পথে হলো দেখা পর্ব-০৭

0
9

#পথে_হলো_দেখা (৭)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আদুরীকে যেহেতু বাহিরে লোকজন খুঁজছে সেজন্য সে ট্রাকের বাহিরে বের হচ্ছে না। যতই টগর সাহস দিক, আদুরীর এতটুকু সাহস নেই তাদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর। সাহসের সঙ্গে বলা চলে বিন্দু পরিমান ইচ্ছেও নেই। তবে দিনটি কোনরকম কেটে গেলেও, রাতটা বেশ বোরিং লাগছে আদুরীর। টগরের সঙ্গে গল্প করতে করতে গল্পও ফুরিয়ে গিয়েছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে টগর বলে,“চলো এক কাজ করি।”

“কী কাজ?”
আদুরীর প্রশ্নে টগর জবাব না দিয়ে নিচে নামে। জামালকে সামনে থেকে ডেকে নিয়ে আসে টগর। তিনজন একত্র হলে টগর জামালের ফোন থেকে লুডু বের করে বলে,“চলো তিনজনে মিলে লুডু খেলি।”

“হ্যাঁ করা যায়। কতক্ষণ সামনে বসে ফোনে গান শুনিয়ে কাটাবো। খুবই বোরিং লাগছিলো।”
জামালের সম্মতি পেয়ে টগর আদুরীর জবাবের জন্য অপেক্ষা করে। আদুরীও রাজি হয়। তিনজনে মিলে লুডু খেলতে শুরু করে। প্রথমদিকে আদুরী ভালো খেললেও পরবর্তীতে ভালো পারছে না। তার দান ভালো পড়ছে না। জামাল এবং টগর আদুরীর এই বেহাল দশার বেশ মজা নিচ্ছিলো। আদুরী তাদের মজা নেওয়া দেখে মনমরা হয়ে যায়। এটা দেখে টগর জামালকে কিছু একটা ইশারা করে। জামাল রাজি নাহলে টগর ইশারায় অনুরোধ করে। জামাল রাজি হয়। অতঃপর দু’জনে মিলে নিজেদের গুটির উল্টাপাল্টা দান দেয়। যার ফলে আদুরী জিতে যায়। আদুরী জিতে গিয়ে সেই খুশি হয়। সে তো খুশিতে চিৎকার করে উঠে। টগর এবং জামাল মুচকি হেসে বলে,“আস্তে।”

“হ্যাঁ?”
আদুরী বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। টগর বলে,“আস্তে চিৎকার করো।”
আদুরী বুঝতে পেরে লজ্জা পায়। সে একটু বেশিই জোরে চিৎকার করে উঠেছে। তার লজ্জারাঙা মুখ দেখে টগর মুচকি হাসে। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেলে আদুরী বলে,“আপনারা ইচ্ছাকৃত আমাকে বিজয়ী বানিয়ে দিলেন তাই না?”

টগর না সূচক মাথা নাড়ালেও জামাল হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ায়। আদুরী অবাক হয়ে দু’জনার দিকে তাকায়। অতঃপর তিনজনেই হেসে দেয়। তারা তিনজন আবার এক দান খেলার সিদ্ধান্ত নেয়।যেমন কথা তেমন কাজ। তারা খেলার মাঝ পর্যায়ে ছিলো। সেই মূহুর্তে আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায়। রাতের বৃষ্টিময় আকাশ ফুটে উঠতে টগর বলে,“বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। চলো সামনে যাই।”

সবাই মাথা নাড়ায়। তবে আদুরী প্রথমে নামে না। সে বৃষ্টির আগ মূহুর্তের রাতের আকাশটাকে উপভোগ করতে শুরু করে। সেটা বুঝতে পেরে টগর বলে,“মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলে সামনে যাবার সময় পাবে না। তাই নিচে নেমে যা উপভোগ করার করো।”
আদুরী মাথা নাড়ায়। সে নিচে নামে। অতঃপর দু’হাত মেলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।

আকাশজুড়ে গাঢ় মেঘের চাদর, যেন কালি দিয়ে আঁকা কোনো বেদনার ক্যানভাস। চাঁদ দেখা যায় না—তবে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, আলোর কোনো ক্ষীণ আভা মাঝে মাঝে মেঘের ফাঁকে ভেসে ওঠে। এমন এক মূহুর্তে আদুরী তার মুখে দুই এক ফোঁটা বৃষ্টির স্পর্শ পায়। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। তবে এই রাতে বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না। সেজন্য আদুরী ট্রাকের সামনে উঠে পড়ে। জামাল এবং টগর কিছুটা গায়ে লেগে বসে। তারা আদুরীকে স্বাচ্ছন্দে বসার জায়গা দিতেই এটা করে। আদুরী গাড়িতে বসেও জানালা দিয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছে। জানালার কাচটা জামাল বন্ধ করতে চাইলে আদুরী বলে,“থাকুক না এটা খোলা।”

অতঃপর জামাল বন্ধ করে না। টগর এক দৃষ্টিতে আদুরীর দিকে তাকিয়ে আছে। আর আদুরী বাহিরে।

চারদিকে এক ধরনের কুয়াশাভেজা অন্ধকার, যেন রাত নিজেই ভিজে গেছে বৃষ্টির কণায় কণায়। বৃষ্টি টুপটাপ ঝরে, কখনো হালকা, কখনো মুষলধারে—সেই শব্দই যেন রাতের একমাত্র সঙ্গীত। দূরে কোথাও বিদ্যুতের ঝলকানি, এক মুহূর্তের জন্য আকাশ আলোকিত করে, যেন কোনো দুঃখিনী নারী চোখ মেলে তাকালেন।

এমন রাতে বাতাসটাও ভারি—শীতল, স্নিগ্ধ, জড়ানো এক বিষণ্নতা নিয়ে। বাতাস আদুরীর গায়ে লাগতে শরীরে এক শীতল ভাব অনুভব হয়। জানালার কাচ বেয়ে বৃষ্টির পানি ভেতরে আসতে জামাল সেটা বন্ধ করে দেয়। তারপর বলে,“এখন এভাবে দেখো। তাছাড়া উপায় নাই।”
আদুরী মাথা নাড়ায়। টগর এবং জামালকে একবার দেখে নিয়ে মনেমনে বলে,“কোন এক বর্ষা মৌসুমে গন্তব্যহীন পথে এক ট্রাক এবং দু’টি মানুষ হয়ে ওঠে এক আদরহীন আদুরীর সবচেয়ে নির্বরতার জায়গা।”

আদুরী কথাগুলো ভাবতে মুচকি হাসি দেয়। আড়চোখে বারবার টগরকে দেখে। নীল সবুজের মিশ্রনে তৈরি একটি লুঙ্গি পড়ে আছে টগর। যে লুঙ্গিতে নীল সবুজের মাঝে ধূসর বর্নটাও জায়গা করে নিয়েছে। সঙ্গে হাফ হাতা একটি কালো রঙের গঞ্জি গায়ে। মুখশ্রী আবৃত তার খোচা খোচা দাঁড়িতে। সব মিলিয়ে টগরকে এই মূহুর্তে আদুরীর কাছে অসাধারণ লাগছে। আদুরী বুঝতে পারে তার হৃদয় টগরকে অন্য নজরে দেখছে। সেজন্যই তো বারবার এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। টগরও আদুরীর তাকানো লক্ষ্য করে মুচকি হাসি। অতঃপর তিনজন সামনে বসে গল্প করতে শুরু করে। গল্পের সঙ্গে বৃষ্টি শেষ হওয়ার অপেক্ষাও তারা করছে। তবে বৃষ্টি শেষ হওয়ার নাম নিচ্ছে না। গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে আদুরী টগরকে নিয়ে তার কল্পনার জগতে এক অন্যরকম রঙীন গল্প সাজায়। সেই রঙীন স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত অবস্থায় মাথাটা হেলিয়ে টগরের কাধে পড়ে। জামাল টগরকে একটু ঠেলে আদুরীর আর একটু কাছে পাঠায়। তারপর বলে,“ভালোভাবে মাথাটা কাধে রাখতে দে। নয়তো ভালো ঘুম হবে না আদুরীর।”

টগর কোন কথা বলে না। সে চুপচাপ আদুরীর মাথাটা কাধে রেখে তাকে দেখতে থাকে। জামাল শান্ত গলায় বলে,“তবে তোর ছন্নছড়া জীবনের একটি গতি হচ্ছে?”

“একটু বেশি ভাবছো না?”
টগরের এই প্রশ্নে জামাল নাসূচক জবাব দেয়। সে স্বাভাবিক গলায় বলে,“বেশি ভাবছি না। তোরা দুজনেই একা। তোদের দুজনকে মানাবে ভালো। সকালে আমি তোদের বিয়ের কথা বলে যে ভুল বলিনি একদিন তোরা দুজনেই এই কথাটি স্বীকার করবি। দেখে নিস।”

“আচ্ছা দেখা যাবে।”
টগর এটা বললে জামাল মুচকি হাসে। মনেমনে বলে,“হয়তো নিয়তিও তোদের এক করতে চাইছে। নয়তো ট্রাকটা এখানে নষ্ট হওয়ার ছিলো? ট্রাকটা চলতো। সকালে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যেতাম, আদুরী সেখান থেকে বিদায় নিতো। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। তাছাড়া তোদের দুজনার চোখাচোখি তো ভিন্নরকম ইঙ্গিত দেয়। কথা বলে না তেল আর জল একসাথে রাখতে নেই। বিষয়টি তেমনই। বিপরীত লিঙ্গের দুজন মানুষ একসঙ্গে থাকলে। একসঙ্গে অনুভূতি জন্মানোর মতো সময় কাটানোর সুযোগ পেলে অনুভূতি তো জাগবেই।”
এসব ভেবে জামাল মুচকি হাসে। ফোন চেক করে দেখে তাতে চার্জ সীমিত সেই সাথে নেটওয়ার্কও নেই। তবুও স্ত্রীর উদ্দেশ্য একটি ম্যাসেজ পাঠায় জামাল। নেট এলে চলে যাবে এই আশায়। যদিও তার স্ত্রী জানে সে গাড়ি নিয়ে মাঝরাস্তায় আটকে আছে। তবুও ফোন বন্ধ হয়ে গেলে। তাতে তাকে না পেলে স্ত্রী চিন্তা করবে। সেজন্যই ম্যাসেজ পাঠিয়ে রাখা।

একটি ঝড়বৃষ্টিময় রাতের আধার কেটে সকালে মিষ্টি রোদের দেখা মেলে। সেই মিষ্টি রোদের আলো কাচ ভেদ করে আদুরীর গায়ে পড়তে সে চোখ মেলে তাকায়। তার ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে নিজেকে কারো গায়ের উপর অনুভব করতে আদুরী হচচকিয়ে যায়। সে ছিটকে দূরে যায়। অতঃপর টগরকে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচে। টগর এবং জামাল এখনো ঘুমে মগ্ন। তাদের ঘুমন্ত অবস্থা দেখে আদুরী নিজের দিকে তাকায়। অতঃপর মনেমনে বলে,“দু’টো ছেলের সঙ্গে আমি দুইটি রাত কাটিয়ে দিলাম। এটা যদি লোকে জানে তাহলে তারা আমার চরিত্রকে কিভাবে দেখবে?”
এই প্রশ্নটি মাথায় ঘুরতে আদুরীর মুখটা শুকিয়ে যায়। পরক্ষণে কিছু একটা মনে পড়তে আদুরী বিরবির করে বলে,“পেটে ভাত না থাকলে তো লোক খোঁজ নেয় না। এই অসহয় অবস্থায় তো তারা কেউ আমাকে নিজেদের ঘরে জায়গা দিতো না। তাহলে যারা দিচ্ছে তাদের জড়িয়ে কেন মান নিয়ে টানাটানি করবে? এই অধিকার আমরা সমাজকে কেন দেই?”
একটু থেমে পরক্ষণে বলে,“আদৌ দেই আমরা নাকি তারা নিজেরা অধিকার বানিয়ে নেয়।”
এসব ভেবে আদুরী একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর আপনমনে বলতে থাকে,“যত যাই বলি বাস্তব তো এটাই দু’টো ছেলের সঙ্গে একসঙ্গে রাত পার করেছি, এই কথাটা শুনতেই তো অন্যরকম মনে হয়। যতই কোন খারাপ সম্পর্ক না থাকুক। কিন্তু আমার কি আর কোন উপায় আছে? এই গন্তব্যহীন পথে, অসহায়ত্বের সঙ্গে লড়াই করার মতো সামর্থ্য তো নেই। তাহলে লোকের কথা এত কেনই বা ভাবছি? নিজের কাছে নিজে ঠিক থাকলেই তো হলো।”


চলবে,