পরাণ বধূয়া পর্ব-১১

0
77

#পরাণ_বধূয়া —১১
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
[সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ]

সাইফানের কথায় চমকায় অদ্রিজা। বোকা গলায় জিজ্ঞেস করে——–

‘ অসুস্থ আপনি; ডক্টরও আপনি! তাহলে আমি ডক্টর দেখাতে যাবো কেনো?’

সাইফান শীতল চোখে তাকিয়ে জবাব করে——– ‘ আমি সাইক্রোয়াটিস্ট এর কথা বলেছি।’

‘ ও আচ্ছা।’
কথাটা বলেই আবারো ভরকানো চোখে তাকায় অদ্রিজা তারপর জিজ্ঞেস করে——–

‘ সাইক্রোয়াটিস্ট মানে পাগলের ডক্টর? আমি কি পাগল নাকি?’

আবারো শান্ত চোখে তাকায় সাইফান তারপর বলে——–

‘ সাইক্রোয়াটিস্ট বলতে পাগলের ডক্টর নয় – মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বোঝায়!’

‘ হ্যাঁ। তো?’

‘ তো হলো আপনি ডক্টর দেখাবেন!’

‘ আমি তো সুস্থ। শুধু শুধু ডক্টর দেখাবো কেনো?’

শক্ত ঢোক গিলল সাইফান৷ মেয়েটা এতো প্রশ্ন করে। তবুও বলে——–

‘ আপনি সুস্থ আমি জানি৷ তবুও চেকআপ করা ভালো।’

কিছুসময় নিরব চোখে চেয়ে রইলো অদ্রিজা। সাইফানও দেখছে। অদ্রিজা কিছু একটা ভেবে বলে——–

‘ ডক্টর দেখানোর সাথে সানাফের কি সম্পর্ক?’

‘ কোনো সম্পর্ক নেই। এমনি দেখাবো৷ কালকে সকালে রেডি হয়ে থাকবেন। আপনাকে ডক্টর দেখিয়ে আপনার জন্য কিছু কেনা কাটা করতে হবে। এখন ঘুমান। আমি পাশের রুমেই আছি। আর সানাফকে—!’

কথা সম্পূর্ণ করতে দিলো না অদ্রিজা। তার আগেই হরবরিয়ে বলে,

“ছেলে আমার কাছে থাকুক।”

অদ্রিজাকে শান্ত দৃষ্টিতে পরক্ষ করে সাইফান। তারপর আবারো ছেলের পানে তাকায়। দৃষ্টি স্থীর রেখে বলে,

” আপনি শিউর, সানাফকে রাখতে পারবেন?”

“এতিমখানায় অনেক বাচ্চাই রেখেছি ডক্টর সাহেব। চিন্তা করবেন না।”

” আচ্ছা। দরকার হলে ডাকবেন। আমি পাশের রুমেই আছি।”

কথাটা বলেই সাইফান উঠে দাঁড়ায় চলে যাবার জন্য। তার সাথেই অদ্রিজা কি মনে করে সাইফানের হাত টেনে ধরে। চমকে তাকায় সাইফান। তার সরল দৃষ্টি রাখে মেয়েটির মুখে। অদ্রিজা ঢোক গিলে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে সহজ গলায় বলে,

” আমি আপনাকে মেনে নিয়েছি ডক্টর সাহেব। সম্পর্ক সহজ করতে হলে এখানে এক সাথে থাকতে হবে। আর কাছাকাছি থাকলে সানাফেরও সব বুঝতে সুবিধা হবে। এখন একটুআধটু বোঝতে শিখবে। এতোদিন যা হয়েছে তা হয়েছে। আমি চাইনা ছেলেটা এসব দেখে বড় হোক।”

শান্ত নয়নে তাকায় সাইফান৷ মেয়েটার মাথায় কি গন্ডগোল আছে নাকি সে এমনি এমনি বলছে? অজানা অপরিচিত একলোক সাইফান, তাকে এভাবে বিশ্বাস করছে কেনো অদ্রিজা? তাই মনের জল্পনা-কল্পনা চেপে না রাখতে পেরে প্রশ্ন করে,

” আমি অপরিচিত লোক! এতো বিশ্বাস করছেন কেনো?”

অদ্রিজাও নিরোট মুখে সরল দৃষ্টি নিজে সহজ গলায় বলে,

” আপনার ব্যপারে যতটুকু দেখেছি। শুনেছি; আপনাকে ওই টাইপ লোক মনে হয় নি৷ এতিমখানায় বড় হওয়া মেয়ে আমি! একটু হলেও মানুষ চিনি। বোকা নই!”

কেনো যেনো আবারো হাসি পেলো সাইফানের। তবুও তা নিজের মাঝে চেপে রেখে কপাল কুঁচকায় তারপর বলে,

” আমায় কোন দিক থেকে ভদ্রলোক মনে হচ্ছে?”

“যেদিক থেকেই মনে হোক। রুম আপনার আপনি এখানেই থাকবেন। আর আমি আমার স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবো। আর আমি চাই না – ছেলেটা আমার মতো চাইল্ডহুড ট্রমা দিয়ে বড় হোক।”

লম্বা শ্বাস ফেললো সাইফান। অদ্রিজাকে যেমনটা ভেবেছিলো। তারথেকেও স্ট্রেট ফরওয়ার্ড মেয়ে অদ্রিজা। তাই বিনা প্রতিক্রিয়ায় বিছানায় বসে ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর বলে,
“আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি এখানেই আছি।”

শান্ত, শীতল ও সরল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অদ্রিজা। তারপর বলে প্রশ্নবিদ্ধ গলায় শুধায়,-
“আপনি ঘুমাবেন না?”
” হু! ঘুমাবো।”
“কখন?”

সাইফান আবারো শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকায় অদ্রিজার মুখে পানে। মেয়েটা চাইছে কি? ঢোক গিললো সাইফান। জবাব করলো-

” আপনি ঘুমান৷ আমার ঘুম আসছে না।”

” মাথা ব্যাথা করছে? ম্যাসাজ করে দেবো?”

আসলেই মাথা ধরে ছিলো সাইফানের। কিন্তু এই মেয়েটা বুঝলো কি করে? অবাক হয়ে যায় সাইফান। তবে তা বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক ও শান্ত গলায় শুধায়—

” আপনি বুঝলেন কি করে?”

” অতীত মনে করেছেন সাহেব! অতীত যে বড্ড যন্ত্রণাদায়ক। সেখানে তো আপনি ধোঁকা খাওয়া লোক। কাছে আসুন। আমি মাথা ম্যাসাজ করে দেই।”

ঢোক গিলল সাইফান। মেয়েটা এমন সহজ কেনো? সাইফান তো সহজ হতে পারছে না। উল্টো মেয়েটা যতবার সহজ হতে চাইছে ততবার জড়তা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে সাইফানকে। অদ্রিজা সাইফানের মুখাবয়ব পর্যবেক্ষণ করে শান্ত গলায় শুধায়-

” আপনি কি হেজিটেড করছেন?”

সাইফান তাকিয়ে আছে জবাব দেয় না। তাই অদ্রিজা একটু এগিয়ে এসে সাইফানের কাছাকাছি বসে। তারপর সাইফানের চুলের মধ্যে হাত ঢুবিয়ে দিয়ে বলে,

” আমাদের সবার জীবনের একটা না একটা বাঁধা কিংবা গল্প আছে। যেগুলো ভেবে কখনো আমরা আনন্দিত হই কখনো মন খারাপ করি। ধরুন ওই জিনিসটা যদি না হতো তাহলে জীবন আমাদের সাদামাটা হতো। কিন্তু প্রতিটি ঘটনার একটা কারণ থাকে। এই যে ধরুন – আমার বাবা – মায়ের যে ঘটনা। সেটা থেকে আমি কি শিক্ষা পেয়েছি? যত যাই হোক – কারো প্রতি অন্ধবিশ্বাস, অন্ধ ভালোবাসা থাকা যাবে না। আবার কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না। ধরুন আমি যদি একটা সুস্থ পরিবেশে বড় হতাম তখন কখনোই একটা পরিবারের মূল্য বুঝতাম না। আর না ওই বাচ্চা কালের ওই সব কিছু সাক্ষী হতাম। সাক্ষী হয়েছি বিধায় — আমি চাই না আমার জীবন আমার মায়ের মতো হোক, আর আমার বাচ্চারা আমার মতো জীবন পার করুক। আমি আমার বাচ্চাদের সে সব দেবো যা আমি পাই নি। কিন্তু তার ঘাটতি অনুভব করেছি। তবে এসবে আপনার সাহায্য প্রয়োজন!”

কথাটা টুকু বলে থামে অদ্রিজা। সাইফান অদ্রিজাকে যত দেখছে, শুনছে অবাক হচ্ছে। এই মেয়েটা কি আদৌও সুস্থ নাকি…!

ভাবনার মাঝে অদ্রিজা আবারো বলতে শুরু করে——–

‘ ধরুন আপনার সাথে যদি রামিশার ওই ঝামেলা না হতো আপনার সাথে আমার কখনো দেখাই হতো না। তবে ওই ঝামেলার পর হয়তো আপনি মুখ থুবড়ে পড়ে আবারো সেখান থেকে উঠে লড়তে শিখেছেন। ছেলেকে নিয়ে বাঁচতে শিখেছেন। এর জন্য আপনাকে নিয়ে আমার গর্ববোধ হচ্ছে। এটলিস্ট আমার মায়ের মতো বোকামি করেন নি। আমরা বাঙ্গালিরা অনেক বোকা জানেন। আমরা অনেক ইমোশনালফুল হয়ে থাকি। একটুতেই ভেঙে পড়ি। আর তখনই একটা চরম ভুল সিদ্ধান্ত নেই। এখান থেকে আপনি শক্ত থেকেছেন, লড়েছেন। নিজেকে শক্ত রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ কিন্তু এই যা হলো সব কিছু দিয়েই একটা না একটা শিক্ষা গ্রহন করেছেন। আমি আশা রাখবো সেই ভুল দ্বিতীয়বার করবেন না।’

সাইফানও অদ্রিজার কথা শুনে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বলে——-

“একই ভুল দ্বিতীয়বার হবে না।”

” শক্ত থাকবেন?”

” থাকবো।”

” কেউ কিছু বললে?”

” প্রতিবাদ করবো।”

ঠোট কোণে বাকা হাসলো অদ্রিজা। এতিমখানায় বড় হবার দরুণ – অনেক মানুষ, বাচ্চা বড় আপু, ছেলে মেয়ে সবার মাঝে বড় হয়েছে। সেখানে থেকে অনেক শিক্ষা নিয়েছে সে। তার মধ্যে ম্যানোপুলেট করাটাও কিভাবে যেনো শিখে গিয়েছিলো। এই যে সাইফানের এতো কাছে অদ্রিজা। এসেছে শুনেছে। আর চুলে হাত ঢুবিয়ে তার ধ্যান, চিন্তা, ভাবনা, অন্যদিকে নিয়েছে এগুলো অদ্রিজা এতিমখানার এক খ্রিস্টান বড় আপুর থেকে শিখেছিলো। মেয়েটা দেখতে আগুন সুন্দরী। মা বিদেশি ছিলো বাবা বাংলাদেশী। কি একটা অসুস্থতার কারণে মা মারা গেছে তারপর বাবা বিয়ে করেছিলো। তারপর তাকে এতিমখানায় দিয়ে এসেছিলো। কারণ অত্র এলাকায় খ্রিস্টান চার্চ তখনও গড়ে উঠেনি। মেয়েটার নাম – এ্যাভা। দারুণ দেখতে। মেয়েটা আঠারো হতেই চলে গেলো তারপর আর দেখা হয় নি অদ্রিজার সাথে। শ্বাস ফেলল অদ্রিজা। তারপর শান্ত গলায় ছোট করে বলে—–

“ব্যাথা কমেছে?”

” হু!”

“ঘুমিয়ে পড়ুন!”

নড়লো না সাইফান তাই হাত থামলো অদ্রিজার। তারপর সাইফানের দিকে চোখ রাখলো। সাইফান চোখ তুলে অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বলে,

” একটা আবদার করবো, আপনি আমাকে খারাপ ভাবতে পারেন। তবুও আবদারটা করবো।”

গলা কাঠ হয় অদ্রিজার। এইদিকে অদ্রিজা পারদর্শী নয়। কি চাইবে সাইফান? তবুও নিজেকে শক্ত করে জিজ্ঞেস করে—

” বলুন। পড়লে করবো।”

সাইফান অদ্রিজার চোখে দৃঢ়ভাবে চোখ রাখে। এতে মনে মনে একটি ভরকায় অদ্রিজা। শ্বাস ভারী হয়ে এলো। মনে হলো গলায় কেউ ছুড়ি ধরে আছে তবে অদ্রিজার অপেক্ষা কমিয়ে সাইফান শান্ত গলায় শুধায়,

” আমি অনেকদিন যাবত ঘুমাই না। আপনার মাথা ম্যাসাজ করে দেয়াতে কেমন ঘুম আসছে। আপনি কি আ-রেকটু, মানে—!”

কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে অদ্রিজা বলে,

” দিচ্ছি।”

ঢোক গিললো সাইফান। মেয়েটা কি তাকে খারাপ ভাবলো? সে কি থেকে কি বলেছে? তার এটা বলা উচওত হয় নি। কিন্তু হুট করে এটা কেনো বললো। ভেতরে ঝড়ের মতো দোটানা কাজ করতে শুরু করলো এর মাঝে অদ্রিজা একটা বালিশ নিয়ে নিজের কোলে রাখে তারপর বলে—-

” এখানে মাথা রাখুন।”


চলবে—!