#পরাণ_বধূয়া —০১
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
“ আমি তোকে বিয়ে করতে রাজি অদ্রি কিন্তু এক শর্তে, তোকে আজ রাতে আমার সাথে থাকতে হবে। ”
সিজান ভাইকে সবসময় ভদ্রছেলে বলেই মনে করতো অদ্রিজা; তবে এমন কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাবে চোখমুখ কুঁচকায় সাথে চোখে ভারী অশ্রু জমা হয়; কিন্তু কথার জবাব দিতে পারে না অদ্রিজা! তবে ওকে চুপ থাকতে দেখে সিজান আবারো নিজের মতো করে বলে——-
“ তারপর আমি সিদ্ধান্ত নেবো, আমি তোকে বিয়ে করবে কি না! ”
ঢোক গিললো অদ্রিজা। সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না; কি বলবে? মাথায় কিছুই আসছে না! তবে এর মাঝেই এক গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে প্রশ্ন শোনা যায়—–
‘ এসব কেমন কথা সিজান! তোমায় তো এসব শিক্ষা দেই নি!’
একই সাথে চমকে উঠে সিজান আর অদ্রিজা। অদ্রিজা ভয়ে জামা খাঁমচে ধরে চোখ বন্ধ করে নেয় তাতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে চোখের অশ্রু বেয়ে পড়ে। সিজান অবাক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায় তারপর হতবাক গলায় লোকটাকে দেখে বলে——-
‘ আরে সাইফান মামা তুমি এখানে?’
‘ হ্যাঁ। তোর মা পাঠালো!
তারপর অদ্রিজার দিকে একবার তাকিয়ে সাইফান সিজানকে উদ্দ্যেশ করে জিজ্ঞেস করে—–
‘ এই মেয়ে কি তোদের পাশের ফ্ল্যাটের; যার সাথে তোর মা বিয়ে ঠিক করেছে?’
‘ হু!’
সিজান জবাব দিতেই সাইফান শান্ত চোখে আবারো তাকায় অদ্রিজার পানে। ছোট খাটো একটা তুলতুলে খরগোশের বাচ্চার মতো দেখতে। মেয়েটা নিত্যন্তই বাচ্চা; বয়স কত? সতেরো, আঠারো হবে হয়তো! আর সেই মেয়েকেই তার ভাগিনা এসব প্রস্তাব দিচ্ছে ভাবতেই মন বিষিয়ে উঠলো। তবে জবাব করলো না সাইফান। পাশ থেকে চেয়ার টেনে বসলো টেবিলে বসলো। তাতে সিজান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পাশে চেয়ারে বসে। সাইফান শান্ত চোখে আবারো অদ্রিজাকে পরক্ষ করলো। মেয়েটা চোখ মুখ খিঁচে বসে আছে। তাই শান্ত ও নির্জীব গলায় বলে——-
‘ নাম কি?’
অদ্রিজা চমকে চোখ খোলে। তারপর তার পাশে তাকায়। এক শক্ত পোক্ত পুরুষের মুখাবয়ব দেখে থমকায়। তারপর চমকানো চোখ নিয়ে সিজানের দিকে তাকাতেই সিজান হেসে বলে—–
‘ আমার মামা।’
চোখ সরিয়ে আবারো সাইফানের দিকে তাকালো অদ্রিজা। লোকটার বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। ত্রিশের কোটায় হবে হয়তো। ঢোক গিললো অদ্রিজা তারপর চোখ নিজের কোলে রাখা হাতের ওপর চোখ স্থীর রেখে শান্ত গলায় বলে——-
‘ অদ্রিজা নওয়াজ।’
‘ কিসে পড়ো?’
‘ ইন্টারে ফাইনাল পরীক্ষা দেবো!’
‘ তাহলে এতো দ্রুত বিয়ে কেনো?’
আবারো থতমত খেলো অদ্রিজা এতো সহজ সাবলীল ভাষার প্রশ্ন। তবে সে উত্তর করার আগেই হাসোজ্জল গলায় সিজান বলে—–
‘ আরে মামা রাখো। বয়স দিয়ে কি আশে যায়? বউ হিসেবে ছোট মেয়েই ভালো। নাহলে বেশি বড় হলে বুঝবে বেশি তখন বউ ফেলে চলে যাবে; ঠিক তোমার মতো। ’
শান্ত চোখে সিজানের মুখের দিকে তাকালো সাইফান। তবে জবাব করলো না। সিজান আবারো বলে—–
‘ সানাফ কোথায় মামা?’
‘ গাড়িতে ঘুমাচ্ছে!’
‘ ও আচ্ছা!’
এতোটা সময় নিরবে নিভৃতে সব শুনে গেলো অদ্রিজা। তবে এখন এতোটুকু বুঝতে পেরেছে সিজানের মামা করে লোকটার বউ চলে গেছে আর তার বাচ্চা আছে। এতোদিন সিজানকে দূর থেকেই অদ্রিজা দেখেছিলো আর ভদ্রছেলেই ভেবেছিলো তবে আজকেই এই সাক্ষাতে যেন সব ধুলিমাখা হয়ে গেছে।
সিজান শুধুই নামের ভদ্রলোক। না বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা জানে; আর না কিভাবে মেয়েদের সম্মান করতে হয় তা জানে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো অদ্রিজা। এই লোককে বিয়ে করার কথা চিন্তাও করতে পারছে না আর। তবে সৎ মায়ের ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। তাই অদ্রিজা চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করলো!
এমন সময় সাইফান বলে—–
‘ আচ্ছা আমি যাই; তোরা চলে আসিস!’
সিজানও বলে উঠে—–
‘ আরে মামা এক সাথেই যাবো দাঁড়াও। ’
কথাটা বলেই অদ্রিজার পানে তাকায় সিজান তারপর ব্যস্ত কণ্ঠে শুধায় —–
‘ তোর উত্তরটা দিলি না তো অদ্রি!’
চোয়াল শক্ত করে সাইফান তবে কোন প্রতিক্রিয়া করে না। শান্ত হয়ো অদ্রিজার পানে তাকায় তার উত্তর কি তা শোনার জন্য! অদ্রিজার হাত পা ঘামছে ভীষণ। তবুও নখ খুঁটতে খুঁটতে মিনমিন করে বলে—–
‘ আমার একটু সময় লাগবে সিজান ভাই! তারপর জানাবে।’
সিজান ঘরিতে সময় দেখে বলে——
‘ তোর সময় আজকে সন্ধ্যা সাতটা। তার আগে আমায় জানাবি।’
তারপর সাইফানের দিকে তাকিয়ে বলে——
‘ মামা চলো।’
কথাটা বলেই সিজান ক্যাশকাউন্টারের দিকে যায়। সাইফান আবারো তাকালো মেয়েটার পানে। তারপর উঠতে উঠতে শান্ত গলায় বলে—–
‘ আসুন মিস. অদ্রিজা!’
শরীরের মাঝে একটা ঝনঝন অনুভব হলো। গলা শুঁকিয়ে এলো। খুব অস্বস্তি হলো। এতো সু্ন্দর করে এর আগে কেউ অদ্রিজাকে ডাকে নি। ইনি কি অদ্ভুত লোক; সিজান ঠিক মতো কথা বলে না! আর এই লোক কি সুন্দর করে তাকে সম্বোধন করছে। এই হলো ব্যবহারে মানুষের পরিচয়! তবে প্রতিক্রিয়া বিহীন উঠে দাঁড়ালো অদ্রিজা। সাইফান আগে আগে হাঁটছে পিছনে অদ্রিজা। রেস্টুরেন্টে থেকে বেরোতেই দেখা যায় সিজান গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্রিজা আবারো সাইফানের দিকে তাকালো তো একবার সিজানের দিকে। সিজান কে দেখে অনুমান করা যায় ওর বয়স সাতাশ আটাশ হবে। কিন্তু এই লোকের বয়স তেত্রিশ – চৌত্রিশ। বয়সের পার্থক্য খুব একটা বেশি নয়! তবুও আচার-আচরণের পার্থক্য কতটা আর সিজানের চরিত্রের কি ছিড়ি। সাইফান যেয়ে গাড়ির লক খুলে উঠে বসতে বসতে বলে—–
‘ সিজান তুই সামনে বস। আর মিস. অদ্রিজা আপনি পিছনে বসে পড়ুন। আমার ছেলে ঘুমোচ্ছে তবে যতটুকু জায়গা আছে। আশা করি আপনার হয়ে যাবে। ’
কথাটা বলেই গাড়িতে উঠে বসে সাইফান। সাথে সিজানও। অদ্রিজা কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রয়! তারপর কুণ্ঠাবোধ করেই গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসতেই দেখা মেলে এক তিন বছরের ফর্সা তুলতুলে একবাচ্চার – কি যেনো নাম বলছিলো লোকটা? সানাফ; সানাফ অদ্রিজা যেদিকে বসেছে সেদিকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে আছে। তাই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সানাফকে তুলে ওর মাথা অদ্রিজার কোলে তুলে নেয়। এতে এক অদ্ভুত এক চিনচিন অনুভূতি হয় অদ্রিজার বুকে। তবুও চুপ করে বসে রয় মেয়েটা। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে পুরোটা বিষয় নিবিড় নজর দেখলো সাইফান তবে প্রতিক্রিয়া বিহীন গাড়ি ড্রাইভ করছে। সিজান ফোনে কিছু একটা করছে। তার সাইফান কিছুক্ষণ পর পর মিরর থেকে অদ্রিজা আর সানাফকে পর্যবেক্ষণ করছে। তারপর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে আবারো গাড়ি ড্রাইভিংএ মনোযোগ দেয়।
——-
‘ আপা একটা সাহায্য করবে! এর বদলে তুমি যা বলবে তাই শুনবো!’
আরিমা শান্ত চোখে তাকিয়ে বলে—–
‘ আমি জানি তুই কি চাইছিস। তবে তুই ভাবতে পারছিস; পালিয়ে গেলে কি হবে?’
‘ আপা সিজান ভাইয়ের কথা তো সব বললাম তাও তুমি এইগুলো বলবে? যে লোক বিয়ের আগেই ওই সব বলতে পারে। তার চরিত্র ঠিক কেমন হতে পারে তবু ভাবতে পারছো?’
‘ কি করতে চাইছিস?’
‘ এখন সময় কেবল সন্ধ্যা ছয়টা বাজে; সিজান ভাই সাতটা পর্যন্ত সময় দিয়েছে। আটটায় আমার হলুদ। যদি আমি উত্তর পজিটিভ দেই তাহলে বিয়ে হবে। নেগেটিভ হলে – বিয়ে ভাঙ্গবে আর মা কি করবে বুঝতে পারছো?’
‘ পারছি। আচ্ছা শোন; আমার বান্ধবী রুবিনার কথা মনে আছে? ওর বাড়ি খুলনা; ওইখানে যাবি? মা বুঝতে পারবে না!’
ঢোক গিললো অদ্রিজা। আরিমা সম্পর্কে সৎবোন হলেও অদ্রিজাকে প্রচন্ড ভাবে ভালোবাসে সে। আরিমাও চায় না এই বিয়ে হোক। কারণ হলো সিজানের চরিত্র। সিজান আরিমার ভার্সিটির সিনিয়র তাই কম হলেও সিজানের ব্যপারে ভালো ধারণা আছে। তাই সে আবারো রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে অদ্রিজাকে তাড়া দিয়ে বলে—–
‘ তাড়াতাড়ি বল!’
অদ্রিজা ঢোক গিলে শক্ত গলায় বলে——-
‘ পারবো আপা। পারতে আমাকে হবেই।’
‘ তাহলে দ্রুত শাড়িটা বদলে ফেল। আর আমি আম্মুকে রান্না ঘরে ব্যস্ত করে রাখবো তুই এই ফাঁকে চলে যাবি। আর এই ফোনটা রাখ; তোর কাজে লাগবে!’
কথাটা বলেই নিজের হাতে থাকা স্মার্ট ফোনটা এগিয়ে দিলো আরিমা। অদ্রিজা নাকচ করে বলে—–
‘ এইটা আমি নিতে পারবো না আপা; তোমার টিউশনির টাকা জমিয়ে প্রথম কেনা মোবাইল আমি কিভাবে নেবো। তার চেয়ে বরং—!’
‘ বেশি কথা বলিস না অদ্রি। যা বলেছি কর!’
দেমোনা করে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো তারপর বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় বলে——-
‘ এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না আপু। আমায় মাফ করে দিও। আমি এখনি যাবো। তুমি চলো!’
‘ শাড়ি বদলাবি না?’
’ এইটা আমার মায়ের শাড়ি; থাকুক না আমার কাছে!’
চোখ ছলছল করে উঠলো আরিমার। কপালে এক চুমু খেয়ে উঠে দাড়িয়ে বলে—–
’ আল্লাহ তোর সহায় হোক; এই জাহান্নাম থেকে বেড়িয়ে একটা ফুলের বাগান ওয়ালা জান্নাত দিক।’
কথাটা বলেই আরিমা চলে গেলো। অদ্রিজাও আরিমার পেছন পেছন বেড়িয়ে গেলো। আরিমা রান্না ঘরে ঢুকতেই অদ্রিজা রুমে এসে নিজের ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বিড়াল পায়ে এগিয়ে দরজা খোলে; তারপর সিজানদের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ফেলে বেড়িয়ে যায় অজানা উদ্দ্যেশ্যে। এর পর কি হবে অদ্রিজা জানে না। তবে যা হবে তা মঙ্গলকর হোক অদ্রিজার জীবনে!
——
চলবে?