#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|১১|
রাতের আঁধার পেরিয়ে ভোর আসে আশার আলো নিয়ে। আদ্রিকার জীবন বরাবর এলোমেলো এবং নাটকীয়। তাই তো তার জীবনের ভোর এলো নতুন উৎকন্ঠা নিয়ে। ডানদিকের বিশাল জানালা ভেদ করে ঘোলাটে আলো আসছিল বলে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ খট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ক্লান্ত চোখজোড়া মেলে দেখল পরখ ঘুম থেকে উঠেছে। বাথরুমের সামনে একটি বেসিন আছে। সেখানের দেয়ালে আয়না এবং ঝুড়িতে ব্রাশ, পেস্টসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা৷ সেখানে দাঁড়িয়ে পরখ ব্রাশ করতে শুরু করল।
কানের কাছে পানির কলকল শব্দে ঘুমানো অসম্ভব। তাছাড়া পরখ ঘুম থেকে উঠার পর তার ঘুমিয়ে থাকাটা সমীচীন নয়। সে নিজেও শোয়া থেকে উঠে বসল। বাড়ি থেকে একটি সুতোও নিয়ে আসা হয়নি। ফ্রেশ হওয়া দরকার। পরখ যে কোনো সাহায্য করবে না সেটা তার হাবভাবে স্পষ্ট। পর্তুলিকা ব্যাগে কি কি দিয়েছে সেসব দেখার জন্য ব্যাগের চেইন খুলে মেঝেতে বসে পরল। ব্যাগের ভেভর কয়েক সেট জামা, অন্তর্বাস, তোয়ালে, ব্রাশ থেকে শুরু করে সাজসজ্জার বেশ কিছু জিনিসপত্র দেখে আদ্রিকার মুখে হাসি ফুটল। মনে মনে মা সম শ্বাশুড়ির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলল না।
পরখ ফ্রেশ হয়ে নিজের ঘরের চলে যাওয়ার পর আদ্রিকা ফ্রেশ হয়ে নিল। শাড়ি পাল্টে থ্রি পিস পড়ে বাইরে এসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এবার কি করবে?
গতরাতে সে জীবনে প্রথমবার না খেয়ে ঘুমিয়েছে৷ এখন ক্ষুধায় পেট ব্যথা করছে৷ এতোদিন রোজ ঘুম থেকে উঠে মায়ের হাতের তৈরি নাস্তা খেয়ে দিন শুরু হয়েছিল৷ কোনদিন কি রান্না হচ্ছে তা কখনও খেয়াল করেনি৷ আজ হঠাৎ করে নাস্তার কথা ভেবে বড্ড অসহায় লাগছে৷ আজব এক সংসারে এসে পরেছে সে৷ সাহায্য করার মতো কেউ নেই৷ ফাঁকা বাড়িতে যে একজন মানুষ আছে, ভাবের চোটে তার ধারের কাছে যাওয়া যাচ্ছে না৷
ক্ষুধা লাগলে আদ্রিকার মেজাজ ঠিক থাকে না৷ শান্তশিষ্ট মেয়েটা খিটখিটে হয়ে যায়৷ তাই তো এই মুহুর্তে পরখের প্রতি একঝাঁক বিরক্তি এসে জমা হলো৷ গতরাতে একাই বসে গান্ডেপিন্ডে খাবার গিলে ঘরে চলে গেল অথচ আদ্রিকাকে একবারও সাধলো না৷ মানুষ অযাচিত অতিথির সাথেও এমন আচরণ করে না যেটা পরখ ওর সাথে করছে৷
আদ্রিকা চলে গেল কিচেনে। সামান্য কয়েকটা হাড়ি পাতিল উল্টে পরে আছে, যেগুলোর নামও সে জানে না৷ মায়ের রান্নাঘরে কয়েকবার দেখেছে মাত্র৷ গ্যাসের দুটো চুলা, সিলিন্ডার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রাধবে কি? সবজির ডালা পুরো ফাঁকা। দেয়াল কেবিনেট খুলে মশলা পাওয়া গেল শুধু৷ কিচেনের এককোনায় রাখা ফ্রিজ খুলে গতরাতের বেঁচে যাওয়া পোলাও, রোস্ট বাদে আর কিছু নেই৷ এসব না হয় দুপুরে খাওয়া যাবে৷ কিন্তু এই মুহুর্তে নাস্তা না খেলে আদ্রিকা মূর্ছা যাবে নিশ্চিত।
এক গ্লাস পানি পান করে ড্রয়িংরুমে ফিরে আসতেই পরখের সাথে দেখা৷ এই সকালবেলা শার্ট, প্যান্ট পরে ফরমাল গেটআপে কোথায় চললো কে জানে!
জিজ্ঞাসা করবে না, করবে না করেও আদ্রিকা বলেই ফেলল,
‘কোথাও যাচ্ছেন?’
স্লাইডিং ডোর খুলতে গিয়ে হাত ফিরিয়ে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পরখ পেছনে তাকাল। আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে আদ্রিকা। কিন্তু পরখ কিছু বলল না। কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে স্লাইডিং ডোর খুলে বের হয়ে গেল।
কেউ কখনও ওকে এভাবে অবহেলা করেনি। পুতুলের মতো গোলগাল মুখ দেখে লোকে নিজে আগ্রহ দেখিয়ে কাছে আসত। বরং আদ্রিকাই কারো সাথে কখনও কথা বলেনি৷ সবসময় বোনের হাত ধরে তার গায়ের পেছনে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করত।
অন্যসময় হলে পরখের এমন আচরণে সে অনেক কষ্ট পেত৷ অস্বস্তিতে মুখ লুকিয়ে থাকত সারাদিন৷ কিন্তু খিদের জ্বালা ভয়-ভীতিকে হারিয়ে দেয়।
আদ্রিকা একছুটে পরখের পিছু পিছু বেরিয়ে এসে ডাক দিল,
‘ শুনুন।’
পরখ সিড়ি বেয়ে নামছিল। যাত্রাকালে পেছন থেকে ডাক দেওয়া অশুভ বিবেচনা করা হয়৷ সে বেশ বিরক্ত হলেও আবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আদ্রিকাকে দেখতে থাকল। যে দৃষ্টির সামনে খানিকটা ভয় হলেও আদ্রিকা বলল,
‘ও..ওই মানে… নাস্তা করবেন না?’
দু চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস ফেলে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে পরখ বলল,
‘নাহ।’
আবার সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল। এই মেয়ের সাথে অযথা কথা বলে নিজের মেজাজ খারাপ করার কোনো মানে হয় না৷ এমন করে নাস্তা খাওয়ার কথা বলছে যেনো নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে বসে আছে।
আদ্রিকাও দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আঙ্গিনায় পরখের রাস্তা আটকে দাঁড়াল। কোনোরকম ভনিতা ছাড়া হড়বড়িয়ে বলল,
‘ঘরে কোনো খাবার নেই। নাস্তায় কি খাবো?’
দু হাত বুকের উপর ভাঁজ করে পরখ বলল,
‘তোমার জন্য রাজভোগের ব্যবস্থা করার কথা ছিল বুঝি?’
আদ্রিকার ভীষণ রাগ হলো। এ কেমন ধারা আচরণ? বিয়ে করে নিয়ে এসে এখন না খাইয়ে মেরে ফেলবে নাকি? খালি পেটে সে বেশি কিছু ভাবতে পারে না। তবুও রাগকে একপাশে রেখে অনুরোধ করে বলল,
‘রাত থেকে না খেয়ে আছি। নাস্তার ব্যবস্থা করলে ভালো হত।’
‘আমার সময় নেই। জরুরি কাজ আছে। পথ ছাড়ো।’
সে পথ ছাড়ল না। রাগে ফোস ফোস করে ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
‘তবে সাথে নিয়ে এলেন কেনো? শোয়ার জায়গা নেই, খাবার নেই। আমি এখানে কীভাবে থাকব?’
‘থাকতে ইচ্ছে না হলে থাকবে না। কেউ তোমাকে জোর করে নিয়ে আসেনি। আটকেও রাখেনি৷ দরজা খোলা আছে। যাও চলে।’
রাগে ক্ষোভে আদ্রিকার চোখে জল এলো৷ তবুও সে পরখের দৃষ্টিতে ক্রোধিত দৃষ্টি মিলিয়ে বলল,
‘নিজে বিয়ে করে নিয়ে এসে এখন এমনভাব করছেন যেনো আমি জোর করে আপনার বাড়িতে এসে উঠেছি। কাল থেকে দেখছি, আপনি আমাকে একদম সহ্য করতে পারছেন না। তবে বিয়ে করলেন কেনো?’
বিস্ময়ে পরখের মুখ হা হয়ে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,
‘কারন আমার কপাল খারাপ। কিছু না করেও আমার বাবা মা ভেবে নিয়েছে তোমার সাথে আমি অনেক কিছু করেছি। যে রঙ্গলীলা তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে করেছো, তার দায় পরেছে আমার ঘাড়ে৷ তোমাদের দুজনের রোমাঞ্চিত সিনেমায় বিস্ময়ের চরিত্রে লোকে আমাকে ভেবে নিয়েছে৷ তাই না চাইতেও আমাকে তোমার দায়িত্ব নিতে হল। হোয়াট অ্যা আনলাকি পারসোন আই অ্যাম!’
‘না করে দিলেই পারতেন। বলে দিতেন, উনারা যা ভাবছে তা ভুল।’
‘আমি অস্বীকার করলে উনারা মেনে নিত? মন থেকে সন্দেহ মুছে যেত? কখনো না। বরং আমার সম্পর্কে আরও খারাপ ধারণা তৈরি হত। ভাবত, নিজের দোষ স্বীকার করার মতো সৎ সাহস আমার নেই। যতোই জোর দিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলি না কেনো, মনে একবার সন্দেহ ঢুকে গেলে তা দূর করা অসম্ভব। তার উপর নিজের স্বপক্ষে যুক্তি দেওয়ার মতো যথেষ্ট প্রমাণ আমার কাছে নেই। তোমাকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছি। হাজার বার বারণ করেছিলাম তোমাকে, আমার বাড়ির আশেপাশে আসবে না৷ কিন্তু নাহ! সে কথা তুমি শুনবে কেনো? বন্ধ রুম দেখলে তোমার তো হুশ থাকে না। কখন বয়ফ্রেন্ডের সাথে রুমে ঢুকবে আর দরজা লক করবে সেই চিন্তায় মশগুল থাকো। নিজের জীবন ইনজয় করে এখন এসেছে আমার জীবনটা ধ্বংস করতে। আমার সামনে থেকো সরো। তোমার চেহারা দেখলেই আমার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। ’
আদ্রিকা চোখ সরিয়ে নিল। এই অসভ্য লোকের সাথে কথা বলার কোনো মানেই হয় না৷ বিস্ময়ের ধোঁকার পর আদ্রিকা নিজেকে প্রস্তুত করছিল। বাস্তবিকতা মেনে নিয়ে জীবনে এগিয়ে যাবে। মায়ের কষ্টের কারন না হয়ে তার প্রশান্তি হতে চেয়েছিল। অথচ এক নরক থেকে মুক্তি পেয়ে ভাগ্য তাকে আরেক নরকে ফেলে দিবে – কে জানত!
অবাধ্য অশ্রুকণা টুপটাপ ঝরতে শুরু করলে হাতের উল্টোপিঠে তা মুছে ফেলে দৃষ্টি নত করে সে বলল,
‘সব জেনে শুনে আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এসে এভাবে কথা শোনার কোনো দরকার ছিল না৷ কেনো চুপচাপ বিয়ে করলেন? এখন আবার কথা শোনাচ্ছেন কেনো? মানছি একটা ভুল করে ফেলেছি। তার শাস্তিও কম পাইনি৷
আপনাকে বিয়ে করে আমি নিজেও কোনো সুখের ভেলায় ভাসছি না৷
আপনার সাথে বিয়ে না হয়ে অন্য কোথাও বিয়ে হলে অন্তত আমাকে খালি পেটে থাকতে হত না। সামান্য খাবারের কথা বলায় এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলেন! আপনি খুব ভালো মানুষ?’
‘আমি সব জানি বলে আফসোস হচ্ছে? তোমাদের ভালোই বুদ্ধি দেখছি৷ বিয়ে আগে যা ইচ্ছে করো। লাইফ ইনজয়ের নামে যতরকম নোংরামি করো। তারপর ভালো ঘরের একটা ছেলেকে মুরগী বানিয়ে বিয়ে করে নেও। বাহ! চমৎকার প্ল্যান। যার সাথে তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, সে নিশ্চয়ই তোমাদ তোমার কান্ডকারখানা জানে না? এই ইনোসেন্ট ফেসের আড়ালে একটা ক্যারেক্টারলেস মেয়ে লুকিয়ে আছে সেটা জানলে কোনো ভদ্র ঘরের ছেলে তোমাকে বিয়ে করতে চাইতো না৷’
তীব্র ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে আদ্রিকা বলল,
‘আপনি একটা জঘন্য মানুষ।’
পরখের জবাবের অপেক্ষা না করে গটগট করে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে পরখের মুখটা ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গেছে৷ একটা ভালো কাজে বেরিয়েছিল অথচ এই মেয়েটা এসে মেজাজটা বিগড়ে দিল। যত্তোসব নাটুকেপনা!
_________
পরপর দুই গ্লাস পানি খাওয়ার পর পেট উল্টে বমি আসতে চাইছে। আদ্রিকা চেয়ারে বসে পরল। একটু আগেই সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে, এ বাড়ির একটা দানাপানি সে মুখে দিবে না।
জেনেশুনে বিয়ে করে এখন সুযোগ পাওয়া মাত্র কথা শুনাচ্ছে৷ সাতসকালে উঠে কে এভাবে আরেকজনকে অপমান করে? আদ্রিকা তার সারাজীবনে এমন মানুষ দেখেনি৷ অসভ্য, অসামাজিক, অশালীন, ঝগড়ুটে, বিকৃত মস্তিষ্কের একজন মানুষ। আদ্রিকা পারলে এই কাঠের চেয়ারটি দিয়ে লোকটার মাথায় একটা বারি দিত। কিন্তু শরীরে আপাতত কোনো শক্তি নেই৷ এই মুহুর্তে খাবার চাই৷
আদ্রিকার কাছে কোনো টাকা নেই৷ একটা ফোন থাকলে ভালো হত। নীহারকে কল করে কিছু টাকা চেয়ে নিতে হবে৷ ও বাড়িতে বাবা মা কেমন আছে সেটা জানা হয়নি। শ্বশুরবাড়ির লোকজনও একবার খবর নিল না। নিবেই বা কীভাবে? ওর কাছে কোনো ফোন নেই৷ যার কাছে আছে, সে তো মরে গেলেও আদ্রিকাকে ফোন দিবে না৷ চাইতে গেলে নিশ্চয়ই বলবে,
‘ফোন দিয়ে কি করবে? বিস্ময়কে কল করবে?’
রাগ, ক্ষোভ, বিরক্তি ক্রমে বেড়ে চলেছে। নতুন করে যুক্ত হলো মাথা ঘুরা। দু চোখে যেনো আঁধার নেমে আসছে। আদ্রিকার পক্ষে আর সম্ভব হলো না। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পোলাও, রোস্ট বের করে একটি প্লেটে সামান্য তুলে নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল।
খাবার নিয়ে কখনো লজ্জা পেতে নেই৷ খালি পেটে মস্তিষ্ক এবং শরীর উভয় অচল হয়ে পরে।
পেট ভরে খাবার খেয়ে পানি পান করে আদ্রিকা লম্বা শ্বাস নিল। মরতে মরতে বেঁচে ফিরল যেনো৷ আহা! এখন ভালো লাগছে। পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি৷
থালা বাসন পরিষ্কার করে ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছে। খাবার খাওয়া হয়ে গেছে এবার মাথা গুজার ঠাঁই দরকার। গতকালকের মতো দুই সীটের এই সোফায় ঘুমানো সম্ভব না। একটু নড়াচড়া করতেই মনে হচ্ছিল ধুপ করে নিচে পরে যাবে৷ এই ভয়ে সারারাত একটা তন্দ্রায় কেটে গেছে। আজকেও একইভাবে রাত্রিযাপন অসম্ভব৷
আদ্রিকা গুটি গুটি পায়ে সামনে এগিয়ে গেল। বন্ধ তিনটি কক্ষের মধ্যে ডানদিকের কক্ষটি বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বেহায়া চোখ দুটোও যেনো ছুটে যেতে চাইছে সেদিকে। আদ্রিকা নিজের পায়ের নিয়ন্ত্রণ হারাল না। তবে মন মস্তিষ্ক সবাই যেনো তাকে ভেঙেচূড়ে দিতে উঠে পরে লেগেছে। সবাই ছুটে চলেছে অতীতের পাতায়। সকলের বিরুদ্ধে সে একাই প্রাণপণে লড়াই করছে।
সেই নির্জন দুপুর, সেই কক্ষ, সেই চাপের কাপ, সেই বিছানা… নাহ, নাহ। আদ্রিকা সেসব ভাববে না৷ বেহায়া চোখ দুটো থেকে কখন জল গড়িয়েছে সে জানে না। জলের অস্তিত্ব টের পেয়ে নিজেই ভীষণ লজ্জায় পরে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, কেউ সাক্ষী হয়নি তো এই অবৈধ জলের কণার? দ্রুত হাতে চোখের জল মুছে এগিয়ে গেল মাঝখানের দরজার দিকে৷
এটা পরখের কক্ষ৷ আগের যুগের কাঠের তৈরি দু পাল্লার দরজা৷ একদম উপরে একটি শিকল আছে। সেটা তুলে দিয়ে দরজা বন্ধ করতে হয়৷ দরজায় কোনো তালা দেওয়া নেই৷ পরখ হয়তো ভুলে গেছে।
তখন ক্ষুধার তাড়নায় চিৎকার চেঁচামেচি করলেও এই মুহুর্তে ভয়টা আবার ফিরে এসেছে। কম্পিত হস্তে ছিটকিনি নামিয়ে সে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করল। ছিমছাম কক্ষটি বেশ পরিপাটি। পশ্চিমপাশে একটি জানালা রয়েছে। তার সামনে পরখের পড়ার টেবিল, চেয়ার। একটি কাঠের সস্তা খাট, আরএফএল এর ছোট ওয়্যারড্রব, বাদামি রং এর একটি বীন ব্যাগ এবং খাটের নিচে একটি টিনের ট্র্যাংক ছাড়া আর কিছুই নেই।
আদ্রিকা সতর্কতার সাথে পা ফেলে ঘরময় পায়েচারি করল। আগমনের ছাপ ফেলে গেলে পরখের তোপের মুখে পরতে হবে নিশ্চিত।
সাদা পরিষ্কার চাদরে ঢাকা বিছানা দেখে আদ্রিকার ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। তখনি খেয়াল হল, রাতে শোয়ার ব্যবস্থা করা বাকি। দ্রুত পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আবার ছিটকিনি তুলে দিল।
বামপাশের কক্ষটিতে বড় একটা তালা ঝুলছে। তবে দরজার পাশে দেয়ালে চাবিটি ঝুলিয়ে রাখা। যা দেখে আদ্রিকার মুখে হাসি ফুটল। কিন্তু দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশের সাথে সেই হাসি মিলিয়েও গেল।
মাকড়সার জালে ভরা ধুলো ময়লা যুক্ত কক্ষটি কোনোভাবেই বসবাসের উপযুক্ত নয়। কেমন ভ্যাবসা একটা গন্ধে আদ্রিকার দম বন্ধ হয়ে আসছে। দরজাটি খুলে রেখে সে বাইরে বেরিয়ে এলো। ব্যাগ থেকে ক্লিপ বের করে চুলগুল খোঁপা করে নিল। বন্ধ করলো স্লাইডিং ডোর। গায়ের ওড়নাটি সোফার উপর রেখে আদ্রিকা নেমে পরল যুদ্ধে৷
ভাঁড়ারঘরে কয়েকটি পা ভাঙা চেয়ার মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সেগুলোকে নিয়ে এসে খোলা ছাদে রাখল। কয়েকটি প্লাস্টিকের বস্তা মুখবন্দী করে রাখা৷ ভেতরে কি আছে বুঝা যাচ্ছে না। তবে খুব একটা ভারি নয়। হয়তো লেপ, তোষক কিছু হবে। সেগুলো ছাদে রাখতে গিয়ে আদ্রিকা দ্বিধায় পরে গেল। এগুলো দরকারি জিনিসপত্র হতে পারে। বাইরে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলে পরখ ওকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।
তাহলে এগুলো রাখবে কোথায়? তাৎক্ষণিক কিছু ভেবে পেল না। তবে সব বুদ্ধি বিবেচনা গিয়ে ঠেকছে একটা জায়গা। যার জন্য আদ্রিকাকে আরেকটু সাহসী হতে হবে। বস্তাটি তুলে নিয়ে আদ্রিকা নিজেই নিজেকে বলল,
‘যা আছে কপালে, পরে দেখা যাবে৷’
লম্বা শ্বাস ফেলে বন্ধ দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে থেকে বস্তাটি ভেতরে ছুড়ে মারল। একে একে ভাঁড়ারঘরের সমস্ত জিনিসপত্র এসে ভীড় জমালো কক্ষটিতে৷ দেখতে দেখতে বিস্ময়ের সুসজ্জিত কক্ষটি পরিণত হলো ভাঁড়ারঘরে।
শেষ বস্তু, একটি পুরাতন টুল কক্ষের ভেতর ছুড়ে দিয়ে আদ্রিকা বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইল। দাঁত দ্বারা নিচের ঠোঁট চেপে কান্না আটকে দু চোখ ভরে দেখল কক্ষটির কুৎসিত রুপ। তারপর পাল্লা দুটো টেনে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিল।
মাথার উপরে ঝুলতে থাকা মাকড়সার জালে ধুলো জমে তা কালো রশির মতো দেখাচ্ছে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আদ্রিকার গা গুলিয়ে উঠল৷ কিচেনের এককোনায় লম্বা ঝাড়ু পেয়েছিল। সেটি দিয়ে ঝুলন্ত মাকড়সার জালসহ সমস্ত ময়লা পরিষ্কার করে ফেলল। হাঁচি, কাশি দিতে দিতে অবস্থা খারাপ। কাজ শেষে এখন মনে হচ্ছে, মুখে কাপড় বেঁধে ধুলো পরিষ্কার করা উচিত ছিল।
নিজের কপাল চাপড়ে আদ্রিকা নিজেই নিজেকে বলল,
‘তুই বরাবর এমন। কাজ করার পর আফসোস করিস। এজন্যই বলে ভাবিয়া করিয়ো কাজ, করিয়া ভাবিও না।’
ওয়াশরুম থেকে বালতি ভরে পানি নিয়ে এসে যখন মেঝে মুছতে শুরু করল, তখন চতুর্দিক আযানের ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে৷ ভেজা কাপড় দিয়ে একপাশের ময়লা মুছতে গেলে সেগুলো আরেকপাশে চলে যাচ্ছে৷ সে ভেবে পেলো না, আদ্রতা কীভাবে ঝটপট পুরো বাড়ি মুছে ফেলত।
নাহ, এসব আদ্রিকাকে দিয়ে হবে না৷ সে পুরো বালতি উল্টে দিলো ঘরের মেঝেতে। এবার সব ময়লা ধুয়ে যাবে।
কিন্তু পানি গড়িয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে যেতে দেখে আদ্রিকার গা কাঁপতে শুরু করল। ড্রয়িংরুমে পানি দেখলে পরখ ওকে পানির ট্যাংকিতে চুবিয়ে মারবে। ন্যাকড়া হাতে সে ছুটল পানির পেছনে৷ কাপড় দিয়ে চিপে চিপে মেঝের পানি তুলতে তুলতে আদ্রিকার নাভিশ্বাস দশা৷ কাজ শেষ করে চর্তুদিকে তাকিয়ে আদ্রিকার মুখে আঁধার নামল। ওই তো বালু চিকচিক করছে৷ পায়ের ছাপ পরে কেমন কাঁদাকাঁদা হয়ে গেছে চারপাশ৷ এতো কষ্টের এই ফল দেখে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল। কোমরের ব্যথায় ওভাবেই ভেজা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পরল। ওর পক্ষে আর একটু কাজ করা সম্ভব নয়। এর থেকে ড্রয়িংরুমের মেঝেতে ঘুমানো ভালো ছিল।
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দুদন্ড বিশ্রাম নিতেই দরজায় ঠকঠক শব্দে চমকে উঠল আদ্রিকা।
চলবে
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|১২|
আকাশে শিমুল তুলার মতো মেঘ উড়ছে বেড়াচ্ছে। মৃদুমন্দ বাতাস চারদিকে। তবে খুব একটা ঠান্ডা লাগছে না। মিষ্টি রোদ খেলা করছে প্রকৃতিতে। পার্কিংয়ে বাইক রেখে পরখ চলে গেল ভেতরে। বিমানবন্দরে এলে না চাইতেও মন খারাপ হয়ে যায়। এখানের হাওয়ায় ভাসে বিদায় বার্তা। দীর্ঘশ্বাসের ভারের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে থাকে৷
খুব কাছে একটি সাধারণ মুখশ্রী। প্রিয়জন রেখে দূরে যাওয়ার বিরহ যার মুখবিবরে স্পষ্ট। তবে চোখ দুটোতে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন। উচ্ছ্বাস, উৎকণ্ঠায় মেতে থাকা সদ্য যুবকটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। যুবকটি হয়তো পড়াশোনার উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন পর পরখ নিজেও একই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে থাকবে। ভাবতেই সারাদেহে বিদ্যুৎ খেলে গেল।
বাইরে বসে অপেক্ষা করছিল পরখ। পরিচালকের সহযোগী এসে জানাল,
‘মিস্টার ইবতেহাজ, স্যার আপনাকে ভেতরে ডাকছেন।’
প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট হাতে নিয়ে পরখ উঠে দাঁড়াল। উড়ান এয়ারলাইন্সের পরিচালক নাজিমুদ্দিন মাত্রই চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছেন। পরখকে দেখে হাসিমুখে স্বাগত জানালেন।
‘এসো পরখ। কেমন আছো?’
পরখ চেয়ারে বসল। স্মিত হেসে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি আংকেল। আপনি?’
‘ভালো আছি। চা খাবে তো?’
‘আমি নাস্তা করে এসেছি।’
‘চা খাওয়ার জন্য আবার না খেয়ে পেট ফাঁকা রাখতে হয় নাকি? যখন তখন যেকোনো অবস্থায় চা খাওয়া মানে পান করা যায়।’
ইন্টারকমে চা দিতে বলে নাজিমুদ্দিন বললেন,
‘ফোনে কীসের সমস্যার কথা বললে ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি। তাই সরাসরি দেখা করতে বললাম। অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয় না। ভাবলাম এই সুযোগে তোমার সাথে আলাপ হয়ে যাবে। কি সমস্যা হয়েছে শুনি।’
‘পনেরো তারিখ সুইজারল্যান্ডের একটি টিকিট কেটেছিলাম। আজকে কনফারমেশন মেইল পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু পেলাম না। হেল্পলাইনে ফোন করে শুনি আমার নামে কোনো টিকিট বুক করা নেই।’
নাজিমুদ্দিন খানিক অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় হাসলেন। ছেলেটার গতকালকে বিয়ে হয়েছে, ওর বাবার কাছে তিনি শুনেছেন। বিয়ে নিয়ে ভালোই ঝামেলায় আছে মনে হচ্ছে। না হলে নিজে টিকিট ক্যান্সেল করে আবার নিজেই ভুলে বসে থাকে? এই মুহূর্তে ওকে আরও মানসিক চাপ দেওয়ার ইচ্ছে হলো না। স্মিত হেসে নরম সুরে বললেন,
‘টিকিট বুক করার আগে তুমি আমাকে কল করেছিলে। আমার স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু পরখ তুমি কালকে মেইল পাঠিয়ে টিকিট ক্যান্সেল করলে যে। আমরা তখনি বুকিং ক্যান্সেল করে দিয়েছি। দু তিনদিনের মধ্যে রিফান্ড পেয়ে যাবে।’
পরখ যেনো আকাশ থেক পড়ল। বিশ তারিখ থেকে ওর ক্লাস শুরু হবে। এই মুহূর্তে সে প্লেনের টিকিট ক্যান্সেল করতে যাবে কেনো? সে কি পাগল? সরু চোখে নাজিমুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান পরখ প্রশ্ন করল,
‘আমি টিকিট ক্যান্সেল করেছি? কী বলছেন আংকেল! কখন?’
‘কালকে বিকালে আমাদের অফিশিয়াল জি মেইল এড্রেসে মেইল করেছো। এই দেখো।’
নিজের ল্যাপটপটি পরখের দিকে ঘুরিয়ে মেইলটি দেখালেন। ব্যক্তিগত সমস্যা উল্লেখ করে প্লেনের টিকিট ক্যান্সেল এর অনুরোধ করা হয়েছে। প্রেরকের স্থানে জ্বলজ্বল করছে পরখের জি মেইল এড্রেস। পরখ বার কয়েক পলক ফেলে সে দৃশ্য দেখল।
এ যেনো আমার ভ্রম হয় আল্লাহ। আমার দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফল তুমি এভাবে কেড়ে নিও না। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে মিনতি করেও লাভ হলো না। বদলে গেলো না চোখের সামনে দৃশ্য। মেইল পাঠানোর সময়টি দেখে পরখ বিড়বিড় করল,
‘এই মেইল আমি পাঠাইনি আংকেল।’
‘কিন্তু তোমার জি মেইল এড্রেস থেকেই এসেছে।’
এই কাজটি কে করেছে, তা পরখ জানে। কিন্তু নিজের পারিবারিক আলোচনা বাইরের মানুষের সামনে করতে ইচ্ছে হল না। সে বলল,
‘কোনোভাবে এটা বাতিল করা যায় না? বিশ তারিখ থেকে আমার ক্লাস শুরু হবে। এর আগেই আমাকে সুইজারল্যান্ড পৌঁছাতে হবে।’
নাজিমুদ্দিন বুঝতে পারছেন, কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। ঘাড় চুলকে আমতা আমতা করে বললেন,
‘আসলে হয়েছি কি পরখ, তুমি বুঝতেই পারছো এখনকার অবস্থা। নতুন সিজন শুরু হয়েছে। বিপুল পরিমাণ স্টুডেন্ট দেশের বাইরে যাচ্ছে। বাইশ তারিখ পর্যন্ত সমস্ত ফ্লাইটের টিকিট বুকড।’
‘অন্য কোনো এয়ারলাইন্সে কোনোভাবে ম্যানেজ করা যায় না?’
‘হাতেগোণা কয়েকটা ফ্লাইট যায় সুইজারল্যান্ডে। তাও আবার বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কোনো ফ্লাইড নেই। জানোই তো? সবগুলোতে একই অবস্থা।’
‘আমার ভর্তি বাতিল হয়ে যাবে আংকেল।’
‘কী যে করি! আমার নিজেরও খারাপ লাগছে। গতকাল তুমি বিয়ে করেছো শুনলাম। তাই হয়তো এই সেমিস্টার এটেন্ড করতে চাইছ না। এই ভেবে আমিও টিকিট ক্যান্সেল রিকুয়েস্ট দেখে তেমন কিছু সন্দেহ করলাম না। কিন্তু এখন দেখি ভালোই ঝামেলা হয়ে গেল।’
‘কি করব বুঝতে পারিছি না। ওদিকে ভার্সিটি থেকে মেইল চলে এসেছে। ওদিকে সব ঠিকঠাক। এখন এই অন্তিত মুহূর্তে এ কোন বিপদ ধেয়ে এলো!’
‘ভার্সিটির ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলো। ওদেরকে নিজের সমস্যার কথা জানাও। যদি সময় বাড়িয়ে দেয় তাহলে ভালো। না হলে অনলাইনে ভর্তি কনফার্ম করে রাখো। পরের সেমিস্টার থেকে ক্লাস শুরু কোরো।’
‘ছয় মাস পর আরেকটা সেমিস্টার। অনেকটা পিছিয়ে যাবো। তাছাড়া উনারা অনলাইনে ভর্তি কনফার্ম করবে কিনা তাও জানি না।আমি বুঝতে পারছি না, কি করবো। সব এলোমেলো লাগছে।’
নাজিমুদ্দিনের বাল্যকালের বন্ধুর ছেলে পরখ। নিজ সন্তানের মতোই স্নেহ করেন ওকে। কিন্তু এই মুহুর্তে ওর জন্য কিছু করতে না পারায় বেশ কষ্ট লাগছে। হাত বাড়িয়ে পরখের কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
‘বি স্ট্রং। তোমার কষ্ট আল্লাহ বৃথা যেতে দিবেন না। তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী। ধৈর্য্য রাখো।’
আজ অনেকদিন বাদে পরখের ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ভাগ্য তার সাথে এমন নিষ্ঠুর খেলা কেনো খেলছে? কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছে? কলেজ শেষ করে দেশের বাইরে অনার্স করতে চেয়েছিল কিন্তু ইবনূল ইবতেহাজ মানলেন না।
পরখ নিজেও কখনো জোর গলায় কিছু চাইতে পারেনি। সবসময় নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে সন্দিহান থাকে। আত্মবিশ্বাসের অভাবে জীবনে কম ক্ষতির সম্মুখীন সে হয়নি। কলেজ শেষ করে মনের সুপ্ত ইচ্ছা বাবাকে যখন জানালো, তখনো সে সন্দিহান। আদোও এ সিদ্ধান্ত তার জীবনে সুফল বয়ে আনবে কি? সেই টালমাটাল সময়ে বাবা-মা সে প্রস্তাব নামচ করে দিলেন। এখানেই অনার্স করতে বলায় সে কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল। বাবা-মা অভিজ্ঞ মানুষ। তার থেকে জ্ঞানী। ভেবেচিন্তেই না বলেছে। হয়তো এটাই পরখের জন্য ভালো হবে।
কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর দেখল, তার বন্ধুরা প্রায় সবাই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। অনেক ভালো কলেজ থেকে অনার্স শেষ করে তিন বছরের মধ্যে সফল ক্যারিয়ারও গঠন করে ফেলেছে। অথচ পরখের অনার্স শেষ করতে করতে প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল।
সেদিন যদি সে সাহস করে বিদেশে চলে যেত তবে জীবনে আরও উন্নতি করতে পারত। সে যদি নিজের প্রতি আরেকটু বিশ্বাস রাখত, আরেকটু আত্মবিশ্বাসী হত, একগুয়ে হত – তবে এই দিনটি দেখতে হত না।
নিজের ব্যর্থতা, দূর্বলতা থেকে জন্ম নেওয়া এই রাগ, ক্ষোভ সে দেখিয়েছে নিজের বাবার প্রতি। কেনো তিনি সেদিন পরখের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত ওর উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন? সেই নিয়ে বাবা ছেলের দ্বন্দ আজও চলছে। অভিমান করে পরখ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মত জীবন যাপন শুরু করল। তবুও বাবার খাঁচা থেকে মুক্তি পেল না। লোকটা আজও দূর থেকে পরখের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন।
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে একটু নিরিবিলি জায়গা দেখে পরখ বাইক থামাল। মোবাইল বের করে কল দিল ইবনূল ইবতেহাজকে। প্রথমবার রিং হতেই ইবনূল ইবতেহাজ কল রিসিভ করলেন। কোনো ভণিতা ছাড়াই পরখ বলল,
‘তুমি আমার জিমেইল থেকে মেইল পাঠিয়ে প্লেনের টিকিট ক্যান্সেল করেছো?’
‘হ্যাঁ করেছি।’
ইবনূল ইবতেহাজের সরল সোজা জবাব শুনে পরখের রাগ দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেল। সে চিৎকার করে বলল,
‘কেনো? তুমি আমার সাথে কেনো এমন করছ? চারটা বছর আমি এখানকার একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি স্কলারশিপের জন্য প্রিপারেশন নিয়েছি। তুমি এক ঝটকায় সব শেষ করে দিলে। আমার সাথে তোমার কীসের শত্রুতা?’
ইবনূল ইবতেহাজ যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্মিত কন্ঠে শুধালেন,
‘গতকাল বিয়ে করে তুমি আজ প্লেনের টিকিট সংগ্রহ করতে চলে গিয়েছ! নতুন বউ রেখে বিদেশে চলে যাবে? আমি তো ভাবলাম, বিয়ের উত্তেজনায় তুমি টিকিট ক্যান্সেল করতে ভুলে গেছ। তাই আমি তোমাকে চাপ না দিয়ে নিজেই মেইল পাঠিয়ে দিলাম। দেরীতে টিকিট ক্যান্সেল করলে তোমার এতো কষ্টে উপার্জনের টাকা জলে চলে যেত। এখন ক্যান্সেল করায় আশি শতাংশ রিফান্ড পাবে।’
পরখ অতি কষ্টে নিজের চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করল। এই লোকটাকে অনেক বাজে কথা শোনাতে ইচ্ছে করছে কিন্তু অতিরিক্ত রেগে গেলে, অভিমানটাও অতিরিক্ত বেড়ে যায়। তখন আর তর্কে নামতে ইচ্ছে করে না। এভাবে বারবার অন্যায় করে অভিমানের দয়ায় বেঁচে যায় আপন মানুষেরা। এক হাতে মুখ ঢেকে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে পরখ তার নিস্তেজ কন্ঠে বলল,
‘বারবার আমার স্বপ্নের মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানো তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এবার তুমি যে কাজটি করেছ, তার জন্য আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করব না। ভীষণ অন্যায় করেছ তুমি আমার সাথে।’
ইবনূল ইবতেহাজকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পরখ কল কেটে দিল। জিমেইল একাউন্টে গিয়ে পাসওয়ার্ড পাল্টে সমস্ত ডিভাইস থেকে লগ আউট করে নিল।
পিচঢালা সড়ক দিয়ে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। দু একজন বাইকচালক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে পরখের দিকে। এমন দিনে-দুপুরে সড়কের ধারে কাউকে বসে থাকতে সচরাচর দেখা যায় না। তাও আবার প্রধানসড়কের মতো ব্যস্ত সড়কের কিনারায় কে বসে থাকে!
কিন্তু এই অদ্ভুত কাজটিই পরখ করেছে। সড়কের কিনারায় সড়কের দিকে পিঠ করে বসে আছে। একলা একটু সময় কাটানোর জন্য এই ব্যবস্থা। কারো সান্নিধ্য এই মুহূর্তে মেজাজ আরও বিগড়ে দিতে পারে। নিজের প্রশান্তির জন্য পরখ যেখানে আবাস গড়েছিল, সেখানে এখন ঠাঁই নিয়েছে আরেকজন। যাকে দেখলে পরখের মেজাজ সপ্ত আসমানে উঠে যায়।
বাড়ি ফেরার ইচ্ছে না থাকলেও চারদিক আজানের ধ্বনিতে মুখরিত হওয়ায় সে উঠে দাঁড়াল। তখনি কল এলো পর্তুলিকার। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে এই একজন ব্যক্তি আছেন, যিনি পরখকে মায়ার বাঁধনে আটকে রেখেছেন। পর্তুলিকা না থাকলে পরখ এই দেশ, এখানের পরিচিত মানুষ সবার থেকে বিদায় নিয়ে কবেই অন্যত্র চলে যেত। কিন্তু বেশিদিন মায়ের থেকে দূরে থাকলে পরখের অস্থির লাগে। তাই তো কিছুদিন পর সে বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে আসত।
লম্বা শ্বাস টেনে পরখ নিজের মনের সকল দুঃখ, হতাশাকে আড়াল করে নিল। কল রিসিভ করে বলল,
‘হ্যাঁ মা, বলো।’
টেবিলে খাবার বাটিগুলো গুছিয়ে রাখছিলেন পর্তুলিকা। একটু পরেই উনারা খেতে বসবেন। ছেলে খেয়েছে কিনা খোঁজ না নিলে তিনি স্বস্তি পাবেন না বলেই এই সময় কল করা। মিষ্টি হেসে রিনরিনে কন্ঠে তিনি বললেন,
‘তোরা খেয়েছিস?’
মায়ের কথা শুনে পরখের মনে পরল, ঘরে একজন উপোস আছে। রান্নাবান্না কিছু পারে কিনা জানা নেই। দেখে তো মনে হয়েছে, কখনো চুলার ধারের কাছে যায়নি। রান্না জানলেও ঘরে বাজারসদাই কিছুই নেই। সে ভেবেছিল এই কয়েকটা দিন বাইরে খেয়ে নিবে। এমনিতেও বাসাটি ছেড়েই দিচ্ছিল এ মাসে। কিন্তু এখন আবার জনার্দান রায়ের সাথে কথা বলতে হবে।
‘এখনও খাইনি। কিছু কাজে বাইরে এসেছি।’
‘আদ্রিকাকে একা রেখে আজকেই বাইরে গিয়েছিস। এটা কেমন আচরণ পরখ? ও বাড়িতে মেয়েটার আজ প্রথমদিন। নিশ্চয়ই ভয় পাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যা।’
‘জরুরি কাজ ছিল।’
‘কি কাজ?’
‘প্লেনের টিকিট এর ব্যাপারে।’
‘তুই এ সপ্তাহেই যেতে চাইছিস?’
‘তুমি কি চাইছ? না যাই?’
‘না মানে, হঠাৎ করে এমনভাবে বিয়েটা হয়ে গেল। তুই এখনি চলে গেলে ব্যাপারটা কেমন দেখায়। কিছুদিন পরে গেলে হয় না? ভার্সিটিতে একটু কথা বলে দেখ না।’
পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইবনূল ইবতেহাজের সাথে তার দ্বন্দ্ব বরাবর পর্তুলিকার থেকে লুকিয়ে রাখা হয়। মায়ের কাছে নালিশ করলে পুত্রের ভালোবাসায় মমতাময়ী পর্তুলিকা বাড়িতে বিশাল ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলবেন। পরখ বাবার সাথে ঝামেলা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর স্বামীর উপর পর্তুলিকা বেশ ক্ষেপে গিয়েছিলেন। এটা ওটা বুঝিয়ে মানিয়ে নিয়েছিলেন ইবনূল ইবতেহাজ। কিন্তু স্বামীর প্রতি পর্তুলিকার অভিমান আজও কমেনি।
প্রতিবার বাড়িতে গেলে বাবার সাথে পরখের কিছু একটা নিয়ে তর্ক লেগেই যায়। তাই নিয়ে রাগ করে পরখ আবার বেশ কিছু বাড়ি যায় না। মাস পেরিয়েও পর্তুলিকা যখন ছেলের দেখা পায় না, তখন রেগেমেগে অগ্নিবর্ষণ করেন ইবনূলের উপর। স্ত্রী প্রেমে বিভোর ইবনূল ইবতেহাজ পর্তুলিকার সম্মুখে একদম শিশুর ন্যায় কোমল। সুবোধ বালকের মতো স্ত্রীর সকল আদেশ তার শিরোধার্য। স্ত্রীর মলিন মুখে হাসি ফুটাতে ছেলেকে কোনো না কোনো ফাঁদে ফেলে বাধ্য করেন বাড়ি ফিরতে। ছেলের দুঃখে মা দুঃখ পাবেন। সেই নিয়ে বাবার সাথে ঝামেলা করবেন। তা পরখের পছন্দ নয়।
তাইতো এবারও সে কিছু জানালো না। সকল অভিযোগ একপাশে রেখে বলল,
‘কথা বলার দরকার নেই। এখনি যাচ্ছি না। টিকিট ক্যান্সেল করেছি। এখন বাসায় দিকেই যাচ্ছি।’
‘যাক ভালোই হল। তোরা খাবারের বন্দোবস্ত করেছিস? আমি ভাবছি ড্রাইভারকে দিয়ে কিছু খাবার প্যাক করে পাঠিয়ে দেই।’
‘এসব কিছু করতে হবে না। খাবারের ব্যবস্থা করেছি। তুমি সময় মতো খেয়ে নিও।’
মায়ের সাথে কথা বলা শেষ করে পরখ চলে গেল খাবার হোটেলে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুজনের জন্য খাবার কিনে নিল।
_______
দরজার অপরপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রিকাকে দেখে পরখ থমকাল। এলোমেলো চুল, মলিন মুখ, কপালের একপাশে কালি, ভেজা জামাকাপড় গায়ে। দরজা খুলে দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা, যাতে পরখ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে৷
বিরক্তিভরা চোখে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পরখ বিড়বিড় করে বলল,
‘ইউ আর লুকিং লাইক অ্যা শীট৷’
আদ্রিকা ঠোঁট উল্টে নিজের দিকে তাকিয়ে আরও গুটিয়ে গেল। সত্যি তো আবর্জনার থেকে কম কিছু দেখাচ্ছে না তাকে। তাই বলে এভাবে মুখের উপর অপমান করবে? ভীষণ মন খারাপ হল ওর৷
যা অবশ্য দূর হয়ে গেল, যখন দেখল খাবারের প্যাকেটগুলো টেবিলের উপর রেখে পরখ নিজের কক্ষের দিকে চলে যাচ্ছে।
কক্ষ পরিষ্কার করতে গিয়ে খাবারের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। ক্লান্ত শরীরে খাবার রান্না করা ওর পক্ষে অসম্ভব। পরখ খাবার নিয়ে না আসলে এবেলা না খেয়ে থাকতো, তবুও রাঁধতে যেত না৷
ভাঁড়ারঘরে কোনো ফ্যান নেই। ভেজা মেঝে শুকাতে বেশ সময় লাগছে৷ একমাত্র জানালাটি খুলে দিয়ে আদ্রিকা বেরিয়ে এলো। ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল গোসলের উদ্দেশ্যে। আবর্জনা থেকে একটু মানুষে পরিণত হওয়া যাক।
ডাইনিং টেবিলে খাবারের প্যাকেটগুলো ওভাবেই পরে আছে৷ পরখ এখনও খাবার খায়নি। অত্যাধিক পরিশ্রমের ফলে আদ্রিকার বেশ ক্ষুধা লেগেছে৷ তবুও যে ব্যক্তিটি খাবার নিয়ে এলো, সে না খাওয়া অব্দি খাবার খেতে বসতে সংকোচ বোধ হচ্ছে। বার দুয়েক পরখের কক্ষের বন্ধ দুয়ারের সামনে থেকে ঘুরে এসেছে৷
সে মহাশয়ের কোনো খবর নেই। এদিকে আদ্রিকার ক্ষুধা সহ্যসীমা অতিক্রম করতে চলল। পরখকে খাবারের জন্য না ডেকে সে খেতে বসতেও পারছে না। অবশেষে বাধ্য হয়ে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ধীর কণ্ঠে ডাক দিল,
‘পরখ?’
ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। কয়েকবার ডেকেও যখন কোনো সাড়াশব্দ পেল না, তখন বাধ্য হয়ে দরজা খুলে আদ্রিকা ভেতরে প্রবেশ করল।
খাটে পিঠে ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে পরখ। এপাশ থেকে আদ্রিকা তার পিঠ দেখতে পাচ্ছে শুধু।
মুখ দেখতে না পেলেও তার বসার ভঙ্গি দেখে বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থা আন্দাজ করা যায়।
পরখের শূণ্য দৃষ্টি পশ্চিমের জানালা ভেদ করে দূরে চলে গেছে। মনের অভ্যন্তরে একটা রাগ গোল গোল পাক খাচ্ছে। কিন্তু সেটি প্রকাশ করতে পারছে না৷ লোকে বলে পুরুষ মানুষের অনুভূতি নেই। তারা অনুভূতি শূন্য। ওরা কি করে জানবে সৃষ্টিকর্তার হাতে গড়া প্রতিটি মানুষ অনুভূতিসম্পন্ন। শুধু ব্যক্তিভেদে তা প্রকাশের ধরনটা ভিন্ন। পুরুষ নারীর মতোন কাঁদতে পারে না। চট করে মুখ ফুটে অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারে না বলে তাদের অনুভূতিশূণ্যের তকমা দেওয়া হয়েছে৷ অন্যসব অন্যায়, অনাচারের মতো পুরুষেরা এই অপবাদটিও মুখ বুজে সয়ে নিয়েছে। বরাবরের মত কোনো প্রতিবাদ করেনি।
পরখের সম্মুখীন হওয়ার সাহস হলো না আদ্রিকার। ওকে দেখে নিশ্চয়ই আরও ক্ষেপে যাবে। দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভীত স্বরে জানতে চাইল,
‘পরখ, খাবেন না?’
ঘাড় ঘুরিয়ে রক্তিম দৃষ্টি মেলে পরখ চাইলো ওর পানে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আদ্রিকার সমস্ত সাহস জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিল। দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। পরখ রাগ দেখাল না৷ শুধু শান্ত স্বরে বলল,
‘যাও এখান থেকে।’
ওড়নার কোণা শক্ত করে মুঠোয় ভরে আদ্রিকা আবারও বলল,
‘খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে…’
বাক্যটি উচ্চারণ তখনও শেষ হয়নি। ক্রুদ্ধ পরখ একপলকে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর রাখা কাচের গ্লাসটি তুলে নিয়ে এক আছাড় মারল মেঝেতে৷ ঠাস শব্দ করে প্রাণহীন বস্তুটি ভূমিতে পতিত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তড়াৎ করে লাফিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল আদ্রিকা৷ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পরখ চিৎকার করে বলল,
‘সহজ কথা বুঝো না তুমি?’
এমন উচ্চস্বরে আজ পর্যন্ত ওর সাথে কেউ কথা বলেনি৷ বাবা চিল্লাচিল্লি করলে আদ্রতা ওকে ঘর থেকে বের হতে দিত না। তবুও দূর থেকে বাবার উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনে আদ্রিকার ভীষণ মন খারাপ হত। পরখের এমন ক্ষেপে যাওয়ায় সে ভীষণ ভয় পেল। এতটা ভয় আগে কখনও পায়নি। শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে৷ কম্পিত স্বরে বলল,
‘এভাবে ধমকাচ্ছেন কেনো? কি এমন অন্যায় করেছি আমি? খেতেই তো ডাকলাম।’
‘দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে।’
‘ আপনার থেকে দূরেই আছি। এমন ঠান্ডায় কাল সারারাত ওই সোফায় কাটিয়ে দিলাম তবুও আপনার সামনে আসিনি। আপনার কাছে সাহায্য চেয়ে বিরক্ত করিনি। খাবার কিনে এনেছেন বলেই তো ডাকতে আসলাম। না খেলে খাবার নিয়ে এসেছেন কেনো? বিয়ে করার সময় কাউকে কিছু বলতে পারে নি, এখন যত রাগ আমাকে দেখাচ্ছে। আমাকে ধমকাচ্ছে। যেন আমি উনাকে ধরে বেঁধে বিয়ে করেছি।’
আদ্রিকার কান্নাকাটি এবং ফ্যাচফ্যাচে কথাবার্তা শুনে পরখের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। কখনও অভিযোগ না করা পরখ আদ্রিকার কাছে অভিযোগ করেই বসল।
‘তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমার জীবনে সব খারাপ হচ্ছে। আমার কপালে শনি হয়ে নেমে এসেছ তুমি৷ তোমার জন্য আমার চরিত্রে দাগ লেগেছে, আমার মা আমাকে সন্দেহ করেছে, স্কলারশিপ নিয়ে টানাটানি পরে গেছে। তোমাকে বিয়ে করার শাস্তিস্বরূপ আমার বিদেশ যাওয়া ক্যান্সেল হয়ে গেছে৷ এতো এতো সর্বনাশের পর তোমাকে মাথায় তুলে নাচা উচিত আমার, তাই না?’
পরখের কথা শুনে আদ্রিকা থমথমে খেয়ে গেল। মুহূর্তেই একটা অপরাধ ওকে গ্রাস করে নিল। অযাচিতভাবে পরখের দ্বারে সাহায্য চাইতে সে উপস্থিত হয়েছিল। কথাটি মিথ্যে নয়৷ তখন সে নিরুপায় ছিল। কিন্তু এরপর সে আর কখনও পরখকে বিরক্ত করেনি৷ এখন সে যদি মা ভক্ত ছেলে হয়ে মায়ের আদেশ শিরোধার্য মেনে বিয়েতে মত দেয় সেক্ষেত্রে আদ্রিকার কি করার আছে? এখন পরখের সাথে যা কিছু ঘটছে সেসবে আদ্রিকার হাত নেই। ভাগ্যের ফেরে যদি বিদেশ যাওয়া বাতিল হয়ে যায়, সে দায় আদ্রিকা কেনো নিবে?
মনে অনেক তর্ক বিতর্ক চলতে থাকলেও পরখের মলিন মুখের দিকে চেয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না। বিস্ময়ের কাছে পরখের বিদেশে পড়াশোনার ব্যাপারে একটুআধটু সে শুনেছে। উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরের দেশে যাওয়া পরখের একমাত্র স্বপ্ন। স্বপ্ন ভেঙে গেলে কেমন লাগে সেটা আদ্রিকা এখন ভালোভাবে বুঝতে পারে৷
বিনাবাক্য ব্যয়ে সে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। খাবার টেবিলে এসে বসলেও ক্ষুধাটা কোথাও যেন হারিয়ে গেছে৷ আদ্রিকা ভেবেছিল বিয়ের পর সমস্ত অতীতকে পেছনে ফেলে আবার নতুন করে জীবন সাজাবে৷ মায়ের মতো কিছু ত্যাগ, তিতিক্ষা করে সুন্দর একটা সংসার সাজাবে৷ কিন্তু সেসব আর হচ্ছে কোথায়! আজ আদ্রিকা নিশ্চিত হয়ে গেল, এখানে কোনোভাবেই তার সংসার হবার নয়৷ পরখ নিজের জীবনের ধকল সামলাতে কূল পাচ্ছে না। আদ্রিকার উপস্থিতি ওকে আরও ক্ষেপিয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত। যাকে দেখা মাত্রই পরখ ছ্যাঁত করে উঠছে, তাকে নিশ্চয়ই সে দু হাতে আগলে নিবে না৷ অথচ আদ্রিকার এখন এমন কাউকে দরকার যে তাকে অতীতের অন্ধকার থেকে পরম যত্নে আলোতে নিয়ে আসবে৷
আদ্রিকা চলে যেতেই পরখ ধপ করে বিছানায় বসে অনবরত শ্বাস ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল। এই মেয়েটার সামনে নিজের ব্যক্তিত্বের বিপরীত আচরণ করে ফেলায় সে নিজেই নিজের উপর বিরক্ত। এখন আবার হঠাৎ করে কতকিছু বলে ফেলল। কেনো বলল ওকে এসব? বলে কি লাভ হল?
নিজের প্রতি ক্ষোভের পাতায় প্রতিনিয়ত নতুন ঘটনা যুক্ত হচ্ছে৷ দু’দন্ড স্থির হতে পারছে না সে৷ জীবনের আয়নাটি হঠাৎ করে ভেঙেচূড়ে গেছে। প্রতিটি খন্ড কুড়িয়ে নিয়ে তাকে আবার গড়তে হবে৷ এর জন্য সময় দরকার, মানসিক স্থিরতা দরকার। যা এখানে কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না।
বিছানার উপর মোবাইলটি হঠাৎ কেঁপে উঠল৷ এই মুহূর্তে কারো সাথে কথা বলার মানসিকতা নেই৷ তবুও হাত বাড়িয়ে মোবাইলটি তুলে নিয়ে সেটি রিসিভ করল। সালাম দিয়ে বলল,
‘কে বলছেন?’
ওপাশ থেকে নীহার বলল,
‘আমি আদ্রিকার মা বলছি৷ তুমি নিশ্চয়ই পরখ?’
ব্যাপারটি বুঝতে পরখের কিছুক্ষণ সময় লাগল। তারপর মনের সমস্ত বিরক্তি মুছে ফেলে সজীব কণ্ঠে বলল,
‘জ্বি আন্টি।’
‘আসলে তোমার ফোন নাম্বার আমার কাছে ছিল না৷ অনেক খুঁজে সংগ্রহ করতে হল। মেয়েটার জন্য চিন্তা হচ্ছিল খুব। তোমরা ভালো আছ তো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। এখানে সব ঠিক আছে আন্টি। আপনি চিন্তা করবেন না৷ এক মিনিট দিন, আদ্রিকার সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি৷’
সন্তানের জন্য মায়ের অস্থিরতা পরখ বুঝে। একদিন নিজের মায়ের সাথে কথা না হলে ফোনে তারও এমন অস্থির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে৷
আদ্রিকাকে খুঁজতে হলো না। সে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে৷ পরখ এগিয়ে এসে মোবাইলটি এগিয়ে দিল। মুখে কিছু বলল না। আদ্রিকা ওর মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে হতাশ হয়ে মোবাইলটি হাতে নিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
‘হ্যালো?’
নীহারের মুখে বিস্তৃত হাসি দেখা দিল। সে হড়বড়িয়ে বলল,
‘আদ্রিকা, মা বলছি।’
আদ্রিকার মনে হলো, অথৈ দরিয়ায় সে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন খুঁজে পেল। স্থান কাল ভুলে ছোট বাচ্চার মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে বলল,
‘মা! ও মা! আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, মা। এ কার সাথে তোমরা আমার বিয়ে দিয়েছ! একটা অসভ্য, অসামাজিক লোক। কথাবার্তার কোনো শ্রী নেই৷ সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে থাকে। কিছু বলতে গেলে উল্টো ধমক দেয়৷ সামান্য খাবার খেতে ডাকলাম, আমাকে কতোগুলো কথা শুনিয়ে দিল।’
ওর এক নিঃশ্বাসে বলা কথা শুনে পরখ হতভম্ব হয়ে গেল৷ একজন সাবালিকাকে এমন ছোট বাচ্চার মতো হেঁচকি তুলে কাঁদতে কে দেখেছে কবে? চোখ দুটো গোল গোল করে সে আদ্রিকার মুখের দিকে চেয়ে আছে৷ অথচ আদ্রিকার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই৷ পরখ যে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে মায়ের কাছে ওর নামে হড়বড় করে নালিশ করে যাচ্ছে৷ কে বলে এই মেয়ে মুখচোরা! কথা বলতে জানে না! এখন দেখো মুখে কেমন খৈ ফুটছে!
চলবে…
#অক্ষরময়ী