পথের পাঁচালী পর্ব-০৯+১০+১১

0
10

🔴পথের পাঁচালী (পর্ব :৯, ১০, ১১)🔴
– বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

🔴পর্ব :৯🔴

অপুদের বাড়ি হইতে কিছু দূরে একটা খুব বড় অশ্বখ গাছ ছিল। কেবল তাহার মাথাটা উহাদের দালানের জানোলা কি রোয়াক হইতে দেখা যায়। অপু মাঝে মাঝে সেইদিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিত। যতবার সে চাহিয়া দেখে, ততবার তাহার যেন অনেক– অনেক–অনেক দূরের কোন দেশের কথা মনে হয়–কোন দেশ, এ তাহার ঠিক ধারণা হইত না–কোথায় যেন কোথাকার দেশ-মা’র মুখে ওই সব দেশের রাজপুত্ত্বরদের কথাই সে শোনে।

অনেক দূরের কথায় তাহার শিশুমনে একটা বিস্ময়মাখানো আনন্দের ভাবের সৃষ্টি করিত। নীল রং-এর আকাশটা অনেক দূর, ঘুড়িটা-কুঠির মাঠটা অনেক দূর-সে বুঝাইতে পারিত না, বলিতে পারিত না কাহাকেও, কিন্তু এসব কথায় তাহার মন যেন কোথায় উড়িয়া চলিয়া যাইত–এবং সর্বাপেক্ষা কৌতুকের বিষয় এই যে, অনেক দূরের এই কল্পনা তাহার মনকে অত্যন্ত চাপিয়া তাহাকে যেন কোথায় লইয়া ফেলিয়াছে–ঠিক সেই সময়েই মায়ের জন্য তাহার মন কেমন করিয়া উঠিত, যেখানে সে যাইতেছে সেখানে তাহার মা নাই, অমনি মায়ের কাছে। যাইবার জন্য মন আকুল হইয়া পড়িত। কতবার যে এ রকম হইয়াছে। আকাশের গায়ে অনেক দূরে একটা চিল উড়িয়া যাইতেছে-ক্রমে ছোট্ট-ছোট্ট-ছোট্ট হইয়া নীলুদের তালগাছের উঁচু মাথাটা পিছনে ফেলিয়া দূর আকাশে ক্ৰমে মিলাইয়া যাইতেছে—চাহিয়া দেখিতে দেখিতে যেমন উড়ন্ত চিলটা দৃষ্টিপথের বাহির হইয়া যাইত, অমনি সে চোখ নামাইয়া লইয়া বাহিরাবাটী হইতে এক দৌড়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় উঠিয়া গৃহকার্যরত মাকে জড়াইয়া ধরিত। মা বলিত–দ্যাখো দ্যাখো, ছেলের কাণ্ড দ্যাখো–ছাড়–ছাড়—দেখছিস সকড়ি হাত?..ছাড়ো মানিক আমার, সোনা আমার, তোমার জন্যে এই দ্যাখো চিংড়িমাছ ভাজছি–তুমি যে চিংড়িমাছ ভালোবাসো? হ্যাঁ, দুষ্টুমি করে না।–ছাড়ো–

আহারাদির পর দুপুরবেলা তাহার মা কখনও কখনও জানালার ধারে আঁচল পাতিয়া শুইয়া ছেঁড়া কাশীদাসী মহাভারতখানা সুর করিয়া পড়িত। বাড়ির ধারে নারিকেল গাছটাতে শঙ্খচিল ডাকিত, অপু নিকটে বসিয়া হাতের লেখা ক-খ লিখিতে লিখিতে একমনে মায়ের মুখের মহাভারত পড়া শুনিত। দুর্গাকে তাহার মা বলিত, একটা পান সেজে দে তো দুগগা। অপু বলিত, মা সেই ঘুটে কুড়োনোর গল্পটা? তাহার মা বলে– ঘুটে কুড়োনোর কোন গল্প বল তো–ও সেই হরিহোড়ের? সে তো অন্নদামঙ্গলে আছে, এতে তো নেই? পরে পান মুখে দিয়ে সুর করিয়া পড়িতে থাকিত–

রাজা বলে শুন শুন মুনির নন্দন।
কহিব অপূর্ব কথা না যায় বর্ণন।।
সোমদত্ত নামে রাজা সিন্ধু দেশে ঘর।
দেবদ্বিজে হিংসা সদা অতি–

অপু আমনি মায়ের মুখের কাছে হাতখানি পাতিয়া বলিত, আমায় একটু পান? মা চিবানো পান নিজের মুখ হইতে ছেলের প্রসারিত হাতের উপর রাখিয়া বলিত–এঃ, বড্ড তেতো–এই খয়েরগুলোর দোষ, রোজ হাটে বারণ করি ও-খয়ের যেন আনে না, তবুও–

জানালার বাহিরে বাঁশবনের দুপুরের রৌদ্র-মাখানো শেওড়া ঘেটু বনের দিকে চাহিয়া চাহিয়া মহাভারতের-বিশেষত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথা শুনিতে শুনিতে সে তন্ময় হইয়া যায়। মহাভারতের সমস্ত চরিত্রের মধ্যে কর্ণের চরিত্র বড় ভালো লাগে তাহার কাছে। ইহার কারণ কর্ণের উপর তাহার কেমন একটা মমতা হয়। রথের চাকা মাটিতে পুতিয়া গিয়াছে–দুই হাতে প্ৰাণপণে সেই চাকা মাটি হইতে টানিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছেন– সেই নিরস্ত্ৰ অসহায়, বিপন্ন কর্ণের অনুরোধ মিনতি উপেক্ষা করিয়া অৰ্জ্জুন তীর ছাড়িয়া তাঁহাকে মারিয়া ফেলিলেন!! মায়ের মুখে এই অংশ শুনিতে শুনিতে দুঃখে অপুর শিশুহৃদয় পূর্ণ হইয়া উঠিত, চোখের জল বাগ মানিত না-চোখ ছাপাইয়া তাহার নরম তুলতুলে গাল বাহিয়া গড়াইয়া পড়িত–সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দুঃখে চোখে জল পড়ার যে আনন্দ, তাহা তাহার মনোরাজ্যে নব অনুভূতির সজীবত্ব লইয়া পরিচিত হইতে লাগিল। জীবনপথের যে দিক মানুষের চোখের জলে, দীনতায়, মৃত্যুতে, আশাহত ব্যর্থতায়, বেদনায় করুণ–পুরোনো বইখানার ছেঁড়া পাতার ভরপুর গন্ধে, মায়ের মুখের মিষ্ট সুরে, রৌদ্র ভরা দুপুরের মায়া-অঙ্গুলি-নির্দেশে, তাহার শিশুদৃষ্টি অস্পষ্টভাবে সে পথের সন্ধান পাইত। বেলা পড়িলে মা গৃহকার্যে উঠিয়া গেলে, সে বাহিরে আসিয়া রোয়াকে দাঁড়াইয়া দূরের সেই অশ্বখ গাছটার দিকে এক এক দিন চাহিয়া দেখে–হয়তো কড়া চৈত্র-বৈশাখের রৌদ্রে গাছটার মাথা ধোঁয়া-ধোঁয়া অস্পষ্ট, নয়তো বৈকালের অবসন্ন রাঙা রোদ অলসভাবে গাছটার মাথায় জড়াইয়া আছে–সকলের চেয়ে এই বৈকালের রাঙা-রোদ-মাখানো গাছটার দিকে চাহিয়াই তাহার মন কেমন করিত। কৰ্ণ যেন ওই অশ্বখ গাছটার ওপারে আকাশের তলে, অনেক দূরে কোথায় এখনও মাটি হইতে রথের চাকা দুই হাতে প্ৰাণপণে টানিয়া তুলিতেছে–রোজই তোলে–রোজই তোলে–মহাবীর, কিন্তু চিরদিনের কৃপার পাত্র কর্ণা বিজয়ী বীর অর্জন নহে–যে রাজ্য পাইল, মান পাইল, রথের উপর হইতে বাণ ছড়িয়া বিপন্ন শক্ৰকে নাশ করিল বিজয়ী কর্ণ-—যে মানুষের চিরকালের চোখের জলে জাগিয়া রহিল, মানুষের বেদনায় অনুভূতিতে সহচর হইয়া বিরাজ করিল–সে।

এক-একদিন মহাভারতের যুদ্ধের কাহিনী শুনিতে শুনিতে তাহার মনে হয় যুদ্ধ জিনিসটা মহাভারতে বড় কম লেখা আছে। ইহার অভাব পূর্ণ করিবার জন্য এবং আশ মিটাইয়া যুদ্ধ জিনিসটা উপভোগ করিবার জন্য সে এক উপায় বাহির করিয়াছে। একটা বাখ্যারি কিংবা হালকা কোন গাছের ডালকে অস্ত্ৰীস্বরূপ হাতে লইয়া সে বাড়ির পিছনে বাঁশবাগানের পথে অথবা বাহিরের উঠানে ঘুরিয়া বেড়ায় ও আপন মনে বলে–তারপর দ্রোণ তো একেবারে দশ বাণ ছুড়লেন, অর্জন করলেন কি, একেবারে দুশোটা বাণ দিলেন মেরে! তারপর-ওঃ-—সে কি যুদ্ধ! কি যুদ্ধ! বাণের চোটে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল! (এখানে সে মনে মনে যতগুলি বাণ হইলে তাহার। আশা মিটে তাহার কল্পনা করে, যদিও তাহার কল্পনার ধারা মা’র মুখে কাশীদাসী মহাভারতে বর্ণিত যুদ্ধের প্রণালী সম্বন্ধে যাহা শুনা আছে তাহা অতিক্রমে করে না) তারপর তো অর্জন করলেন কি, ঢাল আর তরোয়াল নিয়ে রথ থেকে লাফিয়ে পড়লেন–পরে এই যুদ্ধ! দুৰ্যোধন এলেন–ভীম এলেন–বাণে বাণে আকাশ অন্ধকার করে ফেলেচে–আর কিছু দেখা গেল না। মহাভারতের রথিগণ মাত্র অষ্টাদশ দিবস যুদ্ধ করিয়া নাম কিনিয়া গিয়াছেন, কিন্তু রক্ত-মাংসের দেহে জীবন্ত থাকিলে তাঁহারা বুঝিতে পারিতেন, যশোলাভের পথ ক্রমশই কিরূপ দুৰ্গম হইয়া পড়িতেছে। বালকের আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তি করিতে তাঁহারা মাসের পর মাস সমানভাবে অস্ত্ৰচালনা করিতে পারিতেন কি?

গ্রীষ্মকালের দিনটা, বৈশাখের মাঝামাঝি।

নীলমণি রায়ের ভিটার দিকে জঙ্গলের ধারে সেদিন দুপুরের কিছু পূর্বে দ্রোণগুরু বড় বিপদে পড়িয়াছেন–কপিধ্বজ রথ একেবারে তাঁহার ঘাড়ের উপরে, গান্তীব-ধনু হইতে ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ মুক্ত হইবার বিলম্ব চক্ষের পলক মাত্র, কুরুসৈন্যদলে হাহাকার উঠিয়াছে—এমন সময় শেওড়া বনের ওদিক হইতে হঠাৎ কে কৌতুকের কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল–ও কি রে অপু? আপু চমকিয়া উঠিয়া আকর্ণ-টানা জ্যা-কে হঠাৎ ছাড়িয়া দিয়া চাহিয়া দেখিল তাহার দিদি জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়াইয়া তাহার দিকে চাহিয়া খিল খিল করিয়া হাসিতেছে। অপু চাহিতেই বলিল–হ্যাঁরে পাগলা, আপন মনে কি বিকচিস বিড়বিড় করে, আর হাত পা নাড়ছিস? পরে সে ছুটিয়া আসিয়া সস্নেহে ভাই-এর কচি গালে চুমু খাইয়া বলিল-পাগল! কোথাকার একটা পাগল, কি বকছিলি রে আপন মনে?

অপু লজ্জিতমুখে বার বার বলিতে লাগিল–যাঃ…বিকছিলাম বুঝি?…আচ্ছা, যাঃ–

অবশেষে দুৰ্গা হাসি থামাইয়া বলিল-আয় আমার সঙ্গে…

পরে সে অপুর হাত ধরিয়া বনের মধ্যে লইয়া চলিল। খানিক দূর গিয়া হাসিমুখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল—দেখেচিস?…কত নোনা পেকেচে?…এখন কি করে পাড়া যায় বল দিকি?

অপু বলিল–উঃ, অনেক রে দিদি!–একটা কঞ্চি দিয়ে পাড়া যায় না?

দুৰ্গা বলিল-তুই এক কাজ কর, ছুটে গিয়ে বাড়ির মধ্যে থেকে আঁকুশিটা নিয়ে আয় দিকি? আঁকুশি দিয়ে টান দিলে পড়ে যাবে দেখিস এখন–

অপু বলিল–তুই এখানে দাঁড়া দিদি, আমি আনচি–

অপু আঁকুশি আনিলে দুজনে মিলিয়া বহু চেষ্টা করিয়াও চার-পাঁচটার বেশি ফল পাড়িতে পারিল না–খুব উচুগাছ, সর্বোচ্চ ডালে যে ফল আছে তাহা দুৰ্গা আঁকুশি দিয়াও নাগাল পাইল না। পরে সে বলিল–চল আজ। এইগুলো নিয়ে যাই, নাইবার বেলায় মাকে সঙ্গে আনবো–মার হাতে ঠিক নাগাল আসবে। দে নোনাগুলো আমার কাছে, তুই আঁকুশিটা নে। নোলক পরবি?

একটা নিচু ঝোপের মাথায় ওড়কলমি লতায় সাদা সাদা ফুলের কুড়ি, দুৰ্গা হাতের ফলগুলো নামাইয়া নিকটের ফুলের কুড়ি ছিড়িতে লাগিল। বলিল–এদিকে সরে আয়, নোলক পড়িয়ে দি–

তাহার দিদি ওড়কলমি ফুলের নোলক পরিতে ভালোবাসে, বনজঙ্গল সন্ধান করিয়া সে প্রায়ই খুজিয়া আনিয়া নিজে পড়ে ও ইতিপূর্বে কয়েকবার অপুকেও পরাইয়াছে। অপু কিন্তু মনে মনে নোলক-পরা পছন্দ করে না। তাহার ইচ্ছা হইল, বলে, নোলকে তাহার দরকার নাই। তবে দিদির ভয়ে সে কিছুই বলিল না। দিদিকে চটাইবার ইচ্ছা তাহার আদৌ নাই, কারণ দিদিই। বনজঙ্গল ঘুরিয়া কুলটা, জামটা, নোনাটা, আমড়াটা সংগ্ৰহ করিয়া তাহাকে লুকাইয়া খাওয়ায়, এমন সব জিনিস জুটাইয়া আনে, যাহা হয়তো কুপথ্য হিসাবে উহাদের খাইতে নিষেধ আছে, কাজেই অন্যায় হইলেও দিদির কথা না শুনা তাহার সাহসে কুলায় না।

একটা কুড়ি ভাঙিয়া সাদা জলের মতো যে আঠা বাহির হইল, তাহার সাহায্যে দুৰ্গা অপুর নাকে কুড়িটি আঁটিয়া দিল, পরে নিজেও একটা পরিল–তারপর ভাইয়ের চিবুকে হাত দিয়া নিজের দিকে ভালো করিয়া ফিরাইয়া বলিল–দেখি, কেমন দেখাচ্ছে? বাঃ বেশ হয়েচে, চল মাকে দেখাইগে–

অপু লজ্জিতমুখে বলিল–না দিদি—

–চল না–খুলে ফেলিসনে যেন।–বেশ হয়েচে–

বাড়ি আসিয়া দুৰ্গা নোনাফলগুলি রান্নাঘরের দাওয়ায় নামাইয়া রাখিল। সর্বজয়া রাঁধিতেছিল––দেখিয়া খুব খুশি হইয়া বলিল–কোথায় পেলি রে?

দুৰ্গা বলিল–ওই লিচু-জঙ্গলে–অনেক আছে, কাল গিয়ে তুমি পাড়বে মা? এমন পাকা-একেবারে সিদুরের মতো রাঙা–

সে আড়াল ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া বলিল–দ্যাখো মা–

অপু নোলক পরিয়া দিদির পিছনে দাঁড়াইয়া আছে। সর্বজয়া হাসিয়া বলিল–ও মা! ও আবার কে রে?–কে চিনতে তো পারছি নে–

অপু লজ্জায় তাড়াতাড়ি নাকের ডগা হইতে ফুলের কুড়ি খুলিয়া ফেলিল। বলিল–ওই দিদি পরিয়ে দিয়েছে–

দুৰ্গা হঠাৎ বলিয়া উঠিল–চল রে অপু, ওই কোথায় ডুগডুগি বাজচে, চল, বাঁদর খেলাতে এসেছে ঠিক, শিগগির আয়–

আগে আগে দুৰ্গা ও তাহার পিছনে পিছনে অপু ছুটিয়া বাটীর বাহির হইয়া গেল। সম্মুখের পথ বাহিয়া, বাঁদর নয়, ও-পাড়ার চিনিবাস ময়রা মাথায় করিয়া খাবার ফেরি করিতে বাহির হইয়াছে। ও-পাড়ায় তাহার দোকান, তা ছাড়া সে আবার গুড়ের ও ধানের ব্যবসাও করে। কিন্তু পুঁজি কম হওয়ায় কিছুতেই সুবিধা করিতে পারে না, অল্পদিনেই ফেল মারিয়া বসে। তখন হয়তো মাথায় করিয়া হাটে হাটে আলু, পটল, কখনও পান বিক্রয় করিয়া বেড়ায়। শেষে তাতেও যখন সুবিধা হয় না, তখন হয়তো সে বুলি ঘাড়ে করিয়া জাত-ব্যবসা আরম্ভ করে। পরে হঠাৎ একদিন দেখা যায় যে, আবার পাথুরে চুন মাথায় করিয়া বিক্রয় করিয়া বেড়াইতেছে। লোকে বলে একমাত্র মাছ ছাড়া এমন কোনো জিনিস নাই, যাহা তাহাকে বিক্রয় করিতে দেখা যায় নাই। কাল দশহরা, লোকে আজ হইতেই মুড়কি সন্দেশ কিনিয়া রাখিবে। চিনিবাস হরিহর রায়ের দুয়ার দিয়া গেলেও এ বাড়ি ঢুকিল না। কারণ সে জানে এ বাড়ির লোকে কখনও কিছু কেনে না। তবুও দুর্গঅপুকে দরজায় দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল–চাই নাকি?

অপু দিদির মুখের দিকে চাহিল। দুর্গ চিনিবাসের দিকে ঘাড় নাড়িয়া বলিল–নাঃ–

চিনিবাস ভুবন মুখুজ্যের বাড়ি গিয়া মাথার চাঙাড়ি নামাইতেই বাড়ির ছেলেমেয়েরা কলরব করিতে করিতে তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। ভুবন মুখুজ্যে অবস্থাপন্ন লোক, বাড়িতে পাঁচ-ছয়টা গোলা আছে, এ গ্রামে অন্নদা রায়ের নিচেই জমিজমা ও সম্পত্তি বিষয়ে তাহার নাম করা যাইতে পারে।

ভুবন মুখুজ্যের স্ত্রী বহুদিন মারা গিয়াছেন। বর্তমানে তাঁহার সেজ ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী এ সংসারের কত্রী।

সেজ-বৌ-এর বয়স চল্লিশের উপর হইবে, অত্যন্ত কড়া মেজাজের মানুষ বলিয়া তাঁহার খ্যাতি আছে।

সেজ-বৌ একখানা মাজা পিতলের সরায় করিয়া চিনিবাসের নিকট হইতে মুড়কি, সন্দেশ, বাতাসা দশহরা পূজার জন্য লইলেন। ভুবন মুখুজ্যের ছেলেমেয়ে ও তাঁহার নিজের ছেলে সুনীল সেইখানেই দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাদের জন্যও খাবার কিনিলেন। পরে অপুকে সঙ্গে লইয়া দুৰ্গা চিনিবাসের পিছন পিছন ঢুকিয়া উঠানে আসিয়া দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া সেজ-বৌ নিজের ছেলে সুনীলের কাঁধে হাত দিয়া একটু ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন– যাও না, রোয়াকে উঠে গিয়ে খাও না। এখানে ঠাকুরের জিনিস, মুখ থেকে ফেলে এঁটো করে বসবে।

চিনিবাস চাঙাড়ি মাথায় তুলিয়া পুনরায় অন্য বাড়ি চলিল। দুর্গ বলিল-আয় অপু, চল দেখিগে টুনুদের বাড়ি–

ইহারা সদর দরজা পার হইতেই সেজ-বৌ মুখ ঘুরাইয়া বলিয়া উঠিলেন-দেখতে পারিনে বাপু। ছড়িটার যে কী হ্যাংলা স্বভাব-নিজের বাড়ি আছে, গিয়ে বসে কিনে খেগে যা না? তা না, লোকের দোর দোর, যেমন মা তেমনি ছা–

ইহাদের বাটীর বাহির হইয়া দুৰ্গা ভাইকে আশ্বাস দিবার সুরে বলিল–চিনিবাসের ভারি তো খাবার! বাবার কাছ থেকে দেখিস রথের সময় চারটে পয়সা নেবো।–তুই দুটো, আমি দুটো। তুই আর আমি মুড়কি কিনে খাবো–

খানিকটা পরে ভাবিয়া ভাবিয়া অপু জিজ্ঞাসা করিল–রথের আর কতদিন আছে রে দিদি?

পর্ব ৯ শেষ 📌

🔴পর্ব :১০🔴

কয়েক মাস কাটিয়া গিয়াছে।

সর্বজয়া ভুবন মুখুজ্যের বাড়ির কুয়া হইতে জল তুলিয়া আনিল, পিছনে পিছনে অপু মায়ের আঁচল মুঠা পাকাইয়া ধরিয়া ও-বাড়ি হইতে আসিল। সর্বজয়া ঘড়া নামাইয়া রাখিয়া বলিল–তা তুই পেছনে পেছনে অমন করে ঘুরতে লাগলি কেন বল দিকি? ঘরকন্নার কাজকর্ম সারবো। তবে তো ঘাটে যাবো? কাজ কর্তে দিবি না–না?

অপু বলিল–তা হোক।–কাজ তুমি ও-বেলা কোরো এখন মা, তুমি যাও ঘাটে। পরে মায়ের সহানুভূতি আকর্ষণের আশায় অতীব করুণস্বরে কহিল–আচ্ছা আমার খিদে কি পায় না? আজি চারদিন যে খাইনি।

–খাওনি তো করবো কি? রোদুরে বেড়িয়ে বেড়িয়ে জ্বর বাঁধিয়ে বসবে, বল্লে কথা কানে নাও নাকি তোমরা? ছিষ্টির কাজ করবো। তবে তো ঘাটে যাব। বসে তো নেই? যা ও-রকম দুষ্টুমি করিস নে–তোমাদের ফরম্যাজ মতো কাজ করবার সাধ্যি আমার নেই, যা–

অপু মায়ের আঁচল আরও জোর করিয়া মুঠা পাকাইয়া ধরিয়া বলিল-কক্ষনো তোমায় কাজ কর্তে দেবো না। রোজই তো কাজ করো, একদিন বুঝি বাদ যাবে না? এক্ষুনি ঘাটে যাও–না, আমি শুনবো না…করো দিকি কেমন কাজ করবে?

সর্বজয়া পুত্রের দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিল–ও রকম দুষ্টুমি করে না, ছিঃ–এই হয়ে গ্যালো বলে, আর একটুখানি সবুর করো।–ঘাটে যাবো, ছুটে এসে তোমার ভাত চড়িয়ে দোব-দুষ্টুমি করে কি? ছাড় আঁচল, ক’খানা পলতার বড়া ভাজা খাবি বল দিকি?

ঘণ্টাখানেক পর অপু মহা উৎসাহের সহিত খাইতে বসিল।

গ্লাস তুলিয়া সে ঢকঢকা করিয়া অর্ধেকখানি খালি করিয়া ফেলিয়া, পরে আরও দু’এক গ্রাস খাইয়া কিছু ভাত পাতের নিচে ছড়াইয়া বাকি জলটুকু শেষ করিয়া হাত তুলিয়া বসিল।

–কই খাচ্ছিাস, কই? এতক্ষণ তো ভাত ভাত করে হাঁপাচ্ছিলে–পলতার বড়া– পলতার বড়া–ওই তো সবই ফেলে রাখলি, খেলি কি তবে?

সর্বজয়া একবাটি দুধ-ভাত মাখিয়া পুত্রকে খাওয়াইতে বসিল। দেখি হাঁ কর–তোমার কপালখানা–মণ্ডা না মেঠাই না, দুটো ভাত আর ভাত–তা ছেলের দশা দেখলে হয়ে আসে–রোজ ভাত খেতে বসে মুখ কাচুমাচু-বাঁচবে কি খেয়ে? বাঁচতে কি এসেচ? আমায় জ্বালাতে এসেচ বই তো নয়–ওরকম মুখ ঘুরিও না, ছিঃ–হা করো লক্ষ্মী–দেখি এই দলাটা হলেই হয়ে গেল–আবার ওবেলা টুলুদের বাড়িতে মনসার ভাসান হবে। তুই জানিস নে বুঝি? শিগগির শিগগির খেয়ে নিয়ে চলো। আমরা সব

দুৰ্গা বাড়ি ঢুকিল। কোথা হইতে ঘুরিয়া আসিতেছে। এক পা ধুলা, কপালের সামনে একগোছা চুল সোজা হইয়া প্রায় চার আঙুল উঁচু হইয়া আছে। সে সব সময় আপন মনে ঘুরিতেছে–পাড়ার সমবয়সি ছেলেমেয়ের সঙ্গে তাহার বড় একটা খেলা-ধুলা নাই– কোথায় কোন ঝোপে। বৈঁচি পাকিল, কাদের বাগানে কোন গাছটায় আমের গুটি বাঁধিয়াছে, কোন বাঁশতলায় শেয়াকুল খাইতে মিষ্ট-এ সব তাহার নখদর্পণে। পথে চলিতে চলিতে সে সর্বদা পথের দুই পাশে সতর্ক দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে চলিয়াছে—কোথাও কাঁচপোকা বসিয়া আছে কি না। যদি কোথাও কণ্টিকারী গাছের পাকা ফল দেখিতে পাইল, তৎক্ষণাৎ খেলাঘরের বেগুন করিবার জন্য তাহা তুলিতে বসিয়া যাইবে। হয়তো পথে কোথাও বসিয়া সে নানারকমের খাপরা লইয়া ছড়িয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিতেছে, গঙ্গা-যমুনা খেলায় কোনখানায় ভালো তাক হয়–পরীক্ষায় যেখানা ভালো বলিয়া প্রমাণিত হইবে, সেখানা সে সযত্নে আঁচলে বাঁধিয়া লইবে। সর্বদাই সে পুতুলের বাক্স ও খেলাঘরের সরঞ্জাম লইয়া মহাব্যস্ত।

সে ঢুকিয়া অপরাধীর দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চাহিল। সর্বজয়া বলিল—এলে! এসো, ভাত তৈরি। খেয়ে আমায় উদ্ধার করো।–তারপর আবার কোন দিকে বেরুতে হবে বেরোও। বোশেখ মাসের দিন-সকলের মেয়ে দ্যাখো গে যাও সেঁজুতি করচে, শিবপুজো করচে–আর অত বড় ধাড়ি মেয়ে–দিনরাত কেবল টো টো। সেই সকাল হতে না হতে বেরিয়েচে, আর এখন এই বেলা দুপুর ঘুরে গিয়েচে, এখন এলো বাড়ি-মাথাটার ছিরি দ্যাখো না! না একটু তেল দেওয়া, না একটু চিরুনি ছোঁয়ানো-কে বলবে বামুনের মেয়ে, ঠিক যেন দুলে কি বাগদিদের কেউ–বিয়েও হবে ওই দুলে-বাগদিদের বাড়িতেই–আচলে ওগুলো কী ধনদৌলত বাঁধা-খোল–

দুৰ্গা ভয়ে ভয়ে আঁচলের খুঁট খুলিতে খুলিতে কহিল–ওই রােয়ককাদের বাড়ির সামনে কালকাসুন্দে গাছে–পরে ঢোঁক গিলিয়া কহিল–এই অনেক বেনেবৌ তাই–

বেনেবৌয়ের কথায় হৃদয় গলে না। এমন পাষাণ জীবও জগতে অনেক আছে। সর্বজয়া তেলেবেগুনে জ্বলিয়া কহিল–তোর বেনেবৌয়ের না নিকুচি করেচে, যত ছাই আর ভাসসো রাতদিন বেঁধে নিয়ে ঘুরচেন–আজি টান মেরে তোমার পুতুলের বাক্স ওই বাঁশতলার ডোবায় যদি না ফেলি। তবে–

সর্বজয়ার কথা শেষ হইবার পূর্বেই এক ব্যাপার ঘটিল। আগে আগে ভুবন মুখুজ্যের বাড়ির সেজ-ঠাকরুন, পিছনে পিছনে তাঁহার মেয়ে টুনু ও দেওরের ছেলে সন্তু, তাহাদের পিছনে আর চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে সম্মুখ দরজা দিয়া বাড়ি ঢুকিল। সেজ-ঠাকরুন কোনো দিকে না চাহিয়া বাড়ির কাহারও সহিত কোনো আলাপ না করিয়া সোজা হন হন। করিয়া ভিতরের দিকের রোয়াকে উঠিলেন। নিজের ছেলের দিকে ফিরিয়া বলিলেন–কই নিয়ে আয়–বের কর পুতুলের বাক্স, দেখি–

এ বাড়ির কেহ কোনো কথা বলিবার পূর্বেই টুনু ও সন্তু, দুজনে মিলিয়া দুর্গার টিনের পুতুলের বাক্সটা ঘর হইতে বাহির করিয়া আনিয়া রোয়াকে নামাইল এবং টুনু বাক্স খুলিয়া খানিকটা খুঁজিবার পর একছড়া পুতির মালা বাহির করিয়া বলিল–এই দ্যাখো মা, আমার সেই মালাটা—সেদিন যে সেই খেলতে গিয়েছিল, সেদিন চুরি করে এনেচে।

সতু বাক্সের এক কোণ সন্ধান করিয়া গোটাকতক আমের গুটি বাহির করিয়া বলিল–এই দ্যাখো জেঠিমা, আমাদের সোনামুখী গাছের আম পেড়ে এনেচে।

ব্যাপারটা এত হঠাৎ হইয়া গেল বা ইহাদের গতিবিধি এ বাড়ির সকলের কাছেই এত রহস্যময় মনে হইল যে এতক্ষণ কাহারও মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হয় নাই। এতক্ষণ পরে সর্বজয়া কথা খুজিয়া পাইয়া বলিল–কি, কি খুড়িমা? কি হয়েচে? পরে সে রান্নাঘরের দাওয়া হইতে ব্যগ্রভাবে উঠিয়া আসিল।

–এই দ্যাখো না কি হয়েচে, কীর্তিখানা দ্যাখো না একবার–তোমার মেয়ে সেদিন খেলতে গিয়ে টুনুর পুতুলের বাক্স থেকে এই পুতির মালা চুরি করে নিয়ে এসেচে-মেয়ে ক’দিন থেকে খুঁজে খুজে হয়রান। তারপর সন্তু গিয়ে বললে যে, তোর পুতির মালা দুগগাদিদির বাক্সের মধ্যে দেখে এলাম–দ্যাখো একবার কাণ্ড–তোমার ও মেয়ে কম নাকি? চোর-চোরের বেহদা চোর-—আর ওই দ্যাখো না-বাগানের আমগুলো গুটি পড়তে দেরি সয় না–চুরি করে নিয়ে এসে বাক্সে লুকিয়ে রেখেচে।

যুগপৎ দুই চুরির অতর্কিততায় আড়ষ্ট হইয়া দুৰ্গা পাঁচিলের গায়ে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া ঘামিতেছিল। সর্বজয়া জিজ্ঞাসা করিল–এনিচিস এই মালা ওদের বাড়ি থেকে?

দুৰ্গা কথার উত্তর দিতে না দিতে সেজ-বৌ বলিলেন,–না আনলে কি আর মিথ্যে করে বলচি নাকি! বলি এই আম কটা দ্যাখো না? সোনামুখীর আমি চেনো, না কি? এও কি মিথ্যে কথা?

সর্বজয়া অপ্ৰতিভ হইয়া বলিল–না। সেজখুড়ি, আপনার মিথ্যে কথা তা তো বলিনি! আমি ওকে জিজ্ঞেস করচি।

সেজ-ঠাকরুন হাত নাড়িয়া ঝাঁজের সহিত বলিলেন–জিজ্ঞেস করো আর যা করো বাপু, ও মেয়ে সোজা মেয়ে হবে না। আমি বলে দিচ্চি–এই বয়েসে যখন চুরি বিদ্যে ধরেচে, তখন এর পর যা হবে সে টেরই পাবে! চল রে সতু-—নে আমের গুটিগুলো বেঁধে নে-বাগানের আমগুলো লক্ষ্মীছাড়া ছড়ির জ্বালায় যদি চোখে দেখবার জো আছে! টুনু, মালা নিইচিস তো?

সর্বজয়ার কি জানি কেমন একটু রাগ হইল–ঝগড়াতে সে কিছু পিছু হটবার পাত্র নয়, বলিল–পুতির মালার কথা জানিনে সেজ-খুড়ি, কিন্তু আমের গুটিগুলো, সেগুলো পেড়েছে কি তলা থেকে কুড়িয়ে এনেচে, তার গায়ে তো নাম লেখা নেই। সেজখুড়ি—আর ছেলেমানুষ যদি ধরো এনেই থাকে–

সেজ-ঠাকরুন অগ্নিমূর্তি হইয়া বলিলেন–বলি কথাগুলি তো বেশ কেটে কেটে বলচো? বলি আমের গুটিতে নাম লেখা না-হয় নেই-ই, তোমাদের কোন বাগান থেকে এগুলো এসেচে। তা বলতে পারো? বলি টাকাগুলোতেও তো নাম লেখা ছিল না।–তা তো হাত পেতে নিতে পেরেছিলে? আজ এক বিচ্ছরের ওপর হয়ে গ্যালো, আজ দেবো কাল দেবো।–আসবো এখন ওবেলা, টাকা দিয়ে দিয়ো–ও আমি আর রাখতে পারবো না– টাকার জোগাড় করে রেখো বলে দিচ্চি।

দলবলসহ সেজ-ঠাকরুন দরজার বাহির হইয়া গেলেন। সর্বজয়া শুনিতে পাইল, পথে কাহার কথার উত্তরে তিনি বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলিতেছেন-ওই এ-বাড়ির ছুড়িটা, টুনুর বাক্স থেকে এই পুতির মালাছড়াটা চুরি করে নিয়ে গিয়ে করেচে। কি নিজের বাক্সে লুকিয়ে রেখেচে–আর দ্যাখো না। এই আমগুলো–পাশেই বাগান, যত ইচ্ছে পাড়লেই হল–তাই বলতে গেলাম, তা মা আবার কেটে কেটে বলচে (এখানে সেজ-বৌ সর্বজয়ার কথা বলিবার ভঙ্গি নকল করিলেন)–তা–এনেচে ছেলেমানুষ– ও রকম এনেই থাকে-ওতে কি তোমাদের নাম লেখা আছে নাকি? (সুর নিচু করিয়া) মা-ই কি কম চোর নাকি, মেয়ের শিক্ষে কি আর অমনি হয়েচে? বাড়িসুদ্দ সব চোর–

অপমানে দুঃখে সর্বজয়ার চোখে জল আসিল। সে ফিরিয়া দুর্গার রুক্ষ চুলের গোছা টানিয়া ধরিয়া ডাল ভাত মাখা হাতেই দুড়দাড় করিয়া তাহার পিঠে কিলের উপর কিল ও চড়ের উপর চড় মারিতে মারিতে বলিতে লাগিল–আপদবালাই একটা কোথেকে এসে জুটেছে–ম’লে ও আপদ চুকে যায়–মরেও না যে বাঁচি-হাড় জুড়োয়।–বেরো বাড়ি থেকে, দূর হয়ে যা—যা, এখখুনি বেরো–

দুৰ্গা মারা খাইতে খাইতে ভয়ে খিড়কি-দোর দিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। তাহার ছেঁড়া রুক্ষ চুলের গোছা দু-এক গাছা সর্বজয়ার হাতে থাকিয়া গেল।

অপু খাইতে খাইতে অবাক হইয়া সমস্ত ব্যাপার দেখিতেছিল। দিদি পুতির মালা চুরি করিয়া আনিয়াছিল। কিনা তাহা সে জানে না-পুতির মালাটা সে ইহার আগে কোনও দিন দেখে নাই—কিন্তু আমের গুটি যে চুরির জিনিস নয় তাহা সে নিজে জানে। কাল বৈকালে দিদি তাহাকে সঙ্গে করিয়া টুলুদের বাগানে আম কুড়াইতে গিয়াছিল এবং সোণামুখীর তলায় আম কটা পড়িয়া ছিল, দিদি কুড়াইয়া লইল, সে জানে কাল হইতে অনেকবার দিদি বলিয়াছে–ও অপু, এবার সেই আমের গুটিগুলো জারাবো, কেমন তো? কিন্তু মা অসুবিধাজনকভাবে বাড়ি উপস্থিত থাকার দরুন উক্ত প্রস্তাব আর কার্যে পরিণত করা সম্ভব হয় নাই। দিদির অত্যন্ত আশার জিনিস আমগুলো এভাবে লইয়া গেল, তাহার উপর আবার দিদি এরূপ ভাবে মারও খাইল। দিদির চুল ছিড়িয়া দেওয়ায় মায়ের উপর তাহার অত্যন্ত রাগ হইল। যখন তাহার দিদির মাথার সামনে রুক্ষ চুলের এক গোছা খাড়া হইয়া বাতাসে উড়ে তখনই কি জানি কেন, দিদির উপর অত্যন্ত মমতা হয়–কেমন যেন মনে হয় দিদির কেহ কোথাও নাই–সে যেন একা কোথা হইতে আসিয়াছে–উহার সাখী কেহ এখানে নাই। কেবলই মনে হয়, কেমন করিয়া সে দিদির সকল দুঃখ ঘুচাইয়া দিবে–সকল অভাব পূরণ করিয়া তুলিবে! তাহার দিদিকে সে এতটুকু কষ্টে পড়িতে দিবে না।

খাওয়ার পরে অপু মায়ের ভয়ে ঘরের মধ্যে বসিয়া পড়িতে লাগিল। কিন্তু তাহার মন থাকিয়া থাকিয়া কেবলই বাহিরে ছুটিয়া যাইতেছিল। বেলা একটু পড়িলে সে টুনুদের বাড়ি, পাটলিদের বাড়ি, নেড়াদের বাড়ি–একে একে সকল বাড়ি খুজিল–দিদি কোথাও নাই। রাজকৃষ্ট পালিতের স্ত্রী ঘাট হইতে জল লইয়া আসিতেছিলেন—তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল–জেঠিমা, আমার দিদিকে দেখেচো? সে আজ ভাত খায়নি, কিছু খায়নি।–মা তাকে আজ বড্ড মেরেচে-—মার খেয়ে কোথায় পালিয়েচে–দেখেচো জেঠিমা?

বাড়ির পাশের পথ দিয়া যাইতে যাইতে ভাবিল-বাঁশ-বাগানে সে যদি বসিয়া থাকে? সেদিকে গিয়া সমস্ত খুজিয়া দেখিল। সে খিড়কি-দরজা দিয়া বাড়ি ঢুকিয়া দেখিল, বাড়িতে কেহ নাই। তাহার মা বোধ হয় ঘাটে কি অন্য কোথাও গিয়াছে। বাড়িতে বৈকালের ছায়া পড়িয়া আসিয়াছে। সম্মুখের দরজার কাছে যে বাঁশঝাড় ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, তাহার একগাছা ঝুলিয়া-পড়া শুকনো কঞ্চিতে তাহার পরিচিত সেই লেজঝোলা হলদে পাখিটা আসিয়া বসিয়াছে। রোজই সন্ধ্যার কিছু পূর্বে সে কোথা হইতে আসিয়া এই বাঁশঝাড়ের ওই কিঞ্চিখানার উপর বসে–রোজ-—রোজ-—রোজ। আরও কত কি পাখি চারিদিকের বনে কিচ-কিচ করিতেছে। নীলমণি রায়েদের পোড়ো ভিটা গাছপালার ঘন ছায়ায় ভরিয়া গিয়াছে। অপু রোয়াকে দাঁড়াইয়া দূরের সেই অশ্বখ গাছটার মাথার দিকটায় চাহিয় দেখিল–একটু একটু রাঙা রোদ গাছের মাথায় এখনও মাখানো, মগডালে একটা কি সাদা মতো দুলিতেছে, হয় বক, নয় কাহারও ঘুড়ি ছিড়িয়া আটকাইয়া বুলিতেছে–সমস্ত আকাশ জুড়িয়া যেন ছায়া আর অন্ধকার নামিয়া আসিতেছে। চারিদিকে নির্জন.কেহ কোনোদিকেই নাই..নীলমণি রায়ের পোড়ো ভিটায় কচুঝাড়ের কালো ঘন সবুজ নতুন পাতা চক চক করিতেছে। তাহার মন হঠাৎ হু-হু করিয়া উঠিল। কতক্ষণ হইল, সেই গিয়াছে, বাড়ি আসে নাই, খায় নাই–কোথায় গেল দিদি?

ভুবন মুখুজ্যের বাড়ির ছেলেমেয়েরা মিলিয়া উঠানে ছুটাছুটি করিয়া লুকোচুরি খেলিতেছে। রানু তাহাকে দেখিয়া ছুটিয়া আসিল–ভাই, আপু এসেচে.ও আমাদের দিকে হবে, আয় রে অপু।

অপু তাহার হাত ছাড়াইয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিল-আমি খেলবো না রানুদি,–দিদিকে দেখেচোঁ?

রানু জিজ্ঞাসা করিল–দুগগা? না, তাকে তো দেখিনি! বকুলতলায় নেই তো?

বকুলতলার কথা তাহার মনেই হয় নাই। সেখানে দুৰ্গা প্রায়ই থাকে বটে। ভুবন মুখুজ্যের বাড়ি হইতে সে বকুলতলায় গেল। সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে–বকুলগাছটা অনেক দূর পর্যন্ত জুড়িয়া ডালপালা ছড়াইয়া ঝুপসি হইয়া দাঁড়াইয়া আছে–তলাটা অন্ধকার। কেহ কোথাও নাই…যদি কোনো দিকে গাছপালার আড়ালে থাকে! সে ডাক দিল–দিদি, ও দিদি! দিদি!

অন্ধকার গাছটায় কেবল কতকগুলা বক পাখী ঝটপট করিতেছে মাত্র। অপু ভয়ে ভয়ে উপরের দিকে চাহিয়া দেখিল। বকুলতলা হইতে একটু দূরে একটা ডোবার ধারে খেজুর গাছ আছে, এখন ডাশা খেজুরের সময়, সেখানেও তাহার দিদি মাঝে মাঝে থাকে বটে। কিন্তু অন্ধকার হইয়া গিয়াছে, ডোবাটার দুই ধারে বাঁশবন, সেখানে যাইয়া দেখিতে তাহার সাহসী হইল না। বকুলগাছের গুড়ির কাছে সরিয়া গিয়া সে দুই-একবার চিৎকার করিয়া ডাকিল-ভাটিশেওড়া বনে কি জন্তু তাহার গলার সাড়া পাইয়া খসি খসি শব্দ করিয়া ডোবার দিকে ছুটিয়া পলাইল।

বাড়ির পথে ফিরিতে ফিরিতে হঠাৎ সে থমকিয়া দাঁড়াইল। সামনে সেই গাব গাছটা! এক সন্ধ্যার পর এ গাবগাছের তলার পথ দিয়া যাওয়া! সর্বনাশ! গায়ে কাঁটা দিয়া ওঠে। কেন যে তাহার এই গাছটার নিচে দিয়া যাইতে ভয় করে, তাহা সে জানে না। কোন কারণ নাই, এমনিই ভয় করে এবং কারণ কিছু নাই বলিয়া ভয় অত্যন্ত বেশি করে। এত দেরি পর্যন্ত সে কোনো দিন বাড়ির বাহিরে থাকে নাই–আজ তাহার সে খেয়াল হইল না। মন ব্যস্ত ও অন্যমনস্ক না থাকিলে সে কখনই এপথে আসিত না।

অপু খানিকক্ষণ অন্ধকার গাবতলাটার দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া ফিরিল। তাহাদের বাড়ি যাইবার আর একটা পথ আছে–একটুখানি ঘুরিয়া পটলিদের বাড়ির উঠান দিয়া গেলে গাবতলার এ অজানা বিভীষিকার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।

পাটলির ঠাকুরমা সন্ধ্যার সময় বাড়ির রোয়াকে ছেলেপিলেদের লইয়া হাওয়ায় বসিয়া গল্প করিতেছেন। পাটলির মা রান্নাঘরে রাঁধিতেছেন। উঠানের মাচাতলায় বিধু জেলেনি দাঁড়াইয়া মাছ বিক্রয়ের পয়সা তাগাদা করিতেছে।

অপু বলিল–দিদিকে খুঁজতে গিয়েছিলাম ঠাকুমা—বকুলতলা থেকে আসতে আসতে–

ঠাকুরমা বলিলেন–দুগগা এই তো বাড়ি গেল। এই কতক্ষণ যাচ্ছে–ছুটে যা দিকি– বোধ হয় এখনও বাড়ি গিয়ে পৌঁছয়নি–

সে এক দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটিল। পিছন হইতে পাটলির বোন রাজী চেচাইয়া বলিল–কাল সকালে আসিস অপু–আমরা গঙ্গা-যমুনা খেলার নতুন ঘর কেটেছি! টেকশালের পেছনে নিমতলায়–দুগগাকে বলিস–

তাহাদের বাড়ির কাছে আসিয়া পৌঁছিয়া হঠাৎ সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেল–দুৰ্গা আর্তস্বরে চিৎকার করিতে করিতে বাড়ির দরজা দিয়া দৌড়াইয়া বাহির হইতেছে–পিছনে পিছনে তাহার মা কি একটা হাতে মারিতে মারিতে তাড়া করিয়া ছুটিয়া আসিয়াছে। দুৰ্গা গাবতলার পথ দিয়া ছুটিয়া পলাইল, মা দরজা হইতে ধাবমানা মেয়ের পিছনে চেচাইয়া বলিল–যাও বেরোও–একেবারে জন্মের মতো যাও–আর কক্ষনো বাড়ি যেন ঢুকতে না হয়—বালাই, আপদ চুকে যাক-একেবারে ছাতিমতলায় দিয়ে আসি।

ছাতিমতলায় গ্রামের শ্মশান। অপুর সমস্ত শরীর যেন জমিয়া পাথরের মতো আড়ষ্ট ও ভারী হইয়া গেল। তাহার মা সবেমাত্র ভিতরের বাড়িতে ঢুকিয়া মাটির প্রদীপটা রোয়াকের ধার হইতে উঠাইয়া লইতেছে। সে পা টিপিয়া টিপিয়া বাড়ি ঢুকিতেই তাহার মা তাহার দিকে চাহিয়া বলিল–তুমি আবার এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে শুনি? মোটে তো আজ ভাত খেয়েচো?

তাহার মনে নানা প্রশ্ন জাগিতেছিল। দিদি আবার মারা খাইল কেন? সে এতক্ষণ কোথায় ছিল? দুপুর বেলা দিদি কি খাইল? সে কি আবার কোন জিনিস চুরি করিয়া আনিয়াছে? কিন্তু ভয়ে কোনো কথা না বলিয়া সে কলের পুতুলের মতো মায়ের কথামতো কাজ করিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিল। পরে ভয়ে ভয়ে প্ৰদীপ উসকাইয়া দিয়া নিজের ছোট বইয়ের দপ্তরটি বাহির করিয়া পড়িতে বসিল। সে পড়ে মােটে তৃতীয় ভাগ-কিন্তু তাহার দপ্তরে দুখানা মোটা মোটা ভারী ইংরাজি কি বই, কবিরাজি ঔষধের তালিকা, একখানা পাতা-ছেড়া দাশুরায়ের পাঁচালি, একখানা ১৩০৩ সালের পুরাতন পাঁজি প্রভৃতি আছে। সে নানাস্থান হইতে চাহিয়া এগুলি জোগাড় করিয়াছে এবং এগুলি না পড়িতে পারিলেও রোজ একবার করিয়া খুলিয়া দেখে।

খানিকক্ষণ দেওয়ালের দিকে চাহিয়া সে কি ভাবিল। পরে আর একবার প্রদীপ উসকাইয়া দিয়া পাতা-ছেড়া দাশুরায়ের পাঁচালিখানা খুলিয়া অন্যমনস্কভাবে পাতা উলটাইতেছে, এমন সময়ে সর্বজয়া এক বাটি দুধ হাতে করিয়া ঢুকিয়া বলিল–এসো, খেয়ে নাও দিকি!

অপু দ্বিরুক্তি না করিয়া বাটি উঠাইয়া লইয়া দুধ চুমুক দিয়া খাইতে লাগিল। অন্যদিন হইলে এত সহজে দুধ খাইতে তাহাকে রাজি করানো খুব কঠিন হইত। একটুখানি মাত্র খাইয়া সে বাটি মুখ হইতে নামাইল। সর্বজয়া বলিল–ওকি? নাও সবটুকু খেয়ে ফেলো–ওইটুকু দুধ ফেললে তবে বাঁচবে কি খেয়ে–

অপু বিনা প্রতিবাদে দুধের বাটি পুনরায় মুখে উঠাইল। সর্বজয়া দেখিল সে মুখে বাটি ধরিয়া রহিয়াছে কিন্তু চুমুক দিতেছে না।–তাহার বাটিসুদ্ধ হাতটা কাঁপিতেছে. পরে অনেকক্ষণ মুখে ধরিয়া রাখিয়া হঠাৎ বাটি নামাইয়া সে মায়ের দিকে চাহিয়া ভয়ে কাঁদিয়া উঠিল। সর্বজয়া আশ্চর্য হইয়া বলিল–কি হল রে? কি হয়েচে, জিভ কামড়ে ফেলেছিস?

অপু মায়ের কথা শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ের বাঁধ না মানিয়া ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল–দিদির জন্য বড্ড মন কেমন করছে!..

সর্বজয়া অল্পক্ষণ মাত্ৰ চুপ করিয়া বসিয়া পরে সরিয়া আসিয়া ছেলের গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে শান্তসুরে বলিতে লাগিল–কেন্দো না, অমন করে কেন্দো না,-ওই পটলিদের কি নেড়াদের বাড়ি বসে আছে–কোথায় যাবে অন্ধকারে? কম দুষ্ট মেয়ে নাকি? সেই দুপুর বেলা বেরুল–সমস্ত দিনের মধ্যে আর চুলের টিকি দেখা গেল না–না খাওয়া, না দাওয়া, কোথায় ও-পাড়ার পালিতদের বাগানে বসে ছিল, সেখানে বসে কাঁচা আমি আর জামরুল খেয়েচে, এক্ষুনি ডাকতে পাঠাচ্ছি–কেন্দো না আমন করে–আবার জ্বর আসবে।–ছিঃ!

পরে সে আঁচল দিয়া ছেলের চোখের জল মুছইয়া দিয়া বাকি দুধ টুকু খাওয়াইবার জন্য বাটি তাহার মুখে তুলিয়া ধরিল-হাঁ করো দিকি, লক্ষ্মী সোনা, উনি এলেই ডেকে আনবেন এখন—একেবারে পাগল–কোথেকে একটা পাগল এসে জন্মেছে—আর এক চুমুক–হ্যাঁ–

রাত অনেক হইয়াছে। উত্তরের ঘরে তক্তাপোশে অপু ও দুর্গ শুইয়া আছে। অপুর পাশে তাহার মায়ের শুইবার জায়গা খালি আছে। কারণ মা এখন রান্নাঘরের কাজ সারিয়া আসে নাই। তাহার বাবা আহারাদি সারিয়া পাশের ঘরে বসিয়া তামাক খাইতেছেন। বাবা বাড়ি আসিয়া দুৰ্গাকে পাড়া হইতে খুজিয়া আনিয়াছেন।

বাড়ি আসিয়া পর্যন্ত দুৰ্গা কাহারও সঙ্গে কোনো কথা বলে নাই। খাওয়া-দাওয়া সারিয়া আসিয়া চুপ করিয়া শুইয়াছে। অপু দুৰ্গার গায়ে হাত দিয়া জিজ্ঞাসা করিল–দিদি, মা কি দিয়ে মেরেছিল রে সন্ধেবেলা? তোর চুল ছিঁড়ে দিয়েচে?

দুৰ্গার মুখে কোন কথা নাই।

সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল-আমার উপর রাগ করেছিস দিদি? আমি তো কিছু করিনি।

দুৰ্গা আস্তে আস্তে বলিল–না বইকি! তবে সন্তু কি করে টের পেলে যে পুতির মালা আমার বাক্সে আছে?

অপু প্রতিবাদের উত্তেজনায় উঠিয়া বসিল।–না–সত্যি আমি তোর গা ছয়ে বলচি দিদি, আমি তো দেখাইনি। আমি জানিনে যে তোর বাক্সে আছে।–কাল সন্তু বিকেল বেলা এসেছিল, ওর সেই বড় রাঙা ভাঁটাটা নিয়ে আমরা খেলছিলাম–তার পর, বুঝলি দিদি, সতু তোর পুতুলের বাক্স খুলে কি দেখছিল–আমি বল্লাম, ভাই, তুমি আমার দিদির বাক্সে হাত দিয়ে না।–দিদি আমাকে বকে–সেই সময়ে দেখেচে–

পরে সে দুর্গার গায়ে হাত বুলাইয়া বলিল–খুব লেগেচে রে দিদি? কোথায় মেরেচে মা?

দুৰ্গা বলিল–আমার কানের পাশে মা একটা বাড়ি যা মেরেছে–রক্ত বেরিয়েছিল, এখনও কন কন কচ্ছে, এইখানে এই দ্যাখা হাত দিয়ে! এই–

–এইখানে? তাই তো রে! কেটে গিয়েছে যে? একটু পিন্দিমের তেল লাগিয়ে দেব দিদি?

–থাকগে-কাল পালিতদের বাগানে বিকেল বেলা যাব বুঝলি? কামরাঙা যা পেকেছে? এই এত বড় বড়, কাউকে যেন বলিসনে! তুই আর আমি চুপি চুপি যাবো।–আমি আজ দুপুরবেলা দুটো পেড়ে খেয়েছি।–মিষ্টি যেন গুড়–

পর্ব ১০ শেষ 📌

🔴পর্ব :১১🔴

এদিনের ব্যাপারটা এইরূপে ঘটিল।

অপু বাবার আদেশে তালপাতে সাতখানা ক খ হাতের লেখা শেষ করিয়া কি করা যায় ভাবিতে ভাবিতে বাড়ির মধ্যে দিদিকে খুজিতে গেল। দুৰ্গা মায়ের ভয়ে সকালে নাহিয়া আসিয়া ভিতরের উঠানে পেপেতলায় পুণ্যিপুকুরের ব্ৰত করিতেছে। উঠানে ছোট্ট চৌকোণা গর্ত কাটিয়া তাহার চারিধারে ছোলা, মটর ছড়াইয়া দিয়াছিল–ভিজে মাটিতে সেগুলির অন্ধুর বাহির হইয়াছে—চারিদিকে কলার ছোট বোগ পুতিয়া ধারে পিটুলি গোলার আলপনা। দিতেছে-পদ্মলতা, পাখি, ধানের শিষ, নতুন ওঠা সূর্য।

দুৰ্গা বলিল–দাঁড়া, এই মন্তরটা বলে নিয়ে চল এক জায়গায় যাবো।

–কোথা রে দিদি?

–চল না, নিয়ে যাবো এখন, দেখিস এখন–। পরে আনুষঙ্গিক বিধি-অনুষ্ঠান সাঙ্গ করিয়া সে এক নিশ্বাসে আবৃত্তি করিতে লাগিল–

পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা কে পুজে রে দুপুর বেলা?

আমি সতী লীলাবতী ভায়ের বোন ভাগ্যবতী–

অপু দাঁড়াইয়া শুনিতেছিল, বিদ্রুপের ভঙ্গিতে হাসিয়া বলিল–ইঃ।

দুৰ্গা ছড়া থামাইয়া ঈষৎ লজ্জা-মিশানো হাসির সঙ্গে বলিল–তুই ও-রকম কচ্চিস কেন? যা এখান থেকে–তোর এখানে কি?–যা।

অপু হাসিয়া চলিয়া গেল। যাইতে যাইতে আবৃত্তি করিতে লাগিল-আমি সতী লীলাবতী, ভাই বোন ভাগ্যবতী, হি হি–ভাই বোন ভাগ্যবতী–হি–হি–

দুৰ্গা বলিল, তোমার বড় ইয়ে হয়েচে, না? মাকে বলে তোমার ভ্যাংচানো বার করবো। 으R–

ব্ৰতানুষ্ঠান শেষ করিয়া দুৰ্গা বলিল, চল গড়ের পুকুরে অনেক পানফল হয়ে আছে– ভোঁদার মা বলছিল, চল নিয়ে আসি–

গ্রামের একেবারে উত্তরাংশে চারিধারে বাঁশবন ও আগাছা এবং প্রাচীন। আম-কাঁঠালের বাগানের ভিতর দিয়া পথ। লোকালয় হইতে অনেক দূরে গভীর বন যেখানে শেষ হইয়াছে, সেখানে মাঠের ধারে মজা পুকুরটা। কোনকালে গ্রামের আদি বাসিন্দা মজুমদারদের বাড়ির চতুর্দিকে যে গড়খাই ছিল তাহার অন্য অংশ এখন ভরাট হইয়া গিয়াছে।–কেবল এই খাতটাতে বারো মাস জল থাকে, ইহারই নাম গড়ের পুকুর। মজুমদারদের বাড়ির কোন চিহ্ন এখন নাই।

সেখানে পৌঁছিয়া তাহারা দেখিল পুকুরে পানফল অনেক আছে বটে, কিন্তু কিনারার ধারে বিশেষ কিছু নাই, সবই জল হইতে দূরে। দূর্গ বলিল–অপু, একটা বাঁশের কঞ্চি দ্যাখ তো খুঁজে–তাই দিয়ে টেনে টেনে আনবো। পরে সে পুকুরধারের ঝোপের শেওড়া গাছ হইতে পাকা শেওড়ার ফল তুলিয়া খাইতে লাগিল। অপু বনের মধ্যে কঞ্চি খুঁজিতে খুঁজিতে দেখিতে পাইয়া বলিল-ও দিদি, ও ফল খাসনি!–দূর-আশ-শ্যাওড়ার ফল কি খায় রে! ও-তো পাখিতে খায়–

দুৰ্গা পাকা ফল টিপিয়া বীজ বাহির করিতে করিতে বলিল-আয় দিকি—দাখ দিকি খেয়ে-মিষ্টি যেন গুড়-কে বলেচে খায় না? আমি তো কত খোইচি।

অপু কিঞ্চি কুড়ানো রাখিয়া দিদির কাছে আসিয়া বলিল-খেলে যে বলে পাগল হয়? আমায় একটা দে দিকি, দিদি–

পরে সে খাইয়া মুখ একটু কাঁচুমাচু করিয়া বলিল—এন্টু এন্টু তেতো যে দিদি–

–তা এন্টু তেতো থাকবে না? তা থাক, কিন্তু কেমন মিষ্টি বল দিকি-কথা শেষ করিয়া দুৰ্গা খুব খুশির সহিত গোটাকতক বড়বড় পাকা ফল মুখের মধ্যে পুরিল।

জন্মিয়া পর্যন্ত ইহারা কখনও কোনো ভালো জিনিস খাইতে পায় নাই। অথচ পৃথিবী ইহারা নূতন আসিয়াছে, জিহবা ইহাদের নূতন—তাহা পৃথিবীর নানা রস, বিশেষত মি রস আস্বাদ করিবার জন্য লালায়িত। সন্দেশ মিঠাই কিনিয়া সে পরিতৃপ্তি লাভ করিবা সুযোগ ইহাদের ঘটে না-বিশ্বের অনন্ত সম্পদের মধ্যে তুচ্ছ বনগাছ হইতে মিষ্টরস আহরণরত এই সব লুব্ধ দরিদ্র ঘরের বালকবালিকাদের জন্য তাই করুণাময়ী বনদেবীরা বনের তুচ্ছ ফুলফল মিষ্টি মধুতে ভরাইয়া রাখেন।

খানিকটা পরে দুর্গা পুকুরের জলে একটু নামিয়া বলিল—ক’ত নাল ফুল রয়েছে। আপু! দাঁড়া তুলছি। জলে আরও নামিয়া সে দুইটা ফুলের লতা ধরিয়া টানিল–ডাঙায় ছুড়িয়া দিয়া বলিল–ধর অপু।

অপু বলিল–পানফল তো খুব জলে–ওখানে কি করে যাবি দিদি?

দুর্গ একটা কঞ্চি দিয়া দূর জলের পানফলের গাছগুলো টানিবার চেষ্টা করিয়া পারিল না। বলিল–বড্ড গড়ানে পুকুর রে– গড়িয়ে যাচ্ছি ডুবজলে–নাগাল পাই কি করে? তুই এক কাজ কর, পেছন থেকে আমার আঁচল ধরে টেনে রাখা দিকি, আমি কিঞ্চি দিয়ে পানফলের ওই বাকিটা টেনে আনি।

বনের মধ্যে হলদে কি একটা পাখি ময়নাকাটা গাছের ডালের আগায় বসিয়া পাতা নাচাইয়া ভারি চমৎকার শিস দিতেছিল। অপু চাহিয়া চাহিয়া দেখিয়া বলিল–কি পাখি রে দিদি?

–পাখি-টাখি এখন থাক–ধর দিকি বেশ করে। আচলটা টেনে, গড়িয়ে যাবো–জোর করে–

অপু পিছন হইতে আঁচল টানিয়া রহিল। দুর্গ পায়ে পায়ে নামিয়া যতদূর যায় কঞ্চি আগাইয়া দিল। কাপড়-চোপড় ভিজিয়া গেল তবু নাগাল আসে না–আরও একটুখানি নামিয়া আঙুলের আগায় মাত্র কঞ্চিখানাকে ধরিয়া টানিবার চেষ্টা করিল। অপু টানিয়া ধরিয়া থাকিতে থাকিতে শক্তিতে আর কুলাইতেছে না দেখিয়া পিছন হইতে হাসিয়া উঠিল।। হাসির সঙ্গে আঁচল ঢিলা হওয়াতে দুৰ্গা জলের দিকে ঝুকিয়া পড়িল কিন্তু তখনই সামলাইয়া হাসিয়া বলিল-দূর, তুই যদি কোনো কাজের ছেলে-ধর ফের। অতিকষ্টে একটা পানফলের ঝাঁক কাছে আসিল–দুৰ্গা কৌতূহলের সহিত দেখিতে লাগিল কতগুলা পানিফল ধরিয়াছে। পরে ডাঙায় ছুড়িয়া দিয়া বলিল-বড্ড কচি, এখনও দুধ হয়নি মধ্যে, আর একবার ধর তো। অপু আবার পিছন হইতে টানিয়া ধরিয়া রহিল। খানিকটা থাকিবার পর সে দিদির বুকিবার সঙ্গে সঙ্গে টানের চোটে আবার দু-এক পা জলের দিকে আগাইয়া আসিতে লাগিল–পরে কাপড় ভিজিয়া যায় দেখিয়া হাল ছাড়িয়া হি হি করিয়া হাসিয়া উঠিল।

দুৰ্গা হাসিয়া বলিল-দূরা

ভাইবোনের কলহাস্যে খানিকক্ষণ ধরিয়া পুকুরপ্রান্তের নির্জন বাঁশবাগান মুখরিত হইতে লাগিল। দুৰ্গা বলিল–এতটুকু যদি জোর থাকে তোর গায়ে! গাবের টেঁকি কোথাকার!

খানিকটা পরে দুর্গা জলে নামিয়া আর একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতেছে, অপু ডাঙায় দাঁড়াইয়া আছে, এমন সময় অপু পাশের একটা শ্যাওড়া গাছের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া চেচাইয়া বলিয়া উঠিল–দিদি, দ্যাক কি এখানে!… পরে সে ছুটিয়া গিয়া মাটি খুঁড়িয়া কি তুলিতে লাগিল।

দুৰ্গা জল হইতে জিজ্ঞাসা করিল–কি রে? পরে সেও উঠিয়া ভাইয়ের কাছে আসিল।

অপু ততক্ষণ মাটি খুঁড়িয়া কি একটা বাহির করিয়া কোঁচার কাপড় দিয়া মাটি মুছিয়া সাফ করিতেছে। হাতে করিয়া আহ্বাদের সহিত দিদিকে দেখাইয়া বলিল–দ্যাখ দিদি, চকচক কচ্ছে–কি জিনিস রে?

দুৰ্গা হাতে লইয়া দেখিল–গোলমত একদিক ছুচোলো পল-কাটা-কাটা চকচকে কি একটা জিনিস। সে খানিকক্ষণ আগ্রহের সহিত নানাভাবে উলটাইয়া পালটাইয়া দেখিতে লাগিল।

হঠাৎ কি ভাবিয়া তাহার রুক্ষ চুলে-ঘেরা মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে ভয়ে ভয়ে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল কেহ দেখিতেছে কিনা। চুপিচুপি বলিল–অপু, এটা বোধ হয় হীরে! চুপ কর, চেচাসনে। পরে সে ভয়ে ভয়ে আর একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিল।

অপু দিদির দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। হীরক বস্তুটি তাহার অজ্ঞাত নয় বটে, মায়ের মুখে দিদির মুখে রূপকথার রাজপুত্র ও রাজকন্যার হীরামুক্তার অলঙ্কারের ঘটা সে অনেকবার শুনিয়াছে কিনা হীরা জিনিসটা কি রকম দেখিতে, সে সম্বন্ধে তাহার মনে একটু ভুল ধারণা ছিল। তাহার মনে হইত হীরা দেখিতে মাছের ডিমের মতো, হলদে হলদে, তবে নরম নয়–শক্ত।…

সর্বজয়া বাড়ি ছিল না, পাড়া হইতে আসিয়া দেখিল–ছেলেমেয়ে বাড়ির ভিতর দিকে দরজার কাছে দাঁড়াইয়া আছে। কাছে। যাইতে দুৰ্গা চুপিচুপি বলিল–মা, একটা জিনিস কুড়িয়ে পেয়েচি আমরা। গড়ের পুকুরে পানফল তুলতে গিাইছিলাম মা। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে এটি পোঁতা ছিল।

অপু বলিল–আমি দেখে দিদিকে বল্লাম, মা।

নসটা খুলিয়া মায়ের হাতে দিয়া বলিল–দ্যাখো দিকি কী এটা

দুৰ্গা আঁচল হইতে জিনিসটা খুলিয়া মায়ের হাতে দিয়া বলিল—দ্যাখো দিকি কী এটা মা?

সর্বজয়া উলটাইয়া পালটাইয়া দেখিতে লাগিল। দুৰ্গা চুপিচুপি বলিল–মা, এটা ঠিক হীরে–নয়?

সর্বজয়ারও হীরক সম্বন্ধে ধারণা তাহাদের অপেক্ষা বেশি স্পষ্ট নহে। সে সন্দিগ্ধ সুরে জিজ্ঞাসা করিল–তুই কি করে জানালি হীরে?

দুৰ্গা বলিল–মজুমদারেরা বড়লোক ছিল তো মা? ওদের ভিটের জঙ্গলে কারা নাকি মোহর কুড়িয়ে পেয়েছিল––পিসি গল্প করতো। এটা একেবারে পুকুরের ধারে বনের মধ্যে পোঁতা ছিল, রোদুর লেগে চকচক কচ্ছিল, এ ঠিক মা হীরে।

সর্বজয়া বলিল-আগে উনি আসুন, ওঁকে দেখাই।

দুৰ্গা বাহিরে উঠানে আসিয়া আহ্বাদের সহিত ভাইকে বলিল–হীরে যদি হয় তবে দেখিস আমরা বড়মানুষ হয়ে যাবো।

অপু না বুঝিয়া বোকার মতো হি হি করিয়া হাসিল।

ছেলেমেয়ে চলিয়া গেলে জিনিসটা বাহির করিয়া সর্বজয়া ভালো করিয়া দেখিতে লাগিল। গোলমতো, ধারকাটা ও পালতোলা, এক মুখ ছুচোলো-যেন সিন্দূর কৌটার ঢাকনির উপরটা। বেশ চকচকে। সর্বজয়ার মনে হইল যেন অনেক রকম রং সে ইহার মধ্যে দেখিতে পাইতেছে। তবে কাচ যে নয়–ইহা ঠিক। এ রকম ধরনের কাচ সে কখনও দেখিয়াছে বলিয়া তো মনে হয় না। হঠাৎ তাহার সমস্ত গা দিয়া যেন কিসের স্রোত বহিয়া গেল, তাহার মনের এক কোণে নানা সন্দেহের বাধা ঠেলিয়া একটা গাঢ় দুরাশা ভয়ে ভয়ে একটু উকি মারিল–সত্যিই যদি হীরে হয়, তা হলে?

হীরক সম্বন্ধে তাহার ধারণাটা পরশপাথর কিংবা সাপের মাথার মণি জাতীয় ছিল। কাহিনীর কথা মাত্র, বাস্তব জগতে বড় একটা দেখা যায় না। আর যদি বা দেখা যায়, তবে দুনিয়ার ঐশ্বর্য বোধ হয় এক টুকরা হীরার বদলে পাওয়া যাইতে পারে।

খানিকটা পরে একটা পুটুলি হাতে হরিহর বাড়ি ঢুকিল।

সর্বজয়া বলিল–ওগো, শোনো, এদিকে এসো তো! দ্যাখো তো এটা কি!

হরিহর হাতে লইয়া বলিল–কোথায় পেলে?

–দুগগা গড়ের পুকুরে পানফল তুলতে গিয়েছিল, কুড়িয়ে পেয়েচে। কি বলো দিকি?

হরিহর খানিকক্ষণ উলটাইয়া পালটাইয়া দেখিয়া বলিল–কাচ, না-হয় পাথর-টাথর হবে-একটুকু জিনিস, ঠিক বুঝতে পারচি নে।

সর্বজয়ার মনে একটুখানি ক্ষীণ আশার রেখা দেখা দিল–কাচ হইলে তাহার স্বামী কি চিনিতে পারিত না? পরে সে চুপিচুপি, যেন পাছে স্বামী বিরুদ্ধযুক্তি দেখায় এই ভয়ে বলিল–হীরে নয় তো? দুগগা বলছিল মজুমদার বাড়ির গড়ে তো কত লোক কত কি কুড়িয়ে পেয়েচে! যদি হীরে হয়?

–হ্যাঁ, হীরে যদি পথেঘাটে পাওয়া যেত। তবে আর ভাবনা কি ছিল? তুমিও যেমন!… তাহার মনে মনে ধারণা হইল ইহা কাচ। পরীক্ষণেই কিন্তু মনে হইল হয়তো হইতেও পারে। বলা যায় কি! মজুমদারেরা বড়লোক ছিল। বিচিত্র কি যে হয়তো তাদেরই গহনায়-টহনায় কোনো কালে বসানো ছিল, কি করিয়া মাটির মধ্যে পুঁতিয়া গিয়াছে। কথায় বলে, কপালে না থাকিলে গুপ্তধন হাতে পড়িলে চেনা য্যা না—শেষে কি দরিদ্র ব্রাহ্মণের গল্পের মত ঘটিবে? সে বলিল—আচ্ছা দাঁড়াও, একবার বরং গাঙ্গুলী-বাড়ি দেখিয়ে আসি।

রাঁধিতে রাঁধিতে সর্ব্বজয়া বার বার মনে মনে বলিতে লাগিল—দোহাই ঠাকুর, কত লোক তো কত কি কুড়িয়ে পায়! এই কষ্ট যাচ্ছে সংসারের—বাছাদের দিকে মুখ তুলে তাকিও—দোহাই ঠাকুর!

তাহার বুকের মধ্যে টিপ্‌ টিপ্‌ করিতেছিল।

খানিকটা পরে দুর্গা বাড়ী আসিয়া আগ্রহের সুরে বলিল—বাবা এখনও বাড়ী ফেরে নি, হ্যাঁ মা?

সঙ্গে সঙ্গে হরিহর বাড়ীর ভিতরে ঢুকিয়া বলিল—হুঁঃ, তখনই আমি বললাম এ কিছুই নয়। গাঙ্গুলী মশায়ের জামাই সত্যবাবু কলকাতা থেকে এসেছেন—তিনি দেখে বল্লেন, এ একরকম বেলোয়ারী কাচ—ঝাড়-লণ্ঠনে ঝুলানো থাকে। রাস্তাঘাটে যদি হীরে-জহরৎ পাওয়া যেত তা হলে…তুমিও যেমন।

পর্ব ১১ শেষ 📌
চলবে।