#পরাণ_বধূয়া —০৮
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
[সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ]
চড় গুলো এতোটাই জোড়ালো ছিলো যে লোকেরা এখনো নিজেদের হতভম্ব ভাব কমাতে পারছে না। অদ্রিজা ঘুরে সবার মুখ দেখলো তারপর আবারো রামিশার দিকে তাকিয়ে বলে——
‘ কি হয়েছে? এখনো বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? ’
রামিশা অপমানে গালে হাত দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে সাইফানের দিকে তাকায়। সাইফান নিজেই বোকা হয়ে আছে। সে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। অদ্রিজা রামিশার দৃষ্টি অনুসরণ করে সাইফানের দিকে তাকায়। সাইফান হতবাক মুখ নিজে সানাফকে বুকে চেপে সোফায় বসে আছে। অদ্রিজা দেখলো তারপর প্রতিক্রিয়া বিহীন রামিশার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে—–
‘ উনি কিছু বলবে না৷ তাই এখন তাকিয়ে থেকেও লাভ নেই। আপনি এখন আসতে পারেন!’
রামিশা অপমানে থমথমে মুখ নিয়ে বলে—–
‘ তোমায় আমি পড়ে দেখে নেবো!’
‘ পরে দেখার দরকার নেই। আমার কথা মনে পড়লে এই চড় গুলোও মনে পড়ে যাবে!’
কথাটা বলেই ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে অদ্রিজা। রামিশা রাগান্বিত মুখে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। এবার অদ্রিজা বাকি মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখলো সবাই এখনো চুপচাপ তাকিয়ে আছে। অদ্রিজা হাসলো তারপর শান্ত চোখে তাকিয়ে বলে—–
‘ মানুষের একটা বিপদ হোক, আপনাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু তামাশার কথা বলেন; এই যে আপনারা কোথা থেকে চলে এলেন, এমন চলে আসেন! একটা বাহিরের মানুষের কথার ভিত্তিতে আপনারা তামাশা বানালেন! অথচ এবারো শুনতে চেয়েছেন আমার আর ডক্টর সাহেবের সম্পর্ক কি? না! আপনারা একপাক্ষিক বিচার করে — ডক্টর সাহেব আর আমার জড়িয়ে উল্টোপাল্টা কথা বললেন। চরিত্রে কালি লেপ্টে দিলেন। আসলে আপনাদের বলেই লাভ কি? সোসাইটি মানেই এমন! ত হলে তাল বানানোর জন্য সবাই উঠেপড়ে লেগে যায়। যাক ভালোই হলো। এখন দয়া করে আপনারা আসতে পারেন। আপনাদের আমাদের কোনো দরকার নেই। দয়া করে আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে আসবেন না। আমি চাই না আপনাদের এই মজার তামাশার কারণে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব পড়ে।এবার আসুন।’
অদ্রিজা কথা শেষ করে লম্বা শ্বাস ফেলে। সাইফান হয়তো কিছু একটা বলতো তবে অদ্রিজার রাগে মাথার ভেতর ধপধপ করছে। কাউকে খু-ন করতে পারলে আপতত শান্তি লাগতো। কিন্তু এটা আপতত কখনোই সম্ভব না। তাই মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে এসে সাইফানের সামনে এসে দাঁড়ায় তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে——–
‘ ছেলে দিন; উনারা গেলে দরজা বন্ধ করে আসবেন।’
একটা সিগনেচার একটা কবুলে এতো জোর? এতো অধিকারবোধ? সাইফান ঢোক গিললো তারপর অরিজার শ্যামবর্ণের রাগান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে সানাফকে কোলে তুলে দেয়। অদ্রিজাও সানাফকে কোলে তুলে হেটে ড্রাইংরুমের মাঝে এসে আবারো থমকে দাঁড়ায় তারপর পিছনে ঘুরে সাইফানকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাস করে—–
‘ আপনার রুমে যাবো নাকি গেস্ট রুমে?’
সাইফান ঢোক গিললো। কে যেনো বলেছিলো —“ ছোট মরিচে ঝাল বেশি। ” কথাটা এখন মনে হচ্ছে প্রমাণ পেয়ে গেলো। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আবারো অদ্রিজার পাণে তাকিয়ে বলে—–
‘ আ-মার রু-মে।’
অদ্রিজা চলে গেলো। অদ্রিজা যেতেই সাইফান লোক গুলোর দিকে তাকালো তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে——–
‘ আপনারা যাবেন নাকি—?’
‘ যাচ্ছি।’ এই চলো – চলো।’
কথাটা বলেই সবাই বিদায় নেয়। বিদায় নিতেই দরজা বন্ধ করে দেয় সাইফান। তারপর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে। পরিস্থিতি কোথা থেকে তাকে কোথায় নিয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য! খাবার টেবিলে খাবার এখনো পড়ে আছে। খেতে ইচ্ছে করছে না। অদ্রিজাও যে এতো সব হবার পর খাবে না সেটাও সে বুঝতে পারলো কেনো যেনো। তাই ধীর পায়ে এগিয়ে নিজের রুমে সামনে এসে দরজায় নক করলো। ভেতর থেকে কোনো উত্তর এলো না তাই দরজাটা হালকা খুলে মাথা ঢুকিয়ে রুমের দিকে তাকায়। অদ্রিজা সানাফকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। ঘুমিয়েছে কিনা বুঝতে পারলো না। কিনৃতু সানাফকে তো খাওয়াতে হবে নাহলে এখন আর এই রুমে আসতো না সাইফান তাই জড়তার সাথে দরজা ঢেলে ভেতরে ঢোকে সাইফান। অদ্রিজা টের পেতেই গম্ভীর গলায় বলে—–
‘ ওখানেই দাড়ান। ”
সটান হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সাইফান। কি একটা অবস্থা।ঝুপ করে উঠে বসে অদ্রিজা তারপর রক্তলাল বর্ণের চোখে তাকিয়ে বলে——
‘ সব সময় কি এমন চুপই থাকতেন? লোকজন যা তা বলছিলো! আর ওই —’
‘ কনগ্রেচুলেশনস মিসেস. ইয়াজিদ।’
‘ রাখেন আপনার শুভেচ্ছা। জবাব দিন!’
‘ ছেলেকে খাওয়াতে হবে; ওকে দিন!’
‘ দেখুন ডক্টর সাহেব, যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব আগে দিন!’
‘ সেটার জন্য অনেক সময় পরে আছে! এখন আপতত খেতে হবে।’
মেজাজ খারাপ হয়ে এলো অদ্রিজার। ঝুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। সাইফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এই মেয়ের রগে রগে এমন ত্যাড়ামি নাকি আজকে ইচ্ছে করেই এমন করছে কে জানে! ততক্ষণে অদ্রিজাও গম্ভীর কণ্ঠে বলে—–
‘ ছেলে নিয়ে যান। আমি দিতে পারবো না।’
আবারো শ্বাস টানলো সাইফান। তার সাথে হচ্ছে কি এসব? মেয়েটাকে ঘরে জায়গা দিয়ে ঝামেলার পর এখন মনে হচ্ছে মেয়েটার ঘর আর সে এমনি থাকতে এসেছে। কই সিজানের সাথে তো এমন ত্যাড়া ত্যাড়া জবাব দিতে পারে নি। তাহলে সাইফানের সাথে এমন ত্যাড়ামি করার মনে কি? নিত্যন্তই ভদ্রলোক সাইফান যদি এটা ভার্সিটি লাইফ হতো তাহলে অদ্রিজার এই ত্যাড়ামি ছুটাতে ঘন্টার ব্যবধাণ হতো না। ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়ে যাবার আগে অদ্রিজা বলে—–
‘ এই রুমেই আসবেন। কথা আছে আপনার সাথে; খবরদার যদি অন্য রুমে যান তো আপনার খবর আছে।’
আবারো ঢোক গিললো সাইফান। এই মেয়ে এমন করছে কেনো? রামিশাকে চড়ানোর দৃশ্য দেখে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হতে ইচ্ছে করছে না সাইফানের। কেমন ভয় ভয় লাগছে। সে তো এমন ভীতু ছিলো না। অথচ এক দু-আঙ্গুলের মেয়ে রামিশার মতো মেয়েকে চড়াতে পারে সে সব পাড়বে; সেখান সাইফান কোন ছাঁই।
ছেলেকে কোনো মতে খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে এসে বিছানায় রাখে। অদ্রিজা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো। সাইফান সানাফকে অদ্রিজার পাশে বিছানায় রেখে বিপরীত পাশে এসে বসতেই। অরিজা ঘুরে তাকায় তারপর রাগান্বিত মুখে বলে—–
‘ এখান থেকে উঠুন; উঠুন — আগে আমার সব প্রশ্নের জবাব দেবেন। তারপর বসবেন নাকি ঘুমাবেন আপনার ব্যপার!’
সাইফান জোরপূর্বক হাসার জন্য ঠোঁট প্রসারিত করলো হলো না তবে অদ্রিজার ঝাড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলো তারপর মুখ ছোট করে বলে—–
‘ পেটের দিকটা ব্যাথা করছে। একটু বসি মিসেস?’
চোখ ছোট ছোট করে তাকায় অদ্রিজা। এই লোক এমন ভীতু হয়ে আছে কেনো? অদ্রিজাকি আসলেই এমন কিছু করে ফেলেছে তাই লোকটা তাকে ভয় পাচ্ছে? তবুও নরম হলে চলবে না অদ্রিজা। তোর মা তার সংসার বাঁচাতে পারেনি, সংসার করে মরেছে। তাই বলে তুই তো আর – তোর সংসার বাণের জলে ভাসিয়ে দিতে পারিস না। ওই রামিশা শাঁক-চুন্নির হাত থেকে সবাইকে বাঁচাতে হলে এমন ভয়েই রাখতে হবে। আর এই ডক্টরকে আঁচলে রাখতে হলে এমন ভয় পাওয়াও ভালো। এটলিস্ট ওই রামিশার সাথে কথা বলতে যাবে না। এসব ভেবে দম ছাড়লো। সাইফান অদ্রিজার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। তাই অদ্রিজা গম্ভীর মুখেই বলে—–
‘ হু; বসুন তারপর প্রথম থেকে সব বলবেন!’
সাইফান পেটের কাছ থেকে ধরে বিছানায় বসলো। তারপর বালিশ নিয়ে পিঠের পেছনে দিয়ে হেলান দিয়ে বলে—–
‘ ওই পাশের বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ারে একটা এইড বক্স আছে। একটু দেবেন।’
অদ্রিজা উঠে এসে ড্রয়ার থেকে বক্স নেয়। তারপর আবারো এসে নিজের জায়গায় বসে। সাইফান বলে—–
‘ আমি ড্রেসিং করবো? আপনি কি তাকিয়েই থাকবেন?’
‘ এখন নির্লজ্জ ভাবলে ভাবুন আমার কিছু করার নেই। বিয়ে করেছি সংসারও করতে হবে। তাই সব কিছু এখন নিজেরই করতে হবে। দ্রুত বলুন। আর শার্টটা খুলুন আমি ড্রেসিং করে দিচ্ছি। ’
হতবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সাইফান। তা দেখে অদ্রিজা নিজেই সাইফানের শার্টের বোতামে হাত দেয়। সাইফানও চমকে অরিজার ছোট হাতটা চেপে ধরে বলে—–
‘ কি করছেন?’
‘ জামাইয়ের সেবা।’
বোকা বনে যায় সাইফান। মাথার স্ক্রু কি ঢিলা নাকি এই মেয়ের? বিয়ে হয়েছে কোথায় রাগারাগি করবে,কান্নাকাটি করবে অথচ এই মেয়ে এমন প্রতিক্রিয়া করছে যেন এটা হওয়ারই ছিলো। অদ্রিজা চুলে একটা হাত খোঁপা করে। তারপর অন্য হাত দিয়ে সাইফান হাত সরিয়ে শার্ট উন্মুক্ত করে ব্যন্ডেজটা খুলে নিয়ে তারপর একটা তুলো নিয়ে তাতে স্যাবলন নিয়ে নেয়। সাইফান বোকার মতো অরিজার ছোট মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্রিজা প্রতিক্রিয়া বিহীন কা-টা জায়গায় তুলোটা চেপে ধরে বলতে শুরু করে—–
‘ আপনার আমার বিয়েটা যেভাবে হয়েছে, হয়েছে। আমার একটা থাকার জায়গা লাগতো, আপনার বাচ্চা সামলানোর জন্য একটা বিশ্বস্ত মানুষ লাগতো। আর সানাফানের দেখা শুনার জন্য তার কাছের কেউ। আমরা সবাই আমাদের স্বার্থ নিয়েই ছিলাম। তবে ভাগ্যবশত আপনি আমার স্বামী হলেন। আমি আপনার বউ আর সানাফের মা। এখন আগে কি হয়েছে তা না ভেবে সামনের দিনের কথা ভাবুন। আর একটা কথা মনে রাখবেন, বিয়ে একটা পবিত্র জিনিস। খোদা তায়ালা স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ অপছন্দ করে। এখন কথা হলো এসব কথা কেনো আপনাকে বলছি। আমি আপনার স্ত্রী। আমি জানিনা আপনার সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিলো৷ কি হয়েছে। তবে আপনি আমাকে বলবেন।আমি শুনবো। তার আগে আমার দিকটা আপনার শোনা উচিত। জানা উচিত — কেনো আমি সহজ হতে চাইছি। আজকে রাতটা আমি এই রুমে থাকবো। সব বলবো, আপনিও বলবেন। দুজনেরটা পরিষ্কার হবার পরে আগামীকাল আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন এই মিসেসে. অদ্রিজা ইয়াজিদের স্থান গেস্ট রুমে হবে নাকি এই রুমে। ’
——
চলবে!