🔴পথের পাঁচালী (পর্ব :১২, ১৩, ১৪)🔴
– বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
🔴পর্ব ১২🔴
বৈশাখ মাসের দিন। প্রায় দুপুর বেলা।
সর্বজয়া বাটনা বাটিতে বাটিতে ডান হাতের কাছে রক্ষিত একটা ফুলের সাজিতে (অনেকদিন হইতে ফুলের সহিত ইহার কোনো সম্পর্ক নাই, মশলা রাখিবার পাত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়) মশলা খুঁজতে গিয়া বলিল–আবার জিরে-মরিচের পুঁটুলটা কোথায় নিয়ে পালালি? বড্ড জ্বালাতন কচ্চিস অপু-রাঁধতে দিবিনে? তারপর একটু পরেই বোলো এখন–মা ক্ষিদে পেয়েছে।
অপুর দেখা নাই।
–দিয়ে যা বাপ আমার, লক্ষ্মী আমার-কেন জ্বালাতন কচ্চিস বল দিকি? দেখচিস বেলা হয়ে যাচ্ছে।
অপু রান্নাঘরের ভিতর হইতে দুয়ারের পাশ দিয়া ঈষৎ উঁকি মারিল, মায়ের চোখ সেদিকে পড়িতেই তাহার দুষ্টুমির হাসি-ভরা টুকটুকে মুখখানা শামুকের খোলার মধ্যে ঢুকিয়া পড়িবার মতো তৎক্ষণাৎ আবার দুয়ারের আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেল। সর্বজয়া বলিল—দ্যাখ্ দিকি কাণ্ড–কেন বাপু দিক্ করিস। দুপুরবেলা? দিয়ে যা–
অপু পুনরায় হাসিমুখে ঈষৎ উঁকি মারিল।
—ওই আমি দেখতে পেয়েছি–আর লুকুতে হবে না, দিয়ে যা—
—হি-হি-হি–আমোদের হাসি হাসিয়া সে আবার দুয়ারের আড়ালে মুখ লুকাইল।
সর্বজয়া ছেলেকে ভালোরূপেই চিনিত। যখন অপু ছোট্ট খোকা দেড়বছরেরটি, তখন দেখিতে সে এখনকার চেয়েও টুকটুকে ফরসা ছিল। সর্বজয়ার মনে আছে, সে তাহার ডাগর চোখ দুটিতে বেশ করিয়া কাজল পরাইয়া কপালের মাঝখানে একটি টিপ পরাইয়া দিত ও তাহার মাথায় একটা নীল রং-এর কম দামের ঘন্টিওয়ালা পশমের টুপি পরাইয়া, কোলে করিয়া সন্ধ্যার পূর্বে বাহিরের রকে দাঁড়াইয়া ঘুম পাড়াইবার উদ্দেশ্যে সুর টানিয়া টানিয়া বলিত–
আয় রে পাখি-ই-ই লেজঝোলা,
আমার খোকনকে নিয়ে-এ-এ-গাছে তোলা…
খোকা ট্যাঁপা-ট্যাঁপা ফুলো-ফুলো গালে মায়ের মুখের দিকে হ্যাঁ করিয়া চাহিয়া থাকিত, পরে হঠাৎ কি মনে করিয়া সম্পূর্ণ দন্তহীন মাড়ি বাহির করিয়া আহ্বাদে আটখানা হইয়া মলা-পরা অসম্ভবরদীপ ছোট্ট পায়ে মাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া মায়ের পিঠের দিকে মুখ লুকাইত। সর্বজয়া হাসিমুখে বলিত-ওমা, খোকা আবার কোথায় লুকুলো? তাই তো, দেখতে তো পাচ্ছিনে! ও খোকা!… পরে সে ঘাড়ের দিকে মুখ ফিরাইতেই শিশু আবার হাসিয়া মুখ সামনের দিকে ফিরাইত এবং নির্বোধের মতো হাসিয়া মায়ের কঁধে মুখ লুকাইত। যতই সর্বজয়া বলিত-ওম, কই আমার খোকা কই-আবার কোথায় গেলা-কই দেখি, ততই শিশুর খেলা চলিত। বার বার সামনে পিছনে ফিরিয়া সর্বজয়ার ঘাড়ে ব্যথা হইলেও শিশুর খেলার বিরাম হইত না। সে তখন একেবারে আনকোরা টাট্কা, নতুন সংসারে আসিয়াছে।। জগতের অফুরন্ত আনন্দভাণ্ডারের এক অণুর সন্ধান পাইয়া তাহার অবোধ মন তখন সেইটাকে লইয়াই লোভীর মতো বার বার আস্বাদ করিয়াও সাধ মিটাইতে পারিতেছে না।–তখন তাহকে থামায় এমন সাধ্য তাহার মায়ের কোথায়? খানিকক্ষণ এরূপ করিতে করিতে তাহার ক্ষুদ্র শরীরে শক্তির ভাণ্ডার ফুরাইয়া আসিত- সে হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হইয়া হই তুলিতে থাকিস্ত-সর্বজয়া ছোট্ট হ্যাঁ-টির সামনে তুড়ি দিয়া বলিত-ষাট ষাটএই দ্যাখো দেয়ালা করে করে। এইবার বাছার আমার ঘুম আসচে। পরে সে মুগ্ধ নয়নে শিশুপুত্রের টিপ-কাজলপরী, কচি মুখের দিকে চাহিয়া বলিত-কত রঙ্গই জানে সনকু আমার-তবুও তো এই যোটের দেড় বছরের! হঠাৎ সে আকুল চুম্বনে খোকার রাঙা গাল দুটি ভরাইয়া ফেলিত। কিন্তু মায়ের এই গাঢ় আদরের প্রতি সম্পূৰ্ণ ঔদাসীন্য প্রদর্শন করিয়াই শিশুর নিদ্রাতুর আঁখিপাতা ঢুলিয়া আসিত, সর্বজয়া খোকার মাথাটা আস্তে আস্তে নিজের কঁধে রাখিয়া বলিত-ওমা, সন্দেবোলা দ্যাখে ঘুমিয়ে পড়লো! এই ভাবছি সন্দেটা উৎবুলে দুধ খাইয়ে তবে ঘুম পাড়াবো-দ্যাখো কাণ্ড!
সর্বজয়া জানিত-ছেলে আট বছরের হইলে কি হইবে, সেই ছেলেবেলাকার মতো মাযের সহিত লুকোচুরি খেলিবার সাধ তাহার এখনও মিটে নাই।
এমন সব স্থানে সে লুকায় যেখান হইতে অন্ধও তাহাকে বাহির করিতে পারে; কিন্তু সর্বজয়া দেখিয়াও দেখে না-এক জায়গায় বসিয়াই এদিকে ওদিকে চায়, বলে-তাই তো! কোথায় গেল? দেখতে তো পাচ্ছিনে!..অপু ভাবে-মাকে কেমন ঠকাইতে পারা যায়! মায়ের সহিত এ খেলা করিয়া মজা আছে। সর্বজয়া জানে যে, খেলায় যোগ দিবার ভান করিলে এইরূপ সারাদিন চলিতে পারে, কাজেই সে ধমক দিয়া কহিল-তা হলে কিন্তু থাকলো পড়ে রান্নাবান্না। অপু, তুমি ওই রকম করো, খেতে চাইলে তখন দেখবে মজাটা–
অপু হাসিতে হাসিতে গুপ্তস্থান হইতে বাহির হইয়া মশলার পুঁটুলি মায়ের সামনে রাখিয়া দিল।
তাহার মা বলিল, যা একটু খেলা করগে যা বাইরে। দেখগে যা দিকি তোর দিদি কোথায আছে! গাছতলায় দাঁড়িয়ে একটু হ্যাঁক দিয়ে দাখ দিকি। তার আজ নাইবার দিন-হতচ্ছাড়া মেয়ের নাগাল পাওয়ার জো আছে? যা তো লক্ষ্মী ছেলে–
কিন্তু এখানে মাতৃ-আদেশ পালন করিয়া সুপুত্ৰ হইবার কোনো চেষ্টা তাহাব দেখা গেল না। সে বাটনা-বাটা-রত মায়ের পিছনে গিয়া কি করিতে লাগিল।
–হু-উ-উ-উ-উ-উম্–
সর্বজয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল অপু বড়ি দেওয়ার জন্য চালের বাতায় রক্ষিত একটা পুরানো চট আনিয়া মুড়ি দিয়া মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়া বসিয়া আছে।
–দ্যাখো দ্যাখো, ছেলের কাণ্ড দ্যাখো একবার। ও লক্ষ্মীছাড়া, ওতে যে সাত-রাজ্যির ধুলো। ফ্যাল ফ্যাল-সাপ-মাকড় আছে না কি আছে। ওর মধ্যে-আজি কদিন থেকে তোলা রয়েছে–
–হু-উ-উ-উম—(পূর্বাপেক্ষা গম্ভীর সুরে)
–নাঃ, বল্লে যদি কথা শোনে-বাবা আমার, সোনা আমার, ওখানা ফ্যাল-আমার বাটনার ঠাত—দুষ্টুমি কোরো না ছিঃ!
থলে-মোড়া মূর্তিটা হামাগুড়ি দিয়া এবার দুই কদম আগাঁইয়া আসিল। সর্বজয়া বলিল-ছুঁবি ছুঁবি-ছুঁও না মানিক আমার–ওঃ, ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গিাইচি-ভারি ভয় হয়েছে মামার!
অপু হি-হি করিয়া হাসিয়া থলেখানা খুলিয়া এক পাশে রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মাথার চুল, মুখ, চোখের ভুবু, কান ধুলায় ভরিয়া গিয়াছে। মুখ কঁচুমাচু করিয়া সে সামনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাঁত কিছু কিচু করিতেছে।
-ওমা আমার কি হবে! হ্যাঁরে হতভাগা, ধুলো মেখে যে একেবারে ভূত সেজেছিস? উঃ–ওই পুরানো থলেটার ধুলো! একেবারে পাগল!
ধূলিধূসরিত অবোধ পুত্রের প্রতি করুণা ও মমতায় সর্বজয়ার বুক ভরিয়া আসিল; কিন্তু অপুর পরনে বাসি কাপড়-নাহিয়া-ধুইয়া ছোঁয়া চলে না বলিয়া বলিল-গামছাখানা নে, ওই দিয়ে ধুলোগুলো আগে ঝেড়ে ফ্যাল। ছেলে যেন কি একটা।
খানিকটা পরে ছেলেকে রান্নাঘরে পাহারার জন্য বসাইয়া সে জল আনিতে বাহির হইয়া যাইতেছে, দেখে দরাজ দিয়া দুর্গা বাড়ি ঢুকিতেছে। মুখ রৌদ্রে রাঙা, মাথার চুল উসকোথুসকো, অথচ ধুলোমাখা পায়ে আলতা পরা। একেবারে মায়ের সামনে পড়াতে আঁচলে বাঁধা আম দেখাইয়া টোক গিলিয়া কহিল—এই পুণ্যপুকুরের জন্যে ছোলার গাছ আনতে গেলাম রাজীদের বাড়ি, আম পেড়ে এনেছে ভাগ হচ্ছে, তাই রাজীর পিসিমা দিলে।
–আহা, মেয়ের দশা দ্যাখো, গায়ে খড়ি উড়াচে, মাথার চুল দেখলে গায়ে জ্বর আসে–পুণ্যিপুকুরের জন্য ভেবে তো তোমার রাত্তিরে ঘুম নেই!-পরে মেয়ের পায়ের দিকে চাহিয়া কহিল-ফের বুঝি লক্ষ্মীর চুবড়ি থেকে আলতা বের করে পরা হয়েচে?
দুৰ্গা আঁচল দিয়া মুখ মুছিয়া উসকোথুসকো চুল কপাল হইতে সরাইয়া বলিল-লক্ষ্মীর চুবড়ির আলতা বইকি! আমি সেদিন হাটে বাবাকে দিয়ে আলতা আনালোম এক পয়সার, তার দরুন দু’পাতা আলতা আমার পুতুলের বাক্সে ছিল না বুঝি?
হরিহর কলকে হাতে রান্নাঘরের দাওয়ায় আগুন লাইতে আসিল।
সর্বজয়া বলিল-ঘণ্টায় ঘণ্টায় তামাকে আগুন দি কোথা থেকে? সুদৱীকাঠের বন্দোবস্ত করে রেখেচোঁ। কিনা একেবারে! বাঁশের চেলার আগুন কতক্ষণ থাকে যে আবার ঘড়ি-ঘড়ি তামাক খাওয়ার আগুন জোগাবো? পরে আগুন তুলিবার জন্য রক্ষিত একটা ভাঙা পিতলের হাতাতে খানিকটা আগুন উঠাইয়া বিরক্তমুখে সামনে ধরিল। পরে সুর নরম করিয়া বলিল-কি হল?
—এক রকম ছিল তো সবই ঠিক, বাড়িসুদ্ধ সবাই মন্তর নেবার কথাই হয়েছিল, কিন্তু একটু মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। মহেশ বিশ্বেসের শ্বশুরবাড়ির বিষয়-আশয় নিয়ে কি গোলমাল বেধেছে, বিশ্বেস মশায় গিয়েচে সেখানে চলে-সে-ই আসল মালিক কিনা। তাই আবার একটু পিছিয়ে গেল; আবার এদিকেও তো অকাল পড়চে আষাঢ় মাস থেকে।
–আর সেই যে বাসের জায়গা দেবে, বাস করাবে বলছিল, তার কি হল?
—এই নিয়ে একটু মুশকিল বেধে গেল। কিনা! ধরে যদি মন্তর নেওয়া পিছিয়ে যায়, তবে ওকথা আর কি করে ওঠাই?
সর্বজয়া খুব আশায় আশায় ছিল, সংবাদ শুনিয়া আশাভঙ্গ হইয়া পড়িল। বলিল, তা ওখানে না হয়, অন্য কোন জায়গায় দ্যাখো না? বিদেশে মান আছে, এখানে কেউ পোছে? এই দ্যাখে আমকাঁঠালের সময়ে একটা আম-কাঁঠাল ঘরে নেই-মেয়েটা কাদের বাড়ি থেকে আজ দুটো আধাপচা আমি নিয়ে এল।—পরে সে উদ্দেশে বাড়ির পশ্চিম দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল-এই ঘরের দোর থেকে ঝুড়ি-ঝুড়ি আমি পেড়ে নিয়ে যায়-বাছারা আমার চেয়ে চেয়ে দ্যাখে,-এ কি কম কষ্ট!
বাগানের কথার উল্লেখে হরিহর বলিল-উঃ, ও কি কম ধড়িবাজ নাকি! বছরে পচিশ টাকা খাজনা ফেলে-বোলে হোত, তাই কিনা লিখে নিলে পাঁচ টাকায়! আমি গিয়ে এত করে বললাম, কাক, আমার ছেলেটা মেয়েটা আছে, ওই বাগানে আম-জোম কুড়িয়ে মানুষ হচ্ছে। আমার তো আর কোথাও কিছু নেই। আর ধরুন, আমাদের জ্ঞাতির বাগান-আপনার তো ঈশ্বর ইচ্ছেয় কোনো অভাব নেই, দুটো অত বড় বাগান রয়েছে, আম জাম নারকেল সুপারি-আপনার অভাব কি? বাগানখানা গিয়ে ছেড়ে দিন গে যান! তা বল্পে কি জানো? বল্পে, নীলমণি দাদা বেঁচে থাকতে ওর কাছে নাকি তিনশো টাকা ধার করেছিল, তাই আমনি করে শোধ করে নিল। শোন কথা। নীলমণি দাদার বড় অভাব ছিল কিনা, তাই তিনশো টাকার জন্যে গিয়েছে ভুবন মুখুজ্যের কাছে হাত পাততে। বৌদিকে ভালোমানুষ পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নিলে আর কি!
–ভালোমানুষ তো কত! সেও নাকি বলেছে, যে জ্ঞাতিশত্তুর-পর-হাতে বাগান থাকলে তো আর কিছু পাওয়া যাবে না, ফল-পাকুড় এমনিই খাবে, তার চেয়ে কিছু কম জমাতেও যদি বন্দোবস্ত হয়, খাজনাটা তো পাওয়া যাবে।
হরিহর বলিল-খাজনা কি আর আমি দিতাম না? বাগান জমা দেবে, তাই কি আমায় জানতে দিলে? বৌদিকে-লুচি-মোহনভোগ খাইয়ে হাত করে চুপি চুপি লিখিয়ে নিলে।…
পর্ব ১২ শেষ 📌
🔴পর্ব :১৩🔴
বৈকালের দিকটা হঠাৎ চারিদিক অন্ধকার করিয়া কালবৈশাখীর ঝড় উঠিল। অনেকক্ষণ হইতে মেঘ মেঘ করিতেছিল, তবুও ঝড়টা যেন খুব শীঘ্ৰ আসিয়া পড়িল। অপুদের বাড়ির সামনে বাঁশঝাড়ের বাঁশগুলো পাচিলের উপর হইতে ঝড়ের বেগে হটিয়া ওধারে পড়াতে বাড়িটা যেন ফাকা ফাকা দেখাইতে লাগিল-ধূলা, বাঁশপাতা, কাঁঠালপাতা, খড় চারিধার হইতে উড়িয়া তাহাদের উঠান ভরাইয়া ফেলিল। দুৰ্গা বাটীর বাহির হইয়া আম কুড়াইবার জন্য দৌড়িল-অপুও দিদিব পিছু পিছু ছুটিল। দুর্গা ছুটিতে ছুটিতে বলিল-শিগগির ছোট্, তুই বরং সিঁদুরকৌটাতলায় থাক, আমি যাই সোনামুখী-তলায়-দৌড়ো-দৌড়ো। ধুলায় চারিদিক ভরিয়া গিয়াছে—বড় বড় গাছের ডাল ঝড়ে বাঁকিয়া গাছ ন্যাড়া-ন্যাড়া দেখাইতেছে। গাছে গাছে সোঁ সোঁ, বোঁ বোঁ শব্দে বাতাস বাধিতেছে–বাগানে শুকনা ডাল, কুটা, বাঁশের খোলা উড়িয়া পড়িতেছে-শুকনা বাঁশপাতা ছুঁচালো আগাটা উঁচুদিকে তুলিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে আকাশে উঠিতেছে—কুক্শিমা গাছের শুঁয়ার মতো পালকওয়ালা সাদা সাদা ফুল ঝড়ের মুখে কোথা হইতে অজস্র উড়িয়া আসিতেছে-বাতাসের শব্দে কান পাতা যায় না।
সোনামুখী-তলায় পৌঁছিয়াই অপু মহা-উৎসাহে চিৎকার করিতে করিতে লাফাইযা এদিক ওদিক ছুটিতে লাগিল-এই যে দিদি, ওই একটা পড়লো রে দিদি-ওই আর একটা রে দিদি! চিৎকার যতটা করিতে লাগিল তাহার অনুপাতে সে আম কুড়াইতে পারিল না। ঝড় ঘোর রবে: বাড়িয়া চলিয়াছে। ঝড়ের শব্দে আম পড়ার শব্দ শুনিতে পাওয়া যায় না, যদিবা শোনা যায় ঠিক কোন জায়গা বরাবর শব্দটা হইল-তোহা ধরিতে পারা যায় না। দুৰ্গা আট-নয়টা আম কুড়াইয়া ফেলিল, অপু এতক্ষণের ছুটাছুটিতে মোটে পাইল দুইটা। তাঁহাই সে খুশির সহিত দেখাইয়া বলিতে লাগিল—এই দাখ দিদি, কত বড় দ্যাখ-ওই একটা পড়লো-ওই ওদিকে—
এমন সময় হই-হাই শব্দে ভুবন মুখুজ্জের বাড়ির ছেলে-মেয়েরা সব আমি কুড়াইতে আসিতেছে শোনা গেল। সতু চেঁচাইয়া বলিল-ও ভাই, দুগগাদি আর অপু আম কুড়ুচ্ছে–
দল আসিয়া সোনামুখী-তলায় পৌঁছিল। সতু বলিল-আমাদের বাগানে কেন এয়েচ আম কুড়ুতে? সেদিন মা বারণ করে দিয়েচে না? দেখি কতগুলো আম কুড়িয়েচো?
পরে দলের দিকে চাহিয়া বলিল-সোনামুখীর কতগুলো আম কুড়িয়েচে দেখেছিস টুনু?– যাও আমাদের বাগান থেকে দুগ্ৰগদি-মাকে গিয়ে নইলে বলে দেবো।
রানু বলিল-কেন তাড়িয়ে দিচ্ছিস সাতু? ওরাও কুড়ুক-আমরাও কুড়ুই।
-কুড়োবে বই কি! ও এখানে থাকলে সব আমি ওই নেবে। আমাদের বাগানে কেন আসবে ও?–না, যাও দুগগাদি-আমাদের তলায় থাকতে দেবো না।
অন্য সময় হইলে দুৰ্গা হয়তো এত সহজে পরাজয় স্বীকার করিত না-কিন্তু সেদিনইহাদেরই কৃত অভিযোগে মায়ের নিকট মারা খাইয়া তাহার পুনরায় বিবাদ বাধাইবার সাহস ছিল না। তাই খুব সহজেই পরাজয় স্বীকার করিয়া লইয়া সে একটু মনমরা ভাবে বলিল-অপু, আয় রে চল। পরে হঠাৎ মুখে কৃত্রিম উল্লাসের ভাব আনিয়া বলিল-আমরা সেই জায়গায় যাই চলা অপু, এখানে থাকতে না দিলে বয়ে গেল-বুঝলি তো?-এখানকার চেয়েও বড় বড় আম-তুই আমি মজা করে কুড়োবো এখন-চলে আয়-এবং এখানে এতক্ষণ ছিল বলিয়া একটা বৃহত্তর লাভ হইতে বঞ্চিত ছিল, চলিয়া যাওয়ায় প্রকৃতপক্ষে শাপে বর হইল, সকলের সম্মুখে এইরূপ ভাব দেখাইয়া যেন অধিকতর উৎসাহের সহিত অপুকে পিছনে লইয়া রাংচিতার বেড়ার ফাক গলিয়া বাগানের বাহির হইয়া গেল।
রানু বলিল-কেন ভাই ওদের তাড়িয়ে দিলে-তুমি ভারি হিংসুক কিন্তু সতুদা!
রানুর মনে দুর্গার চোখের ভরসা-হারা চাহনি বড় ঘা দিল।
অপু অতশত বোঝে নাই, বেড়ার বাহিরের পথে আসিয়া বলিল-কোন জায়গায় বড় বড় আমি রে দিদি? পুঁটুদের সলতেখাগী-তলায়?
কোন তলায় দুর্গা তাহা ঠিক করে নাই, একটু ভাবিয়া বলিল-চল গড়ের পুকুরের ধারের বাগানে যাবি-ওদিকে সব বড় বড় গাছ আছে—চল্—।
গড়ের পুকুর এখান হইতে প্ৰায় পনেরো মিনিট ধরিয়া সুড়িপথে অনবরত বন-বাগান অতিক্ৰম করিয়া। তবে পৌছানো যায়। অনেককালের প্রাচীন আমি ও কঁঠালের গাছ-গাছতলায় বন-চালিতা ময়না-কঁটা ষাঁড়া গাছের দুৰ্ভেদ্য জঙ্গল। দূর বলিয়া এবং জনপ্রাণীর বাস শুন্য গভীর বনের মধ্যে বলিয়া এসব স্থানে কেহ বড় একটা আম কুড়াইতে আসে না। কাছির মতো মোটা মোটা অনেককালের পুরোনো গুলঞ্চ লতা। এ-গাছে ও-গাছে দুলিতেছে-বড় বড় প্রাচীন গাছের তলাকার কঁটাভারা ঘন ঝোপ-জঙ্গল খুঁজিয়া তলায় পড়া আম বাহির করা সহজসাধ্য তো নহেই, তাহার উপর আবার ঘনায়মান নিবিড়-কৃষ্ণ ঝোড়ো মেঘে ও বাগানের মধ্যের জঙ্গলে গাছের আওতায় এরূপ অন্ধকারের সৃষ্টি করিয়াছে যে, কোথায় কি ভালো দেখা যায় না। তবুও খুঁজতে খুঁজিতে নাছোড়বান্দা দুৰ্গা গোটা আট-দশ আম পাইল।
হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল-ওরে অপু-বিষ্টি এল!
সঙ্গে সঙ্গে ঝড়টা যেন খানিকক্ষণ একটু নরম হইল–ভিজে মাটির সোঁদা সেঁন্দা গন্ধ পাওয়া গেল-একটু পরেই মোটা মোটা ফোটায় চড়বড় করিয়া গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়িতে শুরু করিল।
—আয় আমরা এই গাছতলায় দাড়াই-এখানে বিষ্টি পড়বে না—
দেখিতে দেখিতে চারিদিক ধোঁয়াকার করিয়া মুষলধারে বৃষ্টি নামিল-বৃষ্টির ফোঁটা পড়বার জোরে গাছের পাতা ছিঁড়িয়া উড়িয়া পড়িতে লাগিল—ভরপুর টাটকা ভিজা মাটির গন্ধ আসিতে লাগিল। ঝড় একটু যেন নরম পড়িয়াছিল—তাহাও আবার বড় বাড়িল-দুৰ্গা যে গাছতলায় দাঁড়াইয়াছিল, এমনি হয়তো হঠাৎ তথায় বৃষ্টি পড়িত না, কিন্তু পুবে হাওয়ার ঝাপটা গাছতলা ভাসাইয়া লইয়া চলিল। বাড়ি হইতে অনেক দূরে আসিয়া পড়িয়াছে—অপু ভয়ের স্বরে বলিল-ও দিদি—বড্ড যে বিষ্টি এল।
–তুই আমার কাছে আয়-দুর্গা তাহাকে কাছে আনিয়া আঁচল দিয়া ঢাকিয়া কহিল-এ বিষ্টি আর কতক্ষণ হবে-এই ধরে গেল বলে-বৃষ্টি হল ভালেই হল-আমরা আবার সোনামুখী-তলায় যাবো এখন, কেমন তো?
দুজনে চেঁচাইয়া বলিতে লাগিল—
নেবুর পাতায় করম্চা
হে বিষ্টি ধরে যা—
ক্কড়-ক্কড়-কড়াৎ,…প্রকাণ্ড বন-বাগানের অন্ধকার মাথাটা যেন এদিক হইতে ওদিক পর্যন্ত চিরিয়া গেল-চোখের পলকের জন্য চারিধার আলো হইয়া উঠিল—সামনের গাছের মগডালে থোলো থোলো বন-ধুল ফল ঝড়ে দুলিতেছে। অপু দুৰ্গাকে ভয়ে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল-ও দিদি!
–ভয় কি রে! রাম রাম বল-রাম রাম রাম রাম-নেবুর পাতায় করমচা হে বিষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচা হে বিষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচা–
বৃষ্টির ঝাপটায় তাহাদের কাপড় চুল ভিজিয়া টস্টস করিয়া জল ঝরিতে লাগিল—গুমগুমু গুম-ম-ম-চাপা গভীর ধ্বনি-একটা বিশাল লোহার বুল কে যেন আকাশের ধাতব মেঝেতে এদিক হইতে ওদিকে টানিয়া লইয়া বেড়াইতেছে–অপু শঙ্কিত সুরে বলিল-ওই দিদি, আবার–
–ভয় নেই, ভয় কি?–আর একটু সরে আয়-এঃ, তোর মাথাটা ভিজে যে একেবারে জুবড়ি হয়ে গিয়েচে–
চারিধারে শুধু মুষলধারে বৃষ্টিপতনের হুস-স-স-স। একটানা শব্দ, মাঝে মাঝে দমকা ঝড়ের সোঁ-ও-ও-ও, বোঁ-ও-ও-ও-ও রব, ডালপালার ঝাপটের শব্দ-মেঘের ডাকে কানে তালা ধরিয়া যায়। এক-একবার দুর্গার মনে হইতেছিল সমস্ত বাগানখানা ঝড়ে মড়মড় করিয়া ভাঙিয়া উপুড় হইয়া তাহদের চাপা দিল বুঝি।
অপু বলিল-দিদি, বিষ্টি যদি আর না থামে?
হঠাৎ ঝটিকাঙ্কুব্ধ অন্ধকাব আকাশের এপ্রান্ত হইতে লকলকে আলো জিহ্বা মেলিয়া বিদুপোব বিকট অট্টহাস্যের রোল তুলিয়া এক লহমায় ও-প্রান্তের দিকে ছুটিয়া গেল।
ক্কড়—ক্কড়-কড়াৎ!
সঙ্গে সঙ্গে বাগানের মাথায় বৃষ্টির ধোঁয়ার রাশি চিড়িয়া ফাড়িয়া উড়াইয়া, ভৈরবী প্রকৃতিব উন্মত্ততার মাঝখানে ধরা পড়া দুই অসহায় বালক-বালিকার চোখ ঝলসাইয়া তীক্ষ্ণ নীল বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল।
অপু ভয়ে চোখ বুজিল।
দুৰ্গা শুষ্ক গলায় উপরের দিকে চাহিয়া দেখিল,-বাজ পড়িতেছে নাকি?-গাছের মাথায় বনধুধুলের ফল দুলিতেছে।
সেই বড় লোহার বুলটাকে আকাশের ওদিক হইতে কে যেন আবার এদিকে টানিয়া আনিতেছিল–
শীতে অপুর ঠক ঠক করিয়া দাঁতে দাঁত লাগিতেছিল—দুর্গা তাহাকে আরও কাছে টানিয়া আনিয়া শেষ আশ্রয়ের সাহসে বার বার দ্রুত আবৃত্তি করিতে লাগিল-নেবুর পাতায় কবমচা-হে বিষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচা-হে বিষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচাঁ…ভয়ে তাহার স্বর কাঁপিতেছিল।
সন্ধ্যা হইবার বেশি বিলম্ব নাই। ঝড়-বৃষ্টি খানিকক্ষণ থামিয়া গিয়াছে। সর্বজয়া বাহিরের দরজায় দাঁড়াইয়া আছে। পথে জমিয়া যাওয়া বৃষ্টির জলের উপর ছপ-ছপ শব্দ করিতে করিতে রাজকৃষ্ণ পালিতের মেয়ে আশালতা পুকুরের ঘাটে যাইতেছিল। সর্বজয়া জিজ্ঞাসা করিল-হ্যাঁ মা, দুৰ্গা আর অপুকে দেখেছিস ওদিকে?
আশালতা বলিল-না খুড়িমা, দেখিনি তো। কোথায় গিয়েচে? তারপর হাসিয়া বলি-কি ব্যাঙ-ডাকানি জল হয়ে গেল খুড়িমা!
—সেই ঝড়ের আগে দুজনে বেরিয়েচে আম, কুড়োতে যাই বলে আর তো ফেরেনি—এই ঝড়-বিষ্টি গেল, সন্দে হোল, ও মা কোথায় গেল তবে?
সর্বজয়া উদ্বিগ্ন মনে বাড়ির মধ্যে ফিরিয়া আসিল। কি করিবে ভাবিতেছে এমন সময়খিড়কির দরজা ঠেলিয়া খুলিয়া আপাদমস্তক সিক্ত অবস্থায় দুর্গা আগে আগে একটা ঝুনা নারিকেল হাতে ও পিছনে পিছনে অপু একটা নারিকেলের বাগলো টানিয়া লইয়া বাড়ি ঢুকিল। সর্বজয়া তাড়াতাড়ি ছেলে-মেয়ের কাছে গিয়া বলিল-ওমা আমার কি হবে। ভিজে যে সব একেবারে পান্তা ভাত হয়েচিস! কোথায় ছিলি বিষ্টির সময়? ছেলেকে কাছে আনিয়া মাথায় হাত দিয়া বলিল-ওমা, মাথাটা যে ভিজে একেবারে জুবড়ি। পরে আহ্বাদের সহিত বলিল-নারকেল কোথা পেলি রে দুর্গা?
অপু ও দুর্গা দুজনেই চাপা কণ্ঠে বলিল-চুপ চুপ মা-সেজজেঠিমা বাগানে যাচ্ছে—এই গেল-ওদের বাগানের বেড়ার ধারের দিকে যে নারকেল গাছটা, ওর তলায় পড়ে ছিল। আমরাও বেরুচ্চি, সেজজেঠিমাও ঢুকলো।
দুর্গা বলিল-অপুকে তো ঠিক দেখেচে—আমাকেও বোধ হয় দেখেছে। পরে সে উৎসাহের সঙ্গে অথচ চাপা সুরে বলিতে লাগিল—একেবারে গাছের গোড়ায় পড়ে ছিল মা, আগে আমি টের পাইনি, সোনামুখী-তলায় যদি আম পড়ে থাকে তাই দেখতে গিয়ে দেখি বাগলোটা পড়ে রয়েছে। অপুকে বললাম-অপু বাগলোটা নে-মার ঝাঁটার কষ্ট, ঝাঁটা হবে। তারপরই দেখি-হস্তস্থিত নারিকেলটার দিকে উজ্জ্বল মুখে চাহিয়া বলিল-বেশ বড়, না মা?
অপু খুশির সুরে হাত নাড়িয়া বলিল-আমি অমনি বাগলোটা নিয়ে ছুট—
সৰ্ব্বজয়া বলিল—বেশ বড় দোমালা নারকেলটা। ছেচতলায় রেখে দে, জল দিয়ে নেবো–
অপু অনুযোগের সুরে বলিল-তুমি বলে মা নারকোল নেই, নারকোল নেই,–এই তো হল নারকেল! এইবাব কিন্তু বড়া করে দিতে হবে। আমি ছাড়বো না—কখ্খনো—
বৃষ্টির জলে ছেলেমেয়ের মুখ বৃষ্টিধোঁয়া জুই ফুলের মতো সুন্দর দেখাইতেছিল। ঠাণ্ডায় তাহাদের ঠোঁট নীল হইয়া গিয়াছে, মাথার চুল ভিজিয়া কনের সঙ্গে লেপটাইয়া লাগিয়া গিয়াছে। সর্বজয়া বলিল-আয় সব, কাপড় ছাড়িয়ে দিই। আগে, পায়ে জল দিয়ে রোয়াকে ওঠ্ সব–
খানিক পরে সর্বজয়া কুয়ার জল তুলিতে ভুবন মুখুজ্যের বাড়ি গেল। ভুবন মুখুজ্যের খিড়কিদোর পর্যন্ত যাইতেই সে শুনিল সেজ ঠাকরুন বাড়ির মধ্যে চিৎকার করিয়া বাড়ি মাথায় করিতেছেন।
-একটা মুঠো টাকা খরচ করে তবে বাগান নেওয়া-মাগনা তো নয়। তার কোনো কুটোটা যদি হাঘিরেদের জন্যে ঘরে ঢুকবার জো আছে! এ ছুড়িটা রাদিন বাগানে বসে আছে, কুটো গাছটা নিয়ে গিয়ে ঘরে তুলবে-এতে মাগীরও শিক্ষে আছে, ও মাগী কি কম নাকি?-ও মা, ভাবলাম বিষ্টি থেমেচে, যাই একবার বাগানটা গিয়ে দেখে আসি—এই এত বড় নাককোলটা কুড়িয়ে নিয়ে একেবারে দুড়দুড় দৌড়!–এত শতুরতা যেন ভগবান সহি না করেন—উচ্ছন্ন যান, উচ্ছন্ন যানএই ভস সন্দেবোলা বলচি, আব্ব যেন নারকেল খেতে না হয় —একবাব শিগগির যেন ছাতিমতলা–সই হন–
সর্বজয়া খিড়কির বাহিরে কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ছেলেমেয়ের বর্ষণসিক্ত কচিমুখ মনে করিয়া সে ভাবিল যদি গালাগাল ওদের লাগে! বাবা যে লোক! দাঁতে বিষ আছে! কি করি? কথাটা ভাবিতেই তাহার গা শিহরিয়া উঠিয়া সর্বশরীর যেন অবশ হইয়া গেল। সে আর মুখুজ্যেবাড়ি ঢুকিলে না-আশশ্যাওড়া বনে, বাঁশঝাড়ের তলায় বর্ষণস্তব্ধ সন্ধ্যায় জোনাকি জুলিতেছে, পা যেন আর উঠিতে চাহে না-ভয়ে ভয়ে সে জল তুলিবার ছোট্ট বালতিটা ও ঘড়া কাঁখে লইয়া বাড়ির দিকে ফিরিল।
পথে আসিতে আসিতে ভাবিল-যদি নারকেলটা ওদের ফেরত দিই।–তাহলেও কি গাল লাগবে? তা কেন লাগবে- যার জিনিস তাকে তো ফেরত দেওয়া হল, তা কখনও লাগে?
বাড়িতে পা দিয়াই মেয়েকে বলিল-দুগ্গা, নারকেলটা সন্তুদের বাড়ি দিয়ে আয় গিয়ে।
অপু ও দুর্গা অবাক হইয়া মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল—
দুর্গা বলিল-এখখুনি?
-হ্যাঁ-এখখুনি দিয়ে আয়। ওদের খিড়কির দোর খোলা আছে। চট করে যা। বলে আয়, আমরা কুড়িয়ে পেইছিলাম, এই নাও দিয়ে গেলাম।
–অপু আমাকে একটু দাঁড়াবে না, মা? বড় অন্ধকার হয়েচে, চল অপু আমার সঙ্গে।
ছেলেমেয়ে চলিয়া গেলে সর্বজয়া তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে দিতে গলায় আঁচল দিয়া প্ৰণাম করিয়া বলিল-ঠাকুর, নারকেল ওরা শত্তুরতা করে কুড়ুতে যায়নি সে তো তুমি জানো, এ গাল যেন ওদের না লাগে। দোহাই ঠাকুর, ওদের তুমি বাঁচিয়ে-বর্তে রেখো, ঠাকুর। ওদের তুমি মঙ্গল কোরো। তুমি ওদের মুখের দিকে চেয়ো। দোহাই ঠাকুর।
পর্ব ১৩ শেষ 📌
🔴পর্ব :১৪🔴
গ্রামের প্রসন্ন গুরুমহাশয় বাড়িতে একখানা মুন্দির দোকান করিতেন এবং দোকানেরই পাশে তাহার পাঠশালা ছিল। বেত ছাড়া পাঠশালায় শিক্ষাদানের বিশেষ উপকরণ-বাহুল্য ছিল না। তবে এই বেতের উপর অভিভাবকদেরও বিশ্বাস গুরুমহাশয়ের অপেক্ষা কিছু কম নয়। তাই তাহারা গুরুমহাশয়কেও বলিয়া দিয়াছিলেন, ছেলেদের শুধু পা খোঁড়া এবং চোখ কানা না হয়, এইটুকু মাত্র নজর রাখিয়া তিনি যত ইচ্ছা বেত চালাইতে পারেন। গুরুমহাশয়ও তঁহার শিক্ষাদানের উপযুক্ত ক্ষমতা ও উপকরণের অভাব একমাত্র বেতের সাহায্যে পূর্ণ করিবার চেষ্টায়। এরূপ বেপরোয়া ভাবে বেত চালাইয়া থাকেন যে ছাত্ৰগণ পা খোড়া ও চক্ষু কানা হওয়ার দুর্ঘটনা হইতে কোনরূপে প্ৰাণে বঁচিয়া যায় মাত্র।
পৌষ মাসের দিন। অপু সকালে লেপ মুড়ি দিয়া রৌদ্র উঠিবার অপেক্ষায় বিছানায় শূইয়া ছিল, মা আসিয়া ডাকিল-অপু, ওঠু শিগগির করে, আজ তুমি যে পাঠশালায় পড়তে যাবে! কেমন সব বই আনা হবে তোমার জন্যে, শেলেট। হ্যা ওঠে, মুখ ধুয়ে নাও, উনি তোমায় সঙ্গে করে নিয়ে পাঠশালায় দিয়ে আসবেন।
পাঠশালার নাম শুনিয়া অপু সদ্য-নিদ্রোখিত চোখ দুটি তুলিয়া অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার ধারণা ছিল যে যাহারা দুন্টু ছেলে, মার কথা শোনে না, ভাইবোনদের সঙ্গে মারামারি করে, তাহাদেরই শুধু পাঠশালায় পাঠানো হইয়া থাকে। কিন্তু সে তো কোনোদিন ওরাপ করে না, তবে সে কোন পাঠশালায় যাইবে?
খানিক পরে সর্বজয়া পুনরায় আসিয়া বলিল-ওঠে। অপু, মুখ ধুয়ে নাও, তোমায় অনেক করে মুড়ি বেঁধে দেবো এখন, পাঠশালায় বসে বসে খেয়ো এখন, ওঠে লক্ষ্মী মানিক!
মায়ের কথার উত্তরে সে অবিশ্বাসের সুরে বলিল-ইঃ! পরে মায়ের দিকে চাহিয়া জিভ বাহিব করিয়া চোখ বুজিয়া একপ্রকার মুখভঙ্গি করিয়া রহিল, উঠিবার কোনো লক্ষণ দেখাইল না।
কিন্তু অবশেষে বাবা আসিয়া পড়াতে অপুর বেশি জারিজুরি খাটিল না, যাইতে হইল। মা’র প্রতি অভিমানে তাহার চোখে জল আসিতেছিল, খাবার বাঁধিয়া দিবার সময় বলিল-আমি কখখনো আর বাড়ি আসছিনে, দেখো!
—ষাট ষাট, বাড়ি আসবিনে কি! ওকথা বলতে নেই, ছিঃ! পরে তাহার চিবুকে হাত দিয়া চুমু খাইয়া বলিল-খুব বিদ্যে হোক, ভালো করে লেখাপড়া শিখো, তখন দেখবে তুমি কত বড় চাকরি করবে, কত টাকা হবে তোমার, কোনো ভয় নেই।-ওগো, তুমি গুরুমশায়কে বলে দিয়ো যেন ওকে কিছু বলে না।
পাঠশালায় পৌছাইয়া দিয়া হরিহর বলিল-দুটি হবার সময়ে আমি আবার এসে তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাবো, অপু, বসে বসে লেখো, গুরুমশায়ের কথা শুনো, দুষ্টুমি কোরো না যেন! খানিকটা পরে পিছন ফিরিয়া অপু চাহিয়া দেখিল বাবা ক্ৰমে পথের বাঁকে অদৃশ্য হইয়া গেল। অকুল সমুদ্র। সে অনেকক্ষণ মুখ নিচু করিয়া বসিয়া রহিল। পরে ভয়ে ভয়ে মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, গুরুমহাশয় দোকানের মাচায় বসিয়া দাঁড়িতে সৈন্ধব লবণ ওজন করিয়া কাহাকে দিতেছেন, কয়েকটি বড় বড় ছেলে আপনি আপনি চাটাই-এ বসিয়া নানারূপ কুস্বর করিয়া কি পড়িতেছে ও ভয়ানক দুলিতেছে। তাহার অপেক্ষা আর একটু ছোট একটি ছেলে খুঁটিতে ঠেস দিয়া আপন মনে পাততাড়ির তালপাতা মুখে পুরিয়া চিবাইতেছে। আর একটি বড় ছেলে, তাহার গালে একটা আঁচিল, সে দোকানের মাচার নিচে চাহিয়া কি লক্ষ করিতেছে। তাহার সামনে দুজন ছেলে বসিয়া স্নেটে একটা ঘর আঁকিয়া কি করিতেছিল। একজন চুপিচুপি বলিতেছিল, আমি এই ঢ্যারা দিলাম, অন্য ছেলেটি বলিতেছিল, এই আমার গোল্লা, সঙ্গে সঙ্গে তার স্নেটে আঁক পড়িতেছিল ও মাঝে মাঝে আড়াচোখে বিক্ৰয়রত গুরুমহাশয়ের দিকে চাহিয়া দেখিতেছিল। অপু নিজের স্নেটে বড় বড় করিয়া বানান লিখিতে লাগিল। কতক্ষণ পরে ঠিক জানা যায় না, গুরুমহাশয় হঠাৎ বলিলেন—এই ফনে, স্নেটে ওসব কি হচ্ছে রে? সম্মুখের সেই ছেলে দুটি অমনি স্লেটখানা চাপা দিয়া ফেলিল, কিন্তু গুরুমহাশয়ের শ্যেনদৃষ্টি এড়ানো বড় শক্ত, তিনি বলিলেন, এই সতে, ফনের প্লেটটা নিয়ে আয় তো! তঁহার মুখের কথা শেষ হইতে না হইতে বড় আঁচিলওয়ালা ছেলেটি ছোঁ মারিয়া স্লেটখানা উঠাইয়া লইয়া গিয়া দোকানের মাচার উপর হাজির করিল।
-হুঁ, এসব কি খেলা হচ্ছে স্নেটো?-সতে, ধরে নিয়ে আয় তো দুজনকে, কান ধরে নিয়ে আয়!
যেভাবে বড় ছেলেটা ছোঁ মারিয়া স্লেট লইয়া গেল এবং যেভাবে বিপন্ন মুখে সামনের ছেলে দুটি পায়ে পায়ে গুরুমহাশয়ের কাছে যাইতেছিল, তাহাতে হঠাৎ অপুর বড় হাসি পাইল, সে ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল। পরে খানিকটা হাসি চাপিয়া রাখিয়া আবার ফিক ফিক্ করিয়া হাসিয়া উঠিল।
গুরুমহাশয় বলিলেন, হাসে কে? হাসচো কেন খোকা, এটা কি নাট্যশালা? অ্যা? এটা নাট্যশালা নাকি?
নাট্যশালা কি, অপু তাঁহা বুঝিতে পারিল না, কিন্তু ভয়ে তাহার মুখ শুকাইয়া গেল।
–সতে, একখানা থান ইট নিয়ে আয় তো তেঁতুলতলা থেকে বেশ বড় দেখে?
অপু ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া উঠিল, তাহার গলা পর্যন্ত কাঠ হইয়া গেল, কিন্তু ইট আনীত হইলে সে দেখিল, ইটের ব্যবস্থা তাহার জন্য নহে, ওই ছেলে দুটির জন্য। বয়স অল্প বলিয়াই হউক বা নতুন ভর্তি বলিয়াই হউক, গুরুমহাশয় সে-যাত্রা তাহাকে রেহাই দিলেন।
পাঠশালা বসিত বৈকলে। সবসুদ্ধ আট-দশটি ছেলেমেয়ে পড়িতে আসে। সকলেই বাড়ি হইতে ছোট ছোট মাদুর আনিয়া পাতিয়া বসে, অপুর মাদুর নাই, সে বাড়ি হইতে একখানা জীৰ্ণ কর্পেটের আসন আনে। যে ঘরটায় পাঠশালা হয়, তার কোনো দিকে বেড়া বা দেওয়াল কিছু নাই, চারিধারে খোলা, ঘরের মধ্যে সারি দিয়া ছাত্ৰগণ বসে। পাঠশালা-ঘরের চারিপাশে বন, পিছন দিকে গুরুমহাশয়ের পৈতৃক আমলের বাগান। অপরাহ্রের তাজা গরম রৌদ্র বাতাবিলেবু, গাব ও পেয়ারাফুলি আম গাছটার ফাঁক দিয়া পাঠশালার ঘরের বাঁশের খুঁটির পায়ে আসিয়া পড়িয়াছে। নিকটে অন্য কোনদিকে কোনো বাড়ি নাই, শুধু বন ও বাগান, একধারে একটা যাতায়াতের সরু পথ।
আট-দশটি ছেলেমেয়ের মধ্যে সকলেই বেজায় দুলিয়া ও নানারূপ সুর করিয়া পড়া মুখস্থ করে, মাঝে মাঝে গুরুমহাশয়ের গলা শোনা যায়,-“এই ক্যাবলা, ওর শেলেটের দিকে চেয়ে কি দেখচিস? কান ম’লে ছিড়ে দেবো একেবারে! নুটু, তোমার ক’বার নেতি ভিজুতে হবে? ফের যদি
গুরুমহাশয় একটা খুঁটি হেলান দিয়া একখানা তালপাতার চাটাই-এর উপর বসিয়া থাকেন। মাথার তেলে বাঁশের খুঁটির হেলান দেওয়ার অংশটি পাকিয়া গিয়াছে। বিকালবেলা প্রায়ই গ্রামের দীনু পালিত কি রাজু রায় তাহার সহিত গল্প করিতে আসেন। পড়াশুনার চেয়ে এই গল্প শোনা অপুর অনেক বেশি ভালো লাগিতা। রাজু রায় মহাশয় প্রথম যৌবনে ‘বাণিজ্যে লক্ষ্মীর বাস’ স্মরণ করিয়া কিভাবে আষাঢ়ুর হাটে তামাকের দোকান খুলিয়াছিলেন সে গল্প করিতেন। অপু অবাক হইয়া শুনিত। বেশ কেমন নিজের ছোট্ট দোকানের ঝাপটা তুলিয়া বসিয়া বসিয়া দা দিয়া তামাক কাটা, তারপর রাত্রে নদীতে যাওয়া, ছোট্ট হ্যাঁড়িতে মাছের ঝোল ভাত রাধিয়া খাওয়া, হয়তো মাঝে মাঝে তাদের সেই ছেড়া মহাভারতখানা কি বাবার সেই দাশু রায়ের পাঁচালিখানা মাটির প্রদীপের সামনে খুলিয়া বসিয়া বসিয়া পড়া! বাহিরে অন্ধকারে বর্ষারাতে টিপ, টিপ বৃষ্টি পড়িতেছে, কেহ কোথাও নাই, পিছনের ডোবায় ব্যাঙ ডাকিতেছে–কি সুন্দর! বড় হইলে সে তামাকের দোকান করিবে।
এই গল্পগুজব এক এক দিন আবার ভাব ও কল্পনার সর্বোচ্চ স্তরে উঠিত, গ্রামের ও পাড়ার রাজকৃষ্ণ সান্যাল মহাশয় যেদিন আসিতেন। যে কোনো গল্প হউক, যত সামান্যই হউক না কেন, সেটি সাজাইয়া বলিবার ক্ষমতা তাহার ছিল অসাধারণ। সান্যাল মহাশয় দেশভ্ৰমণ-বান্তিকগ্রস্ত ছিলেন। কোথায় দ্বারকা, কোথায় সাবিত্রী পাহাড়, কোথায় চন্দ্রনাথ, তাহা আবার একা দেখিয়া তাহার তৃপ্তি হইত না, প্রতিবারই স্ত্রী-পুত্ৰ লইয়া যাইতেন এবং খরচপত্র করিয়া সর্বস্বাস্ত হইয়া ফিরিতেন। দিব্য আরামে নিজের চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া থেলো হুঁকা টানিতেছেন, মনে হইতেছে সান্যাল মহাশয়ের মতন নিতান্ত ঘরোয়া, সেকেলে, পাড়াগায়ের প্রচুর অবসরপ্রাপ্ত গৃহস্থ বেশি আর বুঝি নাই, পৈতৃক চণ্ডীমণ্ডপে শিকড় গাড়িয়া বসিয়াছেন। হঠাৎ একদিন দেখা গেল সদর দরজায় তালাবন্ধ, বাড়িতে জনপ্রাণীর সাড়া নাই। ব্যাপার কি? সান্যাল মশায় সপরিবারে বিন্ধ্যাচল না চন্দ্ৰনাথ ভ্ৰমণে গিয়াছেন। অনেকদিন আব দেখা নাই, হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা ঠুকণ্ঠক শব্দে লোকে সবিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, দুই গরুর গাড়ি বোঝাই হইয়া সান্যাল মশায় সপরিবারে বিদেশ হইতে প্ৰত্যাগমন করিয়াছেন ও লোকজন ডাকাইয়া হ্যাঁটু-সমান উঁচু জলবিছুটি ও অৰ্জ্জুন গাছের জঙ্গল কাটিতে কাটিতে বাড়ি ঢুকিতেছেন।
একটা মোটা লাঠি হাতে তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া পাঠশালায় আসিয়া উপস্থিত হইতেন— এই যে প্ৰসন্ন, কি রকম আছ, বেশ জাল পেতে বসেচ যে! কটা মাছি পড়লো!
নামতা-মুখস্থ-রত অপুর মুখ অমনি অসীম আহ্বাদে উজ্জ্বল হইয়া উঠিত। সান্যাল মশায় যেখানে তালপাতার চাটাই টানিয়া বসিয়াছেন সেদিকে হাতখানেক জমি উৎসাহে আগাইয়া বসিত। স্লেট বই মুড়িয়া একপাশে রাখিয়া দিত যেন আজ ছুটি হইয়া গিয়াছে, আর পড়াশুনার দরকার নাই, সঙ্গে সঙ্গে তাহার ডাগর ও উৎসুক চোখ দুটি গল্পের প্রত্যেক কথা যেন দুর্ভিক্ষের ক্ষুধার আগ্রহে গিলিত।
কুঠির মাঠের পথে যে জায়গাটাকে এখন নালতকুড়িব জোল বলে, ওইখানে আগে-অনেক কাল আগে-গ্রামের মতই হাজাবার ভাই চন্দর হাজরা কি বনের গাছ কাটিতে গিয়াছিল। বর্ষাকাল-এখানে ওখানে বৃষ্টির জলের তোড়ে মাটি খাসিয়া পড়িয়াছিল, হঠাৎ চন্দর হাজরা দেখিল এক জায়গায় যেন একটা পিতলের হ্যাঁড়ির কানামতো মাটির মধ্য হইতে একটুখানি বাহির হইয়া আছে। তখনই সে খুঁড়িয়া বাহির করিল। বাড়ি আসিয়া দেখে-এক হ্যাঁড়ি সেকেলে আমলের টাকা। তাই পাইয়া চন্দর হাজরা দিনকতক খুব বাবুগিরি করিয়া বেড়াইল—এসব সান্যাল মহাশয়এর নিজের চোখে দেখা।
এক এক দিন রেলভ্রমণের গল্প উঠিত। কোথায় সাবিত্রী পাহাড় আছে, তাহাতে উঠিতে তাঁহার স্ত্রীর কি রকম কষ্ট হইয়াছিল, নাভিগয়ায় পিণ্ড দিতে গিয়া পাণ্ডার সঙ্গে হাতাহাতি হইবার উপক্রম। কোথাকার এক জায়গায় একটা খুব ভালো খাবার পাওয়া যায়, সান্যাল মশায় নাম বলিলেন–প্যাঁড়া। নামটা শুনিয়া অপুর ভারি হাসি পাইয়াছিল-বড় হইলে সে ‘প্যাঁড়া’ কিনিয়া খাইবে।
আর একদিন সান্যাল মশায় একটা কোন জায়গার গল্প করিতেছিলেন। সে জায়গায় নাকি আগে অনেক লোকের বাস ছিল, সন্ধ্যার সময় তেঁতুলের জঙ্গলের মধ্যে দিয়া তাহারা সেখানে যান-সন্ন্যাল মশায় বার বার যে জিনিসটা দেখিতে যান। তাহার নাম বলিতেছিলেন—‘চিকামসজিদ’। কি জিনিস তাহা প্রথমে সে বুঝিতে পারে নাই, পরে কথাবার্তার ভাবে বুঝিয়েছিলেন একটা ভাঙা পুরোনো বাড়ি। অন্ধকারপ্রায় হইয়া আসিয়াছিল- তাঁহারা ঢুকিতেই এক ঝাঁক চামচিকা সাঁ করিয়া উড়িয়া বাহির হইয়া গেল। অপু বেশ কল্পনা করিতে পারে-চারিধারে অন্ধকার তেঁতুল জঙ্গল, কেউ কোথাও নাই, ভাঙা পুরোনো দরজা, যেমন সে ঢুকিল অমনি সাঁ করিয়া চামচিকার দল পলাইয়া গেল।–রানুদের পশ্চিমদিকের চোরাকুঠুরির মতো অন্ধকার ঘরটা।
কোন দেশে সান্যাল মহাশয় একজন ফকিরকে দেখিয়াছিলেন, সে এক অশথতলায় থাকিত। এক ছিলিম গাজা পাইলে সে খুশি হইয়া বলিত-আচ্ছা কোন ফল তোমরা খাইতে চাও বল। পরে ঈঙ্গিত ফলের নাম করিলে সে সম্মুখের যে কোনো একটা গাছ দেখাইয়া বলিত—যাও, ওখানে গিয়া লইয়া আইস। লোকে গিয়া দেখিত হয়তো আমগাছে বেদানা ফলিয়া আছে কিংবা পেয়ারা গাছে কলার কাঁদি ঝুলিয়া আছে।
রাজু রায় বলিতেন-ও সব মস্তর-তস্তরের খেলা আর কি! সেবার আমার এক মামা—
দীনু পালিত কথা চাপা দিয়া বলিতেন-মন্তরের কথা যখন ওঠালে, তখন একটা গল্প বলি শোনো। গল্প নয়, আমার স্বচক্ষে দেখা। বেলেডাঙার বুধো গাড়োয়ানকে তোমরা দেখোচা কেউ? রাজু না দেখে থাকো, রাজকৃষ্ট ভায়া তো খুব দেখেচোঁ। কাঠের দড়ি-বাধা এক ধরনেব খড়ম পায়ে দিয়ে বুড়ো বরাবর নিতে-কামারের দোকানে লাঙলের ফাল পোড়াতে আসতো। একশ’ বছর বয়সে মারা যায়, মারাও গিয়েছে আজ পচিশ বছরের ওপর। জোয়ান বয়সে আমরা তার সঙ্গে হাতের কজির জোরে পেরে উঠাতাম না। একবার- অনেক কালের কথা-আমার তখন সবে হয়েচে উনিশ কুড়ি বয়েস, চাকদা থেকে গঙ্গাচন করে গরুর গাড়ি করে ফিরছি। বুধো গাড়োয়ানের গাড়িগাড়িতে আমি, আমার খুড়িমা, আর অনন্ত মুখজ্যের ভাইপো রাম, যে আজকাল উঠে গিয়ে খুলনায় বাস করছে। কানসোনার মাঠের কাছে প্রায় বেলা গেল। তখন ওসব দিকে কি রকম ভয়ভীতু ছিল, তা রাজকৃষ্ট ভায়া জানো নিশ্চয়। একে মাঠের রাস্তা, সঙ্গে মেয়েমানুষের দল, কিছু টাকাকড়িও আছে— বড্ড ভাবনা হল! আজিকাল যেখানে নতুন গা-খানা বসেচে-ওই বরাবাব এসে হল কি জানো? জন-চারেক ফাণ্ডামাক্কোগোছেৰ মিশকালো লোক এসে গাড়ির পেছন দিকের বাঁশ দুদিক থেকে ধল্পে। এদিকে দুজন, ওদিকে দুজন। দেখে তো মশাই আমার মুখে আর র-টা নেই, কোনো রকমে গাড়ির মধ্যে বসে আছি, এদিকে তারাও গাড়ির বাঁশ ধরে সঙ্গেই আসচে, সঙ্গেই আসচে, সঙ্গেই আসচে। বুধো গাড়োয়ান দেখি পিটু পিটু করে পেছন দিকে চাইচে। ইশারা করে আমাদের কথা বলতে বারণ করে দিলে। বেশ আছে! এদিকে গাড়ি একেবারে নবাবগঞ্জ থানার কাছাকাছি এসে পড়ল। বাজার দেখা যাচ্চে, তখন সেই লোক কজন বল্লে-ওস্তাদজী, আমাদের ঘাট হয়েছে, আমরা বুঝতে পারিনি, ছেড়ে দাও। বুধো গাড়োয়ান বল্লে-সে হবে না ব্যাটারা। আজি সব থানায় নিয়ে গিয়ে বাঁধিয়ে দোব। অনেক কাকুতি-মিনতির পর বুধো বল্লে—আচ্ছা যা, ছেড়ে দিলাম। এবার, কিন্তু কক্ষনো এরকম আর করিাসনি! তবে তারা বুধে গাড়োয়ানের পায়ের ধুলো নিয়ে চলে গেল। আমার স্বচক্ষে দেখা। মস্তরের চোটে ওই যে ওরা বাঁশ এসে ধরেছে, আমনি ধরেই রয়েচে-আর ছাড়াবার সাধ্যি নেই-চলেছে গাড়ির সঙ্গে! একেবারে পেরোক-আঁটা হয়ে গিয়েচে। তা বুঝলে বাপু? মন্ত-তন্তরের কথা–
গল্প বলিতে বলিতে বেলা যাইত। পাঠশালার চারিপাশের বনজঙ্গলে অপরাহ্রের রাঙা রৌদ্র বঁকা ভাবে আসিয়া পড়িত। কাঁঠাল গাছের জগড়ুমুর গাছের ডালে ঝোলা গুলঞ্চ লতার গায়ে টুনটুনি পাখি মুখ উঁচু করিয়া বসিয়া দোল খাইত। পাঠশালা-ঘরে বনের গন্ধের সঙ্গে লতাপাতার চাটাই ছেড়াখোড়া বই-দপ্তর, পাঠশালার মাটির মেজে ও কড়া দা-কটা তামাকের ধোঁয়া, সবসুদ্ধ মিলিয়া এক জটিল গন্ধের সৃষ্টি করিত।
সে গ্রামের ছায়া-ভরা মাটির পথে একটি মুগ্ধ গ্রাম্য বালকের ছবি আছে। বইদপ্তর বগলে লইয়া সে তাহার দিদির পিছন পিছন সাজিমাটি দিয়া কাচা, সেলাই করা কাপড় পরিয়া পাঠশালা হইতে ফিরিতেছে, তাহার ছোট্ট মাথাটির অমন রেশমের মতো নরম চিকণ সুখ-স্পর্শ চুলগুলি তাহার মা যত্ন করিয়া আঁচড়াইয়া দিয়াছে।–তাহার ডাগরা ডাগর সুন্দর চোখ দুটিতে কেমন যেন অবাক ধরনের চাহনি-যেন তাহারা এ কোন অদ্ভুত জগতে নতুন চোখ মেলিয়া চাহিয়া চাহিয়া দিশাহারা হইয়া উঠিয়াছে। গাছপালায় ঘেরা এইটুকুই কেবল তার পরিচিত দেশ-এখানেই মা রোজ হাতে করিয়া খাওয়ায়, চুল আঁচড়াইয়া দেয়, দিদি কাপড় পরাইয়া দেয়, এই গণ্ডিটুকু ছাড়াইলেই তাহার চারিধারে ঘিরিয়া অপরিচয়ের অকুল জলধি! তাহার শিশুমন থই পায় না।
ওই যে বাগানের ওদিকে বাঁশবন-ওর পাশ কাটিয়া যে সরু পথটা ওধারে কোথায় চলিয়া গেল-তুমি বরাবর সোজা যদি ও-পথটা বাহিয়া চলিয়া যাও তবে শাঁখারিপুকুরের পাড়ের মধ্যে অজানা গুপ্তধনের দেশে পড়িবে-বড় গাছের তলায় সেখানে বৃষ্টির জলে মাটি খসিয়া পড়িয়াছে।– কত মোহরভরা হ্যাঁড়ি-কলসির কানা বাহির হইয়া আছে, অন্ধকার বনঝোপের নিচে, কচু ওলা ও বনকলমির চকচকে সবুজ পাতার আড়ালে চাপা-কেউ জানে না কোথায়।
একদিন পাঠশালায় এমন একটি ঘটনা হইয়াছিল, যাহা তাহার জীবনের একটি নতুন অভিজ্ঞতা।
সেদিন বৈকালে পাঠশালায় অন্য কেহ উপস্থিত না থাকায় কোন গল্পগুজব হইল না, পড়াশুনা হইতেছিল-সে গিয়া বসিয়া পড়িতেছিল শিশুবোধক-এমন সময় গুরু-মহাশয় বলিলেন-দেখি, শেলেট নেও, শ্রুতিলেখন লেখো–
মুখে মুখে বলিয়া গেলেও অপু বুঝিয়াছিল গুরুমহাশয় নিজের কথা বলিতেছেন না, মুখস্থ বলিতেছেন, সে যেমন দাশূরায়ের পাঁচালী ছড়া মুখস্থ বলে তেমনি।
শুনিতে শুনিতে তাহার মনে হইল অনেকগুলো অমন সুন্দর কথা একসঙ্গে পর পর সে কখনও শোনে নাই। ও-সকল কথার অর্থ সে বুঝিতেছিল না, কিন্তু অজানা শব্দ ও ললিত পদের ধ্বনি, ঝংকার-জড়ানো এক অপরিচিত শব্দসংগীত, অনভ্যস্ত শিশুকৰ্ণে অপূর্ব ঠেকিল এবং সব কথার অর্থ না বোঝার দরুনই কুহেলি-ঘেরা অস্পষ্ট শব্দ-সমষ্টির পিছন হইতে একটা অপূর্ব দেশেব ছবি বারবার উঁকি মারিতেছিল।
বড় হইয়া স্কুলে পড়িবার সময় সে বাহির করিয়াছিল ছেলেবেলাকার এই মুখস্থ শ্রুতিলিখন কোথায় আছে–
এই সেই জনস্থান-মধ্যবতী প্রস্রবণ-গিরি। ইহার শিখরদেশে আকাশপথে সতত-সামীরসঞ্চরমাণ-জলধর-পাটল সংযোগে নিরস্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কত-আধিত্যকাপ্রদেশ ঘন সন্নিবিষ্ট বন-পাদপসমূহে সমাচ্ছন্ন থাকতে স্নিগ্ধ শীতল ও রমণীয়…পাদদেশে প্রসন্ন-সলিলা গোদাবরী তবঙ্গ বিস্তার করিয়া…।
সে ঠিক বলিতে পারে না, বুঝাইতে পারে না, কিন্তু সে জানে।–তাহার মনে হয়, অনেক সময়েই মনে হয়-সেই যে বছর দুই আগে কুঠির মাঠে সরস্বতী পূজার দিন নীলকণ্ঠ পাখি দেখিতে গিয়াছিল, সেদিন মাঠের ধার বাহিয়া একটা পথকে দূরে কোথায় যাইতে দেখিয়াছিল সে। পথটার দু’ধারে যে কত কি অচেনা পাখি, অচেনা গাছপালা, অচেনা বনঝোপ,-অনেকক্ষণ সেদিন সে পথটার দিকে একদৃষ্টি চাহিয়া ছিল। মাঠের ওদিকে পথটা কোথায় যে চলিয়া গিয়াছে তা ভাবিয়া সে কুল পায় নাই।
তাহার বাবা বলিয়াছিল-ও সোনাডাঙা মাঠের রাস্তা, মাধবপুর দশঘরা হয়ে সেই ধলািচতের খেয়াঘাটে গিয়ে মিশেচে।
ধলচিতের খেয়াঘাটে নয়, সে জানিত, ও পথটা আরও অনেক দূরে গিয়াছে। রামায়ণমহাভারতের দেশে।
সেই অশথ গাছের সকলের চেয়ে উঁচু। ডালটার দিকে চাহিয়া থাকিলে যাহার কথা মনে উঠে-সেই বহুদূরের দেশটা। с
শ্রুতিলিখন শুনিতে শুনিতে সেই দুই-বছর-আগে-দেখা পথটার কথাই তাহার মনে হইয়া গেল।
ওই পথের ওধারে অনেক দূরে কোথায় সেই জনস্থান-মধ্যবতী প্রস্রবণ-পর্বত! বনঝোপের স্নিগ্ধ গন্ধে, না-জানার ছায়া নামিয়া আসা ঝিকিমিকি সন্ধ্যায়, সেই স্বপ্নলোকের ছবি তাহাকে অবাক করিয়া দিল। কতদূরে সে প্রস্রবণ-গিরির উন্নত শিখর, আকাশপথে সতত-সঞ্চরমাণ মেঘমালায় যাহার প্রশান্ত, নীল সৌন্দর্য সর্বদা আবৃত থাকে?
সে বড় হইলে যাইয়া দেখিবে।
কিন্তু সে বেতসীকণ্টকিত তাঁট, বিচিত্রপুলিনা গোদাবরী, সে শ্যামল জনস্থান, নীল মেঘমালায় ঘেরা সে অপূর্ব শৈলপ্রস্থ, রামায়ণে বর্ণিত কোনো দেশে ছিল না। বাশ্মীকি বা ভবভূতিও তাঁহাদের সৃষ্টিকর্তা নহেন। কেবল অতীত দিনের কোনো পাখিডাকা গ্ৰাম্য সন্ধ্যায় এক মুগ্ধমতি গ্ৰাম্য বালকের অপরিণত শিশু-কল্পনার দেশে তাহারা ছিল বাস্তব, একেবারে খাঁটি, অতি সুপরিচিত। পৃথিবীপৃষ্ঠে যাহাদের ভৌগোলিক অস্তিত্ব কোনোকালে সম্ভব ছিল না, শুধু এক অনভিজ্ঞ শৈশবমনেই সে কল্পজগতের প্রস্রবণ-পর্বত তাহার সতত-সঞ্চারমাণ মেঘজালে ঢাকা নীল শিখরমালার স্বপ্ন লইয়া অক্ষয় আসন পাতিয়া বসিল।
পর্ব ১৪ শেষ 📌
🔴চলবে।