নোলককন্যা পর্ব-২৩

0
37

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
ত্রয়োবিংশ পর্ব

২৭

বিয়ের কনে বাড়িতে নেই খবরটি প্রচার হতে বেশি সময় লাগেনি৷ গোসল সেরে আদ্রতার খোঁজে এছেছিলো মাহিনের ভাবি। ওকে না পেয়ে আদ্রিকার কাছে জানতে চাওয়া হলো। সেও কিছু জানে না। ঘন্টা খানেকের মধ্যে বিয়ের অতিথি থেকে শুরু করে আশেপাশের প্রতিবেশীর মাঝে খবর ছড়িয়ে পরছে।
বিয়ের কনে পালিয়েছে খবরটা যখন মোকাররমের কাছে পৌঁছালো সে উদ্ভ্রান্তের মতো আশেপাশের মানুষের দিকে তাকালো। নীহারের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না৷ নিজের মেয়েকে সে ভালোভাবে চিনে৷ কখনো কারো সাথে কথা বলতে দেখেনি, সেরকম কোনো সন্দেহজনক আচরণ লক্ষ্য করেনি৷ তাহলে লোকে কেনো বলছে নীহারের আদ্রতা অন্য ছেলের সাথে পালিয়েছে?
ষাড়ের মতো তেড়ে এলো মাহিন। আদ্রিকাকে পাকড়াও করে বারবার জানতে চাইছে ছেলেটা কে? কার সাথে, কখন পালিয়েছে? সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু আদ্রিকা মাঝ সমাবেশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। নিজের কান্নাকাটি ছেড়ে নীহার এগিয়ে এসে মেয়েক আগলে দাঁড়িয়েছে। মাহিনের বিশাল গোষ্ঠীর সামনে মোকাররম, নীহার সামান্য একটি বিন্দুর মতো অসহায় বসে রইলো ভূমির উপর।

রাত নামতে শুরু করেছে। উৎসুক জনতা ভীড় কমিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যেতে লাগলো। মাহিনের আত্মীয় স্বজনদের ফিরিয়ে নিতে এসেছে মোজাম্মেল। মাহিনকে অনেক কষ্টে টেনেটুনে ঘরে ফেরানো হলো। মোজাম্মেল ফিরে যাওয়ার আগে মোকাররমের পাশে বসে বললো,
– বেশি লেখাপড়া করাইলে মেয়ে মানুষের এম্নেই পাখনা গজায়৷ কার সাথে ভাব আছে সেটা আগেই বলে দিলে আমাদের এমন ঝামেলায় পরতে হতো না। তোমার মানসম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিছে, সাথে আমাদেরও। শুধু শুধু কষ্ট করে ঘরে কালসাপ পুষছো। যতো যাই করো মেয়ে মানুষ কখনো বিশ্বাসের মান রাখে না। তোমার ঘরের তিনটা মেয়ে লোক সারাক্ষণ একসাথে বসে গুজগুজ করে। একজন ভাগছে কিন্তু বাকি দুজন তো আছে। কে কি করে, না করে সব খবর এরা জানে। ওদের জিগাও। সোজাভাবে কইতে না চাইলে কঠোর হও। আদরে দিয়া মাথায় তুলছিলা। এইজন্য তোমার মাথায় ঘোল ঢালছে৷ আমি কিছু কইলে তো গায়ে মাখবা না৷ তবুও কই, যে গেছে তারে তো আর ফিইরা আনতে পারবা না। কিন্তু ঘরে যেইটা আছে, সেইটার দিকে নজর দেও। সময় থাকতে এটারে মানে মানে বিদায় করো। কি হবে এতো লেখাপড়া করায়? দেখতা তো লেখাপড়া শেখানোর নমুনা। বাবা-মায়ের মুখে চুনকালি দিয়া অন্য ছেলের হাত ধরে ভাগছে৷ একলা করছে এই কাজ? জীবনেও না। তোমার ঘরের মানুষের হাত না থাকলে এতো লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়া কেমনে ভাগলো?

আস্তেধীরে উঠে দাড়ালেন মোজাম্মেল। সাদা পাঞ্জাবীতে একটু ধুলো লেগেছে। সেটা না হয় হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলা যাবে কিন্তু গায়ে যে অপমানের ধুলো ছিটিয়ে দিয়েছে আদ্রতা সেটা কীভাবে ঝেড়ে ফেলবেন? এতোক্ষণে পুরো এলাকায় খবর ছড়িয়ে গেছে৷ ব্যবসায়িক লোকজন থেকে শুরু করে সামান্য চেনাজানা মানুষগুলো পর্যন্ত ফোন দিয়ে জানতে চাইছেন, ছেলের বউ নাকি বিয়ের আসর থেকে ভাগছে?
মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছেন না মোজাম্মেল। ছোট ছেলের বিয়েতে বড়সড় আয়োজন করেছিলেন। এক হাজার মানুষকে দাওয়াত করে খাইয়েছেন দুপুরবেলা। যেসব বৃথা গেলো। এতো সহজে ছাড়বেন না মোকাররমকে৷ কড়ায় গন্ডায় হিসাব বুঝে নিবেন।

মোজাম্মেল চলে যেতেই মোকাররম উঠে দাড়ালো। রান্নার আয়োজন করা হয়েছিল আঙ্গিনা। ইট দিয়ে বিশাল চুলা পাতা হয়েছে। বড় বড় ডেক ভর্তি খিচুড়ি হয়েছিলো সকালে। বরযাত্রীদের জন্য পোলাও, রোস্ট, গরু, খাসি সব রান্না শেষ। জর্দা পোলাওটা রান্না করা বাকি ছিলো। কনে পালিয়ে যাওয়ায় বাবুর্চি চলে গিয়েছে তখনি। আঙ্গিনার একপাশে এখনো রাখা আছে বড় চুলায় জ্বাল দেওয়ার জন্য শুকনা মোটা কাঠের ফাঁড়ি। এক হাতে একটা তুলে নিয়ে ঘরের দিকে চলে গেলেন।

২৮

জানুয়ারীর মাঝামাঝি সময়। ভূবনভোলা মনতরীর কাছাকাছি হওয়ায় এখানে শীত একটু বেশি৷ নদী থেকে ভেসে আসা শীতল বাতাস হু হু করে তেড়ে আসে ভূবনভোলায়। গায়ে মোটা একটা হুডি পরে স্লাইডিং ডোর লক করলো। বাইকের চাবিটা হাতে নিয়ে দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে প্রধান ফটকের আম গাছটার নিচে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে পায়ের গতি ধিমে হয়ে এলো।
পরখকে দেখে গায়ের চাদরটা ভালোভাবে টেনে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কেটে গেছে কয়েক মুহুর্ত। বুকে হাত ভাঁজ করে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে পরখ৷ মুখে কিছু বলছে না কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আদ্রিকার দিকে। বাধ্য হয়ে আদ্রিকাকে মুখ খুলতে হলো। দৃষ্টি নিচু করে রেখে বললো,
– বিস্ময়কে একটু ডেকে দিবেন? ফোনে পাচ্ছি না।
– বিস্ময় বাড়িতে নেই।

শীতল কন্ঠে জবান দিলো পরখ। বাড়িতে নেই মানে? অবাক হলো আদ্রিকা। পরখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
– কোথায় গিয়েছে?
– নিজের বাড়িতে হয়তো।

বুঝলো না আদ্রিকা। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। তা দেখে পরখ নিজেই জানালো,
– গত সপ্তাহে বাসা ছেড়ে দিয়েছে৷

আদ্রিকার সরল মন আঘাতে আঘাতে ক্লান্ত। বাড়ির অসুস্থ পরিবেশে মস্তিষ্ক অচল হয়ে যাওয়ার পথে৷ অনুচ্চস্বরে বিড়বিড় করলো,
– ফোনটাও বন্ধ দেখাচ্ছে।

কথা শেষ হওয়ায় পরখ চলে যেতে চাইলো। দু পা এগোতেই পথ আটকে দাঁড়ালো আদ্রিকা। পরখের প্রশ্নাত্মক দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো,
– অন্য কোনো ফোন নাম্বার আছে?

পরখের চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি। তবুও চরম বেহায়া হতে হলো আদ্রিকাকে। বিস্ময়ের সাথে যোগাযোগ করাটা খুব দরকার। নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। একটুখানি কথা বলতে পারলে ভালো লাগবে। বিনাবাক্য পকেট থেকে ফোন বের করে বিস্ময়ের নাম্বার সার্চ করে দুটো নাম্বার পেলো। ফোনটি আদ্রিকার দিকে এগিয়ে দিতেই সে জানালো,
– আমার কাছে ফোন নেই। আপনার ফোন থেকে কল করি?
পরখ কোনো জবাব দিলো না। ফোনটি এখনো আদ্রিকার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে অর্থাৎ সম্মতি আছে ধরে নিয়ে পরখের হাত থেকে ফোনটি নিলো। পরপর কয়েকবার দুটো নাম্বারে ডায়াল করার পরেও যোগাযোগ সম্ভব হলো না। ফোনটি ফিরিয়ে দিয়ে বললো,
– বন্ধ দেখাচ্ছে।

অস্পষ্ট ভাবে হুম বলে ফোনটি পকেটে রেখে বাইকে উঠে বসলো পরখ।
– আমি কি এখানে অপেক্ষা করবো?
দ্বিধা ভরা প্রশ্নটির জবাবে ঘাড় ঘুরিয়ে পরখ তার শীতল চোখে চাইলো। হেলমেট পরতে পরতে জবাব দিলো,
– করতে পারো। তবে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।

পরখ চলে যেতেই গুটিগুটি পায়ে সিমেন্টের সিড়ির নিচের ধাপে চুপচাপ বসে পরলো। দু হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কাদতে থাকলো। এসব কি হচ্ছে জীবনে? বাড়ির শীতল পরিবেশে অভ্যস্ত থাকলেও এই কয়েকদিনে দেখা পরিবেশটা নিজের কাছে বড্ড অচেনা। বদলে যাওয়া মানুষগুলোকে অবাক চোখে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারছে না। আদ্রতার মতো বুঝদার মানুষ বিয়ের দিন কীভাবে পালিয়ে যায়? মন বলছে আদ্রতা পালিয়ে যায়নি। নিশ্চিত খারাপ কিছু হয়েছে। একটা মিসিং কমপ্লেইন করা দরকার। সে কথা কাকে বলবে? শোনার মতো কেউ নেই। মেয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের মধ্যে ঝামেলায় ব্যস্ত বাবা মা। একজন আরেকজনকে দোষারোপ করছে। আদ্রতা যেদিন নিখোঁজ হলো নীহারকে বেধড়ক পি টিয়েছে মোকাররম। ঘরের এককোনায় দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপা ছাড়া কিছুই করতে পারেনি ও। কীভাবে কি হয়েছে সঠিকভাবে মনে নেই। খোলা চোখে সবকিছু আবছা। প্রতিবেশীরা এসে ছাড়িয়ে না নিলে যে যাত্রায় পরপারে পাড়ি জমাতে হতো নীহারকে। রাতে খাওয়া দাওয়া কিছু হয়নি। ডেক ভর্তি খাবার ইচ্ছে মতো নিয়ে গেছে প্রতিবেশীরা। মাহিনদের বাড়ির আত্মীয় স্বজনরা খেয়েছে, বাটি ভর্তি করে নিয়েও গিয়েছে। লোভনীয় খাবার কখনো নষ্ট হয় না। চোখের পলকে গায়েব হয়ে যায়। চোখের সামনে সেদিন প্রমাণ পেয়েছে। সারারাত আড়তে কাটিয়ে দিয়ে সকালে বাড়ি এসেছিলো মোকাররম। অসুস্থ শরীরে অসহনীয় ব্যথা নিয়ে নীহার তখন রান্নাঘরে ভাত বসিয়েছে। মোকাররম এসে সোজা ঢুকে গেলো রান্নাঘরে। খোপা করা চুলগুলো মুঠো ভরে ধরে আরেকদফা পি টা লো। অকথ্য মুখের ভাষার জন্য ধারের কাছে ঘেষা যাচ্ছে না। এভাবে মা র খেতে থাকলে বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিতে হবে সে জ্ঞান নীহারের আছে। কোনোরকমে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে ঘরে দোর দিয়েছে। আদ্রিকাকে নিজের সাথে নিয়ে আসতে ভুলেনি। ওদিকে রাগে, ক্ষোপে, হতাশায় রান্নাঘরের তান্ডব চালালো মোকাররম। ভাতের হাড়ি এনে ফেলেছে হলরুমের মেঝেতে। টগবগ করতে থাকা পানিতে আধা সেদ্ধ হয়েছে মাত্র। সিলিন্ডার নিয়েছে ফেলেছে বাইরের বাগানে। দা দিয়েছে কয়েক টুকরো করেছে গ্যাসের চুলাটা। চাল, ডাল, হলুদ গুড়ো, মরিচ গুড়ো, মশলা সবকিছুর পট উল্টে ফেলে রাখা মেঝেতে। নীহারের শখের টিভিটার ঠিক মাঝখানে কুড়ালের একটা কো প পরতেই নকশা বিগড়ে গেলো। কাচের আলমারি, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার কোনো কিছু বাদ যায়নি। ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে দুপুর পর্যন্ত। নিজের ঘরে গিয়ে গোসল করে, রেডি হয়ে আড়তে যাওয়ার আগে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শাসিয়েছে, রাতে বাড়ি ফিরে যেনো দেখে দুজনে বিদায় হয়েছে৷ না হলে খু ন করে ফেলবে।
নীহারের হাতের ক্ষত থেকে রক্ত পরিষ্কার করার সময় আদ্রিকা বলেছিলো,
– চলো আম্মু নানুবাড়ি চলে যাই। এখানে থাকলে সত্যি মেরে ফেলবে।

নীহার কিছু বলেনি। পাথরের মতো বসে থেকে শুধু চোখের জল ফেলেছে। আদ্রিকা অবাক হয়ে মায়ের কার্যকলাপ দেখে। বিকাল হতেই লৌহমানবী সব ভুলে গিয়ে আবার সংসার গুছানোর কাজে লেগে পরেছে। পাশের বাড়ি থেকে ঠান্ডা ভাত আর লাউ দিয়ে মসুর ডালের তরকারি এনে আদ্রিকা সহ খেয়ে নিলো। রান্নাঘরের অব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র ঝুড়ি ভরে তুলে ফেলে দিলো ময়লার স্তূপে। মেঝেতে পরে থাকা চাল, ডাল ভালোভাবে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিয়েছে। ভাঙা চেয়ার টেবিল সরানোর সময় যখন আদ্রিকা সাহায্য করতে গেলো তখন টের পেলো হাত, পা এখনো কাঁপছে। বেশি ভার তুলতে পারছে না।
মা মেয়ে এই কয়েকটা দিন মোকাররমের থেকে লুকিয়ে ছিলো। রাতের বেলা মোকাররম ফিরে আসার আগেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে নিঃশ্বাস আটকে পরে থাকে। রোজ কয়েকটা লাথি পরে বন্ধ দরজায়। মা মেয়ে দুজনে কেঁপে উঠে। এই বুঝি কুড়ালের কো প পরলো। আদ্রিকা ঘুমিয়ে গেলোও ঘুম আসে না নীহারের চোখে। একমাত্র সম্বলকে বুকে আকড়ে ধরে নিদ্রাহীন রাত কাটিয়ে দেয়।
এই শীতে খোলা আকাশের নিচে ইট দিয়ে চুলা পেতে সেখানে রান্না করা হয়। চাল ডাল দিয়ে এক হাড়ি বসায়। প্রয়োজন অনুযায়ী লবণ আর বাড়ির পেছনের মরিচের গাছ থেকে দুটো মরিচ যোগ হয় সেই চাল ডালে। তেল, হলুদ, পেয়াজ, মশলাবিহীন সেই ফ্যাকাসে পাতলা খিচুড়ি তিনবেলা খেয়ে দিন কাটছে। পাড়াপ্রতিবেশি কেউ আসে মোকাররমের ভয়ে। দু একদিন পাশের বাড়ি থেকে সবজির বাটি এসেছিলো। একসাথে এক বাড়িতে থেকেও মা মেয়ের তেমন কথা হয় না।
বাড়ির ফোনটা মোকাররম কোথায় রেখেছে সেটার খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ এই কয়েকদিন সব জায়গায় খুঁজে দেখেছে আদ্রিকা। সাতটা দিন কী যে নরকযন্ত্রণায় কেটেছে সেই জানে। আজ সকালবেলা মোকাররম বেড়িয়ে যেতেই খুব সাহস করে নীহারের সামনে গিয়ে বলেছে,
– পরিক্ষা শেষে কলেজ খুলছে। ক্লাস করতে যাবো না?
নীহার শান্ত কন্ঠে জবাব দিয়েছে,
– এখন যাওয়ার দরকার নাই।
– রেজাল্টটা অন্তত জেনে আসি। সেশন ফি সময় মতো না দিলে সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি ক্যান্সেল হয়ে যাবে।

বিছানার তোষকের নিচ থেকে দু হাজার টাকা বের করে আদ্রিকার হাতে দিয়ে বলেছে,
– কয় টাকা সেশন ফি লাগে দিয়ে আসিস। রিক্সা নিয়ে চুপচাপ কলেজে যাবি, আবার রিক্সায় চলে আসবি। তোর বাপের নজরে যেনো না আসে৷

আদ্রিকা কি করেছে? বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রিচার্জের দোকানে গিয়ে বিস্ময়ের নাম্বারে কল করেছে। ভাগ্যিস নাম্বারটা মুখস্ত ছিলো। কিন্তু বিস্ময়ের ফোন বন্ধ দেখায়। এরপর রিক্সা নিয়ে সোজা চলে এসেছে বিস্ময়ের বাড়িতে৷ নিজেই নিজের নজরে ঘৃণিত ব্যক্তি হয়ে তবুও বসে রইলো বিস্ময়ের আশায়। সে এলে সব ঠিক করে দিবে। মেঘের ভেলায় উড়িয়ে দিবে মেঘমালার দুঃখগাথা

২৯

অনেক খুঁজে অবশেষে পার্টি অফিসের সন্ধান পাওয়া গেলো। ভর দুপুরে কেমন আবছা অন্ধকারে ঢেকে আছে দোতলার বড় ফ্ল্যাটটি। সভাপতির সাথে দেখা করতে আধাঘন্টা অপেক্ষা করতে হলো। নিজের পরিচয় দিয়ে পরখ জানতে চাইলো বিস্ময়ের অবস্থান। বিনা সংবাদে সবকিছু থেকে সরে গেলেও রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো এতো সহজ নয়৷ ক্ষীণ আশা ছিলো পরখের৷ কিন্তু বিস্ময়ের ইস্তেফা প্রদানের তথ্যে সন্দেহ আরও গাঢ় হলো। নিজের কাজ ফেলে অসহায় মেয়েটাকে সামান্য সাহায্যের উদ্দেশ্যে এখানে ওখানে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে৷ মনে মনে খানিক বিরক্ত হলো আদ্রিকার প্রতি। এই বয়সে কেউ এতো বোকা কীভাবে হয়?
বাইকের শব্দে সিড়ি থেকে উঠে প্রধান ফটকের দিকে ছুটে এসে পরখকে দেখে মুখে আধার নামলো। যাকে আশা করেছিলো তাকে না পেলেও পরখকে দেখে কিছুটা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো,
– কোনো খবর পেলেন?

বাইক থেকে নেমে সোজা উপরে গিয়ে স্লাইডিং ডোর খুলে ভেতরে চলে গেলো। আদ্রিকা ভেতরে গেলো না। বিস্ময় নেই বাড়িতে। অচেনা একটি যুবকের সাথে ঘরবন্দী হওয়াটা ভীষণ বিপদজনক। তারপর পরখের স্বভাব, চরিত্রও ভালো না। সেদিন কেমন হুট করে আক্রমণ করেছিলো। আজকে বাড়ির ভেতরে পেয়ে এতো সহজে ছেড়ে দিবে না নিশ্চয়ই। দিনশেষে সে একজন পুরুষ মানুষ। সুযোগ পেলে মুখ ঘুরিয়ে নিবে না।
বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। পরখ এলো দুটো চেয়ার নিয়ে। সামনাসামনি রেখে নিজে একটা চেয়ারে বসে আদ্রিকার অপেক্ষা করলো। বিনাবাক্যে নিজ আসনে বসে অপেক্ষা করলো পরখের উত্তরের।

– গত সপ্তাহে বিস্ময়ের বাবা ফোন করে বাড়ি যেতে বলায় তাড়াহুড়ো করে চলে গেছে। রাতের দিকে ফোন করে জানিয়েছে সে আর ফিরবে না। অনেক আগে থেকেই বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করতে চেয়েছিলো, সেটা নিশ্চয়ই জানো। আমার মনে হচ্ছে আংকেল ওকে অফিসের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। পার্টি অফিস থেকে রিজাইন নিয়েছে। আমাদের ইন্টার্নশিপও শেষ। ভূবনভোলায় ফেরার আর কোনো কারন দেখছি না।

আদ্রিকা অবাক চোখে পরখের স্বাভাবিক কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনছে। কী সুন্দর বলে দিলো এখানে ফেরার কোনো কারন নেই। মুখ ফুটে অজান্তেই প্রশ্ন বেরিয়ে গেলো,
– আর আমি? আমি ওর পিছুটান নই?

পরখের মুখে বিদ্রুপের হাসি। একটু নড়েচড়ে আরাম করে বসে জানালো কিছু অপ্রিয় সত্য।
– বিস্ময় এখানে এসেছে প্রায় চার বছর। সময় কাটানোর জন্য কাউকে দরকার। সমাজে উচ্চ অবস্থানের জন্য একটা রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসের প্রয়োজন সে সব সময় অনুভব করতো। তোমার সাথে রিলেশনের আগে ওর আরোও কয়েকটা রিলেশন ছিলো। সেগুলো বেশিদিন টিকেনি। তোমার সাথে সর্বোচ্চ সময় কাটিয়েছে৷ ক দিন যেনো হলো তোমাদের রিলেশনের?
– প্রায় এক বছর।
– ওহ।
– আপনি কি বলতে চাইছেন একটু ক্লিয়ার করে বলবেন? এতো ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বলা কথা বুঝার মতো অবস্থায় আমি নেই।
– বুঝার মতো জ্ঞানী তুমি কখনোই ছিলে না। বিস্ময়ের জন্য তুমি যাস্ট ভালো সময় কাটানোর একজন মানুষ ছিলে৷ একজন ভালো বন্ধুর মতো আরকি। ও অনেক ক্যারিয়ার সচেতন ছেলে। জীবনকে উপভোগ করতে জানে। উড়তে জানে, সাথে অন্যকেও উড়াতে জানে। তবে নিজের স্বার্থে সর্বদাই স্বার্থপর। নিজের ক্ষতি করে অন্যের জীবন গোছানোর কাজ ওর দ্বারা হয় না। যতোদিন এখানে ছিলো তোমাকে সময় দিয়েছে। নিজের রাজ্যে ডাক পরায় সমস্ত পিছুটান ছেড়ে পাখি চলে গেছো। এবার বুঝতে পেরেছো?

আদ্রিকা শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। কতো সহজে বলে দিলো! এভাবেও বাঁধন ছিড়ে যাওয়া যায়? ফেলে রাখা পায়ের ছাপ পরে না হৃদয়ে? অবশ্যই পরে৷ কই আদ্রিকা তো ভুলতে পারছে না? বিস্ময় কীভাবে এমন স্মৃতিকাতরহীন হলো?

– সবকিছু এতো সহজ?
– সহজ ভাবলে সহজ। তোমরা একসাথে ছিলে, ভালো সময় কাটিয়েছো। এখন যে যার জায়গায় ফিরে যাও। বিচ্ছেদ মেনে নিতে কষ্ট হবে তবুও কিছু করার নেই। যাওয়ার আগে বিস্ময় তোমার কাছে বিদায় নিলে তোমার জন্য মুভ অন করা সহজ হতো। ও আবার ভালো কনভেন্স করতে পারে। হয়তো তাড়াহুড়ো থাকায় যোগাযোগ করতে পারেনি। ফোনটা বন্ধ কেনো সেটা বুঝতে পারছি না। যাই হোক, যা হবার হয়েছে। সব ভুলে বাড়ি যাও।

আদ্রিকার চোখে নোনা জল গড়িয়ে পরতে শুরু করেছে। অসহায় চোখে পরখের কাছে উত্তর চাইলো,
– এখন আমার কি হবে? আমি কীভাবে থাকবো?
– ব্যাপারটাকে এতো কমপ্লিকেটেড করার কিছু নেই। বিস্ময়ের আগের গার্লফ্রেন্ডগুলো কিন্তু ভূবনভোলা একাডেমির। সেখানে রোজ যাতায়াত ছিলো বিস্ময়ের। বিচ্ছেদের পরেও রোজা দেখা হতো। ব্যাপারটা ওদের এজন্য একটু বেশি বেদনাদায়ক ছিলো। তবুও ওরা কিন্তু মুভ অন করে গেছে। একটা হেলথি রিলেশন থেকে বেরিয়ে আসতে প্রথমদিকে কষ্ট হয়। কিন্তু সময়ের সাথে তোমাকে শক্ত হতেও শেখায়। বিস্ময় এখন একেবারে ভূবনভোলা ছেড়েছে। ব্যাপারটা তোমার জন্য প্লাস পয়েন্ট৷ রোজ দেখা হলে ক্ষত শুকাতে সময় লাগতো। ভেঙে না পরে নিজের দিকে ফোকাস করো। সামান্য একটা প্রেমের সম্পর্কের জন্য কেউ ম রে যায় না।

আদ্রিকা অবাক হলো আরেক দফা। রক্তবর্ণ চোখে চেয়ে রইলো পরখের দিকে। গলার স্বর উঁচু করে জানালো,
– আমাদের বিয়ে হয়েছে। সামান্য প্রেমের সম্পর্ক বলছেন কীভাবে?

পরখ বোধহয় অবাক হলো। সরু চোখে ক্ষণকাল চেয়ে থেকে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। হাস্যকর কোনো কথা শুনেছে এমন ভাবে বললো,
– বিয়ে? বিস্ময় এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে এটা ভাবলে কি করে? দিবাস্বপ্ন দেখো না মেয়ে। ওর জীবনে সবকিছু প্ল্যান করা আছে। আঠাশে বিয়ে, ত্রিশে বাচ্চা, পঞ্চাশে রিটায়ার্ড। সবকিছু আগে থেকে ভেবে রাখা আছে। কোন দেশে, কোথায়, কোন মাসে বিয়ে করবে সেটা পর্যন্ত ডায়েরিতে লিখে রাখা৷ দুদিনের পরিচয়ে তোমাকে বিয়ে করে সংসার সাজানোর কথা বললো আর তুমিও সেটাকে সত্য ভেবে বসে আছো? রিলেশনে এমন প্রতিজ্ঞা সবাই করে।

অসহায় আদ্রিকার গলার জোর কমে এসেছে। দু হাতে মুখ ঢেকে উচ্চস্বরে কেদে বলতে থাকলো,
– আমাদের বিয়ে হয়েছে পরখ। সত্যি বিয়ে হয়েছে। বিশ্বাস করুন প্লিজ। আমি মিথ্যে বলছি না।

(চলবে..)