#পথে_হলো_দেখা (৮)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
সারারাত টানা বৃষ্টির পর সকালে যখন রোদ ওঠে, তখন চারপাশে একধরনের নির্মল, ধোয়া-মুছা পরিবেশ তৈরি হয়। রাতভর বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া পৃথিবীটা যেন সকালে নতুন এক চেহারা পায়।
রাস্তার ধারে গাছপালাগুলো ঝকমকে সবুজ, পাতার ফাঁকে এখনও জলের কণা ঝুলে আছে, রোদের আলো পড়তেই সেগুলো মুক্তোর মতো ঝিলমিল করে। কোথাও কোথাও গাছের ডাল থেকে একফোঁটা জল টুপ করে পড়ে নিচে, কানে এক মিষ্টি শব্দ বাজে।
রাস্তাগুলো ভেজা, কিছু জায়গায় ছোট ছোট জলকাদা জমে আছে, কিন্তু রোদের আলোয় সে জলেও রূপালি ঝিলিক। পাখিরা ডাকে—সারারাতের নিরবতা কাটিয়ে যেন তারাও দিন শুরু করেছে। বাতাসে এখনও ভিজে মাটির গন্ধ, যার সঙ্গে মিশে আছে একধরনের প্রশান্তি।
এমন এক মিষ্টি পরিবেশকে পিচ ঢালা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আদুরী উপভোগ করছিলো। এই রকম প্রশান্তিময় সকালে হাঁটতে হাঁটতে আদুরীর মনে হয়, যে পৃথিবী রাতে একটু থেমে গিয়েছিলো, আর এখন নতুন করে শ্বাস নিচ্ছে। রোদে ভেজা, বৃষ্টির ধোঁয়া, সতেজ এক সকাল। অপরূপ এই প্রকৃতির রূপ। যা আদুরীকে মুগ্ধ করে। তার ভয়ময় জীবনকে ভয়কে হারিয়ে উপভোগ করতে শেখায়। আদুরী খুব মুগ্ধ হয়ে পরিবেশটিকে উপভোগ করছিলো, আর পাশে স্যান্ডো গেঞ্জি এবং নীল, সবুজ, ধূসরের মিশ্রিত লুঙ্গি পরীহিত টগর হাতে একটি সিগারেট ধরিয়ে সেটায় টান দিয়ে উপভোগ করতে থাকে। শ্যামবতী আদুরীর সৌন্দর্যের কাছে টগরের এই সিগারেটের স্বাদ খুবই নগণ্য মনে হচ্ছে। তবুও একসঙ্গে দু’টো বিষয়ই টগর উপভোগ করছে। সতেজ এক সকালে লাল রঙের একটি বেনারসি বাঙালি বধুদের মতো কুচিহীন পড়ে রয়েছে আদুরী। মাথায় ঘন কালো চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছি। মৃদু বাতাসে চুলগুলো হালকা করে উড়ছে। আশেপাশের প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যও আদুরীর এই সৌন্দর্যের কাছে হার মানছে বলে মনে হচ্ছে টগরের। টগর ধীরে ধীরে আদুরীর পাশে এসে দাঁড়ায়। আড়চোখে আদুরীর মুখশ্রী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টগর বিরক্তির নজরে তাকায়। তার বিরক্তির কারণ হলো আদুরীর সামনের ছোট ছোট চুলগুলো বাতাসে তার মুখের উপর পড়ছে। যার জন্য আদুরীর সুন্দর মুখশ্রী দেখতে টগরের অসুবিধা হচ্ছে। অতঃপর কাঁপা কাঁপা হাতে কিছুটা ভয় নিয়ে টগর তার কপালে পাশ দিয়ে ছোট চুলগুলোতে হাত দেয়। টগরের স্পর্শ পেয়ে আদুরী কেঁপে উঠে। সে চোখটা আলতো করে ঘুরিয়ে টগরকে দেখে নেয়। আদুরীকে চুপ দেখে টগর কিছুটা সাহস পায়। তার ভয় কেটে যায়। অতঃপর নির্ভয়ে আদুরীর চুলগুলো কানের পাশে গুজে দেয়। আদুরী এবং টগর আড়চোখে একে-অপরকে দেখে। দু’জনে একে-অপরকে গভীর নজরে দেখে যাচ্ছিলো। সেই মূহুর্তে কারো চিৎকারের শব্দে দুজনে হচচকিয়ে যায়।
আদুরী তার ডান পাশে লক্ষ্য করলে দেখে দু’টো ছেলে তার দিকে তেড়ে আসছে। আদুরী বুকের ভেতর ভয় বাসা বাধা। এরা জামালের বলা সেই লোকগুলো নয়তো। এটা ভেবে আদুরী ভয়ে উল্টো দিকে দৌঁড় দিয়ে বলে,“না। আমি যাবো না। আমি যাবো না।” এটা বলে দৌঁড় দেয়। কিছুটা যেতে শাড়ীর সঙ্গে পা বেজে নিচে পড়ে যায় আদুরী।
“আদুরী!”
টগর চিৎকার দিয়ে বলে। সে ছুটে আদুরীর কাছে আসে। আদুরী মাঝ রাস্তায় উপর হয়ে পড়ে আছে। টগর এসে তাকে ধরে। আদুরী ভয়ে ছেলে দুটোর দিকে তাকায়। ছেলে দুটো আদুরীর কাছাকাছি আসতে আদুরী টগরের বুকের পাশে থাকা গেঞ্জির অংশ শক্ত করে ধরে নেয়। টগর বিষ্ময়ের নজরে একবার আদুরীর দিকে তাকায়, আর একবার ছেলে দুটোর দিকে। ছেলে দুটো দৌঁড়ে তাদের ছাড়িয়ে যেতে টগর বুঝতে পারে এরা অন্য ঘটনার জন্য ছোটাছুটি করছে। কিন্তু আদুরী তখনো বুঝতে পারেনি। কিভাবে বুঝবে সে তো ভয়ে টগরের বুকে মাথা দিয়ে আছে, সেই সঙ্গে চোখ বন্ধ। আস্তে করে ভয়মিশ্রিত কন্ঠে আদুরী বলে,“টগর আমি যাবো না।”
”আদুরী?”
টগরের ডাকে আদুরী সাড়া না দিয়ে একই কথা বলে। অতঃপর টগর কিছুটা জোরেই বলে,“আদুরী?”
আদুরী হচচকিয়ে যায়। সে টগরের দিকে তাকায়। টগর স্বাভাবিক গলায় বলে,“ওরা তোমাকে নিতে আসেনি। ওরা চলে গেছে।”
এই কথা শুনে আদুরী হাফ ছেড়ে বাঁচে। তার বুকের ভেতর দিয়ে অনেক বড় একটি বোঝা নেমে যায়। টগর আদুরীর ভয় কাটানোর জন্য মজা করে বলে,“পৃথিবীর ছেলেদের খেয়েধেয়ে কাজ নাই তো। তারা সবাই তোমাকে খুঁজবে।”
টগরের মজা বুঝতে পেরে আদুরী ম্লান হাসে। অতঃপর টগর উঠে আদুরীর হাত ধরে তাকে উঠাতে নিলে আদুরী ব্যাথায় ‘আহ’ করে উঠে। টগর উৎকন্ঠা হয়ে বলে,“কী হলো?”
একটু থেমে পরক্ষণে আদুরীর হাত দেখতে দেখতে বলে,“দেখি দেখি। কি হলো।”
টগর দেখে আদুরী পিচ ঢালায় রাস্তায় পড়ে যাওয়া তার হাতের তালুতে বেশ কিছুটা চামড়া ঘষা খেয়েছে। পুরো হাত লালচে হয়ে রয়েছে। টগর ব্যস্ত গলায় বলে,“এভাবে কেউ দৌঁড়ায়? দেখলে হাতটার কি করলে। এখন এই মাঝরাস্তায় ডাক্তার কোথায় পাই?”
”ডাক্তার লাগবে না। এটা এমনি সেড়ে যাবে।”
আদুরীর কথায় টগর ধমক দিয়ে উঠে। সে বলে,“হ্যাঁ এসেছেন আমার সব জান্তা মহারানি। এটায় কিছু হবে না, বললেই হলো?”
টগরের এমন কথা শুনে আদুরী চুপ হয়ে যায়। টগর আদুরীকে ধরে সাবধানে ট্রাকে বসায়। তারপর পানির বোতল বের করে হাতে পানি দেয়। পানি দেওয়ার সময় আদুরীর হাতে জ্বালা করায় সে চিৎকার দেয়। তখন টগর হাতে ফু দিতে শুরু করে। আদুরী দেখে টগর খুব যত্ন নিয়ে তার হাতে অল্প পানি দিচ্ছে এবং ঘন ঘন ফু দিচ্ছে। তার এই যত্ন আদুরীকে মুগ্ধ করে। আদুরী মনেমনে বলে,“একদিনের পরিচয়ে কেউ কারো জন্য এতটা উৎকন্ঠা হতে পারে?”
একটু থেমে পরক্ষণে নিজেই বলছে,“পারে তো। আমার হৃদয়ও তো তার জন্য ব্যকুল হচ্ছে।”
এটা বলে আদুরী আপনমনে হাসে। পরক্ষণে মুখটা মলিন হয়ে যায়। সে মনমরা কন্ঠে মনেমনে বলে,“আচ্ছা এই ব্যাকুলতার সমাপ্তি কি ততটাই সুন্দর হবে যতটা সূচনা সুন্দর ছিলো।”
তাদের এই কর্মকান্ডের মাঝে জামাল সকালের নাস্তা নিয়ে আসে। সে টগরের হাতে নাস্তা দিয়ে বলে,“দুজনে খেয়ে নাও। আর টগর ফোনটা দে। আমার ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে।”
টগর মাথা নাড়িয়ে তার ফোনটা দেয়। জামাল ফোনটা হাতে নিয়ে বলে,“ভালো খবর আছে। গ্যারেজ মাত্র খুলেছে।”
“সত্যি?”
টগর খুশি হয়ে বলে। জামাল মাথা নাড়ায়। যার অর্থ হ্যাঁ। টগর বলে,“তাহলে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসোনি কেন?”
“এতদূর আসতে চাচ্ছে না। যাও বা আসতে চাইছে তাতে অনেক টাকা চাচ্ছে। সেজন্যই তো তোর ফোনটা নিলাম। এটা মালিককে জানিয়ে টাকা পাঠাতে বলতে হবে। টাকা তুলে একসঙ্গে গ্যারেজের লোক নিয়ে আসবো। তোরা ততক্ষণ এখানে থাক।”
এই কথা বলে জামাল চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে টগর বলে,“আমি আসবো? একা সবটা সামলাতে পারবে?”
জামাল একবার টগর এবং আদুরীর দিকে তাকায়। তারপর শান্ত গলায় বলে,“পারবো। তোমরা যা করছিলে সেটাই মনোযোগ দিয়ে করো।”
কথাটি বলে মুচকি হাসি দিয়ে জামাল চলে যায়। টগরও ম্লান হাসে। অতঃপর খাবারটা বের করে আদুরীর দিকে তাকিয়ে বলে,“তোমার হাতের অবস্থা তো ভালো না। এবার খাবে কিভাবে?”
এই প্রশ্নের জবাবে আদুরী মিষ্টি হেসে বলে,“আপনার অসুবিধা না থাকলে আপনি আমাকে খাইয়ে দিবেন?”
টগর এই কথা শুনে মনেমনে ভীষন খুশি হয়। সে মাথা নাড়ায়। আদুরীও খুশি হয়। অতঃপর টগর পলিথিন থেকে পরোটা এবং ভাজি বের করে, একটি পরোটা হাতে নিয়ে সেটা ছিড়ে ভাজি নিয়ে আদুরীর মুখের দিকে ধরে। আদুরী সেটা মুখে নেয়। অনেকটা ধৈর্য, সময় এবং যত্ন নিয়ে টগর আদুরীকে খাওয়ায়। সময়টা বেশি ইচ্ছে করেই নিয়েছে টগর। কারণ এটা তার কাছে অন্যরকম এক অনুভূতি ছিলো। অবশ্যই অনুভূতিটা ভালো লাগার। এটাকে আরও ভালো লাগাতে একটু বেশি সময় নিয়েছে টগর।
★
গ্যারেজে গ্যারেজ মালিক এবং তার এক সহকারী আকাশ বসে ছিলো। মালিক অন্য এক কাজে অন্য দোকানে আকাশকে বলে চলে যায়। আকাশ মাথা নাড়িয়ে নিজের কাজ করে। সেই সময়ে দুজন লোক আসে আকাশের কাছে। আকাশ শান্তভাবে বলে,“কিছু বলবেন?”
“এই মেয়েটাকে দেখেছো?”
একটি ছেলে আদুরীর ছবি বের করে জিজ্ঞেস করে। আকাশ ছবিটি ভালোভাবে দেখে বলে,“না তো। এই মেয়েটাকে দেখিনি। কিন্তু আপনারা কারা? এই মেয়েটাকে খুঁজছেন কেন?”
আকাশের এই কথার জবাব না দিয়ে ছেলে দুটো বলে,“আমাদের নাম্বার রাখো। যদি একে কখনো দেখো তাহলে ফোন দিও। চিন্তা করো না। এর জন্য তোমরা টাকাও পাবে। যে খোঁজ দিতে পারবে তাকেই পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হবে।”
“কি! শুধুমাত্র মেয়েটাকে দেখলে, কোথায় দেখেছি এতটুকু জানালেই পাঁচ হাজার টাকা দিবেন?”
আকাশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে। ছেলে দুটো মাথা নাড়ালে আকাশ একটু সন্দেহ করে বলে,“আপনারা কারা? মেয়েদের বিক্রি করে যে খারাপ লোক তারা নন তো?”
এই কথা শুনে ছেলে দুটো বিরক্ত হয়। অতঃপর আস্তে করে পুরো বিষয়টা আকাশকে বোঝায়। আকাশ সবটা বুঝে বলে,“আচ্ছা দেখলে জানাবো। ফোন নাম্বার দিয়ে যান। তবে হ্যাঁ জানানোর পর আবার টাকা নিয়ে নখরা করবেন না।”
’
’
চলবে,