পরাণ বধূয়া পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
57

#পরাণ_বধূয়া — শেষ পর্ব
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
[সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ]

সাইফান ও অদ্রিজার সম্পর্ক অটুট থাকে, তাদের মাঝে গভীর বিশ্বাস ও ভালোবাসা প্রতিটি ক্ষণে আরও বেশি শক্তিশালী হয়। সাইফান ও অদ্রিজা ছাদে বসে। নরম বাতাস। চুপচাপ তারা দেখে আকাশ।

“রামিশার বিচার হচ্ছে। শান্তি লাগছে?”

সাইফান প্রশ্ন করলে অদ্রিজা ফিরে তাকিয়ে জবাব জরে,

“শান্তি নয়, একটা বোঝা নেমে গেছে শুধু। আসল শান্তি আমি যখন আপনার মাথায় প্রথম হাত রেখেছিলাম, সেদিন পেয়েছিলাম।”

“আপনি সেদিন মাথায় হাত রেখে নিজেও জানেন না; কতগুলো দিন পর শান্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বধূয়া।”

অদ্রিজা সাইফানের দিকে তাকিয়ে বলল—
“আমাদের জীবন শুধু একসাথে হবে। কোনো বাঁধা আর থাকবে না।”

সাইফান মৃদু হাসে, ” বধূয়া আমাদের এখন শুধু একে অপরকে দরকার, আর কিছু নয়।”

অদ্রিজা ধীরে মাথা হেলিয়ে দেয় সাইফানের কাঁধে।
নরম গলায় বলে—
“চলুন, নতুন জীবন শুরু করি। ঠিক একদম নতুন করে…”

———

রাতে ঘুমতে গেলে অদ্রিজা সানাফকে বুকে লেপ্টে শুয়ে থাকতে দেখে সাইফান ধীর গলায় শুধায়–

” বধূয়া?”

” হু!”

অদ্রিজা পিঋনে না তাকিয়েই জবাব করতেই সাইফান গম্ভীর কণ্ঠে বলে—

” আপনি কাছে আসবেন নাকি আমি?”

” আমি!” – ছোট গলায় জবাব দিলো অদ্রিজা তা শুনে সাইফান বলে—

” ওকে দ্যান কাম টু মি!”

কথাটা শেষ হতেই অদ্রিজা এগিয়ে এসে সাইফানের বক্ষে মাথা রাখে। সাইফান তাকিয়ে দেখলো তারপর আবারো সানাফের দিকে তাকায়। সে গভীরনিদ্রীয় আচ্ছন্ন তাই আবারো অদ্রিজার পানে তাকিয়ে তার কেশে হাত বুলায় অদ্রিজা চোখ বন্ধ করে থাকে অনেকটা সময় তারপর সাইফানের উদ্দেশ্য বলে—–

” আপনার বয়স কত?”

হুট করে এমন প্রশ্ন করায় কপাল কুঁচকায় সাইফান তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে—–

” একত্রিশ!”

সাথে সাথে চমকে উঠে অদ্রিজা। সরে এসে চোখ বড় বড় করে সাইফানের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব গলায় বল—-

“খোদা, আপনি এতো বুড়ো? জানেন আপনার আর আমার বয়সের ডিফারেন্স কত?”

সাইফানের হাসি পেলো। মেয়েটা ম্যাচিউর হলেও মাঝে মাঝে এতো দুষ্ট আর বাচ্চামি করে। তাই সেও না জানার ভান করে বলে—

“কত মিসেস ইয়াজিদ? ”

” বারো বছবররর!”
এমন ভাবে বয়সটা বললো যেন সাইফান খুব ভুল করে ফেলেছে অদ্রিজাকে। সাইফান সেদিকে পাত্তা দেয় না উল্টো অদ্রিজার হাত টেনে নিজের বক্ষের উপর ফেলে বলে,

” হতাশ হবেন না ম্যাডাম। একদম পুষিয়ে দেবো। কোনো অভিযোগ থাকবে না!”

কথাটা প্রথমে বুঝতে না পারলও যখন কথাটার অর্থ বুঝতে পেরেছে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল মেয়েটার। সাথে মুখ লুকাল সাইফানের বুকে। তা দেখে শব্দ করে হেসে ফেলে সাইফান।

———————

সকাল বেলা খবর এলো রামিশা জেলে সুইসাইড। গভীর রাতে ওয়াশরুমে করেছে তাই কেউ টের পায় নি। অদ্ভুত ব্যপার হলো এই খবর শুনে অদ্রিজা একটুও বিচলিত হয় নি। সাইফান ভাবল হসপিটালের যাবে এর মধ্যে বাসায় কলিং বেল বেজে। অদ্রিজা সাইফানকে বলে,

” আপনি অপেক্ষা করুন। আমি দেখছি।”

তাই সাইফানও কিছু বলে না। অদ্রিজা ধীরে এগিয়ে এসে দরজা খুলতেই অচেনা এক মেয়েকে দেখে থমকায়। তারপর পিছনে ফিরে তাকায়, সাইফান একটু বিচলিত হয়ে বলে,

“সাবরিনা তুই?”

সাবরিনা জবাব করলো না। ঘরের মাঝে প্রবেশ করে অদ্রিজার মুখ একবার দেখে তো একবার সাইফানের মুখ দেখে বলে,

” ও তো সিজানের হবু স্ত্রী। কিন্তু ও তোমার বাসায় কেনো ভাইয়া?”

পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো সানাফ। ফুপিকে দেখেই দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরে তারপর বলে,

” পুপি, এতা মাম্মা!”

সাবরিনা হতভম্ব হয়ে আছে। অদ্রিজাও বুঝলো এটা সাইফানের ছোট বোন। অদ্রিজা কিছু বলার আগে সাইফান বলে,

” আমার কথা শোন!”

” তুমি বিয়ে করেছো?”

” হু!”

” তাই বলে ভাগিনার হবু স্ত্রী? আম্মা আর বড় আপা নিচে দাঁড়িয়ে আছে৷ রামিশা সুইসাইড করেছে তা নিশ্চয়ই শুনেছো। ভাগ্য ভাল আমি একা উপরে এসেছি। বড় আপা এসে এই মেয়েকে দেখলে কি হতো।”

শান্ত চোখে তাকালো সাইফান তারপর গম্ভীর গলয় শুধায়,

” মা আর বড় আপাকে আসতে বল। — তারপর অদ্রিজার পানে তাকিয়ে বলে—–

” আপনি সানাফকে নিয়ে ঘরে যান।”

অদ্রিজা কথা অমান্য করলো না। সাবরিনাকে ধীরে সালাম দিয়ে ছেলেকে নিয়ে রুমে চলে যায়। সাবরিনার মাথা প্রায় এলোমেলো। হচ্ছে কি এসব? ঢোক গিলে মাকে ফোন দেয়। সেও দেরি করে না উপরে উঠে আসে সাইফানের মা আর বড় আপা। দরজা খোলাই ছিল। রুমে প্রবেশ করতেই সাবরিনা বলে,

” মেজো ভাই বিয়ে করেছে!”

হতবার হয়ে যায় সাইফানের মা। বড় আপা চোখ মুখ কুচকে বলে,

” কই আমাদের তো বলে নাই? কারে বিয়া করছে? আবারো বুড়ি ছুড়ি ধইড়া বিয়া করছে তাই না? আগের বারও পাকনামি করছে। এইবারও। মা তোমার পোলারে বোঝাও।”

বড় আপার কথা শেষ হলেই সাবরিনা বিরক্ত নিয়ে বলে,

” আপা থামো। কোনো বুড়ি ধরে না। তোমার পোলার হবু বউরে বিয়া করছে।”

” কিই?” — “কি?”

একই সাথে সাইফানের মা আর বড় আপা জিজ্ঞেস করে। তারপর বড় আপা চোখ বড় বড় করে বলে–

” এই সাবু কারে বিয়া করছে সাইফান? সিজানের হবু বউ মানে অদ্রি? ওই মাইয়া তো পালাইছে। সাইফান ওরে পাইলো কই থেকে?”

সাবরিনা আবারো বিরক্ত হয় তারপর বলে—-

” মাইয়া পালাইছে তাও এতো খুঁজাখুঁজি করে পাও নাই কেন এইডা কখনো ভাবছো? কারণ ওই মাইয়া মেজো ভাইয়ের বাসায়। তারই বউ — অদ্রিজা।”

এবার সবাই বোকার থেকেও বাকরুদ্ধ হয়ে সাইফানের দিকে তাকায়। সাইফান এখনো শান্ত শীতল ও নির্লিপ্ত। তা দেখে বড় আপা জিজ্ঞেস করে—

” তুই এইডা কি কইরা করতে পারোস সাইফান? সব রাইখা আমার পোলাডার হবু বউ?”

সাইফান চোয়াল শক্ত করে তারপর শান্ত গলায় বলে,

” তোমার ছেলের ব্যপারে আমার নিশ্চয়ই কিছু বলা লাগবে না আপা!”

” তাই বলে তুই?”

” তেমন কিছু-ই না আপা!”

“তাহলে কেমন কিছু সাইফান বাবা? লোকে শুনলে ছি ছি করবে, তুই তোর ভাতিজার হবু বউ নিয়ে চলে এসেছিস। তাকে বিয়ে করেছিস!”

সাইফান শান্ত চোখে তাকিয়ে বলে–

” কিছুদিন পর বাবুও হবে আম্মা! এ’সব নিয়ে টেনশন করবেন না তো!”

সাবরিনা এর মধ্যে সিজানকে কল দিয়েছিলো সেও চলে এসেছে। এই কথা শুনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হতবাক গলা বলে,

” মামা? কেমনে করলে এসব?”

সাইফান মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায় তারপর বলে,

” যেমনটা তুই আর রামিশা করেছিলি। তবে রামিশা তখন আমার স্ত্রী ছিলো, আমি ঝামেলা অপছন্দ করি, আর রামিশা মাফ চাওয়ায়আর সবার বুঝানোতে আমি সব মাফ করেছি! কিন্তু অদ্রিজা তোর বউ ছিলো না; না ও তোকে পছন্দ করতো। কেনো করতো না বা কি হয়েছে সেদিন রেস্টুরেন্টে কি হয়েছে তা মনে করিয়ে দিতে হবে না।”

সিজান নিজের রাগ ধরে রাখতে পারলো না। কিছুটা চেঁচিয়ে বলে,

” অদ্রিজা… এই অদ্রি… কই তুই? আমি আগেই জানতাম তোর মাঝে ঘাপলা আছে। আমারে ভাল্লাগে নাই? ভাল্লগছে আমার মামারে! কই তুই… বের হ!”

চেচামেচিতে সাইফান একদমই শান্ত রইলো। অদ্রিজা রুম থেকে সব শুনছে তা সাইফান জানে তাই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় অদ্রিজাকে ডাকে–

” অদ্রিজা! কাম আউটসাইড!”

ঢোক গিললো অদ্রিজা তারপর ভীতু মুখে রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই সবাই অদ্রিজার দিকে তাকায়। অদ্রিজা সবুজ রংয়ের একটা শাড়ি পড়া। সবাই কে দেখে মাথায় কাপড় তুলে নিয়ে শাত গলায় সালাম দিতেই সিজান গর্জে উঠে ——

” মা*গি এহন ভদ্র সাজোস? আমারে ভাল্লাগে না অথচ একবাচ্চা সহ বিবাহিতা বেডা ভাল্লাগে! ”

নোংরা ভাষা শুনে চোখ মুখ খিঁচে ফেলে অদ্রিজা। সিজানকে আগে থেকেই অদ্রিজার পছন্দ না। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে শক্তপোক্ত একটা চড় পড়ে সিজানের গালে। সবাই চমকে যায় সিজান এক চড়ে যায়গা থেকে সড়ে যায়। নাক থেকে গলগলিয়ে রক্ত বেড়িয়ে আসে আর সাইফান শান্ত গলায় বলে,

” জাস্ট স্টপ ইয়োর ফা*কিং শিট; মামী হয় তোর। সম্মান দিয়ে কথা বল।”

সিজান অবাক চোখে তাকিয়ে আছে অদ্রিজা প্রতিক্রিয়াহীন চেয়ে আছে। ঘরের বাকিাও অবাক হয়। সাইফান যথেষ্ট শান্ত স্বভাবের ছেলে তাকে দিয়ে এমন কথা বা এমন ব্যবহার কেউই আশা করে নি। সাইফান একটু এগিয়ে এসে আবারো বলে,

” রামিশার সাথে কি করেছিস তা মনে করিয়ে দিতে হবে। আর তুই কখনো অদ্রিজাকে ডিজার্ভই করিস নি। তাই অদ্রিজার ব্যপারে তোর মুখ থেকে একটা কথা বের হলে ওই মুখ আমি কি করবো আমি নিজেও জানি না।”

বড়আপা চেঁচিয়ে উঠে বলে–

” সাইফান তুই আমার পোলাডারে এমনে থাপ্পড় মারলি তাও এমন একটা মাইয়ার লইগ্গা?”

” এমন একটা মেয়েই আমার বউ, বড় আপা। যে কেউ তার ব্যপারে, তার সাথে যা তা আচারণ করবে তা আমি চুপ করে দেখবো তা ভাবলে খুব ভুল করছো! এক ভুল দ্বিতীয়বার পছন্দ না আমার; আশা রাখবো কেনো ভুলের কথা বলেছি তা তোমাদের বোঝাতে হবে না।”

বড় আপা চুপ হয়ে যায়। সাইফানের মা কিছু বলার পূর্বে ও গম্ভীর কণ্ঠে বলে—

” আপনারও যদি বড় আপার মতো কিছু বলার ইচ্ছে থাকে তাহলে আপনি আসতে পারেন আম্মা।”

সাইফানের মা সব কিছু দেখেছেন। বয়স হয়েছে এতোটুকুতে যা বুঝলেন তাতে বুঝলেন তার ছেলে ভালো আছে। একজন মায়ের কাছে এর থেকে বড় কিছু হতে পারে না। তাই তিনিও শান্ত গলায় বলে,

” আমি এমন কিছুই বলবো না। বউ-মা; আমায় ধরো আমি দাদুভাইয়ের কাছে যাবো। যার চলে যেতে ইচ্ছে করছে। তারা যেনো চলে যায়।”

কথাটা শুনে সাবরিনা অপমানিত বোধ করে। সে মাথা গরম অবস্থায় কি করে ফেলেছে নিজেও জানে না। তাই সে মাথা নিচু করে বলে—

” আমি সরি মেজোভাই; হুট করে সিজানের হবু মানে অদ্রিজা ভাবীকে দেখে বেশি রিয়েক্ট করে ফেলেছি!” – তারপর অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বলে–

” আমি সরি ভাবী! সানাফের সাথে একটু দেখা করবো!”

তারপর সবাই সানাফের কাছে রুমে চল যায়। সাইফানের বড় আপা রাগ করে সিজানকে নিয়ে দরজার দিকে চলে যোতে যেতে বলে—

” যা করলি ঠিক করিস নি সাইফান!”

সাইফান শান্ত গলায় বলে,

” যে যেটা ডিজার্ভ করে সে সেটাই পাবে। শুধু মনে রাখবে পাপ বাপ কেও ছাড়ে না!”

সবাই চলে যেতেই সাইফান রুমে চলে যায়। সেখানের পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। তাই অদ্রিজা বলে,

” আপনারা বসুন আমি চা-কফি করে আনছি!”

কথাটা বলেই রুম থেকে বের হতেই দরজার বেল বাজে। অদ্রিজা নিজের রুমের দিকে তাকালো। এখন আবার কে এলো? তাই কপাল কুঁচকায় তারপর দরজা খুলতেই সিজানকে দেখে ভরকে যায় আর বলে —

” আপনি?”

কথাটা বলার সাথে সাথে সিজান অদ্রিজার হাত চেপে ধরে আর বলে–

” খুব ত্যাজ তোর তাই না? আমারে রিজেক্ট করে আমার মামারে বিয়া করছিস? এই ত্যাজ আমি বাইর করমু তোর; আয় আমার সাথে। ”

অদ্রিজাকে টেনেটুনে বের করে নিয়ে আসে সওজান অদ্রিজা ভীষণ মোচড়ামুচড়ি করতে করতে সিড়ির হ্যাল্ডেল ধরে তবে সিজান এতো জোরজবরদস্তি করার কারণে অদ্রিজা ছটফটিয়ে উঠতেই অসাবধানতা বশত ধাক্কা লগে যায়! মুহুর্তেই সব শান্ত। সিজান গড়িয়ে কতগুলু সিড়ি ডিঙ্গিয়ে গেলো বুঝলো না অদ্রিজা। তবে ভয় পেয়ে গেলো মেয়েটা। তাই দ্রুত আশেপাশে তাকিয়ে দ্রুত নিজের বাসায় ডুকে শ্বাস ফেলে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতেই একপুরুষালী গলায় প্রশ্ন ভেসে আসে—

” ওখানে কি করছেন? আপনি না চা কফি বানাতে এলেন?”

চমকে যায় অদ্রিজা তারপর ঢোক গিলে বলে–

” কিছু না এমনি দেখতে এলাম দরজা ঠিক মতো আটকেছেন কিনা!”

” ওহ! দ্রুত আসুন। আম্মা আপনার সাথে কথা বলবে। আর আম্মার চায়ে সুগার কম দিয়েন তাই বলতে এসেছিলাম। ”

” আচ্ছা! ”

—-

কিছু সময় পর সাবরিনার ফোনে বড় আপার কল এলো। তা দেখে সবাই ওর দিকে তাকায় সাবরিনা কল রিসিভ করতেই চমকে যায় তারপর ঢোক গিলে বলে—-

” সিজান সিড়ি থেকে পড়ে গেছে ওকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তোমরা কি কেউ যাবে?”

সাইফান একটু চমকায় তারপর কেনো যেন অদ্রিজার দিকে তাকায় তবে অদ্রিজা প্রতিক্রিয়া বিহীন বসে আছে তাই সাইফান বলে–

” আমার শরীর ভালো লাগছে না। তোরা যা!”

সাবরিনা একবার অদ্রিজার পানে তাকায় একবার মায়ের পানে তাকায়। তারপর সাবরিনা চলে যায়! সাইফান আর অদ্রিজাও প্রতিক্রিয়াবীহিন ওর চলে যাওয়া দেখে। সবাই চলে যেতেই সাইফানের আম্মা বলে—

” বিয়ে করেছিস কবে?”

সাইফান শান্ত চোখে মায়ের মুখ পরক্ষ করে অদ্রিজার পানে তাকায় তারপর বলে—

” সিজানের বিয়ে হবার কথা যেদিন সেদিন!”

” মানে ভাগিনার বিয়ের দিনই মামার বিয়ে তাও ভাগিনার হবু বউ!”

কথাটা বলেই তিতি হেসে ফেললো। এতে অদ্রিজা আর সাইফান দুইজনই একটু লজ্জা পেলো। তারপর সাইফানের মা বলে–

” আনুষ্ঠানিক বিয়ের ব্যপারে কি ভেবেছিস?”

” ভাবি নি এখনো আম্মা; আপনারা চাইলে—!”

” খুব শিগগিরই। আমি বাসায় যেয়ে তোর বাবার সাথে কথা বলবো। এখন আমার যেতে হবে। ভেবেছিলাম রামিশাকে দেখতে যাবো তবে এখন আর এতো ঝামেলা দেখে মন টানছে না। আমি বরং বাসায় যাই। তুই আমায় একটু নিচে দিয়ে আয়৷ গাড়ি এসেছি যেতে পারবো। তারপর সাইফান সম্মতি জানিয়ে সাইফানের মা কে দিয়ে আসে। রাতে সাবরিনা কল দেয় সাইফানকে তারপর জানায় – সিজান আউট অফ ডেঞ্জার হলেও সে তার পিতৃত্ব ক্ষমতা হারিয়েছে। এই কথা শুনে সাইফান নিশ্চুপ ছিলো। অদ্রিজাও পাশে ছিলো কথাটা শুনে সে উঠে যায় পাশ থেকে। সাইফান একটু আধটু কথা বলে কল কেটে দেয় আর ভাবে – সিজান সব সময়ই এইসব নিয়েই থাকতো। আর তার পরিনতি কতটা ভয়ংকর। অথচ তার অগোচরে রয়ে গেলো আরো একটা সত্যি – অদ্রিজা; যে কিনা তার মায়ের মতো একটা ভুল পথ বাছাই করেছে। তার মা যেমন আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নেবার সময় নিজের বাচ্চার কথা ভাবে নি; নিজের আবেগ ও ভুলকে প্রাধান্য দিয়েছে। অদ্রিজাও নিজে ভালো থাকা ও নিশ্চিন্তে থাকার জন্য পরোক্ষ ভাবে উস্কানি দিয়ে খুন করছে। আরেকজন থেকে নিজের পিতৃত্ব ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। এটা দ্বারা এই প্রমাণিত যে স্বার্থপরতা মানুষকে বিপথগামী করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। ভালো থাকতে কতটা ভয়ংকর রুপ নিতে পারে।

—————

দুই মাস পর –

আকাশে হালকা মেঘ, ছাদে লাইটিং ঝুলছে। একটা ছোট্ট আড়ম্বরহীন অনুষ্ঠানে সাইফান আর অদ্রিজা তাদের আনুষ্ঠানিক বিয়েটা সেরে নিচ্ছে।

সানাফ সাদা পাঞ্জাবিতে দৌড়ে এসে মায়ের আঁচল ধরে বলে—

“মাম্মা, আবাল বুউ?”

অদ্রিজা হাঁসতে হাঁসতে জবাব দেয়—

“উহু, আমি তোমার মাম্মা। কিন্তু এখন থেকে আমি তোমার পাপার বউ।”

সানাফ মুচকি হাসে। আর সাইফান ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে—

“আমরা দুজনেই এখন তোর। ভাগ করবি না কাউকে!”

ছয় মাস পর –

একটা বিকেল। অদ্রিজা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে। চুলে হালকা তেল, ঢিলেঢালা কামিজে তার গা জড়িয়ে থাকা নতুন মাতৃত্বের ছোঁয়া।সাইফান এসে পাশে বসে, চায়ের কাপ নিয়ে।

“শরীর কেমন আজ?”

“বমি একটু কমেছে। বেবিটা খুব বিরক্ত করছে। সারাদিন ঘুমাতে মন চায়।”

“তাই তো লাগছে, আপনার মুখটা আগের থেকে অনেক শান্ত।”

” আপনি কি আমাকে ‘বিরক্তিকর মোটা’ বলতে চাইছেন?”

“না, আমি বলছি আপনাকে এখন ‘মা’র মতো দেখাচ্ছো।”

অদ্রিজা হাসে। মা হচ্ছি, ভাবতেই কেমন জানি লাগছে!”

“এইবার আপনার কোলে বাচ্চা থাকবে, পাশে আমি। সানাফ আমাদের বাচ্চাদের ভাই হবে, ঠিক আগলে রাখবে।”

পাঁচ মাস পর —

সাইফান রাঁধছে রান্নাঘরে। ডিম, খিচুড়ি, আর পুঁইশাক। অদ্রিজা হেঁটে এসে হালকা রাগে বলে—

” আপনি রান্নাঘরে ঢুকেছেন কেনো? আমি ঠিক আছি!”

” আপনি এখন শুধু আমার না, দুইজনের দায়িত্ব। আপনাকে কিছুতেই ক্লান্ত হতে দেবো না।”

অদ্রিজা কিছুসময় চুপ রইলো তারপর হালকা কাঁপা গলায় ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে—

” আপনি জানেন না সাইফান, আমি কতবার এমন একটা পরিবারের স্বপ্ন দেখেছি… যেটা আমার মা কখনো পায়নি। আপনি সেটা করে দিচ্ছেন আমার জন্য…”

সাইফান হাত ধুয়ে এসে আলতোভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত গলায় শুধায়—

” আপনাকে শুধু ভালোবাসি না, আপনার অতীতের ভাঙাগুলোও ভালোবাসি। কারণ সেগুলো না থাকলে আপনি এতটা মজবুত হয়ে উঠতে না। আর না আমাকে এভাবে সামলে রাখতে পারতেন।”

রাত ২টা। হাসপাতালের সাদা আলোয় ভিজে উঠেছে সময়। সাইফান অপারেশন থিয়েটারের বাইরে হাঁটছে পায়চারি করে। নিচু গলায় বারবার শুধু একটাই কথা বলছে,

“সব ঠিক হোক, প্লিজ সব ঠিক হোক!”

প্রায় তিন ঘণ্টা পর নার্স এসে জানায়—
” মেয়ে হয়েছে। মা- মেয়ে দুজনই সুস্থ।”

সাইফান নিঃশ্বাস ছেড়ে দেয়, হাসে, ভেঙে পড়ে। চোখে জল এসে জমে, কিন্তু মুখে হাসি। ঢোক গিলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে। এটাই বোধহয় তার প্রাপ্তি ছিোল তাই হয়তো আগের দিন গুল এতো বিভৎস ছিল। সব আল্লাহর দান; আল্লাহ যা করেন! ভালোর জন্য করেন।

এক বছর পর –

একটা ছোট্ট কেক, হরেকরকমের বেলুন দিয়ে সাজানো সারা বাসা। ছোট্ট বাবুর নাম রাখা হয়েছে — অভ্রিকা”।

সানাফ বোনকে কোলে নিতে চায়, আর অদ্রিজা হেসে বলে—

“বাবা, অভ্রিকা এখনো ছোট। তুমি ওর দাদা, আগলে রাখবে, তাই তো?”

সানাফ গম্ভীর মুখে হেসে ফেলে। আর সাইফান মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলে—

“এই মেয়েটা আর তার মা—আমার দুইটা আশীর্বাদ!”

অদ্রিজা তাকিয়ে থাকে। একটা পূর্ণ জীবন, যার শুরুটা ছিল ধ্বংস থেকে, এখন দাঁড়িয়ে আছে ভালোবাসা আর সাহসের এক পাহাড়ে।

————

এক বিকেল। সাইফান, অদ্রিজা, সানাফ আর অভ্রিকা—সবাই একসাথে বসে আছে ছাদে। বাতাসে শান্তি, চোখে প্রশান্তি। অদ্রিজা ধীরে সাইফানকে বলে—

“এই জীবনটা যেন থেমে না যায়। এভাবেই ভালোবাসা, বোঝাপড়া আর একসাথে থাকা চলুক… সারাজীবন!”

সাইফান সম্মতি সরূপ চুপচাপ তার হাত ধরে। সানাফ পেছন থেকে হেসে বলে—

“আমি চকলেট খাবো! আর বনুকে কোলে নেবো।”

সবাই হেসে ওঠে। আকাশে সূর্য ডুবে যায়, কিন্তু ভালোবাসার আলো এক বিন্দুও কমে না। এভাবেই চলুন বধূয়া আর তার ডক্টর সাহেবের পথ চলা…!

——————–—
“সমাপ্ত।”

শেষ— শেষ— শেষ! ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন; দ 🤍