নোলককন্যা পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

0
59

#নোলককন্যা
#অক্ষরময়ী
অন্তিম পর্ব

কুয়াশা ভরা দিনের চারপাশে ছড়িয়ে পরেছে সূর্যের আলো। পূর্ব আকাশে সূর্যের উঁকি দেওয়া এবেলা আর দেখা যায় না। প্রায় মধ্য আকাশে যাওয়ার সময় হলে সূর্য্যি মামার তেজ বাড়ে। তখনি পালাই পালাই করে উল্টোপথ ধরে শীতের কুয়াশা৷ গায়ের হুডিটা খুলে কোলের উপর রেখে পরখ উৎসাহহীন কন্ঠে শুধালো,
– বিয়ে হয়েছে ভালো কথা। এখন কাবিননামা নিয়ে এসে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে নিজের অধিকার চাও৷ এখানে ঘুরাঘুরি করে লাভ নেই। বিস্ময় ফিরবে না।

অথৈজলে হাবুডুবু খেতে থাকা আদ্রিকা চোখ বড় করে জানতে চাইলো,
– বিস্ময়ের বাড়ি কোথায় জানেন?
– ঢাকায়। তুমি সত্যি যাবে নাকি?
– দরকার হলে যাবো।

হো হো করে হেসে পরখ বললো,
– বেশ বেশ। এখন বাড়ি যাও। আমাকে অফিসে যেতে হবে।
– কিন্তু কাবিননামা পাবো কোথায়?

পরখ উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে ফিরে যাচ্ছিলো। আদ্রিকার প্রশ্নে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা এখনো চোখ বড় বড় করে অসহায়ের মতো চেয়ে আছে। খানিকটা মায়া হলেও বিরক্ত জন্মালো অধিক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– বিয়ের পর তোমাকে যে পেপার্স দিয়েছে সেটাই কাবিননামা।
– আমাকে কিছু দেয়নি।
– বিয়ের পরে বর কনে দুজনের কাছেই দুটো কপি দেওয়া হয়। তোমাকে দেয়নি কেনো?
– আমি কি জানি? কাজী বলেছিলো বয়স কম দেখে এখন রেজিস্ট্রি পেপার দিতে পারবে না। কয়েকমাস পরে দিবে।

ভ্রু কুচকে পরখ ফিরে এলো। আদ্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে সুক্ষ্ম নজরে চেয়ে জানতে চাইলো,
– তোমার বয়স কতো?
– আঠারো পেরিয়েছে কয়েকদিন আগে।
– তাহলে বয়স হয়নি বললে কেনো?
– সার্টিফিকেটে আম্মু বয়স কমিয়ে দিয়েছে।
– বিয়ের বয়স না হতেই বিয়ে হলো?
– হয়েছে তো।
– কীভাবে?
– কবুল বলেছি, রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করেছি।
– পেপারস কাজীর কাছে?
– হ্যাঁ।
– তাহলে গিয়ে কাজীর কাছ থেকে কালেক্ট করো। আমাকে কেনো বিরক্ত করছো?
– কাজীর বাড়ি চিনি না।

অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রিকাকে পরখ হঠাৎ বেশ করে ধমকে উঠলো।
– এই এলাকায় একটাই কাজী আছে। বাড়ি চিনতে হবে কেনো? সোজা কাজী অফিসে যাও। ঘটে এইটুকুও বুদ্ধি নেই। আসছে বিয়ে করে সংসার করতে৷ যাও তো এখান থেকে। অযথা ঝামেলা বাড়িয়ো না।

গটগট করে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে স্লাইডিং ডোর বন্ধ করে দিলো। অফিসের ব্যাগপত্র নিয়ে বের হয়ে দেখে তখনো আদ্রিকা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোমড়ে হাত রেখে পরখ ফির ধমকালো।
– এই মেয়ে, তোমার বাড়িতে লোকজন নেই? ওরা তোমার খোঁজ করবে না? এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে নিজে ঝামেলায় পরবে আমাকেও ফেলবে। তোমার বয়ফ্রেন্ড বাড়ি ছেড়েছে। সকাল থেকে একটা অচেনা ছেলের বাড়িতে পরে আছো। লোকের নজরে পরলে কতো বিশ্রীভাবে ঘটনা রটাবে জানো? তোমার না হয় কোনো মান সম্মান নেই৷ কিন্তু আমার আছে৷ হাত জোড় করে অনুরোধ করছি৷ প্লিজ বিদায় হও।

ধীর পায়ে সিড়ির শেষ ধাপে নামা পর্যন্ত পরখ ছাদেই দাঁড়িয়ে রইলো। ভাবলো ঝামেলা এবার বিদায় হয়েছে। কিন্তু বিপদে পরলে মানুষ কতোটা বেহায়া হয়, পরখ জানতো না। প্রধান ফটকের আম গাছটায় মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকা আদ্রিকা পরখকে চলে যেতে দেখে আবার অনুরোধ করলো।
– কাজী অফিস আমি চিনি না৷ আমাকে একটু সাহায্য করুন। এই মুহুর্তে আপনি ছাড়া সাহায্য করার মতো আমার কেউ নেই।

বাইকে বসে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড স্থিরভাবে চেয়ে রইলো। চোখ তুলে তাকানোর সাহস হচ্ছে না আদ্রিকার৷ অচেনা মানুষটাকে এভাবে বিরক্ত করা ঠিক হচ্ছে না, সেও জানে। কিন্তু এই মুহুর্তে সে নিরুপায়।
– মেইন রাস্তায় গিয়ে রিক্সা নেও। কাজী অফিস যাবে বললেই নিয়ে যাবে।
– একটা যুবতী মেয়ে কাজী অফিস যেতে চাইছে, লোকে বাঁকা চোখে দেখবে।
– এখন কি আমার বাইকে নিয়ে যাবো? আমার সাথে গেলে সেটা মানুষের চোখে লাগবে না? তোমার মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই?
– তাহলে কি করবো?
– আমার ঘাড়ে চেপে বসো। উফ! আমার দিনটাই নষ্ট হয়ে গেলো। বিল্ডিং এর দ্বিতীয়তলায় কাজী অফিস। নিচতলায় কফি হাউজ। রিক্সাওয়ালাকে বলবে বড় মসজিদের পাশের কফি হাউজে যাবে।

আদ্রিকার উত্তরের অপেক্ষা না করে বাইক নিয়ে পরখ চলে গেলো।

রিক্সাওয়ালার সাহায্য নিয়ে কাজী অফিসে পৌঁছে কাজী সাহেবের জন্য অপেক্ষা করতে হলো না। অফিস ফাঁকা ছিলো। উনিও একটু আগে অফিসে এসে চায়ের কাপ নিয়ে টেবিলে বসেছেন। আদ্রিকাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারলেন না। সেদিন অল্প কয়েক মিনিট চোখের সামনে ছিলো মেয়েটা। তাও আবার লাল টুকটুকে সালোয়ার কামিজ পরে। ওতোটা মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়নি। কিন্তু দশ হাজার টাকা দেনমোহরের কথা বলতেই সেদিনের ঘটনা মনে পরে গেলো। এতো কম টাকায় বিয়ে পরিয়ে মাত্র এক হাজার টাকা বকশিস পেয়েছিলেন।

সকাল নয়টায় উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও পরখ অফিসে পৌছালো সকাল এগারোটায়। ভাগ্য ভালো ছিলো ডিরেক্টর তখন অফিসে উপস্থিত ছিলেন। পরখের ইন্টার্নিশিপ পেপার্সে সাইন করে দিলেন। স্বল্প দিনের কলিগদের কাছে বিদায় নিয়ে পরখ ফিরে আসছিলো। বড় মসজিদ পার হতেই পেছন থেকে নিজের নামের ডাক শুনে ফিরে তাকালো। এতো লোকজনের সামনে ওর নাম ধরে ডাকছে আদ্রিকা। বাধ্য হয়ে বাইক থামিয়ে এগিয়ে গেলো আদ্রিকার দিকে। মানবিকতার খাতিরে প্রশ্ন করলো,
– কাবিননামা পেলে?
– উহু। হারিয়ে গেছে।
– মানে? সরকারি কাগজপত্র হারায় কীভাবে?
– তা জানি না। কাজী বললেন, পাতাটা খুঁজে পাচ্ছেন না।

এই মেয়েটা অস্বাভাবিক সেই সাথে তার সাথে ঘটা ঘটনাগুলোও। রেজিস্টার খাতা থেকে বিয়ের ডকুমেন্টস উধাও। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হলো।
– চলো দেখে আসি।

এ সমাজের লোকেরা মেয়েদের খুব একটা পাত্তা দেয় না। একলা মেয়ে মানুষ কি আর করতে পারবে? কখনো কারো মনে যদি একটু দয়া মায়া জন্মায় তবে নিজে থেকে সাহায্য করে। না হলে আজও এ সমাজ মেয়েদের খুব একটা গুরুত্ব সহকারে নেয় না। আদ্রিকাকেও কাজী সাহেব তেমন একটা পাত্তা দেননি। কাগজ খুঁজতে গিয়ে দেখলেন শেষের পাতাটা নেই। হারিয়ে গেলে এখন আর কি করার? বলে কয়ে আদ্রিকাকে বিদায় করে দিয়েছেন। কিন্তু আদ্রিকার সাথে পরখকে দেখে খানিকটা নড়েচড়ে বসলেন। রেজিস্টার খাতা খুলে পরখকে দেখালেন। সত্যিই শেষের পাতাটা নেই।

– এটা কীভাবে হলো? আপনার তত্ত্বাবধানে বিয়ের ডকুমেন্টস কীভাবে হারায়?
– সেটা আমিও ভাবতেছি। সেদিন বিয়েতে একজন সাক্ষী উপস্থিত ছিলো না। উনার সাইন বাকি ছিলো। বিয়ের কয়েকদিন পর ছেলেটা আরেকটা ছেলেকে সাথে নিয়ে এসে বললো রেজিস্ট্রি পেপারে সাক্ষীর সাইন করাতে হবে। আমিও খোলা মনে কাবিনের পাতাটা বের করে ওদের সাইন করতে দিয়েছি। নামাজের সময় পার হয়ে যাচ্ছে দেখে খাতা দিয়ে আমি নামাজ পরতে বসে গিয়েছিলাম। সাইন করার পর ওরা চলে গেছে। আমি আর খাতা চেক করে দেখিনি। হয়তো ওরাই পাতাটা ছিঁড়ে নিয়েছে। আমি ঠিক বলতে পারছি না।
– এই দায়িত্বহীনতার শাস্তি কি হতে পারে জানেন?
– বাবাজী, উত্তেজিত হবেন না। রিস্ক নিয়ে বিয়েটা কিন্তু আমিই পরাইছি। মেয়ের আঠারো বছর তখনো হয় নাই। তবুও আমি এক্সট্রা খাতায় উনাদের রেজিস্ট্রি করাইছি৷ আইন অনুযায়ী এটাও অন্যায়।এই কথা পাঁচকান হলে দুই পক্ষই ফেঁসে যাবো। আমার চাকরি যাবে, সাথে উনাদেরও শাস্তি হবে। আমি বলে কি, এসব ঝামেলা করার কি দরকার? যা গেছে বাদ দেন৷ একটা কাগজে কি এসে যায়! ধর্ম মতে বিয়ে হইছে৷ উনারা স্বামী স্ত্রী এই কথা মিথ্যা হয়ে যাবে না। আদি কালে আমাদের দাদা দাদীদের আগের আমলে কি এসব লেখালেখির নিয়ম ছিলো নাকি? ছিলো না। তাই বলে কি তাদের বিয়ে জায়েজ হয় নাই? অবশ্যই হইছে। সাক্ষী রেখে আল্লাহর কালিমা পরে বিয়েটাই আসল। বাকি থাকলো কাবিননামা। মেয়ের বয়স এখন আঠারো হইছে না? ছেলে মেয়েকে নিয়ে আসেন এক্ষুনি কাগজে দুইটা সাইন করে দিক। আমি আধাঘন্টার মধ্যে কোর্ট থেকে রেজিস্ট্রেশন করায় আনতেছি৷ তারপর কাবিননামা নিয়ে যান।

পরখ কিছু বললো না। চুপচাপ চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো। পেছনে ছুটে আসছে আদ্রিকা । কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলো,
– এখন কি হবে?

মিসম্যানেজমেন্ট ভীষণ অপছন্দ। এখানে আবার নিয়ম কানুনের কোনো বালাই নেই। মেজাজটা এমনিতেই চটে আছে। আদ্রিকার কথায় আরও ক্ষেপে গেলো পরখ।
– এই মেয়ে তুমি বুঝতে পারছো না কিছু? তোমার বিস্ময় কতো নিখুঁতভাবে তোমাকে মুছে দিয়ে চলে গেছে। তোমাদের যদি বিয়ে হয়েও থাকে সেটা কখনো প্রমাণ করতে পারবে না। এই বিয়েটাও ওর ভবঘুরে জীবনের একটা এক্সপেরিমেন্ট ছিলো মাত্র। তোমার আঠারো বছর হয়নি জেনেই এতো বড় পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস করেছে। কাজীর বাড়ি থেকে বিয়ের কাবিননামা গায়েব। বিয়েতে অভিভাবক কেউ উপস্থিত ছিলো না। এখন আর তোমাদের বিয়ের কোনো প্রমাণ নেই। চুপচাপ বাড়ি ফিরে যাও।

সিড়ির ধাপে দেয়ারের সাথে ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা। ওর সামনে রাগান্বিত পরখ। মানুষটাকে এভাবে বিরক্ত করা ঠিক হচ্ছে না সে জানে। কিন্তু আজ যে সে উপায়হীন। একবার বাড়িতে ফিরে গেলে ফেরার সকল পথ বন্ধ৷ নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্নারোধ করে আদ্র গলায় অনুরোধ করলো।
– বিয়ের সাক্ষী আছে। আমার বান্ধবী মেঘা, ও আমার পক্ষ থেকে সাক্ষী ছিলো।
– আচ্ছা বেহায়া মেয়ে তুমি। একজন তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে চলে গেছে। তবুও তুমি তার পায়ে লুটিয়ে পরতে প্রস্তুত৷ যাও মেঘার কাছে। বিয়ের সাক্ষী নিয়ে স্বামীর পায়ে লুটিয়ে পরে অধিকার চাও। তবুও যদি সে দয়ামায়া দেখায়।

পরখ ফিরে যেতে লাগলো। আদ্রিকা পিছু ছাড়লো না।
– বিস্ময়ের সাথে একবার কথা বলার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? আমি ওকে ফিরিয়ে আনতে পারবো। নিশ্চয়ই কোনো চাপে পরে এভাবে চলে গেছে।
– তোমরা মেয়েরা নিজেকে কি ভাবো? পরশ পাথর? তোমরা ছুঁয়ে দিলে বেপরোয়া, ছন্নছাড়া, ভবঘুরে ছেলেটা সুবোধ বালক হয়ে যাবে।
– একবার যোগাযোগ করিয়ে দিন প্লিজ।
– ফোন নাম্বার দুটো বন্ধ। কীভাবে যোগাযোগ করবো?
– হয়তো অন্য সীম কিনেছে। আপনার সাথে যোগাযোগ না করলেও ওর ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধু আছে না? ওদের সাথে ঠিকই যোগাযোগ করেছে। ওর বন্ধুদের কাছে একটু খোঁজ করুন। আজকের দিনটা সাহায্য চাইছি শুধু। এরপর আর বিরক্ত করবো না।
– আজকের পরে কি করবে? বিস্ময় ফিরে না এলে জলে ডুব দিবে নাকি?

তাচ্ছিল্যের কথা গায়ে মাখে না আদ্রিকা। দ্রুতগামী পরখের সাথে পায়ে পা মিলাতে না পেরে ছুটতে থাকে৷

মেঘার বাড়িটা একটু গ্রামের দিকে৷ রিক্সা আসতে চাইছিলো না। দ্বিগুণ ভাড়া দেওয়ায় এসেছে। রিক্সার পেছনে পরখ নিজেও কেনো এলো জানে না। হয়তো মেয়েটার জন্য একটুখানি মায়া এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে। মেঘার সাথে দেখা করতে চাইলে ওর মা কেমন বাঁকা চোখে তাকালো। ঘরে বসতে বলে মেঘাকে ডাকতে কোথায় গেলো কে জানে! বাঁশের তৈরি কাঁচা বাড়ি মেঘাদের। অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো না দেখেই বুঝা যাচ্ছে। অথচ কলেজে ওকে দেখে কেউ বলতে পারবে না, মেঘা কোনো নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। ভাইবোন কয়জন কে জানে! বাড়িতে ছোট ছোট তিন চারজন বাচ্চা চোখে পরেছে।

মেঘা এলো ধীর পায়ে। চোখে মুখে ভীতি। ওর মা পাশে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করে মেঘা নিজেই ওর মাকে বললো,
– আদ্রিকা প্রথমবার আমাদের বাড়িতে এসেছে। কিছু নাস্তা থাকলে দেও।

না করতে গিয়েও মেঘার চোখের ইশারায় থেমে গেলো আদ্রিকা। বাধ্য হয়ে মেঘার মা ঘর ছাড়লেন। দ্রুত আদ্রিকার পাশে বসে মেঘা ফিসফিসিয়ে বললো,
– কি হয়েছে? হঠাৎ এভাবে আমাদের বাড়িতে কেনো এলি?
– বিস্ময়কে খুঁজে পাচ্ছি না মেঘা। আমাদের বিয়ের পেপার্সও গায়েব। বিয়ের কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। তুমি কি একটু সাক্ষী দিবে?

মেঘা কোনো উত্তর দেওয়ার আগে খুদে বাচ্চা দুটো ঘরে প্রবেশ করলো। একটা বিস্কুট আর একটুখানি পানি মুখে দিয়ে আদ্রিকার বিদায় চাইলো। ওকে এগিয়ে দেওয়ার বাহানায় মেঘা বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। সেই সুযোগে আদ্রিকা বিস্তারিত জানালো।

– দেখ আদ্রিকা, কয়েকদিন পর আমার বিয়ে৷

মেঘার কথায় আদ্রিকা বিস্ময়ে হতবাক। চোখ বড় করে তাকিয়ে কোনো রকম বললো,
– হঠাৎ?
– হঠাৎ করে নয়। আমাদের সম্পর্কের প্রায় দুইবছর পেরিয়েছে৷ বাড়িতে এসব কেউ জানে না৷ ছেলের বাড়ি থেকে প্রস্তাব এসেছে। ভালো ঘর দেখে আমার বাবা রাজি হয়। গরীব ঘরের মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করিয়ে কি লাভ বল? আমাদের রিলেশন ছিল এটা জানলে বাবা মানতো না। এজন্য প্রস্তাব পাঠানোর বুদ্ধিটা বিস্ময় ভাইয়া দিয়েছিলেন। বিস্ময় ভাইয়ার সাথে আমার হবু স্বামীর পরিচয় আগে থেকেই ছিলো। সেই সুবাদে আমার সাথে পরিচয়। বিস্ময় ভাইয়া আমাকে তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এজন্য আমি এগিয়ে গিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়াই। সেদিন ফোন করে যেতে বলেছে আমিও গিয়ে সাক্ষী দিয়েছি। এরপরে তোদের কি হয়েছে আমি জানি না। কিন্তু তোদের গোপন বিয়ের সাক্ষী আমি দিয়েছি এটা জানলে বাবা আমাকে মে রে ফেলবে। আমরা গরীব মানুষ। এসব প্রেম ভালোবাসা নিয়ে খুব ভীতি আছে। সামনের সপ্তাহে বিয়ে অথচ দেখ এখনি আমাকে প্রায় ঘরবন্দী করে ফেলেছে। বাইরে বের হওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ৷ সম্মানের বড় ভয় রে। তোর বিয়েতে আমি ছিলাম এটা কাউকে বলিস না প্লিজ। আমার বিয়েটাও ভেঙে যাবে তাহলে।

আদ্রিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আজকের দিনে বাড়ি থেকে বের হওয়াটাই ভুল হয়েছে। সব খারাপ হচ্ছে, সবটা৷ ভেঙে যাচ্ছে ভ্রমের দেয়াল। মেঘাকে খুব কাছের মানুষ ভেবেছিলো৷ সে দেখি গুপ্তচর।
হাঁটতে হাঁটতে কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে মেইন রোডে চলে এসেছে। এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো পরখ। ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো। অচেনা যুবকটিকে দেখে মেঘা প্রশ্ন করলো,
– উনি কে?
– বিস্ময়ের ফ্ল্যাটমেট।

বিস্ময়ের মতো ওমন পরোপকারী, স্বচ্ছ মনের মানুষ আদ্রিকাকে ধোঁকা দিয়েছে বিশ্বাস হলো না মেঘার। পরখের কাছে জানতে চাইলো,
– বিস্ময় ভাইয়া সত্যি বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে?
– শুধু বাড়ি ছাড়ে নি। দেশও ছেড়েছে৷

মেঘা ও আদ্রিকাকে আরেকবার অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিলো পরখ।
– বিস্ময়ের এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা হলো। সেদিন বিস্ময়ের বাবা ওকে ডেকে সুইজারল্যান্ডের একটা টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, রাতেই সুইজারল্যান্ড যেতে হবে। ওদের কোম্পানির একটা ব্রাঞ্জ আছে ওখানে৷ ম্যানেজারের সাথে কি নিয়ে যেনো ঝামেলা হয়েছে৷ বিস্ময়কে গিয়ে সামাল দিতে হবে৷ যদি পরিস্থিতি সামলে নিতে পারে তাহলে সুইজারল্যান্ডের পুরো ব্যবসার দায়িত্ব বিস্ময়ের হাতে তুলে দেওয়া হবে। বিস্ময় এতোদিন এটার অপেক্ষায় ছিলো। এসব লেখাপড়া ওর কোনোকালে ভালো লাগেনি। সবসময় বাবার ব্যবসার হাল ধরতে চাইতো। কিন্তু ওর বাবা রাজি ছিলো না। ওই সময় সুযোগ নিজে থেকে সামনে এসে দাঁড়ালে খপ করে ধরে ফেলেছে।
– আমাকে একবার জানালো না কেনো? আমি কি ওকে মানা করতাম?

আদ্রিকার মাথায় একটা ইট ছুঁ ড়ে মারতে ইচ্ছে করলো পরখের৷ তা করতে না পেরে আক্রোশে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে হতাশায় ডুব দিয়ে বললো,
– ইউ ডাজেন্ট ম্যাটার ফর হিম৷ ক্যারিয়ার কামস ফাস্ট৷

আদ্রিকার দু বাহুতে হাত রেখে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মেঘা বুঝানোর চেষ্টা করলো,
– বোকা মেয়ে, বুঝতে পারতেছিস না? নিজের স্বার্থের কথা ভেবে উনি সব ছেড়ে চলে গেছেন৷ বিদেশে গিয়ে তোকে কেনো মনে রাখবে?

আদ্রিকার বিশ্বাস হলো না। বিস্ময়ের সাথে কথা বললে সব ঠিক হয়ে যাবে। কয়েকদিন কথা না হওয়ায় রেগে গিয়ে এমন করছে। একটু ভুল করলে এমন অনেক শাস্তি সে দিয়েছে। এটাও তেমন এক শাস্তি। গো ধরে পরখের কাছে জানতে চাইলো,
– আপনি ফোন নাম্বার পেয়েছেন? কল দিন। আমি কথা বলবো।

কি আর করার! বাধ্য হয়ে বিস্ময়ের নতুন নাম্বারে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে আদ্রিকার দিকে এগিয়ে দিলো। ওমন স্বার্থপর ছেলের সাথে কথা বলার রুচি হচ্ছে না পরখের৷

আদ্রিকার কন্ঠস্বর শুনে বিস্ময় নিজেই বিস্মিত হলো।
– আমি ভাবলাম খোঁজ না পেয়ে কয়েকদিন কান্নাকাটি করে চুপ হয়ে যাবে। তুমি দেখছি আমার সন্ধানে নেমে পরেছো৷

বিস্ময়ের হাসিমাখা কন্ঠস্বর আদ্রিকার অশান্ত হৃদয়ে প্রশান্তির বাতাস বইয়ে দেয়৷ বিভোর হয়ে ডাকলো,
– বিস্ময়?
– বলো শুনছি।

ওপাশ থেকে বিস্ময়ের তেরছা জবাব৷ তবুও আগ্রহ হারায় না আদ্রিকার৷
– তুমি সত্যি চলে গেছো?
– সবটা জেনে আবার প্রশ্ন করছো কীসের আশায়?
– তোমার থেকে শুনতে চাইছি৷ সত্যিটা তুমি বলো।
– লিসেন আদ্রিকা, প্রথম দেখায় তোমাকে আমার ভালো লেগেছিলো। ইউ ওয়াজ পিওর, ইনোসেন্ট। যেমনটা আমার পছন্দ। আমরা একসাথে অনেক ভালো সময় কাটিয়েছি। সময়ের প্রয়োজনে এখন আলাদা হতে হয়েছে। মন খারাপ না করে মেনে নেও। মুভ অন করো।

এতোদিনের পরিচয়ে আদ্রিকাকে কখনো ‘আদ্রিকা’ বলে ডাকেনি। বিস্ময়ের মুখে আদ্রি অথবা মেঘমালা শুনে অভ্যস্ত। এই মুহুর্তে ফোনে কথা বলা মানুষটাকে অচেনা লাগছে। শুধু কন্ঠস্বরটা একরকম। রোধ হয়ে আসা কন্ঠস্বরে প্রতিবাদ জানালো।
– আমাদের বিয়ে হয়েছে বিস্ময়৷
– বিয়ে? কোনো প্রমাণ আছে? হাসালে আদ্রিকা৷ এই বিয়ের খবর বাইরে বললে নিজেই ফেঁসে যাবে। তোমার বাবার কথা নিশ্চয়ই মাথায় আছে। মেয়ে লুকিয়ে বিয়ে করেছে জানতে পারলে তোমাদের কি হাল করবে সেটা চিন্তা করে তবেই জানিও।

এমন নিষ্ঠুর কথায় কতোক্ষণ চুপ থাকা যায়? ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে অনুনয় করতে লাগলো।
– এমন কেনো করছো বিস্ময়? আমি কি অন্যায় করেছি? তোমার এমন আচরণ মেনে নিতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। আমার সাথে এমন করো না প্লিজ।

বিস্ময়ের মনে বুঝি খানিক দয়া হলো। স্বাভাবিকভাবে জবাব এলো ওপাশ থেকে,
– আমি এখন এমন এক পর্যায়ে আছি যেটার স্বপ্ন সারাজীবন দেখেছি। সবকিছুর উর্ধ্বে আমার স্বপ্ন। তুমি ভাবতেও পারবে না চল্লিশ তলা ভবন থেকে চারপাশটা কতো সুন্দর দেখায়। এই দুনিয়াটা সবচেয়ে সুন্দর, সুখকর। এর বিনিময়ে ভালো কিছু স্মৃতি ফেলে আসতে খুব একটা ভাবতে হয়নি৷ তোমার খারাপ লাগাটা সাময়িক। ভবিষ্যতে যখন আজকের অবস্থানের থেকে আরও ভালো অবস্থানে যাবে তখন নিজের এই বোকামির কথাগুলো ভেবে হাসি পাবে, আফসোস হবে৷ নিজের আফসোস আর বাড়িয়ো না। বাড়ি ফিরে যাও।
– বিস্ময়, বিস্ময়? ফোন কেটো না প্লিজ। আমার কথাটা শুনো। এভাবে আমাকে ফেলে যেও না। আমি খুব বিপদে আছি। প্লিজ একটু দয়া করো। আপু বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে। বাড়িতে খুব ঝামেলা হচ্ছে। বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় চাচার পরিবারের সময় খুবই ক্ষেপেছে৷ ওদের সম্মান নষ্ট হয়েছে। আপু যেহেতু নেই এখন মাহিন ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ের কথা তুলেছে। তুমিও দেশ ছেড়ে চলে গেছো। এখন আমি কি করবো?

ভেসে যাওয়া কল্পনার সংসারে কীসের আশায় খড়কুটো আকড়ে পরে থাকার চেষ্টা করছে সে জানে না। তবুও এই ভরাডুবিতে নিজের বলতে বিস্ময়কেই জানে। আদ্রতার পরেই এই মানুষটাই ভরসা দিয়েছিলো। সকল সমস্যা মুহুর্তেই সমাধান করে দিতে পারে। আদ্রিকার বিশ্বাস আজও তাই দিবে। বিস্ময় অবশ্য সমাধান দিলো। তবে এর থেকে আদ্রিকার বুকে ছু রি চালিয়ে দেওয়া বুঝি বেশি ভালো ছিলো।

হো হো করে হেসে বললো,
– তোমার ফ্যামিলি পাক্কা ড্রামাবাজ। বোনটাও কম যায় না। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। সে তো ভালো কথা। বিয়ে করে নেও। বোনের কর্মকাণ্ডের দায় একটু হলেও তোমার উপর বর্তায়। নাকি তুমিও বোনের মতো ভেগে যাওয়ার প্ল্যান করছো?

বিস্ময়ে বিমূঢ় আদ্রিকা নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্ন করলো,
– বিয়ে করে নিবো? কীভাবে? আমি বিবাহিত। তুমি ভুলে যাচ্ছো আমাদের বিয়ে হয়েছিলো।
– উফ! কী এক বিয়ে নিয়ে পরে আছো। কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে?
– কারো কাছে প্রমাণ করতে না পারলেও আমি জানি, আমি বিবাহিত। তুমিও জানো আমাদের বিয়ে হয়েছিলো। শরীয়ত মোতাবেক আমি এখনো তোমার স্ত্রী। এই যে মেঘা আছে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। ও নিজেও আমাদের বিয়ের সাক্ষী ছিলো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিস্ময় বললো,
– আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পরলাম। মেঘা আছে না তোমার সাথে? ওকে ফোনটা দেও।

এবার খানিকটা কাজ হয়েছে। প্রমাণ নেই বলে তো আর বিয়ে অস্বীকার করা যায় না। কালিমা পরে জোর জবরদস্তির বিয়েতেও বর কনের একে অপরের প্রতি মায়া মহব্বত জন্মায়। এখানে ওরা দুজন নিজের ইচ্ছেতে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো। যা ভুলে এভাবে মুভ অন করা যায় নাকি? চোখের জল মুছে মেঘার দিকে ফোন এগিয়ে দিলো।

– হ্যালো?
– ফোনটা লাউডস্পিকারে দে।
মেঘা বিনাবাক্যে আদেশ পালন করলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো বিস্ময়ের কঠোর কন্ঠস্বর।

– সামনের সপ্তাহে তোর বিয়ে না?
– জ্বী ভাইয়া।
– অন্যের বিয়ের ঝামেলায় না জড়িয়ে নিজের বিয়েতে মনোযোগ দে। আদ্রিকার সাথে তোর কখনো পরিচয় ছিলো সেটা আজকে এখানেই ভুলে যাবি। তুই ওকে চিনিস না, ও তোকে চিনে না। ভালোভাবে বুঝিয়ে বলছি বলে হালকাভাবে নিস না। কথার নড়চড় হলে জানিস তো, তোর জামাইয়ের সাথে আমার কি রকম সম্পর্ক? কতোটা শ্রদ্ধা ভক্তি করে ও আমাকে! তোদের বিয়ে ভাঙ্গতে আমার এক ঘন্টাও লাগবে না। আর আমার বিয়েখেলা বউ আদ্রিকা, বিয়ে বিয়ে করে আমার মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছিলে না? ঠিক আছে৷ বিয়ে হয়েছিলো এখন ছাড়াছাড়িও হয়ে যাক। বিয়ের সাক্ষীর সামনেই তোমাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। কবুল বলে বিয়ে করেছিলাম। এখন তালাক দিয়ে দিলেই তো হবে, তাই না?

আদ্রিকা ছুটে গেলো মেঘার কাছে। হাত পা ভীষণ কাঁপছে। তবুও ফোনের সামনে হাত জোড় করে অনুরোধ করতে থাকলো।
– এমন করো না। প্লিজ বিস্ময়।

কে শোনে কার কথা! বিস্ময় নিজের মতো করে বলে গেলো।
– তালাক..
– বলো না প্লিজ। আর বলো না। আমি হাত জোড় করছি। ফিরে আসতে হবে না তোমার। ওখানেই থাকো। তবুও বলো না।
– তালাক, তালাক। তিন তালাক দিয়ে দিলাম। তোমার সাথে আমার আর কোনো ধরনের সম্পর্ক রইলো না। আর কখনো অযথা বিরক্ত করবে না। যদি চেষ্টা করো তাহলে কিন্তু তোমার বাবার কাছে কিছু উড়ো খবর চলে যাবে যেটা উনার পছন্দ নাও হতে পারে।

ওখানেই মাটিতে বসে পরলো সর্বহারা আদ্রিকা। আজকে বাড়িতে থেকে বের না হলেই বেশ হতো। এই দিনটা আসতো না। সূর্য উঠতো না। তবে কি এমন ক্ষতি হতো? আদ্রিকার মনে হচ্ছে সে এখনো স্বপ্ন দেখছে। এসব কিছু বাস্তব নয়। নিছক বাজে কোনো কল্পনা। আদ্রিকার মনের অজানা কোনো ভয়।
একমাত্র অবলম্বন, পায়ের তলা মাটি। সেটাও মনে হচ্ছে সরে যাচ্ছে। অবলম্বনহীন অতলের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে আদ্রিকা। পতন ঠেকাতে দু হাতে শক্ত করে মাটি আকড়ে ধরলো। কিন্তু একি? মাটি কোথায়? এতো মুঠো ভরা মোটা বালি। যা মুঠোর ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আদ্রিকার নিজের বলে কিছুই রইলো না। চেনা মানুষগুলোর মুখোশ সরে যেতে আর কি বাকি আছে? এর বেশি সহ্য করার সক্ষমতা যে আদ্রিকার নেই। কোথায় যাবে, কি করবে? মাথা কাজ করছে না। বাড়ি গেলে আর বের হওয়ার উপায় নেই। আজ হোক কাল হোক মাহিনের সাথে বিয়েটা হয়ে যাবে। গত রাতে যখন মোজাম্মেল এই অদ্ভুত প্রস্তাবটা দিয়েছিলো, মোকাররম কিছু না বললেও তাকে দেখে মনে হয়েছে তারও মত আছে। বড় মেয়ের দ্বারা সংঘটিত অন্যায়ের দায় চাপাতে ছোট মেয়েকে ব্যবহার করতে খুব একটা কষ্ট হবে না। দিনশেষে দুটোই মেয়ে। মেয়েদের আবার ভালোমন্দ কীসের? পরের ঘরের সম্পত্তি দ্রুত বুঝিয়ে দেওয়াই ভালো।
একমাত্র আশ্রয় ছিলো বিস্ময়। যা একটু আগেই মিছে মায়ার মতো বাস্তবতার আলোয় বিলীন হয়ে গেলো। একমুহূর্তে আদ্রিকা হারিয়ে ফেললো নিজের ভালোবাসা, ভরসা, আশ্রয়।

ফোনটা পরখের হাতে দিয়ে নিজের চোখের জল মুছে মেঘা এগিয়ে এলো আদ্রিকার দিকে। হাঁটু ভাঁজ করে আদ্রিকার দু কাঁধে হাত রেখে ওকে উঠানোর চেষ্টা করে বললো,
– কেউ কিছু জানার আগেই বাড়ি ফিরে যা আদ্রিকা। ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই হবে। এখানে এভাবে বসে থাকলে নিজেও বিপদে পরবি, আমাকেও ফেলবি।

হাহ, বিপদ! বিপদ হতে আর কি বাকি আছে? চারদিক থেকে তারা আদ্রিকাকে ঘিরে ফেলেছে। সর্বস্ব লুটে নেওয়ার পর মলিন এই খোলসটাই তো বাকি। আত্মাটা বেরিয়ে গেলে এই খোলসটাকেও মানুষ ছুঁড়ে ফেলে দিবে। তখন হয়তো একটু শান্তি মিলবে প্রেম আ গু নে জ্ব ল তে থাকা আত্মাটার।

ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে শক্ত হয়ে বসে থাকা আদ্রিকার দিকে চেয়ে পরখ বললো,
– ভালোবাসা এভাবেই ধুলোয় মিশে যায়।

একটা মোটরবাইক ধুলো উড়িয়ে চলে গেলো ব্যস্ত সড়কে। ধীর পায়ে একজোড়া পা ফিরে গেলো বাড়ির পথে। মাঝ রাস্তায় বসে ক্লান্ত প্রেমিকা ধুলো আঁকড়ে টিকিয়ে রাখতে চাইছে নিজের সত্তা। তবুও চোখের জলে, নাকের জলে ভিজছে এক নোলককন্যা।

পরিশিষ্ট:

সব গল্পের শুরুটা ভালোবাসা দিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত সে ভালোবাসা অবশিষ্ট থাকে না। একদিন নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ভয়টা মন থেকে কখনো মুছে ফেলতে নেই। এইটুকু ভয় নিজের সত্তাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। নশ্বর পৃথিবীতে কোনকিছু চিরস্থায়ী নয়। প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, মমতা সবটাই অনুভূতি মাত্র। আজ আছে, কাল নেই। সত্যটাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নাম জীবন। ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া নোলককন্যা হয়তো একদিন আমার আমিটাকে খুঁজে পাবে। কারো কাছে দয়া ভিক্ষে না চেয়ে নিজেই নিজেকে দয়া করবে, একটু ভালো থাকবে। জীবনের বাঁকে আলোর দিশারি খুঁজতে হলে বেঁচে থাকতে হয়। আমার বিশ্বাস, ততোদিন বেঁচে থাকবে নোলককন্যা। হয়তো ফিরবে বেঁচে থাকার নতুন মন্ত্রণা নিয়ে।