#পরাণ_বধূয়া —০২
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
এশারের সময় পার হয়েছে কিছুটা সময় আগে। রেলস্টেশনের শেষ ট্রেইনের জন্য অপেক্ষা করছে অদ্রিজা; গায়ে জড়ানো মায়ের একটা লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি। সবাই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে একবার হলেও তাকিয়ে অদ্রিজার দিকে তাকাচ্ছে। এতে জড়তা আর কুণ্ঠাবোধ সব জড়িয়ে নিলো অদ্রিজাকে। তবুও হাতের ব্যাগটা শক্ত হাতে খামচে একটা বেন্ঞ্চে ঢেসে বসে আছে৷ এতো সময়ে নিশ্চয়ই সবাই জেনে গেছে অদ্রিজা বাড়ি থেকে পালিয়েছে। ঢোক গিললো অদ্রিজা। তারপর আবারো ভারী পল্লবে তাকালো রেললাইনের দিকে। তার লম্বা হাই টানলো। আগে থেকেই বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না শুধু সৎ মায়ের ভয়ে রাজি হয়েছে। কিন্তু অদ্রিজা ঠিক জানে না সিজান কিংবা তাদের পরিবার কেনোই বা তার জন্য রাজি হলো? যেখানে তার থেকে আরিমা চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের অধিকারী। দীর্ঘশ্বাস ফেললো অদ্রিজা তারপর বেন্ঞ্চে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। সময় গড়ালো কিছুক্ষণ। কিন্তু নিজের তাকে কিছুর টান পড়তেই তড়াক করে চমকে তাকায়। তাতে হাতের ধরাটা একটু নরম হতেই একটা কালো মন্ত দেখতে লোক দৌড় লাগায়। অদ্রিকা কি হয়েছে বুঝতে না পেরে বোকার মতো কিছু সময় তাকিয়ে থেকে যখন বুঝতে পারে তা ব্যাগ কেউ ছিনতাই করছে তখনি বেন্ঞ্চ থেকো উঠে দৌড় লাগায় লোকটার পিছনে।
মাত্রই দৌড়ে স্টেশনের ভেতরে ঢোকে সাইফান। তার এক বন্ধু আসবে সিজানের বিয়ে উপলক্ষে তবে সন্ধ্যা থেকে নাকি অদ্রিজাকে পাওয়া যাচ্ছে না। একদিকে ভালোও হয়েছে। মেয়েটা একটা বাচ্চা মানুষ; তার তার ভাগিনার অ-মূলদ পরিবর্তন দেখে নিজের অজান্তেই মন বার বার বলছিলো সিজান অদ্রিজাকে ডিজার্ভ করে না। সী ডিজার্ভ মাচ বেটার দ্যান সিজান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়াতেই; কারো সাথে ধাক্কা লাগে। সাইফান ঘুরে তাকায়। তবে চমকায়, থমকায়, অবাক হয় লোকটা। অদ্রিজা নাওয়াজ; মেয়েটা এখানে কি করছে? আর এভাবে দৌড়াচ্ছেই বা কেনো? অদ্রিজা সাইফানকে ঠিক মতো খেয়াল না করেই থামকে দাঁড়িয়ে কিছুটা দ্রুত এবং আশংকাজনক কণ্ঠ নিয়ে বলে—–
‘ প্লি-প্লিজ হেল্প মি, ও-ওই লোক আ-মার ব্যাগ নিয়ে পালাচ্ছে। ’
কথাটা বলেই অদ্রিজা আর দাঁড়ালো না। আবারো লোকটার পেছনে দৌড় দেয়। সাইফান থমকে অদ্রিজা যেদিকে গেলো সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। তারপর কথার বোধগম্য হতেই নিজেও দৌড় লাগায় অদ্রিজার; সময় লাগলো না! খপ করে অরিজার হাত ধরে সাইফান। অদ্রিজা চমকে হাতের দিকে তাকায়। এক বলিষ্ঠ পুরুষাকায় হাত থেকে থমকে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে আরো স্তব্ধ, নিষ্প্রাণ, নির্জীব হয়। শুষ্ক ঢোক গিললো তারপর জড়িয়ে যাওয়া ক্রন্দসী কণ্ঠে বলে—–
‘ প্লি-প্লিজ আমাকে ছাড়ুন। ওই ব্যাগটা আমার নিতে হবে!’
শান্ত নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে অনিমেষনেত্রে তাকায় সাইফান তারপর গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে—–
‘ কি আছে ওই ব্যাগে?’
‘ আ-আমার মায়ের-মায়ের শেষ স্মৃতি! ’
ঠোঁট ভেঙে আসে অদ্রিজার। অশ্রুর নহরে গাল গলা চোখের পাপড়ি তিরতির করে কেঁপে চলেছে। সাইফান তা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে দেখে আবারো লোকটার দিকে তাকালো। ছিনতাইকারী লোকটার হয়তো পায়ে কোন সমস্যা আছে। ঠিক মতো দৌড়াতে পারছে না। তাই অদ্রিজার হাত ছেড়ে দিয়ে শান্ত গলায় সাইফান বলে—– ‘ আমি না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকবেন। ডোন্ট মুভ।’
কথাটা বলেই লোকটার পেছনে বড় বড় পা ফেলে দৌড় দেয় সাইফান। অদ্রিজা তাকিয়ে আছে সেদিকে। একটা ছাই রংয়ের শার্ট এবং কালো রংয়ের প্যান্ট পড়া লোকটা। শার্টের হাতা ফোল্ড করে ভাজ করে কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা। অদ্রিজা ভয়ে শাড়ি খামচে ভয়ত্ব চোখে তাকিয়ে আছে যেদিক ছিনতাইকারী এবং সাইফান গেছে।
সাইফানের বেশি সময় লাগে নি; লোকটাকে ধরতেই লোকটা থেমে পিছনে ঘুরে তাকায়। তা দেখে অদ্রিজাও সেদিকে দৌড় লাগায় তবে সে যাবার আগেই একটা ধাতবপ্রকৃতি ছোট ছুড়ি চিঁড়ে যায় সাইফানের পেটের দিকে। সাইফান বোঝার আগেই তা হয়েছে। সেখান থেকে শার্ট কেটে গলগলিয়ে লহুর নহর গড়িয়ে পড়লো। তবে অদ্রিজার ব্যাগ সে যে ধরছে ছাড়ে নি। ট্রেনের কমিটির রুমের দুজন লোক বের হতে দেখে লোকটা ব্যাগ রেখে দৌড়ে পালায়। ততক্ষণে সাইফান ব্যাগ একহাতে ধরে অন্যহাতে কাটা জায়গাটাকে ধরে ধপ করে নিচে পড়ে যায়।
সাইফানকে নিচে পড়ে যেতে দেখে হতভম্ব হয়ে থমকে যায় অদ্রিজা। কিছুই বুঝতে পারেনি। তবে লোকটার হাত চালাতে সে দেখেছে তাই আর না দাঁড়িয়ে দৌড়ে সাইফানের কাছে আসে। সাইফান কাতরাচ্ছে। অদ্রিজা ভয় পেয়ে যায়। কান্না করে দেয় মেয়েটা। সাইফান চমকায়। নির্নিমেষ চোখ অবাক হয়ে তাকায় অদ্রিজার দিকে। অদ্রিজা এতো টুকুতেই পাগল প্রায় কাঁপা হাতটা আগে বাড়িয়ে একবার ভাবে সাইফানকে ধরবে আবার আশেপাশে তাকিয়ে কেউ আছে কিনা যার থেকে সাহায্য নেয়া যায় কিনা তা বোঝার চেষ্টা চালায়।
সাইফান ছোট্ট মেয়েটার ছটফটানি দেখে। কৌতূহল বাড়ে। তবুও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। ডক্টরি পেশার বদৌলতে সে এতো টুকু বুঝেছে; ছুড়ি টার সাথে কিছু একটা মিশ্রিত ছিলে যার কারণে ছিঁড়ে যাওয়া জায়গাটায় মিনিটে কাবু করে ফেলেছে সাইফানকে। অদ্রিজা আরেকটু এগলো। হাত বাড়িয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা কিছু রক্ত ছুঁয়ে দেখে তারপর ভীত কণ্ঠে কাঁপা কাপা গলায় বলে—–
‘ আ-আপনার, তো কে-টে গেছে। র-ক্ত বেরোচ্ছে।’
ততক্ষণে স্টেশনের লোক গুলো দৌড়ে এসে দাঁড়ায় অদ্রিজার সামনে তারপর বলে—–
‘ এগুলো সব ছিঁচকে চোর দের কাজ। আপনাদের আরেকটু সাবধানে থাকা উচিত ছিলো।’
তারপর সাইফানকে ধরে বলে—–
‘ উনাকে ধরুন। বেঞ্চে বসিয়ে ডক্টর ডাকতে হবে।’
অদ্রিজা কি করবে বুঝতে পারছে না। সাথে দুজন ধরে পাশের চেয়ারে বসায় সাইফানকে। সাইফান তখনও অদ্রিজার ভীত চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে। লোক গুলো কমিটি রুমে যাবে তার আগেই সাইফান ঠোঁট কামড়ে ব্যাথা হজম করে লোক গুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে—–
‘ অ্যাম এ্য ডক্টর। কাউকে ডাকার দরকার নেই। আমায় শুধু একটা ফাস্ট এইড বক্স এনে দিলেই চলবে।’
লোকগুলো একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর একজন দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। লোকটা শান্ত চোখে অদ্রিজা আর সাইফানকে পর্যবেক্ষণ করে বলে—–
‘ দেখে তো স্বামী স্ত্রী মনে হচ্ছে। নতুন বিয়ে হয়েছে?’
চমকে যায় অদ্রিজা। তবে সে জবাব দেবার পূর্বে সাইফান একবার অদ্রিজার দিকে তাকায় তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে ব্যাথা হজম করে পেটের কাটা জায়গাটা চেপে ধরে রেখেই সাবলীল ভাষায় বলে—–
‘ জ-জ্বি; বউ রাগ করেছে তাই বাপের বাড়ি চলে যাবে। তাই নিতে এসেছি।’
লোকটা হাসলো। এর মধ্যে অন্য লোকটা ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে হাজির। এগিয়ে দিলো সাইফানের দিকে। সাইফান হাত বাড়ায় তা নেবার জন্য সাথে চোখ ঘুরিয়ে আবারো অদ্রিজার দিকে তাকায়। সে এখনো স্তব্ধ হয়ে আছে। প্রতিক্রিয়া করলো না সাইফান৷ বক্সটা খুলে শার্টের যেদিকটা কেটেছে সেদিকটা উন্মুক্ত করে। তারপর সেখানে এন্টিসেপ্টিক লাগাতে লাগাতে অদ্রিজার দিকে তাকায়। এখন মেয়েটা মুখের প্রতিক্রিয়া বদলেছে। পালছে তার ভাবভঙ্গি; ভয়ে চোখ মুখ কুচকে আছে। লোকটা নিরব চোখে দুজনকে দেখে শান্ত গলায় বলে—–‘ এ্যারেন্জ ম্যারেজ আপনাদের?’
সাইফান চমৎকার করে হাসলো তারপর মাথা নাড়িয়ে বলে—– ‘ জ্বি-এক সপ্তাহ্ হবে।’
লোকটা আবারো হাসলো। সাইফান ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ব্যান্ডেজ করে নিতেই লোকটা বলে—–
‘ ওহ-হহ এবার ভাবীর রাগ করার কারণ বুঝতে পেরেছি। কোথায় যেতে চেয়েছে; নিয়ে যান।’
সাইফান বুঝতে না পেরে বলে—– ‘ এক্সকিউজ মি? কোথায় নিয়ে যাবো বলতে?’
লোকটা লাজুক হাসলো তারপর বলে—– ‘ কোথায় আবার নতুন বিয়ে হলে এগুলো একটএ আধটু হয় ভাই; ভাবীর সাথে রাগ না করে। হানিমুনে যায় গা।’
চমকায় দুজনে। অদ্রিজা প্রতিক্রিয়া করতে পারলো না। সাইফান চোখ ছোট ছোট করে বলে—– ‘ কোথায় যাওয়ার কথা বললেন?’
‘ কোথায় আবার – ভাবীরে নিয়ে হানিমুনে!’
——
চলবে—!