পথের পাঁচালী পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
10

🔴পথের পাঁচালী (পর্ব :২৮, ২৯, ৩০)🔴
– বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

🔴পর্ব ২৮🔴

আসলে অপু কিন্তু ঘুমায় নাই, সে জাগিয়া ছিল। চোখ বুজিয়া শুইয়া রাত্রে মায়ের সঙ্গে বাবার যেসব কথাবার্তা হইতেছিল, সে সব শুনিয়াছে। তাহারা এদেশের বাস উঠাইয়া কাশী যাইতেছে। এদেশ অপেক্ষা কাশীতে থাকিবার নানা সুবিধার কথা বাবা গল্প করিতেছিল মায়ের কাছে। বাবা অল্প বয়সে সেখানে অনেকদিন ছিল, সে দেশের সকলের সঙ্গে বাবার আলাপ ও বন্ধুত্ব, সকলে চেনে বা মানে। জিনিসপত্রও সস্তা। তাহার মা খুব আগ্রহ প্রকাশ করিল, সে সব সোনার দেশে কখনও কাহারও অভাব নাই–দুঃখ এ-দেশে বারোমাস লাগিয়াই আছে, সাহস করিয়া সেখানে যাইতে পারিলেই সব দুঃখ ঘুচিবে। মা আজ যাইতে পাইলে আজই যায়, একদিনও আর থাকিবার ইচ্ছা নাই। শেষে স্থির হইল বৈশাখ মাসের দিকে তাহদের যাওয়া হইবে।…

গঙ্গানন্দপুরের সিদ্ধেশ্বরী ঠাকুর-বাড়িতে সর্বজয়ার পূজা মানত ছিল। কোশ তিনেক দূরে কে পূজা দিতে যায়—এইজন্য এ-পর্যন্ত মানত শোধ হয় নাই। এবার এদেশ হইতে যাইবার পূর্বে পূজা দিয়া যাওয়া দরকার, কিন্তু খুঁজিয়া লোক মিলিল না। অপু বলিল-সে পূজা দিয়া আসিবে ও ওই গ্রামে তাহার পিসিমা থাকেন, তাহার সহিত কখনও দেখাশোনা হয় নাই, আমনি দেখা করিয়া আসিবে। তাহার মা বলিল-যাঃ, বকিস নে তুই, একলা যাবি বই কি? এখান থেকে প্রায় চার-ক্লোশ পথ।

অপু মায়ের সঙ্গে তর্ক শুরু করিল-আমি বুঝি সবদিন এইরকম বাড়িতে বসে থাকবো? যেতে পাববো না কোথাও বুঝি? আমার বুঝি চোখ নেই, কান নেই, পা নেই?

–সব আছে, উনি একলা যাবেন সেই গঙ্গানন্দপুর-বড় সাহসী পুরুষ কিনা!

অবশেষে কিন্তু অপুর নির্বন্ধতিশয্যে তাহাকেই পাঠাইতে হইল।

সোনাডাঙা মাঠের বুক চিরিয়া উঁচু মাটির পথ। পথের দু’ধারে মাঠের মধ্যে শুধুই আকন্দযুলের বন, দীর্ঘ শ্বেতাভ ডাটাগুলি ফুলের ভারে নত হইয়া দূৰ্বাঘাসের উপর লুটাইয়া পড়িয়াছে। পথে কোনো লোক নাই, দুপুরের অল্পই দেরি আছে, গাছপালার ছায়া ছোট হইয়া আসিতেছে। অপুর খালি পায়ে বেলেমাটির তাত লাগিতেছিল-তোহাতে বেশ আরাম হয়। পথের ধারের বন-ঝোপে কত কি ফুল ফুটিয়াছে, সাইবাবলা গাছের নতুন ফোটা ফুলের শিষ সূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া আছে, ছোট এক রকমের গাছে রাঙা রাঙা বনভুমুরের মতো কি ফল অজস্র পাকিয়া টুকটুক করিতেছে, মাটির মধ্য হইতে কেমন রোদপোড়া সোদা সোদা গন্ধ বাহির হইতেছে..সে মাঝে মাঝে নিচু হইয়া ঝোপের ভিতর হইতে খুঁজিয়া খুঁজিয়া বৈঁচিফল তুলিয়া হাতে-সেলাই-করা রাঙা সাটিনের জামাটার দু’পকেট ভর্তি করিয়া লইতেছিল।

যাইতে যাইতে তাহার মন পুলকে ভরিয়া উঠিতেছিল। সে কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে পারে না যে, সে কী ভালোবাসে এই মাটির তাজা রোদপোড়া গন্ধটা, এই ছায়াভিরা দূৰ্বাঘাস, সূর্যের আলোমাখানো মাঠ, পথ, গাছপালা, পাখি, বনঝোপ, ওই দোলানো ফুলফুলের থোলো, আলকুশি, বনকালমি, নীল অপরাজিতা। ঘরে থাকিতে তাহার মোটেই ইচ্ছা হয় না; ভারি মজা হয় যদি বাবা তাহাকে বলে-খোকা, তুমি শুধু পথে পথে বেড়িয়ে বেড়াও, তাহা হইলে এইরকম বনফুল-ঝুলানো ছায়াচ্ছন্ন ঝোপের তলা দিয়া ঘুঘু-ডাকা দূর বনের দিকে চোখ বাখিয়া এই রকম মাটির পথটি বাহিয়া শুধুই হ্যাঁটে—শুধুই হ্যাঁটে।…মাঝে মাঝে হয়তো বাঁশবনের কঞ্চির ডালে ডালে শরশিরা শব্দ, বৈকালের রোদে সোনার সিঁদুর ছড়ানো আর নানা রঙ-বেরঙ-এর পাখির গান।

অপুর শৈশব কাটিতেছিল এই প্রকৃতির সহিত ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে। এক ঋতু কাটিয়া গিয়া কখন অন্য ঋতু পড়ে-গাছপালায়, আকাশে বাতাসে, পাখির কাকলীতে তাহার বার্তা রাটে। ঋতুতে ঋতুতে ইছামতীর নব নব পরিবর্তনশীল রূপ সম্বন্ধে তাহার চেতনা জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছিল–কোন ঋতু গাছপালায় জলে-স্থলে-শূন্যে ফুলে ফলে কি পরিবর্তন ঘটায় তাহা সে ভালো করিয়া চিনিয়া ফেলিয়াছিল। ইহাদের সহিত এই ঘনিষ্ঠ যোগ সে ভালোবাসে, ইহাদের ছাড়া সে জীবন কল্পনা করিতে পারে না। এই বিরাট অপরূপ ছবি চোখের উপরে রাখিয়া সে মানুষ হইতেছিল। গ্ৰীষ্মের খরতাপ ও গুমোটের অবসানে সারা দিকচক্ৰবাল জুড়িয়া ঘননীল মেঘসজ্জার গভীর সুন্দর রূপ, অস্তবেলায় সোনাডাঙার মাঠের উপরকার আকাশে। কত বর্ণের মেঘের খেলা, ভদ্রের শেষে ফুটন্ত কাশ-ফুলেভরা মাধবপুরের দূরপ্রসারিত চর, চাঁদিনী রাতে জ্যোৎস্নাজালের খুপরি-কাটা বাঁশবনেব তলা,–অপুর স্মৃটিনোমুখ কৈশোরের সতেজ আগ্রহভরা অনাবিল মনে ইহাদের অপূর্ব বিশাল সৌন্দর্য চিরস্থায়ী ছাপ মারিয়া দিয়াছিল, কাস্তিরসের চোখ খুলিয়া দিয়াছিল, চুপি চুপি তাহার কানে অমৃতের দীক্ষামন্ত্র শুনাইয়াছিল।–অপু কখনও জীবনে এ শিক্ষা বিস্মৃত হয় নাই। চিবজীবন সৌন্দর্যের পূজারি হইবার ব্ৰত, নিজের অলক্ষিতে মুক্তরূপা প্রকৃতি তাহাকে তাহা ধীরে ধীবে গ্রহণ করাইতেছিলেন।…

নতিডাঙার বঁওড়ে কাহারা মাছ ধরিয়াছে। সে খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া দেখিল। গ্রামেব মধ্যে একটা কানা ভিখারি একতারা বাজাইয়া গান গাহিয়া ভিক্ষা করিতেছে-ও গান তো অপু জানে– কতবার গাহিয়াছে–

দিন-দুপুরে চাঁদের উদয় রাত পোহানো হোল ভার।…

বোষ্টম দাদু গানটা খুব ভালো গায়।

হরিশপুরের মধ্যে ঢুকিয়া পথের ধারে একটা ছোট্ট চালাঘরে পাঠশালা বসিয়াছে, ছেলেরা সুর করিয়া নামতা পড়িতেছে, সে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিল। গুরুমশায়ের বয়স বেশি নয়, তাহদের গাঁয়েব প্রসন্ন গুরুমশায়ের চেয়ে অনেক কম।

আর এক কথা তাহার বার বার মনে হইতেছিল। এই তো সে বড় হইয়াছে, আর ছোট নাই, ছোট থাকিলে কি আর মা একা কোথাও ছাড়িয়া দিত?…এখন কেবলই চলা, কেবলই সামনে আগাঁইয়া যাওয়া। তাহা ছাড়া, আসচে। মাসের এই দিনটিতে তাহারা কতদূর, কোথায় চলিয়া যাইবে! কোথায় সেই কাশী-সেখানে!

বৈকালের দিকে গঙ্গানন্দপুরে গিয়া পৌঁছিল। পাড়ার মধ্যে পৌঁছিতেই কোথা হইতে রাজ্যের লজ্জা তাহাকে এমন পাইয়া বসিল যে, সে কোনো দিকে চাহিতেই পারিল না। কায়ক্লেশে সম্মুখের পথে দৃষ্টি রাখিয়া কোনোরকমে পথ চলিতে লাগিল। তাহার মনে হইল সকলেই তাহার দিকে চাহিতেছে। সে যে আজ আসিবে তাহা যেন সকলেই জানো; হয়তো ইহারা এতক্ষণ মনে মনে বলিতেছে-এই সেই যাচ্ছে, দ্যাখা দ্যাখ্য’ চেয়ে।…সে যে পুঁটুলির ভিতর বাঁধিয়া নারিকেল-নাড় লইয়া যাইতেছে, তাহাও যেন সকলেই জানে। তাহার পিসেমশায় কুঞ্জ চক্ৰবতীর বাড়িটা কোনদিকে এ কথাটা পর্যন্ত সে কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না।

অবশেষে এক বুড়িকে নির্জনে পাইয়া তাহাকেই জিজ্ঞাসা করাতে সে বাড়ি দেখাইয়া দিল। বাড়িটার সামনে পাঁচিল-ঘেরা। উঠানে ঢুকিয়া সে কাহারও সাক্ষাৎ পাইল না। দু’একবার কাশিল, মুখ দিয়া কথা বাহির হয়। সাধ্য কি? কতক্ষণ সে চৈত্রমাসের খররেীদ্রে বাহিরের উঠানে দাঁড়াইয়া থাকিত ঠিকানা নাই, কিন্তু খানিকটা পরে একজন আঠারো-উনিশ বছরের শ্যামবর্ণ মেয়ে কি কাজে বাহিরে আসিয়া রোয়াকে পা দিতেই দেখিল-দরজার কাছে কাহাদের একটি অপরিচিত প্রিয়দর্শন বালক পুঁটুলি-হাতে লজ্জাকুষ্ঠিত ভাবে দাঁড়াইয়া আছে। মেয়েটি বিস্মিতভাবে বলিল–

তুমি কে খোকা? কোথেকে আসচো?…

অপু আনাড়ির মতো আগাইয়া আসিয়া অতিকষ্টে উচ্চারণ করিল–এই আমার বাড়ি–নিশ্চিন্দিপুরে, আমার-নাম অ-অপু।

তাহার মনে হইতেছিল, না আসিলেই ভালো হইত। হয়তো তাহার পিসিমা তাহার এরূপ অপ্রত্যাশিত আগমনে বিরক্ত হইবে, হয়তো ভাবিবে কোথা হইতে আবার এক আপদ আসিয়া জুটিল।…তাহা ছাড়া,-কে জানিত আগে যে অপরিচিত স্থানে আসিয়া কথাবার্তা কওয়া এত কঠিন কাজ? তাহার কপাল ঘামিয়া উঠিল।

কিন্তু মেয়েটি তখনই ছুটিয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া মহা-আদরে রোয়াকে উঠাইয়া লইয়া গেল। তাহার মা-বাবা কেমন আছেন সেকথা জিজ্ঞাসা করিল। তাহার চিবুকে হাত দিয়া কত আদরের কথা বলিল। দিদিকে যদিও কখনও দেখে নাই। তবুও দিদির নাম করিয়া খুব দুঃখ করিল। নিজের হাতে তাহার গায়ের জামা খুলিয়া হাতমুখ ধোয়াইয়া শুকনা গামছা দিয়া মুছইয়া তাড়াতাড়ি এক গ্লাস চিনির শরবৎ করিয়া আনিল। পিসি বলিতে সে যাহা ভাবিয়ছিল তাহা নয়, অল্প বয়স, রাজীর দিদির চেয়ে একটু বড়।

তাহার পিসিও তাহার দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছিল। জ্ঞাতি-সম্পর্কের ভাইপোটি যে দেখিতে এত সুন্দর বা তাহার বয়স এত কম তাহার পিসি বোধ হয় ইতিপূর্বে জানিত না। তাই পাশের বাড়ি হইতে একজন প্রতিবেশিনী আসিয়া অপুর পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে সে একটু গর্বের সহিত বলিল-আমার ভাইপো, নিশ্চিন্দিপুরে বাড়ি, খুড়তুতো ভায়ের ছেলে; সম্পর্কে খুবই আপন, তবে আসা-যাওয়া নেই। তাই!… পরে সে পুনরায় গর্বের চোখে অপুর দিকে চাহিয়া রহিল। ভাবটা এই–দ্যাখো আমার ভাইপোর কেমন রাজপুত্ত্বরের মতো চেহারা, এখন বোঝে কী দরের-কী বংশের মেয়ে আমি!…

সন্ধ্যার পর কুঞ্জ চক্ৰবতী বাড়ি আসিল। পাকশিটে-মারা চোয়াড়ে-চোয়াড়ে চেহারা, বয়স বুঝিবার উপায় নাই। তাহার পিসিকে দেখিয়া তাহার যেমন লজ্জা হইয়াছিল, পিসেমশায়কে তেমনি তাহার ভয় হইল। ছেলেবেলায় সে যে প্ৰসন্ন গুরুমশায়ের কাছে পড়িত, তেমনি যেন চেহারাটা। মনে হইল এ লোক যেন এখনই বলিতে পারে-বড্ড জ্যাঠা ছেলে দেখচি তো তুমি?…

পরদিন সকালে উঠিয়া অপু পাড়ার পথে এদিকে-ওদিকে একটু ঘুরিয়া আসিল। চারিদিক জঙ্গলে ভরা, ফাঁকা জমি-দূৰ্বাঘাস প্রায় নাই, এমন জঙ্গল। এই একটা বাড়ি, আবার বনে-ঘেরা সুড়িপথ বাহিয়া গিয়া আবার দূরে একটা বাড়ি। অনেক সময় লোকের বাড়ির উঠানের উপর দিয়া পথ। তাহার বয়সি দু’চারজনকে খেলা করিতে দেখিল বটে, কিন্তু সকলেই তাহার দিকে এমন হ্যাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল যে, তাহাদের সঙ্গে আলাপ করিবার চেষ্টা করা তো দূরের কথা, সে তাহাদের মুখের দিকে চাহিতে পারিল না।

পিসির বাড়ির দিকে ফিরিবার সময়ও বিপদ। এরূপ সকালে মার কাছে সে চিড়া, মুড়ি, নাড়ু বা বাসি-ভাত খাইয়া থাকে। এখানে কি উহারা দিবে? কাল তো রাত্ৰে ভাত খাইবার সময় দুধের সঙ্গে সন্দেশ কিনিয়া আনিয়া দিয়াছে। আজ যদি সে এখনই ফিরে, তবে হয়তো উহারা ভাবিবে ছেলেটা ভারি পেটুক; খাবার খাইবার লোভে-লোভে এত সকালে বাড়ি ফিরিল। রোজ রোজ খাবার খাওয়া কি ভালো?…এখন সে কি করে? নাঃ, বাড়ি ফিরিবে না। আরও খানিক পথে পথে ফিরিয়া একেবারে সেই ভাত খাওয়ার সময়ের একটু আগে বাড়ি যাইবে। অপরিচিত জায়গায় এতক্ষণ পথেই বা কোথায় দাঁড়াইয়া থাকে?

পায়ে পায়ে সে অবশেষে বাড়িতেই আসিয়া পৌঁছিল।

একটি ছয়-সাত বছরের মেয়ে একটা কাঁসার বাটি হাতে বাড়ি ঢুকিয়া উঠান হইতে ডাকিয়া কহিল-নাউ রেঁধেচো জেঠিমা, মোরে একটু দেবে?…

অপুর পিসিমা ঘরের ভিতর হইতে বলিল-কে রে, গুলকী? না, ওবেলা রাধবো, এসে নিয়ে যাস…

গুলকী বাটি নামাইয়া রোয়াকের ধারে দাঁড়াইয়া রহিল। মাথার চুলগুলা কাঁকড়া ঝাকড়া, ছেলেদের চুলের মতো খাটো। ময়লা কাপড় পরনে, মাথায় তেল নাই, রং শ্যামবর্ণ। অপুর দিকে চাহিয়া, কি বুঝিয়া একবার ফিক করিয়া হাসিয়া সে বাটি উঠাইয়া চলিয়া গেল।

অপু জিজ্ঞাসা করিল-মেয়েটা কাদের পিসিমা?

তাহার পিসি বলিল-কে, গুলকী? ওদের বাড়ি এখানে না-ওর মা-বাপ কেউ কোথাও নেই। নিবারণ মুখুজ্যের বৌ-এই যে পাশের বাড়ি, ওর দূর-সম্পর্কের জেঠি-সেখানেই থাকে।

পরদিন পাড়ার একটা ছেলে আসিয়া যাচিয়া তাহার সঙ্গে ভাব করিল ও সঙ্গে করিয়া গ্রামের সকল পাড়া ঘুরাইয়া দেখাইয়া বেড়াইল। বাড়ি ফিরিবার পথে দেখিল-সেই অনাথা মেয়ে গুলকী পথের ধারে পা ছড়াইয়া একলাটি বসিয়া কী খাইতেছে। তাহাকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি আঁচল গুটািইতে গেল-আঁচলে একরাশ আধাপাকা বকুল ফল। অপু। ইতিমধ্যে পিসিমার কাছে তাহার আরও পরিচয় লইয়াছে; নিবারণ মুখুজ্যের বৌ ভালো ব্যবহার করে না, লোক ভালো নয়। পিসিমা বলিতেছিল– জেঠি তো নয় রণচণ্ডী, কত দিন খেতেও দেয় না, এর বাড়ি ওর বাড়ি খেয়ে বেড়ায়। নিজের পুষ্যিই সাতগাণ্ডা—তাদেরই জোটে না, তায় আবার পর!.গুলকীকে দেখিয়া অপুর মোটেই লজ্জা হয় নাছোট্ট একটুকু মেয়েটা, আহা কেহ নাই! তাহার সঙ্গে ভোব করিতে অপুর বড় ইচ্ছা হইল। সে কাছে গিয়া বলিল-আঁচলে কি লুকুচ্চিস দেখি খুকি?..

গুলকী হঠাৎ আঁচল গুটািইয়া লইয়া ফিক করিয়া হাসিয়া নিচু হইয়া দৌড় দিল। তাহার কাণ্ড দেখিয়া অপুর হাসি পাইল। ছুটিবার সময় গুলকীর আঁচলের বকুল ফল পড়িতে পড়িতে চলিয়াছিল, সেগুলি সে কুড়াইতে কুড়াইতে বলিল-পড়ে গেল, সব পড়ে গেল, নিয়ে যা তোর বকুল ও খুকি, কিছু বলবো না, ও খুকি!..

গুলকী ততক্ষণে উধাও হইয়াছে।

পুকুরে স্নান সারিয়া আসিয়া সে বসিয়া আছে, এমন সময় দেখিতে পাইল খিড়কি দরজার আড়াল হইতে গুলকী একবার একটুখানি করিয়া উঁকি মারিতেছে আর একবার মুখ লুকাইতেছে। তাহার সহিত চোখোচে্যুখি হওয়াতে গুলকী ফিক্‌ করিয়া হাসিয়া ফেলিল। অপু দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল-দীড়া, তোকে ধরচি এক দৌড়ে—বলিয়া সে খিড়কি-দরজার দিকে ছুটিল।

গুলকী আর পেছন দিকে না চাহিয়া পথ বাহিয়া সোজা পুকুরপাড়ের দিকে ছুটু দিল। কিন্তু অপুর সঙ্গে পরিবে কেন? নিরূপায় দেখিয়া দাঁড়াইয়া পড়িতেই অপু তাহার কাঁকড়া চুলগুৱা মুঠায় চাপিয়া ধরিয়া বলিল-বড় ছুটি দিচ্ছিলি যে? আমার সঙ্গে ছুটে বুঝি তুই পারবি, খুকি?

গুলকীর প্রথম ভয় হইয়াছিল বুঝি বা তাহাকে মারিবে! কিন্তু অপু চুলের মুঠি ছাড়িয়া দিয়া হাসিয়া ফেলায়, সে বুঝিল এ একটা খেলা। সে আবার সেই রকম হাসিয়া ফেলিল।

অপুর বড় দয়া হইল। তাহার মুখের হাসিতে এমন একটা আভাস ছিল যাহাতে অপুর মনে হইল এ তাহার সঙ্গে ভোব করিতে চায়-খেলা করিতে চায়; কিন্তু ছেলেমানুষ, কথা কহিতে জানে না বলিয়া এইরকম উকিঝুকি মারিয়া-ফিক করিয়া হাসিয়া-দৌড়িয়া পলাইয়া-তাহার ইচ্ছা প্রকাশ করে। অন্য উপায় ইহার জানা নাই। এ যেন ঠিক তাহার দিদি: এই বয়সে দিদি যেন এই রকমই ছিল–এই রকম আঁচলে কুল-বেল-বৈঁচি বাঁধিয়া আপন মনে ঘুরিয়া বেড়াইত, কেহ বুঝিত না, কেহ দেখিত না, এই রকম পেটুক-এই রকম বুদ্ধিহীন ছোট মেয়ে!

অপু ভাবিল-এর সঙ্গে কেউ খেলা করে না, একে নিয়ে একটু খেলি। আহা, মা-বাপ-হারা দুঃখী মেয়ে, আপন মনে বেড়ায়!—সে গুলকীর চুলের মুঠ ছাড়িয়া দিয়া হাত ধরিয়াছিল, বলিলখেলা করবি খুকি? চল ওই পুকুরের পাড়ে। না, এক কাজ করা খুঁকি, আমি তোকে ধরবো-আর তুই ছুটে যাবি; ওই কাঁঠাল গাছটা বুড়ি। আয়

মুঠ ছাড়িয়া দিতেই গুলকী আর না দাঁড়াইয়া আবার নিচু হইয়া দৌড় দিল। অপু চেঁচাইয়া বলিল–আচ্ছা যা, যা দেখি কদূর যাবি-ঠিক তোকে ধরব দেখিস। আচ্ছা ওই গেলি তো এই দ্যাখ-বলিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া সে এক দৌড় দিল-চু-উ-উ-উ। গুলকী পিছন দিকে চাহিয়া অপুকে দৌড়িতে দেখিয়া প্ৰাণপণে যতটুকু তাহার ক্ষুদ্র শক্তিতে কুলায় দৌড়িবার চেষ্টা করিল–কিন্তু অপু একটুখানি ছুটিয়া গিয়াই তাহাকে ধরিয়া ফেলিল। ভারি ছুটতে শিখিচিস খুঁকি না? তা কি তুই আমার সঙ্গে পারিস? চল চোর-চৌকিদার খেলা করবি-তুই হবি চোর-এই কাঁঠাল পাতা চুরি

গুলকীর মুখে হাসি আর ধরিতেছিল না-হয়তো সে এতক্ষণ মনে মনে চাহিতেছিল এই সুন্দর ছেলেটির সঙ্গে ভাব করিতে। মাথা নাড়িয়া আশ্বাস দিবার সুরে বলিল-কাইবিচি নেবে?

অপু মনে ভাবিল চাষার গ্রামে থাকিয়া ও এই সব কথা শিখিয়াছে।–তাহদের গ্রামে যেমন গোয়ালা কি সদগোপের ছেলেমেয়েরা কথা বলে তেমনি।

দুপুরবেলা তাহার পিসিমা ডাকিলে পিছনে পিছনে গুলকী আসিল! অপুর খাওয়া হইয়া গেলে তাহার পিসি জিজ্ঞাসা করিল-ভাত খাবি গুলকী? অপুর পাতে বোস-মোচার ঘণ্ট আছে—ডাল দিচ্ছি, অপু ভাবিল–আহা, ও খাবে জানলে দুখানা মাছ ওর জন্যে রেখে দিতাম। গুলকী দ্বিরুক্তি না। করিয়া নির্লজ্জভাবে খাইতে বসিল। অনেকগুলি ভাত চাহিয়া লইয়া ডাল দিয়া সেগুলি মাখিল, পরে অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া অত ভাত না খাইতে পারিয়া পাতের পাশে রাশীকৃত ঠেলিয়া রাখিল। তবুও উঠিবার নাম করে না। অপুর পিসিমা হাসিয়া বলিল-আর খেতে হবে না গুলকী-হ্যাঁসফাঁস কচ্চিাস-নে ওঠ, কত ভাত নিয়ে ফেললি দ্যাখা তো? তোর কেবল দিষ্টি-খিদে-পরে বলিল, জেঠিমার কাণ্ড দ্যাখো-এতখানি বেলা হয়েচে-কাঁচা মেয়েট-ভাত খেতে ডাকেও না? হলাইবা পর-তা হলেও কচি তো?…

শনিবারে সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরে অপু পূজা দিতে গেল। আচার্য ঠাকুরের খুব লম্বা সাদা দাড়ি বুকের ওপর পড়িয়াছে, বেশ চেহারা। তাহার বিধবা মেয়ে বাপের সঙ্গে সঙ্গে আসে, পূজার আয়োজন করিয়া দেয়, বৃদ্ধ বাপকে খুব সাহায্য করে। মেয়েটি বলিল-চার পয়সা দক্ষিণে কেন খোকা? এতে তো হবে না, বারের পুজোতে দু’আনা দক্ষিণে লাগবে—।

অপু বলিল-আমার মা যে চার পয়সা দিয়েচে মোটে, আর তো আমার কাছে নেই?

মেয়েটি খানকতক কলা মূলা বাছিয়া একখানা পাতায় মুড়িয়া তাহার হাতে দিয়া বলিলঠাকুরের প্রসাদ এতে রৈল, বেলপাতা আর সিঁদুরও দিলাম, তোমাদের বাড়ির মেয়েদের দিয়ে। অপু ভাবিলে—বেশ লোক এরা, আমার যদি পয়সা থাকতো আরও দু’পয়সা দিতাম—-

পিসিমার বাড়ি ফিরিয়া সে বাহিরের রোয়াকে জ্যোৎস্নার আলোতে বসিয়া পিসিমার সঙ্গে পূজার গল্প করিতেছে, পাশের গুলকীদের ঝড়িতে হঠাৎ গুলকীর সবু গলার আকাশ-ফাটানো চিৎকার শোনা গেল-ওরে জেঠি, অমন করে মেরো না-ওরে বাবারে-ও জেঠি, মোর পিঠ কেটে অক্ত পড়চে-মেরো না জেঠি–

সঙ্গে সঙ্গে একটা কর্কশ গলার চিৎকার শোনা গেল-হারামজাদী-বদমায়েশ-চৌধুরীদের বাড়ি গিয়েচো নেমতান্ন খেতে এমনি তোমার নোলা? তোমার নোলায় যদি আজ হাতা পুড়িয়ে হেঁকা না দিই:-লোকের বাড়ি খেয়ে খেয়ে বেড়াবে আর শতেকক্ষোয়ারীরা চোখের মাথা খেয়ে দেখতে পায় না, বলে কি না খেতে দেয় না-আপদ বালাই কোথাকার-বাড়িতে তোমায় খেতে দেয় না?…তোমায় আজ–

অপুর পিসিমা বলিল-দেখচো, ঠেস দিয়ে দিয়ে কথা শুনিয়ে শুনিয়ে বলচে? সত্যি কথা বল্পেই লোকের সঙ্গে আর ভাব থাকে না-তা হলেই তুমি খারাপ—।

অপুর মনটা আকুলি-বিকুলি করিতেছিল। চোখের জলে গলা আড়ষ্ট হওয়ার দরুন কোনো কথা মুখ দিয়া বাহির হইল না।

পরদিন সন্ধ্যার কিছু আগে আহারাদি সারিয়া অপু গোয়ালাপাড়ার দিকে চলিল। আগেব দিন তাহার পিসেমশায় ঠিক করিয়া দিয়াছে। এ গ্রাম হইতে নবাবগঞ্জে তামাক বোঝাই গাড়ি যাইবে, সেই গাড়িতে উঠিয়া সন্ধ্যার সময় রওনা হইলে সকালের দিকে নিশ্চিন্দিপুরের পথে তাহাকে উহারা নামাইয়া দিবে।

অল্পদূরে গিয়া বামুনপাড়ার পথের মোড়ে গুলকীর সঙ্গে দেখা। সে সন্ধ্যায় খেলা করিয়া বাড়ি ফিরিতেছে। অপু বলিল-বাড়ি চলে যাচ্ছি রে খুকি। আজ-সারাদিন ছিলি কোথায়? খেলতে এলিনে কিছু না-। পরে গুলকী অবিশ্বাসের হাসি হাসিতেছে দেখিয়া বলিল-সত্যি রে, সত্যি বলচি, এই দ্যাখ পুটলি, কার্তিক গোয়ালার বাড়ি গিয়ে গাড়ি উঠবো-আয় না। আমার সঙ্গে একটু এগিয়ে দিবি?

গুলকী পিছনে পিছনে অনেকদূর চলিল। বামুনপাড়া ছাড়িয়া খানিকটা ফাকা মাঠ। তাহার পরেই গোয়ালাপাড়া। গুলকী মাঠের ধার পর্যন্ত আসিল। অপুর রাঙা সাটিনের জামটার দিকে আঙুল দেখাইয়া কহিল-তোমার এই আঙা জামাটা ক’পয়সা?

অপু হাসিমুখে বলিল-দুটাকা-তুই নিবি?

গুলকী ফিক্‌ করিয়া হাসিল। অর্থাৎ তুমি যদি দাও, এখখনি..

হঠাৎ সামনের পথে চোখ ফিরাইতেই অপু দেখিতে পাইল, মাঠের শেষে গাছপালার ফাকে আলো হইয়া উঠিয়াছে।–অমনি কেমন করিয়া তাহার মনে হইল আগামী মাসের এমন দিনটাতে তাহারা কোথায় কতদূরে চলিয়া যাইবে। পরে গুলকীকে বলিল-আর আসিস নে খুকি, তুই চলে যা-অনেকদূরে এসে গিাইচিস-তোর বাড়িতে হয়তো আবার বকবে-চলে যা খুকি।-আবার এলে দেখা হবে, কেমন তো? হয়তো আর আসবো না, আমরা কাশী চলে যাবো বোশেখ মাসে, সেখানে বাস করবো-গুলকী আর একবার ফিক করিয়া হাসিল।

সেদিন পূর্ণিমা কি চতুর্দশী এমনি একটা তিথি। সে এদিকে আর কখনও আসে নাই, কিন্তু বাল্যের এই এক প্রথম বিদেশ-গমন সম্পর্কিত একটা ছবি অনেক দিন পর্যন্ত তাহার মনে ছিল– সোজা মাঠের পথে দূর-প্রান্তে গাছপালার ফাঁকে পূৰ্ণচন্দ্ৰ উঠিতেছে (বা চতুর্দশীর চন্দ্র, তাহার ঠিক মনে ছিল না।) পিছনে পিছনে অল্পদিনের পরিচিতা, অনাথা, অবোধ কাঁকড়াচুল ছোট একটি মেয়ে তাহাকে আগাইয়া দিতে আসিয়াছে।

পর্ব ২৮ শেষ 📌

🔴পর্ব :২৯🔴

বৈশাখ মাসের প্রথমে হরিহর নিশ্চিন্দিপুর হইতে বাস উঠাইবার সব ঠিক করিয়া ফেলিল। যে জিনিসপত্র সঙ্গে করিয়া লইয়া যাওয়া চলিবে না, সেগুলি বিক্ৰয় করিয়া ফেলিয়া নানা খুচরা দেনা শোধ দিয়া দিল। সেকালের কাঁঠালকাঠের বড় তক্তপোশ, সিন্দুক, পিঁড়ি ঘরে অনেকগুলি ছিল, খবর পাইয়া ওপাড়া হইতে পর্যন্ত খরিদ্দার আসিয়া সস্তাদরে কিনিয়া লইয়া গেল।

গ্রামের মুবুব্বীরা আসিয়া হরিহরকে বুঝাইয়া নিবৃত্ত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। নিশ্চিন্দিপুরের দুগ্ধ ও মৎস্য যে কত সস্তা বা কত অল্প খরচে এখানে সংসার চলে সে বিষয়ের একটা তুলনামূলক তালিকাও মুখে মুখে দাখিল করিয়া দিলেন। কেবল রাজকৃষ্ণ ভট্টাচাৰ্য স্ত্রীর সাবিত্রীব্রত উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করিতে আসিয়া অনেকক্ষণ কথাবার্তার পর বলিলেন-বাপু, আছেই বা কি দেশে যে থাকতে বলবো।–তা ছাড়া এক জায়গায় কাদায় গুণ পুতে থাকাও কোনো কাজের নয়, এ আমি নিজেকে দিয়ে বুঝি-মন ছোট হয়ে থাকে, মনের বাড় বন্ধ হয়ে যায়। দেখি এবার তো ইচ্ছে আছে একবার চন্দ্ৰনাথটা সেরে আসবে। যদি ভগবান দিন দেন

রানী কথাটা শুনিয়া অপুদের বাড়ি আসিল। অপুকে বলিল-হ্যাঁরে অপু, তোরা নাকি এ গাঁ ছেড়ে চলে যাবি? সত্যি?

অপু বলিল-সত্যি রানুদি, জিজ্ঞেস করো মাকে—

তবুও রানী বিশ্বাস করে না। শেষে সর্বজয়ার মুখে সব শুনিয়া রানী অবাক হইয়া গেল। অপুকে বাহিরের উঠানে ডাকিয়া বলিল-কবে যাবি রে?

–সামনের বুধবারের পরের বুধবারে—

–আসবি নে আর কখনও?

রানীর চোখ অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল, বলিল-তুই যে বলিস নিশ্চিন্দিপুর আমাদেব বড় ভালো গা, এমন নদী, এমন মাঠ কোথাও নেই-সে। গা ছেড়ে তুই যাবি কি করে?

অপু বলিল-আমি কি করবো, আমি তো আব্ব বলিনি। যাবাব কথা? বাবার সেখানে বাস করবার মন, এখানে আমাদেব চলে না যে? আমার লেখা খাতাটা তোমাকে দিয়ে যাবো বানুদি, বড় হলে হয়তো আবাব দেখা হবে–

রানী বলিল-আমার খাতাতে গল্পটাও তো শেষ করে দিলি নে, খাতায় নাম সইও করে দিলি নি, তুই বেশ ছেলে তো অপু?

চোখের জল চাপিয়া রানী দ্রুতপদে বাটীর বাহির হইয়া গেল। অপু বুঝিতে পারে না রানুদি মিছামিছি কেন রাগ করে! সে কি নিজের ইচ্ছাতে দেশ ছাড়িয়া যাইতেছে?

স্নানের ঘাটে পটুর সঙ্গে অপুর কত কথা হইল। পটুও কথাটা জানিত না, অপুর মুখে সব শুনিয়া তাহার মনটা বেজায় দমিয়া গেল। স্নানমুখে বলিল–তোর জন্যে নিজে জলে নেমে কত কষ্টে শ্যাওলা সরিয়ে ফুটু কাটলাম, একদিনও মাছ ধরবিনে তাতে?

এবার রামনবমীর দোল, চড়কপূজা ও গোষ্ঠবিহার অল্পদিন পরে পরে পড়িল। প্রতি বৎসর এই সময় অপূর্ব অসংযত আনন্দে অপুর বুক ভরিয়া তোলে। সে ও তাহার দিদি এ সময় আহার নিদ্ৰা পরিত্যাগ করিত। অপুর দিক হইতে অবশ্য এবারও তাহার কোনো ত্রুটি হইল না।

চড়কের দিন গ্রামের আতুরী বুড়ি মারা গেল। নতুন যে মাঠটাতে আজকাল চড়কের মেলা বসে, তাহারই কাছে আতুরী বুড়ির সেই দো-চালা ঘরখানা। অনেক লোক জড়ো হইয়াছে দেখিয়া সেও সেখানে দেখিতে গেল। সেই যে একবার আতুরী ডাইনির ভয়ে বাঁশবন ভাঙিয়া দৌড় দিয়াছিল-তখন সে ছোট ছিল-এখন তাহার সে কথা মনে হইলে হাসি পায়। আজ তাহার মনে হইল আতুরী বুড়ি ডাইনি নয়, কিছু নয়। গ্রামের একাধারে লোকালয়ের বাহিরে একা থাকিত-গরিব অসহায়, ছেলে ছিল না, মেয়ে ছিল না, কেহ দেখিবার ছিল না, থাকিলে কি আজ সারাদিন ঘরের মধ্যে মরিয়া পড়িয়া থাকিত? সৎকারের লোক হয় না? পাঁচু জেলের ছেলে একটা হ্যাঁড়ি বাইরে আনিয়া ঢালিল-এক-হ্যাঁড়ি শুকনা আমচুর। ঝোড়ো আম কুড়াইয়া বুড়ি আমসি আমচুর তৈয়ারি করিয়া রাখিয়া দিত ও তাঁহা হাটে হাটে বিক্রয় করিয়া দিনপাত করিত। অপু তাহা জানে, কারণ গত রথের মেলাতেও তাঁহাকে ডালা পাতিয়া আমসি বিক্রয় করিতে দেখিয়াছে।

চড়কটা যেন এবার কেমন ফাঁকা ঠেকিতে লাগিল। আর-বছরও চড়কের বাজারে দিদি নতুন পট কিনিয়া কত আনন্দ করিয়াছে। মনে আছে সেদিন সকলে দিদির সহিত তাহার ঝগড়া হইয়াছিল। বৈকালে তাহার দিদি বলিল-পয়সা দেবো অপু, একখানা সীতাহরণের পট দেখিস যদি মেলায় পাস? অপু প্ৰতিশোধ লইবার জন্য বলিল-যত সব পানসে পুতু পুতু পাট, তাই তোর কিনতে হবে, আমি পারবো না যা-কেন রামরাবণের যুদ্ধ একখানা কেননা? তাহার দিদি বলিল-তোর কেবল যুদ্ধ আর যুদ্ধ-ছেলের যা কাণ্ড! কেন ঠাকুর-দেবতার পট বুঝি ভালো হল না?…দিদির শিল্পানুভূতি-শক্তির উপর অপুর কোনো কালেই শ্রদ্ধা ছিল না।

তাহাদের বেড়ার গায়ে রাংচিতা ফুল লাল হইয়া ফুটিলে, তাহার মুখ মনে পড়ে, পাখির ডাকে, সদ্যাফোটা ওড়কলমির ফুলের দুলুনিতে-দিদির জন্য মন কেমন করে। মনে হয় যাহার কাছে ছুটিয়া গিয়া বলিলে খুশি হইত, সে কোথায় চলিয়া গিয়াছো-কতদূর!..আর কখনও, কখনও-সে। এসব লইয়া খেলা করিতে আসিবে না।…

মেলার গোলমালের মধ্যে কে চমৎকার বাঁশি বাজাইতেছে। নতুন সুর তাহার বড় ভালো লাগে-খুঁজিয়া বাহির করিল-মালপাড়ার হারান মাল এক বান্ডিল বাঁশের বাঁশি চাচিয়া বিক্রয় করিবার জন্য আনিয়াছে ও বিজ্ঞাপন স্বরূপ একটা বাঁশি নিজে বাজাইতেছে। অপু জিজ্ঞাসা করিল– একটা ক’পয়সা? হারান মাল তাহাকে খুব চেনে। কতবার তাঁহাদের রান্নাঘর ছাইয়া দিয়া গিয়াছে। সে জিজ্ঞাসা করিল-তোমরা নাকি শোনলাম খোকা গা ছেড়ে চল্লে? তা কোথায় যাচ্চ-হাগা?

অপু দেড় পয়সা দিয়া সবু বাঁশের বাঁশি একটা কিনিল। বলিল–কোন কোন ফুটোতে আঙুল টেপো হারানকাকা? একবার দেখিয়ে দাও দিকি?

মনে আছে একবার অনেক রাত্রে ঘুম ভাঙিয়া সে খানিকক্ষণ জাগিয়া ছিল। দূরে নদীতে অন্ধকার রাত্রে জেলেদের আলোয় মাছধরা দোনা-জালের একঘেয়ে একটানা ঠক ঠক শব্দ হইতেছিল। এমন সময় তাহার কানে গেল অনেক দূরে যেন কুঠির মাঠের পথের দিক অত রাত্রে কে খোলা গলায় গান গাহিয়া পথ চলিয়াছে। কুঠির মাঠের পথে বেশি রাত্রে বড় একটা কেহ হ্যাঁটে না, তবুও আধঘুমে কতদিন যে নিশীথ রাত্রির জ্যোৎস্নায় অচেনা পথিক-কণ্ঠে মধুকানের পদ-ভাঙা গানের তানকে দূর হইতে দূরে মিলাইয়া যাইতে শুনিয়াছো-কিন্তু সেবার যাহা শুনিয়াছিল। তাহা একেবারে নতুন। সুরাটা সে আয়ত্ত করিতে পারে নাই-আধ-জাগরণের ঘোরে সুষমাময়ী সুরলক্ষ্মী দুই ঘুমের মাঝখানের পথ বাহিয়া কোথায় অন্তহিত হইয়াছিলেন, কোনোদিন আর তাঁহার সন্ধান মিলে নাই-কিন্তু অপু কি তাহা কোনোদিন ভুলিবে?

চড়ক দেখিয়া নানা গায়ের চাষীদের ছেলেমেয়েরা রঙিন কাপড় জামা, কেউবা নতুন কোরা শাড়ি পরনে, সারি দিয়া ঘরে ফিরিতেছে। ছেলেরা বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে চলিয়াছে। গোষ্ঠবিহারের মেলা দেখিতে চার-পাঁচ ক্রোশ দূর হইতেও লোকজন আসিয়াছিল। শোলার পাখি, কাঠের পুতুল, রঙিন কাগজের পাখা, রং-করা হ্যাঁড়ি, ছোবা-সকলেরই হাতে কোনো না কোনো জিনিস। চিনিবাস বৈষ্ণব মেলার বেগুনি ফুলুরির দোকান খুলিয়াছিল, তাহার দোকান টুইতে অপু দু’পয়সার তেলে-ভাজ খাবার কিনিয়া হাতে লইয়া বাড়ির দিকে চলিল। ফিরিতে ফিরিতে মনে হইল, যেখানে তাহারা উঠিয়া যাইতেছে সেখানে কি এরকম গোষ্ঠবিহার হয়? হয়তো সে আর চড়কের মেলা দেখিতে পাইবে না! মনে ভাবিল-সেখানে যদি চড়ক না হয় তবে বাবাকে বলবো, আমি মেলা দেখবো বাবা, নিশ্চিন্দিপুর চল যাই-না হয় দুদিন এসে খুড়িমাদের বাড়ি থেকে যাবো?

চড়কের পরদিন জিনিসপত্র বাঁধাৰ্ছদা হইতে লাগিল। কাল দুপুরে আহারাদির পর রওনা হইতে হইবে।

সন্ধ্যার সময় রান্নাঘরের দাওয়ায় তাহার মা তাহাকে গরম গরম পরোটা ভাজিয়া দিতেছিল। নীলমণি জেঠার ভিটায় নারিকেল গাছটার পাতাগুলি জ্যোৎস্নার আলোয় চিকচিক্‌ করিতেছে-চাহিয়া দেখিয়া অপুর মন দুঃখে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। এতদিন নতুন দেশে যাইবার জন্য তাহার যে উৎসাহটা ছিল, যতই যাওয়ার দিন কাছে আসিয়া পড়িতেছে, ততই আসন্নবিরহের গভীর ব্যথায় তাহার মনের সুরটি করুণ হইয়া বাজিতেছে।

এই তাঁহাদের বাড়ি-ঘর, ওই বাঁশবন, সলতে-খাগীর আমবাগানটা, নদীর ধার, দিদির সঙ্গে চড়ুইভাতি করার ওই জায়গাটা-এ সব সে কত ভালোবাসে! ওই অমন নারিকেল গাছ কি তাহারা যেখানে যাইতেছে সেখানে আছে? জ্ঞান হইয়া পর্যন্ত এই নারিকেল গাছ সে এখানে দেখিতেছে, জ্যোৎস্নাবাত্রে পাতাগুলি কি সুন্দর দেখায়! সুমুখ জ্যোৎস্নারাত্রে এই দাওয়ায় বসিয়া জ্যোৎস্নাঝরা নারিকেল শাখার দিকে চাহিয়া কত বাত্রে দিদির সঙ্গে সে দশ-পাঁচিশ খেলিয়াছে, কতবার মনে হইয়াছে কি সুন্দর দেশ তাহদের এই নিশ্চিন্দিপুর! যেখানে যাইতেছে, সেখানে কি রান্নাঘরের দাওয়াব পাশে বনের ধারে এমন নাবিকেল গাছ আছে? সেখানে কি সে মাছ ধরিতে পাবিবে, আম কুড়াইতে পরিবে, নৌকা বাহিতে পরিবে, রেল বেল খেলিতে পাবিবে, কদমতলার সায়েবের ঘাটের মতো ঘাট কি সে দেশে আছে? রানুদি আছে? সোনাডাঙার মাঠ আছে? এই তো বেশ ছিল তাহারা, কেন এসব মিছামিছি। ছাড়িয়া যাওয়া?

দুপুবে এক কাণ্ড ঘটিল।

তাহার মা সাবিত্রীব্রতের নিমন্ত্রণে গিয়াছে, হরিহর পাশের ঘরে আহারাদি সারিয়া ঘুমাইতেছে, অপু ঘবের মধ্যে তাকেব। উপবিস্থিত জিনিসপত্র কি লওযা যাইতে পারে না পারে নাড়িযা চড়িযা দেখিতেছে। উঁচু তাকের উপব একটা মাটির কলসী সরাইতে গিয়া তাহার ভিতর হইতে একটা কি জিনিস গড়াইয়া মেজের উপর পড়িয়া গেল। সে সেটাকে মেজে হইতে কুড়াইয়া নাড়িয়া চড়িয়া দেখিয়া দেখিয়া অবাক হইয়া রহিল। ধুলা ও মাকড়সার ঝুল মাখা হইলেও জিনিসটা কি বা তাহার ইতিহাস বুঝিতে তাহার বাকি রহিল না।

সেই ছোট্ট সোনার কৌটাটা আর বছর যেটা সেজ ঠাকরুনদের বাড়ি হইতে চুরি গিয়াছিল।

দুপুরে কেহ বাড়ি নাই, কৌটাটা হাতে লইয়া অনেকক্ষণ অন্যমনস্কভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, বৈশাখ দুপুবের তপ্ত রৌদ্রভরা নির্জনতায় বাশবনের শন শন শব্দ অনেক দূরের বার্তার মতো কানে আসে। আপন মনে বলিল-দিদি হতভাগী চুরি করে এনে ওই কলসীটার মধ্যে লুকিয়ে রেখে দিইছিল!

সে একটুখানি ভাবিল, পরে ধীরে ধীরে খিড়কি-দোরের কাছে গিয়া দাঁড়াইল-বহুদূর পর্যন্ত বাঁশবন যেন দুপুরের রৌদ্রে ঝিমাইতেছে, সেই শঙ্খচিলটা কোন গাছের মাথায় টানিয়া টানিয়া ডাকিতেছে, দ্বৈপায়ন হ্রদে লুকায়িত প্রাচীন যুগের সেই পরাজিত ভাগ্যহত রাজপুত্রের বেদনাকরুণ মধ্যাহ্নটা! একটুখানি দাঁড়াইয়া থাকিয়া সে হাতের কোেটাটাকে একটান মারিয়া গভীর বাঁশবনের দিকে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল। তাহার দিদি ভুলো কুকুরকে ডাক দিলে যে ঘন বনঝোপের ভিতর দিয়া ভুলো হ্যাঁপাইতে হ্যাঁপাইতে ছুটিয়া আসিত, ঠিক তাঁহারই পাশে রাশীকৃত শুকনা বাঁশ ও পাতার রাশির মধ্যে বৈঁচি-ঝোপের ধারে কোথায় গিয়া সেটা গড়াইয়া পড়িল।

মনে মনে বলিল-রাইল ওইখানে, কেউ জানতে পারবে না কোনো কথা, ওখানে আর কে যাবে?

সোনার কোটার কথা অপু কাহাকেও কিছু জানাইল না, কখনও জানায় নাই, এমন কি মাকেও না।

দুপুর একটু গড়াইয়া গেলে হীরু গাড়োয়ানের গরুর গাড়ি রওনা হইল। সকালের দিকে আকাশে একটু একটু মেঘ ছিল বটে কিন্তু বেলা দশটার পূর্বেই সেটুকু কাটিয়া গিয়া পরিপূর্ণ প্রচুর বৈশাখী মধ্যাহ্নের রৌদ্র গাছেপালায় পথে মাঠে যেন অগ্নিবৃষ্টি করিতেছে। পটু গাড়ির পিছনে পিছনে অনেক দূর পর্যন্ত আসিতেছিল, বলিল-অপুদা, এবার বারোয়ারিতে ভালো যাত্ৰাদলের বায়না হয়েচে, তুই শুনতে পেলিনে৷ এবার–

অপু বলিল-তুই পালার কাগজ একখানা বেশি করে নিবি, আমায় পাঠিয়ে দিবি—

আবার সেই চটকের মাঠের ধারা দিয়া রাস্তা! মেলার চিহ্নস্বরূপ সারা মাঠটিায় কাটা ডাবের খোলা গড়াগড়ি যাইতেছে, কাহারা মাঠের একপাশে রাঁধিয়া খাইয়াছে, আগুনে কালো মাটির ঢেলা ও একপাশে কালিমাখা নতুন হ্যাঁড়ি পড়িয়া আছে। হরিহর চুপ করিয়া বসিয়া ছিল, তাহার যেন কেমন কেমন ঠেকিতেছিল। কাজটা কি ভালো হইল? কতদিনের পৈতৃক ভিটা, ওই পাশের পোড়ো ভিটাতে সে সব ধুমধাম একেবারে শেষ হইয়া গিয়াছিলই তো, যা-ও বা মাটির প্রদীপ টিম টিম করিতেছিল, আজ সন্ধ্যা হইতে চিরদিনের জন্য নিবিয়া গেল। পিতা রামচাদ তর্কবাগীশ স্বৰ্গ হইতে দেখিয়া কি মনে করবেন?

গ্রামের শেষ বাড়ি হইতেছে আতুৱী বুড়ির সেই দোচালা ঘরখানা, যতক্ষণ দেখা গেল অপু হ্যাঁ করিয়া সেদিকে চাহিয়া রহিল। তাহার পরই একটা বড় খেজুর বাগানের পাশ দিয়া গাড়ি গিয়া একেবারে আষাঢ় যাইবার বাঁধা রাস্তার উপর উঠিল। গ্রাম শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে সর্বজয়ার মনে হইল যা কিছু দারিদ্র্য, যা কিছু হীনতা, যা কিছু অপমান সব রহিল পিছনে পড়িয়া—এখন সামনে শুধু নতুন সংসার, নতুন জীবনযাত্রা, নব সচ্ছলতা।.

ক্ৰমে রৌদ্র পড়িল-গাড়ি তখন সোনাডাঙার মাঠের মধ্যে দিযা যাইতেছিল। হরিহর মাঠের মধ্যের একটা বড় বটগাছ দেখাইয়া কহিল-ওই দ্যাখো ঠাকুরঝি পুকুরের ঠ্যাঙাড়ে বটগাছ। সর্বজয়া তাড়াতাড়ি মুখ বাহির করিয়া দেখিল। পথ হইতে অল্প দূরেই একটা নাবাল জমির ধারে বিশাল বটগাছটা চারিধারে ঝুরি গাড়িয়া বসিয়া আছে। সেই বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণ ও তাহার বালকপুত্রের গল্প সে কতবার শুনিয়াছে। আজ হইতে পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে তাহার শ্বশুরের পূর্বপুরুষ এই রকম সন্ধ্যাবেলা ওই বটতলায় নিরীহ ব্ৰাহ্মণ ও তঁহার অবোধ পুত্রকে অর্থলোভে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিয়া পাশের ওই নাবাল জমি, যেটা সেকালের ঠাকুরবি পুকুর ছিলওইখানে পুতিয়া রাখিয়াছিল। ছেলেটির মা হয়তো পুত্রের বাড়ি ফিরিবার আশায় কত মাস, কত বছর বৃথা অপেক্ষা করিত, সে-ছেলে আর ফিরে নাই—মাগে! সর্বজয়ার চোখ হঠাৎ জলে ঝাপসা হইয়া আসে, গলায় কি একটা আটকাইয়া যায়!

সোনাডাঙার মাঠ। এ অঞ্চলের সকলের বড় মাঠ। এখানে ওখানে বনঝোপ শিমুল বাবুল গাছ, খেজুর গাছে খেজুর কাঁদি ঝুলিতেছে, সৌদালি ফুলের ঝাড় দুলিতেছে, চারিধারে বৌ-কথা-কও পাপিয়ার ডাক। দূরপ্রসারী মাঠের উপর তিসির ফুলের রং-এর মতো গাঢ় নীল আকাশ উপুড় হইয়া পড়িয়ছে, দৃষ্টি কোথাও বাধে না, ঘন সবুজ ঘাসে মোড়া উঁচু নিচু মাঠের মধ্যে কোথাও আবাদ নাই, শুধুই গাছপালা-বনঝোপের প্রাচুর্য আর বিশাল মাঠটাির শ্যামপ্রসার, সম্মুখে কাঁচা মাটির চওড়া পথটা গৃহত্যাগী উদাস বাউলের মতো দূর হইতে দূরে আপন মনে আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিয়াছে। একটু দূরে গিয়া ব্যারাসে-মধুখালির বিল পড়িল। কোন প্রাচীন কালের নদী শুকাইয়া গিয়া জীবনের যাত্রাপথের পদচিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে, অন্তৰ্হিত নদীর বিশাল খাতটা এখন পদ্মফুলে ভরা বিল। অপু গাড়িতে বসিয়া মাঠ ও চারিধারের অপূর্ব আকাশের রংটা দেখিতে দেখিতে যাইতেছিল। বেলাশেষের স্বল্পপটে আবার কত কি শৈশব-কল্পনার আসা-যাওয়া! এই তো সে গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়াছে। এখন হয়তো কোথায় কতদূরে চলিবে, যাওয়া তার সবে আরম্ভ হইল, এইবার হয়তো সে-সব দেশ, স্বপ্ন-দেখা সে অপূর্ব জীবন।

হরিহর দূরের একটা গ্রাম আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল-ওই হল ধঞ্চে-পলাশগাছি, ওরই ওপাশে নাটাবেড়ে-ওইখানে বনবিবির দরগাতলায় শ্রাবণ মাসে ভরি মেলা হয়, এমন সন্তা কুমড়ো আর কোথাও মেলে না।

আষাঢ় বাজারের নিচে খেয়ায় বেত্ৰবতী পার হইবার সময় চীদ উঠিল, জ্যোৎস্নার আলোয় জল চিকচিক্‌ করিতেছিল। আজ আবদুর হাট, কয়েকজন হাটুরে লোক কলরব করিতে করিতে ওপর হইতে খেয়ানৌকায় এপারে আসিতেছে। অপুদের গাড়িসুদ্ধ পার হইয়া ওপারে উঠিল। অপু বাবাকে বলিয়া আষাঢ়ার বাজার দেখিতে নামিল। ছোট বাজার, সারি সারি বাঁপিতোলা দোকান, স্যাকরার দোকানের টুকটাক্‌ শুনা যাইতেছে, একটা খেজুরগুড়ের আড়তের সামনে বহু গরুর গাড়ির ভিড়। মাঝেরপাড়া স্টেশন এখনও প্রায় চারি ক্ৰোশ, রাস্তা। কাঁচা হইলেও বেশ চওড়া, দুধারে নীলকুঠির সাহেবদের আমলে রোপিত বট, অশ্বথ, তুতাগাছ। বৈশাখ মাসের প্রথমে পথিপার্থের বট-অশ্বথের ডালের মধ্যে কোথায় কোকিল ডাকিয়া ডাকিয়া সারা হইতেছে, সারা পথটা প্রাচীন বটের সারির কুরি দোলানো। কচি পাতার রাশি জ্যোৎস্না লাগিয়া স্বচ্ছ দেখাইতেছে।

বাংলার বসন্ত চৈত্র বৈশাখের মাঠে, বনে, বাগানে, যেখানে-সেখানে, কোকিলের এলোমেলো ডাকে, নতপল্লব নাগকেশর গাছের অজস্ৰ ফুলের ভারে, বনফুলের গন্ধভরা জ্যোৎস্নাস্নিগ্ধ দক্ষিণহাওয়ায় উল্লামে আনন্দনৃত্য শুরু করিয়াছে, এরূপ অপরূপ বসস্তদৃশ্য অপু জীবনে এই প্রথম দেখিল। এই অল্প বয়সেই তাহার মনে বাংলার মাঠ, নদী, নিরালা বনপ্রান্তরের সুমুখ জ্যোৎস্না রাত্রির যে মায়ারূপ অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল, তাহার উত্তরকালের শিল্পীজীবনের কল্পনামুহুর্তগুলি মাধুর্যে ও প্রেরণায় ভরিয়া তুলিবার তাহ্যাঁই ছিল শ্রেষ্ঠ উপাদান।

রাত্রি প্রায় দশটার সময় স্টেশনে আসিয়া গাড়ি পৌঁছিল। আজ অনেকক্ষণ হইতেই কখন গাড়ি স্টেশনে পৌছাইবে সেই আশায় অপু বসিয়া ছিল, গাড়ি থামিতেই নামিয়া সে একদৌড়ে গিয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে হাজির হইল। সন্ধ্যা সাড়ে আটটার ট্রেন অনেকক্ষণ চলিয়া গিয়াছে, বাবাকে জিজ্ঞাসা করিয়া সে জানিয়াছে সারারাত্রির মধ্যে আর ট্রেন নাই। ওই হীরু গাড়োয়ানের গরু দুইটার জন্যই এরূপ ঘটিল, নতুবা এখনই সে ট্রেন দেখিতে পাইত। প্ল্যাটফর্মে একরাশ তামাকের গাট সাজানো-দুজন রেলের লোক একটা লোহার বাক্স মতো দেখিতে অথচ খুব লম্বা ডাণ্ডাওয়ালা কলে তামাকের গাট চাপাইয়া কি করিতেছে। জ্যোৎস্না পড়িয়া রেলের পাটি চিক্‌ চিক করিতেছে। ওদিকে রেল লাইনের ধারে একটা উঁচু খুঁটির গায়ে দুটা লাল আলো, এদিকে আবার ঠিক সেই রকম দুটা লাল আলো। স্টেশনের ঘরে টেবিলের উপরে চৌপায়া তেলের লণ্ঠন জুলিতেছে। এক রাশ বঁধানো খাতপত্র। অপু দরজার কাছে গিয়া খানিকটা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিল, একটা ছোট্ট খড়মের বউলের মতো জিনিস টিপিয়া স্টেশনের বাবু খটখটি শব্দ করিতেছে।

ইস্টিশান! ইস্টিশান! বেশি দেরি নয়, কাল সকালেই সে রেলের গাড়ি শুধু যে দেখিবে তাহা নয়, চড়িবেও!…

প্ল্যাটফর্ম হইতে নড়িতে তাহার মন সরিতেছিল না। কিন্তু তাহার বাবা ডাকিতে আসিল। খড়মের বউলের মতো জিনিসটাই নাকি টেলিগ্রাফের কল, তাহার বাবা বলিল।

অপু ফিরিয়া দেখিল স্টেশনের পুকুর ধারে রাধিয়া খাইবার জোগাড় হইতেছে। আর একখানি গাড়ি পূর্ব হইতেই সেখানে দাঁড়াইয়া ছিল। আরোহীর মধ্যে আঠারো-উনিশ বৎসরের এক বৌ ও একটি যুবক। অপু শুনিল বেঁটি হবিবপুরের বিশ্বাসদের বাড়ির, ভাইয়ের সঙ্গে বাপের বাড়ি। যাইতেছে। তাহার মায়ের সঙ্গে বেঁটির খুব ভাব হইয়া গিয়াছে। তাহার মা খিচুড়ির চালডাল ধুইতেছে, বৌটি আলু ছাড়াইতেছে। রান্না একত্র হইবে।

সকাল সাড়ে সাতটায় ট্রেন আসিল। অপু হ্যাঁ করিয়া অনেকক্ষণ হইতে গাড়ি দেখিবার জন্য প্ল্যাটফর্মের ধারে বুকিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, তাহার বাবা বলিল, খোকা, অত বুকে দাঁড়িয়ে থেকে না, সরে এসো এদিকে। একজন খালাসিও লোকজনদের হাঁটাইয়া দিতেছিল।

কত বড় ট্রেনখানা!! কী ভয়ানক শব্দ! সামনের একেই ইঞ্জিন বলে? উঃ, কী কাণ্ড।

হবিবপুরের বৌটি ঘোমটা খুলিয়া কৌতুহলের সহিত প্রবেশমান ট্রেনখানার দিকে চাহিয়া ছিল।

গাড়িতে হৈ হৈ কারিয়া মোট-ঘাট সব উঠানো হইল। কাঠের বেঞ্চি সব মুখোমুখি করিয়া পাতা। গাড়ির মেজেটা যেন সিমেন্টের বলিয়া মনে হইল। ঠিক যেন ঘর একখানা; জানলা দরজা সব হুবহু! এই ভারী গাড়িখানা, যাহা আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা যে আবার চলিবে, সে বিশ্বাস অপুর হইতেছিল না। কি জানি হয়তো নাও চলিতে পারে; হয়তো উহারা এখনই বলিতে পারে, ওগো তোমরা সব নামিয়া যাও, আমাদের গাড়ি আজ আর চলিবে না। তারের বেড়ার এদিকে একজন লোক একবোঝা উলুঘাস মাথায় করিয়া ট্রেনখানা চলিয়া যাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া ছিল, অপুর মনে হইল লোকটা কৃপার পাত্র! আজিকার দিনে যে গাড়ি চড়িল না, সে বঁচিয়া থাকিবে কি কবিয়া? হীরু গাড়োয়ান ফটকের বাহিরে দাঁড়াইয়া গাড়ির দিকে চাহিয়া আছে।

গাড়ি চলিল। অদ্ভুত, অপূর্ব-দুলুনি!! দেখিতে দেখিতে মাঝেরপাড়া স্টেশন, লোকজন, তামাকের গোট, হ্যাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া-থাকা হীরু গাড়োয়ান, সকলকে পিছনে ফেলিয়া গাড়ি বাহিরের উলুখড়ের মাঠে আসিয়া পড়িল। গাছপালাগুলো সর্টসট করিয়া দুদিকের জানালার পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া পলাইতেছে-কী বেগ! এরই নাম রেলগাড়ি! উঃ, মাঠখানা যেন ঘুরাইয়া ফেলিতেছে! ঝোপঝাড় গাছপালা, উলুখড়ের চাউনি, ছোটখাটো চাষীদের ঘর সব একাকার করিয়া দিতেছে! গাড়ির তলায় জাতী-পেষার মতো একটা একটানা শব্দ হইতেছে-সামনের দিকে ইঞ্জিনের কী শব্দটা!

মাঝেরপাড়া স্টেশনের ডিসস্ট্যান্ট সিগন্যালখানাও ক্ৰমে মিলাইয়া যাইতেছে!…

অনেক দিন আগের সে দিনটা!

সে ও দিদি যেদিন দুজনে বাছুর খুঁজিতে খুঁজতে মাঠ-জলা ভাঙিয়া উধৰ্ব্বশ্বাসে রেলের রাস্তা দেখিতে ছুটিয়া গিয়াছিল! সেদিন–আর আজ?

ওই যেখানে আকাশের তলে আষাঢ়-দুর্গাপুরের বাঁধা সড়কের গাছের সারি ক্রমশ দূর হইতে দূরে গিয়া পড়িতেছে, ওরই ওদিকে যেখানে তাঁহাদের গায়ের পথ বাঁকিয়া আসিয়া সোনাডাঙা মাঠের মধ্যে উঠিয়াছে, সেখানে পথের ঠিক সেই মোড়টিতে, গ্রামের প্রান্তের বুড়ো জামতলাটায় তাহার দিদি যেন ম্লানমুখে দাঁড়াইয়া তাহাদের রেলগাড়ির দিকে চাহিয়া আছে!…

তাহাকে কেহ লইয়া আসে নাই, সবাই ফেলিয়া আসিয়াছে, দিদি মারা গেলেও দুজনের খেলা করার পথেঘাটে, বাশবনে, আমতলায় সে দিদিকে যেন এতদিন কাছে কাছে পাইয়াছে, দিদির অদৃশ্য স্নেহস্পর্শ ছিল নিশ্চিন্দিপুরের ভাঙা কোঠাবাড়ির প্রতি গৃহ-কোণে-আজ কিন্তু সত্য-সত্যই দিদির সহিত চিরকালের ছাড়াছাড়ি হইয়া গেল।…

তাহার যেন মনে হয় দিদিকে আব্ব কেহ ভালোবাসিত না, মা নয়, কেউ নয়! কেহ তাহাকে ছাড়িয়া আসিয়া দুঃখিত নয়।

হঠাৎ অপুর মন এক বিচিত্র অনুভূতিতে ভরিয়া গেল। তাহা দুঃখ নয়, শোক নয়, বিয়াহ নয়, তাহা কি সে জানে না। কত কি মনে আসিল অল্প এক মুহূর্তের মধ্যে.আতুরী ডাইনী…নদীর ঘোট..তাহদের কোঠাবাড়িটা..চালতেতলার পথ…রানুদি..কত বৈকাল, কত দুপুর.কতদিনের কত হাসিখেলা. পটু.. দিদির কত না-মেটা সাধ…

দিদি এখনও একদৃষ্টি চাহিয়া আছে—

পরীক্ষণেই তোহর মনের মধ্যের অবাক ভাষা চোখের জলে আত্মপ্রকাশ করিয়া যেন এই কথাই বার বার বলিতে চাহিল-আমি চাইনি দিদি, আমি তোকে ভুলিনি, ইচ্ছে করে ফেলেও আসিনিওরা আমায় নিয়ে যাচ্ছে—

সত্যই সে ভুলে নাই।

উত্তরজীবনে নীলকুন্তলা সাগরমেখলা ধরণীর সঙ্গে তাহার খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটিয়াছিল। কিন্তু যখনই গতির পুলকে তাহার সারা দেহ শিহরিয়া উঠিতে থাকিত, সমুদ্রগামী জাহাজের ডেকা হইতে প্রতিমুহূর্তে নীল আকাশের নব নব মায়ারূপ চোখে পড়িত, হয়তো দ্রাক্ষাকুঞ্জবেষ্টিত কোন নীল

দেখিতে পাওয়া বেলাভূমি এক প্রতিভাশালী সুরভ্রষ্টার প্রতিভার দানের মতো মহামধুর কুহকের সৃষ্টি করিত তাহার ভাবময় মনে-তখনই, এই সব সময়েই, তাহার মনে পড়িত এক ঘনবর্ষার রাতে, অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শব্দের মধ্যে এক পুরানো কোঠার অন্ধকার ঘরে, রোগশয্যাগ্ৰস্ত এক পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের মেয়ের কথা–

–অপু, সেরে উঠলে আমায় একদিন রেলগাড়ি দেখাবি?

মাঝেরপাড়া স্টেশনের ডিসট্যান্ট সিগন্যালখানা দেখিতে দেখিতে কতদূরে অস্পষ্ট হইতে হইতে শেষে মিলাইয়া গেল।

২৯ পর্ব শেষ 📌

🔴পর্ব :৩০🔴

দুপুরের পর রানাঘাট স্টেশনে গাড়ি বদল করিতে হইল। অপুর চোখে দু-দুবার কয়লার গুঁড়া পড়া সত্ত্বেও সে গাড়ির জানোলা দিয়া মুখ বাড়াইয়া সারাদিনটা বাহিরের দিকে চাহিয়া আছে। স্টেশনে স্টেশনে। ওগুলাকে কি বলে? সিগন্যাল? পড়িতেছে উঠিতেছে কেন? গাড়ি যেখানে লাগিতেছে সেখানটা উঁচুমতো ইটের গাথা, ঠিক যেন রোয়াকের মতো। তাকে প্ল্যাটফর্ম বলে? কাঠের গায়ে বড় বড় অক্ষরে ইংরাজি ও বাংলাতে সব স্টেশনের নাম লেখা আছে-কুড়ুলগাছি, গোবিন্দপুর, বানপুর। গাড়ি ছাড়িবার সময় ঘণ্টা পড়ে-ঢং ঢেং ঢেং ঢেং-চার ঘা-অপু গুনিয়াছে, একটা বড় লোহার চাকার চারিধারে হাতলপরানো, তাহাই ঘুরাইলে সিগন্যাল পড়ে-কুড়ুলগাছি স্টেশনে অপু লক্ষ করিয়া দেখিল।

সর্বজয়া এবার লইয়া মোটে দুইবার রেলে চড়িল। আর একবার সেই কোন কালে–উনি তখন নতুন কাশী হইতে আসিয়া দেশে সংসার পাতিয়াছেন-জ্যৈষ্ঠমাসে আড়ংঘটায় যুগলকিশোর ঠাকুর দেখিতে গিয়াছিল-সে কি আজকার কথা। সে খুশির সহিত স্টেশনে স্টেশনে মুখ লোকজনের ওঠা-নাম লক্ষ করিতেছিল—বউঝিরা উঠিতেছে নামিতেছে-কেমন সব চেহারা, কেমন কাপড়-চোপড়, গহনাপত্র। জগন্নাথপুর স্টেশনে ভালো মুড়ির মোয়া ফিরি করিতেছে দেখিয়া সে ছেলেকে বলিল-অপু, মুড়ির মোয়া খাবি? তুই তো ভালোবাসিস, নেবো তোর জন্যে? টেলিগ্রাফের তারের ওপর কি পাখি বসিয়া দোল খাইতেছে, অপু ভালো করিয়া চাহিয়া চাহিয়া আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল-দ্যাখো মা, কাদের বাড়ির খাঁচা থেকে একটা ময়নাপাখি পালিয়ে এসেচে।

নৈহাটি স্টেশনে গাড়ি বদলাইয়া গঙ্গার প্রকাণ্ড পুলটার উপর দিয়া যাইবার সময় সূর্য অস্ত যাইতেছিল, সর্বজয়া একপৃষ্টে চাহিয়া ছিল-ওপার হইতে হু হু বাতাস বহিতেছে, গঙ্গার জলে নৌকা, দুপারে কত ভালো ভালো বাড়ি বাগান, এ সব দৃশ্য জীবনে সে কখনও দেখে নাই। ছেলেকে দেখাইয়া বলিল-দেখেচিস অপু, একখানা ধোঁয়ার জাহাজ? পরে সে যুক্তকর কপালে ঠেকাইয়া আপন মনে বলিল-মা গঙ্গা, তোমার ওপর দিয়ে যাচ্চি, অপরাধ নিয়ো না মা, কাশীতে গিয়ে ফুলবিথিপত্রে তোমায় পুজো করবো, অপুকে ভালো রেখো, যে জন্যে যাওয়া তা যেন হয়, সেখানে যেন আশ্রয় হয় মা–

আনন্দে পুলকে, অনিশ্চিততার রহস্যে তার হৃদয় দুলিতেছিল-এরকম মনোভাব এর আগে সে কখনও অনুভব করে নাই। সুবিধায় হৌক, অসুবিধায় হৌক, অবাধ মুক্ত জীবনের আনন্দ সে পাইল এই প্ৰথম, তার চিরকালের বাঁশবনের বেড়া ঘেরা ক্ষুদ্র সীমায় বদ্ধ পল্পীজীবনে এরকম সচল দৃশ্যরাজি, এরকম অভিনব গতির বেগ, এত অনিশ্চয়ের পুলকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় কখনও হয় নাই—যে জীবন চারিধারে পাঁচিল দেওয়াল তুলিয়া আপনাকে আপনি ছোট করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা আজ চলিয়াছে, চলিয়াছে, সম্মুখে চলিয়াছে-ওই পশ্চিম আকাশের অস্তমান সূর্যকে লক্ষ করিয়ানদ-নদী, দেশবিদেশ-ডিঙাইয়া ছুটিয়াছে-এই চলিয়া চলার বাস্তবতাকে সে প্রতি হৃদয় দিয়া অনুভব করিতেছিল আজ।-এই তো সেদিন এক বৎসর আগেও নিশ্চিন্দিপুবের বাড়িতে কত রাত্রে শুইয়া যখনই সে ভাবিত, সুবিধা হইলে একবার চাকদা কি কালীগঞ্জে গঙ্গাস্নানে যাইবে, তখনই তাহা সম্ভবের ও নিশ্চয়তার বহু বাহিরের জিনিস বলিয়া মনে হইয়াছে।–আর আজ?

ব্যান্ডেল স্টেশনে গাড়ি আসিবার একটু আগে সম্মুখের বড় লাইন দিয়া একখানা বড় গাড়ি হু হু শব্দে ঝড়ের বেগে বাহির হইয়া চলিয়া গেল। অপু বিস্ময়ের সঙ্গে সেদিকে চাহিয়া রহিল। কি আওয়াজ!–উঃ! ব্যান্ডেল স্টেশনে পৌঁছিয়া তাহারা গাড়ি হইতে নামিল। এদিকে-ওদিকে এঞ্জিন দৌড়িতেছে, বড় বড় মালগাড়িগুলা স্টেশন কাঁপাইয়া প্রতি পাঁচমিনিট অন্তর না থামিয়া চলিয়া যাইতেছে। হৈ হৈ শব্দ-এদিকে এঞ্জিনের সিটির কানে-তাল-ধরা আওয়াজ, ওদিকে আর একখানা যাত্রীগাড়ি ছাড়িয়া যাইতেছে, গার্ড সবুজ নিশান দুলাইতেছে-সন্ধ্যার সময় স্টেশনের পূর্বে পশ্চিমে লাইনের ওপব এত সিগন্যাল ঝাঁকে ঝাঁকে-লাল সবুজ আলো জুলিতেছে-রেল, এঞ্জিন, গাড়ি, লোকজন!–

একটু রাত্রি হইলে তাঁহাদের কাশী যাইবার গাড়ি আসিয়া বিকট শব্দে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইল। বিশাল স্টেশন, বেজায় লোকের ভিড়-সর্বজয়া কেমন দিশেহারা হইয়া গেল।–তাড়া খাইয়া অনভ্যস্ত আড়ষ্ট পায়ে পায়ে স্বামীর পিছনে এখাখানা কামরার দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইতেই হরিহর অতিকষ্টে দুর্জয় ভিড় ঠেলিয়া বেপথুমান স্ত্রীকে ও দিশেহারা পুত্ৰকে কায়ক্লেশে গাড়ির বেঞ্চিতে বসাইয়া দিয়া কুলির সাহায্যে মোট–গাঁট উঠাইয়া দিল।

ভোরের দিকে সর্বজয়ার তন্দ্ৰা গেল ছুটিয়া। ট্রেন ঝড়ের বেগে ছুটিয়াছে-মাঠ, মাটি, গাছপালা একাকার করিয়া ছুটিয়াছে।–রাত্রের গাড়ি বলিয়া, তাহারা সকলে এক গাড়িতেই উঠিয়াছে-হরিহর তাহাকে মেয়ে-কামরায় দেয় নাই। গাড়িতে ভিড় আগের চেয়ে কম-এক এক বেঞ্চে এক একজন লম্বা হইয়া শুইয়া ঘুমাইতেছে। উপরের বেঞ্চে একজন কাবুলী নাক ডাকাইতেছে। অপু কখন উঠিয়া হ্যাঁ করিয়া জানোলা দিয়া মুখ বাহির করিয়া একদৃষ্টি চাহিয়া আছে।

হরিহর জাগিয়া উঠিয়া ছেলেকে বলিল-ওরকম করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে না। খোকা, এখখুনি চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়বে।–

কয়লার গুঁড়া তো নিরীহ জিনিস, চোখ দুটা যদি উপড়িাইয়া চলিয়াও যায়। তবুও অপুর সাধ্য নাই যে, জানালার দিক হইতে এখন সে চোখ ফিরাইয়া লইতে পাবে। সে প্রায় সারারাত্ৰি ঠায় এইভাবে বসিয়া। বাবা মা তো ঘুমাইতেছিল-সে যে কত কি দেখিয়াছে। কত স্টেশনে গাড়ি দাঁড়ায় নাই, আলো লোকজন সুদ্ধ স্টেশনটা বুশ করিয়া হাউইবাজির মতো পাশ কাটাইয়া উড়িয়া চলিয়া যাইতেছিল-রাত্রে কখন তাহার একটু তন্দ্ৰা আসিয়াছিল, হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া যাইতেই সে মুখ বাহির করিয়া দেখিল যে, গভীর রাত্রির জ্যোৎস্নায় রেলগাড়িখানা ঝড়ের বেগে একটা কোন নদীর ছোট সাঁকো পার হইতেছে-সামনে খুব উঁচু একটা কালোমতো টিবি, টিবিটার ওপরে অনেক গাছপালা, নদীর জলে জ্যোৎস্না পড়িয়া চিক চিক করিয়া উঠিল, আকাশে সাদা সাদা মেঘ-তারপর সেই ধরনের বড় বড় আরও কয়েকটা টিবি, আরও সেই রকম গাছপালা। তাহার পর একটা বড় স্টেশন, লোকজন, আলো-পাশের লাইনে একখানা গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিল–একজন পানওয়ালার সঙ্গে একটা লোকের যা ঝগড়া হইয়া গেল।-স্টেশনে একটা বড় ঘড়ি ছিল-সে তাহার মাস্টার মশায় নীরেনবাবুর কাছে গাড়ি দেখিতে শিখিয়াছিল, গুনিয়া গুনিয়া দেখিল রাত্রি তিনটা বাজিয়া বাইশ মিনিট হইয়াছে। তারপর আবার গাড়ি ছাড়িল-আবার কত গাছ, আবার সেই ধরনের উঁচু উঁচু টিবি-অনেক সময়ে রেলের রাস্তার দুধারেই সেইরকম টিবি-গাড়িতে সবাই ঘুমাইতেছে, ইহারা যদি কিছু দেখিবে না। তবে রেলগাড়ি চড়িয়াছে যে কোন! কাহাকে সে জিজ্ঞাসা করে যে অত টিবি কিসের? এক-একবার সে জানোলা দিয়া মুখ বাড়াইয়া বুকিয়া মাটির দিকে চাহিয়া নিবৃপণ করিবার চেষ্টা কবিতেছিল গাড়িখানা কত জোরে যাইতেছে- চুল বাতাসে উড়িয়া মুখে পড়ে, মাটি দেখা যায় না, যেন কে মাটির গায়ে কতকগুলি সরল রেখা টানিযা চলিয়াছে- উঃ! রেলগাড়ি কি জোরে যায়!—কৌতুহলে, উত্তেজনায় সে একবার এদিকের জানালায়, একবার ওদিকের জানালায় মুখ বাড়াইয়া দেখিতেছিল।

মাঝে মাঝে পূর্বদিকের দ্রুতবিলীয়মান অস্পষ্ট জ্যোৎস্নাভিরা মাঠের দিকে চাহিয়া চাহিয়া তাহার মনে হইতেছিল, কত দূরে তাহারা আসিয়াছে! এসব কোন দেশের উঁচু নিচু মাঠ দিয়া তাহারা চলিয়াছে?

সকালের দিকে সে আবার একটু ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, একটা প্ৰকাণ্ড স্টেশনে সশব্দে গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইতেই তাহার। তন্দ্ৰা দুটিয়া গেল-প্ল্যাটফর্মের পাথরের ফলকে নাম লেখা আছে– পাটনা সিটি।

তাহার পর কত স্টেশন চলিয়া গেল। কি বড় বড় পুল! গাড়ি চলিয়াছে, চলিয়াছে, মনে হয় বুঝি পুলটা শেষ হইবে না-কত ধরনের সিগন্যাল, কত কল-কারখানা, একটা কোন স্টেশনের ঘরের মধ্যে একটা লোহার থামের গায়ে চোঙ্‌লাগানো মতো।–তাহারই মধ্যে মুখ দিয়া একজন রেলের বাবু কি কথা কহিতেছে-প্রাইভেট নম্বর?…হ্যাঁ আচ্ছা-সিক্সটি নাইন-সিক্সটি নাইনহ্যাঁ?…ঊনসত্তর… ছয়ের পিঠে নয়-হ্যাঁ-হ্যাঁ–

সে অবাক হইয়া বাবাকে জিজ্ঞাসা করিল-ও কি কল বাবা? ওর মধ্যে মুখ দিয়ে ওরকম বলচে কেন?

তখন বেলা খুব পড়িয়া গিয়াছে, এমন সময় হরিহর বলিল-এইবার আমরা কাশী পৌঁছে যাবো, বাঁ দিকে চেয়ে থেকে, গঙ্গার পুলের উপর গাড়ি উঠলেই কাশী দেখা যাবে–

অপু একটা কথা অনেকক্ষণ ধরিয়া ভাবিতেছিল। আজ সে সারা পথ টেলিগিরাপের তার ও খুঁটি দেখিতে দেখিতে আসিতেছে–সেই একটিবার ছাড়া এমন করিয়া এর আগে কখনও দেখে নাই জীবনে। এইবার যদি সে রোল-রেল খেলার সুযোগ পায়, তখনই সে ওই ধরনের তারে খুঁটি বসাইবে। কি ভুলটাই করিত আগে! যেখানে যাইতেছে, সেখানকার বনে গুলঞ্চলতা পাওয়া যায় তো?

দিন পনেরো কাটিয়া গিয়াছে। বাঁশফট্‌কা গলির একখানা মাঝারি গোছের তেতলা বাড়ির একতলায় হরিহর বাসা লইয়া আছে। কোনো পূর্বপরিচিত লোকের সন্ধান সে মিলাইতে পারে নাই। আগে যাহারা যেসব জায়গায় ছিল, এখন সেসব স্থানে তাহদের সন্ধান কেহ দিতে পারে না। কেবল বিশ্বেশ্বরের গলির পুরাতন হালুইকর রামগোপাল সাহু এখনও বাঁচিয়া আছে।

বাড়ির ওপরের তলায় একজন পাঞ্জাবী সপরিবারে থাকে, মাঝের তলায় এক বাঙালি ব্যবসায়ী থাকে, বাইরের ঘরটা তার দোকান ও গুদাম-আশেপাশের দু’তিন ঘরে তার রন্ধন ও শয়নঘর।

এ পাঁচ ছয় দিনে সর্বজয়া নিকটবর্তী সকল জায়গা স্বামীর সঙ্গে ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিয়াছে। স্বপ্নেও কখনও সে এমন দৃশ্যের কল্পনা করে নাই,–এমন মন্দির! এমন ঠাকুর-দেবতা! এত ঘরবাড়ি! আড়ংঘাটার যুগলকিশোরের মন্দির এতদিন তাহার কাছে স্থাপত্য-শিল্পের চরম উৎকর্ষের নিদর্শন জানা ছিল–কিন্তু বিশ্বনাথের মন্দির?-অন্নপূর্ণার মন্দির? দশাশ্বমেধ ঘাটের ওপরকার লালপাথরের মন্দিরগুলা?

মধ্যে একদিন সে পাঞ্জাবী ভদ্রলোকটির স্ত্রীর সঙ্গে রাত্রে বিশ্বনাথের আরতি দেখিতে গিয়াছিল-সে যে কি ব্যাপার তাহা সে মুখে বলিতে পারে না। ধূপ-ধুনার ধোঁয়ায় মন্দির অন্ধকার হইয়া গেল-সাত-আটজন পূজারী একসঙ্গে মন্ত্র পড়িতে লাগিল—কি ভিড়, কি জাঁকজমক, কত বড় ঘরের মেয়েরা দেখিতে আসিয়াছিল, তাহাদের বেশভুষারই বা কি বাহার! কোথাকার একজন রানী আসিয়াছিলেন–সঙ্গে চার-পাঁচজন চাকরানী। দামি বারাণসী শাড়ি পরনে, সোনার কন্ধাবসানো আঁচলটা আরতির পঞ্চপ্রদীপের আলোয় আগুনের মতো জুলিতেছিল–কি টানা ডাগর চোখ-কি ভুবু কি মুখশ্ৰী-সত্যিকার রানী সে কখনও দেখে নাই-গল্পেই শুনিয়াছে-হ্যাঁ, রানীর মতো রূপ বটে! তাহাকে বেশিক্ষণ ধরিয়া দেখিয়াছে, কি ঠাকুরের আরতি বেশিক্ষণ দেখিয়াছে, তাহা সে জানে না।

ঠাকুর-দেবতার মন্দির ছাড়া এক-একখানা বসতবাড়িই বা কি!.দুর্গোৎসবের নিমন্ত্রণে নিশ্চিন্দিপুরের গাঙ্গুলি-বাড়ি গিয়া সে গাঙ্গুলিদের নাটমন্দির, দো-মহলা বাড়ি, বাঁধানো পুকুরঘাট দেখিয়া মনে মনে কত ঈর্ষান্বিত হইত—মনে আছে একবার দুৰ্গাকে বলিয়াছিল–দেখেচিস বড়লোকের বাড়িঘরের কি লক্ষ্মছিরি?—এখন সে যেসব বাড়ি রাস্তার দুধারে দেখিতেছে—তাহার কাছে গাঙ্গুলি-বাড়ি–

এত গাড়িঘোড়া একসঙ্গে যাইতে কখনও সে দেখে নাই। গাড়িই বা কত ধরনের! আসিবার দিন রানাঘাটে, নৈহাটিতে সে ঘোড়ার গাড়ি দেখিয়াছে বটে, কিন্তু এত ধরনের গাড়ি সে আগে কখনও দেখে নাই। দু-চাকার গাড়িই যে কত যায়!..তাহার তো ইচ্ছা করে পথের ধারে দাঁড়াইয়া দুদণ্ড এইসব দ্যাখে-কিন্তু পাঞ্জাবী স্ত্রীলোকটি সঙ্গে থাকে বলিয়া লজ্জায় পারে না।

অপু তো একেবারে অবাক হইয়া গিয়াছে। এরকম কাণ্ডকারখানা সে কখনও কল্পনায় আনিতে পারে নাই। তাদের বাসা হইতে দশাশ্বমেধ ঘাট বেশি দূর নয়, রোজ বিকালে সে সেখানে বেড়াইতে যায়। রোজই যেন চড়কের মেলা লাগিয়াই আছে। এখানে গান হইতেছে, ওখানে কথা হইতেছে, ওদিকে কে একজন রামায়ণ পড়িতেছে, লোকজনের ভিড়, হাসিমুখ, উৎসব, অপু সেখানে শুধু ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইয়া দেখে আর সন্ধ্যার পর বাড়ি আসিয়া মহাউৎসাহে গল্প করে।

কাহাদের চাকর একটি ছোট ছেলেকে কোমরে দড়ি বাঁধিয়া রোজ বেড়াইতে আনে, অপু ভাব করিয়াছে—তার নাম পল্টু, ভালো কথা কহিতে জানে না, ভারি চঞ্চল, তাই পাছে হারাইয়া যায় বলিয়া বাড়ির লোকেদের এই জেল-কয়েদির মতো ব্যবস্থা। অপু হাসিয়া খুন। চাকরকে অনুরোধ করিয়াছিল। কিন্তু সে ভয়ে দড়ি খুলিতে চাহে না। বন্দী নিতান্ত ক্ষুদ্র ও অবোধ-এ ধরনের ব্যবহার যে প্রতিবাদযোগ্য, সে জ্ঞানই তাহার নাই আসিলে সর্বজয়া রোজ তাহাকে বকে-একলা একলা ওরকম যাস কেন? শহর বাজার জায়গা, যদি রাস্তা হারিয়ে ফেলিস?…মায়ের আশঙ্কা যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, একথা সে মাকে হাত নাড়িয়া দুবেলা অধ্যবসায়-সহকারে বুঝায়।

কাশীতে আসিয়া হরিহরের আয়ও বাড়িল। কয়েক স্থানে হাঁটাহাঁটি করিয়া সে কয়েকটি মন্দিরে নিত্য পুরাণ-পাঠের কার্য জোগাড় করিল। তাহা ছাড়া একদিন সর্বজয়া স্বামীকে বলিল-দশাশ্বমেধ ঘাটে রোজ বিকেলে পুঁথি নিয়ে বোসো না কেন? কত ফিকিরে লোক পয়সা আনে, তোমার কেবল বসে বসে পরামর্শ আঁটা–

স্ত্রীর তাড়া খাইয়া হরিহর কাশীখণ্ডের পুথি লইয়া বৈকালে দশাশ্বমেধ ঘাটে বসে। পুরাণ পাঠ করা তাহার কিছু নতুন ব্যবসায় নহে, দেশে শিষ্য বাড়ি গিয়া কত ব্ৰতপার্বণ উপলক্ষে সে এ কাজ করিয়াছে। পুঁথি খুলিয়া সুস্বরে সে বন্দনা গান শুরু করে–

বৰ্হপীড়াভিরামং মৃগমদতিলকং কুণ্ডলাক্রান্তগণ্ডং।
…মিতসুভগামুখং স্বাধরে ন্যস্ত রেণুং
…ব্রহ্মগোপালবেশিং।

ভিড় মন্দ হয় না।

বাসায় ফিরিয়া বালির কাগজে কি লেখে। স্ত্রীকে বলে, শুধু শ্লোক পড়ে গেলে কেউ শুনতে চায় না-ওই বাঙালি কথকটার ওখানে আমার চেয়ে বেশি ভিড় হয়-ভেবেচি গোটাকতক পালা লিখবো, গান থাকবে, কথকতার মতোও থাকবে নৈলে লোক জমে না-বাঙালটার সঙ্গে পরশু, আলাপ হল, দেবনাগরীর অক্ষর-পরিচয় নেই, শুধু ছড়া কেটে মেয়ে ভুলিয়ে পয়সা নেয়…আমার রেকবি কুড়িয়ে ছ’আনা, আট আনা, আর ওর একটা টাকার কম নয়…শুনবে একটু কেমন লিখচি?

খানিকটা সে পড়িয়া শোনায়। বলে-ওই কথকের পুঁথি দেখে বনের বর্ণনাটা লিখে নেবো ভেবেচি—তা কি দেবে?

–তুমি কোনখানটায় বসে কথা বলে বল তো? একদিন শুনতে যেতে হবে–

–যেয়ো না, ষষ্ঠীর মন্দিরের নিচেই বসি-কালই যেয়ো, নূতন পালাটা বলবো, কাল একাদশী আছে দিনটা ভালো–

-আসবার সময় বিশ্বেশ্বরের গলির দোকান থেকে চার পয়সার পানফলের জিলিপি এনো দিকি অপুর জন্যে-সেদিন ওপরের খোট্টা বউ কি পুজো করে আমায় ডেকে নিয়ে গিয়ে জল খেতে দিলে, বল্পে, পানফলের জিলিপি, বিশ্বেশ্বরের গলিতে পাওয়া যায়, খেতে গিয়ে ভাবলাম অপু জিলিপি খেতে বড় ভালোবাসে-তা জল খেতে দিয়েচে আমি আর কি বলে নিয়ে আসি-এনো দিকি আজ চার পয়সার।

কয়েকদিন ধরিয়া হরিহরের কথকতা শুনিতে বেশ ভিড় হইতেছে। একখানা বড় বারকোশে করিয়া নারদঘাটের কালীবাড়ির ঝি বড় একটা সিধা আনিয়া অপুদের দাওয়ায় নামাইল। সর্বজয়া হাসিমুখে বলিল-আজ বুঝি বারের পুজো? উনি বাড়ি আসচেন দেখলে, হ্যাঁয়া ঝি? চলিয়া গেলে ছেলেকে ডাকিয়া বলিল-এদিকে আয় অপু-এই দ্যাখ! তোর সেই নারকেলের ফোঁপল-তুই ভালোবাসিস? কিশমিশ, কলা, কত বড় বড় আমি দেখেছিস, আয় খাবি, দিই-বোস এখানে

উৎসাহ পাইয়া হরিহর পুরাতন খাতাপত্রের তাড়া আবার বাহির করে। সর্বজয়া বলেধ্রুবচরিত্র শুনতে শুনতে লোকের কান যে ঝালাপালা হল, নতুন একটা কিছু ধরো না?

সারা সকাল ও দুপুর বসিয়া হরিহর একমনে জড়ভরতের উপাখ্যানকে কথকতার পালার আকারে লিখিয়া শেষ করে। মনে পড়ে এই কাশীতেই বসিয়া আজ বাইশ বৎসর পূর্বে যখন সে গীতগোবিদের পদ্যানুবাদ করে, তখন তাহার বয়স ছিল চব্বিশ বৎসর। দেশে গিয়া জীবনের উদ্দেশ্য যেন নিজের কাছে আরও পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। কাশীতে এত ছিল না-দেশে ফিরিয়া চারিধারে দাশূরায়ের গান, দেওয়ানজীর গান, গোবিন্দ অধিকারীর শুকসারীর দ্বন্দ্ব, লোকা ধোপার দলের মতি জুড়ির গানের বিস্তৃত প্রচলন ও পাসার তাহার মনে একটা নতুন ধরনের প্রভাব বিস্তার করিল।

রাত্রে স্ত্রীর কাছে গল্প করিত-বাজারের বারোয়ারিতে কবির গান হচ্ছে বুঝলে? বসে বসে শুনলাম, বুঝলে?…সোজা পদ সব.কিছুই না, রও না, সংসারটা একটু গুছিয়ে নিয়ে বসি ভালো হয়ে-নতুন ধরনের পালা বাঁধবো- এরা সকলে গায় সেই মান্ধাতার আমলের পদ-রাজুকে তাই কাল বলছিলাম।

অনেক রাত্রে উঠিয়া এক-একদিন হরিহর বাহিরে দাওয়ায় বসিয়া কি ভাবিত, অনির্দিষ্ট কোন আনন্দে তাহার মন যেন পালকের মতো হালকা হইয়া উঠিত।

কি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তাহার সম্মুখে!…

ঝাড়লন্ঠনের আলো-দোলানো বড় আসরে সে দেখিতে পায়, দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে তাহার ছড়া, গান, শ্যামাসংগীত, পদ রাত্রির পর রাত্রি ধরিয়া গাওনা হইতেছে। কত দূর-দূরান্তর হইতে মাঠ ঘাট ভাঙিয়া লোক খাবারের পুঁটুলি বাঁধিয়া আনিয়া বসিয়া আছে শুনিতে। দলের অধিকারীরা তাহার বাড়ি আসিয়া সাধিয়া পালা চাহিয়া লইয়া গিয়াছে।

বাঃ! ভারি চমৎকার তো। কার বাঁধা ছড়া?—‘কবির গুরু ঠাকুর হবু-’ হরু ঠাকুরের?– না। নিশ্চিন্দিপুরের হরিহর রায় মহাশয়ের।

এই দশাশ্বমেধ ঘাটেই বসিয়া তো বাইশ বৎসর পূর্বে মনে মনে কত ভাঙাগড়া করিয়াছেতারপর কবে সে সব ধীরে ধীরে ভুলিয়া গেল-কবে ধীরে ধীরে নতুন খাতাপত্রের তাড়া বাক্সের অনাদৃত, গুপ্ত কোণ আশ্রয় করিয়া দিনের আলো হইতে মুখ লুকাইয়া রহিল-যৌবনের স্বপ্নজাল জীবন-মধ্যাহ্নে কুয়াশার মতো দিগন্তে মিলাইয়া গেল।

হারানো যৌবনের দিকে চাহিয়া দেখিলে বুকের মধ্যে কেমন করিয়া ওঠে, কত কথা মনে পড়ে-জীবনের সে সব দিনকে আর একটিবারও ফেরানো যায় না?

দশাশ্বমেধ ঘাটে অনেক ছেলের সঙ্গে অপুর ভাব হইয়াছে। কিন্তু এখানে তাহার বয়সি সব ছেলেই স্কুলে পড়ে, সে-ই কেবল এখনও স্কুলে পড়ে নাই। নিশ্চিন্দিপুরে মাছ ধরিয়া ও নৌকায় বেড়াইয়া দিন কাটানো চুলিত বটে, কিন্তু এখানে সমবয়সিদের কাছে কিছু পড়ে না বলিতে লজ্জা করে।

তাহা ছাড়া দশাশ্বমেধ ঘাটে যেসব ছেলের সঙ্গে তাহার ভাব হইয়াছে, সবাই অবস্থাপন্ন ঘরের চলে। পল্টুর দাদা একদিন কথায় কথায় বলিয়াছিল যে তাহার বাবাকে খুব বিদেশে বেড়াইতে হয়। অপু বলিয়াছিল-কেন, তোমাদের বুঝি খুব শিষ্য-বাড়ি আছে?

পটুর দাদা আশ্চর্য হইয়া বলিল-শিষ্য-বাড়ি? কিসের ভাই?…

অপু সদুত্তর দিবার পূর্বেই সে বলিল-আমার বাবা কন্ট্রাক্টরি করেন কি না? তা ছাড়া কাঁথিতে ছোট জমিদারি আছে- তবে আজকাল কিস্তি দিয়ে কী-ই বা থাকে?

এক-একদিন বৈকালে অপু দশাশ্বমেধ ঘাটে বেড়াইতে গিয়া বাবার মুখে পুরাণপাঠ শোনে। হরিণশিশু শ্বাপদ কর্তৃক নিহত হইলে হরিণ-বালকের স্নেহাসক্ত রাজর্ষি ভারতের করুণ বিরহবেদনা ও পরিশেষে তাহার মৃত্যুর কাহিনী ষষ্ঠী মন্দিরে পৈঠার উপর বসিয়া একমনে শুনিতে শুনিতে তাহার চোখে জল আসে-এদিকে আবার যখন সিন্ধু সৌবীরের রাজা রঘুগণ তাঁহার স্বরূপ না জানিয়া ব্ৰহ্মার্ষি ভরতকে শিবিকাবাহক নিযুক্ত করেন-তখন হইতে কৌতুহলে ও উৎকণ্ঠায় তাহার বুক দুবু দুরু করে, মনে হয় এইবার একটা কিছু ঘটিবে; ঠিক ঘটবে। কথকতার শেষে পূরবী সূরের আশীৰ্বাচনটি তাহারা ভারি ভালো লাগে–

কালে বৰ্ষতৃ পর্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী
লোকাঃ সন্তু নিরাময়াঃ…

সন্ধ্যার দিকে মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খ ঘণ্টার ধ্বনির সঙ্গে অস্তসূর্যের রাঙা আভা ও পূরবীর মুৰ্দ্ধনার সঙ্গে হরিণ-বালকের বিয়োগবেদনাতুর রাজর্ষির ব্যথা যেন মিশাইয়া থাকে।

বাড়িতে কাগজ কলম বাবার কাছে লইয়া গিয়া বলে-আমায় লিখে দাও না বাবা, ওই যে তুমি গাও-কালে বৰ্ষতু পর্জন্যং?

হরিহর খুশি হইয়া বলে-তুই বুঝি শূনসি খোকা?

-আমি তো রোজই থাকি।–তুমি কাল যখন ভারতের মা মারা যাওয়ার কথা বলছিলে আমি তখন তো তোমার পিছন দিকে বসে-ষষ্ঠীর মন্দিরের ধাপে–

–তোর কি রকম লাগে।–ভালো লাগে?

–খু-উ-উ-ব। আমি তো রোজ রোজ শুনি—

অপু কিন্তু একটা কথা লুকায়। যেদিন তাহার সঙ্গীরা থাকে, সেদিন কিন্তু বাবার দিকে সে যায় না। সেদিন বাবার নিকট দিয়া যাইতেছিল, তাহার বাবা দেখিতে পাইয়া ডাকিল।–খোকা, ও খোকা–

তাহার সঙ্গের বন্ধুটি বলিল-তোমাকে চেনে নাকি?

–অপু শুধু ঘাড় নাড়িয়া জানায়, হ্যাঁ। সে বাবার কাছে আসে নাই সেদিন। তাহার বাবা ঘাটে কথকতা করিতেছে, একথা বন্ধুরা পাছে টের পায়! সে পল্টুর দাদা ছাড়া অন্য বন্ধুদের কাছে গল্প করিয়াছে, কাশীতে তাহদের বাড়ি আছে, তাহারা কাশীতে হাওয়া বদলাইতে আসিয়াছে, দেশে খুব বড় বাড়ি, তাহার বাবা কন্টট্রাক্টরি করেন, তা ছাড়া দেশে জমিদারিও আছে। শেষে বলে-কিন্তু জমিদারি থাকলে কি হবে, কিস্তি দিযে কীইবা থাকে?

তাহার বন্ধুদের বয়স তাহার অপেক্ষা খুব বেশি নয় বলিয়াই বোধ হয় তাহার বর্ণিত গল্পের সঙ্গে তাহার পোশাক-পরিচ্ছদের অসঙ্গতি ধরা পড়ে না, বিশেষত তাহার সুন্দব মুখের গুণে সব মানাইয়া যায়।

পর্ব ৩০ শেষ 📌 চলবে