#পরাণ_বধূয়া —০৫
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
[সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ]
ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে গেলো অদ্রিজার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে জানলা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে। সব এলোমেলো লাগছে। জীবনটা এমন না হলেও পারতো; তার এতোটুকু জীবনে আর কত অভিজ্ঞতা বহন করতে হবে কে জানে! দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবারো মুখ ঘুরিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলায়। এই রুমটা গেস্ট রুম, সিম্পলের মধ্যে ডেকোরেশন করা। দেখতে ভালো লাগলো অদ্রিজার। তাই নিজেই হাসলো।আপতত এই রুমটা তার। ফোন থেকে সময় দেখলো সকাল সাতটা তাই বিছানা থেকে নেমে চুলে হাত খোঁপা করে। মায়ের কিছু পাতলা শাড়ি ছিলো তা নিয়েছিলো নিজের সাথে সেখান থেকে একটা সবুজ শাড়ি পড়েই ঘুমিয়েছিলো। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে নিয়ে বিছানা ঠিক করে ওয়সশরুমে চলে যায়।
ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়ায়। ডাইনিং আর ড্রাইং রুম লাগোয়া। তারপর বামদিকে রান্নাঘর। এখন থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। অদ্রিজা ভাবলো কিছু রান্না করবে; লোকটা এমনিতেই অসুস্থ। যেই ভাবা সেই কাজ, বিড়াল পায়ে এগিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে অদ্রিজা হতবাক। একটা ব্যাচলর লোকের বাসার কিচেন এতোটা পরিপাাটি হতে পারে এই কিচেনে না আসলে হয়তো অদ্রিজা বিশ্বাস-ই করতো না। অবাক করা মুখেই সারা কিচেনে চোখ বুলিয়ে আটা ময়দা মাখে ভাবে রুটি বানাবে। যদিও অদ্রিজা জানে না সাইফান রুটি খায় নাকি তেলে ভাজা পরোটা। সাইফানের শরীর এমনিতেই ভালো না। তাই অদ্রিজা চায় না ভাজা পোড়া খেয়ে সাইফান আরো শরীর খারাপ করুক। ডক্টর এক সপ্তাহ বেড রেস্ট দিয়েছে। তার জন্য লোকটা কত বড় একটা বিপদে পড়লো ভাবতেই মন খারাপ হয়ে এলো অদ্রিজার। মন খারাপ নিয়েই রান্না শেষ করে। তখন সকাল নয়টা। তাই অদ্রিজা ভাবলো একেবারে গোসল নাস্তা করবে। তাই সেও ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখে ওয়াশরুমে চলে যায়।
—
নড়াচড়া করতেই শরীরের অদ্ভুত এক চিনচিন যন্ত্রণায় ঝাপটে ধরলো সাইফানকে। ঢোক গিলে ব্যাথাটা হজম করে উঠে বসলো তারপর পাশ থেকে ফোন তুলে সময় দেখে, সকাল নয়টা আটাশ! এতো সময় হয়ে গেলো। এখনো কিছু রান্না করা হয় নি। একটা মানুষ আছে বাসায়; নিজে একা থাকলে নাহলে এক কথা ছিলো কিন্তু বাচ্চা মেয়েটার কথা ভাবতেই খারাপ লাগলো সাইফানের। মেয়েটাকে কোনো সমস্যা পোহাতে হবে না বলে নিয়ে আসলো অথচ প্রথম দিনই এমন করলো সে। এখন নাস্তা বানাবেই কখন খাবেই কখন? বিরক্ত ধরলো নিজের ওপর; তারপর আবার সানাফকেও আনতে যেতে হবে।
ধীর পায়ে ড্রাইরুমে আসলো সাইফান। তবে ডাইনিং টেবিলে চোখ যেতেই কিছুটা অবাকের রেশ ছেয়ে গেলো সাইফানের মুখে। সে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এতো গোছগাছ দেখে অবাক হয়। ঢোক গিলে প্রতিটা বাটির ঢাকনা উঠিয়ে দেখে। মেয়েটা রান্না করতেছে? নিজের কাছেই খারাপ লাগলো সাইফানের। মেয়েটাকে সে আশা দিয়েছে অথচ মেয়েটা প্রথম দিনেই কাজ করছে। কারো অস্তিত্ব টের পেতেই পাশে ফিরে তাকায় সাইফান। অদ্রিজা ভেজা চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে আসছে, তার শরীরে হালকা মেরুন রঙের সুতির শাড়ি। সদ্যস্নান করে বেরিয়েছে হয়তো; অদ্ভুত লাগলো, হুট করেই এই শ্যামলা চেহারা মেয়েটাকে দেখে। সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নেয় সাইফান। তারপর বড় বড় শ্বাস টানে। ততক্ষণে অদ্রিজার এসে সাইফানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে সাইফানকে দেখে ভুল করেছে এমন ভাবে মাফ চাওয়ার মতো মিনমিন স্বরে —–
‘ আপনাকে না বলে আপনার কিচেনে গেছিলাম; তার জন্য আমি লজ্জিত ও দুঃখিত!’
সাইফান পাশ ফিরলো, অদ্রিজাকে দেখল তারপর আবারও টেবিলে তাকিয়ে বলে—–
‘ এগুলো আপনি করেছেন?’
’ হু!’
আবারও মিনমিন করে জবাব দেয় অদ্রিজা। সাইফান একটা শ্বাস ফেলে বলে—–
’ এতোটা কষ্ট করার কোন দরকার ছিলো না; আপনি আমার মেহমান!’
ভীত চোখে তাকায় অদ্রিজা, সে ভাবলো সাইফান রাগ করেছে তাই আবারো মিনমিন করে বলে—–
‘ আপনি অ-সুস্থ, আমার জন্য এতো বড় বিপদ দিয়ে আবার আমাকে আশ্রয় দিলেন। এই কাজটা সহজ, আমার করতে কোন কষ্টই হয় নি। উল্টো আপনার উপর আশা রেখে সব কিছু ফেলে রাখলে আমার খারাপ লাগতো। আর আমি রান্না পারি, আমার বাসায় মায়ের সাথেই আমি সব রান্না শিখে নিয়েছি। আপনি বসুন, খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিন।’
সাইফান ছোখ ছোট ছোট করে দেখলো অদ্রিজাকে। মেয়েটা নিষ্পাপ হাসলো। সাইফান চোখ সরিয়ে নিতেই চেয়ার টেনে দিলো অদ্রিজা। সাইফান প্রতিক্রিয়া বিহীন বসলো। অদ্রিজা খাবার উঠিয়ে দিতে দিতে বলে—–
‘ আপনার শরীর তেমন একটা ভালো না তাই তেলের জিনিস গুলো এভয়েড করার ট্রাই করেছি। খেয়ে নিন!’
আবারো তাকায় অদ্রিজার দিকে। অদ্রিজাকি এমন সহজ-ই? নাকি সহজ হবার নাটক বা চেষ্টা করছে? কেমন অদ্ভুত লাগছে মেয়েটাকে। গতকাল যে ভয়ে টু শব্দ করতে পারেনি আর আজকে এতোটুকু সময়ে এতো কথা বললো! শ্বাস ফেললো সাইফান ল। তারপর খাবার খেয়ে নিলো প্রতিক্রিয়া বিহীন অথচ অদ্রিজা খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো সে ভেবেছিলো খাবার কেমন হয়েছে সাইফান বলবে তবে তাকে হতাশ করে দিয়ে সাইফান চুপচাপ খেয়ে নিজের রুমে চলে গেছে। হতাশ ও আহত হয় বাচ্চা মেয়েটা।
—
এগারোটার দিকে সাইফান রুম থেকে বের হয়। তখন অদ্রিজা কিচেনে, দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাইফানকে রুম থেকে বের হতে দেখে অদ্রিজা কোমড়ে গুঁজে রাখা শাড়ির আঁচল ঠিক করে বেরিয়ে এসে উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করে——-
‘ কোথায় যাচ্ছেন?’
সাইফান ফিরে তাকায়। অদ্রিজা যে কিচেন থেকে বেরিয়েছে তা বুঝতে পেরে সেদিকে তাকায় সাইফান তারপর আবারো চোখ সরিয়ে অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বলে—–
‘ আপনি কিচেনে থেকে এলেন?’
ভীত হয়ে যায় অদ্রিজা। ভাবলো লোকটা হয়তো এবার রাগ করে দুচার কথা শুনিয়ে দেবে তাই ভীত কণ্ঠে বলে—–
‘ হ্যাঁ। ভাবলাম ফ্রী আছি দুপুরের জন্য রান্না করি। আপনি তো অসুস্থ! ’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো সাইফান। মেয়েটা কেনো বোঝে না, তার জিনিস অনুমতি ছাড়া কেউ ধরলে তা পছন্দ না সাইফানের। তবুও উচ্চবাক্য করে না সে। নরম গলায় বলে—–
‘ আমি সানাফকে আনতে যাবো। দরজা লাগিয়ে দিন, কেউ বেল বাজালে দরজা খুলবেন না। আমার ফিরতে লেট হলে আমি নিজেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে নেবো, সমস্যা নেই।’
‘ আচ্ছা।’
—-
একটু আগে মাগরিবের আযান দিয়েছে। অদ্রিজা নামাজ পড়ে উঠে বসেছে। অদ্রিজা ভেবেছিলো দুপুরেই সাইফান সানাফকে নিয়ে ফিরে আসবে তবে এখনো ফেরেনি। মনে মনে একটু চিন্তা হলো অদ্রিজার। সানাফের মুখটা ভেসে উঠলো। বাচ্চাটা দেখতে কিছুটা সাইফানের মতো হয়েছে। সানাফকে অদ্রিজা একবারই দেখেছিলো। তাও গাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায়; তখন অদ্রিজা নিজে থেকেই বুকের মাঝে ঝাপটে নিয়েছিলো৷ এবার ভাগ্যই কেমন তাকে বাচ্চার কাছে টেনে আনলো। সানাফের কথা ভাবতেই ঠোঁটে একটা মিষ্টি হাসি ফুটলো অদ্রিজার। এর মাঝে মনে হলো ফ্ল্যাটের দরজা কেউ খুলেছে, টের পেতেই অদ্রিজা নিজের রুমের দরজার কাছে এসে দাড়িয়ে বাহিরে তাকায়। সাইফান এসেছে তার একপাশে সানাফকে কোলে নিয়ে রয়েছে অন্য৷ পাশটা কেমন স্যাঁতস্যাঁতে লাগলো তাই দৃষ্টি আরেকটু তীক্ষ্ণ করতেই শার্টের সেই ভেজা স্যাঁতস্যাঁত ভাবের কারণ বুঝতে পারে অদ্রিজা। আবারো কা-টা জায়গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে? ভেবেই আঁতকে উঠল মেয়েটা। দ্রুত দরজার আড়াল থেকে বেড়িয়ে চিন্তিত গলায় বলে—–
‘ আপনার তো ব্লি-ডিং হচ্ছে।’
থমকায় সাইফান অদ্রিজার কথায়। অদ্রিজা চিন্তিত ও উৎকন্ঠা হয়ে তাকিয়ে আছে। সাইফান জবাব দিলো। এদিকে হুট করে অদ্রিজাকে দেখে সানাফ গোল গোল চোখে নিষ্পাপ মুখে তাকিয়ে থাকে তারপর সাইফানের উদ্দেশ্য নিষ্পাপ কণ্ঠে শুধায় —–
‘ পাপা, এতা কে?’
——
চলবে—!