#পথে_হলো_দেখা (৯)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
একটু পুকুরের পাড়ে সবুজ শাড়ীতে বসে আছে আদুরী। একটি একটি নির্জন বাগান। যার চারপাশে ঘন সবুজ গাছপালা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, যেন যুগ যুগ ধরে কারও পথ চেয়ে আছে। পুরনো আমগাছ, কদম, শিরীষ ডালপালা বিস্তার করে আকাশ ছুঁয়েছে, তাদের ছায়ায় সূর্যের আলো ফাঁকি খেলতে খেলতে মাটিতে পড়ে। বাগানের মাঝখানে রয়েছে একটি পাথরের পুকুর। যার জলে ধ্যানমগ্ন জলপিপি আর ছায়া পড়া আকাশ। অপরূপ এই পুকুরের পাড়ে বসে পানিতে পা দুলাচ্ছে শ্যামবতী আদুরী। যার পড়নে সবুজ রঙের একটি শাড়ী। সবুজ গাছপলার মাঝে সবুজ রঙে রাঙানো এক নারী। এ যেন সবুজে সবুজে সমরোহ। আদুরীর চোখে কালো কাজল, ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক আর কপালে ছোট একটি লাল সবুজের মিশ্রনে পড়া টিপ। সবকিছু মিলিয়ে তাকে চমৎকার লাগছে। সেই সঙ্গে কোমর অব্দি ছেড়ে দেওয়া ঘন কালো চুল। আদুরী যেহেতু বসে আছে সেজন্য তার চুলগুলো মাটি ছুয়ে নিয়েছে। আদুরীর এই রূপ দেখে মুগ্ধ নয়নে টগর তাকিয়ে থাকে। তার চোখের প্রতিটি পলক বলছে,”তোমার এই রূপ দেখিবার চাই আমি শত শত অজস্র বার। এই রূপের মায়ায় হারিয়ে যেতে চাই।”
টগর মুগ্ধ নয়নে দেখতে দেখতে আদুরীর কাছে আসে। তার পড়নে লাল রঙের একটি পাঞ্জাবি এবং সাদা রঙের পাজামা। পা দু’টো খালি। জুতা নেই। আর হাতে রয়েছে একটি গোলাপ। আলতো পায়ে হেটে টগর আদুরীর পাশে এসে বসে। আদুরীর মতো পা দু’টো পানিতে ভিজিয়ে দেয়। আদুরী এটা দেখে খুশি হয়ে টগরের মুখের দিকে তাকায়। টগর মুচকি হেসে তার হাতে থাকা গোলাপটি আদুরীর কানে গুজে দেয়। অতঃপর বলে,“শ্যামবতী এবার তোমার এই রূপ স্বার্থক।”
আদুরী জবাব দেয় না। তবে সে হাসে। তার মুখে অন্যরকম এক প্রাপ্তির হাসি। তার হাসিতে মুগ্ধ টগর বলে,“এভাবে হেসো না। আমি মুগ্ধতায় ম রে যাবো।”
আদুরী তৎক্ষনাৎ টগরের মুখে হাত দেয়। তারপর বলে,“ম রবে না। তুমি ম রে গেলে আমি কার সঙ্গে বাধবো ঘর?”
এই কথা শুনে টগর খুব খুশি হয়। সে খুশিতে উচ্চশব্দে হেসে দেয়।
টগরের হাসির শব্দ শুনে আদুরী অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। সে শান্ত গলায় বলে,“আপনি হাসছেন কেন?”
”খুশিতে। তুমি আমার সঙ্গে ঘর বাধতে চেয়েছো সেই আনন্দে। আমার তো খুব খুশি লাগছে।”
”হ্যাঁ?”
আদুরী বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে টগরের দিকে তাকায়। মূহুর্তের মাঝে টগর বাস্তবতায় ফিরে আসে। সে নিজেকে ট্রাকের উপর আবিষ্কার করে। অতঃপর টগর বুঝতে পারে সে মুগ্ধ নয়নে আদুরীকে দেখতে দেখতে কল্পনায় তার সঙ্গে অন্যরকম এক সুন্দর জগতে চলে গিয়েছিলো। নিজের কল্পনার কথা ভেবে টগর লাজুক হাসে। মনেমনে বলে,“ইশ যদি সত্যি হতো।”
“কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন বলুন তো?”
আদুরীর প্রশ্নের জবাবে টগর শান্ত গলায় বলে,“যেখানে হারিয়ে গিয়েছিলাম সেটাই হয়তো আমার পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা।”
“তাই?”
আদুরী জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালে টগর মাথা নাড়ায়। দু’জনে একই জায়গা বসে থাকতে বিরক্তবোধ করে। তাই দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় আশেপাশে ঘুরে দেখার। দুজনে নিচে নামে। আদুরী তবে কিছুটা ভয় পাচ্ছিলো। যা দেখে টগর শান্ত গলায় বলে,“এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যা ঘটার তা এমনি ঘটবে। তাই ভয়কে জয় করে একটু মুক্তভাবে বাঁচুন। ভয় নিয়ে আসলে ঘোরাটা ঠিক যায় না।”
আদুরী মাথা নাড়ায়। দু’জনে মিলে রাস্তার দক্ষিন দিকে হাঁটতে শুরু করে। বাজারের উল্টো দিকে। যেহেতু বাজারের দিকে সেই লোকগুলোকে জামাল দেখেছে তাই আদুরী সেদিকে যাওয়ার রিস্ক নিতে চায় না। টগরও বিষয়টি বুঝতে পেরে উল্টো দিকে হাটে। কিছুটা পথ হাটতে টগর একটি সিগারেট ধরায়। এটা দেখে আদুরী বলে,“এটা খেলে কী এমন উপকার হয় যে একটু পর পর খেতেই থাকেন।”
এই কথা শুনে টগর সিগারেট আদুরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,“একবার টেনে পরীক্ষা করে নাও।”
”আপনি?”
আদুরী বিরক্ত হয়ে তাকায়। টগর মুচকি হাসে। অতঃপর বলে,“মজা করছিলাম। তবে সত্যি একবার টেনে দেখতে পারো। হয়তো ভালো লাগবে।”
”সত্যি?”
আদুরীর এই কথায় টগর অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। তার কথা সিরিয়াস নিয়ে নিয়েছে আদুরী। টগরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আদুরী বলে,“তাহলে দেন একবার টেনেই দেখি।”
“আসলেই?”
টগরের কথায় আদুরী মাথা নাড়ায়। মুখে বলে,“আমি বাহিরের জগত, নানা মানুষের নানা কর্মকান্ড দেখে শেখার আশা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছি। তেমন কিছু তো শেখার মতো পাচ্ছি না। তাই নাহয় আপনাদের থেকে এটাই শিখলাম।”
এটা শুনে টগর হাসে। সিগারেটে একবার টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলে,“থাক। দরকার নাই। সবকিছুর অভিজ্ঞতা নেওয়ার প্রয়োজন নেই।”
”একবার নেই। একবারের বেশি করবো না। এটার ইচ্ছা নেই।”
আদুরীর এই কথায় টগর রাজি হয়। অতঃপর আদুরীর দিকে সিগারেট আবারও এগিয়ে দেয়। আদুরী সেটা নিয়ে মুখে দেয়। টগর বলে,“এভাবে মুখে নিয়ে না বুঝে টান দিলেই হবে না।”
আদুরী এই কথা শুনে থেমে যায়। অতঃপর টগর আদুরীকে সিগারেট টানতে কিভাবে হবে সেটা শেখায়। আদুরী সেভাবে টান দেয়। কিন্তু তাও ধোঁয়া ছাড়তে পারে না। উল্টো সব মুখের ভেতরে গিয়ে কেমন করে। সে কাশতে শুরু করে। এটা দেখে টগর বলে,“অভিজ্ঞতা নেওয়া হয়েছে?”
আদুরী কিছুটা ঠিক হওয়ার পর জবাব দেয়,“হ্যাঁ। খুবি বাজে।”
এটা শুনে টগর শব্দ করে হাসতে থাকে। আদুরী তার দিকে রাগী চোখে তাকায়। টগর বলে,“বাজে জিনিস বাজেই তো লাগবে।”
“তো আপনি এসব বাজে জিনিস খান কেন?”
আদুরীর এই প্রশ্নের জবাবে টগর ম্লান হেসে বলে,“আমি বাজে ছেলে। তাই বাজে জিনিস খাই।”
এটা বলে টগর হাঁটতে শুরু করে। আদুরীও তার পিছনে হাঁটে। অতঃপর বলে,“আপনি মোটেও বাজে ছেলে নন।”
আদুরীর এই কথাটি শুনে টগর দাঁড়িয়ে যায়। সে পিছন ঘুরে আদুরীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়।
___
জামাল টাকা নিয়ে গ্যারেজে আসলে গ্যারেজ মালিক আকাশের উদ্দেশ্য বলে,“আমি সাধারণ যেগুলো লাগে সেগুলো নিয়ে যাচ্ছি ট্রাকটা সারাতে। এরপরও কিছু লাগলে তোকে ফোন দিবো। সেটা নিয়ে দ্রুত আসবি।”
“আচ্ছা।”
আকাশ মাথা নাড়ায়। জামালের সঙ্গে গ্যারেজ মালিক চলে আসে। তারা চলে যেতে আকাশ সেই সময়ের ঘটনা ভাবে। ছেলে দুটো তাকে আশ্বাস দিয়েছে খোঁজ দিলে অবশ্যই টাকা দিবে। সে সেই টাকার কথাই চিন্তা করছে।
অন্যদিকে জামাল গ্যারেজ মালিককে নিয়ে এসে দেখে টগর এবং আদুরী সেখানে নাই। সে সেটা নিয়ে বেশি ভাবলো না। গ্যারেজ মালিককে নিয়ে গাড়িটা ঠিক করার কাজে লেগে পড়লো। গাড়ি সাড়াচ্ছে আর তারা টুকটাক কথা বলছিলো। গ্যারেজ মালিক সমস্যা বুঝতে পেরে প্রয়োজনীয় যে জিনিসটি দরকার সেটার জন্য আকাশকে ফোন দেয়। ফোন দিয়ে বলে,“এটা নিয়ে দ্রুত আয়।”
অতঃপর ফোন রেখে জামালের উদ্দেশ্যে বলে,“যে জিনিসটি নিয়ে আসতে বলছি তার জন্য আরও দুইশো টাকা বেশি লাগবে।”
“আরে ভাই। কী বলছেন। বারবার টাকা বাড়াচ্ছেন? এতটুকু ছাড় দিন।”
“ভাই আপনি ভিনদেশী লোক। বিপদে পড়ছেন সেজন্য অনেক কম করেই রেখেছি। এতটুকু নাহলে আমার লস হয়ে যাবে।”
জামাল বিরক্ত হয়ে রাজি হয়। তবে মনেমনে ভীষন বকা দেয়। কম করে রাখার নমুনা তো সে দেখছেই।
★
টগর এবং আদুরী গল্প করতে করতে বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে গিয়েছে। সেজন্য টগর থেমে আদুরীর উদ্দেশ্য বলে,“এবার আমাদের যাওয়া উচিত।”
আদুরী মাথা নাড়ায়। তারা দু’জন আবার উল্টো পথে পা বাড়ায়। যাওয়ার পথে টগর আদুরীকে বলে,“আমাদের সঙ্গে সারাজীবন থেকে গেলে হয় না আদুরী?”
আদুরী এই কথা শুনে থেমে যায়। সে টগরের চোখের দিকে তাকায়। সেই চোখে আদুরীর জন্য গভীর ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। আদুরী সেই ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু সে চেয়েও কোথাও গিয়ে তার কথায় রাজি হতে পারছে না। আদুরী রাজি হতে না পেরে বলে,“পথের জিনিস পথেই ফেলে রেখে যায় মানুষ। তার জন্য এত মায়া কেউ বাড়ায় না।”
”ভুল কথা। পথে পাওয়া মূল্যবান জিনিস কিন্তু মানুষ ফেলে রেখে যায় না। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে যায় এবং যত্ন করে ঘরে সাজিয়ে রাখে।”
টগরের এই কথার মাঝে যে ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে সেটা আদুরী বুঝতে পারে। তবে জবাব দেয় না। সে হাঁটতে শুরু করে। টগরও তার পিছনে হাঁটতে থাকে। বেশ কিছুটা সময় পর আদুরী বলে,“আদুরীর মতো মানুষদের জীবনটা কি আদৌ সুন্দর হয়।”
”হয়।”
টগর জবাব দিলে আদুরী ম্লান হেসে তার দিকে তাকিয়ে বলে,“আমার তো মনে হচ্ছে আমার মুক্ত জীবন ক্ষণিকের। এতটুকু সময়ের জন্য আমি মুক্ত পাখির মতো আকাশে ডানা মেলেছি। এই সুন্দর সময়ের স্থায়ীত্বকাল অনেক নগণ্য। যেটা দীর্ঘ হবে না। আমি আবারও বন্দি পাখির মতো খেঁচার ভেতরে বসে ছটফট করবো।”
”জীবনের অনেকটা সময় তুমি বন্দি পাখির মতো খাঁচার ভেতর ছটফট করেছো তাই তো মুক্ত এই জীবন নিয়ে তোমার মনে সংশয় কাজ করছে। যেটা আদৌ সঠিক নয়। খাঁচার পাখি একবার মুক্ত পেলে সে আর কখনো বন্দি হয় না। সে মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ায় মনের আনন্দে।”
টগরের এই কথায় আদুরী ভরসা পায়। তবে বাস্তবেই কি আদুরীর মতো মানুষের সঙ্গে এমনটা হবে। সে এই মুক্ত জীবন সারাজীবনের জন্য পাবে? এই প্রশ্নটা আদুরীর মনে বারবার উঁকি দেয়।
’
’
চলবে,