পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-১৯+২০

0
142

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|১৯|

সিক্ত আম পাতায় এক ফোটা বৃষ্টির জল চিকচিক করছে। পাতার শেষাংশে এসে আটকে আছে জলের ফোঁটাটি। সেখানে সূর্যের আলো তীর্যকভাবে পতিত হয়ে রুপালি উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। আদ্রিকা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাতাটির দিকে। অবশেষে অনেক, অনেকক্ষণ পর অলস ভঙ্গিতে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পরল আদ্রিকার হাতের তালুর উপর। ঠিক সেই মুহূর্তে হাসি ফুটল ওর মুখে। অনেকক্ষণ ধরে হাত পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। খানিকটা বিরক্ত লাগলেও এই যে জলের ফোঁটা হাতে পরার সাথে যে আনন্দ পেলো তার বিপরীতে সেই বিরক্তি সামান্যমাত্র৷

ভূমিতে পতিত অপরিপক্ক, কাঁচা আমগুলো তুলে সে পাশের ঝুড়িতে রাখল। কোমরে দু হাত রেখে আরেকবার ঘাড় উঁচু করে আমগাছের ডালে ঝুলে থাকা সামান্য বড় আমগুলো দেখে ঠোঁট ফুলালো। ওগুলো আরেকটু বড় হয়েছে বলে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। গাছে উঠতে পারলে আমগুলো ছেঁড়া যেতো। কিন্তু এখন কি আর করার! আমের ঝুড়িটি নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল।

চুলায় বসানো ফ্রাইপ্যানে আলু ভাজি সেদ্ধ হয়ে এসেছে। সয়াবিন তেলের বোতল থেকে আরও খানিকটা তেল ঠেলে দিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে দিল। সেদিন পর্তুলিকার জন্মদিনে রাতের খাবারের মেন্যুতে আলু ভাজি ছিল। পর্তুলিকা নিজে হাতে আলু ভাজির ফ্রাইপ্যানে খুন্তি নাড়তে নাড়তে হেসে বলেছিল,

‘চিকন করে কাটা আলু ভাজি পরখের ভীষণ পছন্দ। লালচে রঙের মুচমুচে আলু ভাজি দিয়ে ও এক প্লেট ভাত খেয়ে উঠতে পারে।’

পাশে দাঁড়িয়ে আদ্রিকা অবাক চোখে দেখেছিল সময়ের সাথে আলু ভাজির রঙ বদলাতে। এক কড়াই আলু ভাজি ধীরে ধীরে অর্ধেক কড়াইয়ে পরিণত হতে দেখে সে বলেছিল,

‘আমার আলু ভাজি এমন হয় না কেনো? ভাজতে গেলে পুড়ে যায়। আপনার কাছে একটুও পুড়লো না। কী অদ্ভুত!’

পর্তুলিকা হেসে বলেছিল,

‘রান্না একটি শিল্প। এরজন্য সময় ও চর্চার প্রয়োজন। তবে আমার মতে রান্নার সবচেয়ে জরুরি উপকরণ হচ্ছে ধৈর্য্য। তাড়াহুড়ো করে কখনো রান্না ভালো হয় না। সেই সঙ্গে জানতে হবে কখন, কতোটা তাপে রাঁধতে হয়। কষানো তরকারিতে ঝোলের পানি দিয়ে যেমন ধীরে জ্বাল দিতে হয় না। তখন প্রয়োজন উচ্চ তাপমাত্রা। তেমনি কষানোর সময় উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য হয় না। তখন ধিমে আঁচ রাখা চাই। রান্না সম্পর্কে যত জানবে, যত চর্চা করবে ততোই রান্না সুস্বাদু হবে। একদিনে কেউ পরিপক্ক হয় না। চেষ্টা করতে থাকো। আজকে ভালো হয়নি তো কি হয়েছে? কালকে হবে ইনশাআল্লাহ।’

পর্তুলিকার কথায় আদ্রিকা ভরসা পায়। বাড়ি ফিরে সে আজকে আলু ভাজি রাঁধতে বসেছে। ধিমে আঁচে ধীরে ধীরে ভাজতে ভাজতে একসময় আলু ভাজি লালচে হতে থাকে। ভয় কাটে আদ্রিকার। হাসি মুখে আলু ভাজি চেখে দেখে৷ নাহ, মন্দ হয়নি। ঝাল, নুন সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে৷ আজকে একটা রান্না সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে মানে বাকিগুলোও পারবে।

দুপুরে খেতে বসে পরখের শক্ত চোয়াল হঠাৎ করেই শিথিল হতে দেখে আদ্রিকা মনে মনে হাসে। সে নিজেও কি আজ হঠাৎ করে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেনি? উঠেছে তো। কেমন দক্ষ হাতে পরখের প্লেটে গরম ভাত, আলু ভাজি তুলে দিল! নিজে খাওয়ার পাশাপাশি পরখের তৃপ্তিসহকারে খাওয়া দেখে আদ্রিকার ভীষণ ভালো লাগছে৷ সেই ভালোলাগার সূত্র ধরেই হয়তো পরখের কাছে আবদার করে বসল।

‘বাড়ির সামনে আমগাছটায় অনেক আম ধরেছে। আমাকে কয়েকটা কাঁচা আম পেরে দিবেন?’

এমন সহজ সরল কিন্তু অদ্ভুত আবদারে পরখ থমকে কয়েক পল তাকিয়ে রইল। তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই এতোটাও মজবুত বন্ধন নেই যেখানে এভাবে আবদার করা যায়। তবুও মেয়েটি আদ্রিকা, তার দ্বারা সবকিছু সম্ভব। তাই পরখ বেশিক্ষণ হতবাক হয়ে রইল না।

‘তোমার জন্য এখন আমি কাঠবিড়ালির মতো গাছে গাছে ঘুরে বেড়াবো? বিয়ের কাগজে এটাও লেখা ছিল নাকি?’

‘সবসময় বিয়ের খোঁটা দেন কেনো? এটা অলিখিত শর্ত। খেতে ইচ্ছে করেছে বলেই বললাম। আপনার কাছে আমি আবদার করতেই পারি। আর কার কাছে করবো?’

‘অবশ্যই। আমাকে ছাড়া আর কাকে জ্বালাতন করবে! পেয়েছো তো আমাকেই।’

‘দিবেন কিনা সেটা বলুন। অবশ্য আপনি গাছে উঠতে পারেন বলে আমার মনে হয় না।’

কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরখ নিজের কাজে ফিরে যায়। প্লেটের শেষ ভাতটুকু মুখে দিয়ে ধীরে সুস্থে বেসিনে গিয়ে নিজের প্লেট পরিষ্কার করে হাত ধুয়ে চলে গেল কক্ষের দিকে।

সেদিকে তাকিয়ে আদ্রিকা ভেংচি কেটে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিল।

লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেইট পেরোনের সময় পরখ তাকালো আম গাছের কচি আমগুলোর দিকে। জিভে জল নিয়ে আসার মতো লোভনীয় তাদের গড়ন। দিনের আলোয় সতেজ সবুজ রঙ চকচক করছে।

বাইকটি একপাশে রেখে বাইক থেকে নেমে গাছের দিকে এগিয়ে গেল। ছোটবেলায় সে কতো গাছে উঠেছে! হাইস্কুল পাশ করার পর অনেকদিন গাছে উঠা হয়নি। পুরনো স্মৃতিচারণ করে পরখের মুখে হাসি দেখা দিল।
আমগাছটি খুব বেশি বড় নয়। তবে বেশ ঝাকড়া। গাছের গুড়িতে দু হাত রেখে সে তড়তড়িয়ে গাছে উঠে গেলো। একটি মোটা, শক্ত শাখার উপর দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ডাক দিলো,

‘আদ্রিকায়ায়ায়া….’

নিজের ঘরে ছিল আদ্রিকা। শব্দের উৎপত্তির সূত্রধরে সন্দিহান পায়ে সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াতেই পরখকে দেখতে পেল গাছের উপর। বিস্ময়ে ওর চোখ দুটো ছানাবড়া। তারপরেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পরে একছুটে সিঁড়ি বেয়ে সোজা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো। অবাক বিস্ময়ে দুই ঠোঁটের মধ্যকার দূরত্ব বেড়েছে। মুখের উপর হাত রেখে শুধালো,

‘আপনি গাছে উঠতে পারেন!’

বিপরীতে পরখ সামান্য ঝুঁকে একটি ডাল থেকে দুটো ঝুলন্ত আম ছিড়ে আদ্রিকার দিকে নিশানা করে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,

‘নেও ধরো।’

হকচকিয়ে গিয়ে আদ্রিকা দু হাত পেতে দিল। ভাগ্য ভালো ছিল নাকি পরখের নিশানা ভালো ছিল জানা নেই। তবে আম দুটো এসে পরল আদ্রিকার হাতের তালুর উপর। জোরসে আঘাত হানায় ব্যথায় আর্তনাদ করার পাশাপাশি রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

গাছের ডালে দাঁড়িয়ে পরখ দেখল পশ্চিমাকাশের দিকে সামান্য ঝুলে পরা সূর্যের আলোয় দাঁড়িয়ে এই পড়ন্ত দুপুরে জমিনের উপর এক টুকরো চাঁদ হাসছে। চাঁদের পাশে তারার মতো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে মেয়েটির কাকচক্ষু দুটো। হাসির দমকে তার সারা গা দুলছে৷ তিরতির করে কাঁপছে তার নোলকের নিচের অংশে ঝুলন্ত পানপাতা। কোথা থেকে এক দমকা বাতাস এসে লাগল খোলা চুলে। যেনো স্বচ্ছ আকাশে উড়ে গেলো কালো মেঘ।

হাতের ধরে রাখা আমু দুটোর দিক হতে চোখ সরিয়ে পরখের দিকে তাকিয়ে আদ্রিকা দেখল সে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে হাসা ঠিক হয়নি। ভদ্রলোক এখনি না ধমক দিয়ে বসে। তার সাথে চলতে গেলে ভদ্র সমাজের সকল নিয়মকানুন রক্ষা করে চলতে হয়।
খানিকটা ভড়কে গিয়ে সে নিজেকে সামলে নিয়ে আম দুটো মাটির উপর রাখল। হাত উঁচু করে আঙ্গুল
দিয়ে একটি ডালের দিকে নির্দেশ করে বলল,

‘ওই যে ওখানে। ওগুলো অনেক বড়।’

নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে এক পা, দু পা করে পরখ এগিয়ে গেল সেদিকে। আমগুলো ছিঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিল আদ্রিকার দিকে।
আদ্রিকা কিছু ধরতে পারল, কিছু হাত ফসকে বেড়িয়ে গেল।

ইউটিউবে আমের আচারের রেসিপি অনুসন্ধান করে আদ্রিকার মাথায় হাত। একেকজন একেক রেসিপি দেখাচ্ছে। যার কোনোটাই তার মায়ের সহজ সরল রেসিপির সাথে মিলছে না। তাই সব ছেড়ে সে আঁচল পাতলো মায়ের সামনে।

মেয়ের বায়না শুনে নীহার নিজের জগাখিচুড়ি রেসিপিটি দিয়ে দিল বটে। কিন্তু সেই সাথে উদ্বিগ্ন প্রকাশ করে বলল,

‘কতোগুলো আমের আচার বানাবি?’

‘অনেক, অনেকগুলো। পরখ অনেকগুলো আম পেরে দিয়েছে। গতকাল রাত্রে সামান্য বাতাস হলো না? তাতেই আম ঝড়ে পরেছে। সকালবেলা সেগুলো কুড়িয়ে রেখেছিলাম। সব মিলে চার থেকে পাঁচ কেজি আম তো হবেই। ভাবছি কয়েক প্রকারের আচার বানিয়ে রেখে দিব।’

‘শুধু আম থাকলে তো হবে না। এগুলার আচার বানাইতে কতোগুলা চিনি, মশলা লাগবে সেই হিসাব আছে? তুই এভাবে খরচ করতে থাকলে সংসার ভেসে যাবে। ছেলেটা কয় টাকা বেতন পায় সেটাও তোর মাথায় রাখতে হবে। তোর নিত্যদিনের রেসিপির চক্করে বাজারসদাই করতেই ওর বেতন ফুরিয়ে গেছে মনে হয়। নেহাৎ ভদ্র ঘরের ছেলে বলে কিছু বলছে না। যা চাইছিস এনে দিচ্ছে। কীভাবে, কোথায় টাকা পাচ্ছে সে কথা তুই কখনও জানতে চেয়েছিস? ভেবেছিস কখনো? এখন আবার আচার বানানোর বায়না ধরেছিস। কতো কেজি চিনি, কতটা তেল লাগবে ভেবেছিস? প্রতিদিন গোশত, মাছ, শাক, সবজি এটা ওটা আনতে বলতেছিস। আর সেগুলো দিয়ে অদ্ভুত সব রান্না করিস। কতোগুলা তেল নষ্ট হয়! সয়াবিন তেলের দাম সম্পর্কে তোর ধারনা আছে? পানির দামে তেল বিক্রি হয়? এসব কিনতে টাকা লাগে না? আজেবাজে রান্নার দোকান বন্ধ কর। একটা মানুষের উপর এতো চাপ দিস না। বাড়ি ভাড়া, পড়াশোনা, নিজের খরচ, তোর খরচ, সংসারের খরচ সবমিলিয়ে কম টাকা যায়! তোর এতোসব আবদার পূরণ করতে গিয়ে বেচারা হিমশিম খাচ্ছে।’

আদ্রিকা অবুঝ নয়। কেউ একটু বুঝিয়ে দিলে সে ঠিকই বুঝে। ওর পৃথিবীটা অনেক সরল, সোজা তাই বাঁকাভাবে ভাবতে পারে না। জীবনের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার আগ পর্যন্ত সে সহজভাবে ভাবতে থাকে৷ নিত্যদিন নতুন রান্নাবান্না বিষয়টি তার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর ছিল। কিন্তু এর বিপরীতে পরখের উপর অযাচিত চাপ পরে যাচ্ছে এই ব্যাপার তার মাথায় আসেনি। নীহার মনে করিয়ে দেওয়ায় তার কুয়াশাচ্ছন্ন মস্তিষ্কের দ্বার উন্মোচিত হলো। সেই সাথে যুক্ত হলো নতুন চিন্তা।

‘এতোগুলা আম এখন কি করবো? আচার না করলে নষ্ট হয়ে যাবে।’

‘ছিঁড়ছিস যখন নষ্ট করার দরকার নাই। জামাইয়ের উপরেও চাপ দেওয়ার দরকার নাই। আমার কাছে কিছু টাকা আছে। পাঠায় দিচ্ছি। আচারের জন্য আলাদা করে চিনি, তেল, মশলা কিনে নিস।’

নীহার টাকা পাঠাতে চাইলে আদ্রিকা আরেক বিপাকে পরলো। টাকা নিবে কীভাবে?

নীহার তাকে মোবাইল ব্যাংকিং এর পরামর্শ দিল।
পরদিন সকালবেলা পরখ বেড়িয়ে যাওয়ার পর বাড়ির সামনে থেকে একটি রিক্সা নিয়ে আদ্রিকা চলে গেল মার্কেটে। দোকানী ছেলেটি খুব একটা বয়স্ক নয়। সদ্য যুবক। আদ্রিকাকে অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে নিজেই জিজ্ঞাসা করল,

‘আপনার কি লাগবে?’

‘আমার মা টাকা পাঠাবে। কীভাবে নিবো একটু বলে দিতেন।’

দোকানী ছেলেটি বেশ সময় আদ্রিকাকে পুরো ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিল এবং নীহারের সাথে যোগাযোগ করে টাকা লেনদেন সম্পন্ন করে আদ্রিকাকে জিজ্ঞাসা করল,

‘আপনি এই এলাকায় নতুন?’

ব্যক্তিগত বিষয় জানার আগ্রহে আদ্রিকা ভ্রু কুচকে তাকাল। তা দেখে দোকানী সাফাই গেয়ে বলল,

‘না মানে, নতুন দেখলাম তো। আগে কখনো এদিকে দেখিনি।’

ঝট করে মুখে বিরক্তি দেখা দিল আদ্রিকার। কর্কশ কণ্ঠ জানাল,

‘আমি এলাকায় নতুন হলেও আমার স্বামী নতুন নয়। তাই আমাকে নতুন ভেবে মোটেও ঠকানোর চেষ্টা করবেন না।’

এমন অপবাদে দোকানী ছেলেটি ভড়কে গেল। বিব্রত দেখাল তাকে।

‘আপনি অকারন রেগে যাচ্ছেন। আমি এমনিতে জিজ্ঞাসা করছিলাম।’

‘আমিও এমনিতেই উত্তর দিলাম৷ আচ্ছা, ওসব বাদ দিয়ে আমার একটা হেল্প করুন। এখানে চিনি, তেল, মশলা কোথায় পাওয়া যায়?’

‘সামনে গিয়ে বামদিকে মুদির দোকান।’

ভ্রু কুচকে আবারও ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আদ্রিকা গটগট করে সেদিকে চলে গেল।

_________

রাস্তার পাশে কাচঘেরা ছোট একটি পেস্ট্রি শপ। কাচ ঘেরা বাক্সে শোভা পাচ্ছে লাল, কালো, সাদা বিভিন্ন রঙের পেস্ট্রি। ক্যাশ কাউন্টারের ভেতরে একটি চেয়ারে বসে আছে পরখ। মুখ তার খানিকটা থমথমে। পেস্ট্রিশপের মালিক শাহরিয়ার রুমি অনতিদূরে দুজন যুবক যুবতির টেবিলে পেস্ট্রি পরিবেশন করছে। তার মুখটি হাস্যোজ্জ্বল। পানির বোতল টেবিলে দেখে কপোত-কপোতীর উদ্দেশ্যে সে বলল,

‘ইনজয় ইউর ফুড।’

ফিরে এসে পরখের মুখোমুখি বসে রুমি তখনও হাসছে। খানিক নড়েচড়ে বসে পরখ নিজেকে সামলে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে বলল,

‘কেমন চলছে?’

চোখ সরু করে তাকিয়ে রুমি বলল,

‘কি কেমন চলছে? ব্যবসা নাকি আমার জীবন?’

ওর মুখের হাসি দেখে পরখের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওকে দেখেই রুমি এভাবে বিদ্রুপের হাসি হাসছে। অথচ বাল্যবন্ধু হওয়ার সুবাদে পরখ খুব ভালোভাবে জানে, রুমি সদা হাস্যোজ্জ্বল। পরখের মুখে আমাবস্যার ঘোর অন্ধকার দেখে রুমির হাসি বিস্তৃত হলো। হাত বাড়িয়ে পরখের কাধের উপর চাটি মেরে বলল,

‘এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেনো মামা? চিল কর। জীবন একটাই। সবসময় এতো সিরিয়াস থাকলে চলবে?’

‘তোর হাসিটা বিরক্ত লাগছে। প্লিজ, হাসা বন্ধ কর।’

‘আমার মুখটাই হাসি হাসি।’

‘বিশ্রী দেখাচ্ছে।’

‘দৃষ্টির উপর ডিপেন্ড করে। তোর চোখের সমস্যা আরও বেড়েছে মামা। চশমা ব্যবহার কর।’

সে কথা এড়িয়ে গিয়ে পরখ ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলে মেয়ে দুটোকে দেখে আবারও জানতে চাইল,

‘এই দু একজন কাস্টমার দিয়ে শপ চলে?’

‘উহু। লসের ভেলায় ভাসছি। কিন্তু কিছু করার নাই। সবই আমার কপাল’

‘অন্য কিছু করছিস না কেনো?’

‘তুই তো জানিস, রান্নাবান্না করতে আমি কতো পছন্দ করি। রেস্টুরেন্ট দিব বলে বাড়িতে কতো ঝামেলা করে টাকা পয়সা নিলাম। শেফ হবার জন্য একটা কোর্স পর্যন্ত করেছি। কিন্তু আমার আসলে মার্কেটিং স্কিল ভালো না। ব্যবসায়িক জ্ঞান কম থাকায় বিজনেসটা চলছে না। শুধু টাকা থাকলে হয় না মামা, বুদ্ধিও থাকা লাগে।’

‘কীসের কোর্স করছিস?’

‘শেফ হবার। আমেরিকান একটা কোম্পানি কোর্সের সুবিধা দিচ্ছে। পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করে কোর্স করছি মামা। ভাবতে পারিস?’

‘কিছু লাভ হয়েছে?’

‘কী বলিস! আলবাত হয়েছে। চাইনিস, জাপানিজ, থাই, আমেরিকান সব ধরনের রান্না শিখে গেছি। ওরা অবশ্য বিদেশের নামকরা রেস্টুরেন্টে শেফ হিসেবে নিয়োগে রেকমেন্ড করতে চাইছিল। কিন্তু আমরা বাঙালি নিজের শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যাইতে চাই না। আমার রক্তেও বাঙালিয়ানা। দেশেই থাকবো, নিজের শহরে ব্যবসা করবো। এখন খাচ্ছি বাঁশ।’

ছেলে মেয়ে দুটোর খাওয়া শেষ। বিল দিতে আসায় ওদের আলোচনায় ভাটা পরলো। পরখ তাকিয়ে দেখলো, চর্তুদিকে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বললেও এখানের পরিবেশে কেমন অন্ধকার, মনমরা ভাব। অকারন বিষাদে ছেয়ে যায় মনের ভেতরটা। হাত ঘড়িটি বিপবিপ শব্দ করে জানান দিল, দুপুর বারোটা বেজেছে। পরখ উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে৷ রুমিকে বলল,

‘আজকে উঠি। আরেকদিন দেখা হবে।’

মুখের হাসিটি ধরে রেখে রুমি চেয়ার ত্যাগ করলো। পরখের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গভীর চোখে চেয়ে বলল,

‘টাকা না নিয়ে চলে যাচ্ছিস যে! তোর লাজুক স্বভাবটা এখনো যায়নি তাহলে। তুই পারিস বটে! কালকে হোয়াটসঅ্যাপে নক দিয়ে টাকার ধার চাইতে পারলি আর এখন সামনাসামনি এতোক্ষণ আলাপ করলাম একবারও টাকার কথা বললি না। টাকা না নিয়ে আবার চলে যাচ্ছিস। এই মুখচোরা স্বভাব নিয়ে জীবন চলবে? যা চাওয়ার মুখ ফুটে স্পষ্ট করে চাইবি। তুই তো আমার কাছ থেকে দান নিচ্ছিস না। ধার নিচ্ছিস। কয়েকদিন পর ফেরত দিয়ে দিবি। তাহলে এতো সংকোচ কীসের? প্রয়োজনে আমরা সবাই একে অপরের কাছে সাহায্য চাই। এখানে লজ্জার কি আছে? আমাকে তুই কতোবার টাকা ধার দিয়েছিস! এই শপটা যখন খুললাম তখন কতোগুলো টাকা ধার দিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেছিস। আর নিজের বেলা এখন সংকোচবোধ করে আমাকে ছোট করতেছিস!’

‘সে কবেকার কথা! পুরনো কথা এখন তুলছিস কেনো?’

‘তুলছি কারন তুই নিজেকে ছোট করে দেখছিস৷ আমি তোর থেকে লাখ টাকা ধার নিলে তুই কেনো আমার কাছে মাত্র দশ হাজার টাকা ধার নেওয়াও হীনমন্যতায় ভুগবি। আমরা বন্ধু পরখ। নিজেদের মধ্যে কীসের লজ্জা!’

রুমি আগেই টাকা গুনে ভজ করে আলাদা করে রেখেছিল। বন্ধুকে সামনে দাঁড় করিয়ে টাকা গুনে তার হাতে তুলে দিয়ে তাকে আরও অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না। এমনিতে টাকা ধার চেয়ে মেসেজ করতে পরখকে কতোটা কুণ্ঠা, কতোটা লজ্জার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সেটা সে আন্দাজ করতে পারছে৷
অন্তর্মুখী পরখ কখনোই অন্যের কাছে কিছু চেয়ে নিতে পারে না। আজ টাকা চাইতে তাকে কতো দ্বিধার শেকল ভাঙ্গতে হয়েছে তা বন্ধু হিসেবে রুমি ঠিকই অনুমান করতে পারছে৷

ড্রয়ার থেকে টাকা বের করে পরখের হাতে দিল। পরখ সাথে সাথে তা পকেটে রেখে লজ্জিত দৃষ্টি নিচু করে মলিন কণ্ঠে বলল,

‘সামনের মাসের শুরুতেই ফেরত দি…’

‘মামা, এসব বালের ফর্মালিটি আমার সাথে করবি না। যখন সুবিধা হবে দিবি।’

‘তোর ব্যবসাটাও তো মন্দা চলছে। টাকা পয়সার দরকার আছে না? আমি তাড়াতাড়ি ফেরত দিব। বিদেশ যাওয়ার পেছনে আমার সব টাকা খরচ হয়ে গেছে। প্লেনের টিকিট এর টাকাটা রিফান্ড পাওয়ার কথা ছিল, ওদেরও কিসের যেন ঝামেলা চলছে। বিপদ একা আসে না, সঙ্গে করে নাতিপুতিসহ চোদ্দগুষ্টিকে নিয়ে আসে।’

‘ব্যবসা মন্দা চললেও টাকার কষ্টে আমি নাই। বাপের রিটায়ার্ডের পুরো টাকাই আমার একাউন্টে দিয়ে দিছে। তাও যেনো আমি ঠিকঠাক ব্যবসাটা করি৷ কিন্তু আমাকে দিয়ে হচ্ছে না মামা। ভাবছি বড় করে নতুন কিছু শুরু করব৷ কিন্তু একা একা সাহস হচ্ছে না।’

‘তোর মধ্যে ইচ্ছাশক্তি আছে। তুই পারবি। যাস্ট একবার সাহস করে শুরু করে দেখ।’

‘একটা কথা বলি মামা, রাগ করিস না। তুই যেহেতু দেশে কিছুদিন আছিস, আমার সাথে এড হয়ে যা। তোর বিজনেস আইডিয়া ভালো। হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট নিয়ে লেখাপড়াও করছিস। এই ফিল্ডে তোর ভালো জ্ঞান আছে। আমার টাকা, তোর বুদ্ধি – দুই মিলে আমরা রাজ করবো এই শহরে। কি বলিস?’

‘প্রস্তাব মন্দ নয়। কিন্তু আমার হাতে সময় কই? ভার্সিটিতে ক্লাস নেই, এরপর আবার নিজের পড়াশোনা করি। রাতে দিকে লেকচার তৈরি করি। বিজনেসে কখন সময় দিবো?’

‘সেটাও ঠিক।’

‘তুই বরং অন্য পার্টনার খুঁজে দেক। আমাদের ব্যাচের অনেকেই তো এখানে বিজনেস করতে চাচ্ছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করে দেখ। এমনিতেই কোনো হেল্প লাগলে আমি তো আছি।’

রুমির চিন্তিত মুখশ্রী দেখে মায়া হলেও পরখের আসলে কিছু করার নেই। ওর ভার্সিটির পরবর্তী সেমিস্টারে যোগ দিতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত জানায়নি। ওখানে না হলে আবারও নতুন করে ভার্সিটির জন্য এপ্লাই করতে হবে৷ এমন অবস্থায় লেখাপড়া থেকে একেবারে সরে দাঁড়ানো সম্ভব না। ওকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷ অন্যদিকে বেচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন। যার যোগান দিচ্ছে শিক্ষকতার পেশা। এ পেশায় শিক্ষার্থীকে শেখানোর থেকে নিজেকে শিখতে হচ্ছে বেশি৷ সব মিলিয়ে শ্বাস ফেলার ফুসরত পাচ্ছে না।

________

পকেটে সামান্য অর্থ, সামনে দৈত্যের মতো বিশাল হা করে আছে বিভিন্ন ব্যয়ের খাত। নিত্যদিন বাজারের উর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্ত জীবনে আয়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখা কঠিন। বাড়িভাড়া, মাসিক বাজার, নিত্যপণ্য, পড়াশোনার খরচ, বাইকের পরিচর্যা এবং পকেটখরচ মিলিয়ে পুরো মাসের হিসাব মেলাতে গলদঘর্ম অবস্থা। তার উপর যুক্ত হলো দেনা।
মাত্র দশ হাজার টাকায় এই মাসের বাকি দিনগুলো কীভাবে চলবে তাই ভেবে পরখের মাথায় হাত।

নিত্যদিনের বাজারসদাইয়ে স্রোতের মতো টাকা ভেসে যাচ্ছে। না জানি এই কয়েকদিনে আদ্রিকা আবার কি আনতে বলে! ওদিকে বাইকের পেট্রোল শেষ হয়েছে। ত্রিরিশ তারিখে বাড়ির মালিককে ভাড়ার টাকা পাঠাতে হবে৷ পরখের বেতন আসবে পাঁচ তারিখে৷ সেই সামান্য টাকা থেকে রুমির দশ হাজার টাকা ফেরত দিলে আর যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে তা দিয়ে নতুন মাস চলা যাবে না। তখন আবার ঋণের জন্য হাত পাততে হবে? তবে কি পরখ কখনো এই ধারদেনার চক্র থেকে বের হতে পারবে না? এতোটাই খারাপ দিন এসে গেলো তার জীবনে!

ক্রমশ পরখের মাথা ভারী হয়ে এলো। কপালে দুপাশের শিরাগুলো দপদপ করে মাথা ব্যথার আগমনের বার্তা জানান দিচ্ছে। ঠিক তখনি গুটি গুটি পায়ে আদ্রিকাকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা গেলো।

বাড়ি ফিরে আদ্রিকাকে দেখতে না পেয়ে পরখ ভীষণ অবাক হয়েছিল। বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত সে কখনো একা বাড়ির বাইরে যায়নি। তাই হয়তো পরখ অবাক হয়েছিল। পরোক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে নিজস্ব চিন্তায় ডুবে যায়। কিন্তু খোলা রাখে কক্ষের দ্বার। অবশ্য পরখের মতে, একলা বাড়ির নিরাপত্তার খাতিরে সে দরজা খোলা রেখে বাড়ি পাহারা দিচ্ছিল।
কিন্তু এই মুহূর্তে আদ্রিকার হাতে পলিথিনের ব্যাগে বাজারসদাই দেখে পরখের কপালে সুদীর্ঘ ভাঁজ পরল। চেয়ার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে আদ্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে কর্কশ কন্ঠে জানতে চাইল,

‘তোমার হাতে এগুলো কি?’

মুদির দোকানে চিনি ও তেল পাওয়া গেলেও গরম মশলা পাওয়া গেল না৷ সেগুলো খুঁজতে আরও দেরী গিয়ে আদ্রিকার। কিন্তু এখনও পরখের ফেরার সময় হয়নি বলে সে নিশ্চিন্ত ছিল। পরখ আজ বেলা একটা না বাজতেই চলে আসবে সে কথা আদ্রিকা কী করে জানবে? স্লাইডিং ডোরের লক খোলা দেখে সে অবাক হয়েছিল। এরপর গুটি গুটি পায়ে নিঃশব্দে প্রবেশ করেও বিপদ এড়ানো গেল না। পরখের ধমকে হাতের পলিথিন দুটো টেবিলের উপর রেখে সে মাথা নিচু করে জবাব দিল,

‘চিনি।’

পরখ নিজে হাতে পলিথিনের ব্যাগ থেকে বাজারসদাই বের করে দেখল। তিনটি মাঝারি সাইজের সরিষার তেলের বোতল, একটি ভিনেগার, এক কেজির দুটো চিনির প্যাকেট, ছোট একটি গুড়ের দলা এবং মশলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরল টেবিলের উপর। যাদের দর্শন মাত্র পরখ যেন আরও শীতল হয়ে গেল। আদ্রিকার দিকে ফিরে প্রশ্ন করল,

‘কে কিনে দিয়েছে?’

ঝড়ের পূর্বাভাসে আদ্রিকা তটস্থ। কাচুমাচু হয়ে জবাব দিল,

‘আমি।’

‘টাকা কোথায় পেয়েছো?’

‘আম্মু দিয়েছে।’

‘কেনো? আমি তোমাকে বাজার-সদাই এনে দেই না?যখন যা চাইছ এনে দিচ্ছি না? না করেছি কখনও? আমি তোমার ভরণপোষণ করতে সক্ষম নই, সেটা জানাতে তুমি তোমার মায়ের থেকে টাকা নিয়ে এসব কিনে এনেছো?’

আদ্রিকা মুখ তুলে অবাক চোখে পরখের দিকে চাইল। সে সত্যি রেগে গিয়েছে! চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে। আদ্রিকা দু দিকে মাথা দুলিয়ে বলল,

‘এমন নয়। আমের আচার তৈরি করতে অনেক তেল মশলা লাগবে… ’

‘সেটা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। তাই তুমি তোমার মায়ের থেকে টাকা নিয়ে এসে আচার বানাবে। তাই তো?’

‘না মানে এ মাসে অনেক খরচ হয়ে গেছে। আপনার কাছে টাকা আছে কিনা।’

পরখ হুট করে এগিয়ে এসে আদ্রিকা মুখোমুখি হয়ে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কটমট করে তাকিয়ে বলল,

‘আমি তোমাকে বলেছি আমার কাছে টাকা নেই? তোমার মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসে খরচ করো বলেছি?’

ঠিক কি ভুল হয়েছে আদ্রিকা নিশ্চিত নয়৷ তবে কিছু একটা ভুল তার দ্বারা সংগঠিত হয়েছে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। কিন্তু পরখের এমন আক্রমণে সে ভীষণ ভড়কে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। নিস্তব্ধতা নাকি সম্মতির লক্ষণ। তাই আদ্রিকার এমন নিস্তব্ধতা পরখকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে নিজের অপারগতা দেখিয়ে দেয়। যেন আদ্রিকার পেছনে দাঁড়িয়ে বাবা হাসছে, ‘কেমন? বিয়ের একটা মাসও নিজের স্ত্রীর দায়িত্ব বহনের সামর্থ্য হলো না তোমার?’

পরখ গর্জে উঠল হঠাৎ।

‘স্পিক আপ। আমি বলেছি তোমাকে? যা চাইছ এনে দিচ্ছি, যেভাবে চাইছ করে দিচ্ছি তবুও তোমার সাহস হয় কি করে আমাকে এভাবে অপমান করার? আমাকে ছোট করার অধিকার তোমাকে কে দিলো?’

আকস্মিক চিৎকারে কেঁপে উঠে আদ্রিকা তার ওড়নার কোনা মুঠো ভরে ধরে হেঁচকি তুলে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। তা পরখের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে জানতে চাইল,

‘কতো টাকা নিয়েছো?’

আদ্রিকা ক্রন্দনরত কণ্ঠে হেঁচকিসমেত জবাব দিল,

‘এক হাজার।’

‘এক্ষুণি এই মুহূর্তে তুমি উনার টাকা ফেরত দিয়ে আসবে। যাও বের হও।’

‘আমি এখন কীভাবে ফেরত দিবো?’

পরখ পকেট থেকে একটি এক হাজার টাকার নোট বের করে আদ্রিকার হাতে গুজে দিয়ে বলল,

‘যেভাবে নিয়েছো সেভাবেই ফেরত দিয়ে আসবে। যাও।’

বাহু ধরে টেনে বসার ঘর থেকে দরজার দিকে আনতে থাকলে আদ্রিকার করুণভাবে অনুরোধ করল,

‘মায়ের ফোনে একাউন্ট খোলা নেই। পাড়ার দোকান থেকে পাঠিয়েছে।’

‘তাহলে বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসবে।’

‘আমার বাবা এসব কিছু জানে না পরখ। জানতে পারলে খুব ঝামেলা করবে।’

‘সেসব আমি জানি না। কীভাবে দিবে তোমার ব্যাপার। যাও টাকা দিয়ে তারপর আমার বাড়িতে পা রাখবে।’

ছাদে দাঁড়িয়ে আদ্রিকা বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে রইল। এক মুহূর্তে কী থেকে কি হয়ে গেল সে বুঝে উঠতে পারছে না। পরখ যে খুব রেগে গেছে তা স্পষ্ট। কিন্তু এতো রেগে যাওয়ার মতো কাজ সে করেনি। আদ্রিকা নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে কান্না থামায়। কিন্তু আবারও নতুন জল ভিজিয়ে দেয় গাল। হেঁচকির তালে দুলে উঠে গা৷ দু হাতে ঘষে ঘষে সে জল মুছে নিতে সে ব্যস্ত হয়ে পরে।

পরখ বসে আছে বসার ঘরের সোফায়। রাগ, ক্ষোভ, হতাশা, উত্তেজনায় মাথার চুল টানছে৷ একের পর এক ব্যর্থতায় সে ক্লান্ত। আশেপাশের সবাই যেনো তাকে পরিহাস করছে৷ না লেখাপড়া হলো, না ক্যারিয়ার হলো। না ভালো ছেলে হয়েছে, না হয়েছে ভালো স্বামী। ওর বাবা ঠিকই বলে, পরখ আসলে এখনও কোনো দায়িত্ব পালন করার যোগ্য হতে পারেনি। বিয়ের একমাস না গড়াতেই প্রমাণ হয়ে গেল, পরখ নিজের স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ। যা রটানোর দায়িত্ব স্বয়ং তার স্ত্রী নিজের কাঁধে নিয়েছে৷ আদ্রিকার মায়ের সামনে আর কোন মুখে সে দাঁড়াবে? মেয়েটি তার পৌরষে দাগ লেপ্টে দিল। ভাবতেই পরখের পাগলপ্রায় অবস্থা।

নিজেকে সামলে স্লাইডিং ডোর খুলে ভেতরে এলো আদ্রিকা। টাকাটি টেবিলের উপর রেখে টেবিলের জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতে বলল,

‘এখনি টাকা পাঠাতে পারব না। আমার মায়ের সংসারে ঝামেলা হয়ে যাবে। সময় সুযোগ বুঝে পরে পাঠিয়ে দিবো।’

পরখ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র ঘৃণা নিয়ে বলল,

‘এই কয়েকদিনে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে তুমি একটা স্বার্থপর, সুবিধাবাদী মেয়ে। যার কোনো আত্মসম্মান নেই। থার্ডক্লাস, ক্যারেক্টারলেস মানুষের থেকে এরকম ব্যবহার পাবো সেটা আমার আগে থেকে জানা উচিত ছিল।’

তীব্র অপমানে আদ্রিকার গা জ্বলে উঠলেও সে নিজেকে যতোটা সম্ভব শান্ত রেখে পরখের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘সামান্য একটা বিষয়ে আপনি অযথা রিয়েক্ট করছেন।’

‘সামান্য বিষয়! কোনটা সামান্য আর কোনটা অসামান্য সেই জ্ঞান তোমার থাকলে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় কথা বলার সাহস করতে না। নিজের কৃতকর্মের কথা ভুলে গিয়ে এই বাড়িতে সহজ সাবলীল ভাবে বাস করতে পারতে না। তোমার কাছে তো সবকিছু সহজ, সামান্য।’

‘কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি? টাকা নেওয়া আপনার পছন্দ হয়নি। ঠিক আছে, আ’ম স্যরি। বললাম তো ফিরিয়ে দিব।’

‘সব কথা ওখান থেকেই শুরু হয়, ওখানেই শেষ হয়৷ তোমার মধ্যে মিনিমাম লজ্জাবোধ থাকলে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে না। আত্মসম্মান এর কথা না হয় বাদই দিলাম।’

‘এতই যদি আমাকে নিয়ে আপনার সমস্যা থেকে থাকে তাহলে আগেই বলে দিতেন, থাকতাম না আপনার সাথে। সেদিনই চলে যেতাম। কেনো নিয়ে এলেন? বিয়ের পর থেকে আপনি আমাকে কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। আপনি আগে থেকে সব জানতেন, জেনেশুনে বিয়ে করেছেন। তখনি না করেন দিতেন। আচ্ছা, বাবা মায়ের জন্য না করেননি। ঠিক আছে মানলাম৷ কিন্তু এ বাড়িতে সেঁধে নিয়ে এলেন কেনো?’

‘সেটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে। নিয়ে আসা একদমই উচিত হয়নি। প্রথমদিনেই যদি তোমাকে আমার জীবন থেকে বের করে দিতে পারতাম তবে আমার এই দূর্দশা হতো না।’

আদ্রিকা জানে না কেনো, পরখের এই সহজ স্বীকারোক্তি, এই আফসোস ওকে ভীষণ কষ্ট দিল। যেদিন বিস্ময়ের ধোঁকার কথা শুনেছিল সেদিনও এর থেকে কম কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু কেনো যেনো আজ আদ্রিকার দম আটকে এলো৷ কাঁদলো না, আহাজারি করলো না। শুধু এক আকাশসম অভিমান নিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,

‘সেদিনের আফসোস করে বিশেষ লাভ নেই। আজকে দিন। তাহলে ঝামেলা শেষ হয়ে যায়।’

‘একটু আগেই বের করে দিয়েছি, সেটা ভুলে গেছ তুমি? কিন্তু ওই যে তুমি চরম বেহায়া, নির্লজ্জ মেয়ে। স্বার্থপরতায় অন্ধ। নিজে স্বার্থ হাসিলের জন্য সব উপেক্ষা করে আবার ফিরে আসতে পারো। এখানেই ঘাপটি মেরে পরে থাকবে আমি জানি। তোমার গায়ে আসলেই কোনো কথা লাগে না, তাই না? মান, অপমান কিছু অনুভব হয় না?’

আদ্রিকার চোখ চেয়ে এক ফোটা অবাধ্য জল গড়িয়ে পরায় সে দ্রুত সে জল মুছে ফেলে বলল,

‘আপনি কথা বলার আগে ভাবেন না, আপনার কথা মানুষকে ঠিক কতোটা কষ্ট দেয়৷ এর পরিনাম ঠিক কি রকম হতে পারে? বার বার বেরিয়ে যেতেন বলেন, সত্যি যদি কোনোদিন চলে যাই তখন ব্যাপারটা কেমন হবে একবার ভাববেন।’

পরখ দু হাত জোর করে কপালে ঠেকিয়ে বলল,

‘প্লিজ যাও। বের হবে যাও আমার বাড়ি থেকে, আমার জীবন থেকে। আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। তোমাকে দেখলে আমার নিজেকেও নোংরা মনে হয়।
কিন্তু আমি জানি তুমি যাবে না। তুমি এখানেই থাকবে। তুমি কি ভেবেছো, কীসের লোভে, কীসের আশায় এখানে আছো আমি জানি না? যার অপেক্ষায় এখানে দিন কাটাচ্ছো সে যে কখনো ফিরে আসবে না সেটা আমি তোমাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি৷ আমার শান্তি নষ্ট না করে প্লিজ নিজের রাস্তা মাপো। নিজেও সুখে থাকো, আমাকেও থাকতে দেও৷ যাস্ট বের হও আমার বাড়ি থেকে। চলে যাও।’

নিজের কথা শেষ করে হনহন করে কক্ষে ঢুকে বাইকের চাবী নিয়ে পরখ বেরিয়ে গেল। লাইব্রেরিতে যাওয়ার সময় হয়েছে। ওখানে ভালো একটা কফি পাওয়া যায়। সেটা খেয়ে মাথা ব্যথা কমিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে হবে। এসব উটকো ঝামেলার কারনে সে নিজের লক্ষ্য বিচ্যুত হতে পারে না।

পরখ চলে গেলেও তার ছুড়ে দেওয়া বাক্যবাণ আদ্রিকাকে ঘিরে রাখল। ছিঃ ছিঃ কী নোংরা অপবাদ ছুড়ে দিয়ে গেলো লোকটা! সে নাকি ওই ধোকাবাজের অপেক্ষায় এখানে পরে আছে৷ এর থেকে ভালো আদ্রিকা কুয়ায় ঝাপ দিয়ে আ/ত্মহুতি দিবে। সে কি এতোটাই ফেলনা হয়ে গেছে! সারাক্ষণ দুরছাই আর কতো সহ্য করা যায়? এতো অনাগ্রহের মাঝে সে মাথা নিচু করে, কান বন্ধ করে ছিল। কিন্তু আজকের লাঞ্ছনা, অপমান, অপবাদ আদ্রিকা মেনে নিতে পারছে না। কেউ তার শুধরানোর চেষ্টা দেখছে না! কেউ তার অনুতাপ, অনুশোচনা দেখছে না। তবে কার জন্য, কীসের জন্য এসকল প্রচেষ্টা? সে চোখের জল মুছে নিচের ঠোঁট ঝুলিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর সেও গটগট করে বেরিয়ে গেল ইট পাথরের এই অভিশপ্ত বাড়িটি থেকে।

চলবে….
#অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|২০|

‘চুপকথা’ বরাবর শান্ত, নিস্তব্ধ যার পরিবেশ। শুধু কখনোসখনো রাত বিরাতে মোকাররমের উচ্চ কণ্ঠ ভেসে আসতে শোনা যেতো৷ দুই মেয়ে বিদায়ের পর যা এখন আর শোনা যায় না৷ বদরাগী, রগচটা মানুষটি এখন নাজুক লতার মতো নেতিয়ে থাকে। চালের আড়ত হতে মনোযোগ সরিয়ে আপাতত সম্পূর্ণ দৃষ্টি নার্সারিতে৷
এতে অবশ্য নিহারের কাজ দ্বিগুণ বেড়েছে৷ ঘর সংসারের কাজের পাশাপাশি আজকাল নার্সারির কাজেও তাকে ছুটতে হচ্ছে৷ মোকাররম যতক্ষণ বাড়ির পেছনের বাগানের কাজ করে, নীহারকেও তার সঙ্গে থাকতে হয়৷

আজও খুব সকালে কাজে নেমে পরেছে মোকাররম। কোথা থেকে যেনো গোবর সার এনে রেখেছিলো গতকাল। আজকে যেগুলো মাটির সঙ্গে মেশানো হচ্ছে৷ স্বামীর সাথে হাত মিলিয়েছে নীহার৷ সন্তানহারা দুজন মানুষ একে অপরের নির্ভরতার জায়গায় পরিণত হয়েছে।

মাটির সঙ্গে গোবর মেশানো শেষে মোকাররম বলল,

‘কোদালটা নিয়ে এসো।’

সকালের নাস্তা তৈরির চিন্তা নীহারের মস্তিষ্কে। এসব কাজে তার না আসলেই চলতো। কিন্তু মানুষটার আজকাল কি হয়েছে কে জানে! একদন্ড একলা থাকতে চায় না৷ হয়তো একাকীত্বে ভয় পাচ্ছে৷ অদ্ভুত এক মায়ায় আটকে পরে নীহারও তাকে একা ছাড়ছে না৷
হাতের ধুলো-ময়লা ঝেড়ে নীহার উঠে দাড়ালো। ঘরের বারান্দায় কোদালটি রাখা৷ সেটি নিতে ঘরের দিকে আসা মাত্রই গুঞ্জনটি কানে এলো।

দেয়ালের ওপাশে কারো আহাজারি শোনা যাচ্ছে৷ একজনের নয়; সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। উৎসাহী নীহার গলা উঁচু করে ওপাশে উঁকি দিলো৷ দেয়ালের অনতিদূরে মোকাররমের বড় ভাই মোজাম্মেল মস্ত বড় অট্টালিকা। তারই নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটি সাদা মাইক্রোবাস। যাকে ঘিরে আছে উৎসুক জনতা। স্পষ্ট দেখা গেলেও কিছু শোনা যাচ্ছে না। নীহার ভ্রু কুচকালো। আগ্রহবোধ হচ্ছে কিন্তু গৃহে মোকাররমের উপস্থিতি নীহারকে সে স্বাধীনতা দিলো না। মোকাররম যদি কোনোভাবে জানতে পারে, অন্যত্র কলহে নীহার আগ্রহ দেখিয়েছে তবে বিনাকারণে নীহারকে উত্তমমধ্যম প্রদান করা হবে৷ অন্তরে সে আশংকা উঁকি দেওয়া মাত্র উত্তেজনার রেশ টেনে ধরে নীহার ছুটলো নিজে কাজে৷

কোদাল হাতে নিয়ে মাটিতে কো প দিলো মোকাররম। মাটি কু পি য়ে আজকেই গোবর সার ছিটিয়ে দিবে৷ পাশে দাঁড়িয়ে নীহার উশখুশ করছে। তা দেখে মোকাররম বিরক্ত হয়ে বলল,

‘কি হইছে? কারে দেখো?’

কোনো এক গোপন বার্তা প্রদানের উৎসাহে নীহারের কণ্ঠ খানিকটা নিচু এবং রোমাঞ্চকর হলো।

‘ভাইজানের বাড়ির সামনে একটা মাইক্রো দেখলাম।’

মোজাম্মেল এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি৷ তার বাড়িতে মাইক্রোবাসের উপস্থিতি কোনো বিশেষ ঘটনা নয়৷ কিন্তু নীহারের বলার ধরণে ঘটনাটি রহস্যময় শোনালো। বিশেষ আগ্রহ দেখালো না মোকাররম।

‘বড়লোক মানুষের বাড়িতে মাইক্রো আসা কোনো নতুন ব্যাপার না। তার বাড়িতে সরকারি অফিসার, রাজনীতির লোকজনের আসা যাওয়া চলতেই থাকে।’

‘অনেক মানুষজন দেখলাম বাড়ির সামনে। নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা হইছে৷’

‘ঝামেলা হইছে কেমনে বুঝলা? কাজের লোকজনও তো হইতে পারে।’

‘বেশিরভাগই গ্রামের মহিলা।’

‘তাহলে কোনো অকাজের ঘটনাই হবে৷ তা না হলে মহিলা মানুষ জমা হইতো না।’

নীহার আর কিছু বললো না৷ মুখ কুচকে দাঁড়িয়ে রইল। মোকাররম না থাকলে সে একছুটে গিয়ে ঠিকই ঘটনা জেনে আসত।

হাতের কাজ শেষ করে ওরা দুজন ঘরের দিকে ফিরছিলো। কিন্তু খুব কাছে কোলাহলের শব্দে মোকাররমকে আগ্রহ দেখাতে হলো। এবারে শব্দটি উৎস ওদের বাড়ির সদর দরজার সামনে। মোকাররম দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো কমপক্ষে বিশজনা ব্যক্তি তারই বাড়ির সামমে দাঁড়িয়ে আছে উৎসাহ ভরে৷ ভীড়ে মাঝে দাঁড়িয়ে আহাজারি করছে মনোয়ারা।

ক্রন্দনরত কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দগুলো খুবই অস্পষ্ট। মোকাররম কিছু বুঝতে না পেরে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মোজাম্মেল এবং তার বড় ছেলে মৃদুলের দিকে তাকাল৷ তারা দুজনও বিরস মুখে এদিকেই তাকিয়ে আছে৷ ততোক্ষণে নীহার বাইরে বেরিয়ে এসেছে। মোকাররমের কাছে জানতে চাইল,

‘আবার কি হলো?’

‘কি জানি! কিছু বুঝতেছি না।’

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলার কাছে নীহার জানতে চাইল,

‘কি হয়েছে ভাবি?’

মহিলাটি বোধহয় খানিক নারাজ হলো। আমাবস্যার ঘন আঁধারের সাথে প্যাঁচার মুখভঙ্গি যুক্ত করে জানাল,

‘নিজেদের বাড়ির খবর নিজেরাই রাখো না তোমরা। কেমন ভাই এরা! তোমাদের থেকে আমরা গরীব মানুষগুলাই ভালো আছি। একজনের বিপদে আরেকজনে ঝাপিয়ে পরি। অথচ তোমাদের দেখো, কাল সারাটা রাত তোমার ভাসুরের বাড়ির উপর দিয়ে ঝড় গেলো, অথচ তোমরা মানুষগুলা একবার দেখতেও বের হইলা না৷ সাহায্য করা তো দূরের কথা, মানুষ একবার খোঁজটা তো নেয়।’

নীহার খানিক বিচলিত হয়ে মোকাররমের দিকে তাকালো। মহিলাটির কথার ধাঁচ মোটেও সুবিধার নয়৷ এবার মোকাররম ক্ষেপে না গেলেই হয়৷ ওদিকে নীহারকে দেখে মনোয়ারা আরও উত্তেজিত হয়ে পরল।

‘আল্লাহর গজব পরবে তোদের উপর নীহার৷ এই আমি মা হয়ে অভিশাপ দিচ্ছি৷ তোরও দুইটা মেয়ে আছে। তাদের কপালে পরবে। আমার সংসারের যেই ক্ষতি তুই করছিস, তার ফল তুই পাবি। ধ্বংস হয়ে যাবি।’

নীহার কিছু বলার আগে মোকাররম গর্জে উঠল।

‘এসব কি বলতেছো ভাবি? মাথা ঠিক আছে তোমার? এই মৃদুল, তোর মায়েরে নিয়া যা এখান থেকে। সকালবেলা উঠে রাস্তাঘাটে কী সব শুরু করছে!’

মৃদুল, মোজাম্মেল কেউ একচুল পরিমাণ নড়াচড়া না করে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরিস্থিতি গুরুতর ; বুঝতে অসুবিধা হলো না মোকাররমের। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো ভাইয়ের দিকে।

পাশের বাড়ির একজন গৃহবধূ নীহারের পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘আপনি কিছু জানেন না ভাবি?’

মনোয়ারা শাপশাপান্তে নীহার স্তম্ভিত। গৃহবধূর প্রশ্নে চমকে উঠল। বলল,

‘হ্যাঁ? কি জানব? কি হয়েছে কিছুই বুঝতেছি না।’

সদ্য বিবাহিত গৃহবধূ। নিয়ম নীতির চাদরে মোড়ানো ভদ্রতা এখনো সামলে উঠতে পারেনি৷ ঘটনার গম্ভীর্যতা না বুঝেই ফিক করে হেসে আঁচলে মুখ ঢেকে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘গতকাল মাহিন ভাই বিয়ে করছে যে।’

নীহার অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে চোখ দুটো বড় বড় করে জানতে চাইল,

‘মাহিন বিয়ে করছে! কাকে?’

‘পাশের গ্রামের মেয়ে। ওই মাইক্রোতে বর কনে দুজনেই আছে। আপনার ভাবী ঘরে ঢুকতে দিতেছে না।’

‘কেন? ভাবি তো নিজেই ছেলের বিয়ের জন্য উঠে পরে লাগছে। আমার আদ্রিকার বিয়ের পর উনি সেই সপ্তাহেই ছেলের বিয়ে দিবেন বলে জেদ ধরে বসলেন। এখন বউ ঘরে তুলে না কেন?’

‘ঘরের তোলার মত বউ নাকি! শুনলাম তো মেয়ে ভালো না। প্রেম আছিলো। কয়েকবার প্রেমিকের সাথে ভাগছে। প্রতিবার বাপ মা গিয়ে নিয়ে আসছে।’

নব পুত্রবধূকে বশ্যতা স্বীকারের প্রচেষ্টায় ব্যস্ত শাশুড়ি দ্রুত এগিয়ে এসে ধমকে উঠলেন,

‘চুপ থাকো তুমি। সারাক্ষণ ফটর ফটর করে। মাহিনের মা শুনলে ঝাটা পিটা করবে। মুখ জানো ওই মহিলার? কাঁচির থেকে বেশি ধার। একবার কথা কানে গেলে ছিড়ে খাবে। অন্যের ঝামেলায় পরার দরকার নাই। চলো, বাড়ি চলো।’

উৎসুক জনতাকে পেছনে ফেলে নীহার এগিয়ে গেলো মাইক্রোবাসটির দিকে।

অট্টালিকার সামনে মোজাম্মেল দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নাই। অসাড় শরীরটি একটু বিশ্রাম চাইছে। কিন্তু উনার অর্ধাঙ্গিনীর রুদ্ররূপ কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না৷ এরই মাঝে আগুনে ঘি ঢালতে মোকাররম এসে প্রশ্ন করল,

‘কি হইছে ভাইজান?’

মোজাম্মেল মুখ ফিরিয়ে নিলেও চাচার প্রশ্নের উত্তরে নীরবতা পালন করে তাকে অপমান করতে পারল না মৃদুল। বিরস মুখে বলল,

‘আর বলবেন না চাচা। মাহিনকে নিয়ে গেছিলাম মেয়ে দেখতে৷ কিন্তু ওরা এতো বদ তা জানতাম না৷ মিষ্টি কথা বলে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাইলো। একগাদা খাবার খাওয়ানোর পর মেয়ে দেখাইলো৷ মেয়ে দেখতে শুনতে ভালোই৷ এখন আমরা বাইরে একটু খোঁজ খবর নিবো না?’

‘অবশ্যই নিবা।’

‘আমার এক বন্ধু গেছিলো আমাদের সাথে। ও বললো আমরা বাড়ি গিয়ে কথা বলে আপনাদের জানাবো। মেয়ের বাবা বললো, আলোচনা পরেও করা যাবে। মেয়ে পছন্দ হইলে পাকা কথা আজকেই হয়ে যাক।’

‘তোমরা না করলা না? ছেলের বাবা মা কেউ নাই সাথে। পাকা কথা কে বলবে?’

‘ওরা কি গুরুজন মানে! পুরাই অসভ্য মানুষজন। মানতে অস্বীকার করায় আমাদের দিলো আটকে৷ মেয়ে দেখার পর, বিয়ে না করে কিছুতেই যাইতে দিবে না৷ শুনে তো আমাদের মাথায় হাত। কৌশলে আমার বন্ধুটাকে একটু বাইরে পাঠায় দিছিলাম। ও ফিরে এসে কয়, পাড়ার লোকজন কেউ মেয়েটারে ভালো বলতেছে না। এই মেয়ের নাকি বয়ফ্রেন্ড ছিল। কয়েকবার তার সাথে পালিয়ে গেছে। এক দুদিন পর বাড়ির লোকজন খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসছে৷ তা হলে বুঝেন অবস্থা।’

মোকাররম অস্বস্তিবোধ করে মাইক্রোবাসের দিকে মুখ ফিরে তাকালো। সেখানে লাল টুকটুকে বউ সাজে একজন অষ্টাদশীকে দেখা যাচ্ছে৷ দুধে আলতা গায়ের রঙ, পানপাতার মুখশ্রীতে স্নিগ্ধ হাসি। নিশ্চিন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে বাইরের পরিস্থিতি। পাশেই কয়লাকান্ত বর মশাই৷ আষাঢ়িয়া মেঘ তার সারা অঙ্গে। কটমট দৃষ্টি মেলে সোজা সামনের দিকে চেয়ে আছে। বিরক্তি গলে গলে পরছে তার শরীর ও মনে।

অনুচিত হলেও সত্যি, এই মুহূর্তে মোকাররমের খানিকটা পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে৷ তা মনের ভেতর চেপে রেখে মোকাররম বলল,

‘বাড়িতে খবর দিলা না কেন?’

কণ্ঠে বিষাক্র উষ্মা ঢেলে উত্তর দিল মোজাম্মেল।

‘খবর দিয়ে লাভ আছে! এই মহিলারে হাজারবার বারণ করছি, এতো তাড়াহুড়ো করিও না। খোঁজ খবর নিয়ে মেয়ে দেখো৷ কিন্তু নাহ, সে এখনি ছেলের বিয়ে দিবে। যেখানে সেখানে ছেলেকে পাঠায় দিতেছে মেয়ে দেখতে। শেষমেশ কিনা ডা/কাতের ঘরে পাঠাইছে৷ আরে এই মেয়ের বংশ নামকরা ডা/কাত। খবর শুনে সেই রাতের বেলা আমি ওসির বাড়ি ছুটছি৷ ওসি সাহেবরে নিয়া ওখানে গিয়ে শুনি, এটা সেই রঘু ডা/কাতের বাড়ি৷ হারামজাদা পুলিশও কয়, আপোষ করে ফেলেন৷ এদের সাথে ঝামেলা করে টিকতে পারবেন না। কী আর করার! বিয়ে দিয়ে নিয়ে আসলাম। আমি তো আর আমার ছেলেকে ভাসায় দিয়ে আসতে পারি না।’

মোকাররম আরেকবার তাকালো নববধূবেশী অষ্টাদশীর দিকে। তার সাহসীকতা, চঞ্চলতার রহস্য জানা গেল তবে৷ এ এলাকার নামকরা ডা/কাত ছিল রঘু ডা/কাত। খানিকটা আদর্শবানও বটে৷ কখনো গরীবের গৃহে হানা দিত না। তার অ/স্ত্র ঝংকার দিয়ে উঠল গৃহস্থ বাড়ির সদর দরজায়। শোনা যায়, পাকিস্তানি আমলে হানাদার বাহিনীকেও বেশ তটস্থ করে রেখেছিল। এমন বংশের মেয়ে মাহিনকে বিয়ে করল কেনো?

‘এই মেয়ে প্রেমিক রেখে মাহিনকে বিয়ে করলো?’

মৃদুল খানিকটা এগিয়ে এসে চাচার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘হাই স্কুলের থাকতে আবেগের বশে প্রেম-ট্রেম করছিলো মনে হয়। গ্রামবাসী খালি কথা ছড়ায়। তাছাড়া শুনছি, ছেলেটা ওদের এলাকার রাজমিস্ত্রী। ওমন ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিবে রঘু ডা/কাতের ছেলে?’

‘তা অবশ্য ঠিক। মেয়ে সুন্দর আছে।’

‘ওর বাবা বলছে, মেয়েকে কে/টে মনতরীতে ভাসায় দিবে তাও ওখানে বিয়ে দিবে না৷ হুমকিধামকি শুনে ছেলে ভয়ে গুটিয়ে গেছে৷ গত বছর বিয়েও নাকি করে ফেলছে৷ এখন মেয়ের আর কি করার! বাপ মা যেখানে দিচ্ছে, সেখানেই বিয়ে করে নিলো।’

‘ভালোই মুশকিল হলো দেখছি৷ তোমার মা কি বলে?’

‘জেদ ধরে আছে, ঘরে তুলবে না।’

পাশ থেকে বিরক্ত হয়ে মোজাম্মেল আওয়াজ দিলো,

‘এই তোমার চিৎকার চেচামেচি শেষ হইলে এদের ঘরে ঢুকতে দেও।’

মনোয়ারা এগিয়ে এসে বলল,

‘আমি জিন্দা থাকতে এই মেয়ে আমার বাড়িতে পা রাখবে না। আমার লা/শের উপর দিয়ে ওরে নিয়ে যাও’

মোকাররম বললো,

‘বিয়ে তো হয়ে গেছে। এখন এসব ঝামেলা করে কি লাভ ভাবি?’

‘এই তুমি একদম লাভ ক্ষতির কথা বলবা না৷ তোমাদের জন্য আমার ছেলেটার এতো বড় সর্বনাশ হইলো। ইচ্ছে করে তোমরা তোমাদের মেয়েকে পার করায় দিছো। কি ভাবছো আমি বুঝি না? বড়লোক ছেলে দেখে তোমাদের মাথা ঘুরে গেছে। নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে আমার ছেলেটার জীবন ধ্বংস করে দিছো তোমরা। এই আমি মনোয়ারা বলে দিচ্ছি, ভালো করে শুনে নাও৷ তোমার মেয়ের ওই সংসার টিকবে না। যেই লোভে তোমরা আমার ছেলেটার এত বড় ক্ষতি করছো, সেই লোভ তোমার মেয়ের জীবন ধ্বংস করে দিবে। একটাও সংসারী হতে পারবে না।’

নিজ সন্তানের উদ্দেশ্যে এমন অভিশাপ নীহারের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিলো। মোকাররমের পাশে দাঁড়িয়ে সে কম্পিত কণ্ঠে অনুরোধ করল,

‘এসব কি বলতেছেন ভাবি! মানছি আপনার মেজাজ ভালো নাই তাই বলে আমার মেয়েদের এভাবে অভিশাপ দিবেন! আল্লাহর দরবারে কখন কোন কথা কবুল হয়ে যায় বলা যায় না৷ এভাবে বলবেন না।’

‘নাটক করতে আসবা না নীহার৷ তুমি সব জানতা৷ ইচ্ছা করেই আমাদের মান সম্মান নষ্ট করছো। তুমি আগে থেকে আদ্রতা আর মাহিনের বিয়ের বিপক্ষে ছিলা। পড়াশোনার নাম করে সময় বাড়ায় নিছো, যাতে মেয়েকে বাড়ি ছাড়া করতে পারো৷ ঠিকই সুযোগ বুঝে বিয়ের দিন আদ্রতাকে ভাগায় দিলা। একবার আমি মাফ করে দিছি, কিন্তু দ্বিতীয়বার তুমি আমার ছেলের মনটা ভাঙ্গছো। আমাদের মান সম্মান নিয়া ছিনিমিনি খেলছো। ছেলের টাকাপয়সা দেখে তুমি আর মোকাররম তো পাগল হয়ে গেছিলা না? এইবার দুজনে মিলে মেয়েকে পালাইতে সাহায্য করলা। ছি! তোমাদের এতো লোভ!’

রেগে গিয়ে মোকাররম সামনে এগিয়ে আসতে নিলে নীহার বাধা দিলো। কিন্তু মোকাররম থামলো না। ওখানে দাঁড়িয়েই গর্জে উঠল।

‘না জেনে উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না৷ ছেলের বিয়ে দিতে আপনিই ব্যস্ত হইছিলেন৷ বিয়েশাদির ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করলে এমনি হয়। এখন ঠকে গিয়ে আমার মেয়েদের নামে বাজে কথা বলতেছেন কোন আক্কেলে? আমার মেয়েদের কপালে যা ছিল তাই হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ ওরা ভালো আছে। ভালোই থাকবে। ’

‘ব্যস্ত হবো না? তোমার মেয়ে দুটাই এই পৃথিবীতে একমাত্র মেয়ে না। জগতে আরও মেয়ে আছে। একটা ভালো মেয়ে দেখে আমার ছেলেটার বিয়ে দিতাম। কিন্তু তোমাদের তো নজর খারাপ। সারাক্ষণ বড় ভাইয়ের ধন সম্পদের দিকে শকুনের নজর দিয়ে রাখো। আমার সংসারটা তোমাদের কুনজরে শেষ হয়ে গেল। আমার ছেলেটার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গেলো৷ এতোকিছুর পর ভাবিও না তোমার মেয়ে দুইটা সুখে থাকবে। স্বামীর ঘর করতে পারবে না৷ দেখবা দুদিন পরেই ঘর সংসার ছেড়ে বাপের বাড়িতে এসে উঠবে। আমিও দেখবো তখন, কোথায় যায় তোমাদের এই অহংকার।’

মোকাররম কিছু বলার আগে নীহার বাধা দিলো।

‘বাদ দেও এসব। কথা বললে কথা বাড়বে। তুমি চলো এখান থেকে।’

‘আমার মেয়েদের নামে বাজে কথা বলে কোন সাহসে?’

‘বললে বলুক। উনি বললেই তো আর সেসব হচ্ছে না। আল্লাহ আছেন। ভরসা রাখো।’

হাত ধরে টানতে টানতে এগিয়ে মোকাররমকে নিয়ে যাচ্ছে নীহার। সেদিকে তাকিয়ে মোজাম্মেল বিরক্ত হয়ে আদেশ দিল,

‘বড় বউমা, তুমিই ছোট বউমাকে বরণ করে ঘরে তুলো। এই গর্দভ মহিলা বাড়িতে ঢুকতে না চাইলে বাইরেই থাকতে বলো ওকে।’

______

ঘাড়ে গামছাটি নামিয়ে মুখমণ্ডল মুছে নিয়ে রিক্সাচালক আরেকবার শুধালেন,

‘আপা নামবেন না?’

ধ্যান ভাঙ্গল আদ্রিকার। চোখ হতে গড়িয়ে পরা অশ্রুকণা মুছে নিয়ে তাকাল রুদ্ররূপী বাবার দিকে। অশ্রুসিক্ত মা এক হাতে চোখের জল মুছছেন, আরেকহাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বাবাকে। সে দৃশ্য দেখে সে কীভাবে এখানে নিজের কদম রাখবে? তবে যে চাচীর অভিশাপ এখনি, এই মুহূর্ত সত্য বলে প্রমাণিত হবে৷

মাথা ঘোমটা আরেকটু লম্বা করে নিয়ে আদ্র কণ্ঠে বলল,

‘এখানে নামব না। বাজারের দিকে চলেন।’

‘কইলেন নার্সারি যাবেন। এখন কইতাছেন নামবেন না৷ আমি বাজারের ওইদিক যামু না৷ এইখানে নামেন।’

‘এখানে নামা যাবে না।’

‘দেখেন, আমি এহনো খাওয়েন সোময় পাই নাই৷ আপনারে নামায় দিয়া বাড়িদ দিকে যামু৷ বাজার উল্টাদিক। ওইদিক যামু না।’

‘তাহলে আরেকটু সামনে নিয়ে গিয়ে নামায় দেন।’

‘ভাড়া কিন্তু বেশি লাগবো৷’

‘আচ্ছা দিব।’

মাইক্রোবাসটির অপরপাশের জানালার কাচ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে নববধূ। রিক্সার ছাউনির ছিদ্র দ্বারা বধূর মুখদর্শন করে আদ্রিকার দৃষ্টি আবার ঘোলাটে হলো৷ এই চঞ্চল, হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটির কপালে কি আছে কে জানে!

উচ্ছ্বাসে টইটম্বুর নববধূ আসে ভরা আঙ্গিনায়। ধীরে ধীরে তার সমস্ত উচ্ছলতা হারিয়ে যায় ঘরকন্নায়।

ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে রিক্সাটি চলে যেতেই মৃদুলের স্ত্রী এসে মাইক্রোবাসের দরজা খুলে নববধূকে গাড়ি হতে নিচে নামালো।

ঘড়িতে সময় ক’টা বাজে আদ্রিকার জানা নেই। পার্স তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় বরাবরের মতো মোবাইলটির কথা সে ভুলে গেছে। একটু আগেই বৃদ্ধ, ক্ষুধার্ত রিক্সাওয়ালা তাকে পিচঢালা রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। শেষ দুপুরের ক্লান্ত রাস্তায় আদ্রিকা হাটছে একলা। এই এলাকাটির তার অপরিচিত। বাড়ি পেরিয়ে এদিকে কখনো আসা হয়নি৷ আজ প্রথমবার আসায় কেমন গা ছমছমে অনুভূতি হচ্ছে৷ শ্রমজীবী মানুষেরা পথের ধারে সস্তা হোটেলে ভাত খাচ্ছে৷ কেউবা রিক্সায় গা এলিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে৷

ফাঁকা রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন তরুণীকে এলোমেলো হাটতে দেখে পথিকের আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তারা সরু চোখে আদ্রিকাকেই দেখছে। দৃষ্টিগুলো তীরের মতো বিঁধছে আদ্রিকার পায়ে৷ কোথায় যাবে সে জানে না। শুধু জানে জনমানবপূর্ণ এই বাজারহাট পেরিয়ে যেতে হবে। সে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে। আধা মাইল পেরিয়ে আসার পর বাজারহাট শেষ হয়েছে। দু একটা রিক্সা আলস্যতায় ভর করে আদ্রিকার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল৷ ও তখনো ফুটপাত ধরে হাটছে।

হঠাৎ তীব্র বেগে একটি মোটরসাইকেল একদম আদ্রিকার কাছে ঘেঁষে চলে যাওয়ায় সে বেশ হকচকিয়ে গেল৷ আর একটুখানি হলেই বাহুতে ধাক্কা লেগে যেত। সে অবাক চোখে মোটরসাইকেলের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে থমকে গেলো৷
সেই কালো বাইক, কালো হেলমেট৷ চলন্ত মোটরসাইকেল আরোহী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকেই দেখছে৷

হৃদপিণ্ড অতিমাত্রায় কম্পিত হতে লাগল। আর এগোনোর সাহস পেল না সে। এই অপরিচিত জায়গায় কোথায় যাবে সে৷ না আছে বাবার বাড়ি, না আছে স্বামীর বাড়ি৷ মেয়ে জন্মের আবার নিজের বাড়ি বলে কোনো শব্দ নেই৷

এবার আশেপাশে তাকিয়ে আর কোনো রিক্সা দেখা গেলো না। এমন মাঝরাস্তায় নিজেকে সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত মনে হচ্ছে। আদ্রিকা দ্রুত পা চালালো। কোথাও একটা যেতে হবে। আড়ালা আবডালে লুকাতে হবে। কিন্তু হাটতে গেলেই মনে হচ্ছে পেছনে থেকে কেউ তার উপর নজর রাখছে৷

কিছুদূর এগিয়ে তার নজরে এলো একটি সাইনবোর্ড। কালো বোর্ডে সাদা রংয়ে লেখা ‘অভয়ারণ্য’।

এই পার্কে সে কখনো আসেনি৷ তবে বান্ধবীদের মুখে নাম শুনেছে। পার্কের দরজায় একজন পৌঢ় দাঁড়িয়ে আছে। পরনে দারোয়ানের পোশাক। আদ্রিকা ভেবেছিল পৌঢ় তার পথ আটকে দাঁড়াবে৷ তাই ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। কিন্তু দেখা গেলো, পৌঢ় তার দিকে শুধু সন্ধিহান চোখে চেয়ে আছে। মুখে কিছু বলছে না।

পার্কের ভেতরে গাছপালা ছাড়া তেমন কিছু নেই৷ চলার পথের দুপাশে বসার জন্য কাঠের বেঞ্চ। তাতে বসে গল্প করছে কপোত কপোতি৷ এমন প্রেমময় দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে স্বভাবতই আদ্রিকার মনে পরলো বিস্ময়ের কথা৷ তারা কখনো এভাবে পার্কে আসেনি৷ খুব কাছাকাছি বসে কাধে মাথা রাখেনি৷ ওরা বসেছে রুফটপ রেস্টুরেন্টে, ভার্সিটির উন্মুক্ত মাঠে। একবার, হ্যাঁ শুধু একবার একান্তে সাক্ষাৎ হয়েছিল যার খেসারত আদ্রিকাকে প্রতিনিয়ত দিতে হচ্ছে। ঘুরেফিরে স্মৃতিরা জমা হচ্ছে পরখ নামক অসভ্য, নির্দয় ব্যক্তিটির পাতায়।

আদ্রিকা হাটছে আর চোখের জল ফেলছে। অতীতের ওই একটি পাতা যদি মুছে ফেলা যেতো! জীবনের সব পুণ্যের বিনিময়ে তা মুছে ফেলে দিতো। পার্কের শেষপ্রান্তের একটি বেঞ্চে বসে নীরবে চোখের জল ফেলছিল সে। বাবা, মা, আদ্রতা, পরখ, পিউ মা সবার কথা মনে পরছে। ওরা কি একবারও আদ্রিকার কথা মনে করছে না?
উহু। করছে না হয়তো। সবারই নিজস্ব জীবন আছে, ব্যস্ততা আছে৷ অলস, অকর্মা শুধু আদ্রিকা। খায় দায় ঘুমায় আর অহেতুক চিন্তাভাবনা করে৷
এই যে কতোক্ষণ ধরে সে আকাশ কুসুম ভাবছে।

পাখির কলতানের মাঝে হুট করে বেযে উঠলো বাশির আওয়াজ। আদ্রিকা চমকে উঠে দেখল অনতিদূরে দাঁড়িয়ে আছে সেই পৌঢ় দারোয়ান। আদ্রিকাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বলল,

‘এখন বের হতে হবে। সময় শেষ। মাগরিবের আযান দিয়ে দিয়েছে।’

আদ্রিকা বাধ্য মেয়ে। চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে পৌঢ়ের পিছুপিছু চলতে শুরু করল।

চলবে…
#অক্ষরময়ী