পরাণ বধূয়া পর্ব-০৪

0
70

#পরাণ_বধূয়া —০৪
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
[সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ]

সাইফানের কথা শুনে চমকে যায় অদ্রিজা। চিন্তিত গলায় বলে——-

‘ আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে?’

ততক্ষণে অদ্রিজার কান্না থেমে গেছে। প্রশ্ন করে আতঙ্কিত মুখে আশেপাশে তাকালো অদ্রিজা তবে কাউকে দেখতে না পেয়ে আবারো ব্যর্থ চোখে সাইফানের দিকে তাকায়। সাইফান অদ্রিজার ছোট্ট মুখটায় আতঙ্ক আর চিন্তা দেখলো। অদ্ভুত রকমের লাগছে সব তার কাছে। তবুও ঠোঁট চেপে ব্যাথা হজম করে মাথা উঁচু নিচু করে বলে—–

‘ হু!’

কথাটা বলতেই অদ্রিজা দাঁড়িয়ে যায়। তা দেখে অবাক হয়ে সাইফান জিজ্ঞেস করে——-

‘ কি হয়েছে?’

অদ্রিজা চিন্তিত মুখ নিয়ে সাইফানের দিকে তাকিয়ে আছে তারপর আবারো আশেপাশে তাকিয়ে বলে—–

‘ আমি একা তো আপনাকে হসপিটাল পর্যন্ত নিতে পারবো না। আর আপনি যদি গাড়িও এনে থাকেন। আপনি তো ড্রাইভ করার অবস্থায়ও নেই। আর এসব তো আমি আরো আগে পারি না।’

মেয়েটা কথা শুনে একটু নিশ্চিত হলো যাক মেয়েটার বুদ্ধিমতী। নিজের মনে হাসলো তারপর বলে——-

‘ আমি ক্যাব বুক করি? স্টেশনের বাহিরে পর্যন্ত তো নিয়ে যেতে পারবেন?’

অদ্রিজা মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে পারবে। তাই সাইফান আবারো পকেট থেকে ফোন বের করে ক্যাব বুক করে আবারো সামনে তাকায় অদ্রিজা এখনো দাঁড়িয়ে আছে তা দেখে সাইফান কপাল কুঁচকায় তারপর বলে—–

‘ কি হয়েছে? দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?’

‘ এমনি!’

‘ বসুন।’

অদ্রিজা আবারো বসলো। তারপর রেললাইনের দিকে চোখ স্থান করলো। ততক্ষণে শেষ ট্রেন চলে গেছে। সাইফান দেখলো অদ্রিজার মুখখানি। তারপর ঘুরিয়ে বেঞ্চে হেলান দিয়ে মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে কিছু সময় চোখ বন্ধ করে রাখে। সানাফ সিজানদের বাসায়। সাইফানের ছোট বোন সাবরিনা সানাফকে ভালোই রাখতে পারে। এই বছর মেয়েটার বিয়ে হলো। সিজান আর সাবরিনা সমবয়সী। ছেলেটাও সাবরিনের সেই ভক্ত। এদিক থেকে একটু রিলিফ লাগছে। একটা লম্বা শ্বাস টেনে সাইফান অদ্রিজার উদ্দেশ্য বলে—–

‘ এখন কোথায় যাবেন?’

‘ জানি না।’ – ঢোক গিলে ভঙ্গুর গলায় জবাব দেয় অদ্রিজা। তাই সাইফান চোখ মেলে তাকায় তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে——–

‘ বাসায় ফিরে যান!’

চোখ মুখে আর্তনাদ ফুটে উঠেছে অদ্রিজার সাথে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে—–

‘ মা মে-রে ফেলবে। বাকিদের কথা তো বাদ-ই!’

‘ এতো যখন ভয় তাহলে পালালেন কেন? আগে এই সব মাথায় ছিলো না?’

‘ তাহলে কি আপনি বলতে চাইছেন আপনার ওই দুশ্চরিত্র ভাগিনাকে বিয়ে করে সংসার করি? আর পালানোর পরে কোথায় যাবো তা মাথায় থাকলে তো হতোই; তখন আমার মাথায় ছিলো সেখান থেকে পালাতে হবে। মানুষ অসুন্দর হোক অনায়াসে সংসার করা যায়; কিন্তু দুশ্চরিত্র হলে সমস্যা। ’

একশ্বাসে শ্বাসে কথা গুলো বললো অদ্রিজা। সে এতো টাই উত্তেজিত হয়েছিলো যে মেয়েটার ছোট শ্যামবরণ মুখটা রক্তাভা ফুটে উঠেছিলো। সাইফান দেখলো সে এই কথাটা আসলেই বিশ্বাস করে। মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসলো তারপর হুট করেই জিজ্ঞেস করে——–

‘ আমার সাথে যাবেন?’

চমকায়, থমকায়, অবাক হয় অদ্রিজা। সচকিত দৃষ্টি নিয়ে বলে——

‘ মানে?’

সাইফান শ্বাস ফেললো। তারপর স্থির নির্জীব গলায় বলে—–

‘ আপনি একটু আগেই বললেন; কোথায় যাবেন জানেন না। তাহলে ধরে নেয়া যায় আপনার যাওয়ার জায়গা নেই।’

এতোটুকু বলে থামলো সাইফান তারপর আবারো নির্বিকার গলায় বলে—–

‘ আপনাকে আমার বাসায় জায়গা দেবারও একটা কারণ আছে বলতে পারেন; সেটা হলো আমার ছেলে সানাফ। ওর তিন বছর চলছে; অ্যাম এ্য ডক্টর। কাজের কারণে হুটহাট হসপিটালে যেতে হয়। ওখানেই সময় কাটে বেশি। আগে সানাফকে আমার বোন রাখতো কিন্তু এই বছরই আমার বোনের বিয়ে হয়েছে। তাই সানাফকে দেখাশোনা করার জন্য আমার একজন মানুষ লাগতো; তাই আপনার নাহয় আমার ছেলেকে দেখে রাখলেন আর আমার বাসায় থাকলে। আপনার কোনো সমস্যা হবে না। আপনি চাইলে পড়াশোনাও করতে পারবেন; তার ব্যবস্থা আমি করে দেবো! শুধু রিকুয়েষ্ট ওই একটাই — আমার ছেলে! আমি কাজের প্রশারে পড়লে ফ্রী হতে সময় লাগে! ততক্ষণ আবার ছেলেটার জন্যও চিন্তা হয়। তাই ভাবলাম আপনাকে বলি; এখন বাকিটা আপনার মর্জি!’

অদ্রিজা শুনলো। কিছুক্ষণ ভাবলো। তাকে বিশ্বাস করা কি উচিত হবে? সে কাউকে চেনেও না। অদ্রিজা তার বাবা দ্বিতীয় ঘরের সন্তান। নানুবাড়ি কখনোই সে দেখে নি। সে জানে না ওই বাড়ির আত্মীয়রা কেমন হয়? আরিমাদের বাসা থেকে যা দেখেছে শিখছে এই যা। এখন যাওয়া কোনো জায়গাও নেই। সাইফানের ব্যাপারে মোটামুটি ধারণা হয়েছে; তবে সে এতো রাতে রাস্তায় রাস্তায় কোথায় ঘুরবে? কার কাছে যাবে? কার হাতে পড়বে? তারপর কি হবে! সব কিছু ভেবে চুপ করে থম মেরে বসে রয় অদ্রিজা।

সাইফানের ফোন বেজে উঠে। ক্যাবের ড্রাইভার এসেছে। তা দেখে অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে সবিনয় গলায় বলে—–

‘ মিস. অদ্রিজা; ক্যাব এসেছে। আমায় হেল্প করুন।’

অদ্রিজা উঠে এসে সাইফানের সামনে দাঁড়ালো। কুণ্ঠাবোধ হচ্ছে তবুও লোকটা তার জন্য বিপদে পড়ছে তাই নিজের ছোট হাতটা এগিয়ে দিলো সাইফানের সামনে। সাইফান দেখলো, মনে মনে মেয়েটার নির্বুদ্ধিতার জন্য হাসি পেলো তবুও তা চেপে রেখে স্বাভাবিক ভাবে বলে——–

‘ আমার হাত ধরুণ!’

এইবার বুঝতে পারলো অদ্রিজা কি বোকামি করেছে তাই এগিয়ে এসে সাইফানের বলিষ্ঠ হাতে বাহু চেপে ধরে। বাইসেপ্স মাসল গুলো শার্টের ভেতরে যে ফোলা ফোলা তা বুঝতে পারলো অদ্রিজা। জড়তা নিয়ে ঢোক গিলে চোরা চোখে সাইফানের দিকে তাকালো। সাইফানের অবশ্য এদিকে খেয়াল নেই। সে অদ্রিজার সাহায্য বিড়াল পায়ে সামনে এগোতে ব্যস্ত। ক্যাবের সামনে যেয়ে দাঁড়ায় অদ্রিজা আর সাইফান। সাইফান মনে মনে মনে মনে ভেবে নিলো অদ্রিজা যাবে না তাই সেও আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি। সাইফান গাড়িতে উঠতে যাবে তখন অদ্রিজা দ্রুত গলায় মিনমিন করে—–

‘ আমি রাজি; —!’

থমকায় সাইফান। তারপর ঘুরে অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলে—–

‘ আর ইউ শিউর?’

‘ হু!’
জড়তা নিয়ে মাথা নিচু করে। তাইফানও আর অদ্রিজাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায় নি। শুধু ছোট করে বলে—–

‘ দ্যান কাম উইথ মি।’

————

হসপিটাল থেকে বাসায় এসেছে কিছুক্ষণ হয়। গেস্ট রুমটা এখন অদ্রিজা দখল করে আছে। সাইফান নিজের রুমে সুয়ে সাবরিনাকে কল দেয়। প্রথমে কলটা রিসিভ হয় নি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবারো কল দেয় সাইফান। কল রিসিভ হয়। সাবরিনা চিন্তিত গলায় বলে——–

‘ কোথায় তুমি? আসবে কখন? ’

‘ আমি একটু কাজে আঁটকে গেছি রে। আজকে ফিরতে পারবো না। সানাফকে একটু দেখে রাখিস।’

‘ হায়রে; ডক্টর মানুষ বুঝেছি! হসপিটালে তাই না?’

চুপ থেকে সাইফান জবাব দিলো ——- ‘ হ্যাঁ।’

‘ আচ্ছা কালকে এসে নিয়ে যেও। আর সিজানে হবু বউকে যে সন্ধ্যা থেকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনেছো?’

সাইফান দরজার দিকে তাকাল। তারপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে——– ‘ না তো!’

সাবরিনা বিরক্ত হলো। তারপর বলে——-

‘ আমার কি মনে হয় জানো? মেয়েটা পালিয়েছে।’

‘ পালাবে কেনো? সিজান ভালো ছেলে।’

অবাক হবার ভান করে বলে সাইফান। সিজানের প্রতি একটা চাপা রাগ আছে সাইফানের। অদ্রিজা পালিয়েছে এটা দেখার পর নিজে ম্যাচিউর হওয়া স্বত্বেও বাচ্চাদের মতো খুশি হয়েছে সাইফান। ওপরপাশ থেকে জবাব এলো সাবরিনার ——–

‘ ধূর ছাই; মেয়েটার নাকি সৎ মা। বড় আপার কথা তো জানোই? সিজানের চরিত্রও আমরা সবাই কম বেশি জানি। তোমার বউয়ের —

থেমে যায় সাবরিনা। তারপর আবারো বলে——

‘ সে যাগ গে; ভালো হয়েছে মেয়েটা পালিয়েছে। নাহলে দেখা যেতো বিয়ের একমাসের মাথায় মেয়েটা ম-রে যেতো। দোয়া করি মেয়েটা যেখানে গেছে ভালো থাক।’

সে কথার জবাব করলো না সাইফান। শুধু বললো——

‘ আমার যদি আগামীকাল আসতে দেরি হয় তাহলে আমার বাসায় আসার দরকার নেই। চাবি হারিয়েছি তাই নতুন লক দেয়া হয়েছে দরজায়। তুই এলেও বাসায় ঢুকতে পারবি না। তুই তোদের বাসায় চলে যাস আমি ওকে সময় মতো ফ্রী হয়ে নিয়ে আসবো।’

সাবরিনা হতাশ হয়ে বলে—–

‘ এর জন্য বলি — নতুন ভাবে শুরু করো। সানাফ একটা ভালো মা ডিজার্ভ করে, তুমি একটা ভালো বউ ডিজার্ভ করো। এতো এলোমেলো আর কত বছর থাকবে? আমার কথা তো শুনছোই না। যাক; যা ভালো বোঝো করো। রাখছি।’

কথাটা বলেই কলটা বিচ্ছিন্ন হয়। সাইফান ফোনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুঝলো। মিথ্যা কথা বলতে তার পছন্দ নয়; তবে পরিস্থিতি এমন যে না বললে – ঝামেলায় পড়ার সম্ভবনা খুব বেশি।

——

চলবে—!