পরাণ বধূয়া পর্ব-০৬

0
71

#পরাণ_বধূয়া —০৬
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
[সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ]

সাইফান ছেলের প্রশ্নে ছেলের দিকে তাকালো তবে কি জবাব দেবে খুঁজে পেলো না। সানাফ এখনো নিষ্পাপ চোখে একবার সাইফানের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার তার গোটা গোটা বাদামি রঙ্গের চোখ নিয়ে অদ্রিজার দিকে দেখছে৷ অদ্রিজা এগিয়ে এসে কিছুটা জড়তা নিয়ে সানাফকে টেনে কোলে তুলে নিয়ে সাইফানের উদ্দেশ্য বলে—–

‘ আমার মনে হয়, আপনার ব্যান্ডেজ টা ঠিক করা উচিত। রক্ত দিয়ে মাখা-মাখি অবস্থা। এমন হলে আপনার শরীর আরো খারাপ লাগবে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। বাবু আমার কাছে থাকুক।’

কপাল কুঁচকে চোখ ছোট করে অদ্রিজার কথা শুনলো সাইফান তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে—–

‘ আমার মনে হয় না, ও আপনার কাছে থাকবে। ও অপরিচিত মানুষের কাছে থাকে না, কান্নাকাটি করে তার চেয়ে বরং ওকে আমায় দিন।’

অদ্রিজা শুনলো না। নিজের মতো সানাফে কোলে নিয়ে পায়চারি করতে করতে বলে—–

‘ ও আমার কাছে থাকবে। চিন্তা করবেন না-ও কান্না করবে না। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। রক্তে যাচ্ছে-তাই হয়ে আছে। এমন হেলাফেলা করলে আপনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’

থমকালো সাইফান। জবাব দিতে চেয়েও দিলো না। শান্ত ভঙ্গিতে নিজের রুমে চলে গেলো। সাইফান চলে যেতেই এতোক্ষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে আটকে রাখা শ্বাস ফেলে। অদ্রিজা ভেবেছিলো সানাফকে দেবে না। কিন্তু দিলো যাক ভালোই হয়েছে। সানাফ নিষ্পলক চোখে অদ্রিজার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে অদ্রিজা মিষ্টি হাসলো তারপর জিজ্ঞেস করে—–

‘ তোমা নাম কি পাখি?’

সানাফ পিটপিট করে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে ছোট গলায় শুধায়—–

‘ তানাপ’

খিলখিল করে হেসে ফেলে অদ্রিজা৷ তারপর বলে——

‘ তানাপ না বাবা সানাফ, বলো সানাফ।’

‘ তানাপ।’

আবারো হেসে ফেলে অদ্রিজা। তারপর মিষ্টি গলাশ বলে—–

‘ আচ্ছা; তোমার নাম তানাপ।’

সানাফ মাথা নাড়িয়ে বলে—–

‘ তানাপ না তানাপ।’

অদ্রিজা হেসে ছোট ছোট পায়ে সারা ড্রইংরুম পায়চারী করে। সানাফের বয়য়সের করণে তার কথা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে অদ্রিজা ওর নাম ভুল বলেছে তাই নিজের সঠিক নাম বলেছে অথচ তার উচ্চারণ স্পষ্ট না হবার কারণে দুটোই এক শোনাচ্ছে। এটা সেটা গল্প করতে করতে সানাফের চোখে ঘুম নেমে আসে। কিছুসময়ের মাঝে ঘুমে তলিয়েও যায় বাচ্চাটা। তাই অদ্রিজা থেমে যায়। তারপর সাইফানের রুমের দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। ধীরে একটা বালিশে সানাফ কে শুয়িয়ে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে সানাফকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। সানাফও উষ্ণ দেহের ওম পেয়ে পাখির ছানার মতো গুটিয়ে যায় অদ্রিজার তনুর সাথে। অদ্রিজা দেখলো তারপর সানাফকে আরেকটু মিশিয়ে নিয়ে নিজেও চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। সময় ব্যবধানে অদ্রিজাও ঘুমিয়ে গেলো সানাফের সাথে।

ফ্রেশ হয়ে ব্যান্ডেজ করে নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে, ড্রইংরুমে এসে রুম ফাকা দেখে কপাল কুঁচকায় সাইফান তারপর ভাবে হয়তো অদ্রিজা নিজের রুমে গেছে তাই অদ্রিজাকে না ডেকে সরাসরি কিচেনে এসে সব খাবার গরম করে সাইফান। টুকটাক সব কাজ গুছিয়ে খাবার গুলো ডাইনিং রুমের টেবিলে এনে রাখে। তারপর সানাফের জন্য খাবার গরম করে এনে রেখে ভাবে এবার অদ্রিজা আর সানাফকে ডাকবে; তাই ড্রইংরুমে আসতেই দরজার কলিংবেল বেজে উঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রইংরুমে থাকা বড় ঘরিটার দিকে তাকালো। সময় রাত সাড়ে এগারোটা; এই সময় তো কারো আসার কথা না; তাহলে কে এলো। এর মধ্যে আবারো দরজার বেল বাজে তাই বিরক্ত পায়ে এগিয়ে এসে দরজা খুলতেই রমিশা কে দেখে অবাক হয় সাইফান। রমিশা সাইফানকে কথা বলার সময় না দিয়ে সাইফানকে হাত দিয়ে সরিয়ে বাসার ভেতরে চলে আসে। সাইফান শান্ত চোখে দেখে। রমিশাকে দেখে কোনো ভাবেই স্বাভাবিক লাগছে না!

রমিশা এদিক সেদিক তাকিয়ে এলোমেলো চোখে চেয়ে বলে—–

‘ সানাফ কোথায়?’

‘ কেনো এসেছো?’ -শান্ত, শীতল, নির্জীব সাইফানের কণ্ঠ। রামিশা কপাল কুঁচকায় তারপর বলে—–

‘ আমার ছেলেকে দেখতে।’

‘ সেটার অধিকার তুমি আরো সাড়ে তিন বছর আগে হারিয়েছো রামিশা। এতো রাতে একটা পুরুষের বাসায় এভাবে আসাটা নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলার কাতারে পড়ে না। যেখান থেকে এসেছো সেখানে চলে যাও রামিশা। সানাফকে দেখার দরকার নেই।’

রেগে গেলো রামিশা। তারপর বলে—–

‘ আমি সানাফকে জন্ম দিয়েছি। তুমি এসব কথা কেনো বলছো? কি বোঝাতে চাও তুমি? আমার কোন অধিকার নেই?’

‘ না নেই। থাকলে — আমার নিশ্চয়ই পিছনের সব কথা মনে করিয়ে দিতে হবে না রামিশা। এখন যেখান থেকে এসেছো দয়া করে সেখানে যাও।’

জেদ দেখায় রামিশা। নিজের কথায় জেদ নিয়েই বলে—–

‘ যাবো না আমি, কি করবে তুমি?’

‘ কিছুই না। শুধু তোমায় বাসা থেকে বের করে দেবো।’

চমকে যায় রামিশা। তারপর চমকানো গলায় বলে—–

‘ তুমি আমায় বাসা থেকে বের করে দেবে? এই বলো তো তোমার কি হয়েছে? তুমি আর আমাকে ভালোবাসো না? বলো! এই সানাফের পাপা বলো?’

মুখ ঘুরিয়ে নিলো সাইফান তারপর শক্ত ও গম্ভীর গলায় বলে—–

‘ ভালো তাকেই বাসা যায় যে যোগ্যতা রাখে; তুমি সেই যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছো। এখন কেনো এসেছো? সানাফ তো তোমার কাছে ছুঁতো মাত্র, টাকা চাই? কত টাকা চাই তোমার?’

রামিশাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে হয়তো ড্রাংক। তাই সাইফান চায় না এখানে কোনো ধরনের তামাশা হোক কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হোক।

খিকখিক করে হেসে ফেলে রামিশা। তারপর প্রশংসা করার ভঙ্গিতে বলে——

‘ এর জন্যই আমি তোমায় এতো পছন্দ করি সাইফান। আফটারঅল ইউ আর অ্যা জেন্টাল ম্যান এন্ড অলসো অ্যা জিনিয়াস ডক্টর। বেশি না; ছিয়াশি হাজার লাগবে আপতত। পরে আবার লাগলে বলবো।’

সাইফান প্রতিক্রিয়া বিহীন নিজের রুমে চলে যায় তারপর একটা ব্ল্যাংক চেক এনে রামিশার দিকে এগিয়ে দেয় তারপর নির্বিকার চিত্তে বলে——

‘ যা লাগবে নিয়ে নিও তবুও এমন হুটহাট রাতে এসো না। এটা ভদ্রলোকের বাসা। তোমার এমন আচারণের কারণে সোসাইটিতে আমায় একঘর করে দিও না। এখন আসতে পারো।’

রামিশা চেকটা হাত বাড়িয়ে নিলো তারপর হেসে বলে—–

‘ আজকে আমার মন ভালো সাইফান তাই চেঁচামেচি করিনি। আর তুমিও আজকে সহজে মেনে নিয়েছো। এমন সবসময় গুডবয় থাকলেই পারো।’

কথাটা বলেই হাসলো রামিশা। অদ্রিজা কেবল সানাফ কে কোলে নিয়ে নিজের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো। তবে একটা ওয়েস্টার্ন পার্টি ড্রেস পড়া মেয়ে দেখে থমকালো। স্লিভলেস ব্যাকলেস কালো রংয়ের একটা পার্টি ড্রেস। মুখে সুন্দর করে মেকআপ করা; চুল গুলো সোনালী রংয়ের কালার করা। ফর্সা মুখে মেয়েটিকে এই সাজে ভালোই মানেয়েছে। সাইফানের সাথে কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে তবে সাইফানের চেহারা নিরোট, নির্জীব, নির্বিকার। এখানে ঠিক কি হয়েছে অদ্রিজা বুঝলো না। ফ্যালফ্যাল চোখে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো। রামিশা কথা শেষ করেই বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করে হাসলো। তারপর হাসি থামাতেই চোখ যায় সাইফানের পিছনে গেস্ট রুমের দরজার দিকে যেখানে অদ্রিজা দাড়িয়ে, অদ্রিজার শরীর একটা মেরুন রঙের শাড়ি জড়িয়ে আছে; তার কোলে সানাফ। কি সুন্দর বুকে মাথা পেতে লেপ্টে আছে ছেলেটা। সাইফানের বাসায় একটা মেয়ে?

রামিশা শান্ত চোখে অদ্রিজাকে পর্যবেক্ষণ করে আগুনের মতো ধপ করে ছলকে জলে উঠলো। চোয়াল শক্ত করে সাইফানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে——

‘ সাইফান এই মেয়েটা কে? বিয়ে করেছো তুমি?’

সাইফান নির্বিকার ভঙ্গিতে পিছনে ফিরে তাকায় তারপর অদ্রিজা আর সানাফ কে দেখে শান্ত শীতল গলায় আদেশ সরূপ অদ্রিজাকে বলে—–

‘ অদ্রিজা সানাফকে নিয়ে রুমে যান!’

রামিশা এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো কিছুটা চেঁচিয়ে বলে—–

‘ ঘরে যাবে কেনো? কে ও? আমার ছেলে ওর কাছে কেনো? কি হয় তোমার? বিয়ে করে নিয়েছো তাই না? তাই তো বলি! তোমরা সব পুরুষেরা এক; কচি মেয়ে দেখতে না দেখতেই বিয়ে করে নিয়েছো? কতদিন হয়েছে?’

‘ রামিশা জাস্ট স্টপ। যা তা বলছো — আমি কোনো বিয়ে করিনি।’

রামিশা আবারো অদ্রিজার দিকে তাকালো। অদ্রিজা কিছুই বুঝতে পারছে না তাই ফ্যালফ্যাল নয়নে এখনো একই জায়গায় স্থীর দাঁড়িয়ে আছে। রামিশা চেঁচিয়ে রাগত্ব গলায় আবারো বলে—–

‘ বিয়ে করো নি মানে? তাহলে ও তোমার বাসায় কি করছে? ও তোমার বউ নয়; তাহলে কেনো ও তোমার বাসায়? ওকে দেখে কোনো ভাবেই কাজের লোক মনে হচ্ছে না। আর তুমি এমন একটা মেয়ে কাজের জন্য বাসায়ও রাখবে না। তাহলে কে ও?’

ধৈর্য ধরে চুপ করে আছে সাইফান৷ রামিশা যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে ফেলছে। রামিশা এবার এগিয়ে এসে সাইফানের টিশার্ট খাবলে ধরে চেঁচিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করে—–

‘ কথা বলছো না কেনো সাইফান? ও কে? কি সম্পর্ক তোমাদের? লিভ ইন করছো? ও বুঝেছি ও তোমার রক্ষিতা তাই না?’

সাইফান এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো রামিশাকে। তারপর বলে—–

‘ ওর ব্যাপারে আর একটা কথাও বলবে না রামিশা।’

‘ তুমি ওর জন্য আমার সাথে এমন ব্যবহার করলে সাইফান?’

‘ হ্যাঁ। করেছি। যা তা বলবে না ওর ব্যাপারে।’

‘ একজন রক্ষিতার জন্য এতো দরদ।’

‘ রামিশা।’

‘ চিৎকার করবে না সাইফান। তুমি ডিভোর্সী ওর মতো একটা মেয়ে নিশ্চয়ই এমনি এমনি তোমার সাথে থাকছে না? কি সম্পর্ক তোমাদের জবাব দেও আমায়, টেল মি… হু ইজ শি? কি সম্পর্ক তোমাদের মাঝে, কতদিন একসাথে থাকছো? তোমার ব্যপারে আমি ভালো করে জানি সাইফান, একটা মেয়ে তোমার সাথে থাকছে আর তাকে তুমি ছুঁয়ে দেখো নি এটা আমি বিশ্বাস করি না। কতদিনের সম্পর্ক বলো আমায়? এর জন্যই বার বার চলে যেতে বলছিলে তাই না? !’

রামিশা আর সাইফানের চেঁচামেচিতে পাশের ফ্ল্যাটের লোকেরা বেড়িয়ে এলো। দরজা আগে থেকেই খোলা ছিলো। লোক গুলো যেনো কথা বলার কারণ খুঁজে পেলো। সব কথা শুনে সবাই ছি-ছি করছে অনেকেই, কারণ সবাই সাইফানকে ভদ্রলোক বলেই জানতো। তার ঘরে এমন একজন মেয়ে আছে আর এমন সম্পর্ক তা শুনে ছি ছি করছে। ভীর জমতে জমতে অনেকেই এসে ভীর জমিয়েছে সাইফানের ফ্ল্যাটের সামনে।

এতো চেঁচামেচিতে সানাফ চেঁচিয়ে গলা ভেঙে কেঁদে উঠলো। অদ্রিজাও এসব কথার মানে বোঝে না এমন নয়, তাকে কি বলা হয়েছে, কতটুকু হেও ঘৃণা, নিতু মনমানসিকতা নিয়ে তাকে আর সাইফানকে জড়িয়ে এসব বলেছে সবই সে বুঝেছে। চোখ ভেঙে নিঃশব্দে অশ্রু গড়াচ্ছে অদ্রিজার চোখ থেকে। সাইফান অসহায় দৃষ্টি নিয়ে অদ্রিজার দিকে তাকালো। রামিশা রাগে ফুশছে। অদ্রিজা সানাফকে থামানোর চেষ্টায় বুকে চেপে ধরে আছে তবে নিজের অশ্রুর বাঁধ থামছে না। এর মধ্যে গুঞ্জন উঠলো — হারাম সম্পর্কে থেকে বিয়ে দিয়ে দেন। যদি ডক্টর সাইফান বিয়ে না করে তাহলে সোসাইটি থেকে এখনি বেড়িয়ে যেতে হবে। আর মেয়েটাকে চরম শাস্তি দিতে হবে।

—-—
চলবে—!