেছন থেকে মোকাররমের রুক্ষ কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
– সাত সকালে উঠে ফোন হাতে নিছিস কেন? ফোনে কি দরকার তোর?

আমতাআমতা করে আদ্রিকা কোনোরকমে জবাব দিলো,
– সময় দেখতেছি আব্বু।
– বাড়িতে ঘড়ি নাই? ফোন দে এদিক। সারাক্ষণ ফোন একটা কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুরে৷

আদ্রিকার একমাত্র সম্বল বগলদাবা করে নিয়ে গেলো। বিস্ময়ের সাথে যোগাযোগের এই একটা পথ বাকি ছিলো। সেটাও গেলো। রাগে, দুঃখে, হতাশায় সারাটা দিন ঘরে মনমরা হয়ে বসে রইলো।

আদ্রতার গায়ে হলুদের কথা ছিলো দুপুর বারোটায়৷ সব গুছিয়ে গায়ে হলুদ যখন শুরু হলো তখন বিকাল তিনটা বাজে। হলুদ জমিন লাল পাড়ের শাড়ি পরে স্টেজে কাঠের ছোট একটি পীড়িতে বসে আছে আদ্রতা। মোকাররমকে জোর করে ধরে নিয়ে এলেন কয়েকজন মহিলা। বাবার হাতে মেয়ের দেহে প্রথম হলুদ ছুঁলো। শক্তপোক্ত আদ্রতার চোখ আদ্র হলো ক্ষণিকেই। ও ভেবেছিলো যাই হয়ে যাক, সে কাঁদবে না। অদৃষ্টের লক্ষণ মেনেই নিয়েছে। কেঁদেকেটে কি হবে! সেই প্রতিজ্ঞায় সূচনায় বিঘ্ন ঘটলো।
হতে পারে মোকাররম মানুষ হিসেবে ত্রুটিসম্পন্ন। হয়তো বাবা হিসেবেও তেমন একটা ভালো নয়। তবুও বাবা তো। পিতৃত্বের প্রথম অনুভূতি পেয়েছেন যার আগমণে, সেই মেয়ের বিয়েতে একটুও কি কষ্ট হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেন না। সারাজীবন মেয়েদের এতো ধমকের উপর রেখেছেন, এতো বকেছেন যে এখন দুটো আদরের কথা বলতে লজ্জা লাগে। একটু একটু করে পুরো পরিবারের সাথে এতো দূরত্ব কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে বুঝতেই পারেননি। মেয়ের গালে হলুদ ছোঁয়ার সময় হাতটা এতো কাঁপছিলো! আশেপাশের মহিলাগুলো কি কি যেনো বলছিলো? দুটো পান পাতায় হলুদ নিয়ে প্রথম দু গালে দেন, কপালে, নাকে, দু হাতে তারপর পায়ের পাতায়। আবছা আবছা শুনেছেন কিন্তু এতো কিছু করতে পারলেন না৷ এতো দীর্ঘ যাতনা সহ্য করা সম্ভব নয়। কোনো রকম দু গালে হলুদ ছুঁইয়ে দিলেন। মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকা মেয়েটার শরীর ভীষণ কাঁপছে। মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন। ওদিকে কতো কাজ বাকি! বাবুর্চিখানায় ওরা কি করছে কে জানে?

একে একে বিবাহিত নারী সদস্যরা আয়েশ করে আদ্রতার দেহে হলুদের প্রলেপ লেপ্টে দিলো। ডাকতে ডাকতে সবশেষে এলো নীহার। হলুদ কি দিবেন কেঁদেই কূল পাচ্ছেন না। তবুও নিয়ম মেনে মেয়ের গায়ে হলুদ দিলেন, মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন, মিষ্টি খাওয়ালেন। তারপর মেয়েকে জড়িয়ে এমন কান্না শুরু করলেন যে সবাই মিলে উনাকে সামলানো মুশকিল হয়ে গেলো৷ আদ্রতা নিজেও এতোক্ষণ কাঁদছিলো কিন্তু মাকে এভাবে ভেঙে পরতে দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে আদ্রিকাকে খুঁজলো। মেয়েটা কোথায় ঘাপটি মেরে আছে কে জানে? মাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আদ্রতা চাইলেই আসর ছেড়ে বের হতে পারছে না৷ এই মেয়েটার বুদ্ধিসুদ্ধি কবে হবে কে জানে? পাশে বসে থাকা মেয়েদের মধ্যে একজনকে বললো, আদ্রিকাকে ডেকে বলো আম্মুকে এখান থেকে নিয়ে যেতে।

আদ্রিকাকে খুঁজে পাওয়া গেলো নিজের ঘরে৷ খবর পেয়ে ছুটে এসে নীহারকে টেনে হিচড়ে নিয়ে গেলো।
হলুদ মাখানো পর্যন্ত ঠিক ছিলো কিন্তু গোসল! সে এক লজ্জাজনক পরিস্থিতি। মৌমাছির মতো মহিলারা জেঁকে ধরেছে। এদের সামনে গোসল করতে হবে ভেবেই আদ্রতার গলা শুকিয়ে আসছে। এতো অনুরোধ করলো নিজেই গোসল করে নিবে, কেউ শুনলো না। এখনো নাকি নিয়মকানুন বাকি। কলসি ভরে পানি এনে আদ্রতার গায়ে ঢাললো। পাতা কাপড় ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। গামছাটা গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে কোনোরকমে বসে অত্যাচার হজম করছে। পেছন থেকে একজন মহিলা বললেন, এবার শাড়িটা খুলে ভালোভাবে গোসল করাতে হবে। আর ধৈর্য্য রাখতে পারলো না আদ্রতা৷ সবার সামনে কোনোভাবেই গোসল করবে না। মাহিনের বড় ভাবি হয়তো বুঝলেন আদ্রতার বিড়ম্বনা।
– সব নিয়ম কানুন শেষ৷ এখন আমরা বেড়িয়ে যাই। ও নিজে ভালোভাবে গোসল করে নিক। আমাদেরও তো গোসল সেরে নিতে হবে।

আটকে রাখা শ্বাস ছাড়লো আদ্রতা। ভেজা গায়ে এক ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে আদ্রিকাকে বললো,
– দরজা বন্ধ করে দে। ঘরে কেউ যেনো ঢুকতে না পারে৷

গোসল সেরে বাসন্তি রঙের একটা শাড়ি পরে নিলো। ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে বাইরে এসে দেখলো ঘরে পায়েচারি করছে অপরিচিত একটি মেয়ে। বিয়ে বাড়িতে কতোশত মেহমান এসেছে। সবাইকে চেনে না আদ্রতা। ওদের মধ্যে কেউ একজন ভেবে খুব একটা গুরুত্ব দিলো না। নিজের কাজে ব্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি আদ্রিকার কথা ভাবছে। মেয়েটাকে বলেছিলো ঘরে কাউকে ঢুকতে না দিতে৷ অথচ অপরিচিত একটা মেয়েকে ঘরে রেখে নিজেই গায়েব। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে ময়েশ্চারাইজার দিচ্ছিলো। কাঁচা হলুদের কারনে হাত পা সব এখনো হলুদ হয়ে আছে।
– আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো আদ্রতা।

চমকে পেছনে তাকালো আদ্রতা। মেয়েটা কখন যেনো পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
– জ্বি বলুন।
– এখানে বলা যাবে না।

মেয়েটার কথা শুনে আদ্রতা টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু উঁচু করে চাইলো। দেখতে চো র ছি নতাইকারী বলে মনে হচ্ছে না। ভদ্র চেহারা, গায়ে শালীন বেশভূষা।
– কিছুক্ষণের জন্য আমার সাথে বাইরে আসবেন?
– আজকে আমার বিয়ে৷ বিয়ের কনে এখন একা বাইরে গেলে লোকে কী ভাববে?
– কিচেনের দরজা দিয়ে বাড়ির পেছনে আসুন। কেউ খেয়াল করবে না।
– পুরো বাড়ি মানুষজনে গিজগিজ করছে।
– এতো মানুষজন পেরিয়ে আমি এলাম। কেউ খেয়াল করেনি। স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চলে আসুন। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত।

গটগট করে বেড়িয়ে গেলো মেয়েটা। কিছুক্ষণ ভেবে আদ্রতা নিজেও দ্রুত পায়ে কিচেনের ছোট দরজা দিয়ে সোজা বাড়ির পেছনের দিকে চলে গেলো৷ এদিকটায় তেমন কেউ আসে না। সামান্য একটু জায়গা। নীহার কিছু সবজি আবাদ করে। এছাড়া চারা উৎপাদনের বীজ এখানেই রোপন করা হয়। তাই বেশির ভাগ সময় আগাছা দিয়ে ভরা থাকে এদিকটা। শাড়ির কুচি উঁচু করে ধরে মেয়েটার পিছু পিছু কীসের টানে এগিয়ে যাচ্ছে আদ্রতা জানে না৷ বাড়ির শেষ সীমানায় এক বুক সমান উচ্চতার ইটের দেয়াল। পুরো বাড়িতে সুউচ্চ দেয়াল দ্বারা ঘেরা থাকলেও পেছনের এই দেয়ালটার উচ্চতা একটু কম রাখা হয়েছে। পেছনে পরিত্যক্ত রাস্তা। কেউ হাঁটাচলা করে না। এমন জায়গায় মূল্যবান ইটের অপচয় করতে চাননি মোকাররম। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে বিকল্প।

বিকল্পকে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ালো আদ্রতা। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো বিকল্পের দিকে। মেজাজ বিগড়েছে অনেক আগেই। নিজেকের বোকামির কারনে নিজের উপরেই রাগ লাগছে৷ যার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো বিকল্পের উপর৷
– তুমি পাঠিয়েছো উনাকে? ও খোদা! কী বোকা আমি! উনার কথা শুনে নাচতে নাচতে চলে এলাম এখানে। একবারও ভাবলাম না, এর পরিণাম কি হতে পারে। আমাকে কেউ এখানে দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কেনো এসেছো তুমি এখানে? আমি ভেবেছিলাম তোমার সুবুদ্ধি উদয় হয়েছে। তুমি যে মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় ছিলে কে জানতো? একদম আমার বিয়ের দিন ঝামেলা কর‍তে চলে এসেছো! কি ভেবেছো? বিয়ে ভেঙে গেলে আমার বাবা নাচতে নাচতে তোমার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিবে? মোটেও না। দরকার পরলে আমাকে কে টেকু টে মনতরীতে ভাসিয়ে দিবে। তবুও নিজের সম্মানে সামান্যতম দাগ পরতে দিবে না৷ আমার পিছু ছেড়ে দিচ্ছো না কেনো তুমি?

একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছে আদ্রতা। ভীষণ ঘাবড়ে গেছে মেয়েটা। বিকল্প ওকে বলতে দিলো৷ কথা শেষে লম্বা শ্বাস নিয়ে শান্ত হলো আদ্রতা। বিকল্প কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না বলে নিজেই লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। শুকনো মুখে সামান্য হাসার চেষ্টা করে বিকল্প বললো,
– উনার নাম আল্পনা। তোমার সাথে দেখা করার চেষ্টায় তোমাদের বাড়ির সামনে ঘুরাফেরা করছিলেন। সকালে আমার সাথে আলাপ হলো। উনার কথা শুনে জরুরি মনে হলো তাই তোমার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তোমার বাড়ির অলিগলি যেহেতু আমার চেনা। তুমি কি উনার কথাগুলো একটু শুনবে?

আদ্রতা অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে আরেকবার তাকালো। বয়সে আদ্রিকার সমান হবে। বেশ সুশ্রী, মায়াবী চেহারা। আবার বিকল্পের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
– আমার বাড়ির সামনে কি করছিলে তুমি? বাড়ির অলিগলি কীভাবে চিনো?

বিকল্প কিছু বললো না। কি উত্তর দিবে সে? সে তো প্রায়শই আদ্রতার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। বিষন্ন জীবনে যখন বেঁচে থাকার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলতো তখনি চলে আসতো আদ্রতার দুয়ারে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে বুঝাতো, তোমার বেঁচে থাকার একটা কারন এখানে আছে। অনেক অনেক পরিশ্রম করতে হবে। চুপকথার রাজকন্যার যোগ্য হতে হবে৷
যেদিন মাহিনের মা মারা গেলো সেদিন আর বাড়ি ফেরা হয়নি। সারাটা রাত চুপকথার চারপাশে ঘুরঘুর করে রাত কাটিয়ে দিয়েছে। তখনি নজরে এসেছিলো এই নিচু দেয়ালটা। একটু চেষ্টা করলে টপকে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করা যায়।

আল্পনা আলতো করে আদ্রতার হাতে হাত রাখলো। মুচকি হেসে বললো,
– আমার কাছে মাহিনের কিছু ছবি আছে। আপনি কি দেখবেন?

কী মিষ্টি মেয়েটার কন্ঠস্বর! আদ্রতা মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। আল্পনা নিজের ফোনের গ্যালারি থেকে কিছু ছবি দেখালো যেখানে আল্পনা ও মাহিনকে একসাথে দেখা যাচ্ছে। কিছু সেলফি, কিছু ছবি ব্যাকক্যামেরায় তোলা। হয়তো টাইমার অন করে তুলেছে। ছবিতে খুব ঘনিষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে দুজনকে। হোটেলের কামরায় সাদা বেডশিটের নিচে দুজনে শুয়ে আছে। আল্পনাকে কোলে বসিয়ে ওর কপালে চুমু দিচ্ছে মাহিন। আল্পনার হাত ধরে তাতে চুমু দিচ্ছে। সবগুলো ছবি দেখার রুচি হলো না আদ্রতার৷ অন্য কেউ হলে এমন ধোঁকাবাজিতে ভেঙে পরতো, চোখের জলে বুক ভাসাতো। কিন্তু আদ্রতার চোখ রুক্ষ। মুখ লাল হয়ে উঠেছে। রাগে কাঁপছে মেয়েটা।

– এই অমানুষটাকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম আমি! কী আশ্চর্য! সবার সামনে ভদ্রতার মুখোশ পরে বেড়ায় সেটা আগেই জানতাম। তাই বলে এতোটা নীচ, এতো নোংরা, জঘন্য তা জানতাম না। চরিত্রহীন, নর্দমার কীট। জানোয়ারের থেকেও অধম।

রাগে পায়েচারি করতে করতে এমন অনেক গালি ছুটতে থাকলো আদ্রতার মুখ থেকে। রাগ কিছুটা শিথিল হলে আল্পনার দিকে তাকিয়ে হুশ ফিরলো। মেয়েটা তো মাহিনকে ভালোবাসে। ওর সামনে এতো নোংরা গালি দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।
– স্যরি আল্পনা। রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা বলে ফেলেছি৷ তোমার খারাপ লেগেছে, তাই না?

চওড়া হাসলো আল্পনা।
– প্রতি মুহুর্তে আমি নিজেই ওকে এর থেকেও ভয়ংকর গালি দেই আপু। আপনি কেনো স্যরি বলছেন? ভাবছেন আমি ওকে ভালোবাসি? বাসতাম একসময়। অজান্তে ভুল করে ফেলেছি। ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি। তাই বলে জেনে-বুঝে আ গু নে ঝাপ দেওয়ার মতো বোকা আমি নই। আমার যা ক্ষতি করার ও করে ফেলেছে। কারন আমি অনভিজ্ঞ ছিলাম। এখন সবটা জানি। বিন্দুমাত্র ভালোবাসা আর অবশিষ্ট নেই। সুযোগ থাকলে ওই অমানুষটাকে আমি নিজে হাতে খু ন করে ফেলতাম।
– তাহলে এখানে কেনো এসেছো? আমাকে কেনো জানালে?
– আমি জানতাম না বলে আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। আপনাকে কেনো জেনে বুঝে ভুল করতে দিবো? আমি সহজে ফিরে আসতে পেরেছি। কিন্তু একবার বিয়ে হলে গেলে সেখান থেকে ফিরে আসাটা আপনার জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাবে। তখন এই সম্পর্কটা শুধু দুটো মানুষের মাঝে আবদ্ধ থাকবে না। সেখানে পরিবার জড়িয়ে থাকবে, জড়াবে তাদের সম্মান। সম্মান, সামাজিকতা, মানবতা, দায়িত্ববদ্ধতা কিছু পায়ের শিকল হয়ে আটকে রবে।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে এখন আর ছোট মনে হচ্ছে না৷ প্রতিকূলতা মানুষকে অভিজ্ঞ, জ্ঞানী, বিবেচক হতে সাহায্য করে৷ যে মানুষ প্রতিনিয়ত ঠকেছে, সে প্রতিনিয়ত শিখেছে। তার জ্ঞানের ঝুলি বেশি ভারী৷ লড়াই করার ক্ষমতা, টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি। গোলকধাঁধায় ফেঁসে গিয়েও আল্পনা কতো সহজে ফিরে আসতে পেরেছে। অথচ আদ্রতা এখনো গোলকধাঁধায় প্রবেশ করেইনি। মাত্র প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছে৷ তবুও ফিরে যেতে কতো বাঁধা! চাইলেই কি এতো সহজে বিয়ে ভেঙে দেওয়া যায়? বাড়িতে কতো মানুষজন! বিয়ের আয়োজন চলছে। আদ্রতার হাত ভরা মাহিনের নামের মেহেদি, গায়ে মাহিনের ছোঁয়া হলুদ। সেসব কলঙ্ক হয়ে লেপ্টে রবে গায়ে। একবার বিয়ে ভেঙে গেলে সারাজীবনের জন্য এ কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে হবে আদ্রতাকে। দুদিন বাদেই মাহিন বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে। কিন্তু আদ্রতার বিয়ের আলাপ উঠতেই লোকে বলবে, মেয়ে তো ভালো না। বিয়ের আসর থেকে বরযাত্রী ফিরে গেছে। অপয়া, অলুক্ষ্মে মেয়ে।

চিন্তায় ডুবে থাকা আদ্রতার হাত ধরে অতল টেনে তুললো বিকল্প। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে ভরসা দিলো।
– আমার সাথে যাবে আদ্রতা? এতো আরাম আয়েশের জীবন হয়তো দিতে পারবো না। তবে সুখে রাখবো তোমাকে। সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে তোমাকে ভালো রাখার৷

আদ্রতা ভেতরে ভেতরে বিদ্রুপের হাসি হাসলো। আরাম আয়েশের জীবন? লোকে কোথায় দেখে আরাম, কোথায় আয়েশ? চার দেয়ালের ভেতরের খবর কেউ জানে? দু বেলা মাছ গোশত দিয়ে ভাত খেলে বুঝি সে জীবন আরাম আয়েশের হয়? মাসের অর্ধেকগুলো দিন বাড়িতে ঝামেলা লেগে থাকে। এমন কোনো মাস যায়নি, যে মাসে মোকাররমের হাতে মা র খায়নি নীহার। অথচ লোকে বলে, নীহারের রাজকপাল। কতো বড় বাড়ি, স্বামীর জমজমাট ব্যবসা! শুধু একটা ছেলে নেই, এই আরকি।
বিকল্পের সাথে গেলে সুন্দর একটা জীবন ওর জন্য অপেক্ষা করছে এ নিয়ে আদ্রতার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজের সুখের বিনিময়ে জ্ব ল ন্ত অ গ্নি কু ণ্ডে নিক্ষেপ করত হবে নিজের মা, বোনকে। আদ্রতাকে না পেয়ে মোকাররম যে নীহারের উপর চ রা ও হবে এ ব্যাপারে ও পুরোপুরি নিশ্চিত। আদ্রতা থাকায় আ গু নের আঁ চ থেকে দূরে ছিলো আদ্রিকা। কিন্তু আদ্রতার ছায়া সরে যেতেই তীব্র দ হ নে মুহুর্তেই ঝ ল সে যাবে আদ্রতার আদরের ছোটবোনটি। কে আগলে রাখবে ওদের? নিমিষেই দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরলো। পেছন ফিরে তাকালো নিজের বাড়ির দিকে৷ কাঁপতে থাকা গলায় বললো,
– আমার মা, আদ্রিকা?

বিকল্প অবুঝ নয়। সবটাই বুঝলো। কিন্তু এই মুহুর্তে ফিরে যাওয়া মানে, জেনে বুঝে আ গু নে ঝাঁ প দেওয়া। যে আ গু নে মৃ ত্যু হয় না। প্রতিমুহূর্তে শুধু মন ঝ ল সে যেতে থাকে। এমন আত্মদ হ নের কোনো মানে হয় না। আদ্রতার গালে আলতো হাত রেখে বললো,
– আমরা ফিরে আসবো। শুধু কয়েকটা দিন মাত্র। তোমার বাবা এতোটাও ভয়ংকর নয়। হয়তো একটু রাগী, স্বার্থপর। কিন্তু অমানুষ নয়।

বিকল্পের হাতে হাত রেখে দেয়ালের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আদ্রতা প্রতিজ্ঞা করলো, সে ফিরবে। যা কিছু এলোমেলো করে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, সবটা ঠিক করে দিতে তাকে ফিরতেই হবে।

এক লাফে দেয়ালের উঠে বসলো বিকল্প কিন্তু আদ্রতা পরলো বিপাকে। শাড়ি পরে দেয়াল টপকানো চারটেখানি কথা নয়। তাও আবার এতো উচু দেয়াল। নিচ থেকে ওকে উপরে তুলে দিলো আল্পনা। উপর থেকে টেনে নিলে বিকল্প। ছলছল চোখে চেয়ে আদ্রতা চওড়া হেসে আল্পনার উদ্দেশ্যে বললো,
– তুমি ভীষণ সাহসী মেয়ে আল্পনা। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। দোয়া রইলো, সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে সূর্যের মতো ঝলমল করে উঠো।

আল্পনা মুচকি হাসলো। নিজেকে সে সামলে নিয়েছে। তবুও মাঝেমধ্যে বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা হয়। এর জন্য কাকে দায়ী করবে? সে তো নিজেই ভুল করেছে। তার এমন পরিস্থিতির জন্য সে নিজেই দায়ী।
আদ্রতাকে দেয়ালের ওপাশের রাস্তায় ঠিকমতো নামিয়ে দিয়ে বিকল্প নিজেও নেমে গেলো। যাওয়ার আগে আল্পনাকে বললো,
– আমার একটা কাজ করে দিবে আল্পনা? যদি তোমার কোনো অসুবিধা না হয়, তবে এই ছবিগুলো আরেকজনকে দেখাতে হবে। কখন দেখাবে সেটা পরিস্থিতি বিবেচনা করে তুমি ঠিক করে নিও। সাবধানে থেকো। আল্লাহ হাফেজ।

(চলবে..)